হৃদয় জুড়ে তার ছায়া পর্ব-১৪+১৫

0
198

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১৪
#আদওয়া_ইবশার

অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে নাহিদের মুখে কথা গুলো শুনে সেই যে দুপুর থেকে পাপড়ির বুকের ভিতর তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে এখন পযর্ন্ত থামার নামগন্ধ নেই। কথা গুলো স্বরণ হতেই বারবার মানষপটে ভেসে উঠছে নাহিদের দুষ্টুমি ভরা হাস্যোজ্জ্বল মুখটা। জীবনে প্রথমবার একটা পুরুষ তার এতোটা কাছাকাছি এসেছে। কানের কাছে মনে হচ্ছে এখনো সেই গরম নিঃশ্বাস টুকু লেপ্টে আছে। হৃদয় জুড়ে চলছে অবাধ্য অনুভূতিদের মিছিল। এতোটা নিখাঁদ অনুভূতির প্রখরতা এর আগে কখনো অনুভব হয় নি তার। কেমন যেন মন- মস্তিষ্ক দুটোই নিজের সাথে বেইমানি করে ঝুঁকে আছে নাহিদের দিকে। ভিতর বাহির সম্পূর্ণটাই বিদ্রোহ ঘোষণা করছে পাপড়ির নিরবতায়। নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে আশকারা দিচ্ছে অবাধ্য অনুভূতিদের। ঠেলে দিচ্ছে বারবার নাহিদের দিকেই। কিন্তু এমনটা তো হবার কথা ছিল না! তার বিশ বছরের জীবনে সে তো তার জন্য পাগলপ্রায় কম প্রেমিক পুরুষ দেখেনি। স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ ভার্সিটি সব জায়গায় কত কত সুদর্শন যুবকের প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে। কিন্তু কখনো তো এমন স্বচ্ছ অনুভূতির সাথে পরিচয় হয়নি তার। তাহলে কেন নাহিদের বেলায় এমন হচ্ছে? কেন বারবার ঐ মানুষটার কথা মনে হতেই হৃদয় কাঁপছে? যে মানুষটার কথা শুনে এতোদিন গা জ্বলা অনুভূতি হতো। আজ সেই মানুষটার কথায় হৃদয় জুড়ে কেমন শীতলতা ছুঁয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে প্রগাঢ় অনুভূতির তোলপাড়। নিজের এমন পরিবর্তনে ক্ষণে ক্ষণে মনের মাঝে হাজারটা প্রশ্ন উকি দিলেও উত্তর জানা নেই একটারও। নিগূঢ় অন্ধকারের মাঝে এক টুকরো আলো জ্বলে হঠাৎ করেই বিপ বিপ করে কেঁপে ওঠে একটু দূরে মেঝেতে অযত্নে ফেলে রাখা ফোনটা। সাথে কেঁপে ওঠে আপন ভাবনায় মগ্ন থাকা পাপড়ি। নিরবতার জাল ছিঁড়ে হঠাৎ ফোনের অল্প শব্দেও ধরাস করে লাফিয়ে ওঠে বুকের ভিতরটা। একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সামান্য স্থির করে হাতে তুলে নেয় ফোনটা। চোখের তারাই ভেসে ওঠে নাহিদের নাম্বার থেকে আসা একটা ম্যাসেজ,

” সকাল হতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। কিন্তু এখনো আমার জবাব পেলাম না। পোস্টার ছাপানোর কাজ শুরু করে দিব না কি?”

ম্যাসেজটা পড়ে ভ্রু কুঁচকে নেয় পাপড়ি? বোঝার চেষ্টা করে এগুলো আসলে প্রেম নিবেদনের পর্যায় পরে না কি হুমকি! কিছু একটা ভেবে ঝটপট টাইপ করে পাঠিয়ে দেয় ফিরতি বার্তা,

“ফ্লার্ট করার জন্য কি আর কোনো মেয়ে খোঁজে পান নি? শেষমেশ আমাকেই বেছে নিতে হলো?”

সাথে সাথে আবারও নাহিদের থেকে বার্তা আসে,

“আপনার মনে হচ্ছে আমি ফ্লার্ট করছি?”

“তা নয়তো কি?”

“এমন মনে হবার কারণ?”

“মনে হলো তাই বললাম। আর সব কারণ বিশ্লেষণ করা যায়না।”

নাহিদের থেকে আর কোনো ফিরতি বার্তা আসেনি। এক ধ্যানে কতক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেও যখন আশানরুপ কোনো বার্তা পায়নি তখন অচিরেই পাপড়ির বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এক রাশ শীতল অনুভূতি গুলো হারিয়ে গিয়ে বুকের ভিতর নতুন করে সৃষ্টি হয় বিষাপূর্ণ অনুভূতি। মনে হয় যেন মহামূল্যবান কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছে হঠাৎ করে। নিজেই নিজের মনকে বিরবির করে বলে,

” এতোক্ষন খুব তো লাফালাফি করছিলি। এবার হলো তো সব মিথ্যে প্রমাণ! অল্প দিনের পরিচয় হলেও আমার ওকে খুব ভালো করেই চেনা আছে। অসভ্য ছেলে একটা। সবসময় যা ইচ্ছে তা নিয়ে মজা করবে। অপর মানুষটা এতে রাগ হলো না কি কষ্ট পেল কিচ্ছু যায় আসেনা তার এসবে।”

নিজ মনে কথা গুলো বললেও কোথাও একটা যেন আশা ছিল নাহিদ হয়তো তাকে সত্যিই ভালোবাসে। ভেবেছিল তাকে বেয়াক্কল ডেকে মজা করলেও হয়তো নাহিদের চোখে দেখা অনুভূতি মিথ্যে ছিলনা। মুখে যা ইচ্ছে তাই বলা যায়। কিন্তু চোখ কি কখনো মিথ্যে বলতে পারে? হয়তো পারে। যার প্রমাণ নাহিদ করে দিল। নইলে তার চোখের ভাষা কিভাবে মিথ্যে হয়ে যায়? যে চোখ দুটো দুপুরে আভাষ দিয়েছিল অঘাত ভালোবাসার। সেই চোখের মালিকটাই কিভাবে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার ভালোবাসাকে ফ্লার্ট বলার পরও কোনো জবাব দেয়না! নিশ্চয়ই তখন ফ্লার্ট করেছিল বলেই কোনো জবাব আসেনি। এই বেয়াদব ছেলেটার কেন বারবার সব বিষয়ে পাপড়িকেই অপদস্থ করতে ইচ্ছে হয়? তাকে ছাড়া কি আর কোনো মেয়েকে চোখে দেখেনা সে? পূণরায় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো পাপড়ির বুক চিড়ে। এলোমেলো মস্তিষ্কের হাজারটা এলোমেলো ভাবনা নিয়েই অন্ধকার হাতরে রুমে গিয়ে শুয়ে পরে। রাত প্রায় শেষের দিকে। তবুও চোখে ঘুম নেই পাপড়ির। মস্তিষ্ক জুড়ে একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নাহিদ আবার তাকে বোকা বানিয়েছে। আর এই সুযোগ সে নিজেই করে দিয়েছে ছেলেটাকে। এতো বোকা তো পাপড়ি ছিলনা। তাহলে কিভাবে পারছে একটা ছেলে তাকে এভাবে বারবার বোকা বানিয়ে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাতে? দুপুরে কথা গুলো শোনার পর পাপড়ির মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল এটা যদি একবার নাহিদ জেনে যায় তাহলে কিরকম একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতির সম্মোখিন হবে সে! নাহিদ’ই বা কেমন ভাববে তাকে? নিশ্চয়ই মনে করবে পাপড়ির কাছে ভালোবাসা খুবই স্বস্থা। স্বস্থা না হলে কি আর এরকম ইঙ্গিতপূর্ণ একটা কথা শুনেই বেহায়া মন নেচে ওঠে! কি বিচ্ছিরি একটা কান্ড! ভাবতেই মেজাজের খ্যায় হারিয়ে ফেলছে পাপড়ি। ইচ্ছে করছে নিজেই নিজের গালে দুই-তিনটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে এমন একটা বোকামি করার অপরাধে।

ঘুটঘুটে অন্ধকার কেটে গিয়ে কোমল রোদের ছটা এসে আলোকিত করে দিয়ে গেছে প্রকৃতিকে। পবন জুড়ে বইছে ঝিরঝিরে মন মাতানো হাওয়া। রোদের তেজ বলতে গেলে একদম নেই। প্রকৃতির এমন কোমল রূপ দেখে যে কারো খিটখিটে মেজাজ’ও ফুরফুরে হতে বাধ্য। মন ভালো করে দেওয়া আবহাওয়াটাকে সঙ্গী করে পাপড়ি এসেছে ভার্সিটিতে। এক টানা তিনটা ক্লাসের পর এখন বিরতি। সুসজ্জিত ক্যান্টিন রেখে প্রকৃতির রূপে নিজেকে উজাড় করতে মাঠের এক কোণে সবুজ ঘাসের মাঝেই উৎফুল্ল মনে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে । গতকাল থেকে রাত পযর্ন্ত ঘটে যাওয়া বিষয় গুলো আপাতত মাথা থেকে সরে গেছে তার। তবে ঘুম থেকে ওঠার পর রাতের কথা গুলো মনে হতেই তীব্র লজ্জায় মরিয়া হয়েছিল পাপড়ির আপাদমস্তক। রাতের ভাবা আবেগপূর্ণ ভাবনা গুলো যেন সকাল হতেই কর্পূরের ন্যায় উড়ে গিয়েছিল। কোথাও একটা শুনেছিল পাপড়ি মধ্যরাতে মানুষের মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায়। সচল থাকে শুধু হৃদয়। আবেগে ঠাসা হৃদয়টা মস্তিষ্কের অচলাবস্থার সুযোগ নিয়ে হাজারটা অবাঞ্চিত আবেগজড়িত ভাবনা ভেবে বসে। যে ভাবনা গুলো আবার সকাল হলে নিজের কাছেই নিজেকে লজ্জায় ফেলে দেয়। অবচেতন মন ধিক্কার জানায় নিজের ভাবনার প্রতিই। পাপড়ির ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে নাহিদের প্রতি এতো দূর্বলতা কাজ করেছিল ভাবতেই আয়নাতে আর নিজের চোখের দিকেও তাকাতে পারেনি। অস্বস্তিতে গাট হয়ে কোনো মতে সকালটা পার করে ছুটেছিল ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। ভেবেছিল ক্লাস অথবা বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত থাকলে ঐ চিন্তা গুলো মস্তিষ্ক থেকে সরে যাবে। ঠিক হয়েছেও তাই।পরপর তিনটা ক্লাস করার পরই মস্তিষ্কে আর নাহিদের ভাবনার জায়গা হয়নি। ফুরফুরে মেজাজে অনুভব করতে পারছে বন্ধুদের সান্নিধ্য। যদিও পাপড়ির শিক্ষা জীবনে তেমন কোনো বন্ধু হয়ে উঠেনি। একমাত্র ঐশী নামের মেয়েটার সাথেই তার স্কুল লাইফ থেকে তৈরি হয়েছিল বন্ধুত্বের বন্ধন। এরপর স্বল্প ভাষী হওয়াই সবসময় সহপাঠিদের সাথে হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকতে না পারাই আর কোনো বন্ধু হয়ে ওঠেনি তার। তবে ভার্সিটিতে এসে আরও দুই একজনের সাথে ঐশীর উছিলায় প্রতিদিন টুকটাক কথা হলেও ঠিক বন্ধু বলা যায়না তাদের।

শান্ত মনে নরম ঘাসের গালিচায় বসে ঐশী সহ আরও তিন-চারজন ক্লাসমেটের গল্পগুজব শুনে যাচ্ছিল পাপড়ি নিরব শ্রোতার মতোই। ক্ষণেক্ষণে কিছু একটা নিয়ে হেসে উঠছিলো সকলে একসাথে। পাপড়ির ঠোঁটেও লেগেছিল এক টুকরো স্বচ্ছ হাসি। বন্ধুদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাতেই হঠাৎ দৃষ্টি যায় গেইট এর দিকে। সাথে সাথে ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা নির্মল হাসিটুকু মিলিয়ে যায় পাপড়ির। ভ্রু কুঁচকে কিয়দক্ষণ তাকিয়ে থাকে গেইট এর দিকেই। ভার্সিটির গেইট পেরিয়ে রাস্তার বিপরীত পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নাহিদ। প্রথমে দূর থেকে তাকে ঠিক চিনতে না পারলেও পাশে থাকা নাহিদের বন্ধুদের দেখে ঠিকই চিনে নেয় পাপড়ি। উৎফুল্ল মেজাজটা নাহিদের মুখদর্শনেই ভাটা পরে। বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে ওঠে মুখের ভিতরটা। কতক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে তাদের না দেখার ভান করেআবার বন্ধুদের দিকে ফিরে তাকায় পাপড়ি। বন্ধুরা এখনো জমজমাট আড্ডায় মশগোল। কিন্তু সে আগের মতো আড্ডাতে আর মন দিতে পারছেনা। উশখুশ করছে শুধু। বারবার আড়চোখে গেইটের দিকে তাকাতে চেয়েও তাকানোর সাহস হচ্ছেনা। এমন হাসফাস অবস্থার মাঝেই কেটে যায় চার-পাঁচ মিনিট। এরপর হুট করেই পেছন থেকে ভেসে ওঠে সেই স্বল্প পরিচিত কন্ঠস্বর,

“মিস. . পাপড়ি! আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিল। কিছুক্ষনের জন্য যদি বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে এদিকে আসতেন খুবই উপকৃত হতাম।”

নাহিদের কন্ঠ কর্ণগোচর হতেই চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নেয় পাপড়ি। ভয়ে বুকের ভিতরটা ধরাস ধরাস শব্দ করে ওঠে। মিস শব্দটা শোনার পরই মনে হচ্ছিলো এই বুঝি অভদ্রটা বন্ধুদের সামনেই তাকে বেয়াক্কল ডেকে আবার না অপদস্থ করতে শুরু করে। কিন্তু সেটা না করে নাহিদ যখন সুর টেনে তার নাম ধরে ডেকে ওঠে সাথে সাথেই চমকে গিয়ে চোখ মেলে পাপড়ি। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে নাহিদের মুখের দিকে। পাপড়ির মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে নাহিদ। চোখের ইশারায় জানিয়ে দেয়, “সম্মানের সহিত ডেকেছি দেখে এখন যদি আবার ভাব ধরে আমাকে এড়িয়ে যান তাহলে কিন্তু আপনার সম্মান মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে এক মুহূর্ত সময় নিবনা।” নাহিদের মনোবল বুঝতে পেরে ঝটপট দাঁড়িয়ে যায় পাপড়ি। শুকনো ঢোক গিলে মেকি হেসে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলে,

“তোরা থাক। আমি একটু আসছি।”

আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়না পাপড়ি। এক পলক নাহিদের দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় মাঠের অপর প্রান্তে বন্ধুদের থেকে একটু আড়ালে। তা দেখে ঠোঁট টিপে হাসে নাহিদ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাবিব নাহিদের পিঠ চাপড়ে বলে,

“যাও বন্ধু। আড়ালে গিয়ে তোমার ইম্পোর্টেন্ট কথা সেড়ে আসো। ততক্ষণে আমরা না হয় বিয়ানদের সাথে গল্প করি একটু। ”

ছেলে গুলোর কথার আগামাথা কিছুই বুঝে পায়না ঐশী সহ তার সাথে বসে থাকা বন্যা, প্রীতি। শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। নাহিদ প্রস্থান করতেই এক লাফে নাজিম বসে পরে বন্যা ঐশীর ঠিক মাঝখানে। সাথে সাথেই ছোটখাট এক চিৎকারে পরিবেশ থমথমে করে ফেলে তিন বান্ধবী। হুটহাট এমন চিৎকারে হকচকিয়ে যায় লাবিব নাজিম রাফিন তিনজনেই। নাক ছিটকায় রাফিন। কন্ঠে বিরক্তি ধাঁচ নিয়ে বলে,

” এই মেয়েরা কি ভাই! একটু কিছু হইতেই এরা বাঁশ গলায় চিৎকার শুরু করে দেয়। এদের কি আর কাজ কাম নাই? যত্যসব ন্যাকার দল।”

চলবে……

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১৫
#আদওয়া_ইবশার

মেহগনি গাছের ডালে দুটো জোড়া শালিক এসে বসেছে। যত্নসহকারে একে অপরের শরীর খুঁটিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার দুজনে মেতে উঠছে দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়ায়। ধারালো ঠোঁটের শক্ত ঠোকর বসিয়ে দিচ্ছে একে অপরের মাথায়। এক ধ্যানে পাখি দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে পাপড়ি। এমন একটা ভাব যেন এই মুহূর্তে শালিক দুটোর দুষ্টু মিষ্টি প্রেমের উপাখ্যান দেখা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই। নাহিদ পাপড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গলা ঝারে। অসল ভঙ্গিতে পাখি দুটোর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নাহিদের দিকে তাকায় পাপড়ি। অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে জানতে চায়,

“কি যেন জরুরী কথা বলার জন্য ডেকেছিলেন? তা কি সেই জরুরী কথা?”

একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায় নাহিদ। কিন্চিৎ ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

” আপনার কি খুব শখ হয়েছে পুরো জাতির কাছে নিজেকে বেয়াক্কল হিসেবে জানান দেওয়ার?”

“মানে?” কিছুই বুঝতে পারেনি এমন একটা ভাব পাপড়ির। ঠোঁট বাঁকিয়ে অল্প হাসে নাহিদ। দূরে ঐশীদের সাথে বসে থাকা লাবিবকে কাছে ডাকে। সাথে সাথেই এক দৌড়ে ছুটে আসে লাবিব। পাপড়ির দিকে তাকিয়ে প্রাণ খোলা হেসে একটা মোড়ানো কাগজ এগিয়ে দেয় নাহিদের দিকে। কয়েক সেকেন্ডে কাজটা করে আবারও এক দৌড়ে চলে যায় সেখান থেকে। নাহিদের ঠোঁটের কোণে এখনো দুষ্টু হাসি লেগে আছে। পাপড়ির দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে কাগজটা মেলে ধরে ঝরঝরে কন্ঠে বলে,

” আমি মানুষটা আপনার ভাষায় অভদ্র হলেও কথা রাখতে জানি। বলেছিলাম আমার জবাব না পেলে ছবি সহ বেয়াক্কল নাম দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে দিব! কথা অনুযায়ী কাজ অর্ধেক শেষ। এবার শুধু আনাচে কানাচে লাগিয়ে দেওয়া বাকী। এটাও কি কমপ্লিট করে ফেলবো? বেশি সময় লাগবেনা কিন্তু। সবার আগে না হয় আপনার বন্ধুদের হাতে দিয়ে শুভ উদ্বোধনটা করে ফেলি!”

হতবম্ভ হয়ে পোস্টারের দিকে তাকিয়ে থাকে পাপড়ি। অচল মস্তিষ্ক শুধু একটা কথায় ভাবছে, এ কোন পাগলের পাল্লায় পরল সে! মানুষটা কি আসলেই সুস্থ্য স্বাভাবিক মস্তিষ্কের না কি অর্ধ পাগল? একজন স্বাভাবিক প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের দ্বারা কখনো এরকম পাগলামি করা সম্ভব?আর কিছুই ভাবতে পারেনা । মনের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। যে ছেলে পোস্টার ছাপানো পযর্ন্ত এগিয়ে যেতে পারে সেই ছেলের দ্বারা কোনো কিছুই অসম্ভব না। ক্রস্ত পায়ে নাহিদের দিকে এগিয়ে যায়। টান দিয়ে হাত থেকে পোস্টারটা ছিনিয়ে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে নিচে ফেলে দেয়। খেঁকিয়ে বলে ওঠে,

” আপনি যে চরম লেভেলের অভদ্রের সাথে সাথে একটা বদ্ধ উন্মাদ,পাগল এটা জানা ছিলনা।”

“এখন তো জানলেন! আর হ্যাঁ, একটা ছিঁড়েছেন তো কি হয়েছে? ঐ যে নাজিমের কাধে ব্যাগ দেখছেন। ঐটার ভিতর কিন্তু আরও শত শত এমন পোস্টার ছাপানো আছে। সো বুঝতেই তো পারছেন নাহিদ এতো কাঁচা খেলোয়াড় না।”

কুটিল হেসে জবাব দেয় নাহিদ। রাগ সংবরণ করতে না পেরে পূণরায় তেড়ে আসে পাপড়ি। দাঁতে দাঁতে পিষে হাত দুটো নাহিদের গলার কাছে নিয়ে বলে,

“আর একটা উল্টাপাল্টা কিছু করলে একদম খু’ন করে ফেলব। অভদ্র, অসভ্য,পাগল লোক কোথাকার। একদম অসহ্য লাগে আপনাকে আমার।”

কথা গুলো একদম গায়ে লাগায়না নাহিদ। পাপড়িকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গলা ছেড়ে বন্ধুদের ডেকে বলে,

“আর বসে থেকে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। কাজ শুরু করে দে তোরা। কারো যদি নিজের মানসম্মানের প্রতি মায়া -দয়া না থাকে তাহলে আমার কি করার!”

সাথে সাথেই চেচিয়ে ওঠে পাপড়ি। হরবরিয়ে বলে,

“এই একদম না একদম না। আমি রাজি।”

“কিসের রাজি?” প্রশ্ন করে নাহিদ।

“আপনার শর্তে রাজি।”
না বোঝার ভান করে পূণরায় প্রশ্ন করে নাহিদ,

“কোন শর্তে রাজি?”

নিজেকে যথাসম্ভ শান্ত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে জবাব দেয় পাপড়ি,

” আপনার ফেবিকল হতে রাজি। হয়েছে? এবার অন্তত পাগলামি থামান।”

নাহিদের ঠোঁটের কোণে বিশ্বজয়ের হাসি। হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলে,

“একেই বলে সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হয়। এই কথাটা রাতে বলে দিলেই তো হতো। শুধু শুধু আমাকে পোস্টার ছাপানোর পিছনে এতো গুলো টাকা খরচ করতে হতনা। সে যায় হোক।দ্রুত কাছে আসুন।”

হুট করে এমন আহবানে হকচকিয়ে যায় পাপড়ি। বিস্মিত কন্ঠে জানতে চায়,

“কাছে আসব মানে?”

“একটু আগেই না বললেন আমার ফেবিকল হতে রাজি! তো আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে হবেনা? তবেই তো বুঝতে পারব আপনি আমার কতটা কাজের ফেবিকল। আর কথা না বাড়িয়ে ঝটপট এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন তো। যেতে হবে আমার তাড়াতাড়ি। আপনার পিছনে সারা দিন পরে থাকলে চলবেনা।”

মানুষ এতোটা ঠোঁটকাটা, লাগাম ছাড়া বেহায়া হতে পারে বুঝি! জানা ছিলনা। ধৈর্য্য হারায় পাপড়ি। অসহ্য কন্ঠে বলে,

“এবার কিন্তু অতিরিক্ত করছেন। আপনার মতো এমন পাগলের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে আমি না। মেন্টাল হাসপাতালের কোনো মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েই পারফেক্ট। আপনার এমন মাত্রাতিরিক্ত ফাজলামি কোনো সুস্থ্য মস্তিষ্কের মেয়ের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না।”

“তাহলে আপনি না হয় বেয়াক্কলের সাথে সাথে আজ থেকে পাগল’ও হয়ে গেলেন। ভালোবাসার জন্য একটু পাগল হতে ক্ষতি কি!”

ভাবলেশহীন জবাব নাহিদের। আর কোনো উত্তর দেয়নি পাপড়ি। অসহ্য রকমের বিরক্তিতে চুপ হয়ে যায়। দূর থেকে তাদের এমন বেগতিক অবস্থা দেখে এগিয়ে আসে লাবিব। পিছন পিছন নাজিম রাফিনও ছুটে আসে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাহিদকে নাজিম। শান্তনা দেবার মতো করে বলে,

“থাক ভাই । আজকে না হয় এই আমারেই নিজের ফেবিকল ভেবে নে! বন্ধুর উষ্ণ আলিঙ্গনেই আপাতত তৃষ্ণা মিটিয়ে ফটাফট কেটে পর এখান থেকে। প্রয়োজনের তুলনায় লেবু বেশি চিপলে কিন্তু তিঁতা হইয়া যায়। কাছে আসার গল্পটা না হয় আরেকদিন অন্য কোনো নিরিবিলি জায়গায় দুজনে চুপিসারে করে নিস। ভদ্র ছেলেরা পাবলিক প্লেসে ঐসব করেনা।”

নাজিমের এমন লাগামছাড়া কথার ধরনের অস্বস্তিতে পরে যায় পাপড়ি।লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। নিজ মনেই বিরবির করে বলে ওঠে,

“সব কয়টা একরকম ঠোঁটকাটা স্বভাবের। একটা মেয়ে সামনে রেখে কি ধরনের কথাবার্তা বলে! ছিঃ”

এরকম দুষ্টু মিষ্টি মুহুর্ত গুলোকে সঙ্গী করেই শুরু হয়েছিল নাহিদ পাপড়ির প্রেমের উপাখ্যান। নিয়ম করে ফোনে নাহিদের হাজারটা ফাজলামিপূর্ণ কথা শুনতে শুনতে একটা সময় এই মাত্রাতিরিক্ত অভদ্র ঠোঁটকাটা ছেলেটার প্রতিই বাজে ভাবে দূর্বল হয়ে ওঠে পাপড়ির কোমল হৃদয়টা। নাহিদ নামক বাজে ছেলেটার ভালোবাসার রঙে রাঙিয়েছিল নিজেকে। কেউ কখনো মুখ ফুটে কাওকে বলেনি “ভালোবাসি”। তবুও জানতো তারা একে অপরকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। হয়ে ওঠেছিল একে অপরের নতুন এক পৃথিবী। যে পৃথিবীর পুরোটাই ছিল ভালোবাসায় মুড়ানো। চোখে ছিল দুজনের হাজারটা রঙিন স্বপ্ন।মনের মাধুরী মিশিয়ে পাপড়ি একদিন বউ সাজবে নাহিদের। ছোট্ট একটা সংসার হবে দুজনের। যে সংসারের প্রতিটা কোণায় কোণায় সুখ লেপ্টে থাকবে। একে অপরের কাধে মাথা রেখে কাটিয়ে দিবে শত শত নির্ঘুম রাত। যৌবনের রঙিন দিন গুলো পিছনে ফেলে বার্ধক্যে পৌঁছেবে দুজন দুজনার হাত ধরে। এই ছোট ছোট স্বপ্ন গুলোর কথাও কেউ কাওকে কখনো মুখ ফুটে বলেনি। তবে দুটো মানুষ দুই প্রান্তে থেকেও একে অপরকে নিয়ে একই স্বপ্নে বিভোর থাকতো।

***
প্রতিদিনের মতো সেদিনও সকাল থেকে নাহিদের ফোনের অপেক্ষায় ছিল পাপড়ি। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। পাপড়ির অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নাহিদের থেকে কোনো কল আসেনা। চিন্তিত হয় পাপড়ি। ভাবে আবার কোনো বিপদ হলো কি না। শত ব্যস্ততার মাঝেও যে ছেলে সময় করে প্রতিদিন অন্তত দুবার হলেও ফোন দিয়ে ননস্টপ কথার ঝুলি খুলে বসে। হাজারটা লাগামছাড়া, হাসি-ঠাট্টার কথা বলে পাপড়িকে লজ্জা আর হাসির সাগরে ক্ষণেক্ষণে ডুবিয়ে মারে। সেই ছেলে আজ সারাদিন কেটে যাবার পরও একটা ম্যাসেজ পযর্ন্ত দেয়নি বিষয়টা গভীর চিন্তায় ফেলে পাপড়িকে। মনের ভিতর জমা হয় অজানা এক ভয়। আর অপেক্ষায় থাকতে না পেরে নিজেই ফোন করে বসে সন্ধ্যার পর। দুইবার রিং হয়ে কেটে যায়। তৃতীয় বারের মাথায় রিসিভ হয়। সাথে সাথেই পাপড়ি উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে,

“কোথায় ছিলেন আপনি? সারাদিনে একটা ম্যাসেজ দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেন নি! একটা মানুষ এতোটা কেয়ারলেস কিভাবে হতে পারে! এই বোধটুকু একবারও মাথায় আসেনি যে সারাদিন কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে কেউ হয়তো চিন্তা করতে পারে?”

“বাড়ি যাচ্ছি আমি।”

অত্যন্ত শীতল কন্ঠের জবাব নাহিদের। নিরব হয়ে যায় পাপড়ি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে,

” হঠাৎ বাড়িতে কেন? কোনো কিছু হয়েছে কি? আঙ্কেল-আন্টি, নাদিয়া, নাফিস ঠিক আছে তো সবাই!”

“জানিনা।”

অবাক হয় পাপড়ি এমন জবাবে। কন্ঠে বিস্ময়টুকু ধরে রেখেই বলে,

“জানিনা মানে কি? এসব কি ধরনের স্বভাব আপনার বলুন তো? একটা সিরিয়াস মুহূর্তে এসেও আপনার মাঝে কোনো হেলদুল থাকেনা!”

একটু বোধহয় বিরক্ত হয় নাহিদ। গলার স্বর আগের থেকে উচু করে কিছুটা গম্ভীর হয়ে জবাব দেয়,

“আশ্চর্য! আমি কি বাড়ি পৌঁছে গেছি নাকি? গাড়িতে থেকে ওরা কেমন আছে না আছে জানব কিভাবে? এসব লজিকলেস কথাবার্তা শোনার ইচ্ছে আমার এই মুহূর্তে একদম নেই। ফোন রাখছি।”

কথাটা বলতে দেরি কিন্তু সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে দেরি হয় না। বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে ফোন কানে নিয়েই ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে পাপড়ি। হঠাৎ নাহিদের এমন আচরণের কোনো মানে খোঁজে পায়না। ভালোবাসার মানুষের থেকে এটুকু কটূক্তিও যেন সহ্য হয় না। টুপ করে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে চোখের কার্ণিশ বেয়ে নিজের অজান্তেই। গাল বেয়ে উষ্ণ জলের ধারা গড়িয়ে পরছে অনুভব হতেই সাথে সাথে হাত দিয়ে মুছে নেয় অশ্রু টুকু। হাওয়ায় মিলিয়ে দেয় বেদনার্থ অনুভূতিটাকে। অবুঝ মনকে বুঝায় নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা হয়েছে বাড়িতে। যার কারণে মন মেজাজ ভালো নেই নাহিদের। খিটখিটে মেজাজটা হয়তো অন্য কারো কাছে প্রকাশ করতে না পেরে তার সাথেই মিটিয়ে দিয়েছে ঝাঝটুকু। রাগ-অভিমান, ভালোবাসা এই সবকিছুই তো প্রিয় মানুষ গুলোর কাছেই প্রকাশ করা যায়। পাপড়ি যদি নাহিদের ভালোবাসার ভাগ নিতে পারে তাহলে রাগের ভাগ কেন নিতে পারবেনা?ভালোবাসার সাথে না হয় প্রিয় মানুষটার রাগটুকু মিষ্টি মধুর যন্ত্রণা হিসেবে গ্রহণ করে নিল। কোনো ক্ষতি নেই তো তাতে।

চলবে…