#সৎ_মা (১৭)
#সামসুজ্জামান_সিফাত
অবশেষে মামার বাড়ি চলে এলাম। ওইদিনের মামীর কাছে আসতেই মামী আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,”কেমন আছো বাবা ?”
– জ্বি মামী ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন ?
– ভালো আছি বাবা।
– আচ্ছা মামী, আমার মামারা কি বাড়ি এসেছিলো ?
– না বাবা।
– আচ্ছা আমার বোন, মামা-মামী বা তানিয়া কারো ছবি আছে কি আপনার কাছে ?
– না বাবা আমার কাছে নেই।
– অন্য কারো কাছে আছে কি ?
– না। কারণ, ওরা কাউকে ই ছবি তুলতে দেয়নি।
– ওহ্ আচ্ছা। আচ্ছা ঠিক আছে মামী ভালো থাকবেন। আজকে যাই তাহলে।
– যাই মানে কি ? ওইদিন ও এসেছো কিছু খেয়ে যাওনি। আজকে না খেয়ে যেতে পারবে না।
– না মামী, এখন খাওয়া সম্ভব না। আমি খেয়ে এসেছি।
– তুমি খেয়ে এসেছো ঠিক আছে। তোমার সাথে যারা আছে ওরা অন্তত খেয়ে যাক।
পাশ থেকে ওরা বলে উঠলো,”না আন্টি আমরা সবাই ই খেয়ে এসেছি এখন খাওয়া সম্ভব না।”
মামী বললেন,”আচ্ছা তবে আরেকদিন না খেয়ে যেতে পারবে না।”
– আচ্ছা।
সবাই গাড়িতে চলে এলাম। গাড়ি চালিয়ে বাবার দোকানের সামনে চলে এলাম। তারপর আকিব কে উদ্দেশ্য করে বললাম,”আকিব তোকে তো বাবা চিনে তাই তুই বাবার সাথে কথা বলবি। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করবি।
– ঠিক আছে।
– আর শোন, আমাকে বাবা চিনবে না। তোকে যদি জিজ্ঞেস করে যে আমরা কারা, তাহলে বলবি বন্ধু। আমি যে সিফাত এটা বলবি না।
– কিন্তু কেন ?
– এমনি। যা বলছি তা কর। আর বাবাকে জিজ্ঞেস করবি যে, আমার আর শিফাদের খবর জানে কি না।
– ঠিক আছে।
– গাড়ি থেকে নেমে চল তাহলে বাবার সামনে যাওয়া যাক।
সবাই মিলে গাড়ি থেকে বাবার সামনে এলাম। আকিব কে দেখে বাবা জিজ্ঞেস করল,”কেমন আছো আকিব ?”
– এই ত চাচা ভালো। আপনি কেমন আছেন ?
– উপর দিয়ে ত ভালো ই আছি কিন্তু ভেতর দিয়ে ই ভালো নেই।
– আপনার কথা বুঝলাম না চাচা।
– বুঝবে ও না তুমি। তা তোমার সাথে এরা কারা ?
আকিব নাদিয়াকে দেখিয়ে বলল,”এ হচ্ছে নাদিয়া, আমার স্ত্রী।”
এবার আকিব আমাদের দেখিয়ে বলল,”আর এরা হলো আমার বন্ধু।”
তারপর আকিব নাদিয়া কে উদ্দেশ্য বলল,”আর নাদিয়া ওনি হচ্ছেন সিফাতের বাবা।”
আকিবের মুখে আমার নাম শুনা মাত্রই দেখলাম বাবার মুখ কেমন যেন হয়ে গেছে। চোখের কোণে হালকা পানি দেখতে পেলাম। আকিব বাবাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,”আচ্ছা চাচা, সিফাতের কি কোনো খোঁজ-খবর জানেন কি ?”
– নারে বাবা। ওর মামা নাকি একবার তাকে ঢাকা দেখেছিল। আমরা ঢাকা ও অনেক খুঁজেছিলাম কিন্তু এত বড় শহরে আমার নির্দোষ ছেলেটাকে খুঁজে পাইনি। জানিনা কেমন আছে আমার ছেলেটা। সেদিন আমার উচিত ছিল ছেলের কথা বিশ্বাস করা। কিন্তু কীভাবে বিশ্বাস করবো বলো, আমার বৌ মানে সিফাতের সৎ মা প্রতিনিয়ত সিফাতের নামে বানিয়ে বানিয়ে বিচার দিত। এদিন বলত, সিফাত নাকি তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল, ওদিন বলত, সিফাত তার গায়ে হাত তুলত, এমন আরো অনেক কথা বলতো। কিন্তু আমার ছেলের প্রতি আমার খুব বিশ্বাস ছিল যার কারণে, ছেলেকে একটা বার জিজ্ঞেস ও করিনি। এর পর একদিন সিফাতের সৎ ভাই শিপন এসে বলতে লাগলো যে,”বাবা বাবা ভাইয়া না মাকে মারছে।” ত আমি সেদিন বাড়ি গিয়ে দেখি সত্যি ই তার মায়ের গায়ে মারের চিহ্ন। সেদিন থেকে ই সিফাতের উপর আমার বিশ্বাস উবে গেছে।”
বাবা থেমে গেল। বাবার গাল বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। আমার ও এমন অবস্থা হয়েছে, আমি আর চোখের পানি আটকে রাখতে পারবো না। তাই পেছন ঘুরে দাঁড়ালাম। আমি ভাবছি মানুষ কতটা খারাপ হলে, একজন বাবার কাছে তার ছেলেকে খারাপ বানানোর চেষ্টা করে ? এই জন্যই হয়তো বাবা আমার কথা গুলো বিশ্বাস করেনি।
বাবা আবার ও বলতে শুরু করলো,”আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, তার মাকে বিশ্বাস করা। কি করবো বলো, হঠাৎ করে ই সিফাত কে আদর করতে শুরু করেছিল ত তাই আর সিফাতের কথা গুলো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত যখন, তার মায়ের খরিদ্দার এসে আমাকে বলল যে,”ভাই আপনি কি ছেলে জন্ম দিয়েছেন ?” আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে,”কি হয়েছে ?” সে বলল,”এমন ছেলে জন্ম দিয়েছেন যে ছেলে কি না, তার বাবার বৌয়ের জন্য টাকার বিনিময়ে খরিদ্দার এনে দেয়।” এই কথা শুনে সেদিন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তখন আমার মাথা খারাপ হয়ে যায় একদম। সেই লোক সেদিন আমাকে অনেক লোকের সামনে সিফাতের জন্য অনেক অপমান করেছিল। যার কারণে, আমি সেদিন তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিই। কিন্তু যেদিন সত্যি জানতে পারলাম, সেদিন যেন আমি জিন্দা লাশ হয়ে গেছি। নিজেকে কোনো ভাবে ই বুঝ দিতে পারছি না যে, সিফাত কে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। তাকে যদি একটা বারের জন্য সামনে পেতাম তাহলে তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতাম। জানিনা তার সাথে দেখা হবে কি না। হয়তো তার আগে ই মরে যেতে পারি।
বাবার মুখে মরে যাওয়ার কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলাম না। ‘বাবা’ বলে চিৎকার দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,”কে তুমি বাবা ? আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরলে কেন ?”
আমি কিছু বলতে পারছি না। পাশ থেকে আকিব বলল,”চাচা এই আপনার ছেলে সিফাত।”
আকিবের কথা শেষ হতে দেরি হলো কিন্তু বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরতে দেরি হলো না। এমন ভাবে ধরেছে যেন আর ছাড়বে না। অনেক দিন পর বাবার বুকে জায়গা পেয়ে খুব শান্তি লাগলো। মনে হচ্ছে, এতদিন যদি এই বুকে থাকতে পেতাম তাহলে ধন্য হতাম। তবে এতদিন কোনো কষ্টে থাকিনি। তাও নিজের বাবা আর অন্যদের মধ্যে অনেক ফারাক আছে। ফারাক থাকলেও বলতে হবে সাদ্দাম ভাইয়ের পরিবারের মত পরিবার হয় না। তাদের ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না।
অনেকক্ষণ যাবৎ বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। এবার ছেড়ে দিয়ে বলতে লাগলো,”বাবা আমি তোর সাথে অনেক বড় অপরাধ করেছি, তুই আমকে ক্ষমা করে দে।”
– আরে বাবা, ছেলের কাছে বাবা কি কখনো ক্ষমা চায় নাকি ?”
– হয়তো চায় না, কিন্তু আমি তোর সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছি যার জন্য ক্ষমা চাইতে ই হবে। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে।
– আরে কিসের ক্ষমা হ্যাঁ ? তুমি অপরাধ করলে তা ক্ষমা করতাম তাই না ? কিন্তু তুমি তো কোনো অপরাধ করোনি।তুমি সামান্য একটা ভুল করেছো। ভুল ত মানুষ ই করে। ভুল করলে ও ছেলের কাছে বাবাকে কখনো ক্ষমা চাইতে নেই।
বাবা কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ করে আবার ও জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিয়ে বলতে লাগলো,”তোর মত ছেলে পেয়ে আমি ধন্য বাবা। কি করে যে সেদিন আমি তোকে অবিশ্বাস করে বাড়ি থেকে বের করে দিলাম ?”
– দেখ বাবা, যা হবার হয়েছে। এখন এসব কথা বাদ দাও। আচ্ছা বাবা শিফা, মামা-মামী আর তানিয়া কোথায় ?
– ওরা তো তোর খুঁজে ই ঢাকা গেছে।
– তাদের কোনো ছবি আছে কি ?
– না রে বাবা। আমার ঘরের কালনাগিণীর জন্য তোদের কিছু ই আমার বাবিতে রাখতে পারিনা।
– সমস্যা নেই। আচ্ছা বাবা, ওরা কোথায় থাকে তা জানো কি ?
– নারে বাবা তা ও জানিনা।
– ঠিক আছে। আচ্ছা বাবা ভালো থেকো, আমি তাদের নিয়ে তারপর বাড়ি আসবো।
– কোথায় যাবি এখন ?
– ঢাকা।
– না গেলে হয় না ? কতদিন পর তোর দেখা মিলল, আর এখন ই চলে যাবি ?
– হ্যাঁ বাবা।
– তোর ঠিকানা টা দিয়ে যা অন্তত।
– এখন না বাবা। আমার জন্য দোয়া করো বাবা।
বলেই বাবাকে সালাম করে সবাইকে নিয়ে গাড়িতে চলে এলাম। বাবা হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমি তার সুযোগ না দেওয়ায় বলতে পারেনি। দেখলাম বাবার চোখে পানি। বাবাকে এই অবস্থায় রেখে যেতে আমার ও কলিজা ফেটে যাচ্ছে প্রায়। আমার দ্বারা গাড়ি চালানো সম্ভব না তাই আরিফকে বললাম গাড়ি চালাতে।
চলবে।