#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৪৯
#আফনান_লারা
________
সারথি বাড়ির ভেতরে আসতেই বাড়ির বিয়ে বিয়ে আমেজটা যেন আরও দিগুণ বেড়ে গেলো।
সাথে আনাফকে দেখে হইহই রইরই ও বেড়ে গেছে।
সারথি সবাইকে একসাথে বলে দেয় আনাফ তার খুব ভাল বন্ধু।
এই শুনে সবাই যতটা আদর যত্ন করছিল মুখে হাসি নিয়ে ঠিক ঐসময়ে সারথি বলে উঠে তার আর সজীবের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
মূহুর্তেই পরিবারের প্রতিটি মানুষের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়।সবাই সারথির দিকে তাকিয়ে আছে ডিভোর্সের কারণ জানার জন্য।সারথি কিছুই বলছেনা।
আনাফ তখন হাতের শরবতের গ্লাসটা রেখে দিয়ে বলে,’আমি বলছি কি কারণ।সজীব মালয়েশিয়াতে একটা মেয়েকে পছন্দ করে,ওকে বিয়েও করবে।আর তাই সে সারথিকে ডিভোর্স দিয়েছে। ‘
আনাফের কথা শুনে কেউ কেউ কষ্ট পেলো আর কেউ কেউ রাগান্বিত হলো।মানিক সাহেব তো চট করে ফোন কানে ধরলেন।কল করেছেন সজীবের বাবার নাম্বারে।আজ এর একটা বিহিত হবেই।দাদাজানের খারাপ লাগলো সারথির জন্য।তিনি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন,’কাঁদিস না।সবাই শুরুতে ভালোটা পায়না’
আনাফ তখন মুচকি হেসে বললো,’আহা পুরো কথা তো শুনেন।সেই ভালো সে পেয়ে গেছে।এই যে আমি বসে আছি,আপনাদের হবু নাতিন জামাই।পেশায় ডাক্তার।যার যার যা সমস্যা আমায় বলবেন,চিকিৎসা করে দিব ফ্রিতে’
দাদাজান আনাফের মুখের দিকে চেয়ে আছেন,আসলেই কি সত্যি বলছে।নাকি মশকরা করছে।মিসেস সোনালী এগিয়ে এসে সারথির কাছে ফিসফিস করে জানতে চাইলেন এটা সত্যি কিনা।সারথি কিছুই বললোনা।
আনাফ আবার বললো,’ওকে কি জিজ্ঞেস করছেন।লজ্জায় সে কি নিজের মুখে বিয়ের কথা বলবে?আচ্ছা আপাতত এই যুগলের বিয়েটা হয়ে যাক তারপর নাহয় আমার আর সারথিরটা হবে।আমি কিন্তু যা বলছি সব সিরিয়াসলি বলছি’
দাদাজান আনাফের পাশে বসে ওর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললেন,’সারথির সাথে তোমার পরিচয় হলো কি করে?’
‘সে অনেক কাহিনী।আগে বলুন তো আপনি আপনার নাতিন আমার সাথে বিয়ে দিবেন?আপনার নাতিন আমাকে হ্যাঁ ও বলেনা,না ও বলেনা।এখন আপনাদের মত না জানা অবধি আমার শান্তি হচ্ছেনা।’
‘তুমি রাজি হলে কি হবে?তোমার বাবা মা কি রাজি হবেন?’
‘বিয়ে তো আমি করতেছি,তারা শুধু অনুষ্ঠান করবে।তারাও রাজি,ওটা নিয়ে ভাবিয়েন না।
আমি আপনাদের মতামত জানতে চাই’
দাদাজান আনাফকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।কেঁদে কেঁদে বললেন,’মানুষ ভাল হলে কেন এত কষ্ট পায়?আমার সারথি ছোট থেকে কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে।তার জীবনে আমি একটিবার ও সুখ দেখিনি।এখন আবার তার সাথেই এমন কেন হতে হলো?জানো সজীবও ওকে পছন্দ করেই বিয়ে করেছিল।’
‘আমি তো ওরে পছন্দ করার কথা বলিনি।
আমি ওরে ভালোবেসে ফেলেছি।’
সারথি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আনাফ দাদাজানের কথা শুনছিল সেসময় মিসেস সায়না ওকে চিমটি একটা দিয়ে বললেন,’কিরে সারথি!!এই ছেলে দেখি সজীবের চেয়েও সুন্দর।তোকে যদি দেখাতে পারতাম!!!
এত সুন্দর একটা ছেলে তোর বর হতে যাচ্ছে জানিস??’
‘সব সুন্দর ভাল হয়না’
‘এই বেলায় সুন্দরটা ভাল হলো।নাহলে কোন ছেলে এতসব জেনেও বিয়ে করতে এক পায়ে খাড়া হয়??তাও ডাক্তার!!আমার না বিশ্বাস হচ্ছেনা।আসলেই ডাক্তার তো?অবশ্য ডাক্তার গুলার চেহারা দেখেই বুঝা যায়।একে দেখে ডাক্তারই মনে হয়।কিভাবে পরিচয় হলো?’
‘সাতাশ জুলাই ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলো,এরপর থেকে চিনি।’
‘বাহ!!নায়কের মতন এন্ট্রি!তারপর প্রেম হলো কি করে?’
‘প্রেম?আমাদের প্রেম হয়নি!’
‘তবে ছেলে যে বললো তোকে ভালোবাসে?’
‘সব ভালোবাসাতে কি প্রেম থাকা লাগে চাচিআম্মু?’
‘তাও ঠিক!সরাসরি ভালবাসি বলেছে?’
‘এই মানুষটা ভালবাসি না বলেও তার সব কাজে কেমন করে যেন দিনের পর দিন বুঝিয়ে দিয়েছে।আমি যে ধোকা খেলাম,আমি যে মরতে চাইলাম কেমন করে যেন আগলে নিয়েছে সবটা।আমি এই ধাপে এসে বুঝতে পারলাম উনি ধীরে ধীরে আমার একজন উত্তম জীবনসঙ্গী হয়ে যাচ্ছেন’
———-
ঘন্টাখানেক পর ফারাজ আর পূর্ণতার হুশ ফিরেছে।দুজনেই চেয়ে দেখে একজন আরেকজনের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে।তাই হুশ ফেরায় দুইদিকে দুজনে সরে গেলো।উঠে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলো তারা কোথায়।পরে বুঝতে পারলো তারা হাবিজাবিতে।
এটা দেখে দুজনেই দিলো এক দৌড়,কিন্তু গেট অবধি গিয়ে আর যেতে পারেনি,মতিন গেটে তালা ঝুলিয়ে রেখেছে।
‘আমরা এখানে এলাম কি করে?’
‘পূর্ণতা আপনার মনে আছে আনাফ ভাই আমাদের একটা চকলেট খাইয়েছিল?’
‘হুম মনে আছে’
‘তার পর থেকে তো আর কিছু মনে নাই আমার।আপনার কিছু মনে আছে?’
‘আপনি আমার হাত ধরেছিলেন’
‘এটা মিথ্যা কথা’
‘আর বলেছিলেন আমি সুন্দরী,আমার এই টুকুই মনে আছে,মেয়েরা সব ভুলে গেলেও প্রশংসা ভুলেনা’
‘আমি বলবো আপনাকে সুন্দরী?মিথ্যে বলার জায়গা পান না?হয়ত অসুন্দরী বলেছিলাম’
‘না।আমার মনে আছে আপনি আমায় সুন্দরী বলেছিলেন’
আজিজ খান ওদের মাঝখানে এসে তখন বললেন,’হুম।ঐ সুন্দরীর সাথেই আজ তোমার বিয়ে হবে ফারাজ ‘
ফারাজ ঢোক গিলে চুপ করে আছে।পূর্ণতা বললো,’আমি পালাই’
এটা বলে সে দেয়াল টপকে ওপারে যাবার বৃথা চেষ্টা করে।শাড়ী পরে থাকায় সে দেয়ালে উঠতেই পারেনি।তখন ফারাজ এসে বললো,’আপনি থাকেন,আমি বরং পালাই’
এটা বলে ফারাজ নিজে দেয়াল টপকানোর চেষ্টা চালালো ওমনি আজিজ খান আর মতিন মিলে ওকে জড়িয়ে ধরে নিচে নামিয়ে চ্যাংদোলা করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেছে।পূর্ণতা নখ কামড়াতে কামড়াতে কোনদিক দিয়ে পালাবে সেটা ভাবছিল তখনই দাদাজান এসে দাঁড়ালেন ওর সামনে।
ওনাকে গম্ভীর চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
‘আজ কোথায় পালাবা তোমরা?তুরুইল্লার বাসায় গিয়েও যদি পালাও তোমাদের বিয়ে আজই হবে’
এই বলে দাদাজান চলে গেলেন।পূর্ণতা তালা ভাঙ্গার চেষ্টা করছে এবার।
—–
‘আমি এসব কি শুনছি বেয়াই??সজীব বাবা নাকি সারথিকে ডিভোর্স দিয়েছে?’
সজীবের বাবা জনাব আমিন অফিসের কিছু ফাইল দেখছিলেন,মানিক সাহেবের মুখে এই কথা শুনে চট করে ফাইলটা বন্ধ করে ফেললেন।মানিক সাহেব যে ঠাট্টা করার মানুষ না এটা তিনি জানেন,তার মানে এটা সত্যি!
‘কি হলো কিছু বলছেন না কেন বেয়াই?’
‘আমি আপনার থেকে মাত্র শুনলাম।আচ্ছা আমি সজীবের সাথে কথা বলছি।আপনি শান্ত থাকুন’
‘শান্ত থেকে আর কি হবে?ডিভোর্স হয়ে গেছে।বাচ্চারা আমাদের না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো আর আমরা সব হয়ে যাবার পর জানছি!’
আমিন সাহেব কলটা কেটে সজীবের নাম্বারে কল দিলেন এবার।
সজীব সেসময় সমুদ্রের কিণারায় বসে ছিল গাল ফুলিয়ে।সারথির সাথে আনাফের সম্পর্কটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।একটা কাজের লোক এসে ওর ফোন দিয়ে গেলো তখন।গাল ফুলিয়ে রেখে নাম না দেখেই সে ফোন কানে ধরে।
ওপাশ থেকে ধমকের সুরে শোনা গেলো,’এসব কি শুনছি সজীব?’
বাবার কন্ঠ শুনে সজীব নড়েচড়ে বসে।বাবা আবারও জানতে চাইলেন সবাই যেটা বলছে সেটা সত্যি কিনা।তার মানে বাবা ডিভোর্সের খবর জেনে গেছে। এই ভয়টাই পেয়েছিল সজীব।
সজীবকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে আমিন সাহেব সিওর হয়ে গেলেন ডিভোর্সের ব্যাপারটা তাহলে সত্যি।
‘আমি জানতে চাই কোন সাহসে তুমি এত বড় সিদ্ধান্ত নিলে?
সারথিকে চেনা আছে আমার।ওর মতন বোকাসোকা,দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি মেয়ের পক্ষে তোমায় ডিভোর্স দেয়া অসম্ভব। তার মানে ডিভোর্স দিলে তুমিই দিছো।
তোমার এত দুঃসাহস আসে কই থেকে সজীব?টেল মি!’
‘বাবা আসলে আমি!’
‘এখন বলোনা তুমি কিয়ামের মেয়ে লেভেনের প্রতি আসক্ত আজ অবধি!এই কথা আমি শুনতে চাইনা!যদি এটাই শেষ কথা হয়ে থাকে তবে জেনে রাখো!দুদিনের মধ্যে তুমি বাংলাদেশ ফিরবে,সারথিকে আবার বিয়ে করবে।তোমাদের ডিভোর্স আমি মানিনা আর কেউ মানবেওনা।মানতে দিব না আমি।সারথিকে আমি আর তোমার মা মিলে পছন্দ করে এনেছিলাম।তোমার কোনো রাইট নাই আমাদের না জানিয়ে তাকে ডিভোর্স দেয়ার।এত বড় বেয়াদবি করেছো এটার শাস্তি তুমি অবশ্যই পাবে।
যদি আমার কথা না শুনো তবে মনে করবে তোমার বাবা মা মারা গেছে।তুমি বেছে নাও।লেভেন নাকি তোমার গোটা পরিবার’
এই কথা বলে আমিন সাহেব কল কেটে দিছেন।সজীব রাগ করে ফোন ছুঁড়ে মারে বালিতে।বাবা কঠোর হবে,রাগ করবে এটা সজীব জানতো কিন্তু এমন একটা ডিসিশান সামনে এনে দেবে এটা সজীব জানতোনা।এখন তো দোটানায় ঝুলছে!
লেভেনকে ছাড়া অসম্ভব। আর তাকে না ছাড়লে পুরো পরিবার সজীবকে ছেড়ে দিবে।কি অদ্ভুত এক ঝামেলা!!
‘তারা কি জানে সারথি আমার অনুপস্থিতিতে আনাফকে আপন করে ফেলেছে।সে কি আবার আমায় বিয়ে করবে!বাবার জানা উচিত সারথি আর আমার পথ দুদিকে চলে গেছে।চাইলেই এক হওয়া আর সম্ভব না।’
———-
ফারাজকে মতিন ধরে রেখেছে।আজিজ দাদু পাঞ্জাবি প্যাকেট থেকে বের করছেন ওকে পরানোর জন্য।ওদিকে ভেতরের রুমে পূর্ণতা গাল ফুলিয়ে বিছানার মাঝখানে বসে আছে আর মিসেস সায়না ওর চুল বেঁধে দিচ্ছেন। হাবিজাবিতে বিয়ের আমেজ লেগেছে।
মানিক সাহেব কল দিয়ে দিয়ে ঝগড়া করছেবন সজীবের বাবা মায়ের সাথে।
তিনি ফারাজ পূর্ণতার বিয়ের খবর জানেন না এখনও।
আনাফ সারথিকে নিয়ে ওদের ছাদে এসেছে।সারথি ছাদের রেলিংয়ে হাত রেখে বলে,’জানেন আমাকে কখনও বাড়ির ছাদে আসতে দিতো না কেউ’
‘কেন?’
‘আমি পড়ে যাব বলে’
‘তোমাদের তো ছাদের রেলিং আছে।ভয়ের কি আছে?’
‘আমারও এক কথা।তাও কেন যে কেউ দিতোনা!’
আনাফ সারথির দিকে চেয়ে থেকে আললো,’তুমি কি খুশি?’
‘কি কারণে?’
‘এই যে কদিন পর আমাদেরও বিয়ে হবে’
‘সব সুখে হাসতে হয়না’
‘তবে কিসে হাসতে হয়?’
‘হাসতেই হয়না।হাসলে নিজের উপর নিজের নজর লাগে।হাসির কারণটা খুব জলদি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।তাই এখন আর আমি হাসিনা’
‘তার মানে তুমি চাও আমি সারাজীবন থাকি?’
চলবে♥
#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৫০
#আফনান_লারা
________
বিকালের মিষ্টি আবহাওয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিয়ের আমেজ।সোফায় একপাশে ছাই রঙের মখমলের পাঞ্জাবি পরা বসে আছে ফারাজ।মাথায় সাধারণ একটা সাদা টুপি।গালটা কুমড়োর মতন ফুলিয়ে রেখেছে সে।
তার ঠিক পাশের সোফায় লাল রঙের সুতির শাড়ী আর মাথায় নেটের ঘোমটা টান দিয়ে বসানো হয়েছে পূর্ণতাকে।দুজনেরই মুখের অবস্থা ছোটখাটো একটা কুমড়োর বাগান হয়ে আছে।
একজন আরেকজনের দিকে আড় চোখে দেখছে।পুরো হল ভর্তি মানুষ।সেই দোকানদারটাকেও ডাকা হয়েছে।
সবার হাসি খুশিতে গমগম করছে গোটা হাবিজাবি বাড়ি।শুধু হাসি নেই বর বউয়ের।ফারাজ তার বাবার দিকে চেয়ে বলে বিয়েটা সে করতে চায়না।কিন্তু ওর কথা শুনে কোনো রিয়েকশান জানাতে পারেনি মানিক সাহেব।তার হাত পা যেন বাঁধা।
তিনি নিজেও দেখেছেন ফারাজ পূর্ণতাকে সবসময় না না বলে দিনশেষে ওকে নিয়েই ভেগেছে তাই এখন আর তিনি কিছু বলতে চান না,করতেও চান না।
পূর্ণতাও তার বাবাকে বললো সে বিয়েটা করতে চায়না।কিন্তু তিনিও কোনো উত্তর দিলেন না।
হুজুরের কথায় যখন কবুল বলার সময় এলো তখন ফারাজের মুখ দিয়ে আর কথা বের হয়না।দাদাজান ওর পাশে বসে ওর দুহাত চাপ দিয়ে ধরে বললেন,’বলো কবুল।আর ছাড়া পাবেনা চান্দু’
ফারাজ তাও কিছু বলছেনা।পূর্ণতা ফিসফিস করে বলছে,’কবুল বলিয়েন না।প্লিজ কবুল বলিয়েন না।আজ যেন আপনার মুখ দিয়ে কবুল না বের হয়’
পাশে বসে থাকা মিসেস সায়না মুচকি হেসে বললেন ‘ওকে মানা করে তুমি নিজেই তো তিনবার বলে দিয়েছো’
পূর্ণতা অমনি নিজের কপালে নিজে একটা বাড়ি মেরে দিলো।ফারাজ বলছেনা কিছু তখন হুজুর ওকে আবারও বলতে বললেন।এরপরেও ফারাজ কিছু বলেনি।
দাদাজান তখন ফোন বের করে ফারাজের দিকে চেয়ে বললেন,’তবে তাই হোক।আজ পূর্ণতার সাথে শাহেদের বিয়ে হোক।যাও পাঞ্জাবিটা খুলে ভাঁজ করে নিয়ে এসো।আমি শাহেদকে ফোন করছি,সে শীঘ্রই চলে আসবে’
ফারাজ হা করে দাদার মুখের দিকে চেয়ে রইলো।মানিক সাহেব এই কথা শুনে চট করে রাজি হয়ে গেলেন।দাদাজানের হাত থেকে ফোন নিয়ে তিনি কল করা ধরলেন শাহেদকে।শাহেদ ফোন রিসিভ করার পর তিনি ওকে জলদি আসতে বললেন বাড়িতে।ফারাজের চোখের সামনে সব হয়ে যাচ্ছে।সে কিছুই করছেনা।পরে দাদাজান ওকে ঝাঁকিয়ে বললেন জলদি করে পাঞ্জাবিটা খুলে নিয়ে আসতে।
ফারাজ উঠে দাঁড়ায়,মূর্তির মতন হেঁটে হেঁটে সে উপরের দিকে চললো।
অরিন্দম দাদাজানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে যদি সত্যি সে পাঞ্জাবি খুলে নিয়ে আসে তখন! দাদাজান মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বললেন এমনটা হবেনা।সে নিজে বিয়ে না করলেও পূর্ণতাকে অন্য কারোর হতে দেবেনা।
ফারাজ তার রুমে এসে বসেই ছিল।প্রায় এক ঘন্টা পর কানের কাছে হইচইর ঢল শুনে কান খাড়া করে সে দরজা খুলে বাইরে বেরোয়।
নিচে শাহেদকে দেখলো পূর্ণতার পাশে বসানো হচ্ছে।
আজিজ খান উপরে চেয়ে ফারাজকে দেখে বললেন,’নাতি তুমি তো আসবানা,পাঞ্জাবিও আনবানা আমরা জানতাম, তাই শাহেদকে শার্ট পরিয়েই পূর্ণতার সাথে বিয়েটা দিচ্ছি।এসো এসো, দেখতে এসো’
ফারাজের যেন পায়ের তলার মাটি নড়ে গেছে।চোখ বড় করে সে বিয়েটা হতে দেখছে।মাথা কাজ করছেনা।পাঁচ মিনিট দেখে সে সবাইকে থামতে বলে।
দ্রুত হেঁটে নিচে নেমে সবার সামনে এসে বললো,’নাহ।শাহেদ পূর্ণতাকে বিয়ে করবেনা’
সবাই ওর মুখের দিকে চেয়ে আছেন।দাদাজান বললেন,’তোমার এত রঙঢং দেখার সময় আমাদের নেই।যাকে বিয়ে করবা তাকে নিয়ে তুমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগো সারাক্ষণ সুতরাং তাকে বিয়ে করার কোনো দরকার নাই তোমার।এই শাহেদ কবুল বলো’
ফারাজ তখন শাহেদকে সরিয়ে নিজে পূর্ণতার পাশে বসে বললো,’না।আমি ওকে বিয়ে করবো,শাহেদ করবেনা’
পূর্ণতা হা করে ফারাজের দিকে তাকালো।সবার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।শাহেদকে এখানে আনা হয়েছিল আগুনে ঘি ঢালার জন্য।কাজটা হয়ে গেছে বলে এবার সে দর্শকের মতন একপাশে দাঁড়িয়ে গেলো।দাদাজান আরও একবার জানতে চাইলেন আসলেই সে বিয়ে করতে চায় কিনা।ফারাজ জোর গলায় বললো সে চায় বিয়ে করতে।
পূর্ণতা শুধু দেখে যাচ্ছে।ফারাজের কবুল বলার পর যখন তার বেলা আসলো তখন সে আর কিছু বলতে পারছেনা।সে রীতিমত আশ্চর্য হয়ে গেছে!
এবার মিসেস সোনালী পূর্ণতাকে খোঁচা দিলেন হুজুর কি বলছে সেটা শুনতে।
পূর্ণতা রোবটের মতন তাই তাই বলে গেলো যেটা হুজুর বলতে বললেন।সে অবাকের শেষ সীমানায় চলে গেছিলো।ফারাজ এত জলদি রাজি হবে সেটা ও কল্পনাও করতে পারেনি।বিয়েটা যে হয়ে গেছে সেটার ও হুশ নেই তার।
ফারাজের কৃতকলাপে সে চমকে বসেই আছে, কোনো কিছু বলার বা করার জোর পাচ্ছেনা।
————–
খাটে উঠে আনাফ মুখে ফুল একটা ধরে আরেকটা ফুল খাটের স্ট্যান্ডে লাগাচ্ছে।নিচে সারথি দাঁড়িয়ে আছে হাতে ফুলের ব্যাগ নিয়ে।আনাফ ফুলটা টেপ দিয়ে লাগিয়ে বললো,’তোমার ভাইয়ের খাটটা ছোট মনে হয়।ওদের দুজনের হবে তো?একজন আরেকজনকে তো পছন্দই করেনা।পরে দেখা গেলো একজন নিচে শোবে’
‘ফারাজ নিচে শুতে পারেনা, ওর ঠাণ্ডা লেগে যায়,সব চেয়ে বড় কথা প্যানিক হয়ে যায় ফ্লোরে শুলে।পূর্ণতাকেও নিচে শুতে দিবেনা যতদূর জানি।খাতাখাতি করে দুজনে বিছানাতেই শোবে।বাবাকে বলে বড় একটা খাটের ব্যবস্থা করে দেবো’
‘বাসরঘর শেষবার সাজিয়েছিলাম আমার একটা বন্ধুর বিয়েতে।এরপর নিজের শালার বাসর ঘর সাজাবো কখনও কল্পনা করিনি।
দেখতে যে সুন্দর হবে এমনটাও না।আমি তেমন করে সাজাতে পারিনা’
‘যে ফুল আনিয়েছে মতিন,হাতে নিয়ে বুঝলাম। ওগুলা দিয়ে আমার মনে হয় সুন্দরই হবে সব’
আনাফ সারথির থেকে একটা গোলাপ নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই গোপন হাসি হাসলো।সারথি বুঝলো না।গোলাপটা সে আলাদা করে রেখে অন্য গোলাপ নিয়ে কাজ করছে এখন।সারথি ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে বলে,’আমি ফুল অনেক পছন্দ করি।গিফট হিসেবে ফুলই বেস্ট বলে মনে হয় আমার’
‘আমায় বলার কারণ আমি যেন এরপর থেকে ফুল দিই?’
‘মোটেও না’
‘মোটেও তাই মনে হলো।তবে তুমি না বললেও কিন্তু আমি সব গিফটের সাথে একটা করে ফুল দিতাম কারণ ফুল আমার নিজেরও অনেক পছন্দ’
‘তাই বলে আপনার নিজের বাড়ির বাগানে ফুল নেই?’
‘তুমি জানলে কি করে?’
‘বাগানে দাঁড়ালেই বোঝা যায় সেটা বাগান নাকি অন্য কিছু’
‘আসলে সময় পাইনা বাগান করার।তবে অনেক শখ আমার।বুড়ো বয়সে বাগান করবো।এখন তো সময় পাইনা’
‘কই?সারাক্ষণ দেখি আমাকে নিয়ে ছুটছেন।রোগী দেখেন কখন?’
‘রাত বিরাতে!ও হ্যাঁ একটা কথা তো বলতে ভুলেই গেছি।শোনো আমি কিন্তু একটা জরুরি বিষয়ে আলাপ করবো তোমার সাথে’
‘কি সেটা?’
আনাফ চট করে বিছানায় বসে সারথির হাত ধরে ওকে কাছে টেনে আনলো এরপর বললো,’ধরো তোমার মুখের পাশের চুলগুলো কানের পেছনে গুজে ঠোঁট দিয়ে ছুঁতে যাচ্ছিলাম তোমার ঐ মুখ ওমনি আমার কল আসে,রোগীর সিরিয়াস অবস্থা তখন কিন্তু না ছুঁয়েই আমায় বেরিয়ে যেতে হবে।তুমি রাগ করতে পারবেনা’
সারথি বিরক্ত হয়ে বলে,’এটা কেমন কথা?আমার কাছে রোগীর চাইতে রোমান্স বেশি হয়ে যাবে?’
‘পুরো কথা তো শুনবে।আমার ভুল সময়ে কল আসে সবসময়।যেমন ধরো রাত বারোটার পরে,দুপুর দুইটার পরে।মানে যখন তোমায় কাছে আনতে যাব তখনই আমার হাসপাতালে মূমুর্ষ রোগী এসে পৌঁছে,এবার ভাবো!!’
——–
পূর্ণতার কান জ্বালাফালা করে তুলেছে দোকানদারের বউ সেলিনা।
তিনি একাই একশো।পূর্ণতাকে জ্ঞান দিয়েই যাচ্ছেন।পূর্ণতা গাল ফুলিয়ে বসে আছে এক কোণায়।
‘শোনো মাইয়া,আমাগো পোলা খুব সাদাসিধা। ওরে নিয়ে ভাববার কিছু নাই। ও হয়ত জানেওনা পিরিত কি জিনিস।তুমি ওরে শিখাইবা।তোমারে দেইখা আমার কেমন জানি বাতি বাতি লাগে’
‘বাতি বাতি মানে কি?’
‘মানে পাকনা আর কি।তুমি এর আগে কয়ডা প্রেম করছিলা?’
‘করি নাই’
‘মিছা কথা কম কও মাইয়া।তোমারে দেখে মনে হয় বহুত কয়ডা প্রেম করছো।তোমার মুখে লেখা আছে”আমি বিশটা প্রেম করছি”
‘আসলেই?আর কি লেখা আছে?’
‘আর লেখা আছে “আমি জামাই পালতে পারমু'”
মিসেস সায়না এসব শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন।পূর্ণতা তব্দা খেয়ে বসে আছে।ফারাজ তাকে বিয়ে করেছে নিজের সম্মতিতে এটা সে ভাবছে।অন্য কিছু ভাবতেও পারছেনা।
————-
রাত নয়টার পরে আবারও সেই জোরজবরদস্তি করে ফারাজ পূর্ণতাকে এক ঘরে করে দেয়া হলো।
আগে ফারাজই ঢুকে ছিল,পূর্ণতা শেষে।
আনাফ আর সারথি মিলে ওদের রুমে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিছে।পূর্ণতা এতক্ষণ নিজেকে শক্ত করে রেখেছিল সবার সামনে,এবার সে পেয়েছে ফারাজকে একা।ঘোমটা ফেলে ফারাজের দিকে আঙ্গুল তুলে এগিয়ে এসে সে বলে,’আপনার থেকে এটা আশা করিনি আমি।আপনি বিয়েটা না করলে আজ আমায় বিয়ে করতে হতোনা’
‘রিয়েলি?আমি আপনাকে বিয়ে না করলে শাহেদের সাথে আপনার বিয়ে হয়ে যেতো’
‘হতোনা।সবাই আপনার মতামত জানার জন্য নাটক করছিল আমি সিওর’
‘নাহ।এটা সত্যিনা।যদি আমি কোনোকিছু না বলতাম তবে শাহেদের সাথে সত্যি সত্যি আপনার বিয়েটা হয়ে যেতো’
‘তবে হতো।অন্তত আপনার সাথে তো হতোনা।আপনি কেন আগ বাড়িয়ে আমায় বিয়ে করলেন?আপনি না আমায় পছন্দ করেন না?তাহলে এটা কি করলেন!’
ফারাজ এবার চুপ।কোনো কিছু না বলে বিছানায় বসে গেছে সে।পূর্ণতা আবারও ধমকে বললো,’বাসর ঘর যে সাজিয়েছে,খাটের ছিরি দেখেছে কেউ?এই খাটে দুজন অপরিচিত মানুষ কেমনে ঘুমাবে?আপনাকে চিনতে আমার আরও কয়েক মাস পাড়ি দিতে হবে সেখানে বাসর রাত থেকেই গায়ের সাথে গা লাগিয়ে শুতে হবে?আমি পারবোনা’
‘আমি অর্কর রুমে গিয়ে ঘুমাবো।আপনি ঘুমান এখানে’
এই কথা বলে ফারাজ তার বালিশ নিয়ে দরজায় হাত লাগাতেই বুঝতে পারলো আনাফ বাইরে দিয়ে দরজা লক করে দিয়েছে।
‘কেউ আছো?দরজা খুলো’
কেউ কোনো সাড়া দেয়নি।পূর্ণতা বিছানায় উঠে বসে বললো,’আমি নিচে শুতে পারবোনা,আপনার সাথে লেগেও শুতে পারবোনা’
‘এক কাজ করেন, আপনি শুইয়েনই না আজকে।জেগে থাকেন,আমায় ঘুমাতে দেন।আমার কাল একটা মেলায় যেতে হবে।আমার আঁকা ছবি সেখানে সেল হবে।’
‘তো?বিয়ে করার সময় মনে ছিল না?কবুল বললেই সব শেষ?কবুল দিয়ে সব শুরু।আমার যে দায়িত্ব আছে সেটা আজ থেকে আপনার।আমি রাতে ঘুমাবো কি করে এটার ভাবনাটাও আপনার।’
‘আপনি তো এত ক্যাচ ক্যাচ করতেন না আগে।বিয়ে হতেই মেয়েরা এমন বদলে যায়?’
‘আমার না বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে আপনি আমায় নিজে জেনে বুঝে বিয়েটা করেছেন।আচ্ছা একটা কথা বলুন,আমার বিয়ে হয়ে গেলে আপনার কি যায় আসতো?আপনি কেন নিজে শাহেদকে সরিয়ে বিয়েটা করে নিলেন?’
‘জানিনা’
ফারাজ বালিশটা আগের জায়গায় রেখো লাইট অফ করে এক কোণায় শুয়ে পড়ে।পূর্ণতা প্রায় দেয়ালের সাথে লেগে গেছে।ফারাজকে একটা ধাক্কা দিয়ে সে বললো,’আমি এই চিপায় ঘুমাবো কি করে?বউ জামাইকে কেউ সিঙ্গেল খাট দেয়?আপনার পরিবার জোর করে বিয়ে দিতে পারছে, জোর করে বড় খাট দিতে পারে নাই?’
‘আপনি এই ঘ্যান ঘ্যান কাল সকালে করবেন?আমায় প্লিজ একটু ঘুমাতে দিন’
‘না দিব না।আমার ঘুমের কি হবে?কাল সকালে উঠে যে নতুন বউ সেজে কত ন্যাকামি করতে হবে ওগুলার জন্য যে এনার্জি লাগবে সেগুলো আসবে কই থেকে যদি আমি রাতে ঘুমাইতে না পারি?!!’
আনাফ তখন বাইরে থেকে বললো,’ডিয়ার নতুন বউ জামাই,দয়া করে আপনারা ঝগড়াঝাঁটি বন্ধ করে হালকা প্রেম ভালবাসা জমিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।নতুন বর বউ গায়ের সাথে লেগে ঘুমালে ভালবাসা চিরকাল থাকে,আমি শুনছিলাম
এক মহাজ্ঞানী বলেছিল’
সারথি জানতে চাইলে কোন মহাজ্ঞানী।
আনাফ তখন নিজের শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে বললো,’ফারাজ ভাই নতুন বউকে এত রাগাইওনা।দরকার হলে ওরে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াও।তোমাদের চেঁচামেচিতে আমরা ডিনারটাও করতে পারছিনা’
পূর্ণতা লজ্জা পেলো,সে তো আস্তে আস্তেই কথা বলছিল তবে সবাই চেঁচামেচি শুনলো কি করে?
চলবে♥
#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৫১
#আফনান_লারা
________
রাত শেষ হতে গিয়েও হচ্ছেনা।সব চেয়ে কষ্ট লাগে তখন যখন ঘুমের শান্তি গায়েব থাকে আর রাতটা হয় দীর্ঘ। ফারাজ ও মনে হয় ঘুমাচ্ছেনা।পায়ের আঙ্গুল নাড়ছে অনবরত।
খাটে হেলান দেয়া অবস্থায় পূর্ণতা এসব খেয়াল করছে।
বিছানায় ঠিকভাবে শুয়েও সে কেন ঘুমাচ্ছেনা তা ভাবে পূর্ণা।সে তো নাহয় জায়গার অভাবে ঘুমাতে পারছেনা।
আরও কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর পূর্ণতা বললো,’কাল থেকে আমি আমার রুমে ঘুমাবো,এভাবে চিকন খাটে শোয়ার চাইতে আলাদা শোয়াই ভাল।আগে যেমন ছিলাম ভাল ছিলাম’
‘আর আপনার মনে হয় দাদাজান সহ বাড়ির আর বাদ বাকি সবাই এটা মেনে নেবে?’
‘না মানলে বড় খাট এনে দিক।আমার চোখে ঘুম এসে ভর্তি হয় আছে অথচ জায়গা অসুন্দরের কারণে ঘুমটাকে একটা নাম দিতে পারছিনা।আচ্ছা আপনি ঘুমান না কেন?’
‘আমি কারোর অশান্তি দেখে নিজে শান্তিতে ঘুমাতে পারি না’
পূর্ণতার কেন যেন এই কথা শুনে অনেক আনন্দ হলো।ফারাজের ওর প্রতি টান আছে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে সে গুটিশুটি দিয়ে শুয়ে পড়ে।ওকে হঠাৎ শুয়ে পড়তে দেখে ফারাজ অবাক হলো কিছুটা।
এতক্ষণ তো বসে বসে ঘ্যান ঘ্যান করছিল,হঠাৎ চিপায় ঘুমাতে রাজি হলোই বা কেন!’
———
আনাফ সবার সাথে বসেছে ডিনার করতে।
দাদাজান এক চামচ ডাল খাচ্ছেন আর আনাফকে একবার করে দেখছেন।মানিক সাহেব এখনও জানেন না আনাফ কদিন পর সারথিকে বিয়ে করবে।সারথি আনাফের পাশে বসেই খাচ্ছিল।খাবার খেতে খেতে মানিক সাহেব বললেন,’তা বাবা তুমি আর সারথি কতদিন থেকে বন্ধু?’
‘এই হলো এক মাসের বেশি’
‘সজীবের কথা জানো?’
‘হুম জানি’
‘ছেলে মেয়ে কখনও বন্ধু হতে পারেনা সেটা কি মানো?’
আনাফ মুচকি হাসলো।সারথি থ হয়ে বসে আছে।বাবা যে কোন টপিক থেকে কোন টপিকে টানচেন সেটা নিয়ে সে বেশ ভাল বুঝতে পারছে।
‘মানি। আমি তো বলছিনা আমি আর সারথি কেবলই বন্ধু’
‘তবে?’
এই কথার জবাব দিলেন দাদাজান।বাটির ডাল সবটুকু শেষ করে খালি বাটি মিসেস সোনালীর দিকে ধরে বললেন,’আনাফ তোমার মেয়ের হবু জামাই হয় মানিক।সে সারথিকে বিয়ে করবে’
মানিকের হাত থেকে রুটির টুকরাটা পড়ে গেলো।আশ্চর্য হয়ে তিনি অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন বেলায়েত হোসেনের দিকে।বেলায়েত হোসেন আবার বললেন,’তোমার কি মত?এর আগে তো জোর করে মেয়েকে একটা কাপুরুষের হাতে তুলে দিয়েছিলে।এবার মেয়েকে নিজের মতে কিছু করতে দাও অন্তত ‘
মানিক সাহেব কিছু না বলে উঠে চলে গেছেন।
আনাফ সব দেখেছে চুপচাপ।সারথির পাতের ভাত শেষ হচ্ছেনা শুরু থেকেই,সে হয়ত অনেক চিন্তা করছে বসে বসে।আনাফ তখন ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’তোমার বাবা তোমার ভাইয়ের বিয়ে আটকাতে পারেনি,তোমার কি মনে হয় তোমার বিয়ে আটকাতে পারবে?’
‘আমি এই নিয়ে বাবার সাথে কথা বলবো’
বেলায়েত হোসেন আনাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’বাবা তুমি তোমার পরিবারের সাথে কথা বলবে আজকেই।এরপর কি হয় আমাদের জানাবে।পরিবারের অমতে করা বিয়ে বেশিদিন টিকে না’
আনাফ হাসলো।তার হাসিতে লুকিয়ে আছে বেলায়েত হোসেনের বলা কথাটার নেই কোনো গুরুত্ব।
‘দাদু ভাগ্য বলেও কিন্তু কিছু আছে।এই যে বললেন পরিবারের অমতে বিয়ে করলে বিয়ে বেশিদিন টিকেনা,সজীবের সাথে সারথির বিয়েটা কিন্তু সম্পূর্ণ পরিবারের দ্বারাই। তাহলে সেটা টিকলোনা কেন?সবসময় রীতি অনুুযায়ী সব হয়না দাদু।মাঝে মাঝে ভাগ্যের উপর নির্ভর করতে হয়।সারথিকে আমি ভালবাসি,এটা সব চাইতে বড় কথা।আর টিকবে নাকি টিকবেনা সেটা নাহয় আমার উপরই থাকুক।কারণ আমি কিন্তু আমাদের সম্পর্কটার মজবুত খুঁটি।
বাবা মায়ের মতামত থাকবে আমার ধারণা।যদি না থাকে তবে তাদের মত আনতে যা করা লাগে আমি করবো।আপনি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন দাদু। আচ্ছা আজ আমি আসি।ফোনে কথা হবে এরপরে’
দাদাজান ওকে থামতে বলে বললেন,’বাগানের দিকে গিয়ে বসো।তোমার সাথে আমার কথা আছে।আমি এই বেলায় গরম দুধ খাই।তুমিও আমার সাথে খেও’
এই বলে বেলায়েত হোসেন উঠে চলে গেছেন।আনাফ সারথির কানের কাছে আবারও ফিসফিস করে বললো’,যাই,ফোন দিব কিন্তু।রিসিভ করবা ঠিকমত’
এটা বলে আনাফ উঠে চলে গেলো বেলায়েত হোসেনের পিছু পিছু।
—–
আনাফ দাদাজানের সামনে বরাবর বসে আছে চুপচাপ।তাদের দুজনের সামনের টেবিলে ধোঁয়া ওঠা গরম দুধের গ্লাস।আনাফ এমনিতেও রাতে দুধ খেয়ে ঘুমায়।তাই দাদাজানের স্বাস্থ্য সচেতনতা দেখে সে খুশি হলো।দাদাজান কিছুই বলছেননা।অথচ যেভাবে ডেকেছিলেন যেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু।আনাফ তো জানেনা দাদাজান ডাকার পর পনেরো/দশ মিনিট কোনো কথা বলেন না।
বেশ কিছুসময় পর গ্লাসের দুধটা শেষ করে তিনি বললেন,’যদি তোমার বাবা মা রাজি না হন কোনোমতেই, তবে কি করবে?শুধু এটার জবাব দাও’
‘যদি একেবারেই না মানে তবে আমার সামর্থ্য আছে সারথিকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকার’
‘মা বাবা এত কষ্ট করে মানুষ করলো তোমায়, সেটার কি দাম নেই?’
‘মাসে মাসে যে চেক আমি তাদের হাতে দিই সেটা কখনওই বাদ যাবেনা।আমি সারথি দুজনেই তাদের মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করবো’
——–
সারথি তার রুমে বসে আনাফের কথাই ভাবছিল।আনাফ গেছে কিনা সে তো জানেনা।যদি জানতো!!
আনাফ কি এক বার বলে যাবে!!
দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজে সারথির ঘোর কাটে।পেছনে ফিরে বলে,’কে?’
ওপাশ থেকে কোনো সাড়া আসেনা।সারথি দু কদম এগিয়ে আবার বলে,’আনাফ?’
‘ধুর!কি করে বুঝলা?’
‘আতরের গন্ধে’
‘আমি আর আতর লাগাবোই না।
চলে যাচ্ছি বলে বলতে এলাম।আবার কবে দেখা হবে কে জানে।”প্রেমের সম্পর্ক পরিবারকে জানালে দেখা করা লাটে ওঠে”
আনাফের এই কথা শুনে সারথির ভীষণ হাসি পেলো।হাসতে হাসতে বললো,’আচ্ছা আমি নাহয় বের হবো দেখা করতে’
‘সত্যি তাই?’
‘হ্যাঁ।আমার তো ধরা বাঁধা নেই।বের হতেই পারি’
‘তাহলে ভাল হলো।তবে আসি?’
‘আসেন’
আনাফ চলে গেলো হয়ত।সারথির নাকের কাছে আতরের গন্ধটা যেন খুব তীব্র হয়ে এসেছে।অথচ আনাফ বললো সে চলে যাচ্ছে।
সারথি সামনে হাত বাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে আনাফ সত্যি গেছে কিনা।সামনে আনাফ নেই,কিন্তু সেই আতরের গন্ধটা খুব মোটা করে পাচ্ছে সে।
এটা কি মনের ভুল নাকি সত্যি আনাফ ওর খুব কাছে।
সারথি শক্ত গলায় বললো,’আপনি যে যান নি আমি জানি।লুকোচুরির কারণ বলবেন?’
আনাফ সত্যি ছিল এখানে।সারথির ঠিক পেছনে।সারথি ধরে ফেলেছে বলে সে চুপিচুপি চলে গেছে আবার।
———
রাত গভীর হতেই ফারাজ টের পেলো তার পিঠের সাথে লেগে আছে পূর্ণতার মাথা।চুলে ঘঁষা লাগাচ্ছে যতবার ফারাজ নড়ছে ততবার ।
ছোটকাল থেকেই তাকে এই রুমটা দেয়া হয়েছে।সে কখনও কোনো কাজিনের সাথেও রাতে এক ঘরে ঘুমায়নি যার কারণে আজ পাশে অন্য একজনকে সে মেনে নিতে পারছেনা।ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে তার কাছে।উদ্ভট প্রকৃতির মনে হয় সবকিছু।
সে মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু রুম অন্ধকারের দরুণ কিছুই দেখলোনা।তবে অনুভবে বুঝতে পারছে সে।
পূর্ণতা ঘুমের ঘোরে গড়াগড়ি করেনা কিন্তু আজ খাটের বেহাল দশার কারণে তার গড়াগড়ি এসে গেছে এমন ভাবে যে ফারাজ রীতিমত বিরক্ত। সে ফারাজের পিঠে নিজের মাথা ঘঁষেই চলেছে।শেষে ফারাজ উঠে বসে যাওয়ায় তার হুশ ফেরে।মাথা তুলে অসহায়ের মতন চেয়ে থাকে ফারাজের দিকে।
‘আপনি এমন বাচ্চামো শুরু করেছেন কেন পূর্ণতা?’
‘কি করেছি?ফিডারে করে দুধ খেয়েছি?বাচ্চার সাথে তুলনা করছেন কেন?’
‘ফিডারে করে দুধ খেলেও হতো।আপনি মাথা দিয়ে যে জ্বালাতন করছেন আমায়।নিজে তো ঘুমাচ্ছেন না, সাথে আমাকেও ঘুমাতে দিচ্ছেন না’
————–
লেভেন সকাল সকাল এসে হাজির।সে আজ সারাদিন সজীবের সাথে কাটাবে বলে ঠিক করেছে।এসে জানতে পারে সজীব কাল সমুদ্র দেখতে যেয়ে আর বাসায় ফেরেনি।সজীব যে কেবল মন খারাপ থাকলেই সমুদ্রের দিকে যায় এটা লেভেন জানে।
এখন তো ওদের দুজনের হাসিখুশি থাকার কথা।তবে সে কি কারণে কাল সমুদ্রে দেখতে গিয়ে আর আসলোনা।হাতের ব্যাগটা বিছানায় ফেলে লেভেন বিচের দিকে চলে আসে।এসে দেখে তোয়ালে বিছিয়ে সজীব শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছে বালির উপর।
লেভেন ওর কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বললো,’কি হয়েছে তোমার বলবে?’
‘কিছুই হয়নি’
‘এরকম তো ছিলেনা।তোমায় ছন্নছাড়া মানায়না সজীব’
‘আমি বেশ আছি’
‘না ঠিক নেই তুমি।সত্যি করে বলবে তুমি সারথিকে আমার চেয়ে বেশি ভালবাসো?’
‘নাহ।আমি কেবল তোমাকেই ভালবাসি’
‘তাহলে ওর জন্য তোমার মন পুড়ছে কেন?’
‘পোড়েনা।আমি ওসব ভাবছিনা’
‘তোমার সাথে থেকে থেকে এতগুলো বছরে আমি এটা জানতে পেরেছি তুমি কখন কাকে নিয়ে ভাবো।’
‘তুমি ভুল লেভেন’
লেভেন সজীবের বুকে মাথা রেখে নিজেও বালিতে গা এলিয়ে দিলো।সজীবের গায়ে বালি লেগে আছে।সেই বালিতে নিজের মুখটা বিছিয়ে সে সজীবের দিকে চেয়ে থাকে।সজীবের চোখ শুধুই রোদমাখা আকাশটার দিকে।সে আকাশের দিকে চেয়ে আছে ঠিক তবে সে অন্যকিছু ভাবছে বলেই আকাশটা দেখছে।
মানুষ আকাশকে দেখতে আকাশ দেখেনা।আকাশ দেখার নাম করে মানুষ নিজের সবচাইতে কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।মূলত আকাশকে পর্দা বানিয়ে সেই পর্দায় মানুষ অন্য ছবি দেখে।
সজীব সেটাই করছে।লেভেন সজীবের বুকে অনেকক্ষণ এপাশওপাশ করে উঠে গেলো।কিছু কিছু পুরুষ মানুষ এমন ভাবে তৈরি যে তারা যাকে একবার মন থেকে চায়,যার মায়ায় একবার পড়ে যায় এরপর যত সুন্দর,যত পারফেক্ট সামনে ঘোরাফেরা করুক না কেন তারা ঐ আগের সুন্দরটাকেই ভাবে,তাকেই চায়।তাদের জোর করে কিছু করানো যায়না।তারা যেটা ঠিক করে রাখে সেটাই করে।সজীব ঠিক সেই কাতারের পুরুষ।সে সারথিকে হয়ত পছন্দ করে যার কারণে এখন লেভেনের সাথে জড়িয়ে পড়ায় সে ওকে চেয়েও মন থেকে সরিয়ে নিতে পারছেনা।
লেভেন বালিতে বসে থেকে এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ যাবত সজীবকে দেখছিল।
বিচের ঢেউের সাথে মিশে ঠাণ্ডা হাওয়া মিলিয়ে যে রোমান্টিক এপটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল সেই পরিবেশটাকে সজীব নেহাত উড়িয়ে দিচ্ছে। তার মনে প্রেম আসছেনা।
লেভেন সজীবের হাত একটা টান দিয়ে বললো,’চলো সাঁতরাবো’
‘ইচ্ছে করেনা’
‘করবে,এসো আমার সাথে’
‘মনের বিরুদ্ধে কিছু করলে তার ফলাফল কি জঘন্য হয় জানো লেভেন?’
‘আমার সাথে এমন কেন করছো সজীব?তুমি আসলে কি চাচ্ছো?
আমাদের বিয়ের কিন্তু খুব বেশি দেরি নেই।তুমি কি পিছু পা হতে চাও?’
‘লেভেন আমি একা থাকতে চাই।তুমি প্লিজ আজ থেকে তিনদিন পর আসবে?এই তিনদিনে আমি গুছিয়ে নেবো নিজেকে’
লেভেন চুপ করে উঠে চলে গেলো, আর একটিবার পেছনে ফিরে তাকায়নি।ও চলে যেতেই বালি থেকে উঠে সজীব পানির দিকে গেলো।
সমুদ্রে গা ভেজানো যায় মন ভাল থাকুক কিংবা খারাপ থাকুক।তবে সেটা একা একা।
পাশে কেউ থাকলো মন যেন ভরে না।একা একা সাঁতারে যে আনন্দ,সঙ্গীকে নিয়ে সাঁতারে সে আনন্দ অন্যরকম হলেও,আগের আনন্দটার কাছাকাছি কখনওই যেতে পারেনা।
পানিতে ডুব দিয়ে মাথা তুলে সজীব আবারও আকাশের দিকে তাকায়।
সারথি একদিন বলছিল,’জানেন!আমি জানি আকাশটা খুব আলোকিত।হয়ত দেখতে পাইনা তাও আমার ধারণা আকাশটা অনেক উজ্জ্বল রঙ দিয়ে গড়া।কারণ আমি মাথা তুলে আকাশ দেখলেই চোখের সামনের অন্ধকারটা যেন লাঘব হতে থাকে।অথচ ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থেকেও আমি আকাশের রঙটা খুঁজে পাইনা।’
সেই কথাটা মাথায় রেললাইনের মতন কেবল ঘুরছে।লেভেন ও তো কত কথা বলে।তবে লেভেনের কথা কেন মনে পড়েনা,কানে বাজেনা?”
চলবে♥