ডাকপাড়ি পর্ব-৬১+৬২+৬৩

0
312

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৬১
#আফনান_লারা
________
আনাফের গায়ের আতরের গন্ধটা আজ অনেক বেশি করে ভাসছে বাতাসে।সারথি পারছেনা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে।এদিকে আনাফ ওকে না বলে কিছু করবেওনা সেটা ও খুব ভাল করেই জানে আর তাই নিজ থেকেই আনাফের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে।কেন,কি কারণে তারা দাঁড়িয়ে আছে তা দুজনেই জানেনা তবে মূহুর্তটা খুব সুন্দর যাচ্ছে।
আনাফ সারথির ঘাড়ে হাত রেখে ওকে ধরে বলে,’চলো ফাঁকা রাস্তা থেকে ঘুরে আসি’

‘এই রুমই ভাল’

আনাফ অবাক হয়ে সারথির দিকে চেয়ে রইলো।তারপর আবারও জানালার দিকে ফিরে বলে,’কেন?মন খারাপ?’

‘মন ভাল হবার জন্য এই রুমটাই যথেষ্ট ‘

‘এভাবেই সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি?’

‘তো চলুন বিছানাতে বসি,আমি তো দাঁড়িয়ে থাকতেও বলিনি ‘

আনাফ সারথিকে টেনে বিছানার কাছে নিয়ে বসে।দুজনে সেখানে বসে এবার পা দুলাচ্ছে।রুমের ড্রিম লাইটের আলোটুকু আলাদা পরিবেশে নিয়ে গেছে ওদের।সারথির অবাধ্য খোলা চুলগুলো ওর পা দোলার সাথে পাল্লা নিয়ে দুলছে বারবার।আনাফ সেটাই দেখছিল এতক্ষণ। সেসময় সারথি বলে ওঠে,’কি দেখছেন?’

‘আমি যে তাকিয়ে আছি বুঝলে কেমনে?’

‘আমার সামনে থাকলে যে আমাকেই দেখেন সেটা জানি।তাই আর জানতে হয়না’

আনাফ জিভে কামড় দিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে বলে,’আর কি করি বলো!কত সাধনার বউ,কত সাধনা করে তাকে পেলাম।দেখবো না তো কি করবো?’

সারথির মুখে হাসি ফুটে গেলো, তারপর আবারও পা দুলাতে দুলাতে বললো,’আপনি অনেক ফ্লার্ট করতে জানেন’

‘বিশ্বাস করো!জানতাম না।তোমায় দেখে মুখ দিয়ে গড়গড় করে বের হয়ে আসছে এইসব।আমি এমন ছিলাম না।আমার মুখ দিয়ে কোনো মেয়ে ভালবাসার কথা বের করতে পারতোনা।সেই আমি তোমায় দেখে কবি,উপন্যাসিক হয়ে গেছি ‘

সারথি এবার খিলখিল করে হেসে ওঠে।ওর হাসির আওয়াজ শোনা গেলো পূর্ণতা আর ফারাজের রুমে।
পূর্ণতা সেসময় ফারাজের কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিল।সারথির হাসির আওয়াজ পেয়ে ফারাজকে রেখে দিলো এক দৌড়।সোজা দরজার দিকে।ফারাজাও বেশ বুঝতে পারে যে পূর্ণতা ওদিকেই যাওয়ার জন্য দৌড় দিয়েছে।তাই সে শোয়া থেকে উঠে এসে পূর্ণার হাত ধরে আটকালো।

‘না আপনি যাবেন না’

‘আরেহ আপু হাসতেছে।মনে হয় মজার কোনো কথা বলছে।আমি গিয়ে একটু শুনে আসি’

‘নতুুন জামাই বউ হাসবেনা তো কি কাঁদবে?আজব কথাবার্তা! আপনার কি লজ্জা নাই?ওদের দরজা বন্ধ এখন জানেন না?’

‘দরজা খুলতে বলবো’

‘কানের নিচে একটা উত্তমধ্যম চড় দিয়ে আপনার এই ছেলেমানুষি তুলে দিব।চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ুন।আসছে আমার বোন আর বোনের জামাইকে ডিস্টার্ব করার জন্য।আরেহ আমাকে ডিস্টার্ব করেন না,কোনো সমস্যা নাই।আমার বোনকে কেন ডিস্টার্ব করবেন?চুপচাপ গিয়ে ঘুমাবেন এখন’

পূর্ণতা কোমড়ে হাত রেখে ফারাজের দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে বলে,’আমি সাধে করছি এইসব?আপনি আমায় সময় দেন না,আমার সাথে কথা বলেন না।নতুন বউ জামাই অনুভূতি হয় না বলেই তো আমার অন্য দিকে ঝোঁক।আপনি যদি ঠিকঠাক ব্যবহার করতেন তবে তো আমার আরেকজনের টা দেখতে যেতে হতোনা’

ফারাজ মুখ ফুলিয়ে বিছানায় এসে বসে বলে,’মানে কি সোজা করে বলে দেন।এত প্যাঁচ বুঝিনা’

পূর্ণতা চট করে ফারাজের পাশে বিছানায় উঠে বসে বললো,’শুনুন।আপনি আমায় নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছিলেন তাই না?’

‘হুম।তো?’

‘তো আমার সাথে এক রুমে ঘুমাতে আপনাকে সবাই মিলে জোর করাতে হয় কেন?’

ফারাজ চুপ করে আছে এবার।পূর্ণতার কথার জবাব কি দিবে তা সে জানেনা কিন্তু জবাব তো দিতেই হবে,এদিকে জবাবটা তার জানা নাই।বানিয়ে বললেও বিপদ।পূর্ণতার সামনে কথা বানানো অসম্ভব।

‘কি হলো বলুন ‘

‘আপনি কি চাইছেন বলেন?আমি বাদ রাখবোনা’

পূর্ণতা ওমনি ফারাজের গায়ের সাথে লেগে বসে বললো,’আপাতত চাই আমাকে বউ হিসেবে আদর যত্ন করেন।তাতেই হবে’

‘আমি কি অনাদর করতেছি?’

‘ওটাই তো সমস্যা। আপনি কিছুই করতেছেন না।বিষয়টা এমন হয়েছে যে, খাচ্ছি দাচ্ছি আর ঘুমাচ্ছি।আমাদের যে বিয়ে হয়েছে,আমরা য়ে নতুন বউ জামাই সেটা দেখে বোঝা যায়না।কিন্তু জানেন?সারথি আপু আর আনাফ ভাইকে দেখে বোঝা যায় তারা নতুন বউ জামাই’

‘তো কি করতে হবে নতুন বউ জামাই অনুভূতি আনতে হলে?’

‘রাতে বসে গল্প করতে হবে,হাসাহাসি করতে হবে’

‘হাসির কথা না হলে হাসবো কি করে?আমার তো কোনো কিছুতেই হাসি পায়না’

পূর্ণতা ওমনি দাঁত কেলিয়ে ফারাজকে কাতুকুতু দেয়া শুরু করে দেয়।ফারাজ এইটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সে এখন ।তাদের দুজনের রুমের দরজা খোলা ছিল।অর্ক হাতে বই নিয়ো পানি খেতে এসছিল এদিকেই।ফারাজকে চেঁচামেচি করতে শুনে সে এদিকে এসে দরজায় হাত রাখলো ধাক্কা দিতে ওইসময় ফারাজ দরজা খুলে বের হয়ে আসলো।অর্ক ওকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পূর্ণতা ও বের হয়ে গেলো।আবারও ওকে কাতুকুতু দেবে এমন সময় অর্ককে দেখে নিজেকে সংযত রাখলো সে।অর্ক চশমা ঠিক করে বলে,’চাচ্চু তুমি কি চাচিমণিকে ভয় পাও?’

‘না তো’

ফারাজ পাঞ্জাবি টেনে ফু দিলো।পাঁচ মিনিটের কাতুকুতু দিয়ে পূর্ণতা ফারাজের হাল খারাপ করে ফেলেছে।অর্ক পূর্ণতার দিকে চেয়ে বলে,’তুমি কি চাচ্চুকে ভয় দেখাচ্ছিলে?’

‘তোমার চাচ্চু কাতকুতুতে ভয় পায়।সেটা দিয়েছি বলে পালাচ্ছিল,সত্যি কথা বলতে লজ্জা পায়’

ফারাজ কপালে হাত দিয়ে বললো,’ওরে না বলার পেছনে কারণ ছিল আমার।এখন ও পুরো বাড়িসুদ্ধ সবাইকে জানাবে’

এই কথা শেষ করেই ফারাজ দেখে অর্ক উধাও।সত্যি সে সবাইকে বলতে গেছে পূর্ণতা ফারাজকে কাতুকুতু দেয়।
——–
‘ আচ্ছা বাইরের রুম থেকে হট্টগোল কিসের শোনা যায়?আপনি শুনছেন?’

‘হুম।দাঁড়াও দেখে আসি’

আনাফ উঠে এসে দরজা খুলতেই অর্ক ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।সে এদিক দিয়েই যাচ্ছিল।

‘কি ব্যাপার অর্কবাবু?কিছু হয়েছে নাকি?’

‘পূর্ণতা চাচিমণি ফারাজ চাচ্চুকে কাতুকুতু দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে।’

সারথি এ কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে ফেললো।আনাফ পেছনে তাকিয়ে ওর দিকে চেয়ে বললো,’তোমাদের গোটা বাড়িটাই একটা বিনোদনকেন্দ্র।এই খবর এবার আর কাকে জানাবে এই পিচ্চি??”

‘দাদাজানকে জানাবে এবার।পূর্ণতা আর ফারাজ ও কম না।এই কথা বাইরে পাচার হলো কি করে?’
———-
ফারাজ পর্দার আড়ালে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর অর্ক সারা বাড়ি করে এসেছে পূর্ণতা ফারাজকে কাতুকুতু দিচ্ছে।
পূর্নতা শুরুতে এটাকে তেমন একটা গুরত্ব না দিলেও এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে লজ্জার তার চামড়া খসে পড়ে যাচ্ছে।ফারাজ যে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল সেটার পেছনে এসে এবার পূর্ণতাও দাঁড়িয়ে আছে।

‘শান্তি হইছে আপনার?বউ জামাই ফিলিংস আসছে?’

পূর্ণা দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে ফারাজের দিকে কপাল কুঁচকে চেয়ে বললো,’নিজেদের মাঝে জামাই বউ ফিলিংস আনতে চাইছিলাম।ঢাকঢোল পিটিয়ে এমনটা চাইনি আসলে’

‘এখন কেমন লাগছে আপনার?পুরা জামাই বউয়ের সম্পর্কের গুষ্টি উদ্ধার করে দিয়েছে অর্ক।গিয়ে বলেন আর কিছু লাগলে’

‘এভাবে বকতেছেন কেন?আমার কি মনে ছিল নাকি এত কিছু?আর বউ জামাইকে কাতুকুতু দিতেই পারে।এটা স্বাভাবিক।মানুষ জানলে কি হইছে!’

‘ স্বাভাবিক হলে পর্দার আড়ালে আমার সাথে এসে লুকিয়েছেন কেন বলুন?’

‘হেহে!!জামাই লুকিয়ে থাকবে আর বউ বাইরে বাইরে ঘুরবে।বিষয়টা কেমন দেখায় না?’
————
আনাফ ফারাজ আর পূর্ণতাকে পর্দার আড়ালে গিয়ে ফিসফিস করতে দেখে চলে এসেছে ওখান থেকে।রুমে এসে দরজা লাগিয়ে সারথির পাশে বসতেই সারথি জানতে চাইলো বাইরে কি হচ্ছে।

‘তোমার ভাই আর ভাইয়ের বউ দুইজনেই বয়সের তুলনায় একেবারে অপরিপক্ব।অর্ক খবর পাচার করছে দেখে দুজনেই পর্দার আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে আছে।ভাবতে পারো!’

সারথি মাথায় হাত দিয়ে বললো,’ওদের জন্য রুম খালি পড়ে আছে।পর্দার আড়ালে লুকানোর কি দরকার।হায়রে!বিয়ে করে দুজনের মাথাটা পুরো গেছে’

সারথি আর হাসি আটকাতে পারছেনা।হেসেই চলেছে সে।আনাফ বিছানায় পা তুলে গুটিশুটি দিয়ে শুয়ে পড়লো হঠাৎ।মাথাটা রাখলো সারথির কোলে।এতদিনের এই ইচ্ছাটা পূরন করার একটা নির্দিষ্ট সময় খুঁজছিল।সেই সময়টা এসে গেছে বলে পূরণ করে নিলো।
সারথি আনাফের কপালে হাত রাখে।মানুষটাকে এভাবে এর আগে ছুঁয়ে দেখা হয়নি।আনাফের কপালে হাত দিয়েই শিউরে ওঠে সে।
ইশ যদি চোখে দেখা যেতো!মানুষটা কিরকম যদি জানা যেতো!!তার ঠোঁটজোড়া দেখা যেতো!’

আনাফ সারথির বিষণ্ণবদন দেখে জানতে চায় এর কি কারণ।

‘আমি কেন আপনাকে দেখার সৌভাগ্য পেলাম না?’

‘মানুষটাকেই পেয়ে গেছো।চোখে দেখার সৌভাগ্য চাও?পুরো সৌভাগ্য টাই তো তোমার সারথি।যাকে দেখায় পাওনি,তাকে ছোঁয়ায় পাবে।কতটা সৌভাগ্যবতী তুমি ভাবতে পারো?’

চলবে♥

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৬২
#আফনান_লারা
________
সারথির বিয়ের খবর সজীবের বাবাকে আশাহত করে দিয়েছে।তিনি সারথির উপর নয় বরং সজীবের উপর ক্ষেপে আছেন প্রচণ্ডরকম ভাবে।তার মতে সজীবের বেহুদা কার্যকলাপের জন্যই আজকের এই দিনটা এসেছে।সারথির কোনো দোষ তিনি দেখেননা।একটা মানুষকে অবহেলা করলে সে তো অন্যদিকে যাবেই।আর সজীব থাকতে তো সারথি এসব কিছু করে নাই।সজীবের আচরণে আর ডিভোর্সের পরেই আনাফের সাথে সম্পর্ক গড়েছিল।সজীব ও সারথির দোষ দেয়নি।সে দোষ দিয়েছে নিজের কপালের।
যাই হোক দুই দিন দুই রাত বাবার রাগারাগি তো অতীষ্ঠ হয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় মালয়েশিয়া ফেরত চলে যাবে।কারণ দেশে থেকে তার আর কোনো কাজ নেই,যেটা ঠিক করতে এসেছে সেটা বেঠিক হয়ে বসে আছে।এখন আর চিৎকার দিয়েও বিষয়টা আগেরমতন সাজানো যাবেনা।
সজীবের এই সিদ্ধান্ত টাকে বাবা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন।তবে!তিনি ভেবেছেন সজীব মালয়েশিয়া যাওয়া মানে ওকে সহজে আবার বাংলাদেশে আনা অসম্ভব। আর সজীবের কাছে মালয়েশিয়া মানেই হলো লেভেন নামের সেই মেয়েটা।অনেক হারাম সম্পর্ক গড়েছে তারা,এবার নাহয় সব ভুলে মানসম্মান বাঁচাতে ঐ মেয়েটার সাথেই সজীবের বিয়েটা দিয়ে দেয়া উচিত।
অনেক ভেবেচিন্তে তিনি এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন।সজীব মালয়েশিয়া চলে যাবার আগেরদিন রাতে তিনি ওকে ডেকে পাঠালেন নিজের রুমে।
—-
‘বাবা আসবো?’

‘এসো’

বাবা তখন ফোন দেখছিলেন।সজীবকে দেখে ফোন রেখে ওর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।

‘বলতে পারো লেভেন মেয়েটার বয়স কত?’

‘২৬’

‘এত বয়স??কবে থেকে প্রেম করো তোমরা?’

‘কয়েক বছর!

‘যাই হোক,যে দোষী তাকে তার দোষ মনে করিয়ে দিয়ে সময় নষ্ট করতে চাইনা আমি।শুনো,ঐ মেয়েটাকে বলো তার পরিবার নিয়ে আমাদের বাসায় আসতে।তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো’

এ কথা শুনে সজীব যেন আকাশ থেকে ধপাস করে নিচে পড়লো।বাবার দিকে হা করে তাকিয়েই থাকলো শুধু।বাবা ওকে অবাক হতে দেখে আবার বললেন,’এত হা করে তাকিয়ে থাকতে হবেনা।সারথির সাথে যদি লেভেনকে কমপেয়ার করা হয় আমি সারথিকেই বেছে নিব।কিন্তু আফসোস!সারথি আর আমাদের রইলোনা।তোমায় আর ঐ মেয়েটাকে এখন আবার আগেরমতন তো খোলামেলা চলতে ফিরতে দিতে পারিনা।সব কিছুর একটা নাম থাকে তাই আমি চাইছি তোমাদের বিয়েটা দিতে।যেটা বলছি করো।আমার হাতে সময় কম।লন্ডনে ফেরত যেতে হবে।’
———
আনাফ সারথিকে নিয়ে তাদের বাসায় এসেছে।বাবা বাসায় ছিল না তখন। মা আর ফুফুরা মিলে সারথিকে ওয়েলকাম জানায় সুন্দরভাবেই।আনাফ সারথির সাথে সাথেই থাকছিল কিন্তু ওর ফুফাতো বেনেরা দুষ্টামি করে ওকে খোঁচা দিয়ে কত কথা শুনালো যার কারণে লজ্জার চোটে এখন সে সারথির ধারের কাছে গিয়েও বসতে পারছেনা।ওদের কথার ভয়ে সে যাচ্ছেনা মূলত।
সারথির আশেপাশে ওর ফুফাতো বোনেরা সব ঘুরঘুর করছে।

আনাফ দেখলো সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তাও কেউ সারথিকে ওর রুমে আসতে দিচ্ছেনা।যেভাবে সবাই গল্প জুড়েছে, এই গল্প রাত বারোটা পেরিয়ে যাবে তাও শেষ হবেনা।ফুফুদের গল্পের আসর অনেক ভারী।আনাফ খুব ভাল করে জানে।ছোটকালে মা যখন ওকে আর অধরাকে নিয়ে ফুফুদের বাসায় বেড়াতে যেতো, গল্প করতে করতে রাত দুটোর দিকে সকলে ঘুমাতো।এত এত গল্প করতো সবাই।এখনও তাই।আনাফের পেটে কামড় দিলো এই ভয়েই।সারথিকে যে করেই হোক ছলছাতুরি করে তার রুমে আনতে পারলেই হলো,এরপর আর বোনেরা যাই করুক আনাফকে সারথির পাশ থেকে সরাতে পারবেনা।

বুদ্ধি করে আনাফ নিজের রুমের মাঝে গিয়ে দাঁড়ায়।ফোন বের করে কথা বলার এক্টিং করে চেঁচিয়ে বললো,’হ্যালো,হ্যাঁ স্যার।জি স্যার,আমার ওয়াইফ বাসাতেই আছে।দাঁড়ান দিচ্ছি’

এই বলে আনাফ দরজার কাছে এসে বলে,’সারথি একটু এদিকে এসো,আমার হাসপাতালের সিনিয়র একজন সার্জন কল করেছেন।আমার ফ্রেন্ড হয়।কথা বলতে চায় তোমার সাথে,সে এখন কানাডা তাই আসতে পারেনি বাসায়’

সারথি মাথা নাড়িয়ে নিজে নিজে এদিকে চলে আসলো দেয়াল ধরে ধরে।আনাফের ফুফাতো বোনেরা বুঝতেই পারেনি আনাফ নাটক করছে।

আনাফ সারথির হাত ধরে তার রুমে নিয়ে এসে দরজাটা ঠেলে দিয়ে সারথির কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’শুনো।আমি মিথ্যে বলেছি।কেউ কল করেনি। তোমাকে এই রুমে আনার নিঞ্জা টেকনিক ফলো করলাম।চুপ করো বসো এখন ‘

সারথি মুচকি হেসে বিছানায় বসে।আনাফ দম ফেলে দরজাটা আটকাতে যাওয়া ধরতেই দেখে তার ফুফাতো বোনেরা এসে হাজির।

‘কই দেখি কিসের কথা হয়’

আনাফ ভয়ে চোখ বড় করে চেয়ে আছে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে।তখনই সারথি আনাফকে বাঁচাতে বলে উঠলো,’কথা বলা শেষ’

‘ওমা এত জলদি?’

‘হুম।শুধু জানতে চেয়েছিল ভাল আছি কিনা’

এবার সবাই বিছানায় উঠে বসে গল্প শুরু করে দিছে।আনাফ নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে সারথির পাশের খালি জায়গায় বসেছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ফুফু এসে সবাইকে চলে যেতে বললেন রুম থেকে।সারথিকে রেস্ট নিতে বলে আনাফের সব ফুফাতো বোনদের নিয়ে তিনি চলে গেলেন ওখান থেকে।আনাফ তো খুশিতে মনে মনে ঠিক করে নিলো ফুফুকে আড়ংয়ের গিফট কার্ড কিনে দিবে।কত বড় উপকার করলো ফুফু।খুশিতে নাচতে নাচতে গিয়ে দরজাটা লক করে সে এক ছুটে সারথির পাশে এসে বসে আবার।

সারথি বললো,’আপনি এমন পাগলামো কেন করছেন শুনি?আমাকে আর দেখেননি?’

‘হাসপাতালের ছুটি আর কয়েকদিন আছে।তাই এই সময়গুলো উপভোগ করে নিচ্ছি।আর কিন্তু সহজে সময় পাবোনা’
———–
‘বুঝলেন ভাই।হাবিজাবি মেনশনের নামটা একেবারে সার্থক।এই মেনশনের মানুষগুলা সব আউলাঝাউলা,তাদের কাজকর্ম ও সব আউলাঝাউলা।
আজকের কথাই বলি শোনেন, জীবনে দেখছেন ছেলে বিয়ে করাই আনলে মেয়ে পক্ষের বাড়ি থেকে গাজী টাংকি দিতে?এই বাড়িতে সেই কাজটাই হইছে।ওদের ঐ যে ছেলে ফারাজ আছেনা?ওরে বিয়ে করাইছে কয়েক দিন আগে।ওমা!আমি ভাবতেছিলাম মেয়ের বাড়ি থেকে বুঝি কিছুই দেয়নাই!
আজ দেখলাম মেয়ের বাপে একটা গাজী টাংকি লইয়া আনছে।ভাবতে পারেন!কতটা আজগুবি কাজ!!
যৌতুক হিসেবে কেউ গাজী টাংকি দেয়?’

লোকমান মিয়ার কথা শুনে অপরিচিত লোকটি চায়ে চুমুক দিয়ে আগ্রহ সহকারে বলে,’হয়ত তাদের টাংকির প্রয়োজন।বিয়েতে তো ছেলেরা তাদের প্রয়োজনের কথা জানালে মেয়েরা সেটা দেয়’

‘টাংকি কেন প্রয়োজন!ওহ হো মনে পড়ছে।টাংকিতে তো হিসু করে রাখে বাড়ির বিচ্ছু গুলা।তবে নতুন টাংকি কি জন্য?এটাতে কি হিসু করবেনা?’

‘হিসু করে মানে?এটা কেমন কথা?টাংকিতে প্রস্রাব করবে কেন?’

‘আপনি জানেন না?’

‘না’

‘তাহলে ধরেন আরেক কাপ চা।শোনেন কাহিনী,এদের বাড়ির টাংকিতে সারাদিন ইউরিন মিক্স করা পানি থাকে।এরা সেটা দিয়ে শরবত বানাই খায়’

‘কি বলছেন সত্যি?’

‘আরেহ হ্যাঁ।শুধু খায়না।ধোয়,গোসল করে সব সব।খবিশ দেখতে হলে এই বাড়িতে গিয়ে দেখেন’

‘এটা আদৌ সম্ভব?

‘আপনার বিশ্বাস হচ্ছেনা তো?আপনি এক কাজ করেন,ওদের বাসায় যান।আপনাকে শরবত খাইতে দিবে।তারপর সেই শরবত যদি নোনতা লাগছে তো বুঝে নিবেন ওটা টাংকির পানি’

‘ছিঃ!কি বলছেন।এত খবিশ এরা?’

‘হুমম।মস্ত বড় খবিশ।যাই হোক,কি বলা ধরছিলাম যেন?’

‘বিয়েতে কেউ টাংকি দেয়?এটা বলছিলেন’

‘ওহ হ্যাঁ,
ভাবেন!টাংকি মানুষ বিয়ের উপহার হিসেবে দেয়!এটা কেবল এই বাড়ির মানুষের চিন্তাধারার সাথেই মেলে।অন্য মানুষ এগুলা চাইবেনা অন্তত’
———
পূর্নতা টাংকিতে তালা দিয়ে চাবি নিজের আঁচলে বেঁধে বললো,’এইবার কি করে এই টাংকির পানি নোংরা করে বাবুরা সেটাই আমি দেখবো।এখন থেকে আমি যেভাবে চালাবো সেভাবে চলবে বাড়ির প্রতিটা বাচ্চাকাচ্চা!

ফারাজ ছাদের এক কোণায় বসে ছবি আঁকছিল।অর্ক ওর পাশে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল।পূর্ণতা কোমড়ে হাত দিয়ে টাংকির পাশে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বিড়বিড় করছে।সেটা দেখে অর্ক ফারাজকে বলে,’চাচিমণি মনে মনে গৌরবিত হচ্ছে কেন?’

‘টাংকিতে তালা দিয়ে নিজেকে মহারাণী ভিক্টোরীয়ার নাতনি ভাবতেছে’

‘উনিও হয়ত এই অসাধ্য সাধন করতে পারে নাই।টাংকিতে তালা দেয়া মহৎ কাজ।যদিও আগে জানতাম না তবে চাচিমণিকে এভাবে গৌরবিত হতে দেখে মনে হলো।আমিও টাংকিতে তালা দিব ভাবছি’
——
ফারাজের রুমে ডাবল বেড আনা হয়েছে।
অনেক সুন্দর একটা ডিজাইনে করা ডাবল বেডটা পেয়ে পূর্ণতা মাঝখানে শুয়ে শুয়ে ছাদ দেখছে।ফারাজকে জায়গা দিচ্ছেনা।ভাবতেই মনটা ভাল হয়ে যাচ্ছে পূর্ণতার যে আজ থেকে এই সুন্দর খাটটা তার।ফারাজের অবশ্য এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই নতুন খাটে বসার কিন্তু খাট আসার ঘন্টা কেটে যাবার পরেও পূর্ণতা ওকে বসতে দেয়নি।সে পুরো খাটে গড়াগড়ি করছে।

‘এক কাজ করেন।খাটের কাঠ ভেঙ্গে চিবিয়ে খাওয়া শুরু করে দেন’

‘আপনার হিংসা হচ্ছে?এতদিন তো শুকনা-চিকনা খাটে শুতেন,
এখন আমি আসায় দাদাজান এই নান্দনিক খাটটা এনে দিয়েছে বলে আপনার হিংসা হচ্ছে?’

‘মোটেও না।আপনি পুরো খাট জুড়ে শুয়ে থাকেন,আমার কিছু না।’

‘তবে এত কথা কেন বলছেন? যান না নিজের কাজ করেন ‘

ফারাজ মনে মনে পূর্ণতা বকা দিয়ে হাতের কাজটা শেষ করে গোসলে গেলো।সব সময়কার মতন তোয়ালে নিতে ভুলে গেছে।আগে ফাঁকা রুমে বেরিয়ে এসে বিছানা থেকে তোয়ালেটা নিতো,কিন্তু এখন কিভাবে নিবে?’

‘পূর্ণা?’

‘কে?কে ডাকে আমায়?’

‘ঢং করতে হবেনা।বিছানার কোণায় আমার তোয়ালে আছে।এনে দিন’

‘বুঝে গেছি আমি।তোয়ালে দিতে আসলে আপনি আমায় হ্যাঁচকা টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে যাবেন তারপর রোমান্স হবে।ইশ! আমার লজ্জা করে।আমি পারবোনা তোয়ালে দিতে।যাঃ দুষ্টু!’

‘পূর্ণতা ফাজলামি বন্ধ করে আমার তোয়ালেটা দিন।শীতে কাঁপতেছি।গা মুছতে হবে আমার’

‘আগে প্রমিস করেন আমাকে টান দিবেন না’

‘আমার ঠেকা পড়ছে আপনাকে টান দেয়ার।সোজাসুজি আমার তোয়ালে দেন বলছি!’

পূর্ণতা তোয়ালেটা নিয়ে ওয়াশরুমের কাছে এসে সামনে ধরলো।ফারাজ তোয়ালেটা ধরে টান দেয়া ধরতেই পূর্নতা বললো,’আপনার কি মনে হয়না আমাকে টান দেয়া উচিত? ‘

‘এখনই বললেন যে টান যেন না দিই।প্রমিস ও করালেন, এখন আবার এসব কি?তোয়ালেটা ছাড়ুন। আমায় দিয়েও আবার দিচ্ছেন না?কি হয়েছেটা কি আপনার!!”
———
আনাফ দরজায় কান লাগিয়ে শুনছে বাইরের রুমে ফুফুরা সবাই হাসাহাসি করছে ওকে নিয়ে।বউ পেয়ে নাকি পাগল হয়ে গেছে সে।এ কথা শুনে আনাফের লজ্জায় ইচ্ছে করছিল বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে।কথাটা সারথিও শুনেছে।

‘আপনার কি দরকার ছিল দরজা লক করার?’

‘বোনেরা কেউ যাতে আসতে না পার তাই তো দরজা লক করলাম।আমি কি জানি দরজা লক করলে ওরা এসব বলবে।আর ফুফুই তো ওদের নিয়ে গেলো আমাদের একা সময় দেয়ার জন্য।তবে এখন এসব কেন বলছে?’
—–
‘আনাফ যে অন্য সবার চাইতে আলাদা সেটা আমরা আগেও জানতাম কিন্তু ও যে সারথির মতন একটা মেয়েকে বিয়ে করে দেখিয়ে দিবে তা আসলেই ভাবনার বাহিরে ছিল আসমা!’

‘ঠিক বলছেন আপা।আমি নিজেও অবাক হয়েছি যখন শুনলাম ও সারথিকে ভালবাসে,বিয়ে করতে চায়।আনাফের পছন্দ কিরকম সেটা জানতাম কিন্তু ওর এমন অদ্ভুত পছন্দ যে বাস্তবে পূরণ হয়ে যাবে তা আসলেই ভাবিনি।আমার এখনি সব স্বপ্নের মতন মনে হয়।আনাফ সব কেমন করে যেন সত্যি করে নিলো।ওর বাবাকেও রাজি করিয়ে নিয়েছে রাগ দেখিয়ে’

‘আসলে ভাগ্য ছিল বলেই হয়েছে নাহলে ভাইজানের যে চয়েস।সারথিকে জীবনেও তিনি আনাফের পাশে মেনে নেয়ার মতন মানুষ না।তাও কিরকম করে যেন বিয়েসাদি সব হয়ে গেছে। ভাইজান কোথায় এখন?’

‘অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে গেছে’

‘নাকি রাগ করে?’

‘নাহ রাগ নয়।বরং অপেক্ষায় ছিল কখন সারথি আনাফ আসবে বাসায়।আমাকে বলেছে সব তৈরি রাখতে’
——
সারথি নিজে নিজে উঠে রুমের এক কোণায় একটা জায়গা আবিষ্কার করলো যেখানে নিচে কিছু কুশন পাতানো আর কয়েকটা ফুলের গাছ তাও তাজা,জীবন্ত।
আনাফ সেসময় দরজায় কান রেখে সব শুনার চেষ্টায় ছিল।সারথি সেখানে বসে হাত বাড়িয়ে ফুলগাছগুলো ছুয়ে ছুঁয়ে দেখছে।এর আগে আনাফের রুমে তার আসা হয়নি।অধরা যে বাসায় আছে ওটাতে আনাফের রুমে যাওয়া হয়েছে কিন্তু এই বাসার রুমে এ প্রথমবার।কুশন একটা কোলে নিয়ে যে সামনে মুখ ঘুরিয়ে আন্দাজেই বলে ওঠে,’আনাফ পাশে বসবেন একটু?আমায় বলুন তো এই জায়গায় আলো কিরকম আসে?এখন থেকে আপনার চোখ দিয়ে দেখতে চাই।আগের মানুষটা আমায় কেবল কালো রঙটাই চিনিয়েছে।আমি জানি আপনি আমায় রঙধনুর রঙ চেনাবেন’

চলবে♥

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৬৩
#আফনান_লারা
________
আনাফ সারথির কথাটা শুনে এক সেকেন্ড ও অপেক্ষা করলোনা।বাতাসের গতিতে ছুটে ওর পাশে বসে গেলো ফটাফট।সারথি জানতে চাইলো জানালা কোন দিকে।আনাফ ওর হাতটা তুলে দেখিয়ে দেয়।
সারথি তখন আনাফের ঘাড়ে মাথা রেখে বলে,’আমি আপনি আর এক রাশ ভালবাসার সময়টা শুরু এখান থেকেই।জানালার ফাঁকে,পর্দার আড়ালে,দরজার শেষ অবধি ভালবাসাগুলো খেলা করবে,উড়বে’

‘আর কি করবে?’

‘আর আমাদের মাঝে এসে ধাক্কা লেগে মিশে যাবে’
———
অরিন্দম কর্মকার আজ এসেছে ফারাজ পূর্ণতাকে তার গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে আনতে।যদিও সেখানে বাড়ি নেই, খালি জমি পড়ে আছে।ওনার ছোট ভাইয়ের বাড়িতে উঠবেন।
পূর্ণতা তৈরি হয়ে নিলেও ফারাজ বললো সে যাবেনা।এতদিন ধরে যে ছবির পেছনে শ্রম দিয়েছে সেটা যে ক্রেতা কিনবে তার আজই আসার কথা।বিদেশী ক্লায়েন্ট।তাই সে যাবেনা।
অরিন্দমের বাড়িতে অনেক ককাজ বলে উপায়ন্তর না পেয়ে শুধু পূর্ণতাকে নিয়েই তিনি গ্রামে চলে গেছেন।এটা ফারাজ জানতোনা।সে তার কাজে চলে গেছিলো অনেক আগেই।
তার ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলো।
বাড়িতে ফিরে মাকে খাবার দিতে বলে সোজা নিজের রুমে আসে ফারাজ,ভেতরটা ফাঁকা।ফারাজ ভেবেছিল পূর্ণতা রুমেই থাকবে। কারণ আসার সময় সে পূর্ণতাকে দেখেনি।
রুম খালি দেখে ভেবে নিলো হয়ত অর্কর রুমে সে।কারণ পূর্ণতা প্রায় সময় অর্কর রুমে গিয়ে বকবক করে।
হাতের ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখে সে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে রুমটা আগের মতই দেখে মন খারাপ হলো।মেয়েটা গেলো কই?
তোয়ালে দড়িতে ঝুলিয়ে রুম থেকে বের হয় সে।সোজা অর্কর রুমে যায়।অর্ক পড়ার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।ফারাজ ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলে সন্ধ্যাবেলা ঘুমাতে নেই।ওর রুমেও পূর্ণতাকে না পেয়ে ফারাজের এবার চিন্তা হলো।
চিন্তা করতে করতে সে নিচে গিয়ে খেতে বসে।মা খাবার সাজিয়ে রেখে অন্য কাজে চলে গেছেন।ফারাজ পাতে হাত রেখে মাথা ঘুরয়িে এদিক সেদিক চেয়ে নিলো।আশ্চর্য!

‘কি গো নতুন জামাই?কাকে খোঁজো?’

‘কাউকে না কাকি’

‘ফারাজ তোমায় কিন্তু কখনও ভাতে হাত রেখে এদিক ওদিক তাকাতে দেখিনি।তবে এখন দিশা বদলে গেলো ক্যান?’

‘এমনিতেই দেখলাম রাত কত হলো’

সায়না কাকি মুচকি হাসলেন,বলতে চাইলেন সে যাকে খুঁজছে ও বাড়িতে নেই,পরে কি যেন দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় আসায় আর বললেন না।চলে গেলেন ওখান থেকে।ফারাজ লজ্জায় কারণে জানতে চায়নি পূর্ণতার কথা।সে নিজেই খুঁজে বের করবে বলে ঠিক করে।চটজলদি ভাতটা শেষ করে হাত ধুয়ে বাগানের দিকে যায় সে।বাগান খালি না,সেখানে দাদাজান বসে বসে রেডিওতে পুরোনো দিনের গান শুনছেন।
দাদাজানকে ওখানে দেখে ফারাজ আর সেদিকে যায়নি।পা টিপে টিপে ওখান থেকে চলে গেছে। বাড়িতেও নেই,বাগানেও নেই তবে গেলো কোথায়য়?
পরে মাথায় আসলো ছাদের কথা।দিলো এক দৌড় ছাদের দিকে।দৌড়ের সময় সিঁড়িতে খেলো এক হোচট।এরপর বসে বসে পা যখন সে ঘঁষছিল,সেসময় অর্ক ওকে দেখে বলে,’তুমি কি পূর্ণতা চাচিমণিকে খুঁজতেছো?’

‘না তো’

‘মনে হয় তাকেই খুঁজতেছো,কারণ এর আগে পুরো বাড়িতে তোমায় এমন ডিটেক্টরের মতন ঘুরতে দেখিনি।
যাই হোক শোনো,চাচিমণি তার আব্বুর সাথে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে চলে গেছে’

‘আজই?’

‘হুম আজই।তোমায় ও তো বলেছিল।তুমিই তো গেলে না’

ফারাজ ভেবেছিল হয়ত দুদিন পর যাবে।এভাবে আজ বলে আজই চলে যাবে সেটা ভাবেনি।
ছাদে আর যাওয়া হয়নি,সোজা তার রুমেই আসা হলো।

‘ভালই হয়েছে।থাকলে এখন ঘ্যান ঘ্যান করে মাথা খারাপ করতো।শান্তিতে ঘুমাতে পারবো আজ।’

টেবিলের ওপর থেকে একটা বই নিয়ে পড়তে বসে ফারাজ।বিয়ের আগে এই সময়টা সে বই পড়তো।সময় কেটে যেতো।এখন হঠাৎ সময় কাটছেনা।কি ব্যাপার??এত চেইঞ্জ!!
————
পূর্ণতা তার বাবার সাথে গ্রামের বাড়ি এসে ফারাজের চাইতে বেশি বোর হয়ে আছে।মনে হয় অনেক মূল্যবান কিছু সে শহরে ফেলে এসেছে।তার এখানে কিছুই ভাল লাগছেনা।মন চাইছে এক ছুটে হাবিজাবিতে চলে যেতে।এরকমটা লাগবে জানলে সে কখনওই আসতোনা।সেই তখন থেকে পুকুর ঘাটে বসে পা দুলাচ্ছে সে।কেউ তার সাথে কথাও বলছেনা,যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। দাদার বাড়িতে নিজের সমবয়সী কাজিন না থাকলে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।নিজেকে মরুভূমির পর্যটক মনে হয়।
বয়সে ছোট কেউ হলেও হতো।পর্ণতার সব কাজিন তার চেয়ে পনেরো/ বিশ বছরের বড়।তাদের সাথে সে কি করে আড্ডা জমাবে?বোন যারা ছিল সবার বিয়ে হয়ে বাচ্চাগুলো প্রাইমারিতে পড়ছে।বাবা আসার পর থেকে ব্যস্ত। সে এখানে এসে মস্তবড় ভুল করেছে সেটা বুঝেছে কিন্তু কিছু করতে পারছেনা।মন চাইলো ফারাজকে কল করে তার সাথে কথা বলার। পরে ভাবলো সে কেন আগে ফোন দেবে?ফারাজ কি তাকে মিস করেনা?ফারাজ কেন একবারও কল করেনি?
—–
ফারাজ ফোন হাতে নিয়ে শুয়ে আছে। একবার কল করা উচিত আসলেই।দম ফেলে কলটা দিয়েই দিলো সে।
সাথে সাথে রিসিভ হলো।পূর্ণতা ওর কলেরই অপেক্ষায় ছিল।

‘কি খবর আপনার ম্যাডাম?’

‘মনে আছে আমাকে, আদৌ?’

‘কলটা কিন্তু আমিই করেছি’

‘আপনারই করা উচিত।আমি এসেছি সেই কখন।আরও আগে ফোন দিয়ে জানা উচিত ছিল আমি পৌঁছেছি কিনা’

‘নিজে তো ফোন দেন নাই,আমি দিছি এখন আমাকেই দাম দেখাচ্ছেন?’

‘খেয়েছেন?’

‘হ্যাঁ,আর আপনি?’

‘পরে খাবো।তো কেমন লাগছে আমায় ছাড়া?’

‘আপনি তো দুদিনের মানুষ।আমি এতদিন একা থাকি নাই?’

‘তার মানে আমায় মিস করছেন না?’

‘না করছিনা।আমি বিন্দাস খাচ্ছি দাচ্ছি,আয়েশ করছি’

পূর্ণতা রাগ করে কলটাই কেটে দিয়েছে।ফারাজ ফোনের দিকে চেয়ে থেকে বলে, ‘সরি!কিন্তু আমি আসলেই আপনাকে খুব মিস করতেছি’

সারথিকে দেখার জন্য কোনো প্রতিবেশী আসেনি।কারণ সারথি যে সজীবের বউ ছিল এটা সকলে জানে।তাই ঠিক কি কারণে আসেনি সেটাই ভাবছে আনাফের বাসার সবাই।

রাতের বেলা ডিনারটা সেরে আনাফ সারথিকে নিয়ে ছাদে এসেছিল হাওয়া খেতে। সারথি ফুলগাছে হাত বুলাচ্ছিল।এগুলা তারই যত্নের ফুলগাছ।অনেকদিন পর তার এই ছাদে আসা।আনাফ হঠাৎ করে সারথিকে বললো,”জানো আজ সজীবদের বাসায় অনেক মেহমান’

‘কেন?’

‘শুনলাম সজীবের গার্লফ্রেন্ড লেভেন না কি যেন সে তার পরিবার নিয়ে আসবে’

‘আসবে তো মেহমান কিসের আগেভাগে?’

‘আরেহ সজীবের আত্নীয় ওরা।হবু বউকে দেখবে সবাই’

‘ওহ আচ্ছা ভালই।আমার পরে উনিও নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিচ্ছেন।’

‘ওই সজীবের জীবন গোছানোই ছিল।মাঝ দিয়ে তোমার জীবনের ১৪টা বাজিয়ে রাখছিল এতদিন’

সারথি মুচকি হেসে বলে,’তবে আপনি আমার জীবনের কয়টা বাজালেন?’

‘আমি বাজাই নাই।বাজানো ভাল না’
————
লেভেনকে একটুও পছন্দ করেন না সজীবের বাবা এবং মা।কিন্তু এখন তাদের কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই বলে যাকে পছন্দ হয়না তাকেই পছন্দ করার অভিনয় করতে হবে।মানসম্মান আগে তারপর সবকিছু।
যেটা নিয়ে ভয় ছিল সেটাই হলো।লেভেন তার বাবাকে নিয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু তার পোশাক মার্জিত ছিল না।হাঁটু দেখা যায় এমন পোশাক পরে সে এসেছে।সজীব এটার কথা ভুলে গেছিলো।যদি মনে থাকতো তবে সে লেভেনকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতো যাতে ভাল জামা পরে আসে।লেভেনকে এই বেশে দেখে সজীবের আত্নীয় হতে শুরু করে সজীবের বাবা মা রীতিমত আশ্চর্য হয়ে আছেন।কি বলবেন ভেবেই পাচ্ছেন না।এদিকে কিছু যে বলবে সেটার অবস্থাও নেই।কিয়াম তার বডিগার্ড সবকয়টাকে নিয়ে আসছে। সবাই মিলে ঘিরে রেখেছে সজীবের বাবা -মাকে। ওদের দেখে ভয়ে আর কেউ টু
শব্দ টুকুও করেনি।সজীবের মা উর্মিকে ফিসফিস করে জানিয়ে দিছেন যেন লেভেনকে নিয়ে ভাল কোনো পোশাক পরিয়ে আনে।
উর্মি আর দেরি না করে লেভেনকে সবার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলো।

সজীবের বাবার পাশে এসে বসেছেন মিঃ কিয়াম।তিনি এমন ভাব ধরছেন যেন বিয়েটা তিনি চাপে পড়ে করাচ্ছেন।তার কোনো মতই নেই এ বিয়েতে।এদিকে সজীবের বাবা আরও ভাব দেখাচ্ছেন।দু বেয়ানের ভাবের চাপাচাপি তে থাকা যাচ্ছেনা।কেউ কারো সাথে কথাই বলছেনা অথচ তারা একই সোফায় বসে আছে একই জায়গায়।তাদের মাঝের দুরুত্ব ১০ইঞ্চির।
—–
উর্মি লেভেনকে একটা সুন্দর শাড়ী পরিয়ে দেয়।
লেভেন জীবনে শাড়ী পরেনি।এ প্রথম পরা হলো।সে নিজেকে আয়নায় দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।উর্মি বললো,’আপু তোমায় অনেক সুন্দর লাগছে।মনে হয় যেন শাড়ীটা তোমার জন্যই তৈরি’

সজীব ভীড় ঠেলে এ রুমে এসেছিল লেভেনের সাথে কথা বলার জন্য।রুমে এসে লেভেনকো শাড়ীতে দেখে তার হাঁটাই বন্ধ হয়ে যায়।
লেভেনকে এতটা সুন্দর লাগছিল সজীব কি বলার জন্য এসেছে সেটাই ভুলে গেছে।

উর্মি সজীবকে দেখে রুম ছেড়ে চলে গেলো।লেভেন লজ্জা পেয়ে এক ছুটে বারান্দায় চলে আসে। সজীব ও ওর পাশে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
ঠিক সেসময়ে পাশের ইউনিটের বারান্দায় আনাফ আর সারথি ছিল।সারথি মেঝেতে বসে বসে গুন গুন করছিল।আর আনাফ রেলিংয়ে হাত রেখে আকাশের তারা গুনার বৃথা চেষ্টা করছিল।সজীব আর লেভেনের এমন দর্শন দেখে সে হা হয়ে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ।
“”বাংলাদেশেই এমন করে জড়িয়ে ধরে বিয়ের আগে তার মানে মালয়েশিয়া তে না জানি কেমন কেমন কাজ করতো এরা দুজন।
শ্বশুর মশাই দেখেশুনে কত বড় চরিত্রহীনের সাথে আমার বউটার বিয়ে দিছিলো।আমার এখনও বিশ্বাস হয়না মেয়েটাকে আমি উদ্ধার করে নিজের করতে পেরেছি।’

ওমা আনাফের সামনে সজীব লেভেনকে হঠাৎই কিস করে ফেলে। এটা দেখে আনাফ চোখ বড় করে পিছিয়ে যায়।তোতলাতে তোতলাতে সারথির হাত ধরে মেঝে থেকে তুলে দাঁড় করায় সে।

‘কি হলো?টান দিয়ে দাঁড় করালেন কেন??’

‘না মানে!চলো রুমে যাই’

‘আমার তো এখানে ভাল লাগছে।আরেকটু থাকি’

‘না না।থাকতে হবেনা।চলো’

আনাফ জোর করে সারথিকে রুমে নিয়ে আসে।বিছানায় বসে এখন জোর জোরে হাঁপাচ্ছে।চোখের সামনে এইসব দেখলে বুকের ভেতর ধড়ফড় করা স্বাভাবিক।সারথি আনাফের হাতটা ধরে বলে,”কি হলো?কিছু দেখলেন নাকি?এমন হাঁপাচ্ছেন কেন?’

‘তুমি কি জানো সজীব অনেক বাজে একটা ছেলে?’

‘হয়তবা’

‘সে কি করছে জানো..সে এখন….’

‘কি?’

‘নাহ কিছুনা।বাদ দাও।আমার খুব ভাল লাগছে,আমি তোমায় সজীবের কাছে থেকে আর কষ্ট পেতে দেইনি।নিজের কাছে রেখে শান্তি দেবো’

‘পাশের বারান্দায় সজীব ছিল তাই না?’

‘তুমি জানলে কি করে?’

‘আমি সজীবের গায়ের গন্ধ চিনি,তার সাথে একটা মেয়েলী গায়ের গন্ধ ও পেযেছি।হয়ত লেভেন’

‘অন্য কেউ ও তো হতে পারে’

‘ঐ বাড়ির সবার গায়ের গন্ধ আমি চিনি’

‘আজ তো তাদের বাসায় অনেক
আত্নীয়’

‘আপনি ওনার হয়ে সাফাই কেন দিচ্ছেন?আমি নিশ্চিত ওখানে সজীব আর লেভেন ছিল।যদি সজীবের সাথে অন্য কেউ হতো তবে তারা কথা বলতো।
আমি কেবল শুনেছি চুড়ির ঝুনঝুন আওয়াজ। আর কিছু………।নাই বা বললাম।ভাল কিছু নয়।হয়ত খারাপ কিছু যেটা জানলে আমার কষ্ট হতো বলেই আপনি আমায় এখানে নিয়ে আসলেন।আপনার ধারণা ভুল।আমি কষ্ট পেতাম না কিংবা পাইনি।উনি আমার কেউ হোন না।

আমি যাকে ভালবাসি,যদি জানি সে আমায় ভালবাসেনা,যদি হাতেনাতে প্রমাণ পাই সে আমায় ধোকা দিচ্ছে,ভুলধারণা পরিষ্কার হয়ে যায় তবে ঐ মানুষটাকে আমি ঘৃনা করি’

চলবে♥