গোধূলির শেষ আলো পর্ব ০১+২

0
1529

#গোধূলির শেষ আলো?
#পর্ব ০১+২
#writer Tanishq Sheikh Tani

অর্ধমৃত কুমার নদীর ঢেউ হঠাৎ হঠাৎ দমকা বাতাসে কুলুকুলু বইছে।দখিনা ফাগুন পবনের ছোঁয়া চোখ বন্ধ করে গায়ে মাখছে খালিদ।চারপাশে মৃদুমন্দ জঙ্গলি ফুলের সুবাস।আহ! কি অনাবিল সৃষ্টি। জীবনটা যদি এমনি শান্ত সুবাসে ভরপুর হয়ে উঠতো? পৃথিবীর সব জড়তা,দৈন্যতা এই সুবাসে যদি বিলীন হতো?কতো মধুরই না হতো তবে।যদি এমনি করেই জীবন চিরকাল বাংলা মায়ের প্রকৃতির আহ্লাদে কেটে যেত।ঐ দূর রূক্ষ মরুভূমির প্রবাসজীবনে যদি আর যাওয়া না লাগতো। খালিদের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ হয়ে অভ্যন্তরের বেদনা রূপে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের সমন্বয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।

“-আরে খালিদ ভাই যে! কবে আইলা?

ঘার ঘুরিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ ছোট ভাই সমতুল্য বন্ধু সজিবের দিকে তাকিয়ে রয়।তারপর ঠোঁটে মৃদু হাসি হেসে জবাব দেয়,,

“- এই তো আল্লাহ তাআ’লার ইচ্ছায় গত পরশুদিন।কেমন আছিস তুই?

“- গরিব মানুষের আর থাকা।আপনি তো এখন বড়লোক মানুষ।আমাগের যে ভুলে যান নাই এই টাই তো কথা।

সজিব কাঁচা রাস্তা ছেড়ে ঢালু নদীর পাড়ের সরু রাস্তা দিয়ে ছ্যার ছ্যার করে নামতে নামতে বলে।

“- তা হঠাৎ বড়লোক হলাম কি করে? আমার ধারণা আমার হাইট এবং দৈহিক গড়ন আগের মতোই আছে।আর স্মৃতি শক্তিও ঠিকঠাকই আছে।আচ্ছা সজিব কাতার গিয়ে কি মানুষ সব ভুলে যাই নাকি?তাহলে তো সত্যি আমার জন্য সেটা চিন্তার বিষয়।আমি আমার জ্ঞাতিভাইদের ভুলতে চাই না রে।মুচকি হেসে কিছুটা চিন্তিত হওয়ার ভান ধরে খালিদ।

খালিদের মজা সজিব ঠিকই ধরতে পারে।কপাল কুঁচকে তাকায় কোমড়ে হাত রেখে।তারপর হেসে দেয় সশব্দে দুজন।

“-তুমি আর পাল্টালে না খালিদ ভাই।সেই আগের মতোই রয়ে গেলে।

“- এক্সাক্টলি! আমি তোদের সেই পুরোনো খালিদ ভাই ছিলাম আর আছিও।আয় বস পাশে।

সজিব খালিদের পাশে গিয়ে বসে।অনেক্ষণ গ্রামের অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ হলো দুজনের।সজিবও কাতার প্রবাস জীবন নিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করলো খালিদ কে।খালিদ নিরস ভঙ্গিতে সব প্রশ্নের উত্তর দিলো।কারন মাতৃভূমিকে ছেড়ে ৪ বছরের প্রবাসজীবন খালিদের কাছে অসহ্য যন্ত্রনার। প্রবাসজীবনের কথা অন্য কারো মুখে গল্প উপন্যাসের মতো হলেও খালিদের কাছে তা নিছক স্কুলের বইয়ের প্রবন্ধের মতো নিরস বিষয়।তবুও রুজির অবমাননা হয় এমন কিছুই মনে আনে না খালিদ।

“- তা এবার কয়দিনের জন্য দ্যাশে আইলা খালিদ ভাই?

“-দুইমাস!

“- মেলা দিন দেহি। এতো দিন ছুটি নিলা যে? বিয়া টিয়া করবা নেহি?

“-তেমন কোনো ইচ্ছা নেই।তবে বাড়ির লোক চাচ্ছে বিশেষ করে মা চাচ্ছে বিয়েটা করেই যেন এবার যাই।

“- কাকি চাইতেছে যহন তাইলে কইরেই যাও শুভকাম টা।

“- না রে ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই।বিয়ে করে ২ বছরের জন্য বউকে রেখে দূরদেশে থাকাটা সমীচীন হবে না।দিনকাল ভালো না।তারউপর নতুন বাড়িটা তো একেবারে ফাঁকা জায়গায় করছি।রাত বিরাতে দুজন মেয়ে মানুষ একা কি করে থাকবে? তাই ভাবছি ৩ বছর পর একবারে এসেই বিয়েটা করবো।

“- সেইটাও হয়।তবে কাকি অসুস্থ মানুষ।কোইত্তে কি হয়ে যায়?শেষকালে আফসোস নিয়া মরবো।

“- হুমম।

সজিবের মুখে মায়ের মৃত্যুর কথা শুনতেই খারাপ লাগে খালিদের।মলিন হয়ে যায় মুখটা।মা জননী মরে যাবে কথাটা কোনো সন্তানের কাছেই ভালো শোনায় না।আর খালিদের জান খালিদের মা।খালিদের গম্ভীরতা ভাঙলো সজিবের কথায়

“- তা শুনলাম নতুন ঘর দেচ্ছো? পাকা দালান!

“- হুম।বড়ভাবীকে তো জানিস ই।মাকে সহ্যই করতে পারছে না।খুব কষ্ট পায় মা তার দূর্ব্যবহারে।তাই আমার ভাগের জায়গাতেই একতলা বিল্ডিং করছি আপাতত। তবে ফাউন্ডেশন ৪ তলারই।আস্তে আস্তে বাকিটা করবো।এখানেই মা থাকবে।কাজের লোক রেখে দিবো।কিন্তু বাড়িটা যেহেতু নির্জন জায়গায় হয়ে গেছে তাই এই বাড়িটার দুটো রুম ভাড়া দিয়ে মা কে বড় মামার বাড়িতে ভাড়া রাখবো। তাতে করে মার খারাপও লাগবে না আর কারো কথাও শুনতে হবে না।

“-এইটা মাজিদ ভাই খুব খারাপ কাম করছে।তোমার ভাগের জায়গায় নিজের ঘর কইরে তোমারে ঐ ফাঁকা সুপারী বাগানের পাশের নির্জন জায়গায় ঘর তুলতি দেছে।ভাই ভাই শত্রু হয়ে গেছে সামান্য সম্পত্তির জন্যি।সব বড় ভাবির কানপড়া বুঝলা।

“- কে কার শত্রু হয়েছে? মাজিদ ভাই আমার বড় ভাই।আমার সহোদর। রক্ত কি করে শত্রু হয় রে? সে আমার শত্রু না।সে আমার ভাই।হয়তো আমিই তার মনে কোনো কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই এমন করেছে।আমি তো জানি আমার ভাই আমাকে সন্তানতুল্য মনে করে।

“- তোমার মনটা মেলা ভালো গো খালিদ ভাই।আল্লাহ ভালো মানুষগুলোরেই কেন এতো কষ্ট দেয়?

“- কষ্ট কই দেয়? পরীক্ষা করে।আল্লাহ যাকে পছন্দ করে তাকেই দুঃখ কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করে।পরীক্ষায় পাশ করলেই তার প্রিয় বান্দা হবো বুঝলি?(মৃদু হেসে)

“- হ! তোমার কতা বুঝবো না তো কার কতা বুঝবো?এতো ফাইন করে বুঝাও তুমি।আচ্চা খালিদ ভাই তুমি তো আই.এ তে ফাস্ট হইছিলে তাইলে পড়ালেহা ছাড়লে ক্যা?

“- পড়ালেখা তো ছাড়িনি। তবে হ্যাঁ একাডেমিক বিদ্যা ছেড়েছি সংসারের প্রয়োজনে।আচ্ছা বাদ দে এসব।তোর কি খবর? বিয়ে করবি বলে শুনলাম?

“- করতে তো চাচ্ছি!আইজ কালকার মেয়েরা সব শিক্ষিত হয়ে গেছে। আমার মতো গোমূর্খ দোকানদাররে কিডা বিয়ে করবি কও দিনি?

“- থাকিলে নসিবে আপনি আপনিই আসিবে।শুধু সময়ের অপেক্ষা এখন।আর গো মূর্খ কই তুই? এসএসসি পাশ সদরে বড় কাপড়ের দোকান আছে।এমন ছেলেকেই তো মেয়ের বাবারা চাই।সময় সুযোগ হলেই সব হবে দেখিস।দুআ করবো যেন তাড়াতাড়ি সে সময়টা আসে তোর।তোর বিয়েটা যেন খেয়েই যেতে পারি।সহাস্যে সজিবের পিঠ চাপড়ে বলে খালিদ।

হঠাৎই আসরের আজান শুনে খালিদ চুপ হয়ে যায়।খালিদকে দেখে সজিবও চুপ হয়ে যায়।কারন খালিদ ভাই ই তাকে একদিন আজানের জবাব দেওয়ার ফজিলত বলেছিল।যারা আজানের জবাব দেবে তাদের নাকি পরকালে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হবে।রোজহাশরের দাঁড়ানো কাতার থেকেই তাদের চেনা যাবে।কথাটা শুনে সজিবও চেষ্টা করে আজানের জবাব দেওয়ার।

আজান শেষে আরো কিছুক্ষণ পর চুপটি ভাঙে খালিদ।সজিব কে নিয়ে কথা বলতে বলতে মসজিদের দিকে রওনা হয়।পথিমধ্যে আরো অনেক কথা হয় দুজনের মধ্যে।হাইস্কুলের পরেই মসজিদ টা। হাইস্কুলের পেছনের মেহগনির বাগানের মধ্য দিয়ে হাটছিল দুজন।খালিদ খেয়াল করলো হঠাৎই সজিবের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।হাসির কারন খুঁজতেই আবিষ্কার করলো সম্মুখে আগত দুজন যুবতী।যার একজন লজ্জায় বইগুলো বুকে জড়িয়ে মাথা অবনত করে আড়চোখে এদিকে তাকিয়ে সজিবের মতোই হাসছে মিটিমিটি। কিন্তু পাশের মেয়েটার যেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই।অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে হেসে হেসে।সেই হাসির ঝলক কিছুটা হৃদপিণ্ড শীতল করছে খালিদের।হ্যাঁ খালিদের বড় চেনা মেয়েটা।
মেয়েগুলো কাছাকাছি আসতেই সজিবের হাটার স্পিড কমে গেলো।খালিদ বিষয়টা আচ করতে পেরে চলে যেতে উদ্যোত হতেই সজিব ইশারায় থামতে বললো।মেয়েদুটো কাছে আসতেই খালিদ মোবাইল টা কানে ঠেকিয়ে গাছের আড়ালে সরে দাড়ায় অন্য দিকে মুখ করে।

“-আসসালামু আলাইকুম সজিব ভাই! দোকান ছেড়ে এইখানে দাড়ায় আছেন কেন?আপনি নেই দেখে আমার বান্ধবীর পরাণ আকুলিবিকুলি করতেছিল।

প্রেমের তৃষ্ণায় তৃষ্ণিত দুই কপোত কপোতী সব ভুলে ডুবে আছে একে অপরের চক্ষু সমুদ্রে।মুখ নয় মনে হচ্ছে তাদের দু চোখ কথা বলছে।সজিব পুষ্পার দিকে অপলক চেয়ে রয়।

“-কি রে বলিস নে কেন? দেখতে না পেলে মরে যাস আর সামনে পেলেই চুপসে যাস।

বান্ধবী পুষ্পাকে গায়ে গায়ে ধাক্কা দিয়ে তানি প্রেমের জ্বলে ডোবা কপোত কপোতীকে আবার কূলে নিয়ে আসে।অর্থাৎ তাদের ধ্যান ভাঙায়।

“-চুপ কর তুই! চল! ( লজ্জায় লাল হয়ে)

তানির হাত চেপে ধরে পুষ্পা।তারপর হাঁটতে শুরু করে বাড়ির পথে।

“-ও সজিব ভাই! দূরে দূরে আর কতো? আসেন না পাগড়ী পড়ে।বাড়ি নিয়ে সারাদিন দেইখেন।খালি খালি দোকান বন্ধ করে ব্যবসায় লস দিয়ে দেখবেন কেন আমার বান্ধবীরে? বেচারি আপনার চিন্তায় মরেই যাই যাই।পুষ্পার কিছু হইলে কিন্তু আপনার নামে ১৪৪ ধারার মামলা করবানে।হি!হি!হি

“- কি শুরু কললি? চুপ কর বোন( মুখ চেপে ধরে)আমি কিন্তুক এবার মেলা রাগ করবানে দেখেনিস? তোর সাথে কথা বলবান না।

“- ক্যা! ক্যা?আমি অন্যায় টা কি করলাম শুনি? তুই তো সত্যিই সজিব ভাইয়ের জন্যি কষ্ট পাইস।তার সিটা জানা লাগবি নে?

“- তাই বলে তুই সবার সামনে এসব কবি? গিরামের মানুষ শুনলি মান সম্মান কিছু থাকবি আমার ক? ( কাঁদো কাঁদো হয়ে)আমাগের সম্পর্কের কতা আব্বার কানে গিলে কস্মিনকালেও তো বিয়ে দিবেন না ওর সাথে আব্বা।

“- সবাই মানে কে? কেউ তো নাই তাই তো কলাম।আমি তোর বান্ধবী না? আমি তোর ক্ষতি চাইতে পারি কদিনি? ( পুষ্পার চোখ মুছে জড়িয়ে ধরে)

“- ছাড়! আর সিনেমা কত্তি হবি না।কেউ নাই তাইনে ঐ যে কালো গেঞ্জি পড়া লম্বাটে মানুষটারে তোর চোখে পড়তিছে না।

পুষ্পার কথা শুনে তানি পেছন ফিরে তাকিয়ে ভালো করে নজর দিতেই দেখে সজিবের সাথে কালো টিশার্ট পরিহিত লম্বাটে একটা ছেলে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। ছেলেটার মুখ সামনের দিকে ফেরানো তাই পিঠটায় দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা ভূতের মতো কোথায় লুকিয়ে ছিল? কই আমার নজরে তো পড়লো না? নাকি আমার চোখের পাওয়ার কমে গেলো?তাহলে তো পুষ্পা সত্যি বলেছে।বেক্কল ছেড়ি তুই রে তানি।মা ঠিকই কয় তোর মাথা গোবর ভরা।লোকটা কি মনে করলো কথাগুলো শুনে?(নখ কামড়াতে কামড়াতে ভাবে)

“- পুষ্পা!
একই ভাবে ভূত দেখার মতো খালিদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে।

“- তুই আমার সাথে কতা কবি নে। যা তুই সর!

“- এই দ্যাখ কানে ধরছি।উঠ বস করছি আর করবান না রে এমন।মাফ করে দে না রে।তুই ছাড়া আমার কিতা আছে ক?হেসে আবার গলা জড়িয়ে ধরে বান্ধবীর তানি।

“- সিনেমা করবি নে সর তুই।

“- আচ্ছা আমি এখনি যাইয়ে ঐ ছেরারে জিজ্ঞেস করে আসছি সে কিছু শুনছে নাকি? দাড়া তুই

“- এই থাম! তোর কি কোনোদিনই বুদ্ধি হবি নে রে।এমন ক্যা তুই।এতো ছেলেমানুষ হওয়া ভালো না বুঝলি?যাওয়া লাগবি নে তোর। চল বাড়ি যাই।এমনিতেই মেলা দেরি হয়ে গেছে।

“- কিন্তু ঐ লোকটা যদি সব কয়ে দেয় কাকারে? তাইলে তুই সজিব ভাইরে আর পাবি নে তো

“- কবেন না। দেখছিস না ওরা দুজন কথা বলতি বলতি যাচ্ছে তার মানে পরিচিত লোক। আর তুই তারে চিনিস না?

“- কারে?

“- কারে মানে? খালিদ ভাইরে!

“- কোন খালিদ! আমাগের যে ফাইভে প্রাইভেট পড়াইছিলো অংকের?

“- হ! সেই খালিদ ভাই।

“- ইয়া আল্লাহ! ঐ তুই আগে কবি না।তুই জানিস নে তারে আমি কি ভয় পাই।একবার ফাইভে লাভ ক্ষতির অংক পারি নেই তাই বেত দিয়ে হাতে ৫ টা বারি দিছিল।আল্লাহ গো কি জোরেই যে দিছিলো না বারি? আমার হাত ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছিলো।ঐ তুই আমারে কলি না ক্যা?সে যদি শুনে ফেলে আমার কথা আমি তার সামনে মুখ দেখাবো কি করে? ওরে পুষ্পার বাচ্চা তুই একটুও বললি না ক্যা?

“- ক্যা! ক না আরো জোরে জোরে ক।সজিবভাই,,,( তানির গলা জরিয়ে)

“- সর তুই! তোর মতো বান্ধবী থাকার চেয়ে শত্রুও ভালো। একটু তো সংকেত দিবি?এখন যদি সে আমারে কিছু কয় তালি তোরে দেখিস মারে ফেলবানে।হু

পুষ্পার উপর রাগ করে হনহন করে আগেই বাড়ির দিকে চলে তানি।পুষ্পা দৌড়ে এসে ওর মান ভাঙানোর চেষ্টা করে।কিন্তু মান আর ভাঙে না তানির।

“-এ মা! মারে। এ মা কই গেলি তুই।আমার খিদে লাগছে। তাড়াতাড়ি খাবার দে।

“- ওরে আল্লাহ রে! এই মাইয়ে এই তোর কি বুদ্ধি সুদ্ধি কোনদিনই হবি না রে।রাস্তার তেই স্কুল ড্রেরেস না খুলেই খাবো খাবো করতিছিস? এমন করলে মাইনষি কবি রে হ্যাঁ। দিন দিন সেয়ানা হচ্ছিস আর জ্ঞানবুদ্ধি সব কমতেছে নাকি রে?

উঠানে বসে চুলায় আগুন ধরানোর জন্য জন্য সংগ্রহ করা গাছের ডাল, পাতা আলাদা করতে করতে চড়া গলায় মেয়েকে ধমকাতে থাকে ফজিলা।কিন্তু তার স্বামীর আদরের বাদর হওয়া ষোড়শী যুবতি কন্যা কি আর এই ধমকানি কানে তোলে? মোটেও না।তার উপর খালিদ নামক ভয় মাথায় ভনভন করছে।না শোনার ভান করেই ঢ্যাং ঢ্যাং করতে করতে বইগুলো কোমড়ে ঠেকিয়ে বাড়িতে ঢোকে তানি।

“- আরে মা তুই ভাষণ পরে দে! আগে খাবার দে। পেটে আমার ছুছো দৌড়াচ্ছে।

স্কুলের বই বারান্দায় রাখা চৌকিতে ছুড়ে মেরে সাদা সুতি ওড়না, দোপাট্টা একটানে খুলে বারান্দার কাপড় শুকানোর ঝুলন্ত বাশের উপর ফেলে রান্নাঘরে দৌড়ে পিড়ি নিয়ে হাটু ভাঁজ করে বসে হাটুতে মুখ ঠেকিয়ে বসে ।
খিদে তো মরেই গেছে পুষ্পার কথা শুনে। তবুও খাবে। কারন ভাত চাবাতে চাবাতে যদি খালিদের চিন্তাটা ভোলা যায়?আচ্ছা সত্যি কি ওটা খালিদ ভাই ছিল? কিন্তু সে না বিদেশ? সত্যি যদি লোকটা খালিদ ভাই হয় তালি তো তুই শেষ তানি।সে তোকে সামনে পেলে গিলে খাবে পানি ছাড়াই।কিন্তু সে তো সামনেই ছিল।তালি তখন কিছু বললো না ক্যা?তার কি মনে আছে আমার কথা? মনে হয় নাই।আল্লাহ যেন তাই হয়।কথাটা ভাবতেই হাসি ফোটে মুখে।তানির ভাবান্তরে ছেদ হয় মায়ের বকুনিতে।

“- আল্লাহ আমি এই মাইয়ে রে নিয়ে কই যাবো?আরে ও তানি! ইস্কুলের তে আইসে যে হাত মুখ ধুতি হয়।সে কথা কবে শিখবি তুই? এমনে গিদর হয়ে খাতি বসে কেউ ধুলোবালি গায়ে মেখে।যা হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে আই কইলাম।

রান্নাঘরের দুয়ারে দাড়ায়ে শুকনো কঞ্চি হাতে মেয়েকে শাসায় ফজিলা।কয়েকবার বলার পরেও যখন তানি কথা শোনে না তখন রাগ হয়ে ফজিলা কঞ্চির কয়েকটা বাড়ি তানির গায়ে দেয়।পা ছড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাদার অভিনয় করে তানি।

“- মা তুই আমারে মাললি ক্যা?ও আব্বা তুমি কোয়ানে আব্বা গো।তোমার তানি রে ফজিলা বেগম মারে ফেললো গো আব্বা।

“- এই দেহো শুরু হয়ে গেলো নাটক।এই তোর বাপ আমারে কি করবি? যা হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে আয় আমি খাবার দিচ্ছি। যা!

আবার একটা বাড়ি দিতে উদ্যত হলেই তানি দৌড়ে উঠানে দাড়ায়।মায়ের মার যে মিস গেছে এতে দারুন আনন্দ পায় তানি।ফিক করে হেসে ওঠে।এলোমেলো চুলে ধুলোয় রোদে মলিন হওয়া মুখটার হাসি দেখে ফজিলা বেগম অপলক চেয়ে থাকে।বড্ড মায়াবী লাগে হাসলে মেয়েটাকে।মায়ের ওভাবে চুপ করে দাড়িয়ে থাকা দেখে।ধীরে ধীরে পা টিপে মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে তানি পেছন থেকে।

“- এ মা দে না ভাত? এই দ্যাখ মাথা ছুলাম কালকের তে হাত মুখ পাও কান নাক সব ডলে ডলে ধুবানে।বই সুন্দর করে টেবিলে রাখবানে। ইস্কুলির পুষাকউ বদলাবানে আইসেই।এহন মাফ কর।দে না ভাত মা! দে না।দ্যাখ তোর মেয়ে কইলাম খিদেয় মরেই যাবেনে।তহন এতো সম্পত্তি দিয়ে কি করবি তুই?

“- ক্যা আমি আছি না?এই সম্পত্তি কি তোর নাকি, অংকে ফেল ছাত্রী।

নিজের সমন্ধে পরিচিত গলায় এমন কথা শুনে স্বভাবতই রেগে লাল হয়ে যায় তানি।পেছন ফিরে নাক ফুলিয়ে কটমট করে তাকায়,,,,,

গোধূলির শেষ আলো?
#পর্ব ০২
#Writer Tanishq Sheikh Tani

“- দ্যাখ ভাই সবসময় এইটা কবি না আমারে।সেই ক্লাস ফাইভে একবার অংকে ফেল মারছিলাম তার খোটা তুই আজও ক্যা দিস আমাকে? তারপর কি আর একবারও ফেল করছি বল?

“- একবার করাও যা ১০০ বার করাও তাই।আর এতো যে চ্যাটাং চ্যাটাং ডায়লগ মারছিস এখন সব পাস করিস হেন তেন।খালিদ ভাই না পড়ালে তুই আজিবনই অংকে ফেল ছাত্রী থাকতি এটা সবাই জানে।

“- হ ঠ্যাঙা জানিস তোরা।ঐ খালিদ আমাকে কয়দিন পড়াইছে হুম।খালি ক্লাস ফাইভ ই তো।এক ক্লাস পড়াইয়ে কি সে আমারে অংকের বিদ্যাসাগর বানায় দেছে নাকি?

“- তুই আর অংকের বিদ্যাসাগর? অষ্টম আশ্চর্যের আবিষ্কার হয়ে যাবে তো? ( মুচকি হেসে)।একদিন এক অক্ষর পড়ালিউ সে তোর মাস্টার ছিল।বেয়াদব তার নাম ধরিস তুই।

“- মা! ওরে কিছু কও কইলাম।ধ্যাৎ ভাল ঠেহে না।

তানি ভাইয়ের সাথে কথায় পেড়ে না উঠতে পেরে রাগে দুঃখে লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢোকে।কিছুক্ষণ বাদেই কমলা রঙের থ্রি পিস পড়ে চুল টা পরিপাটি করে আচরে বেরিয়ে আসে।কলপাড়ে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে গামছা দিয়ে মুখ মুছেই বাইরে বেরোনোর জন্য উদ্যত হয়।তা দেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে ফজিলা বেগম।

“- এই তুই কনে যাচ্ছিস? ভাত খাবি নে?

“- না খাবো না।পেট আমার ভরে গেছে তোমার বংশের বাতির কথা শুনে।তারেই খাওয়াও ভরে ভরে।আমার ভাগের ভাতটাও তারে গেলাও।হু

বারান্দায় বসা বড় ভাই ফয়েজকে মুখ ভেংছে হনহন করতে করতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়।

“- এই ফয়েজ! মাইয়েডারে খালি খালি এতো জ্বালাইস ক্যা।মাইয়েডা আমার সারাদিন ইশকুল করে খিদা পেটে বাড়ি আসেএ খেতেও পারলো না।তোরা দুই ভাই বোন এমন ক্যা ক দিনি?মনে হয় যেন ইন্দুর বিলাই।ও পরের বাড়ি গেলি দেখিস তোরি পুড়বেনে।

“- আমি কি করলাম মা! সত্যি কথা বললি তোমার মেয়ে এমনিই করে।আমি আবার যা সত্যি তাই বলি।ও এ পরের বাড়ি গেলি আমার চে খুশি আর কেউ হবেন না মা।

“- ওরে আমার সত্য বাদী রে।যা বোনের রাগ ভাঙায়ে তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়।জানিস ই তো পেটে খিদে ও সহ্য করতে পারে না।যা বাজান ডাকে নিয়ে আয়।

“- আরে কি যাবো?যাবো না আমি।আমার মেলা কাজ আছে।আর তোমার পেটুক মেয়ে এখন সোজা পুষ্পাদের বাড়ি গেছে।ঐখানেই খেয়ে নিবেন।

মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে ফয়েজও বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়।ফজিলা বেগম নিরুপায় দেউরিতে দাড়িয়ে ছেলেকে বকে বোনকে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু তার কথা কে শোনে?

বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাগে ওড়নার আঁচলে হাত মুচরাতে মুচরাতে মাঠের মাঝের আইল দিয়ে হেঁটে যেতেই হঠাৎ সামনে তাজকে দেখে থেমে যায়।মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে তানির দিকেই এগোতে থাকে তাজ।নীল টিশার্টের কলার ঘার থেকে নিচে নামিয়ে চুল ব্রাক ব্রাশ করতে করতে এদিকেই আসছে।
তানি কি করবে ভেবে পায় না।ঢোক গিলে ঠাঁই দাড়িয়ে আছে।রাগের মাথায় ভুলেই গিয়েছিল এই রাস্তায় অপছন্দের মানুষটার বাড়ি পরে।তাজের অসভ্যতার জন্যই এই পথে সহজে যাই না তানি।বেশি সময় লাগলেও মেইন রোড দিয়েই পুষ্পাদের বাড়ি যায়। কিন্তু আজ তো পড়েই গেছে শয়তানের সামনে।তানি পেছন ঘুরে আবার বাড়ি পথে হাঁটা ধরে।স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে কারো দৌড়ে আসার শব্দ। বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে সে শব্দ শুনে।তানি প্রানপনে জোরে হাটার চেষ্টা করছে।
হঠাৎই ধপ করে সামনে এসে দাঁড়ায় তাজ।মুখে দুষ্টু হাসিটা এখন আরো প্রশস্ত হয়েছে।চোখে চাহনীও মারাত্মক শয়তানি ভরা।
তানির পথ আগলে দাড়ায়।তানি পাশ কাটতে গেলে তাজও সেদিকে আগলে দাঁড়ায়।

“- একেলা পাইয়াছি রে রাধে এ নিঠুরো ভুবনে,,
আজ পাশা খেলবো রে রাধে ওওও,,,

তাজ কিছুটা ঝুঁকে তানির চারপাশে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে থাকে।গানটা শুনে তানি রাগে ফুঁসতে থাকে।

“- তাজ আমার সামনের থে সর কচ্ছি।

“- পথ আগলে ধরেছি যখন সে পথ আর ছাড়বো না সখী।একেবারে বউ করে ঘরে নিয়ে তুলবো।হবি না আমার বউ?

“- আমার স্যান্ডেল তোর বউ হবি।নে নিয়ে যা স্যান্ডেল হারামজাদা। সর এখান থেকে।

তাজের পেটে দুহাতে সজোরে ধাক্কা দিয়ে পাশ কেটে যেতেই তাজ হাত ধরে ফেলে তানির

“- তাজ খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু। মেজাজ এমনিতেই মেলা খারাপ।উল্টো পাল্টা কিছু হয়ে যাবে বলে দিলাম।ছাড় আমার হাত!
তাজের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে তানি।

“- তাহলে বল বিয়ে করবি আমায়।আমি আব্বারে দিয়ে কালই প্রস্তাব পাঠাবো।

“- তাজ হাত ছাড়! তোর মতো চরিত্রহীন ছেলেরে কে বিয়ে করবে? আমি? মরে গেলেও না।তুই হতে পারিস এই গিরামের চেয়ারম্যানের ছেলে তাই বলে আমার উপর তোর কতৃত্ব চলবি না।ছাড়!ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে যেতেই তাজ একটানে তানিকে বুকের উপর ফেলে দেয়।তানি হাত তাজের বুকে ঠেকিয়ে দুরত্ব তৈরি করে।
তানি বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে যায় তাজের অসভ্যতার ধৃষ্টতা দেখে।মনে মনে আল্লাহ কে ডাকে যেন ওদের দুজনকে কেউ না দেখে ফেলে এ অবস্থায়।মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাবে তবে।

“- থাক না পাখি এমনি করেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে এ বুকের মাঝে।
আমিও একটু বাচি তোকে ভালোবেসে,,,
তোর দেওয়া দাগ চরিত্রে যত্নে রাখি মেখে।

“- ফয়েজ ভাই!

তানির মুখে ফয়েজের নাম শুনে তাজ তাড়াতাড়ি তানিকে ছেড়ে দূরে সরে যায়।এদিক সেদিক তাকাতেই দেখে ফয়েজের নাম নিশানাও নেই।দাঁত কটমট করতে করতে সামনে তাকাতেই দেখে তানি দৌড়ে অনেকদূর চলে গেছে।চোখ ছোট করে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ তাজ।তারপর ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে বলে,,,

“- যাও পাখি যেখানে খুশি।কিন্তু ফিরে তোমাকে এই নীড়েই আসতে হবে(নিজের বুকে হাত রেখে বলে)।
এই তাজ যা চাই তাই পাই।তোকে আমার চাই তানি অবশ্যই চাই বড় তেজ তোর।এই তেজ ভাঙার জন্যও তোকে আমার চাই ই।তোকে আমার চাই ই চাই তানি।

তানি নাকে মুখে দৌড়ে মেইন রোড দিয়ে পুষ্পাদের বাড়ি চলে আসে।এই তাজ এতো বেড়েছে তা ভাবনার বাইরে ছিল তানির।

“- কিরে তোর কি হয়ছে এভাবে দৌড়ে আসছিস কোন থে?

তানি পুষ্পাকে টেনে ওর ঘরে নিয়ে সব ঘটনা খুলে বলে পুষ্পা হা করে মুখে হাত দেয়।দুজনই ভাবে কি হবে? এসব কথা বড়দের বললে তারা কোনো বিচার তো করবেই না উল্টো বিয়ে দিয়ে দেবে তাড়াতাড়ি। মেয়ে নিয়ে কেউ বিচার ডাকবে না কারন মেয়ে মানুষ আজন্মই অপরাধী সে অপরাধ করলেও কি না করলেও কি? দোষ ঘুরে ফিরে তারই।দু বান্ধবী চিন্তায় পড়ে যায় বিষয়টা নিয়ে।

সজিবের কাপড়ের দোকানে এসে বসে খালিদ ও সজিব।দুজনের মুখেই চিন্তার ছাপ।

“- সবই তো শুনলে খালিদ ভাই।এহন কও করবা তো সাহায্য আমার।তুমি ছাড়া আর কেউ আমার আর পুষ্পের মিল করাতে পারবি না।তুমি আমাগের জন্য আল্লাহর রহমত গো।তুমি যদি না করো আমাগের মরা ছাড়া কোনো উপায় থাকবি না। খালিদের হাত ধরে কাদে সজিব।তারপর মাটিতে বসে পড়ে।

“- এই কি করছিস কি? ওঠ।আরে ওঠ।

“- তাইলে কও তুমি কথা বলবা ওর আব্বা, ভাইয়ের সাথে।

“- আচ্ছা ঠিক আছে।এবার কান্না থামা।বর কি কখনও কাঁদে? মুচকি হেসে বলে খালিদ।

“- তুমি সত্যি আমার ভাই খালিদ ভাই।আপন ভাইয়ের চে কম না তুমি আমার কাছে।তাই তো তোমারেও সব বলি আমি।

সজিবের সাথে আরো কিছুক্ষন আলাপ সেড়ে উঠতে চাই খালিদ।কারন মা বাড়িতে একা।বড় ভাবি ফিরেও তাকাবে না তার ঘরে।
তার উপর মনের মধ্যে অন্যরকম আলাপন হচ্ছে। যার জন্য কিছু সময় একাকিত্ব থাকাটা বড় জরুরী। অনুভূতিগুলো খুবই যন্ত্রনা দিচ্ছে।

“-আচ্ছা অনেক সময় হয়ছে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি।এখন যাই।একবারে মাগরিব পরে বাড়ি যাবো।

“- আচ্ছা। আমি কাল যাবানে তোমাগের বাড়ি।

সজিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খালিদ বাড়ির পথে হাঁটা দেয়।বার বার চোখে তানির হাসি মুখটায় ভাসছে খালিদের।এতোদিন না দেখে কষ্টে ছিল কিন্তু আজ দেখে যে কষ্ট টা আরও বেড়ে গেলো।

চলবে,,,,