তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-৪০+৪১

0
477

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৪০

শত্রুরা সবসময় দুর্বলতা খুঁজে বের করে আঘাত হানতে পছন্দ করে। তাজ ভাইয়ের বেলায়ও তাই হয়েছে। বেশ কয়েকদিন ধরে সে একদল সন্ত্রাসীর পেছনে উঠেপড়ে লেগেছিল। আর তার ফলস্বরূপ সেই সন্ত্রাসীর দল তার দুর্বলতা হিসেবে আমাকেই খুঁজে পেয়েছে। মূলত তাজ ভাইকে জব্দ করার জন্যই আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। অথচ বেচারারা নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই ফেঁসে গেছে। তাজ ভাইকে জব্দ করতে তো পারেইনি, উলটো নিজেরাই ধরা পড়ে জেলে ঢুকে গেছে। সেদিনের পর পাঁচদিন কেটে গেছে। আর আমার এই পাঁচদিন সম্পূর্ণ বিষাদে ভরা ছিল। তাজ ভাইয়ের মধ্যে হঠাৎ বিস্তর পরিবর্তন। সেদিনের পর থেকে উনি আর আমার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না। যখন-তখন আমাকে কারণে-অকারণে বকেন না। শাসন করে পড়তে বসান না। সময়-অসময়ে চা খেতে চান না। আমি নিজে নিয়ে গেলে না-ও করেন না। কখনও না খেয়ে থাকলে খাবারটা খাইয়ে দিয়ে গেলেও, মুখ থাকে গম্ভীর। আমি যেচে কথা বলতে গেলেও হুঁ, হা করে যান। আমাকে ভার্সিটিতেও নিয়ে যায় রাজ ভাইয়া। সকালে ঘুম থেকে ডেকে তোলে বাবা। ওনার এই অদ্ভুত পরিবর্তন আমি সহজভাবে নিতে পারছি না। কেমন যেন রহস্যময় লাগছে। নইলে উনি তো এভাবে চুপ মেরে যাওয়ার মানুষ না। যে লোক সারাটা দিন অযথাই আমার পেছনে লেগে থাকত, সে হঠাৎ মৌনতা অবলম্বন করবে কোন দুঃখে? এমনও তো না যে উনি কোনো কারণে রেগে আছেন। আমি নিজের মুখে জিজ্ঞেসও করেছি যে উনি কোনো কারণে আমার ওপর অসন্তুষ্ট কি না। জবাবে উনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন উনি আমার ওপর কোনোভাবেই অসন্তুষ্ট না। তাহলে? এই তাহলের উত্তর হাজার খুঁজেও আমি উদঘাটন করতে সক্ষম হইনি। এদিকে ওনার মৌনতা আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাক্ষণ ওনার এই হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ খুঁজতে, খুঁজতে আমার মাথায় শুধু উনিই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাঁচদিনে বেশ দুঃখ বিলাসও হয়ে গেছে। পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুর প্রতি অনিহা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ উনি এতসব স্বচক্ষে দেখেও চুপ! এটাও সম্ভব? যে এতটা দিন পর্যন্ত আমার দৈনন্দিন জীবনের কোনো কিছুতে একটু অনিয়ম হলে রেগেমেগে বোম হয়ে যেত। নিজ হাতে সব ঠিক করে দিত। আজ আমি এলোমেলো হয়ে থাকলেও সে ফিরেও তাকাচ্ছে না!

রাত নয়টার দিকে বিছানায় বইখাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমি সটান শুয়ে ওই একই বিষয়ে ভেবে চলেছি। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলাম তাজ ভাই। গত পাঁচদিন ধরে উনি এই অদ্ভুত কাজটাও করছেন। আমার রুমে ঢোকার আগে নক করছেন, অনুমতি চাইছেন। অথচ পাঁচদিন আগেও এটা নিয়ে আমি চেঁচামেচি করা সত্ত্বেও উনি ত্যাড়ামি করেছিলেন। আমি মুখ তুলে তাকাতেই তাজ ভাই অনুমতি চাইলেন,
“আসব?”
আমি ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বালিশে মাথা এলিয়ে দিয়ে বললাম,
“আসুন।”
উনি ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলেন। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“শরীর খারাপ?”
আমি থমথমে মুখে জবাব দিলাম,
“মরে গেলেই বা কে খবর রাগে?”
আরও এক বিস্ময় সৃষ্টি করে উনি আমার এই অভিমানভরা কথাটাও কোনোরকম আমলে নিলেন না। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন,
“উঠে বোস।”
আমি উঠে বসলাম। এতক্ষণে খেয়াল করলাম ওনার হাতে একটা শপিং ব্যাগ। উনি সেই ব্যাগটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। আমি ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলাম,
“কী এটা?”
“খুলে দেখ।”
ওনার কন্ঠস্বর কেমন যেন লাগছে। গম্ভীর, থমথমে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেও সন্তোষজনক কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। তাই ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে শপিং ব্যাগে কী আছে তা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আর তা দেখামাত্রই আমার চোখ-মুখ খুশিতে ঝলক দিয়ে উঠল। লাল আর কালো রংয়ের খুব সুন্দর একটা শাড়ি। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আমি শাড়িটা খুলে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। কিন্তু উনি হঠাৎ আমার জন্য শাড়ি আনলেন কেন বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলাম,
“হঠাৎ শাড়ি আনলেন যে?”
“পছন্দ হয়েছে?” প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করলেন উনি।
“হ্যাঁ, সুন্দর। কিন্তু এখন এই শাড়ি দিয়ে কী করব আমি? কোনো প্রোগ্রামও তো নেই।”
আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। লক্ষ্য করলাম ওনার মুখটা কেমন ফ্যাকাসে লাগছে। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে উনি আমার দিকে তাকিয়ে ফট করে বলে উঠলেন,
“কাল বিকেলে পাত্রপক্ষ তোকে দেখতে আসবে।”
আমি ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই ফিক করে হেসে উঠলাম। হাসতে হাসতে বললাম,
“সিরিয়াসলি তাজ ভাই? আপনি আর কোনো অজুহাত খুঁজে পেলেন না? এর থেকে ভালো ছিল যদি বলতেন কাল তোর বিয়ে। যে কি না কদিন আগে নিজে পাত্রপক্ষকে ফিরিয়ে দিয়েছে, সে আবার পাত্রপক্ষকে আমাকে দেখানোর জন্য নিজ হাতে শাড়ি কিনে আনবে? আমাকে বোকা পেয়েছেন?”
তাজ ভাই ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলেন,
“হাসছিস কেন তুই?”
“হাসব না তো কী করব? এ কদিন মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন, আর আজ এসেছেন আজাইরা ফাজলামি করতে।”
“আমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি ফাজলামি করছি?” গম্ভীর মুখে শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন তাজ ভাই।
আমি ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি থামিয়ে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করলাম। চোখ জোড়া সরু করে বোকা, বোকা মুখে বললাম,
“তার মানে?”
“মানেটা স্পষ্ট। আগামীকাল বিকেলে পাত্রপক্ষ তোকে দেখতে আসছে। কদিন আগে যাদের না বলা হয়েছিল তারাই। আর কিছু জানার আছে?”
প্রথমে ফাজলামি ভেবে নিলেও এবার ওনার কথার ধরণ দেখে আমার কপালে কিঞ্চিত ভাঁজ পড়ল। মিইয়ে পড়া সন্দিহান কন্ঠে আমি বললাম,
“আমি কিন্তু এখন মোটেও ফাজলামির মুডে নেই তাজ ভাই। পাঁচ-পাঁচটা দিন পর যেচে আমার সাথে কথা বলছেন, তা-ও আবার এসব কথা? আপনি আমাকে অন্য ছেলের জন্য দেখাবেন, এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”
“কেন? সমস্যা কোথায়? তারা তোকে আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছে। এখন শুধু চোখের দেখা দেখে বিয়ের কথা বলবে, ব্যস। মামু রাজি। আশা করি মামুর পছন্দের ওপর তোর আপত্তি থাকবে না।”
ওনার এমন গম্ভীর কথাবার্তা শুনে আমার মেজাজ চটে গেল। তবু নিজেকে সামলে কিঞ্চিত বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“তাজ ভাই প্লিজ। কী সব বলছেন? আমার এসব ভালো লাগছে না। আমার সাথে কথা বলতে হবে না আপনাকে। যান তো।”
“ছেলেটাকে তো তুই দেখিসনি। দেখাচ্ছি ওয়েট।”
বলেই উনি পকেট থেকে ফোন বের করলেন। আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি আমার দিকে ফোনটা তাক করলেন। স্ক্রিনে বেশ হ্যান্ডসাম এক ছেলের ছবি ভাসছে। আমি এক নজর দেখেই দৃষ্টি ফিরিয়ে তাজ ভাইয়ের মুখের দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকালাম। ওনার মুখোভাব বলছে উনি সিরিয়াস। ফাঁকা একটা ঢোক গিলে আমি কমতা-আমতা করে বললাম,
“আ-আপনি মজা করছেন।”
“না”, দৃঢ় কন্ঠে বললেন উনি।
“মিথ্যে কথা।”
“মিথ্যে বলে আমার লাভ?”
এরপর আর কী বলা যায় সহসা খুঁজে পেলাম না। হাত-পা হঠাৎ কেঁপে উঠল। চট করে আমি বিছানা থেকে নেমে ওনার মুখোমুখি দাঁড়ালাম। কাঁপা গলায় বললাম,
“স্পষ্ট করে বলুন তো, কাহিনি কী?”
তাজ ভাই সেই একই ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন,
“বললামই তো। আর কী বলব? ছেলেটাকে সবার পছন্দ হয়েছে। ছেলেও তোকে পছন্দ করে। তাই সবার সম্মতিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
“আপনি রাজি হলেন?” ফট করে প্রশ্ন করে বসলাম আমি।
উনি আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললেন,
“সবাই রাজি হলে আমি বাদ যাব কেন? যাইহোক, ডিনারে চল।”
কথাটা বলেই উনি দরজার দিকে পা বাড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি ওনার এক হাত চেপে ধরে থামিয়ে দিলাম। তাজ ভাই বোধ হয় একটু থমকালেন। আমি ছলছল চোখে বললাম,
“এসব বলে কষ্ট দিতে চাইছেন আমাকে?”
“এমনটা মনে হওয়ার কারণ?” গম্ভীর গলায় উলটো প্রশ্ন করলেন তাজ ভাই।
“আপনি অন্য একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছেন?”
“সবাই চাইছে।”
“সবাই চাইলেও আপনি কীভাবে চাইছেন?”
“কেন? আমার তো আলাদা করে চাওয়ার কিছু নেই।”
“আপনি এত স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বলছেন!” অবাক হয়ে কথাটা বলতেই আমার বাঁ চোখের কার্নিশ বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তাজ ভাই আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই আমার মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করতে করতে বললেন,
“কাল সময়মতো রেডি থাকিস। কোনো ঝামেলা যেন না দেখি।”
আমি হতবুদ্ধি হয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ওনার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী সব বলে গেলেন উনি! ওনার কথাগুলো যে সত্যি তা এখনও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে আমাকে বোকা বানানোর ধান্দায় এমনটা করছেন। মনে মনে আশংকাও দানা বাঁধছে। কিছুক্ষণ থম মেরে এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে আমি হঠাৎ রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য বাবার রুম। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেই সত্যিটা বের হয়ে যাবে। আমি নিশ্চিত এসব মিথ্যা। বাবার কাছ থেকে প্রমাণ নিয়ে তারপর শয়তানটার সাথে আর কথাই বলব না। আমাকে মিথ্যে বলে কাঁদানো? এক ছুটে বাবার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে পা বাড়াতে যেতেই হঠাৎ থমকে গেলাম। তাজ ভাই ভেতরে, বাবার সাথে কথা বলছেন। ওনার একটা কথা কানে ভেসে আসতেই আমি পুরোপুরি থমকে গেলাম। উনি বললেন,
“ওনারা নিশ্চিত করেছে মামু। কাল বিকেলেই আসবে বলেছে। ইলুকে বলে রেখেছি আমি। তুমি ভেবো না।”
আমার হাত-পা হঠাৎ শক্ত হয়ে এল। নড়াচড়া করার শক্তিও পাচ্ছি না। নিজের কানে শোনা কথাটাও আমার মিথ্যা মনে হলো। চোখ জ্বালাপোড়া করে মাথাটা ভার হয়ে আসছে। আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াতে পারলাম না। যেভাবে এক ছুটে গিয়েছিলাম, সেভাবেই এক ছুটে পুনরায় রুমে চলে এলাম। রুমে ঢুকেই ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। নিজেকে কেমন এলোমেলো লাগল। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। বেশ কনফিউশনেও পড়ে গেলাম। এটা কীভাবে সম্ভব? তাজ ভাই এমন স্বাভাবিক! ওনার এত এত ভালোবাসা কোথায় গেল? দুহাতে মাথা চেপে ধরলাম। নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পড়ল। আবেগী মনের কাছে হার মেনে কান্নারা বাঁধ ভেঙেই ছাড়ল। আজ এই প্রথম আমি রাতের বেলা রুমের দরজা ভেতর থেকে লক করে রাখলাম। উদ্দেশ্য কারো সামনে না যাওয়া। যেভাবে ভেঙে পড়েছি, তাতে সবার সামনে যাওয়া সম্ভব না। সবাই প্রশ্ন তুলবে। ডিনার করার জন্য জেনিফার ভাবি আর বাবা অনেক ডাকাডাকি করে গেল। আমি শুধু বললাম যে আমার ক্ষুধা নেই। মাথা ব্যথা করছে তাই ঘুম প্রয়োজন বলে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তাদের বিদায় করলাম। আজ আর তাজ ভাই এলেন না আমাকে জোর করে খাওয়াতে। আমার অপেক্ষা বিফলে যাওয়ার সাথে সাথে অভিমানের পাল্লা ক্রমশ ভারী হলো। কান্নাকাটি করে রাত কটা বাজে ঘুমালাম নিজেরই খেয়াল নেই।

ভোরে বাবার ডাকে ঘুম থেকে উঠলাম। কান্নার কারণে মাথাটা হালকা ব্যথা করছে। নামাজ আদায় করে আল্লাহর নিকট প্রাণভরে প্রার্থনা করলাম। নামাজের পর প্রতিদিন তাজ ভাই আর বাবার জন্য চা করা হয়। অথচ আজ প্রতিদিনকার সেই ইচ্ছেটাই মরে গেছে। তবু রুম থেকে বেরোলাম। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ানোর সময় দেখলাম তাজ ভাইয়ের রুমের দরজা বন্ধ। এসময় তো কখনও ওনার রুমের দরজা বন্ধ থাকে না। চুপচাপ চা করে এক কাপ চা বাবাকে দিয়ে এলাম। বাবা খুব একটা কথা তুলল না। তাজ ভাইয়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওনাকে ডাকতে গিয়েও কন্ঠনালি আটকে গেল। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে দারুণ ব্যথা শুরু হলো। বুঝলাম, পারব না ওনাকে ডাকতে। দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলাম। চায়ের কাপটা পুনরায় রান্নাঘরে রেখে এলাম। আমারও আর চা খাওয়া হলো না। রুমে এসে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আবার কান্না। শিয়রের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিলাম বান্ধবীদের সাথে কথা বলার জন্য। ব্যাপারটা ওদেরকে জানানো হয়নি। যদি কিছু সমাধান দিতে পারে ওরা। কিন্তু স্ক্রিনে সর্বপ্রথম চোখ পড়ল শ্রেয়ান ভাইয়ার মেসেজের নোটিফিকেশনে। গতরাতে আমি ঘুমানোর পরের মেসেজ। শ্রেয়ান ভাইয়া তো আমার সাথে যোগাযোগই বন্ধ করে দিয়েছেন। গতকাল বাড়িতে এসেও তেমন কথা বলেননি। হঠাৎ মেসেজ! দ্রুত মেসেজ ওপেন করলাম। উনি লিখেছেন,
“কাল সাড়ে দশটার দিকে আমি তোমার ভার্সিটিতে যাব ইলোমিলো। খুব ইম্পর্ট্যান্ট কিছু কথা আছে তোমার সাথে। আমি গিয়েই তোমাকে মেসেজ করব। কষ্ট করে একটু বেরিয়ো প্লিজ।”
অবাক না হয়ে পারলাম না। মেসেজের মাথামুন্ডু কিছুই মাথায় ঢুকল না। এতদিন নিজেকে গুটিয়ে রেখে হঠাৎ কী এমন ইম্পর্ট্যান্ট কথা মনে পড়ল ওনার? তা-ও আবার আজকের দিনে! এবার তো ওনার কথা শোনার জন্য আগ্রহ বেড়ে গেল। নিশ্চয়ই খুব ইম্পর্ট্যান্ট কোনো কথাই বলবেন। শ্রেয়ান ভাইয়া অযথা সময় নষ্ট করার মতো মানুষ না। বেশ অস্থিরতা নিয়ে অনেকটা সময় কাটালাম। ব্রেকফাস্টের সময় মিতা এসে আমাকে ডেকে গেল। আমি বললাম খাবার রুমে দিয়ে যেতে। মিতার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছিল ও খুব অবাক হয়েছে। হবারই কথা। কারণ সবসময়ই আমি বাড়ির সবার সাথে ব্রেকফাস্ট করি। তবু ও কথা বাড়াল না। আমার কথামতো খাবারটা রুমে দিয়ে গেল। আমি জানি আজ খাবার গলা দিয়ে নামবে না। সেজন্যই রুমে নিয়ে আসা। কোনোমতে একটা রুটির অর্ধেক খেয়ে বাকিটা রেখে দিলাম। তারপর ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হতে লেগে পড়লাম। আমি রেডি হয়ে বেরিয়ে দেখলাম তাজ ভাই আর বাবা একসাথেই বেরিয়েছেন। তাজ ভাই আমার দিকে তাকালেন না। যেন আমাকে উনি চোখেই দেখেননি। বুকের বাঁ পাশটা চিনচিনে ব্যথায় ছেয়ে গেল। তবু এ সময় নিজেকে ধাতস্থ করে নিলাম। তাজ ভাই আমার সামনে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। একটাবার নিজের সাথে নেওয়ার কথা মুখেও তুললেন না। কষ্টগুলো সব পাথর চাপা দিয়ে বাবার সাথেই ভার্সিটিতে গেলাম। একটা ক্লাস করলাম পুরো অস্থিরতা নিয়ে। শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা না শোনা পর্যন্ত যেন কিছুতেই স্বস্তি পাব না। ঠিক দশটা পঁয়ত্রিশে শ্রেয়ান ভাইয়ার মেসেজ এল। আমি বান্ধবীদের বলে ক্যাম্পাসে যেতেই শ্রেয়ান ভাইয়াকে পেলাম। উনি আমাকে দেখে মলিন হেসে বললেন,
“কেমন আছো ইলোমিলো?”
আমি ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বললাম,
“ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”
“এই তো ভালো।”
“অনেকদিন পর আপনার সাথে যোগাযোগ হলো। এতদিন যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন যে?”
শ্রেয়ান ভাইয়া আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। প্রসঙ্গ পালটে বললেন,
“চলো ক্যান্টিনে বসি।”
অগত্যা আমি ওনার সাথে ক্যান্টিনে চললাম। মুখোমুখি বসে আমি উৎসুক দৃষ্টিতে শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি মুচকি হেসে বললেন,
“ফুসকা খাবে তো?”
আমি মাথা দুলিয়ে বললাম,
“না ভাইয়া। ইচ্ছে করছে না।”
“কেন?”
“ভালো লাগছে না।”
“ব্রেকফাস্ট করে এসেছ?”
“হ্যাঁ। সেদিন তাজ ভাই আপনাকে আমাদের সাথে ঘুরতে যেতে বলেছিল না? গেলেন না যে?”
“পরে বলছি”, ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন শ্রেয়ান ভাইয়া।
“আপনি কী যেন ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলবেন বলেছিলেন?”
শ্রেয়ান ভাইয়া মাথা দুলিয়ে বললেন,
“বলছি। হাতে বেশি সময় নেই। তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে এখান থেকে। যাইহোক শোনো, আমি যা যা বলব সবটা ধৈর্য ধরে চুপচাপ শুনে যাবে। আগেই কোনো রিয়্যাক্ট করবে না। ফার্স্ট অফ অল, কথাগুলো শুনে হয়তো তুমি খুব অবাক হবে। কিন্তু আমি যে এই কথাগুলো তোমাকে বলেছি তা এখনই কাউকে বলবে না। পরে বললে সেটা তোমার ব্যাপার, তখন বলতে পারবে। বাট এখন বলবে না। বুঝেছ?”
আমি মাথা কাত করে সম্মতি জানালাম। শ্রেয়ান ভাইয়া কপাল চুলকে হয়তো নিজেকে ধাতস্থ করলেন। আর আমি চাপা অস্থিরতা নিয়ে উন্মুখ হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা কাজ করছে। মাথার মধ্যে শুধু ঘুরছে, শ্রেয়ান ভাইয়া কী বলবেন, কখন বলবেন?

চলবে……….……….🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৪১

“সবার আগে তোমাকে একটা প্রশ্ন করব। আশা করি সঠিক উত্তর দিবে”, আমার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললেন শ্রেয়ান ভাইয়া।
আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা কাত করে সম্মতি জানালাম। শ্রেয়ান ভাইয়া নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে খানিক বাদেই বলে উঠলেন,
“তুমি কি জানো তাজ তোমাকে ভালোবাসে?”
আমি কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলাম। এ কথা শ্রেয়ান ভাইয়া জানেন কীভাবে? তাজ ভাই বলেছেন না কি? কিন্তু শ্রেয়ান ভাইয়া এ কথা জেনেও তাজ ভাইয়ের সামনে আমাকে প্রপোজ করলেন কীভাবে? আশ্চর্য! আমি দ্বিধাভরা মুখ করে আমতা-আমতা করতে লাগলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“নির্দিধায় বলতে পারো। জানো না কি?”
এবার আমি ধীর গতিতে ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালাম। শ্রেয়ান ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গেই ভ্রুকুটি করে বললেন,
“তাজ তো কখনও নিজের মনের কথা তোমাকে বলেনি। জানলে কীভাবে?”
আমি শ্রেয়ান ভাইয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললাম,
“ওনার আচার-আচরণে বুঝতে পেরেছি।”
“আচ্ছা। ও নিজের মনের কথা কখনও বলে না কেন, তা জানো?”
আমি ডানে-বায়ে মাথা দুলিয়ে বললাম,
“না। এটা জানার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু কখনও জানতে পারিনি।”
“কারণ ও তোমাকে বিয়ে করে তারপর নিজের মনের কথা বলতে চায়।”
আমি অবাক হয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা শুনলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া একটু থেমে আবার বললেন,
“সুইডেন থেকে ফেরার পর থেকেই ও তোমাকে ভালোবাসে। এ কথা আমি নিজেও জানতাম না। কয়েকদিন আগে জেনেছি। জানলে আমি কখনোই তোমাকে নিজের মনের কথা বলতাম না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, এটা যেমন সত্যি। তেমনি আমি তাজকে ভালোবাসি, এটাও সত্যি। তোমাকে আমি যেদিন প্রপোজ করেছিলাম, সেদিন রাতেই জানতে পারি তাজও তোমাকে ভালবাসে। আমার আগে ও তোমাকে ভালোবেসেছে। তা-ও স্বয়ং তাজ নিজের মুখে আমাকে বলেছে। সেদিন আমি অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার থেকে দ্বিগুণ বেশি তাজ তোমাকে ভালবাসে। ওর মতো করে হয়তো আমি কখনোই তোমাকে ভালোবাসতে পারব না। সেদিন তাজ খুব বিধ্বস্ত মুখে আমার সামনে এসেছিল। কিছু বলতে গিয়েও বারবার আটকে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ও খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। তাই অভয় দিয়ে বলেছিলাম যা বলার নির্দ্বিধায় বলতে। ও খপ করে আমার হাত দুটো মুঠোয় চেপে ধরেছিল। অসহায় মুখে বলেছিল ওর জীবনে ও একজনকেই ভালোবেসেছে। আর সে হচ্ছ তুমি। ওর এলোমেলো জীবন সেদিন থেকেই গুছিয়ে নিয়েছে, যেদিন ও তোমার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করেছে। সুইডেন থাকাকালীন ও বেশিরভাগ সময় প্রচন্ড ডিপ্রেশড থাকত। আন্টি-আঙ্কেলকে, নিজের দেশকে, আপন মানুষদেরকে খুব মিস করত। তুমি ওর জীবনে আসার পর ওর জীবনটাও বদলেছে। ওর ধারণা ও তোমাকেও অনেকটা বদলে দিতে পেরেছে। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোমাকে লাইফ পার্টনার করে বাকি জীবন সাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দিবে। তোমাকে নিয়ে ও খুব ভয়ে থাকে। কখনও কোনোভাবে যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলে, তাই। আমি শুধু অবাক হয়ে শুনে গেছি। আমি ওকে যতটুকু চিনি তাতে আমার ধারণা ছিল, ওর মতো মানুষ আর যাই হোক কারো প্রেমে পড়তে পারে না। অথচ সেদিন আমার বিস্ময় ক্রমশ বেড়েই চলল। ও আমার হাত দুটো ধরে অনুরোধ করে বলেছিল, আমি যেন আর কখনও তোমাকে নিজের ভালোবাসার কথা না বলি। কারণ ও কোনো মূল্যেই তোমাকে হারাতে চায় না। ওর থমথমে মুখ আর এলোমেলো অবস্থা দেখে আমি ওর মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিলাম। আর এটাও আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে, তাজের মন যতই শক্ত হোক, সেটা তোমার ক্ষেত্রে বিপরীত। একমাত্র তোমার ক্ষেত্রে ওর মন তুলোর মতো নরম। তোমার দিক থেকে ও কোনো আঘাত পেলে তা সামলাতে পারবে না। রামিশাকে হারিয়েও আমি নিজেকে সামলে এই পর্যন্ত এসেছি। কিন্তু তাজ পারবে না। আমি নিশ্চিত ও উলটা-পালটা কিছু করে বসবে। কষ্ট হয়েছিল, তবু আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম আমি কোনোদিনও তোমাদের দুজনের মাঝে আসব না। তাই নিজেই তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। হ্যাঁ, তাজ আমাকে বলেছিল আমি যেন তোমার সাথে যোগাযোগ রাখি। আমিই না করেছিলাম। ভালোবাসার আঘাতগুলো খুব তীব্র হয় ইলোমিলো। আর আমি দ্বিতীয়বারের মতো সেই আঘাত পুনরায় ফিরে পেয়েছি। নিজেকে সামলে নিতেই তোমার থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। সেজন্য আমি দুঃখিত।”
শ্রেয়ান ভাইয়া থামলেন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলেন। ওনার মুখোভাব দেখে বুঝলাম কথাগুলো বলতে ওনার কষ্ট হচ্ছে। এদিকে আমি স্তব্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি। তাজ ভাই আমার জন্য শ্রেয়ান ভাইয়ার হাত ধরে অনুরোধ করলে, এখন কেন সে নিজেই আমাকে অন্য কারো সাথে বিয়ে দিতে চাইছে? এ কেমন রহস্য? ইতোমধ্যে চোখের কার্নিশ বেয়ে নিঃশব্দে জল গড়াতে শুরু করেছে। আর কত বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া মিনিট খানেক পর পুনরায় বলতে শুরু করলেন,
“গত তিনদিন আগেও তাজ সেই একই অবস্থায় আমার কাছে এসেছিল‌। তবে সেদিন শুধু ওর মুখটাই বিধ্বস্ত ছিল না, চোখ দুটোও ভেজা ছিল। জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম ও নিজে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করছে। তোমার বিয়ের কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পরে ও বলল ও তোমাকে নিয়ে এখন আরও বেশি ভয় পায়। ওর ভয়টা বেড়েছে তুমি কিডন্যাপ হওয়ার পর। ওর ধারণা ভবিষ্যতে তুমি এমন আরও বিপদের সম্মুখীন হতে পারো। কারণ ওর দুর্বলতা বলতে তুমিই আছো। আর শত্রুর নজর দুর্বল জায়গাতেই আগে পড়ে। তুমি মনের দিক থেকে খুবই দুর্বল আর ভীতু। তাই এসব সামলে ওঠা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। এসব নিয়ে ও আগে কখনও ভাবেনি। কিন্তু কিডন্যাপিংয়ের পরেই ওর মনে এসব ভয় দানা বেঁধেছে। ও চায় না ওর জন্য তোমার জীবনে কোনো দুর্যোগ নেমে আসুক। তাই নিজের মনে পাথর চাপা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে করে হোক ও তোমাকে সুখী দেখতে চায়। আর ওর মনের কথা এখনও তোমাকে জানায়নি বলেই সিদ্ধান্তটা এত দ্রুত নিতে পেরেছে। সিদ্ধান্তটা ওর জন্য সহজ ছিল না। ও সেদিন খুব কেঁদেছিল আমার চোখের সামনে। ওর মায়ের মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বারের মতো আমি ওকে আবার ডুকরে কাঁদতে দেখেছিলাম। আমি সেদিন বারবার নিষেধ করেছিলাম এসব সিদ্ধান্ত না নেওয়ার জন্য। এই নিয়ে রীতিমতো ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল ওর সাথে। কিন্তু ও নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। শুনেছি তোমার বাবাকে ও হাতে-পয়ে ধরে অনুরোধ করে রাজি করিয়েছে এই বিয়েতে। তোমার ভালোর কথা ভাবতে গিয়ে ও ওর জীবনে সবথেকে বড়ো ভুল সিদ্ধান্তটা নিয়েছে ইলোমিলো। আমি শিওর এই বিয়ে হলে ও এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে। বিশ্বাস করো, ও বাঁচবে না। ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমার মতো সহ্য ক্ষমতা ওর নেই। ও নিজেও তা জানে। তবু জেদ ধরে বসে আছে। যেচে নিজের মরণের পথ তৈরি করছে। ও আমাকে নিষেধ করে দিয়েছিল আমি যাতে তোমাকে এসবের একটা কথাও না বলি। কিন্তু আমি ওর কথা রাখতে পারলাম না। বন্ধু যেচে মরতে চাইছে জেনেও চুপ থাকব কীভাবে? ইলোমিলো, আমি এসব কথা তোমাকে বলেছি কারণ এখন শুধুমাত্র তুমিই শেষ ভরসা। যা করার তোমাকেই করতে হবে। এই বিয়েতে তুমি রাজি হবে না ইলোমিলো। আমি তোমার কাছে রিকোয়েস্ট করছি, প্লিজ। আমি জানি আঙ্কেলের সিদ্ধান্তের ওপর কথা বলার সাহস তোমার নেই। কিন্তু বিশ্বাস করো, তুমি সাহস করে একবার না বললে সেই বিয়ে কখনোই হবে না। তাজ যেভাবে হাতে-পায়ে ধরে আঙ্কেলকে বিয়েতে রাজি করিয়েছে, তুমিও ঠিক সেভাবেই আঙ্কেলকে না বলে দাও। পারবে না?”
আমি উত্তর কী দিব? চোখের পানি আটকাতেই তো হিমশিম খেতে হচ্ছে। আশেপাশের কয়েকজন ছেলে-মেয়ে আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। অনেকে নিজেদের মধ্যে ফিসফাসও করছে। আমি মাথা নিচু করে বারবার চোখ মুছে চলেছি। লোকটা আমাকে ভালোবাসে জানতাম, কিন্তু এতটা তা জানতাম না। বুকের মধ্যে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যাই তার কাছে। শ্রেয়ান ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে হয়তো আমাকে সময় দিলেন। আমি যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিলাম। অতঃপর থমথমে মুখে বললাম,
“এতকিছু হয়ে গেল অথচ আমি খুনাক্ষরেও টের পেলাম না!”
শ্রেয়ান ভাইয়া একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“আমাকে উঠতে হবে ইলোমিলো। তুমি কিছু তো বলো প্লিজ।”
“ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব ভাইয়া”, আশ্বাস দিয়ে বললাম আমি।
শ্রেয়ান ভাইয়া এবার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা টানলেন। বললেন,
“আমি তোমার ওপর ভরসা রাখছি। কোনোভাবেই ভয় পাবে না। কখনও কখনও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গেলে একটু সাহস জোগাতে হয় ইলোমিলো। পারবে তো?”
আমি মাথা দুলিয়ে বললাম,
“পারব।”
“ফুসকা অর্ডার দিই?”
“নাহ্, রুচি নেই। অন্য একদিন খাব।”
শ্রেয়ান ভাইয়া জোর করলেন না। স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হুট করে বলে উঠলেন,
“তুমিও তাজকে খুব ভালোবাসো, তাই না ইলোমিলো?”
আমি খানিক থমকালাম। এক পলক শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে পুনরায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। মন বলল সম্মুখে বসা ভগ্ন হৃদয়ের প্রেমিকের সামনে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা খুব বড়ো স্বার্থপরতা হয়ে যাবে। আড়চোখে একবার তাকিয়ে বুঝলাম শ্রেয়ান ভাইয়ার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে মলিন হাসি। কৃত্রিম হাসি দিয়ে লোকটা নিজের কষ্টগুলো আড়াল করতে চাইছে।
ওনার কষ্টগুলোর কাছে আমার বা তাজ ভাইয়ের কষ্টগুলো বলতে গেলে খুবই তুচ্ছ। পরপর দু-দুটো ধাক্কা সামলেও উনি কীভাবে এত স্বাভাবিক আছে কে জানে? আল্লাহ্ ওনাকে এতটা ধৈর্য দান করেছেন বলেই হয়তো কষ্টগুলো ওনার ঝুড়িতেই গিয়ে জমা হয়। আরও কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলে শ্রেয়ান ভাইয়া তাড়া দেখিয়ে চলে গেলেন।

দুপুরে বাবার সাথে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরেই আমি সবকিছু বিছানায় এলোমেলো করে রেখে আগে তাজ ভাইয়ের রুমে ছুটলাম। বাবার সাথে কথা বলার আগে ওনার সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু ওনার রুমে গিয়ে ওনাকে পেলাম না। বাড়ি ফেরেননি না কি? হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত আছেন। নিরাশ হয়ে আমি পুনরায় নিজের রুমে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। গোসল করে বেরিয়ে চুলগুলো কোনোরকমে মুছে তোয়ালেটা বেলকনিতে মেলে রেখে এলাম। তখনই হখৈ জেসিকার আগমন ঘটল। দরজায় টোকা দিতেই আমি ফিরে তাকালাম। সে মিষ্টি হেসে বলল,
“মে আই কাম ইন?”
আমিও মৃদু হেসে বললাম,
“ইয়েস, কাম, কাম।”
এসময় জেসিকার আগমন আমার জন্য মোটেও খুশির ব্যাপার না। তবু ভদ্রতার খাতিরে সৌজন্যমূলক হাসিটুকু মুখে ঝুলিয়ে রাখতে হলো। জেসিকা রুমে ঢুকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ডান হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। দেখলাম ওর হাতে একটা ভাঁজ করা কাগজ। আমি কিছুটা অবাক হয়ে ভ্রুকুটি করলাম। জেসিকা হাসিমুখে বলল,
“টেক ইট।”
এবার আমি হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলাম। প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে কাগজের দিকে তাকাতেই জেসিকা বলল,
“রিড দিস, ওকে?”
আমি মাথা কাত করে সম্মতি জানালাম। সঙ্গে সঙ্গেই জেসিকা চলে গেল। সে চলে যেতেই আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কাগজের ভাঁজ খুললাম। ইংরেজি অক্ষরের ঝকঝকে কয়েকটা শব্দ চোখে পড়ল। খুব সুন্দর হাতের লেখা। নিশ্চয়ই জেসিকার। যাক, মেয়েটার সুবুদ্ধি হয়েছে। দ্রুত ফোন বের করে জেসিকার লেখা ইংরেজি বাক্য বাংলায় ট্রান্সলেট করলাম। জেসিকা লিখেছে,
“ইলোরা, ভালোবাসা শব্দটা খুব দুর্লভ। ভাগ্য করে তুমি সেই দুর্লভ জিনিসটা পেয়েছ। এত সহজে তা হারিয়ে যেতে দিয়ো না প্রিয়। হানি তোমাকে ঠিক কী পরিমাণ ভালোবাসে, সেই ধারণা তার নিজেরও নেই। প্রকৃত ভালোবাসা ধরে রাখতে শেখো, এত সহজে হারিয়ো না। আমি তোমার পাশে আছি।”
লেখাটা পড়ে আমি বুক ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। কাগজটা নিয়ে বইয়ের ভাঁজে রেখে দিতেই হঠাৎ চোখ আটকাল গুছিয়ে রাখা বইগুলোর ওপরে। ভীষণ অবাক হয়ে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ফেললাম। আমার হারিয়ে যাওয়া সেই ডায়েরি! হাত বাড়িয়ে ডায়েরিটা হাতে নিলাম। এক বছরেরও বেশি সময় হয়েছে আমি এই ডায়েরিটা হারিয়েছিলাম। সবসময় ড্রয়ারেই রাখতাম। হঠাৎ একদিন ড্রয়ার থেকে উধাও হয়েছিল। সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও পাইনি। সেদিন খুব মন খারাপ হয়েছিল। কারণ এই ডায়েরিটাতে আমার ব্যক্তিগত অনেক কথা লেখা আছে। ডায়েরি লেখার অভ্যাস আমার কোনোকালেই ছিল না। বড়ো হওয়ার পর যখন একাকীত্ব খুব করে আমাকে গ্রাস করতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই ডায়েরিকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম নিজের মনের সব কষ্টগুলো উজাড় করে দিতে। আম্মুর মৃত্যুর পর থেকে আমার দিনগুলো কেমন কেটেছে সব লিখে রেখেছিলাম। বলতে গেলে নিজের জীবনকাহিনি সব বিশ্লেষণ করে লিখে রেখেছিলাম। কিন্তু এই গায়েব হওয়া ডায়রি আবার হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলো? আশ্চর্য! চুরি-টুরি হয়ে গেলে চোর তো আর এই এক বছর পর আবার এটা ফেরত দিতে আসবে না। তাহলে? বিস্ময় নিয়ে ডায়েরিটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটা পৃষ্ঠায় দৃষ্টি পড়ল। আমি মনোযোগ দিয়ে দেখলাম এই পৃষ্ঠায় আমি লিখেছিলাম জীবনসঙ্গী হিসেবে ঠিক কেমন ছেলে আমার পছন্দ। খুব কেয়ারিং, দায়িত্বপরায়ণ, নামাজী, আমার একাকীত্ব দূর করতে পারবে, পড়ন্ত বিকেলে আমাকে নিয়ে ছাদে আড্ডা দিবে, হুটহাট সারপ্রাইজ দিয়ে আমার মন ভালো করে দিবে, পাঞ্জাবি পছন্দ করবে ইত্যাদি, ইত্যাদি আরও অনেক কথা। কত কথা যে লিখেছিলাম! এখন পড়ে নিজেরই হাসি পেল। কিন্তু লেখাটুকুতে আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল। হুট করেই বিরাট এক রহস্য উদঘাটন করে ফেললাম। অতিরিক্ত বিস্ময়ে আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করলাম,
“তার মানে তাজ ভাই মাইন্ড রিডার না। সব ভাঁওতাবাজি! হায় আল্লাহ্!”

চলবে………………🍁