ডাকপাড়ি পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
290

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২৮
#আফনান_লারা
________
ছেলেটির কথায় দোকানদার কোনো পাত্তাই দিলেননা। তার শুধু চোখের সামনে ভাসছে সেই সুন্দরী রমনীর রুপের হাওয়া।বেশ কিছুক্ষণ কল্পনায় সাঁতার কেটে তিনি ছেলেটির দিকে ফিরে পুরনো প্রশ্নের জবাবে বললেন,’গাছ ভাল হলে ফল ও ভাল হয়’

‘ছেলের মা সুন্দর,ছেলেও সুন্দর বুঝলাম।কিন্তু আমরা মেয়েপক্ষরা তো ছেলের রুপ দেখবোনা।আমরা দেখবো ছেলের চারিত্রিক গুণ,ছেলের ইনকাম আরও কত কি!রুপের সাথে তো মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিনা’

‘একটা কথা বলা ধরলে যদি কেউ মাঝখানে থামিয়ে দেয় ঐ ব্যাক্তিকে আমার মন চায় হাবিজাবির টাংকিতে চুবাই।যাই হোক,তুমি ছোট মানুষ।তোমায় বকা দিয়ে কি লাভ।চুপ করে খালি আমার কথা শুনো তারপর নিজের মত পেশ করবা।কারোর কাছে কিছু জানতে আসলে আগে তার কথাটা শুনে নিতে হয়।মাঝখান দিয়ে নিজের মত পেশ কেন করবা?’

ছেলেটা নড়েচড়ে বললো,’ঠিক আছে আপনি বলতে থাকুন।আমি শুনছি’

দোকানদার এবার ঠিকঠাক হয়ে বসে চায়ে চিনি দিয়ে নাড়তে নাড়তে বললেন,’চেহারা তো সুন্দর,সেটা আপাতত বাদ।এবার বলি ছেলের ব্যবহার। খুব ভাল,অত্যন্ত ভদ্র।বলতে গেলে ভদ্র ছেলে এই ছেলেটাকে দেখলে শরম পাবে।এত বেশি ভদ্র!তারপর বলি চারিত্রিক গুণের কথা।হায়রে এত ভাল ছেলে আমি আর দেখি নাই’

দোকানদারের কথা শুনে ছেলেটার মুখে হাসি জমতে জমতে মনে হয় এইবার ব্লাস্টই হয়ে যাবে।পানসে চা টুকুও খুব ভাল লাগছে তার কাছে।দোকানদারের বলা কথা সাথে চা
আহা সব জমে ক্ষীর!!!

দোকানদার বলছেন,’মানুষ বাইরে প্রেম করে,জানাজানি হয়, পরিবার নিয়ে ঝামেলা হয়।কিন্তু এই ফারাজ ছেলেটা কত ভাল সে একেবারে বাড়ির ভেতরে মেয়ে রেখে প্রেম করে।এরকম জ্ঞান কজনের থাকে?’

এই কথা শুনে ছেলেটার চা খাওয়া আটকে গেছে।কপাল কুঁচকে বললো,’সেটা আবার কেমন কথা?ঠিক বুঝলাম না’

‘আহা বুঝলেনা?মানে হলো ফারাজদের বাড়িতে ওদের দূর সম্পর্কের একটা মেয়ে থাকে।সেই মেয়ের জন্য ফারাজের যে টান!একেবারে খাপে খাপ!!দুজনকে যা মানায়!!’

‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন ফারাজ ঐ মেয়ের সাথে সম্পর্কে আছে?’

‘তা নয়ত কি?দূর সম্পর্কের আত্নীয়র জন্য এত দরদ আসে কই থেকে হ্যাঁ?
আপন আত্নীয় গুলোর খবর নাই আর সে দূর আত্নীয়র জন্য জীবনে যা করে নাই তা আজ করছে’

‘কি করছে?’

‘দৌড়াদৌড়ি’

ছেলেটা কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালো।পেশায় সে একজন ব্যবসায়ী।রড,সিমেন্ট,বালুর ব্যবসা করে।চাঁদপুরে তার দোকান।ঢাকাশহরে তার বড়বোনের বাসা।যে বোনের জন্য ফারাজকে সে দেখতে এসেছে সে হলো ওর মেজো বোন।প্রতিবেশীদের থেকে আগে খোঁজ নেয়া ঠিক মনে করে আগে সে এই কাজটায় করেছে কিন্তু এরকম একটা ভাল প্রস্তাবের এমন নেগেটিভ রিভিউ আসবে,কে জানতো!আদৌ কি ছেলেটা এত খারাপ?
অনেকসময় দেখা যায় প্রতিবেশীরা সত্যি বলে আবার মিথ্যাও বলে।এখন এই দোকানদার কোনটা বলছে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা ঠিক হবেনা।আরেকটা কথা হলো নিজের চোখে দেখবেই বা কি করে!

ছেলেটা ওসবই ভাবছিল সেসময় দেখলো সুতির শাড়ী পরা একটি মেয়ে ওর সামনে দিয়ে হেঁটে গেট খুলে ভেতরে যাচ্ছে।আচ্ছা এই মেয়েটাই কে সেই?
অনেক ভেবেচিন্তে ছেলেটা ডাক দিলো মেয়েটিকে।মেয়েটি আসলে পূর্ণা ছিল।বাজারে ফেক্সিলোড করতে গিয়েছিল সে।ফেরার পথে তাই ছেলেটার সাথে দেখা।

‘আমি শাহেদ,ফারাজের ক্লাসমেট। আপনি কি বলতে পারবেন ওর বাসাটা কোনদিকে?আপনি তো এই বাসায় থাকেন তাইনা?আসলে আমি এ প্রথম আসলাম ওকে সারপ্রাইজ দিব বলে’

পূর্ণতা হেসে বললো,’আরে এটাই তো ওনার বাড়ি’

ছেলেটি এবার পূর্ণতার সাথে বাড়িতে যেতে যেতে বললো,’ফারাজ কি সেই আগের মতনই আছে নাকি বদলে গেছে?’

‘কি আর বলবো!! যে বদমেজাজি উনি।আগে কেমন ছিলেন জানিনা তবে আমার সাথে দেখা হবার পর থেকে হুমকি,দামকি ছাড়া কথাই বলেননি’

‘কিরকম হুমকি?’

‘এই যে ওনার থেকে দূরে দূরে থাকতাম।মনে হয় ওনার মেয়েদের উপর এলার্জি আছে’

‘হাহাহা।আগেও ছিল জানতাম।এখনও আছে বুঝি?’

‘হ্যাঁ আছেই তো। দাদাজান ওনার বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছেন।এবার যদি তার এলার্জিটা কমে বউ পেয়ে’

‘আপনার কাছে ফারাজকে কেমন লাগে?’

‘করলার ভেতর লাল যে আবরণ থাকেনা?ঠিক সেটার মতন।’
———
সারথি অধরার হাত ধরে বলে,’আমার বারবার মনে হচ্ছে তোমার ভাইয়া আছেন।উনি কি সত্যি চলে গেছেন নাকি আওয়াজ না করে পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন?’

অধরা মনে মনে ভাবলো সারথির অনুভব করার ক্ষমতা আছে অনেক।আপাতত সে কথা কাটিয়ে বলে এটা কেবলই সারথির মনের ভুল ধারণা।এই কথা বলে সে ওখান থেকে চলে যায়।সারথির মন তখনও মানছিল না বলে সে একটু একটু করে এগিয়ে রুমে ঢোকার যে দরজা আছে বারান্দাতে, সেটার কাছে এসে নাক টান দিলো।আনাফের গায়ের আতরের গন্ধ না থাকলেও যে গন্ধটা আছে তা খুব কম মাত্রায় পেলো সারথি।কিন্তু আনাফ কেন এমনটা করবে তা ভেবে মনের ভ্রান্ত ধারণা ভেবে সারথি চলে এসেছে রুমে।
বাড়ির কেউ একবার তার খোঁজ নেয়নি।

“তারা কি জানে আমি কোথায়?নাকি আমায় আর তাদের প্রয়োজন নেই?এটা হতে পারে তারা ধরে নিয়েছে আমি সজীবদের বাসায় ফিরে গেছি,নাহলে আর কেউ না দিক ফারাজ একবার হলেও কল করতো আমায়।”

আনাফ দূরে থেকে সারথির মন খারাপ দেখে ভাবছে মেয়েটা কি হাসতে জানেনা?সারাক্ষণ মুখটা ভার কেন করে রাখে?আচ্ছা কি করলে তাকে হাসানো যায়?ফানি কিছু দেখালে হাসতে পারে।কিন্তু সে তো দেখতে পাবেনা।

“তাহলে কি এমন করতে পারবো যেটাতে মেয়েটার মুখে হাসির বৃষ্টি ঝরবে?আমি তো এটাও জানিনা সারথি কিসে বেশি খুশি হয়।এ ব্যাপারে ফারাজ ভাল বলতে পারবে কিন্তু ওর নাম্বার কই পাবো!”
——–
মিসেস সোনালী আজ একবার সজীবের মাকে ফোন করেছেন।প্রথমবার তিনি ধরেননি কিন্তু পরেরবার ধরেছেন।দুজনে দুজনের খোঁজখবর নিলেন শুরুতে।পরে সোনালীকে বললেন,’সারথি কেমন আছে?’

সজীবের মা আশ্চর্য হয়ে গেছেন এই কথা শুনে।
“সারথি কেমন আছে মানে?সারথি তো আপনাদের বাড়িতে’

এই শুনে মিসেস সোনালীর হাত থেকে ফোনটাই পড়ে গেলো।ছুটে গেলেন ফারাজের কাছে।ফারাজ তখন অর্ককে অঙ্ক করাচ্ছিল।মা ঝড়ের গতিতে তেড়ে এসে বললেন,’ফারাজ রে।আমার সারথি তো আবার একা একা বেরিয়ে গেছে।আমি ভাবছিলাম সে সজীবদের বাসায় আছে।এখন তো শুনলাম ওখানেও নেই।তুই ওকে আমার কাছে নিয়ে আয়।কিছু একটা কর!কবে থেকে নেই তাও তো জানিনা।এত ব্যস্ততার মাঝে সারথির কথা মাথা থেকে একেবারে বেরিয়ে গেছিলো’

ফারাজ হাতের কলম ফেলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।যাবার পথে শাহেদ আর পূর্ণতার সাথে দেখা হলো।পূর্ণতা চেঁচিয়ে বললো,’আরেহ দাঁড়ান!! আপনার ক্লাসমেট এসেছে’

ফারাজ কোনো কথা না শুনেই চলে গেছে।শাহেদ ওকে ছুটতে দেখে ভাবছে আবার কি হলো ফারাজ তো নাকি সচরাচর ছোটাছুটি করেনা।

পূর্ণতা শাহেদকে বসতে বললো।কিন্তু শাহেদ এখন বসবেনা বলে ঠিক করে এসেছিল।সে আসলে তার বড় বোনকে নিয়ে আসবে এই বলে দরজা অবধি এসেই চলে গেছে।পূর্ণতা আর জোরাজুরি করেনি।সে একাই বাড়িতে ঢুকে দেখলো মিসেস সোনালী মুখে আঁচল ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
পূর্ণতা কিছুই বুঝতেছেনা এই বাড়িতে আসলে কি হচ্ছে।মিসেস সোনালীর কাছে এসে তাই সে জানতে চাইলো কি হয়েছে।তিনি জানালেন সারথির কথা।
তখনই পূর্ণতার মনে পড়লো আনাফের কথা।সে বললো হয়ত আনাফের কাছে থাকতে পারে।আনাফের নাম্বার আছে কিনা।দূর্ভাগ্যবশত আনাফের নাম্বার তাদের কারোর কাছে নেই।ফারাজ বিনা ঠিকানায়,বিনা তথ্যে সারথিকে খুঁজতে রাস্তায় নেমে গেছে।
চোখের সামনে তার সব ঝাপসা লাগছে।সারথি গায়েব আর তারা এই ব্যাপারটা মাথাতেই নেয়নি।কবে থেকে গায়েব কে জানে,কেমন আছে কোথায় আছে সেসব ভাবতেই ফারাজের গা গুলিয়ে আসছে।
———
কলিংবেল বেজেছে। ফোমওয়ালারা এসেছেন ফোম দিয়ে যেতে।সারথির কানে কথাটা গেলো।অধরা এসে বললো একটু সরে দাঁড়াতে।তোষক সরিয়ে ফোম বসাবে বিছানায়।সারথির বেশ মনে আছে ঘন্টা খানেক আগে সে শক্ত বিছানা নিয়ে আফসোস করছিল।কথাটা অধরা শুনেই কি এই ব্যবস্থা করেছে?

অধরার কানের কাছে তখন আনাফ ফিসফিস করে বলে দিয়েছে সারথি যদি জানতে চায় হঠাৎ ফোম কেন বদলাচ্ছে তাহলে বলতে যে আগে থেকেই বদলানোর কথা ছিল।

আনাফ খুব ভাল করে জানে সারথির মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।এবং সে অধরাকে পাকড়াও করবে এই ব্যাপারে।এত সাবধান থাকার পরেও আনাফের মনে হয় একদিন সে ধরা খাবেই।সারথি চোখে দেখেনা তো কি হয়েছে তার অনুভব করার ক্ষমতা প্রখর।

সারথি অধরার কাছে আর কিছু জানতে চায়নি।এই রুমটার আয়নায় ফ্রেম লাগানো নেই।হয়ত পরে লাগানো হবে এই ভেবে দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা আছে।সারথি আয়নাটা ছুঁতেই বুঝতে পারলো এটাতে হাত কাটা যেতে পারে তার অসাবধানতায়।মাথায় একটা বুদ্ধিও আসলো তার।মুখে হাসি ফুটিয়ে আয়নায় হাত বুলিয়ে দেখতে দেখতে বিনাকারণেই চিৎকার করে বললো সে হাতে ব্যাথা পেয়েছে।আনাফ তখন দূর থেকে ওকেই দেখছিল।অধরা ছিল তার রুমে।সে শুনতে পায়নি।
আনাফ এক দৌড়ে এসে সারথির হাত ধরে বললো,’কোথায় ব্যাথা পেলেন?’

সারথি হাসলো।হাসতে হাসতে বললো,’ঘুঘুকে ফাঁদে ফেলতে পেরেছি হাহাহাহা’

সারথিকে খিলখিল করে হাসতে দেখে আনাফ যে ডোজ খেলো সেটা ভুলে সারথির চমৎকার হাসিটাই দেখে যাচ্ছে।আর কত মুগ্ধ হবে একটা মানুষের প্রতি।সারথি হাসির কারণে কিছু বলতেই পারছেনা।শুধু হেসেই যাচ্ছে।আনাফ ওর হাত ছেড়ে কপাল কুঁচকে বললো,’তাহলে এই ছিল পরিকল্পনা?’

‘ধরা খেলেন।এটা আপনারই বাসা।এত লুকোচুরির কি আছে বুঝলাম না’

‘আমি বাসায় থাকলে আপনি তো ভাববেন খারাপ কিছু করে বসবো’

‘বলতেও পারি,যদি আশেপাশে ঘুরঘুর করেন তবে।’

‘আপনি সত্যি হাতে ব্যাথা পাননি?’

‘আমি ব্যাথা পেলে চেঁচাইনা’

‘ধরা খেয়ে ভালই হলে।অন্তত এটা জানতে পারলাম আমি এই বাসায় থাকলে একটা মানুষের অসহজবোধ হবেনা’

সারথি আর কিছু না বলে চুপচাপ বিছানা খুঁজে বসে পড়ে।আনাফ ওর দিকে ফিরে আবার বললো ফারাজের নাম্বার আছে কিনা ওর কাছে।
———-
‘ভাই আপনি যে ফারাজকে নিয়ে বললেন তার সবটাই তো মিথ্যে।আমি গিয়ে পরোক করে এসেছি’

‘তুমি যাহা দেখিয়াছো তাহার সবখানাই ভুল,বেঠিক!
আর আমি যাহা বলিয়াছি তাহার সবখানাই সঠিক’

‘আরে কবিতা শুরু করলেন কেন?আমি সত্যি বলছি।নিজের চোখে দেখে আসলাম।ওদের তো প্রেমিক প্রেমিকা মনে হলো না একবারও’

‘প্রেমিক প্রেমিকা অচেনা এক ছেলের সামনে নিজেরদের প্রেম দেখাবে?এত বড় দামড়া ছেলে হয়ে এই টুকু বুঝোনা মিয়া!! আসছো নিজের বোনরে বিয়া করাইতে।যাও তো ভাগো’

‘আহা রাগ করছেন কেনো।আমি তো যা দেখলাম তাই বলছি’

‘বয়স অনুযায়ী দেখার ভুল।দেখি এই কাপটা দেখে বলো কি দেখতেছো?

‘কি দেখবো!খালি একটা কাপ।আর কি?’

‘উহু!! কাপটায় লিবিস্টিক লেগে আছে।মানে হলো,এই কাপের চা একটা মেয়ে খেয়ে গেছে।তাহলে বুঝো তুমি কি দেখলা আর আমি কি দেখলাম?’

চলবে♥

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২৯
#আফনান_লারা
________
লোকটার কথায় দম আছে কিন্তু কেনো যে বারবার মনে হচ্ছে তিনি ফারাজের ব্যাপারে বানিয়ে বানিয়ে বলছেন।প্রতিবেশী হয়ে এতকিছু বলার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে?ওনার কি ফারাজের সাথে কোনো শত্রুতা আছে?
দোকানদার শাহেদকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে বলেন,’মামা তুমি আরও এক কাপ চা নাও।আমার কাছে ফারাজের ব্যাপারে আরও কথা আছে’

‘দেখুন একটা কথা বলি আপনাকে,আমরা খুব সাদাসিধা পরিবারের মানুষ।আমার বোন ও খুব সাদা মনের। তাই আমি ভেবেছি “হাবিজাবি” বাড়ির মানুষরাও তেমন।এদের বাড়ির ছেলে ফারাজকে নিয়ে আমায় খবর দিয়েছিল আমার এক বন্ধু।সে ফারাজের ক্লাসমেট ছিল। তার থেকে ফারাজকে নিয়ে যা যা শুনেছি আর আপনার থেকে যা যা শুনছি তার মাঝে আকাশ পাতাল তফাত দেখছি।তাই আমি নিজে একবার ফারাজের সাথে কথা বলে দেখবো।তাছাছা আমার পরিবারের লোকজনও যাচাই বাছাই করবেন।তাড়াহুড়ার কিছু নেই।
আর একটা কথা,আপনার চায়ের পানি কষে না।পানি কষাবেন ভাল করে তাহলে চা স্বাদ হয়।আজ আসি’

শাহেদ চলে গেছে।দোকানদার রাগ করে ব্যবহার করা পুরোনো চাপাতার বালতি নিয়ে পেঁপে গাছের তলায় এসে ঢাললেন, তারপর বিড়বিড় করে বললেন,’সোনালী আমার প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে মানিককে বিয়ে করেছিল।আমি এর শোধ তুলবোই।একদিন না একদিন ঠিক তুলবো’
——–
পূর্ণতা নিজেও বের হয়েছে সারথিকে খোঁজার জন্য।
ফারাজের মাথা ঘুরছে সারথির কোনো খোঁজ না পেয়ে।আশেপাশে যাকেই দেখছে তার কাছেই সারথিকে নিয়ে জিজ্ঞেস করছে তাও কোনো তথ্য পায়নি।মাথা কাজ করছেনা।সারথি না বলে কোন সময় যে বেরিয়ে গেলো।
দিশেহারা হয়ে একটা দোকানের পাশে রাখা টুলে বসে পড়ে ফারাজ।এখন কোথায় খুঁজবে।কি দিয়ে শুরু করবে তাই ভাবছিল।
সেসময় পূর্ণতা এসে সামনে দাঁড়ায়।ওর ও একই অবস্থা।কপালভর্তি ঘাম,হাঁপিয়ে যাচ্ছে শুধু।ফারাজ ওকে দেখে কোনো কথা বলেনি।মাথা নিচু করে বসে আছে শুধু।পূর্ণতা এক বোতল পানি কিনে ছিপি খুুলে ওর দিকে ধরে বললো,’হয়ত আমি জানি আপু কোথায় আছেন’

‘কোথায়?’

‘আনাফ ভাইয়ার কাছে,ঐ যে ঐদিন আপুকে দিতে আসলোনা?’

‘আনাফ ভাই এসেছে সারথিকে বাঁচিয়েছে বলে পরে দিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিল।তার মানে কি প্রতিবার ওর সাথে সারথির দেখা হবে?এটার কোনো লজিক আছে?’

‘যেহেতু কোথাও খোঁজ পাচ্ছেন না,একবার আনাফ ভাইয়ার কাছে গিয়ে দেখা করলেই হয়ত সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

কথাটা ফেলে দেয়ার মতন ছিল না,কিন্তু সমস্যা হলো কোথায় গেলে আনাফকে পাবে।

এই কথা শুনে পূর্ণতাও ভাবতে বসেছে।অনেকক্ষণ ভাবার পর তার মনে পড়লো সেদিন সারথি আপুর যেখানে এক্সিডেন্ট হয়েছিল সেখানে সদর হসপিটালে আনাফ ডাক্তার হিসেবে এসেছিল,এ কথা আনাফ নিজেই বলেছে।তার মানে ওখানে গেলে ওর নাম্বার পাওয়া যেতে পারে।এই কথা ফারাজ শুনতেই বোতল রেখে দিলো এক দৌড়।পূর্ণতাও ছুটেছে ওর সাথে সাথে।হাসপাতাল টা বেশি দূরেনা বলে ওরা দুজনেই ক্ষিপ্রগতিতে ছুটছে।পাঁচ মিনিট দৌড়ানোর পর তারা হাসপাতালের সামনে এসে হাজির হয়।ভেতরে গিয়ে যেখানে সিজনালি ডাক্তার বসেন সেই চেম্বারে গিয়ে নার্সকে তারা তারিখ বলে সেইদিনের ডাক্তারের নাম ও নাম্বারের তালিকা চাইলো।নার্স দিতে চাইছেনা।দিতে পারা খুব সহজ কিন্তু নার্সটি বারবার ঘুরাচ্ছিল।যেন তার এক্সের ফোন নাম্বার চাইছে পূর্ণতা।
শেষে একশো টাকার একটা কচকচে নোট খামে পুরে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে ফারাজ।ওমনি নার্সটা একটা ফাইল খুলে নাম- নাম্বার সব ফারাজের হাতে তুলে দিলো।পূর্ণা আর ফারাজ দুজন মিলে নাম চেক করতে করতে সবার শেষে আনাফের নাম পায়।দুজনেই এখন মহাখুশি।এবার ফোন বের করে কল ও করেছে।
আনাফ সেসময় শাওয়ারে ছিল।তার ফোনের সাউন্ড এত বেশি ছিল যে সারথি সহ অধরাও শুনেছে।অধরা তখন টেবিলে উঠে ফ্যান পরিষ্কার করছিল।তাই সে কলটাকে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি।সারথি আওয়াজ শুনে দেয়াল ধরে ধরে রুম থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে আনাফের রুমের কাছে এসে থামলো।তারপর দরজায় হাত রাখতেই সেটা খুলে গেছে।এবার আরও সামনে গিয়ে ফোন যেখানে সেখানে এসে হাতে নিয়েছে সে।এই নিয়ে ৩য় কল ছিল।সারথি আসতে আসতে দুবার কাটা গিয়েছিল।সারথি মুখের কাছে নিয়ে ফোন রিসিভ করার চেষ্টা করছে। ফোনটা অনেক ঘাঁটাঘাঁটির পর শেষে রিসিভ হয়েছে।
ওপাশ থেকে ফারাজ বলে উঠলো,’আনাফ ভাই আমি ফারাজ।’

এটা শুনে সারথির মুখের কথা আটকে গেছে।কি বলবে জবাবে তা ভাবছে।সেসময় আনাফ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছিল।সারথিকে মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে জানতে চাইলো কি হয়েছে।
সারথি কিছু না বলে ফোন রেখে চলে যাচ্ছে।আনাফ তখন ফোন তুলে কানে ধরার পর ফারাজ আবার বললো,’ভাইয়া শুনতে পাচ্ছেন?আমি ফারাজ বলছি’

‘ফারাজ মানে সারথির ভাই ?হাই কেমন আছো?’

‘ভাল নেই ভাই।সারথি কাল থেকে বাসায় নেই।কোথায় গেছে জানিনা।আপনি বলতে পারবেন সে কোথায়?’

‘সে আমার কাছে আছে’

‘সুস্থ আছে তো?’

‘হ্যাঁ,তুমি এক কাজ করো।আমি ঠিকানা দিচ্ছি, তুমি চলে আসো।তোমায় দেখলে হয়ত ওর মন ভাল হবে’

‘হ্যাঁ।এখনই দিন।আমি আসতেছি”

আনাফ ঠিকানা মেসেজ করে পাড়িয়ে দিয়েছে।সারথি রুমের বাইরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সব শুনছিল। আনাফ ফোন রেখে রুম ছেড়ে বের হতেই দেখে সারথি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে।আনাফ তখন ওর সাথে কিছু কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু কেমন করে যেন সারথি ওর উপস্থিতি টের পেয়ে যায়,সে চলে গেছে ওখান থেকে। ফারাজকে ঠিকানা দেয়া নিয়ে কি সারথি রেগে আছে নাকি অন্য কারণ?
‘আমার মতে ফারাজকে জানিয়ে ভুল করিনি। তাহলে সারথি এড়িয়ে চললো কেন?’

আনাফ গেলো অধরার কাছে।অধরা চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে ফ্যান মুছতেছিল।ওকে বলে কয়ে নিচে নামিয়ে আনাফ তাকে সারথির কাছে পাঠালো।শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে।সারথির মন খারাপ কেন সেই কারণ জানার জন্য।

অধরা আনাফের শেখানো মতন সারথির কাছে এসে টুকুস করে বসে পড়ে।সারথি তখনও চুপ করে ছিল।অধরা হাত নিয়ে সারথির কানের পাশের চুল সরিয়ে বললো,’তোমার কানের দুল অনেক সুন্দর’

কথাটা শুনে সারথি চট করে কান থেকে দুল খুলে বললো,’তুমি নিয়ে যাও’

‘এমা!সুন্দর বললে বুঝি সেটা দিয়ে দিবে?’

‘আমি এমনই।আমার কোনো জিনিস কারোর পছন্দ হলে সাথে সাথে দিয়ে দিই।নাহলে পরে ঐ জিনিসটা যতবার পরি আমার মন খারাপ হয়’

‘এটা আবার কেমন কথা?না না এটা আমি নিতে পারবোনা।সুন্দর বলেছি কারণ এটা তোমার কানেই সুন্দর লাগছে’

সারথি আবারও চুপ। অধরা এবার ওর হাত ধরে হাতের আঙ্গুল গুলো দেখতে দেখতে বললো,’তোমার কি মন খারাপ আপু?’

‘হুম’

‘কেনো?’

‘কাল থেকে আমি বাসাতে নেই।অথচ আমার খোঁজ এখন নিলো আমার ভাই’

‘হয়ত মনে ছিল না,বা অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল।আনাফ ভাইয়াও তো আমার কথা ভুলে যায় কাজের চাপে।মাসে একবার কল দেয় জানো?’

‘ফারাজ আমাকে দিনে দুইবার করে কল দিতো।সেখানে গোটা একদিন সে কলই দেয়নি এই বিষয়টা আমি হজম করতে পারছিনা’

‘আরে ভাই বোনের মধ্যে এগুলো ধরে বসে থাকলে হয়?তুমি বরং তোমার ভাইয়ার সাথে রাগ দেখিয়ে রাগটা কমিয়ে নিও।’

সারথি আবারও চুপ হয়ে গেছে।দূর থেকে আনাফ ইশারা করে অধরাকে শিখিয়ে দিচ্ছে আরও কিছু বলার জন্য।
সেটা দেখে অধরা আবার বললো,’তোমার ভাইয়ের সাথে আমায় বিয়ে দিবা?’

এটা শুনে সারথির মুখে হাসি ফুটলো। ওর হাসি দেখে অধরা বলে,’আমি কিন্তু পানি গরম করতে পারি,আবার সেই পানি ফ্রিজে রেখে ঠাণ্ডাও করতে পারি।মাল্টিটেলেন্টেড।’

সারথি এবার খিলখিল করে হাসছে।আনাফ ও হাসলো ওর হাসি দেখে।গোসল করে বের হবার পর থেকে একবারও মাথা মুছেনি সে। ঠাণ্ডা লেগে গেছে ওর তাই হাঁচি দিয়ে ফেললো হঠাৎ করে। সারথি আবারও ধরে ফেলেছে আনাফ আশেপাশেই আছে।এবার নিজের উপরই নিজের বিরক্ত লাগলো।সে অন্ধ বলে আনাফ ওর কাছাকাছি থাকে আর সে বুঝতেও পারোনা।বুুঝতে পারলে বের করে দিতো ওনাকে।আশেপাশে এমন থাকতে দিতোনা।
————-
ফারাজ একাই আসতে চেয়েছিল কিন্তু পূর্ণতা ওর পিছু ছাড়বেইনা।সেও যাবে বলে জেদ ধরে বসে আছে।
শেষে বাধ্য হয়ে ওকে নিয়েই চললো ফারাজ।আনাফ যে ঠিকানা দিছে সেটা তেমন একটা দূরেনা, বাস ধরেছে দুজনে।একেবারে পেছনের দুই সিট।পূর্ণতা জানালার পাশের সিটটায় বসে জানালা খুলে দিলো ওমনি ফারাজ বললো,’অতি বাতাসে আমার হাঁপানি শুরু হয়।জানালা বন্ধ করেন’

‘কি গরম সেটা দেখছেন?জানালা বন্ধ করলে বাঁচবো কি ভাবে?’

‘তো মরে যান’

‘আজব কথাবার্তা!আমি জানালা বন্ধ করবোনা’

ফারাজ ঝুঁকে জানালা বন্ধ করে দিয়েছে পূর্ণতার কথা না শুনে।এদিকে পূর্ণতা গরমে হাত দিয়ে বাতাস করার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে।তাও লাভ হচ্ছেনা।মনে হয় মাথার উপর লাভা ভাসছে।ফারাজের অবাধ্য হয়ে আবার জানালা খুলে দিয়েছে পূর্ণতা।এমন করে একবার বন্ধ একবার খোলা করতে করতে শেষে পূর্ণতা জিতে গেলো।কারণ সে জানালা ধরে লেপটে বসে আছে।
এতক্ষণে বাতাসে ফারাজের শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে গেছে।চোখ বন্ধ করে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করছিল।পূর্ণতা জিতে গেছে ভেবে দাঁত কেলিয়ে জানালা দিয়ে যানজট মনযোগ সহকারে দেখছিল।যানজট দেখা মজার কিছু না কিন্তু পূর্ণতার কাছে বেশ মজা লাগছিল।
হঠাৎ হাঁটুর উপর ফারাজের হাত পড়তেই চমকে সে পাশে চেয়ে দেখলো ফারাজ বারবার শ্বাস নিচ্ছে আর কি যেন বলার চেষ্টা করছে। পূর্ণতা ভয় পেয়ে গেছে।ভয়ের চোটে সবার আগে জানালা আটকে ফেললো।তারপর ফারাজের হাতটা ধরে বললো,’কি হয়েছে?কি করতাম?আপনি ঠিক আছেন?’

ফারাজ ইশারা দিয়ে ব্যাগ দেখাচ্ছিল,এই ব্যাগটা আসার পথে বাড়ি ফিরে আবার নিয়ে এসেছিল যদি পথে কাজে লাগে।তার ব্যাগে ইনহেলার আছে।পূর্ণতা ব্যাগ হাতিয়ে ওকে ইনহেলারটা দিলো তখনই।
দশ /পনেরো মিনিট পর ফারাজ স্বাভাবিক হয়।হয়েই পূর্ণতার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকালো।পূর্ণতা চোরের মতন চেয়ে থেকে বললো,’গরমে গলে গেলেও আর জানালা খুলবোনা।মাফ করে দেন’

‘আপনার সাথে এক বাসে ওঠাই আমার অপরাধ। আর একটুর জন্য মরে যেতাম আমি।আমি যে বললাম বাতাসে আমার কষ্ট হয়,আমি কি মিথ্যা বলেছি?’

ফারাজের ফোন বাজছে এবার।চেয়ে দেখলো দাদাজান কল করেছেন।ফারাজ পূর্ণতাকে চুপ থাকতে বলে রিসিভ করলো।

‘তুমি কোথায় ফারাজ?’

‘আমি ফার্মগেট।জ্যামে বসে আছি।সারথির খোঁজ পেয়েছি’

‘ফার্মগেট??আমার বন্ধু আজিজ তোমার সাথে দেখা করবে।যেখানে নামবে সেই জায়গার নাম বলো’

ফারাজ ভয়ে ভয়ে বলে দিলো।দাদাজান অমনি কল কেটে দিছেন।তার বন্ধু আজিজকে ফারাজ চেনে।মানুষকে প্রশ্ন করতে করতে মেরে ফেলবে তারপর সেখান থেকে উঠিয়ে আবার প্রশ্ন করবে।
পূর্ণতা বললো,’কি বলেছে দাদাজান?’

‘ঝামেলায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো আমাদের।এক কাজ করতে হবে’

‘কি কাজ?’

‘চলেন পালাই’

‘কেনো?’

‘একটা পাগলের থেকে বাঁচতে হবে।নাহলে এই দিনে আর বাড়ি ফেরা হবেনা।প্রশ্নে প্রশ্নে বিয়েসাদি করিয়ে বাচ্চাও পয়দা করিয়ে দিবেন।আর আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনা বলেই আপনাকে নিয়ে পালাচ্ছি।কারণ আজিজ দাদু আমাদের একসাথে দেখলে বিয়ে পরিয়ে দিবেন।
এই ফ্রেন্ড সার্কেলের প্রতিটি প্রবীণ ব্যাক্তি একই ধরনের।’

চলবে♥

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩০
#আফনান_লারা
________
জ্যাম থাকাকালীন দুজনেই নেমে পড়েছে বাস থেকে।দাদাজানকে ঠিকানা হিসেবে যেটা বলেছিল ফারাজ, তারা যাচ্ছে তার উল্টো জায়গায়।
ছুটতে ছুটতে গলির পর গলি শেষে দুজনে এসে দাঁড়ায় অন্য গন্তব্যে।এখান থেকে আনাফের বাসা বেশ দূরে।তাও কিছু করার নেই।সামনে যে বিপদ আসতে চলছিল সেটা থেকে বাঁচতে পেরে ফারাজ অনেক খুশি।
এখন তারা আছে একটা ক্যাফের সামনে,ভ্রাম্যমাণ কফি শপ।ফারাজের ইচ্ছে হলে কফি খাবে।তাই পূর্ণতাকে একটা টুলে বসিয়ে দিয়ে গেছে কফি অর্ডার দিতে।সেখানে আবার বিরাট বড় লাইন।ফারাজ গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছে।পূর্ণতা টুলে বসে বসে পা দুলাচ্ছিল হঠাৎ পাশে একজন বয়স্ক লোককে কফি হাতে বসতে দেখে পা দোলানো বন্ধ করে দিয়ে চুপ করে থাকলো।
লোকটি কফি তার পাশের টুলে রেখে পূর্ণতার দিকে চেয়ে বললেন,’তোমার বাসা কই নাতিন?’

‘মাতুয়াইল ‘

‘ওখানে আমার এক বন্ধুর বাসা।তোমাদের বাসার নাম কি?’

পূর্ণতার কাছে অপরিচিত মনে হয়েছে বলে সে ভুলভাল একটা বাড়ির নাম বলে দিয়েছে।লোকটা এবার বললো,’তুমি কিসে পড়ো?’

‘অনার্স ফাইনাল ইয়ার’

‘বিয়ে করেছো?’

‘জ্বী না’

‘করবে?’

‘বাবা মা খুঁজে দিলে করবো।’

‘আমি খুঁজে দিলে করবে?’

‘নাহ।কারণ আমি তো আপনাকে চিনিনা’

‘ঘটকের পরিচয় জেনে কি করবে?তোমার তো জানা উচিত ছেলের ব্যাপারে’

‘জানতে চাইনা’

‘আরে শুনো।ছেলে খুব ভাল।মাস্টার্স পাশ করেছে।পেশায় সে একজন চিত্রকর। খুব ভাল ছবি আঁকে।ছবিগুলো এত এত দামে বিক্রি হয়।তাছাড়া ছেলের মেধা নিয়ে কি বলবো,দারুণ মেধা’

‘তাহলে আঁকাআঁকি না করে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হতে বলেন’

‘সেটাই তো সমস্যা। ছেলের তো ইচ্ছে চিত্রকর হওয়া।’

‘ভাল’

‘হেব্বি লম্বা।একদম বাঁশের মতন দেখতে,মোটা বাঁশ।বিদেশী বাঁশ একগুলো আছেনা? মোটা মোটা ওগুলার মতন।এত লম্বা যে মাথা উপরে করে তাকাতে হয়।তারপর ব্যবহার কি বলবো!!এত ভাল ছেলে আমি জীবনে দেখি নাই।আমার নাতিন যদি ওর থেকে পাঁচ বছরের বড় না হতো তাহলে ওরে নাতিন জামাই করে আনতাম।যাই হোক।তুমিও তো আমার নাতিনের মতনই।বলো তোমার কেমন লাগলো সব শুনে?’

‘ছবি তো দেখলাম না’

‘দাঁড়াও উদাহরণ দিচ্ছি।ঐ যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।সাদা পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা।ঐ যে পাঁচ নম্বরে যে দাঁড়িয়ে আছে একদম ওর মতন দেখতে।হুবুহু!এক মিনিট!আরে এটাই তো সেই যার কথা তোমায় বলছি।খোদার কি কুদরত!!!
বলতে না বলতেই ছেলে সামনে এসে গেলো।আমার আর কষ্ট করতে হবেনা।তুমি বসো।আমি ওরে ধরে নিয়ে আসতেছি’

পূর্ণতা ফারাজকে দেখে চোখ বড় করে চেয়ে আছে।লোকটা সোজা গিয়ে ফারাজকে খপ করে ধরে ওর কাছে নিয়ে এসেছেন।

‘দেখো নাতিন।ওর কথাই বলছিলাম।কি সুন্দর তাইনা?’

ফারাজ ইশারা করে বলছে এটাই আজিজ দাদু।পূর্ণতা কপালে হাত দিয়ে চুপ করে দেখছে কেবল।
আজিজ খান এবার বললেন,’তোমার না সাইনবোর্ডে থাকার কথা ছিল?তুমি এখানে কি করো?’

‘ঐ আসলে কফি খেতে ইচ্ছে হলো তাই’

‘আমি তো সাইনবোর্ডের দিকে যাচ্ছিলাম।যাক ভালো হয়েছে এখানে দেখা হয়ে গেছে।বসো!বসে একসাথে কফি খাবো আর আলাপও হয়ে যাবে’

তিনি জোর করে ধরে ফারাজকে বসিয়ে দিয়েছেন।

অনেকক্ষণ ওদের দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে এরপর তিনি বললেন,’তোমাদের একে অপরকে কেমন লাগছে?’

এই কথা শুনে দুজনেই বলে উঠলো,’অসহ্য’

‘অসহ্য কেন?এখনও তো সংসার করলেনা।সংসারের আগের অবস্থা চলছে এখন।সংসার করার সময় অসহ্য মনে হবে।তার আগে কেন মনে হচ্ছে?তোমরা কি একে অপরকে চিনো?’

দুজনে এবার পড়ে গেলো বিপদে।কি জবাব দিবে তাই ভাবছে।সত্যিটা তো জানাতেই হবে তাই পূর্ণতাই বলে উঠলো সে ফারাজকে চিনে।

‘দ্যাটস গ্রেট।তাহলে আর কি!বিয়ে পাকা ভেবে নিচ্ছি?’
————–
সারথিকে রেখে অধরা চলে গেছে।সারথি চুপচাপ আনাফের পায়ের আওয়াজ শুনছিল।এখন আনাফ ওর থেকে খুব একটা দূরেনা।সে পা টিপে টিপে হাঁটছে সম্ভবত। সারথির ইচ্ছে হলো ধরে আচ্ছা করে পেটাই করতে পরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে বললো,’আপনার বাসায় থাকলে আনাফ নামের সিসি ক্যামেরার আওতাধীন থাকতে হবে?’

আনাফ হাঁটা বন্ধ করে সারথির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।সারথি আবার বললো,’ফারাজ আসলে ওর সাথে আমি চলে যেতে বাধ্য হবো যদি আপনি নক না করে আমার রুমে চোরের মতন ঢুকে আমার দিকে চেয়ে থাকেন তবে’

‘সরি।সুন্দরকে দেখা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তবে যাচ্ছি আমি।আসবোনা হুহ’

আনাফ চলে গেলো।এবং সারথি এটাও বুঝতে পারলো সে সত্যি সত্যি গেছে।লুকিয়ে আবারও আসার চেষ্টা করেনি।সারথি মিটমিট করে হাসছে এবার।অানাফ দূরে এসে সারথিকে হাসতে দেখে নিজেও হাসলো। আজ সে সারথিকে দুবার হাসিয়েছে।এর চেয়ে বড় কিছু আর কি হতে পারে।

সারথি উঠে দাঁড়িয়ে ওয়ারড্রবে হাত রেখে ধীরে ধীরে দরজার দিকে যাচ্ছে।একা বসে থাকতে তার কোনোদিনই ভাল লাগেনা।তাও ভাগ্যের পরিহাসে তাকে সবসময় একাই বসে থাকতে হয়।এখন অধরার কাছে যাচ্ছে সে।শুধু শুধু বসে থাকবে নাহয় গল্প করবে।আনাফ তখন ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে ঐদিকটায় যাচ্ছিল।
সারথি বের হতেই ওর সাথে বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়ে দুজনে দুদিকে পড়ে গেছে।আনাফ নিজেও ব্যাথা পেয়েছিল তাও ব্যাথার কথা না ভেবে উঠে বসে সারথির হাত টেনে ধরে বললো,’ব্যাথা পেলেন?’

‘নিজের বাসায় কোন মানুুষ দৌড়ায়?’

‘কেউ দৌড়ায় কিনা জানিনা তবে আমি ছুটি ‘

‘আর একটুর জন্য আমাকে অন্ধর সাথে সাথে পঙ্গু ও বানিয়ে দিতেন।তাছাড়া ডাক্তার হয়ে ঠাণ্ডা পানি খাচ্ছেন?’

‘এগুলোতে মুখ ডুবিয়ে রাখবো,আমার হেভিট।খাবোনা’

‘ভাল।কথায় কথায় আমার হাত ধরতে হবেনা আপনাকে।’

আনাফ হাতটা ছেড়ে দিয়ে জিভ কামড়ে সারথির দিকে চেয়ে রইলো।সারথি নিজে নিজে হাতের কুনুই মুছতে মুছতে অধরাকে খুঁজতে চলে গেছে।আনাফ নিচ থেকে পানির বোতলটা নিয়ে আবার নিজের কাজে চলে গেছে।

অধরা তার বই খাতা সব বিছানায় বিছিয়ে বসে বসে বলছে,’হে আমার বইগণ!!বিশ্বাস করো!পরীক্ষা শেষ হলে তোমাদের কটকটি আলার কাছে বেচে দেবোনা।যত্ন করে রেখে দিবো আলমারির উপরে।দয়া করে আমার মাথায় কদিন ভাঁড়া থাকো।আমাকে ভাঁড়া দিতে হবেনা।প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ালেই হবে।প্লিজ বই খাতা বোঝার চেষ্টা করো’

সারথি তখন বললো,’বই কথা শুনে?’

‘হ্যাঁ।আমার মতে পৃথিবীর সবকিছু সব দেখে এবং শুনে।’

‘পৃথিবীর সব কিছু সব দেখে না আবার সব শুনেও না।মাঝে মাঝে কজন এগুলো থেকে বঞ্চিত হয় ‘

অধরা বুঝতে পারলো সারথি এমনটা কেন বলেছে।তাই সে এই বিষয়টাকে আর আগায়নি।সারথি ওর কাছে এসে একটা বই সরিয়ে বসলো।অধরা ওর দিকে ফিরে হাসিমুখে বললো,’সেমাই খাবে?’

‘এখন?’

‘হ্যাঁ,আমার আনাফ ভাইয়া খুব ভাল সেমাই বানাতে পারে।ওরে দিয়া বানাই দাঁড়াও’

‘না থাক লাগবেনা’

‘আরে সে তোমার প্রেমে অন্ধ।মাঝ রাতে উঠিয়ে বিরিয়ানি রাঁধতে বললে সুরসুর করে রেঁধে দিবে’

এটা বলে অধরা আনাফকে ডাক দিয়েছে।আনাফ মুখে পানি দিচ্ছিল। অধরার ডাক শুনে দ্রুত চলে আসলো।

‘কি ভাইয়া?আমি ডাকাতে এত জোরে আসলা,সারথি আপু ডাকলে তো মনে হয় ডেকে আর দম ফেলা লাগতোনা, তার আগেই এসে পড়তে’
———–
লেভেনের বাবা সজীবকে সোজা করে বলে দিয়েছেন আগামী দু মাসের মধ্যে তাকে একশো কোটি টাকার মালিক হয়ে দেখিয়ে দিতে হবে তা নাহলে তিনি লেভেনকে তার পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবেন।লোকটা অত্যন্ত লোভী একজন মানুষ তা সজীব খুব ভাল করে জানে,কিন্তু লেভেনের প্রেমে সে অন্ধ বলে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে টাকা কামিয়ে যাচ্ছে তাও কিছুতেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছেনা।
এবার তো ওনার উপর প্রচণ্ড রাগ হয়েছে সজীবের।একমাত্র লেভেনের মুখ চেয়ে সে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়িয়ে গেছে।
উনি চলে যাবার সময় লেভেনকেও নিয়ে গেছেন। তাই মন খারাপ করে সজীব নিজের বাসায় ফিরে এসেছিল।আসতেই মায়ের কল।মা জানায় সারথি নাকি বাসা থেকে মিসিং।
এবার মাথায় আরেক টেনসন এসে বাসা বাঁধলো।অবশ্য এর পেছনে একমাত্র কারণ সজীব নিজেই।
সারথির সাথে সে যেটা করতেছে তাতে করে সারথির নিরুদ্দেশ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
লেভেনের পেছনে ছুটতে ছুটতে সে সারথির জীবনকে নষ্ট করে দিয়েছে।
এখন সারথিকে কোথায় খুঁজে পাবে সবাই।সে এখানে বসে থেকে কি বা করতে পারবে।ফোন খুঁজে সারথির নাম্বারে কয়েকবার কল করে সজীব।রিসিভ করেছে সায়না।তিনি জানিয়েছেন সারথি বাসা থেকে গায়েব,এরপর আবার বলেন ফারাজ নাকি সারথির খোঁজ পেয়েছে।সে যেন চিন্তা না করে।কিছুটা নিশ্চিত হয়ে সজীব দম ফেললো।তাও পুরো নিশ্চিন্ত সে হয়নি।ফারাজ যতক্ষণ না সারথিকে পাচ্ছে ততক্ষণ মনের ভয়টা যাবেনা।

সারথির যদি কিছু হয়ে যায়?সজীব তখন কি করবে?
আজীবন সে অপরাধী হয়ে থেকে যাবে?
আচ্ছা সারথি কি একা থাকবার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে নাকি সুইসাইড করতে?

“যদি তাই হয় তবে মনে হয় আমি অনেক বড় বিপদে পড়ে যাবো।জেল খাটতে হবে তা নিয়ে ভাবছিনা,আমি ভাবছি সারথির জীবন নিয়ে।
আমি চাইনা তার কিছু হোক।ওকে তো ঘৃনা করিনা আমি,বরং ওর আমাকে ঘৃনা করা উচিত।
সজীবের মনে হলো একবার লেভেনকে না জানিয়ে বাংলাদেশ যাওয়া উচিত।সারথির সাথে আলাদা বসে কথা বলে সব ঠিক করে নিলে হয়ত আরও ভাল হবে।
তাই ভেবে ফোন নিয়ে টিকেট বুক করতে বসে সজীব, ঠিক সেসময় লেভেনের কল আসে।
যেন একটা বাধা।বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করেছে সজীব।লেভেন কাঁদছিল।কান্নার কারণে কিছু বলতেই পারছিলনা।
সজীব জানতে চাইলো কি হয়েছে।লেভেন জানায় সে দরকার হলে পালিয়ে আসবে তাও সজীবকে সে হারাবেনা কিছুতেই।
———–
আজিজ খান একসাথে পূর্ণতা আর ফারাজের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছেন মশলা মিশিয়ে।প্রশ্ন করতে করতে দুজনের মাথা ঝিম ধরিয়ে ফেলেছেন।
শেষে ফারাজ পূর্ণতার কানে ফিসফিস করে বললো তাদের আরও একবার পালাতে হবে।নাহলে এমন করে চলতে থাকলে দুজনকেই ফ্যাসাদে পড়ে থাকতে হবে গভীর রাত অবধি।

বুদ্ধি করে দুজনেই একসাথে বলে উঠলো,’আজিজ দাদু ঐ দেখেন আকাশে হেলিকপ্টার!’

আজিজ খান অমনি উপরে তাকালেন আর ফারাজ পূর্ণতা দিলো এক দৌড়।দৌড়ে দৌড়ে দুজনে এক গলিতে গিয়ে গলি শেষ করে হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা তুলে দেখলো তারা আবারও ঘুরে ফিরে আগের জায়গায় চলে এসেছে।আজিজ দাদুর সামনে বরাবর।আজিজ দাদু এখনও আকাশের দিকে চেয়ে থেকে বলছেন,’নাতি-নাতিন! কই আকাশে তো কিছু নেই, কেবল বিকেল বেলার কমলা রঙের মেঘ ভাসছে’

পূর্ণা বললো,’ভাল করে দেখেন সবুজ রঙের হেলিকপ্টার’

এটা বলে দুজনে দিলো আবার দৌড়’

চলবে♥