তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-২৮+২৯

0
528

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২৮

ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমিরা আপু গাল ফুলিয়ে বসে আছে। বড়োরা খাওয়া শেষ করে ওঠার পর আমরা ছোটোরা সবাই একসাথে খেতে বসেছি। আমিরা আপু খুব আশা নিয়ে আগে-আগে তাজ ভাইয়ের পাশের চেয়ারে বসেছিল। কিন্তু আমি এসে তাদের বিপরীত দিকের চেয়ারে বসার পর, তাজ ভাই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়েছেন। তার কান্ডে উপস্থিত সবাই মুখ টিপে হাসলেও আমিরা আপুর মুখটা চুপসে গেল। মেয়ের মুখের অবস্থা দেখে ফুপু তাজ ভাইকে প্রশ্ন করলেন,“ওখান থেকে আবার এখানে এলি কেন বাবা?”

তাজ ভাই স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন,“ইলু ঠিকমতো না খেলে ওর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। দূরে বসে থাকলে ও অজুহাত দেখিয়ে ঠিকমতো খাবে না।”

আমিরা আপু বলে উঠল,“তা দেখার জন্য তো বড়োরা আছে ভাইয়া। আপনাকেই কেন লাগবে?”

আমিরা আপুর সাথে তাল মিলিয়ে জুম্মান ভাইয়াও বললেন,“তাই তো, এখানে আম্মু আছে, মামি আছে। তারা তো খেয়াল রাখবেই।”

তাজ ভাই তাদের কথায় কান না দিয়ে খেতে আরম্ভ করলেন। খাবার মুখে পুরে আমাকে বললেন,“খাচ্ছিস না কেন?”

আমি খাবার মুখে তুলতে গিয়েও থেমে গেলাম। তাজ ভাই ভ্রুকুটি করে পুনরায় প্রশ্ন করলেন,“কী হয়েছে?”

আমি এদিক-ওদিক সন্ধানী দৃষ্টি বিচরণ করে বললাম,“জেমি কোথায়? এখানেই তো ছিল।”

অর্নি ভাবি হেসে বললেন,“এখানেই আশেপাশে আছে হয়তো। চিন্তা কোরো না। তুমি খাও, জেমিকে আমি খাবার দিচ্ছি।”

অর্নি ভাবি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠতে যেতেই জেমি এসে উপস্থিত। এসেই আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে মিয়াও মিয়াও শুরু করে দিলো। অর্নি ভাবি একটা বাটিতে মাংস তুলতে নিতেই ফুপু বাধা দিয়ে বললেন,“আরে থামো, থামো। আমি দিচ্ছি খাবার, তুমি খাও।”

অর্নি ভাবি ‘আচ্ছা’ বলে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। ফুপু রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আমি পরোটা ছিঁড়ে মুখে পুরে চিবোতে-চিবোতে রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকালাম। ফুপু একটা বাটি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাটিটা জেমির সামনে রাখতেই আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বাটিতে কিছু হাড়গোড়, একটু আগে বড়োরা খাওয়ার পর যেগুলো ফেলে দিয়েছিল সেগুলোই হয়তো। জেমি সেগুলো শুঁকে বাটির কাছ থেকে সরে এসে আবার আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে মিয়াও মিয়াও শুরু করল। আমি কিছু বলতেও পারছি না। তাজ ভাই জেমির বাটির দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে বললেন,“এসব কী দিয়েছ ফুপু?”

ফুপু বললেন,“বিড়ালকে এছাড়া আবার কী দিব?”

মিনহা আপু বলল,“কেন? তুমি দেখনি জেমি কী খায়?”

“দেখেছি। বলি একটা বিড়ালকে নিয়ে এত আদিকখেতার কী দরকার? মাছ-মাংস না দিলে ক্ষুধার জ্বালায় সবই খাবে।”

আমি খাবার রেখে অবাক দৃষ্টিতে ফুপুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। তাজ ভাই বললেন,“এসব ও কখনও খায় না ফুপু।”

আহনাফ ভাইয়া বললেন,“ওসব ফেলে মাংস দাও ফুপু।”

মেজো কাকি বললেন,“আমি দিচ্ছি‌।”

সঙ্গে সঙ্গে ফুপু ধমকের সুরে বললেন,“চুপচাপ খা তো নিজেরা। একটা বিড়ালের খাবারের জন্য নিজেরা খাওয়া বন্ধ করে বসে আছে সবাই। আজব! ক্ষুধা পেলে সবই খাবে দেখিস। এসব বিড়াল-টিড়ালকে মাথায় তুলতে হয় না।”

ফুপুর ধমক শুনে সবাই চুপচাপ খাওয়া শুরু করল। তাজ ভাই জেমির দিকে তাকিয়ে আছেন। জেমি ক্ষুধায় আমার চেয়ারে দু’পা তুলে জোরে-জোরে চেঁচামেচি করছে। আমি না পারছি কিছু বলতে, না পারছি সহ্য করতে। ওর ক্ষুধার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে, ওর এমন আচরণ দেখে আমার চোখে পানি চলে এল। আমি টলমল চোখে, অসহায় দৃষ্টিতে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। ওনার মুখটা গম্ভীর দেখাচ্ছে। ফুপু আমাকে বললেন,“কী হলো? খাও।”

আমি জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। মাথা নিচু করে পরোটা ছিঁড়ে মুখে তুলতে যেতেই হুট করে তাজ ভাই নিজের প্লেটটা দূরে ঠেলে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। উপস্থিত সবাই তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। ফুপু ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বললেন,“কী হলো বাবা? এভাবে উঠে গেলি কেন? খাবার ভালো হয়নি?”

তাজ ভাই তার কথায় কান না দিয়ে আমার হাত ধরে টেনে দাঁড় করালেন। তারপর শ্রেয়ান ভাইয়া আর নাসের ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,“লাগেজ গুছিয়ে নে, হারি আপ।”

কথাটা বলে তাজ ভাই এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। আমার হাত ধরে টানতে-টানতে দ্রুত সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন। উপস্থিত সবাই ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে আমাদের পেছন-পেছন ছুটে এলেন। কিন্তু তাজ ভাই তাদের আগেই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে এসে সোজা আমার রুমে চলে এলেন। রুমে ঢুকেই ভেতর থেকে দরজা আটকে দিয়ে আমার লাগেজ বের করে জামাকাপড় গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ওদিকে বাইরে থেকে সবাই দরজা ধাক্কাধাক্কি করছে, আর তাজ ভাইকে ডেকে চলেছে। আমি হতবাক হয়ে ওনার কান্ড দেখতে লাগলাম। তাজ ভাই পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে ফোন করলেন। ওপাশের ব্যক্তি ফোন রিসিভ করতেই বললেন,“শ্রেয়ান, কী করছিস তুই?”

শ্রেয়ান ভাইয়া কিছু একটা বলতেই উনি রাগত স্বরে বললেন,“আমি তোকে হাত-পা তুলে বসে থাকতে বলেছি? তাড়াতাড়ি লাগেজ গুছিয়ে নে, পারলে আমারটাও গোছা। আমি এক্ষুনি আসছি।”

উনি ফোন রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? রেডি হয়ে নে।”

আমি সাহস করে এগিয়ে গিয়ে বললাম,“আপনি না গতকাল রাতেই বললেন বউ ভাতের অনুষ্ঠানের পরে যাবেন? এখন আপনি চলে গেলে সবাই ভাববে আমার জন্য আপনি চলে গেছেন। এভাবে চলে যাওয়া কি ঠিক হবে?”

আমার কথা শেষ হতেই উনি ধমকে উঠে বললেন,“ঠিক ভুল আমি তোর থেকে শিখব? রেডি হতে বলেছি রেডি হ। বাড়তি কথা বলতে বলিনি।”

ওনার ধমক শুনে আমি মিইয়ে গেলাম। ওনার ভাঁজ করা কাপড়গুলো থেকে একটা ড্রেস নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম ওনার লাগেজ গোছানো শেষ। দরজার বাইরে এখনও সবার হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। উনি উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতে-বাড়াতে বললেন,“আমি রেডি হয়ে আসছি। ততক্ষণ পর্যন্ত রুম থেকে বেরোবি না।”

আমার উত্তরের আশা না করে উনি দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। উনি বেরোতেই দরজার সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলো ওনাকে বুঝাতে-বুঝাতে ওনার পেছনে ছুটলেন। আমি সেদিকে কান না দিয়ে চুপচাপ রেডি হতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হিজাব পরার সময় আমিরা আপু রুমে এল। সে এসেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ-মুখ শক্ত করে রাগত স্বরে বলল,“এই মেয়ে, খুব ভালোভাবেই হাত করেছ দেখছি ওনাকে। বড়োদের কথাও শুনছে না, ভাবা যায়! আর তোমাকে রেডি হতে বলেছে বলেই রেডি হওয়া শুরু করে দিলে? ড্রেস চেঞ্জ করে এক্ষুনি গিয়ে ওনাকে বলো তুমি আজ যাবে না।”

আমি বললাম,“উনি আমার কথা শোনার মতো মানুষ না আপু। আমি বলেছিলাম, কিন্তু উনি উলটো আমাকেই ধমকেছেন। তোমাদের কথাই তো শুনছে না। দেখছো না?”

আপু দাঁতে-দাঁত চেপে বললেন,“ঠিক আছে, যাচ্ছ যাও। কিন্তু একটা কথা ভালোভাবে মাথায় ঢুকিয়ে যাও। তাজ ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাড়ির বড়োরা সবাই মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বড়োদের সিদ্ধান্ত উনি ফেলতে পারবেন না। বলা যায় আমি খুব শিঘ্রই ওনার বউ হতে চলেছি। তাই এখন থেকে ওনার কাছ থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখবে। ওনার আশেপাশেও ঘেঁষবে না, খবরদার।”

আমি হা করে আমিরা আপুর কথা শুনলাম। কথা শেষ করেই আপু যেভাবে এসেছিল সেভাবেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ভাবলাম,“হিন্দি সিরিয়ালের খলনায়িকাদের মতো হুমকি দিয়ে গেল!” পরক্ষণেই এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে হিজাব পরায় মনোযোগ দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই বাইরে থেকে শ্রেয়ান ভাইয়ার কন্ঠস্বর শোনা গেল। সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ডেকে বললেন,“ইলোমিলো, আসব?”

আমি বললাম,“আসুন ভাইয়া।”

শ্রেয়ান ভাইয়া রুমে ঢুকে আমার লাগেজটা হাতে নিয়ে বললেন,“চলো।”

আমি শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে রুম থেকে বেরোতে-বেরোতে বললাম,“ওনাকে একটু বোঝান না ভাইয়া। এভাবে চলে গেলে এ বাড়ির সবাই আমাকে দোষারোপ করবে।”

শ্রেয়ান ভাইয়া হতাশ গলায় বললেন,“ও শুনবে আমার কথা? দেখো না কথায়-কথায় কীভাবে ধমকায়?”

আমি মুখটা ছোটো করে বললাম,“আমাকেও ধমকেছে। লোকটা পারেও বটে!”

“ওর জায়গায় আমি থাকলেও ঠিক এটাই করতাম। শুনতে খারাপ লাগলেও, এ বাড়ির কিছু-কিছু মানুষের আচরণ সহ্য করার মতো না। এজন্যই তাজ এত রেগে গেছে।”

“হুম। জেমি কোথায়?”

“নাসেরের কাছে।”

আমরা নিচে এসে দেখলাম বাড়ির সবাই এখনও তাজ ভাইকে ঘিরে দাঁড়িয়ে নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেই চলেছে। কিন্তু উনি কারোর কথা কানে তুলছেন না। ওনার কাকারা কেউ এখন বাড়িতে নেই। তারা থাকলে হয়তো ওনাকে আটকানো সম্ভব হত। আমরা নিচে আসতেই তাজ ভাই আমাদের ইশারায় ডেকে সবার উদ্দেশ্যে ‘আসি’ বলেই দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার পেছন-পেছন নাসের ভাইয়াও ছুটলেন। আমি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গিয়ে বড়ো কাকির সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,“আসছি কাকি, ভালো থাকবেন।”

কাকি ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,“আবার এসো মা।”

“আপনারাও যাবেন আমাদের বাসায়।”

আমি আর শ্রেয়ান ভাইয়া সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ছোটো কাকি, ফুপু আর আমিরা আপু বিদায় নেওয়ার মুহুর্তেও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম তাজ ভাই জায়েদ ভাইয়াদের সাথে কথা বলছেন। আমি তাদের থেকে বিদায় নিতে যেতেই মাহিন ভাইয়া বললেন,“নেক্সট টাইম ঢাকায় গেলে তোমার সাথে মিট করব ইলোরা। ভালো থেকো।”

আমি হাসিমুখে বললাম,“নিশ্চয়ই, আমাদের বাসায় যাবেন কিন্তু ভাইয়া।”

মাহিন ভাইয়া হেসে বললেন,“ইন শা আল্লাহ্।”

গাড়িতে ওঠার সময়ও আফনান ভাইয়া তাজ ভাইকে বললেন,“এভাবে না গেলেও পারতি ভাই। আবার আসবি তো?”

“ইচ্ছে হলে আসব। তোমরা সবাই যেয়ো ঢাকায়।” বলেই তাজ ভাই গাড়িতে উঠে বসলেন। আসার সময় যেভাবে বসেছিলাম, যাওয়ার সময়ও সেভাবেই বসলাম। তাজ ভাই ড্রাইভিং সিটে, আমি তার পাশের সিটে, শ্রেয়ান ভাইয়া আর নাসের ভাইয়া পেছনের সিটে। গাড়ি স্টার্ট করার পর থেকে তাজ ভাই একটা কথাও বললেন না। আমি আড়চোখে ওনার দিকে কয়েকবার তাকালাম। নাকের ডগায় এত রাগ নিয়ে থাকে বলেই বোধ হয় লোকটা মাফিয়া হতে পেরেছেন। প্রায় বিশ মিনিটের মতো ড্রাইভ করার পর তাজ ভাই একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামালেন। আমরা গাড়ি থেকে নেমে রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। সকালের খাবারটা কারোরই হয়নি, বিধায় সবারই ক্ষুধা পেয়েছে। তাজ ভাই নিজে জেমিকে খাওয়ালেন। অথচ কদিন আগে নিজেই জেমিকে ফেলে দিয়ে এসেছিলেন, ভাবতেই আমার হাসি পেল। সবাই পেটপুরে খেয়েদেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। আমার, শ্রেয়ান ভাইয়ার আর নাসের ভাইয়ার কথা শুনতে-শুনতে এক সময় তাজ ভাইয়ের রাগ হাওয়া হয়ে গেল। তারপর কথায়-কথায় আমাদের জার্নিটা বেশ ভালোই কাটল। বাসায় পৌঁছাতে-পৌঁছাতে দুপুর আড়াইটা বাজল। শ্রেয়ান ভাইয়া আর নাসের ভাইয়া পথেই নেমে পড়েছিলেন। তারা ট্যাক্সি নিয়ে যার-যার বাড়ি ফিরে গেছেন। শুক্রবার হওয়ার দরুন বাবা বাড়িতেই ছিল। আমরা বাড়িতে প্রবেশ করতেই সে ছুটে এসে আমাদের বুকে জড়িয়ে নিলেন। মারজিয়া খালা, মিতা আর রিতাও ছুটে এল। তাদের চোখ-মুখের খুশিই জানান দিলো, আমাদের অনুপস্থিতিতে তাদের মন কিছুটা হলেও খারাপ ছিল।

___________________________________

বিকাল সাড়ে চারটা বাজে। আমি ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি। পাশের সোফায় তাজ ভাই কাত হয়ে শুয়ে মনোযোগ দিয়ে টিভিতে খবর দেখছেন।

“ওই পিচ্চি, বারবার ঘড়ির দিকে কী দেখছিস? জামাই আসার কথা না কি আজ?”

তাজ ভাইয়ের কথায় আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ওনার দিকে তাকালাম। বললাম,“আমি বিয়ে করলাম কবে?”

“আমি কী জানি! করতেও পারিস। আজকাল কাউকে বিশ্বাস নেই।”

“তাহলে তো আপনিও বিয়ে করেছেন। ঐ যে পলাশ ভাইয়া আর তার বউ বারবার ভুল করে আমাকে ভাবি বলে ফেলেছিল। তার মানে আপনি সত্যিই গোপনে বিয়ে করে বসে আছেন?”

তাজ ভাই চোখ বড়ো করে বললেন,“আরে শুধু বিয়ে না কি? আমার তো কয়েক হালি বাচ্চাকাচ্চাও আছে।”

ওনার কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। পরক্ষণেই তাজ ভাইয়ের দৃষ্টি লক্ষ্য করে থেমে গেলাম। উনি একদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ইতস্তত বোধ করে নড়েচড়ে বসলাম। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠতেই আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই বললেন,“সত্যি-সত্যিই তোর জামাই চলে এল না কি রে? কার জন্য অপেক্ষা করছিলি?”

“এক্ষুনি দেখতে পারবেন।” হাসিমুখে কথাটা বলেই আমি ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম। দরজা খুলতেই ওপাশের মানুষটা ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“কেমন আছিস ইলো?”

আমিও তাকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বললাম,“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

“ভালো। তাজ ভাইয়া কোথায়?” বলতে-বলতে আফরা আপু আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি বললাম,“ভেতরেই আছে। আসো।”

আফরা আপু লাগেজ নিয়ে ভেতরে ঢুকল। আমি দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে গেলাম। আফরা আপু হাসিমুখে তাজ ভাইয়ের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। আপুকে দেখে তাজ ভাই হয়তো কিছুটা অবাক হয়েছেন। আপু কিছুক্ষণ গল্প করে লাগেজ রাখতে রুমে যেতেই তাজ ভাই আমাকে বললেন,“এই পিচ্চি, ও আসবে আমাকে বলিসনি কেন?”

আমি ত্যাড়াভাবে বললাম,“কেন? বললে কি পার্লারে গিয়ে সাজগোজ করে আসতেন?”

“সাট আপ। এই, ও কি পার্মানেন্টলি এখানে চলে এসেছে?”

“হ্যাঁ। কথা তো এটাই ছিল যে, এখন থেকে আপু এখানে থেকেই পড়াশোনা করবে। এ কদিন আমি বাসায় ছিলাম না বলে আপু আসেনি। আজ আমি বাসায় আসার সময় গাড়িতে বসেই আপুকে মেসেজে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমি বাড়ি ফিরছি। তাই আপুও আজ চলে এল। এরমধ্যে না কি একদিন এসে আপু তার যাবতীয় জিনিসপত্র সব রেখে গিয়েছিল, একসাথে নিয়ে আসতে ঝামেলা হবে বলে। ভালো হয়েছে না আপু আসায়? বাড়িতে একজন মানুষ বাড়ল।”

বলেই আমি দাঁত কেলিয়ে হাসলাম। তাজ ভাই আমার মাথায় চাটি মেরে বললেন,“যা হাসার হেসে নে। দুদিন পর আবার দেখবি নিজেই এজন্য আফসোস করছিস।”

আমি গাল ফুলিয়ে হাতের তালুতে মাথা ঘষতে-ঘষতে বললাম,“উফ্! মাথায় ব্যথা পেয়েছি। আফসোস করব কেন? আজব কথা!”

“সময় এলে এমনিতেই বুঝে যাবি পিচ্চি। এখন হাজার বুঝালেও বুঝবি না। আসলে, সমস্যাটা হচ্ছে তোর মোটা মাথায়।” কথাগুলো বলতে-বলতে উনি দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলেন। আমি গাল ফুলিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম রিতা দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমি কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলাম,“হাসছিস কেন?”

“ভাইয়া ঠিকই বলে, আপনি সত্যিই মাথামোটা।” দাঁত কেলিয়ে কথাটা বলেই রিতা রান্নাঘরের দিকে ভোঁ দৌড় দিলো। আমি হা করে আহাম্মকের মতো সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। শেষে কি না সার্ভেন্টের মুখেও ‘মাথামোটা’ শব্দটা শুনতে হলো!

চলবে………………🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২৯

ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে বারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই। এখনও তাজ ভাইয়ের বাড়ি ফেরার নাম নেই। বাবা আর আফরা আপু সাড়ে দশটায় ডিনার করেছে। আমাকে খেতে ডাকায় আমি বলে দিয়েছি ক্ষুধা নেই। তবে কথাটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। কেন জানি খেতে ইচ্ছে করছে না। আধা ঘন্টা যাবত তাজ ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করেই চলেছি। কিন্তু প্রতিবারই রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে। শ্রেয়ান ভাইয়ার নাম্বারটা থাকলে তাকে ফোন করে খবর নেওয়া যেত। কেন যে তার নাম্বারটা রাখলাম না। নিজের বোকামির জন্য মনে মনে নিজেকেই বকতে লাগলাম। ইতিপূর্বে উনি এত দেরি করে বাড়ি ফিরেননি। ঘড়ির কাঁটা যতই সামনে এগোচ্ছে, ততই আমার মাঝে অস্থিরতা বাড়ছে। এর আগে কখনও বাবার জন্যও আমি এতটা চিন্তায় পড়িনি। তাজ ভাইকে ফোন করতে করতে আমি রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। বাবার রুমের দরজা বন্ধ। বোধ হয় ঘুমাচ্ছে। আফরা আপু দোতলার একটা রুমে আছে। সে-ও হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। আফরা আপুর ইচ্ছে ছিল তাজ ভাইয়ের আশেপাশের কোনো রুমে থাকার। কিন্তু নিচের তলায় কোনো রুম খালি নেই। তিনটা রুমে আমি, বাবা, তাজ ভাই থাকি। বাকি একটা বাবার পার্সোনাল রুম। ওখানে আমিও যাই না। আমি ঠিক করেছি তাজ ভাইকে এখন থেকে ওপরের তলার কোনো রুমে থাকতে বলব। আফরা আপু দোতলায় একা একা থাকলে, ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। শত হলেও সে আমাদের অতিথি। এতরাতে একা-একা ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে থাকতেও আমার ভয় লাগছে। সারা বাড়ি নিশ্চুপ। এমনিতেই ভূতে আর অন্ধকারে ‌আমার প্রচন্ড ভয় আছে। হঠাৎ মনে হলো এখন যদি লোডশেডিং হয়, তাহলে তো আমি ভয়ে এখানেই জ্ঞান হারাব। কথাটা মাথায় আসতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। তখনই হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ কানে এল। সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই দরজা আটকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনে আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ব্যস্ত হয়ে বললাম,“এতক্ষণে আসার সময় হলো আপনার? এত দেরি হলো কেন? ফোন রিসিভ করেননি কেন?”

তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো শুনেও কোনো উত্তর দিলেন না। ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। আমি ওনার সামনে দাঁড়িয়ে একইভাবে বললাম,“এত রাত করে ফিরবেন, একটা ফোন করে তা জানিয়ে দিতে পারলেন না? কয়টা বাজে খেয়াল আছে আপনার? পৌনে একটা বেজে গেছে। এতক্ষণ অবধি জেগে ছিলাম আমি।”

তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“আমার কাছে এক্সট্রা চাবি ছিল। জেগে থাকতে কে বলেছে?”

আমি রাগত স্বরে বললাম,“টেনশন হচ্ছিল তাই জেগে ছিলাম। শখ করে মাফিয়া হয়েছেন, দুনিয়াতে আর কোনো কাজ ছিল না? মাফিয়াগিরি করে রাত-দুপুরে বাড়ি ফিরবেন? কত গর্বের কাজ!”

তাজ ভাই এবারও প্রতিউত্তর করলেন না। বড়ো একটা দম নিয়ে দুহাত এক করে নিজের কপালে ঠেকালেন। ওনার ডান হাতের দিকে দৃষ্টি পড়তেই আমি চমকে উঠলাম। খপ করে ওনার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভালোভাবে দেখতেই আমার মাথাটা ভনভন করে উঠল। আমি ধপ করে ওনার পাশে বসে পড়লাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,“এত রক্ত কেন?”

তাজ ভাই ঝট করে নিজের হাতটা আমার হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পেছনে লুকিয়ে ফেললেন। ওনার হাতের অনেকটা অংশ জখম হয়ে গেছে। সেখানে তাজা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আমি একহাতে মাথা চেপে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। তাজ ভাই আমার পাশ থেকে উঠে গেলেন। একটা গ্লাসে পানি নিয়ে এসে আবার আমার পাশে বসলেন। জখম হওয়া ডান হাতে আমাকে আলতো করে আগলে ধরে, আরেক হাতে পানির গ্লাস মুখের সামনে ধরলেন। আমি দ্রুত কিছুটা পানি খেলাম। উনি পাশের টি-টেবিলে গ্লাসটা রেখে আমার মাথাটা নিজের বুকে রাখলেন। আমি চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। মিনিট দশেক এভাবেই বসে থাকার পর আমি কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলাম। তারপর তাজ ভাইয়ের কাছ থেকে সরে, উঠে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে হাঁটা দিতেই তাজ ভাই পিছু ডেকে বললেন,“চলে যাচ্ছিস?”

আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম,“ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসি।”

উনি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাঁধা দিয়ে বললেন,“দরকার নেই। আমি রুমে গিয়ে ব্যান্ডেজ করে নিচ্ছি।”

কথাটা বলেই উনি নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি পেছন থেকে প্রশ্ন করলাম,“ডিনার করবেন না?”

“ইচ্ছে করছে না।” বলেই উনি রুমে চলে গেলেন। কোনো কিছু না ভেবে আমিও ওনার রুমের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে চোখ পড়তেই আমার পা থেমে গেল। ওপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আফরা আপু এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই আপু ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দিকে চলে গেল। আমার মনে খটকা লাগল, কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা কি আফরা আপু দেখে ফেলেছে? দেখে থাকলে সে কী ভেবেছে? আফরা আপুকে নিয়ে বেশি না ভেবে তাজ ভাইয়ের রুমে চললাম। দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে দেখলাম তাজ ভাই বিছানায় উঠে বসে হাতে ব্যান্ডেজ করছেন। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতে ব্যান্ডেজ করতে তার মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না। মাফিয়া বলে কথা! এমন জখম বা ব্যান্ডেজের ব্যাপারে নিশ্চয়ই খুব অভিজ্ঞতা আছে। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে তাজ ভাই ব্যান্ডেজ ঠিক করতে করতে বললেন,“ঘুমাতে যাচ্ছিস না কেন?”

আমি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উলটো রাগ দেখিয়ে বললাম,“মাফিয়া হয়ে কী পেয়েছেন আপনি? এমন আঘাত পেয়ে কী মজা পান? কোনো লাভ আছে, শুধু গুন্ডামি ছাড়া? এমন তো নয় যে টাকা উপার্জনের জন্য আপনাকে মাফিয়া হতে হয়েছে। তাহলে? এই পথ বেছে নেওয়ার মানে কী? আমি কালই বাবাকে সব বলে দিব। তার আদরের ভাগনে কত গর্বের কাজ করে বেড়ায়, তা জানাতে হবে না তাকে?”

কথাগুলো বলে আমি দরজার দিকে পা বাড়াতেই তাজ ভাই বললেন,“চিঠি আর ছবিটা কিন্তু এখনও আমার হাতে আছে।”

আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে শক্ত মুখে বললাম,“ওগুলো ভিজিয়ে পানি খান বসে বসে।”

“তোর বাপকে দেখাব।”

“দেখান গিয়ে।”

“ভয় পাস না।”

“আপনি বাঘ, না ভাল্লুক?” বলেই আমি আবার দরজার দিকে পা বাড়ালাম। চোখের পলকে তাজ ভাই বিছানা ছেড়ে নেমে এসে পেছন থেকে আমার হাত টেনে ধরলেন। আমি দাঁড়িয়ে পড়লেও পেছন ফিরে তাকালাম না। উনি আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে বললেন,“এত রাগ কিসের?”

“আমি রাগ করব কোন দুঃখে?”

“ডিনার করেছিলি?”

“জেনে কী করবেন?”

“গান সাথেই আছে। শুট করব?”

“হাত ছাড়ুন।”

“কেন?”

“ঘুম আসছে।”

“খাবার গরম করবে কে?”

“একটু আগেই তো বললেন খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“এখন করছে। যা, দ্রুত গিয়ে খাবার গরম কর।” বলেই উনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। দ্রুত প্রস্থান করলাম। রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গরম করার সময় তাজ ভাই এসে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। আমি ওনার দিকে এক নজর তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। উনি গলা ঝেড়ে বললেন,“আজ কিন্তু কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলে আগলে রেখেছিলাম। এক্ষেত্রেও কি সুইডেন আর বাংলাদেশের তফাৎ মাপা হবে?“

আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ওনার দিকে তাকালাম। বললাম,“আপনাকে কোনো কথা বলাই মহাপাপ। এক কথা নিয়ে সবসময় পড়ে থাকেন। পাজি লোক!”

উনি হাসলেন। তারপর আবার বললেন,“এই, তোকে না বলেছিলাম রান্না শিখতে? কোনোমতে রুটি বানানো শিখে আর কিছু শেখার নাম নেই। কাল থেকে যখন সময় পাবি টুকটাক রান্না শিখবি।”

“পারব না। আমি রান্না শিখে কী করব? সার্ভেন্ট আছে কী করতে?”

“ঐ যে বললাম, বিয়ের পর কাজ না জানলে শ্বাশুড়ি চুল ছিঁড়ে ফেলবে।”

“আপনাকে বলেছে?”

“এসব আমার জানা আছে। তোর মতো অকর্মা মেয়ের কপালে দজ্জাল শ্বাশুড়িই জুটবে।”

“আপনি কীভাবে শিওর হলেন যে আমি বিয়ে করব?”

“আমার মামুর অন্ন ধ্বংস করার সুযোগ দিব ভেবেছিস?”

“আমার বাবা হয় সে। আমাকে ভাগিয়ে দিয়ে আপনার আমিরাকে এ বাড়িতে তোলার প্ল্যান করছেন না কি?” বলতে বলতে খাবার নিয়ে ওনাকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। উনি আমার পেছন পেছন আসতে আসতে বললেন,“কী বললি? আবার বল।”

“কানে সমস্যা হলে ডক্টরের কাছে যান।”

“এই পিচ্চি, ভালো কথা মনে করেছিস। আমিরা আর আফরার মধ্যে কাকে বিয়ে করা উচিত বলতো?”

আমি প্লেটে খাবার তুলতে তুলতে বললাম,“দুজনকেই করুন। ডানে এক বউ থাকবে, আর বায়ে এক বউ। মাঝখানে আপনি দুই বউয়ের যত্ন-আত্তি পেয়ে আকাশে উড়বেন।”

উনি চেয়ার টেনে বসে বললেন,“মাথামোটা কি তোকে এমনি-এমনি বলি?”

আমি ওনার দিকে প্লেট এগিয়ে দিয়ে ওনার পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম। ওনার হাতের কথা মনে পড়তেই বললাম,“আপনি খাবেন কীভাবে?”

উনি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন,“চামচ দে।”

আমি ওনার দিকে একটা চামচ এগিয়ে দিলাম। ওনার হাতের যা অবস্থা তাতে আজ আর আমাকে খাইয়ে দিতে পারবেন না। নিজের প্লেটটা টেনে নিয়ে আমি খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। উনি চেষ্টা করেও ডান হাতে খেতে পারলেন না। বাঁ হাতে চামচ নিতেই আমি আমতা-আমতা করে বললাম,“আমি খাইয়ে দিই? আমি যখন অসুস্থ ছিলাম, তখন তো আপনিও খাইয়ে দিয়েছিলেন। তাই আর কী।”

উনি আমার দিকে তাকিয়ে চামচ রেখে দিলেন। অর্থাৎ সম্মতি আছে। আমি ওনার প্লেটটা কাছে টেনে এনে ভাত মেখে ইতস্তত করে ওনার মুখের সামনে তুলে ধরলাম। উনি বললেন,“আগে নিজে খান, তারপর অন্যকে খাওয়াবেন।”

আমি বললাম,“আমার খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত আপনি বসে থাকবেন?”

“আপনাকে খাওয়ানোর সময় আমি না খেয়ে বসে থাকি?”

আমি আর কথা বাড়ালাম না। রাত অনেক হয়েছে, ঘুমও আসছে। চুপচাপ ওনার প্লেট থেকেই নিজেও খেলাম ওনাকেও খাইয়ে দিলাম। অস্বস্তি বোধ করলেও তা পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করলাম। খাওয়া শেষ করে বাটি আর প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। সেগুলো পরিষ্কার করে এসে দেখলাম তাজ ভাই এখনও বসে আছেন। আমি প্রশ্ন করলাম,“এখনও বসে আছেন কেন? ঘুমাবেন না?“

“হুম। যা গিয়ে শুয়ে পড়।” বলে উনি উঠে রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি পেছন থেকে বলে উঠলাম,“যে কাজে নিজের শরীরে আঘাত পান, তা ছেড়ে দিলে কী হয়?”

তাজ ভাই দাঁড়ালেন না। যেতে যেতেই বললেন,“ছেড়ে দিলেই মনের আঘাত সারবে?”

আমি অবাক হয়ে ওনার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মাফিয়ার সাথে মনের আঘাতের কী সম্পর্ক বুঝে উঠতে পারলাম না। তবু এটা নিয়ে বেশি ভাবতে পারলাম না। ঘুমে দুচোখ বুজে আসছে।


আবার শুরু হয়েছে আমার চা বানানো। সকাল সকাল মহারাজ আমাকে ঠেলে রান্নাঘরে পাঠিয়েছেন চা খাবেন বলে। আমি রান্নাঘরে ঢুকে দেখলাম আফরা আপু চা বানাচ্ছে। আমি বেশ খুশিই হলাম। হাসিমুখে বললাম,“কখন উঠেছ আপু?”

আপু উত্তর দিলো না। তার মুখটা কেমন যেন গম্ভীর দেখাচ্ছে। আমি তার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করে আবার বললাম,“তোমার কি শরীর খারাপ? তাহলে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”

আপু শক্ত মুখে বলল,“আমার শরীরের ভালো-খারাপ আমি নিজেই সামলাতে পারি। অন্য কাউকে প্রয়োজন হয় না।”

কথাটা যে আমাকে খোঁচা মেরে বলা হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। গত রাতের ঘটনাটা হয়তো আপু ভালোভাবে নিতে পারেনি। কিন্তু তাতে তো খারাপ কিছু ছিল না। আপু দুই কাপ চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি এগিয়ে গিয়ে দেখলাম আপু দুই কাপের বেশি চা করেনি। কী আর করা? আমি নিজেই চা বসালাম। দু কাপ চা করে এক কাপ টেবিলে রেখে আরেক কাপ নিয়ে বাবার রুমে চললাম। বাবাকে চা দিয়ে টেবিলের কাছে আসতেই আমি অবাক হলাম। টেবিলে চায়ের কাপ নেই। একটু আগে আমি নিজে টেবিলের ওপর রেখে গেলাম। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে উধাও হলো কীভাবে! রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখলাম মিতা-রিতা এসেছে। মারজিয়া খালা আসেনি এখনও। হয়তো মিতা বা রিতা সরিয়ে নিয়েছে ঠান্ডা হয়ে যাবে ভেবে। আমি রান্নাঘরের‌ দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম,“আমি টেবিলে চা রেখে গিয়েছিলাম। সরিয়েছে কে?”

মিতা বলল,“ভাইয়াকে নিতে দেখেছি।”

আমি অবাক হয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলাম,“কখন?”

“মাত্রই দেখলাম টেবিল থেকে চায়ের কাপ নিয়ে ড্রয়িং রুমে যেতে।”

আমি ড্রয়িং রুমে ছুট লাগালাম। গিয়ে দেখলাম জাহাপনা পায়ের ওপর পা তুলে চা পান করছেন আর আরামসে টিভি দেখছেন। আমি ওনার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কোমরে হাত রেখে বললাম,“আমার চা চুরি করেছেন কেন?”

তাজ ভাই চোখ দুটো সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“তোর চা? কই? চায়ে তো তোর নাম লেখা দেখছি না। কাপের কোথাও-ও না।”

বলতে-বলতে উনি চায়ের কাপটা পর্যবেক্ষণ করলেন। আমি বললাম,“চা-টা আমি নিজে বানিয়েছি। আপনি নিলেন কেন? একবার না খেয়েছেন? আবার খাওয়ার কী হলো?”

“কখন খেলাম?”

“একটু আগেই তো আফরা আপু আপনার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে গেল।”

“ও।” বলেই আবার উনি টিভিতে মনোযোগ দিলেন। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,“আপনার আবার চা খেতে ইচ্ছে হলে আফরা আপুকে বলতে পারলেন না? না বলে আমারটা নিয়েছেন কেন? চোর কোথাকার!”

“ভুলে যাচ্ছিস তুই আমার এসিস্ট্যান্ট?”

আবার শুরু হয়ে গেছে আজাইরা বকবক। এখানে দাঁড়িয়ে ওনার বকবক শোনার থেকে রুমে বসে ঝিমানো ঢের ভালো। উলটো দিক ঘুরে সামনে পা বাড়াতেই আফরা আপুর সামনে পড়লাম। আফরা আপু আমার পাশ কাটিয়ে তাজ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল। তাই আমিও আর দাঁড়ালাম না। কিন্তু আফরা আপুর কথা শুনে পুনরায় অবাক হলাম। ড্রয়িং রুম থেকে বেরোনোর সময় আমার কানে এল আফরা আপুর বিস্মিত কন্ঠের একটা কথা। সে বলল,“এ কী ভাইয়া! আপনি না বললেন চা খেতে ইচ্ছে করছে না? আপনি খাবেন না বলায় আমি তো দুই কাপ চা একাই খেয়েছি। তাহলে এখন খাচ্ছেন যে!”

তাজ ভাই স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন,“মাথা ধরেছে।”

ব্যাস, নিসঙ্কোচে একটা মিথ্যা বলে ফেললেন। আরেকজন কষ্ট করে চা বানাল তার জন্য, তা খেতে ইচ্ছে করেনি। অথচ আমারটা চুরি করে খেতে খুব ভালো লেগেছে। এই লোকের ভালো হওয়ার আর বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। এসব আবোল-তাবোল ভাবনা মাথায় চেপে আমি সোজা রুমে চলে এলাম।

আজ ভার্সিটিতে যাওয়া হবে না। তাজ ভাই না কি আজ বিকালের আগে বাইরে বেরোবেন না। বাড়িতে বসে ল্যাপটপ আর একগাদা কাগজপত্র নিয়ে কীসব কাজ করছেন। মনে সাহস জুগিয়ে আমি বারবার বলেছি একটা টেক্সি ডেকে দিতে। কিন্তু না, ওনার সাফ-সাফ কথা, উনি ছাড়া আর কারো সাথে বাইরে বেরোতে পারব না। এক কথায় আমার ওপর মহারাজের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। বাবা অনেক আগেই অফিসে চলে গেছে। নইলে বাবার সাথেই যেতে পারতাম। আফরা আপুও ভার্সিটিতে চলে গেছে। এদিকে আমি অসহায়, অবলা প্রাণীর মতো হাত-পা গুটিয়ে মহারাজের পাশে বই নিয়ে বসে আছি। ভেবেছিলাম ভার্সিটিতে না গেলে বসে বসে টিভি দেখব। আমার ভাবনার গলায় ধারালো ছুরি চালিয়ে, শয়তানটা আমাকে ধরে এনে নিজের পাশে বই নিয়ে বসিয়ে রেখেছেন। উঠতে চাইলেই ধমকে উঠে বলছেন,“হয় পড়তে হবে, নয় আজকে দুপুরের সব খাবার রান্না করতে হবে।” বেছে বেছে দুটো বিরক্তিকর কাজই জুটিয়ে দিয়েছেন। আমি গাল ফুলিয়ে একবার বইয়ের দিকে তাকাচ্ছি, আরেকবার ওনার দিকে। লোকটা আমার ফোনটাও নিজের কাছে আটকে রেখেছে। অথচ নিজে তখন থেকে ল্যাপটপ ঘেঁটে চলেছেন। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ কানে আসতেই আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,“কে যেন এসেছে। যাই দরজা খুলে দিয়ে আসি।”

উনি কপাল কুঁচকে বললেন,“বাড়িতে তিনজন সার্ভেন্ট আছে।”

আমি গাল ফুলিয়ে আবার বসে পড়লাম। মিনিট দুয়েক পরই দরজা ঠেলে ভেতরে এলেন শ্রেয়ান ভাইয়া। তাকে দেখে আমি বেশ খুশিই হলাম। এখন অন্তত গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে হবে না। শ্রেয়ান ভাইয়া তাজ ভাইয়ের পাশে বসে সবসময়কার মতো একগাল হেসে আমাকে বললেন,“হাই ইলোমিলো, কী অবস্থা তোমার?”

আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“আপনাদের মাফিয়াদের পাল্লায় পাড়লে যেমন অবস্থা হয়।”

শ্রেয়ান ভাইয়া এবার শব্দ করে হেসে বললেন,“আমরা আবার কী করলাম?”

“এই যে, অসহায় প্রাণীর মতো হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসিয়ে রেখেছে।”

“আহারে! তাজ, তোর সত্যিই দয়ামায়া নেই।”

তাজ ভাই শ্রেয়ান ভাইয়ার কথায় কান না দিয়ে ল্যাপটপটা তার দিকে ঘুরিয়ে বললেন,“এই দেখ।”

শ্রেয়ান ভাইয়া মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে চোখ বুলালেন। আমি মাথা উঁচিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দূর থেকে কিছুই দেখতে পেলাম না। শ্রেয়ান ভাইয়া ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখেই প্রশ্ন করলেন,“কখনকার কনভারসেশন?”

তাজ ভাই উত্তর দিলেন,“কিছুক্ষণ আগের। কী মনে হচ্ছে তোর?”

শ্রেয়ান ভাইয়া কপালে ভাঁজ ফেলে মাথা দুলিয়ে বললেন,“বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। আশা করি কাজে আসবে।”

তাজ ভাইও মাথা দোলালেন। আমি গালে হাত দিয়ে বললাম,“সামনে আস্ত দুটো মাফিয়া বসে আলোচনায় ব্যস্ত। আর আমি একজন পুলিশ অফিসারের নাম্বারের অভাবে খবর দিতে পারছি না।”

শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বললেন,“আহারে! পুলিশ অফিসারের নাম্বার লাগবে তোমার? কিন্তু শেষে যদি, অফিসার তোমার প্রেমে পড়ে যায়?”

“আমি প্রেম করতে না, আপনাদের ধরিয়ে দিতে ফোন করব।”

তাজ ভাই বললেন,“তালগাছ থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে যাবজ্জীবন পঙ্গু হয়ে জীবন কাটাবে, তবু কেউ তোর প্রেমে পড়বে না রে পিচ্চি।”

শ্রেয়ান ভাইয়া আবার হা হা করে হেসে উঠলেন। আমি কপাল কুঁচকে বললাম,“আর আপনার প্রেমে ঐ আমিরার মতো গায়ে পড়া মেয়েরাই পড়বে। ওহ্ হো! প্রেমে কী পড়বে? সে তো এখন আপনার হবু বউ।”

শ্রেয়ান ভাইয়া গলা ঝেড়ে বললেন,“বিয়েটা তো হোক। হলে আমার নাম পালটে শ্রেয়ান থেকে সারেং রাখব।”

এবার আমিও হেসে উঠলাম। কথায় কথায় শ্রেয়ান ভাইয়া হঠাৎ বলে উঠলেন,“এই ইলোমিলো, তুমি বলেছিলে না আমার বাইকে উঠবে? আজ তো দুপুর পর্যন্ত আমি ফ্রি আছি। বাইকও সাথে নিয়ে এসেছি। ঘুরতে যাবে?”

আমি আনন্দে গদগদ হয়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। আড়চোখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শয়তানটা আগে থেকেই সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি মিইয়ে গেলাম। এর আগে দু-দুবার শ্রেয়ান ভাইয়ার জন্য বকা শুনেছি। আজ ঘুরতে গেলে যে তৃতীয়বারের মতো আবার বকা শুনতে হবে, দৃষ্টিতেই তার পূর্বাভাস পেয়ে গেলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার নিরবতা দেখে আবার প্রশ্ন করলেন,“যাবে না?”

আমি আমতা-আমতা করে বললাম,“না ভাইয়া। আসলে, আমার এখন বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না।”

শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো উনি আমার থেকে এমন উত্তর আশা করেননি। তবু মেকি হেসে বললেন,“ঠিক আছে। আজ তাহলে থাক। অন্য একদিন যেয়ো।”

চলবে…………………..🍁

(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)