#চন্দ্রপ্রভা_রজনী
#পর্বঃ৪
লিখাঃসামিয়া খান
সুবাহার এখন বেশ অস্বস্তি ফিল হচ্ছে।একে তো এতো মানুষের মধ্যে ভারী শাড়ী, গয়না পড়ে থাকতে হচ্ছে।তার মধ্যে একটু পর পর বিভিন্ন মানুষ আসছে দেখা করতে এবং ছবি তুলতে।অনিচ্ছা স্বত্বেও সুবাহার তাদের সাথে হাসি মুখে কথা বলতে হচ্ছে।এত আলোতে এখন সুবাহার চোখ জ্বলছে।অসহায় মুখ করে সুবাহ পাশে বসে থাকা আরিয়ানের দিকে তাঁকালো।আরিয়ান কীভাবে বেশ আয়েস করে ফোনের স্ক্রিনে স্ক্রল করে চলেছে অথচ পাশে সুবাহার যে এত কষ্ট হচ্ছে তাতে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
“আমার দিকে তাঁকিয়ে লাভ নেই সুবাহ।আমি আগেই বলেছিলাম শাড়ীটা বেশ ভাড়ী সে হিসেবে মেকআপ কম করতে। যাতে পরে সাফোকেটেড ফিল না হয়।কিন্তু আমার কথা ভালো লাগেনি তোমার।”
“আমি কি করবো বলেন।বুবু বলল এই মেকআপটা এপরুপ্রিয়েট।”
“এখন ভুগো তাহলে।”
সুবাহ বেশ মন খারাপ করে বসে রইলো।আরো কিছুক্ষণ ফোনে স্ক্রল করে আরিয়ান উঠে দাড়ালো।এবং সুবাহার হাত ধরে কোনো কথা না বলে তাকে নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে আসলো।
একটা রেস্ট রুমের দরজাতে হালকা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো আরিয়ান আর সুবাহ।এখানে কেন নিয়ে আসছে তা জানেনা সুবাহ কিন্তু আরিয়ানের বকার ভয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারেনি।সুবাহকে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়া করালো আরিয়ান।তারপর মাথা থেকে শাড়ীর আঁচলটা সরিয়ে গলা থেকে একে একে গয়না খুলতে শুরু করলো।একটা সিম্পেল হাড় ব্যতিত গলায় আর কোনো জুয়েলারি রাখলো না।
“যখন ছোট ছিলাম তখন টিভিতে আলিফ-লায়লা হতো।সেখানে মাঝেমধ্যে দৈত্যদের দেখানো হতো।তাদের কানে ঠিক তুমি যেরকম কানের দুল পড়ে রয়েছো থাকতো।”
“আপনি এটা বলতে পারলেন?”
“অবশ্যই পারলাম।তার মধ্যে ভারী মেকআপ।কেমন মোটা মোটা লাগছে দেখতে তুমি জানো।”
আরিয়ানের মুখ থেকে মোটা শব্দটা শুনে বেশ দমে গেল সুবাহ।সুবাহ মটেও মোটা নয় এবং আজকের সাজে তার প্রশংসা করেছে সবাই।আর এক আরিয়ান যে কিনা তাকে মোটা বলছে।
“কানের দুল রাখবে নাকি খুলবো?”
“থাক।”
“এই যে প্রফেসর ম্যাডাম মোটা বলেছি তাতে মন খারাপ করার কি আছে?”
“আপনি আমার সাথে এমন করেন কেন?আমাকে কি আপনার বিয়ে করার ইচ্ছা ছিলনা?”
আয়নার ভেতর আরিয়ানের অবয়বের দিকে তাঁকিয়ে সুবাহ এ প্রশ্নটা করলো।কিন্তু প্রশ্নটা একটুও বিচলিত করলো না আরিয়ানকে।
“গয়না গুলো তুলে রেখো।এখানে রেখে যেওনা।”
কথাটা বলে দাড়ালো না আরিয়ান।কাকে যেনো কল করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
,
,
,
হাতের মুঠি বারবার সংকুচিত প্রসারিত করছে স্বাধীন।কিন্তু কোনোভাবে নিজেকে মানাতে পারছেনা।আজকে সকালে পনের দিনের সাজেক ট্যুর শেষে বাড়ী ফিরেছে।তিনদিন টানা রেস্ট নেওয়ার কথা থাকলেও বাবার কথায় আজকে এই রিসেপশনের পার্টিতে আসতে হয়েছে।মিনিস্টারের একমাত্র ছেলে স্বাধীন চৌধুরী।বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে হলে বেশ ভদ্র এবং সুশীল একজন ছেলে।তার বাবা তাকে বিদেশে হায়ার স্টাডির জন্য পাঠাতে চাইলেও সে যায়নি।বরং দেশের একটা নামকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে পড়ছে।বাবা মিনিস্টার হলেও কখনো তার নামের অপব্যবহার করেনি।
তার জীবনেও একটা ভালোবাসা আছে কিন্তু সে তার থেকে যথেষ্ট বড়।এমনকি পাঁচ বছরের বড়।কথায় আছেনা ভালোবাসা বয়স দেখে হয়না।স্বাধীনেরও তাই হয়েছে।যদি হুট করে সে ভালোবাসা অন্য কারো হয়ে যায়?ব্যথাটা তখন হয়তো সহ্য করার মতো না।স্বাধীন জানতো না কার বিয়েতে এসেছে সে কিন্তু স্টেজের কাছে এসে যখন নিজের ভালোবাসাকে বধূ হিসেবে দেখলো তখন তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছে হয়তো।না পারছে সহ্য করতে পারছে না কিছু বলতে পারছে।আরিয়ান যখন সুবাহকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তখন স্বাধীন স্টেজেই ছিলো।আরিয়ানকে সুবাহার হাত ধরতে দেখে মনে হয়েছিল এক ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিতে কিন্তু সে নিরুপায়।মুখে হাজার বিরক্তিভাব ফুটিয়ে তুলে হলের একপাশে বসে রইলো সে।এরমধ্যে একবার যেখানে এলকোহল থাকে সেখান থেকে চক্কর দিয়ে এসেছে।আচ্ছা তার কি এখন মদ খেয়ে মাতলামি করে নিজের ভালোবাসা জাহির করা উচিত নাকী চুপচাপ দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকা উচিত।
,
,
,
ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো মায়া।স্টুডিও থেকে বের হয়ে সে বাজারে গিয়েছিলো।ঘরে রান্না করার মতো কিছু ছিলনা।তিন বেডরুমওয়ালা একটা ফ্ল্যাটে বসবাস করে সে।একা না তার সাথে আরেকটা মেয়ে থাকে।মেডিকেলে পড়াশোনা করছে সে।কিছুদিন হলো সিলেট গিয়েছে নিজের বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে।
পুরো ফ্ল্যাটটা অন্ধকার হয়ে রয়েছে।দেয়াল হাতড়ে সুইচ খুঁজে লাইট অন করলো মায়া।হাতে বাজার ভর্তি ব্যাগটা কিচেনে রেখে রুমে এসে ফ্যান ছেড়ে বসলো সে।হুট করে একটা মৃদু শব্দ আসা শুরু করলো।শব্দটা খুব বেশী সম্ভবত পাশের রুম থেকে আসছে।শব্দের উৎসটা জানার জন্য মায়া পাশের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
পাশের রুমের দরজা হাট করে খোলা।রুমের ভিতরে উঁকি দিয়ে কিছু একটা দেখেই মা গো বলে চিল্লিয়ে মায়া দৌড় দিলো।
দৌড়ে মেন দরজায় যাওয়ার আগে কারো সাথে ধাক্কা লেগে নিচে পরে গেলো মায়া।
“মায়া তুমি কি বিড়াল প্রজাতির যে সবসময় এরকম দৌড়াদৌড়ি করো।”
সামনে থাকা ব্যাক্তিকে দেখে মায়া মনে হলো কিছুটা ভরসা পেলো।তারপরও জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে নিতে বলল,
“দুর্বা তোমার রুমে দেখো কি যেনো আছে।”
“কি আছে?”
“জানিনা কিন্তু মানুষ নয়।”
“তাহলে কি অমানুষ!আসো দেখিতো কি।”
মায়ার হাত ধরে তাকে টেনে তুলে দুর্বা রুমের দিকে আগালো।রুমে গিয়ে দেখতে পেলো রুমের সব স্বাভাবিক।
“মায়া সব তো ঠিক আছে।তাহলে কি দেখে ভয় পেলে?”
“আমি এখানে মানুষের মুখের মতো কিছু একটা দেখেছি।আবার শব্দও শুনেছি।”
“তুমি তো সবসময় দেখো।এখানে বসো মায়া।”
মায়াকে পাশে বসিয়ে বলা শুরু করলো দুর্বা,
“তুমি এইযে বিভিন্ন জিনিসে মুখের অবয়ব,তারপর হঠাৎ করা বাতাসের শব্দে ভয় পাওনা এটা জানো কি বলে?প্যারিডোলিয়া।Pareidolia শব্দটি দুটি গ্রীক শব্দ para (পরিবর্তিত, পাশাপাশি) এবং eidolon (ছবি, আকৃতি) নিয়ে গঠিত। এই বৈশিষ্ট্যের সবচেয়ে সাধারণ প্রভাব হচ্ছে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত নকশার মধ্যে মানুষের মুখাবয়ব খুঁজে পাওয়া।
প্যারিডোলিয়া আত্মরক্ষার একটি কৌশল যা বিবর্তনের ধারায় মানুষের মধ্যে উৎসাহিত হয়েছে। মূলত জন্মলগ্ন থেকেই মানুষের মধ্যে অপর মানুষের মুখাবয়ব চিনে নেয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। একটি শিশুর জন্মের দুদিনের মধ্যেই সে অন্যান্য মানুষের বিভিন্ন মুখভঙ্গি শনাক্ত করা এবং সেগুলো অনুকরন করা শিখে ফেলে। শিশুর বয়স যখন সাতমাস হয় তখন সে একটি ভীতিপূর্ণ মুখভঙ্গী এবং একটি হাসিখুশী মুখভঙ্গীর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং ভীতিপূর্ণ মুখভঙ্গীর প্রতি বেশী মনোযোগ দেয় যা তাকে বিপদ-আপদ থেকে সতর্ক থাকার অভ্যাস তৈরি করে দেয়।”
“তার মানে আমি পাগল দুর্বা?এটা অনেক বড় রোগ?”
“মায়া তুমি কি সিরিয়ালের নায়িকা যে এত সহজ সরল?আমি কোথাও মেনশন করিনি এটা একটা রোগ।এটা সবার সাথেই হয়ে থাকে। দেখো মায়া একটু তো সেনসিবল হতে শিখো।তোমার জীবন এমনিতেও অনেক কঠিন।তোমার এখন অনেক শক্ত হতে হবে।আরিয়ান স্যারদের মতো মুখোশধারী মানুষদের চিন্তে হবে।আমি ভাবতেও পারিনা আমার মেন্টর আরিয়ান স্যার কীভাবে ফেম এর জন্য তোমাকে ইউস করতে পারলো।তাও রক্ষা তোমরা ফিজিক্যাল হওনি।তা নয় এখন কেঁদে কুল পেতে না।মানুষ চিন্তে শিখো মায়া কারণ সমাজে আরিয়ান স্যারের মতো মানুষের অভাব নেই।”
দুর্বার কথায় কোনো জবাব দিলনা মায়া।আরিয়ানের কলেজের স্টুডেন্ট দুর্বা।মেডিকেল থার্ড ইয়ারে পড়ে।আরিয়ানকে বেশ সমীহ করে।কিন্তু এখন মায়ার সাথে ঘটে যাওয়া কাহিনি থেকে করতে পারছেনা।খুব খারাপ লাগে মায়ার জন্য মাঝেমধ্যে দুর্বার।মেয়েটার সবথেকেও কিছু নেই।আর যতোটুকু আছে তা কেড়ে নেওয়ার জন্য কিছু মানুষ উঠে পড়ে লেগেছে।
চলবে,,