তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-৪৪ এবং শেষ পর্ব

0
885

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৪৪(অন্তিম পর্ব)

কখনও-কখনও আমাদের স্বাভাবিক দিনগুলো হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এই যেমন আমাদের একটা সাদামাটা দিনে হুট করে এমন কিছু একটা ঘটনা ঘটে যায়, যা দিনটার রং-ই বদলে দেয়। অথচ এমন কিছু যে হবে, তা আমাদের ভাবনার বাইরে থাকে। এমন কিছু হয়ে গেলে আমরা আশ্চর্য হই, স্তব্ধ হই, অতিরিক্ত আনন্দ কিংবা দুঃখে থমকে যাই। আজ আমার ক্ষেত্রেও ঠিক এটাই হয়েছে। আমার স্বাভাবিক দিনটা হুট করেই জলবায়ুর মতো অস্বাভাবিকভাবে বদলে গেছে। আজ সকালে রিতা যখন বলল, গতকাল বাবা পাত্রপক্ষকে না করে দিয়েছে। তখন আমি খুশিতে পারলে নেচে উঠি। কিন্তু পরমুহূর্তেই তাজ ভাই হুট করে আমার রুমে এসে আমাকে একদফা শাসিয়ে গেলেন। তার কথায় মধ্যে একটা ছিল, বিয়ে তো হবেই। তখন আমি ওনার কথাটা তেমন পাত্তা দিইনি। কিন্তু বিকেলেই আমি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। গ্রামের বাড়ি থেকে ছোটো কাকা, কাকি আর অলি এসেছে। কৌতুহল নিয়ে তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, তাদেরকে বাবা আসতে বলেছে। কারণ আজ সন্ধ্যায় আমার বিয়ে। কথাটা শোনামাত্র যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কিছুতেই এ কথা বিশ্বাস করতে পারিনি। তাজ ভাই তখন বাড়িতে নেই। শ’খানেক কল করার পরও উনি ফোন রিসিভ করেননি। শ্রেয়ান ভাইয়াকে ফোন করে জানলাম তারা জরুরী কাজে ব্যস্ত আছেন। কথা বলার সময় নেই। বাবা আর কাকা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেছেন। বাবার সামনে গিয়ে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার সাহস আমার নেই। ওই মুহূর্তে আমি যেন অতল গহ্বরে আটকা পড়লাম। উদ্ধার হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। রাজ ভাইয়ারও দেখা নেই। যদিও ওনার সাথেও এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না। জেনিফার ভাবির খোঁজ করেও তাকে পেলাম না। জেসিকা বাড়িতেই আছে। কিন্তু ওর সাথে তো কিছুই বলা যাবে না। দিশেহারা হয়ে আমি দরজা আটকে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। তাজ ভাই আমার বিয়ের ব্যবস্থা করেই ছাড়লেন, ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। রিসিভ হবে না জেনেও তাজ ভাইয়ের নাম্বারে বারবার ডায়াল করে চলেছি। যদি একবার রিসিভ হয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পর বাবা আর কাকা আমার রুমে এলো। তারা দরজায় টোকা দিতেই আমি চোখ-মুখ মুছে মাথায় ওড়না টেনে নিয়ে মাথা নিচু করে তাদের সামনে দাঁড়িয়েছি, তাই হয়তো তারা কিছু বুঝতে পারল না। না কি বুঝেও বুঝল না, জানা নেই। বাবা আর কাকা এসেই প্রশ্ন করে বসলেন যে, তাদের সিদ্ধান্তের ওপর আমার আর কোনো কথা আছে কি না। থাকলে যেন স্পষ্ট জানিয়ে দিই। আমার কাছে মনে হলো, জীবনের প্রথম আমি এমন এক পরিস্থিতির শিকার হলাম, যা থেকে নিস্তার পাওয়ার সাহসটুকুও আমার নেই। কারণ বাবা-কাকার সামনে আমি এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না। তাছাড়া তারা বিয়ের ব্যবস্থা করে; তবেই আমার মতামত জানতে এসেছে। ব্যাপারটা আমাকে ভেতর থেকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো। মনোভাব গোপন রেখে বহুকষ্টে বলে দিলাম, তারা যা সিদ্ধান্ত নিবে তা-ই আমি মেনে নিব। দু-একটা কথা বলে তারা বেশ খুশিমনে চলে গেল। তারপর আবার শুরু হলো আমার বদ্ধ ঘরে করুণ আর্তনাদ। অথচ যার জন্য এই করুণ আর্তনাদ, এই শ্বাসরুদ্ধ ছটফটানি, স্বয়ং সে-ই নিজ হাতে আমায় ঠেলে দিচ্ছে অতল মৃত্যু গহ্বরে। জেনিফার ভাবি আর রাজ ভাইয়া বাড়ি ফিরলেন সন্ধ্যার দিকে। এসেই আমার রুমের দরজায় নক করে আমাকে বার কয়েক ডাকলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি কোনোরকমে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। আশ্চর্য হলাম, তারা দুজন আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালেও কোনো প্রশ্নও করল না। বরং চমৎকার হেসে তাদের হাতের শপিং ব্যাগ দেখিয়ে জানাল, তারা আমার বিয়ের শপিং করতে গিয়েছিল। অর্থাৎ আমাকে বউ সাজানোর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে এনেছে। জেনিফার ভাবি বিছানায় সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমাকে দেখাতে লাগলো। আমার সেসবে খেয়াল নেই। পাথুরে মুর্তির ন্যায় চুপচাপ ঠাঁয় বসে রইলাম। রাজ ভাইয়া টুকটাক কথা বলে চলে গেল। জেনিফার ভাবি বলল বিয়ের বেনারসী ওনারা আনেননি। ওটা না কি তাজ ভাই নিয়ে আসছেন। কথাটা শুনে বুকের মধ্যে দুমড়ে-মুচড়ে উঠলো। নিজ পছন্দের বেনারসী পরিয়ে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন, বাহ্! এই মুহূর্তে এসে জেনিফার ভাবির সামনে নিজেকে আটকে রাখা দায় হয়ে পড়ল। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলাম। কিন্তু হায়! জেনিফার ভাবি বুঝল বিয়ে হয়ে যাওয়ার কষ্টে আমার এই কান্না। সে আমাকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিলো। তারপর ঘটল আরেক কান্ড। আমার বান্ধবীরা সবাই এসে আমার রুমে উপস্থিত! প্রথমে অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। ওদের কারো মুখেই হাসি নেই। কথা বলে জানলাম ওদের ফোন করে বাবা আসতে বলেছে। প্রিয় বান্ধবীদের কাছে পেয়ে কষ্টগুলো বাঁধ মানল না। পুনরায় কান্না রূপে বেরিয়ে এলো। ওরা আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিলো না। বরং সবাই মিলে তাজ ভাইয়ের ওপর নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করল। আস্তে আস্তে বাড়িতে মানুষের সমাগম টের পাওয়া যাচ্ছে। বাইরের কোলাহল কানে আসতেই বুঝলাম, বরযাত্রী এসে গেছে। আমাকে সাজানোর দায়িত্ব পড়েছে বান্ধবীদের ওপর। কিন্তু আসল যা, বেনারসীই এখনও আনা হয়নি। ডিটেকটিভ সাহেব বেনারসী নিয়ে বোধ হয় দুঃখ বিলাস করছেন। বেশিক্ষণ দেরী হলো না। বেনারসীর ব্যাগ হাতে স্বয়ং আহনাফ তাজওয়ার যখন আমার রুমের দরজায় পা রাখলেন, তখন এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সময়টা এখানেই থেমে যাক। আর নয়তো জীবন প্রদীপটাই নিভে যাক। উনি যখন রুমে এলেন তখন শুধু আমার সাথে আমার বান্ধবীরাই আছে। উনি আমার দিকে তাকালেন না, বেনারসীর প্যাকেটটা ঐশীর হাতে দিয়ে মৃদু কন্ঠে বললেন,
“খুলে দেখো তো।”
ঐশী প্যাকেট খুলে বেনারসী বের করল। সাদা বেনারসী। আনহা অবাক কন্ঠে বলে উঠল,
“সাদা বেনারসী! লালটা আনলেন না কেন ভাইয়া?”
আমি তখন মৃত দৃষ্টিতে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আনহার কথা শুনে চাপা কষ্ট উন্মুক্ত করে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললাম,
“এটা তো বিয়ে নয়, মৃত্যুর সাজ। উনি আসলে খুব ভালোভাবেই জানেন কোন সাজ ঠিক কিসে মানায়।”
তবু তাজ ভাই আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। শান্ত, গম্ভীর মুখে যেভাবে এসেছিলেন, ঠিক সেভাবেই চলে গেলেন। উনি যখন ধীর পায়ে দরজা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখন আমার মনে হলো জীবন থেকে সুখ নামক অমূল্য সম্পদটা হারিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করল ছুটে গিয়ে তাকে আটকে রাখি। কিন্তু হায়! যে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যেতে চায়, তাকে কি আটকে রাখা যায়? বান্ধবীরা সবাই মিলে আমাকে বউ সাজালো। আমি কেবল অশ্রুসিক্ত চোখে পাথুরে মুর্তির ন্যায় ঠাঁয় বসে রইলাম। জেনিফার ভাবি, জেসিকা এসে মাঝে মাঝে দেখে গেল আমায়। তাদের সাথে আরও একজনকে দেখলাম। অর্নি ভাবি। কিন্তু কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। সে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি মুখে ঝুলিয়ে প্রশ্ন করল,
“কেমন আছো ইলো?”
আমি উত্তর দেইনি। এই অর্নি ভাবি যে তাজ ভাই আর আমার ব্যাপারে সবকিছু জানেন, তা আমার অজানা নয়। তবে এটুকু সময়ের মধ্যে তাদেরকেও দাওয়াত করে আনা হয়েছে দেখে অবাক হলাম। কোলাহল শুনে মনে হচ্ছে অনেক মানুষই এসেছে; তবে আমার রুমে তেমন কেউ আসেনি। আমাকে সাজানোর প্রায় পনেরো মিনিট পর কয়েকজন লোক রুমে এলো। সঙ্গে বাবা আর কাকা আছে। ঘোমটার আড়ালে কেবল তাদের কন্ঠস্বর শুনে চিনতে পারলাম। ঘোমটার আড়াল থেকেই চারদিকে চোখ বুলিয়ে আকাঙ্ক্ষিত মুখটা খুঁজলাম, কিন্তু সে যে কোথাও নেই। থাকবেই বা কেন? আজ তো তার মুক্তির দিন। কথাবার্তায় বুঝলাম কাজি নিয়ে এসেছে, বিয়ে পড়ানো হবে। এক মুহূর্তের জন্য ইচ্ছে করল, সব পেছনে ফেলে ছুটে চলে যাই। মস্তিষ্কে তাজ নামটা বারংবার ঘন্টা বাজিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে আমি নিজের মধ্যে নেই। পাষাণ প্রেমিকের ওপর মনটা বিষিয়ে উঠল। বিয়ে পড়াতে আসা লোকজন কী সব বলে চলল, কিছুই আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। সবাই যখন সাইন করার জন্য বারবার বলতে শুরু করল, তখন হুঁশ ফিরল। কিন্তু আমার হাত অসাড় হয়ে গেছে। অন্য কারো বউ হওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন পেপারে সাইন করা আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভয়াবহ কাজ বলে মনে হলো। চারপাশ থেকে শুধু একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, সাইন কর। সবশেষে বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সাইন করতে বলায়, আমি কূল হারালাম। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কলমটা হাতে তুলতেই হলো। কাঁপা হাতে সাইন করতে গিয়ে অনুভব করলাম, আমি কলম চালাতে পারছি না। আঙুলগুলো চলছে না। নিজের নাম লেখাটাও যেন ভুলে গেছি। বাবা আর কাকা বুঝিয়ে বলার পর কম্পিত হাতেই ধীরে ধীরে সাইন করলাম ঠিকই, সঙ্গে আমার জীবন্ত ভালোবাসারও বলিদান করলাম। প্রবল স্রোতের গতিতে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল রেজিস্ট্রেশন পেপারে। সমস্ত অনুভূতিগুলো কান্না রূপে বেরিয়ে এলো। অথচ সবাই খুব সহজেই ভেবে নিল, বিয়ে হয়ে গেছে, বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে আমি কাঁদছি। অথচ যার জন্য এই কান্না, সে কীভাবে শ্বাস নিচ্ছে? বিয়ে পড়ানো শেষ হওয়ার পর আমি একদম চুপ মেরে গেলাম। আশেপাশে অনেক মানুষ আসছে-যাচ্ছে, সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। অনেকক্ষণ পর জেনিফার ভাবি এসে আমাকে রুম থেকে নিয়ে চলল। ড্রয়িংরুমে নিতেই আমি রুদ্ধশ্বাসে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। নাহ্, কাঙ্ক্ষিত মুখটা কোথাও নেই। জেনিফার ভাবি আমাকে নিয়ে সোফায় বসালেন। টের পেলাম আমার পাশে কেউ বসে আছে। পরক্ষণেই সবার কথায় বুঝলাম, ইনি আমার সদ্য বিবাহিত বর। বাবা এসে আমার হাতটা তার মেয়ে জামাইয়ের হাতে তুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আমি কেঁপে উঠলাম। ঝট করে হাতের দিকে তাকালাম। পাঞ্জাবির হাতা আর হাতঘড়ি নজরে পড়ল। বাবা সরে যাওয়ার পরও লোকটা আমার হাত মুঠোয় আবদ্ধ করে রাখলেন। রাগে-দুঃখে আমি নিজের হাতটা মুচরে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। ইচ্ছে করল বাবাকে ডেকে বলতে, দেখো, কেমন এক অসভ্য লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছ।

________________________

বনলতা,
আমার শূন্য বনের একচ্ছত্র গুল্মলতা। আমার প্রথম প্রেমের কিছু ভয়ঙ্কর অনুভূতি। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়ানো মুগ্ধতা। ঘোর অমাবস্যার রাতে উজ্জ্বল চন্দ্র রূপে দর্শন দেওয়া চন্দ্র প্রভা। ঘুমঘুম ফোলা দুটো চোখ, অগোছালো চুল আর আকাশ রঙা সালোয়ার, কামিজ পরিহিতা পুঁচকে মেয়েটার মুখে কী জাদু ছিল জানি না। প্রথম দর্শনেই কি না আমার হৃদয় হরণ করে নিল! সুইডেনের দীর্ঘ আট বছরের জীবনে যে আমি হাজারো সুন্দরী মেয়েদের এড়িয়ে চলেছি অনায়াসে, সেই আমি কি না আটকে গেলাম এক পিচ্চি রমণীর মায়াবী মুখে! সেই যে আটকালাম, আজও আমার স্তব্ধ দৃষ্টি ওই মুখেই নিবদ্ধ রয়ে গেল। সে আমার অভ্যাসে পরিণত হলো। মন ভালো করার কারণ হলো। ভাবো তো, এই বয়সে এসে টিনএজারদের মতো এমন পাগলামি মানায়? তারপর হঠাৎ বুকের চিনচিনে ব্যথা, অস্থিরতা আর নির্ঘুম রাত আমাকে বুঝিয়ে দিলো, প্রেমের পাগলামি বয়স মেনে আসে না। দিনের পর দিন সে আমার চিন্তা-চেতনায় সম্পূর্ণভাবে বিরাজ করে বসল। ব্যস্ত জীবনের ভীড়ে আমার গম্ভীর মুখে মুচকি হাসির কারণ হলো। তারপর সে হাসির বিনিময়ে আমি তাকেও হাসালাম। ওই হাসিটুকুও যে আমার ঘুম পাকড়াও করে নিবে, তা কে জানত? তবে সবচেয়ে বড়ো সত্যি হচ্ছে, তার গাল ফুলানো মুখটাই আমার ভীষণ প্রিয়। মনে হয়, এই তো সেই পিচ্চি মেয়েটা, যাকে আমি কারণে-অকারণে ক্ষেপাতাম আর সে রাগে-অভিমানে সারাক্ষণ গাল ফুলিয়ে বসে থাকত। তাই তো আমি অযথাই তাকে ইচ্ছে করে ক্ষেপাই, এবং আজীবন এভাবেই ক্ষেপাব। প্রতিটা মুহূর্তে আমি টের পাই, তার প্রতি আমার সেকি লোভ! ভালোবাসার লোভ, তাকে আজীবন নিজের করে রাখার লোভ, তার কোলে মাথা রেখে তার মায়াবী জাদুমিশ্রিত মুখে আমৃত্যু চেয়ে থাকার লোভ। লোকে বলে,‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।’ আমি বলি,‘তার প্রতি আমার সমস্ত লোভ, সমস্ত অনুভূতিগুলো যদি মৃত্যু এনে দেয়; তবে তা-ই সই।’ সব মৃত্যু দুঃখের হয় না, কিছু মৃত্যু সুখেরও হয়। আমার পিচ্চি প্রেমিকা, তোমার প্রতি আমার দারুণ অভিমান জমে আছে। যার মূল কারণ, তুমি আমায় বোঝো না, বুঝতে চাও না। তবে আমি চাই না এ অভিমানগুলো ভাঙুক, কিংবা তুমি আমায় বোঝো। কিছু অভিমান না হয় ভালোবাসা হয়ে আজীবন বেঁচে থাকুক। আমি আমার সহজ-সরল, হাসি-খুশি, নিষ্পাপ পিচ্চি প্রেমিকাটাকেই চাই। আজ, কাল, পরশু এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চাই। আমার জীবনে প্রেম নিয়ে পদার্পণ করার বিনিময়ে, আমি তোমাকে আমৃত্যু ভালোবেসে যাব বনলতা। আজ না হয় সকল লুকোচুরির ইতি টেনে, চিঠির ইতির সূচনা হোক। সূচনা হোক প্রকাশিত ভালোবাসার।
ইতি
তোমার ডিটেকটিভ সাহেব

অশ্রুসিক্ত চোখে পাথুরে দৃষ্টিতে তাকিয়ে দ্রুত চিঠি শেষ করেই আমি ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকালাম। নতুন বর আমার হাতে এই চিঠি গুঁজে দিয়ে থমথমে মুখে ওয়াশরুমে চলে গিয়েছিলেন। চিঠিটা বুকে চেপে ধরে আমি বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। আজও অমাবস্যা। মনে পড়ে গেল সেই রাতের কথা, যে রাতে আমার জীবনের ঘোর অন্ধকার ঠেলে এক উজ্জ্বল চন্দ্র এসে আমার জীবন আকাশ ঝলমলে আলোয় আলোকিত করেছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার আকাশে লক্ষ্যভ্রষ্ট দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আমি গত দিনগুলোর ভাবনায় বুঁদ হলাম, যেন বর্তমান নিয়ে আমার বিশেষ কোনো হেলদোল নেই। পেটে শক্ত এক জোড়া পুরুষালি হাতের স্পর্শে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। বর নামক পুরুষ আমায় পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখল। শরীরে কম্পন ধরে গেলেও আমি ফিরে তাকালাম না। শক্ত মুখে অশ্রুভেজা চোখ জোড়া বন্ধ করে পেট থেকে হাত দুটো সরানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। কিন্তু বলিষ্ঠ হাতের শক্তির কাছে কোমল হাতের শক্তি চুনোপুঁটির মতো হেরে গেল। বেশ কিছুক্ষণ হাতাহাতি করার পর আমি থমথমে গলায় বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“হাত সরান।”
অসভ্য লোকটা গা জ্বালানো হাসি দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার আগেই আমার বাহু ধরে ঝট করে নিজের দিকে ঘুরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। গভীর দুটো চোখের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমি হুড়মুড়িয়ে দৃষ্টি সরালাম। লোকটা দুহাতে আলতো করে আমার মুখটা তুলে ধরলেন। কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বললেন,
“ভালোবাসি ইলুরানি।”
শব্দ দুটো কর্ণগুহরে পৌঁছনোমাত্র আমার অশ্রুসিক্ত চোখ দুটোতে শ্রাবণের ঢল নামল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। পরমুহূর্তেই ঠোঁট ভেঙে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। লোকটা হাসিমুখে পুনরায় বললেন,
“এই পিচ্চি, ভালোবাসি তো।”
আমি কাঁদতে-কাঁদতে ওনার বুকের কাছের পাঞ্জাবি খামচে ধরে ঝাঁকুনী দিয়ে কান্নাভেজা ভাঙা কন্ঠে বললাম,
“আপনি খুব বেশি খারাপ লোক। আই হেট ইউ ডিটেকটিভ সাহেব।”
দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথাটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরে মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে উনি বললেন,
“আই লাভ ইউ টু মিসেস তাজওয়ার।”

_________________________

রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। ব্যস্ত শহরের রাস্তা ভর্তি যানবাহন ডিঙিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে। চারপাশে হর্নের শব্দে অতিষ্ট আমি সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে মুখের ওপর ওড়না ফেলে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। তবু যদি একটু শান্তি মেলে। কিন্তু আমার শান্তি কী আর সবার সহ্য হয়? মাননীয় বর মহাশয় ঝট করে আমার মুখের ওপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে দিলেন। বিরক্তি নিয়ে আমি পুনরায় মুখে ওড়না টেনে নিলাম। পরমুহূর্তেও উনি একই কাজ করলেন। পরপর চারবার এরকম করার পর আমি মুখ দিয়ে ‘চ’ সূচক বিরক্তিকর শব্দ করে ওনার দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“তাজ ভাই, আমাকে বিরক্ত না করলে আপনার শান্তি হয় না?”
তাজ ভাই চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললেন,
“স্বামীকে ভাই ডাকতে নেই বেগম সাহেবা। মোটা মাথাটাকে এবার একটু ঘষেমেজে পরিষ্কার করুন। না পারলেও সমস্যা নেই, আমি আছি তো। ভিম বার দিয়ে ঘষে একদম তকতকে করে ফেলব। স্বনামধন্য ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ারের একমাত্র বউ এমন মাথামোটা, এ কথা ভাইরাল হলে কী একটা অবস্থা হবে! ভাবা যায়?”
আমি কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করলাম,
“শুরু হলো ফালতু বকবক।”
তাজ ভাই গাড়ি থামাতেই আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
“পৌঁছে গেছি?”
“হুঁ”, সিটবেল্ট খুলতে খুলতে জবাব দিলেন উনি।
গাড়ি থেকে নেমে সম্মুখে শ্রেয়ান ভাইয়াকে দেখে আমি অবাক হলাম। উনি হাসিমুখে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আজও ওনার হাতে সেদিনের মতো এক গুচ্ছ লাল গোলাপ। উনি এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। অবাক দৃষ্টিতে একবার শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখের দিকে, আরেকবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তাজ ভাইয়ের মুখে বিস্ময়ের লেশমাত্র নেই। আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিব্রত কন্ঠে বললাম,
“ভাইয়া…..।”
আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়া সহাস্যে বলে উঠলেন,
“উইল ইউ বি মাই বেস্ট ফ্রেন্ড, ইলোমিলো? এবারও ফিরিয়ে দিবে না তো?”
আমি মুচকি হেসে শ্রেয়ান ভাইয়ার হাত থেকে গোলাপগুলো নিতে নিতে বললাম,
“এমন ফ্রেন্ডকে ফিরিয়ে দিব, এতটাও পাষাণী আমি নই।”
শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“কনগ্রাচুলেশন। নতুন জীবন সুখের হোক, ভালোবাসায় রঙিন হোক।”
তাজ ভাই এগিয়ে গিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“সরি ভাই, এত কষ্ট দেওয়ার জন্য।”
শ্রেয়ান ভাইয়া তাজ ভাইকে ছাড়িয়ে কাঁধে মৃদু থাপ্পড় মেরে বললেন,
“ধুর শালা, তুই আমার কাছে কী তা তুই বুঝিস না, আর বুঝবিও না। বাদ দে, অনেক রাত হয়েছে। এই মাঝরাতে নতুন বউকে এখানে নিয়ে এলি, প্রশ্ন করেনি?”
আমি বললাম,
“কিছুই তো বুঝলাম না ভাইয়া। আমাকে ধরে বেঁধে এই মাঝরাতে গাড়িতে উঠাল। কতবার জিজ্ঞেস করলাম,‌ কোথায় যাচ্ছি। উত্তরই দিলো না।”
শ্রেয়ান ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
“এখনই উত্তর পেয়ে যাবে ইলোমিলো।”
আমি কৌতুহল নিয়ে বলে উঠলাম,
“বলুন তাহলে।”
তাজ ভাই এগিয়ে এসে আমার ডান হাতটা মুঠোয় নিয়ে রাস্তার পাশে হাঁটা দিলেন। সঙ্গে শ্রেয়ান ভাইয়াও এলেন। তাজ ভাইয়ের ইশারায় আমি সামনের দিকে তাকাতেই ভীষণ অবাক হলাম। উত্তেজনায় চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। কাঁপা গলায় বললাম,
“আশ্রম!”
তাজ ভাই আমার হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে বললেন,
“বউয়ের স্বপ্ন পূরণ করলাম। মা আর মামির নামে আশ্রম করে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম আরও আগে। কিন্তু পরিস্থিতির জন্য দেরী হলো।”
অশ্রুসিক্ত চোখে আমি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আপনার মনে ছিল?”
পাশ থেকে শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,
“তা আর বলতে! ব্যাটা তো আমাকেও জানায়নি। কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছিলাম। ব্যাপারটা বেশ ভালো লেগেছে আমার। তুমি খুশি তো ইলোমিলো? ভেবে নাও এটা তোমার বরের পক্ষ থেকে তোমার বিয়ের উপহার।”
আমি প্রশস্ত হেসে বললাম,
“এর থেকে বেস্ট গিফট আর হতেই পারে না ভাইয়া। খুশি না হয়ে উপায় আছে?”
“আচ্ছা, তাহলে তোমরা থাকো যতক্ষণ ইচ্ছা। নব দম্পতির মধ্যে থেকে আমি কাবাবের হাড্ডি হতে চাই না”, সকৌতুকে বললেন শ্রেয়ান ভাইয়া।
তাজ ভাই বললেন,
“চলে যাবি?”
“হ্যাঁ, রাত তো অনেক হলো। থাক তোরা,‌ কাল দেখা হবে।”
“আচ্ছা।”
শ্রেয়ান ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আল্লাহ্ হাফেজ ইলোমিলো।”
আমিও মুচকি হেসে বললাম,
“আল্লাহ্ হাফেজ।”
শ্রেয়ান ভাইয়া নিজের বাইকে চড়ে বসলেন। বাইক স্টার্ট করে উনি চলে যাওয়ার সময় ওনার মলিন মুখটা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। মানুষটা হাস্যোজ্জ্বল মুখের আড়ালে যে কতশত কষ্ট লুকিয়ে রেখেছেন, তা কেবল উনিই জানেন। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে আমি আশ্রমের দিকে ফিরে তাকালাম। তাজ ভাই হঠাৎ আমার কানের কাছে মুখ এনে মৃদু স্বরে বললেন,
“তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি সেদিনই নিয়েছিলাম, যেদিন তোমার চাপা কান্না আমার কানে পৌঁছেছিল। আর আজ আবারও নিলাম, সবাইকে জানিয়ে। মনে আছে, অনেক-অনেক দিন আগে এক সন্ধ্যায় তোমায় কী বলেছিলাম? বলেছিলাম, জীবন থেকে সম্পূর্ণ কষ্ট মুছে দিতে পারব কি না জানি না। তবে ভাগাভাগি করে চার ভাগের তিন ভাগ কষ্ট নিজের বুকে নিয়ে নিব। আর বাকি এক ভাগ অনুভূতিটুকু বুঝার জন্য রেখে দিব। তা-ও যদি না পারি তাহলে প্রাণখোলা হাসির কারণ হব। কিন্তু সেদিন তুমি বোঝোনি। আজ বুঝে নাও। না কি আজ বুঝেও বুঝবে না?”
ওনার মুখে এই প্রথম ‘তুমি’ সম্বোধন শুনে হঠাৎ শিউরে উঠলাম। ইতিপূর্বে উনি আমাকে শুধুমাত্র চিঠিতেই ‘তুমি’ সম্বোধন করেছেন, আর আজ মুখে। এটুকু সম্বোধনেই যে এত অনুভূতি মিশে আছে, তার সাথে আমার নতুন পরিচয় ঘটল। আমি নতজানু হয়ে মৃদু স্বরে বললাম,
“আপনাকে বোঝার কোনো উপায় রাখেন আপনি?”
তাজ ভাই মৃদু শব্দ তুলে হাসলেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরনের সাদা পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে পুনরায় বললেন,
“তো? সারপ্রাইজগুলো কেমন লাগলো?”
আমি সরু চোখে তাকিয়ে বললাম,
“প্রথমটা মোটেও ভালো ছিল না। পারলে আপনার মাথা ফাটাতাম, শয়তান লোক।”
তাজ ভাই আমার হাত ধরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“শিওর? ভালো ছিল না?”
“না।”
“সত্যি?”
আমি উত্তর না দিয়ে গাল ফুলিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। তাজ ভাই ড্রাইভিং সিটে বসে আমার সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বললেন,
“দিনে দিনে তোমার সাহস বাড়ছে মিসেস তাজওয়ার। মনে হচ্ছে নিয়মিত ধমক না শুনলে এ সাহস আকাশ ছুঁবে।”
আমি ইতস্তত করে বললাম,
“আপনি আমায় ‘তুমি’ বলবেন না তো। কেমন যেন লাগে আমার।”
“কেমন লাগে?”
“জানি না।”
“জানো না কেন?”
“তা-ও জানি না, ধুর।”
তাজ ভাই পুনরায় হাসলেন। সিলবেল্ট লাগিয়ে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বললেন,
“আজ কী?”
আমি ভ্রুকুটি করে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করলাম,
“কী?”
“জানো না?” এক ভ্রু উঁচিয়ে বললেন উনি।
ওনার মুখে দুষ্টুমির আভাস পেয়ে আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। ওনার তপ্ত নিঃশ্বাস আমার মুখের ওপর আছড়ে পড়তেই আমি ঢোক গিলে বললাম,
“সরে বসুন।”
তাজ ভাই না সরে উলটো টুক করে আমার গালে একটা চুমু খেয়ে বসলেন।‌ আমি চোখ দুটো ছানাবড়া করে তাকাতেই উনি ঠোঁট টিপে হেসে বললেন,
“আজ আমাদের সোহাগ রাত ইলুরানি।”
লজ্জায় নতজানু হয়ে আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসি আটকালাম। চেনা মানুষটাকে আজ বড্ড অচেনা লাগলো। আমি যখন লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি, ঠিক তখনই তাজ মহাশয় নিজস্ব চরিত্রে ফিরে গিয়ে সোজা হয়ে বসে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,
“আমি বলে তোর মতো মাথামোটাকে বউ হিসেবে গ্রহণ করেছি। নইলে তোকে বিয়ে করত কোন হতভাগা? নেহাতই আমি খুব উদার মনের মানুষ। তাই তোর কপালে জামাই জুটল।”
আমি কপাল কুঁচকে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“একটা দিনও কি আপনি ভালো মানুষ হয়ে থাকতে পারেন না? এই তো এতক্ষণ অন্যরকম ছিলেন। এখন আবার সেই পূর্বের আচরণ!”
“তোর সাথে এত প্রেম-প্রেম হাবভাব পোষায় না, বুঝলি? বেশি প্রেম দেখালে তুই মাথায় চড়ে বসবি।”
আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। আজকের দিনটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না, তাই মুখ ঘুরিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফিরালাম। মনে হঠাৎ আফসোস জাগল, ইশ্, বিয়েটা গ্রামে হলে ভালো হতো। দুজনের মা-ই তো ওখানে আছে। তাজ ভাই হঠাৎ পাশ থেকে বলে উঠলেন,
“বিয়েটা গ্রামে করার ইচ্ছে আমারও ছিল। কিন্তু ওখানকার পরিস্থিতি ভালো লাগেনি। মেজো মামার পরিবার তো নেই সেখানে। বললেও মামি তার বাবার বাড়ি থেকে ফিরে আসত না।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে চট করে ঘুরে বসে সন্দিহান কন্ঠে বললাম,
“এই, আপনি তো মাইন্ড রিড করতে জানেন না। আমার ডায়েরি পড়ে সব জেনেছিলেন। এখন আমার মনের কথা জানলেন কীভাবে?”
তাজ ভাই ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা ঝুলিয়ে বললেন,
“তোমার মনটা তো আমারই। তাই আর কারো না হলেও, তোমার মাইন্ড রিড করার মতো অলৌকিক ক্ষমতা আমার আছে।”
আমি বেশ অবাক হলাম। তাজ ভাই ফিক করে হেসে উঠে বললেন,
“একদিনেই এতকিছু বুঝতে যাস না। মোটা মাথাটা আরও মোটা হয়ে যাবে।”
আমি বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে গিয়েও ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে দমে গেলাম। হুট করে আমার মাথায় অনুভুতিগুলো তোলপাড় সৃষ্টি করল। তাজ ভাইয়ের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বললাম,
“এতটা কষ্ট না দিলেও পারতেন ডিটেকটিভ সাহেব। আরেকটু হলে শ্বাসটুকু বন্ধ হয়ে যেত।”
তাজ ভাই একহাতে আমায় আগলে ধরে মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে বললেন,
“শ্বাসটুকু সচল রাখার জন্যই তো এত আয়োজন। ভাইয়াকে দিয়ে মামুকে এই বিয়ের জন্য রাজি করানো, তারপর একদিনে সবাইকে ইনভাইট করে সব আয়োজন, এত ব্যস্ততার মাঝেও বউয়ের জন্য নিজের পছন্দের সাদা বেনারসী কিনতে যাওয়া, সবাইকে বলে-কয়ে বুঝিয়ে তোমাকে জানাতে নিষেধ করে সারপ্রাইজ দেওয়া, এসবের পেছনে কারণ একটাই। যেকোনো মূল্যে আমার বনলতাকে ভালো রাখা, হাসিখুশি রাখা, নিজের কাছে আগলে রাখা।”
আমি ওনার বাহু আঁকড়ে ধরে বললাম,
“বিপজ্জনক লোক একটা। মনে দয়ামায়া নেই? আমার অবস্থা দেখেও চুপচাপ মজা নিচ্ছিলেন। এত জ্বালান কেন আমায়?”
তাজ ভাই আমার মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে কোমল কন্ঠে বললেন,
“আজীবন তোমাকে জ্বালানোর ব্রত গ্রহণ করেছি বেগম সাহেবা। প্রণয়ের উত্তাল স্রোতে ভেসে জ্বালিয়ে মারব তোমায়। তোমার আমার প্রণয়ালাপন চলেছে, চলছে এবং চলবে। এ থেকে তোমার পরিত্রাণের পথ নেই ইলোনি, একদমই নেই।”

~সমাপ্ত~