তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-৪২+৪৩

0
490

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৪২

দুপুরে খাবার টেবিলে তাজ ভাইকে দেখতে পেলাম। খাওয়ার সময় জানতে পারলাম পাত্রপক্ষের লোক বিকালে আসতে পারবে না। সন্ধ্যায় আসার কথা বলেছে। তাতে আমার কী? আমি এসবে ভ্রুক্ষেপ করলাম না। অপেক্ষায় থাকলাম কখন তাজ ভাই রুমে যাবেন। খাওয়া শেষ করেই উনি রুমে চলে গেলেন। আমিও নিজের রুমে গিয়ে ডায়রিটা হাতে নিয়ে দ্রুত ওনার রুমে ছুট লাগালাম। হাত দুটো পেছনে লুকিয়ে ধীর পায়ে রুমে ঢুকে দেখলাম উনি মাত্রই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন। আমাকে দেখে ভ্রুকুটি করে বললেন,
“কারো রুমে এলে নক করে আসতে হয়, জানিস না?”
আমি চরম অবাক হবার ভান করে বললাম,
“তাই না কি? জানা ছিল না তো। আসলে আমি আপনার থেকে অনুপ্রাণিত তো, তাই বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছে।”
তাজ ভাই প্রতিউত্তর না করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করলেন,
“কেন এসেছিস?”
আমি প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করলাম,
“আজকাল ডিটেকটিভিটি ছেড়ে চুরির কারবার শুরু করেছেন না কি?”
আমার কথা শুনে তাজ ভাই ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত করে তাকালেন। পরক্ষণেই হয়তো ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলেন। নিজের ফোনে মনোযোগ দিয়ে বললেন,
“যা বলার স্পষ্ট বলে বিদায় হ।”
“এটা চুরি করেছিলেন কেন?” হাত দুটো সামনে এনে ডায়রিটা ওনার সামনে তুলে ধরে বললাম।
উনি ডায়রির দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে কিছু না বোঝার ভান করে বললেন,
“কার ডায়রি এটা?”
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“ঢং করছেন? এই ডায়রি চুরি করে পুরো এক বছর নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছেন। এখন না চেনার ভান করে আমাকে বোকা বানাতে চাইছেন? হারানো ডায়রির তো আর পাখা গজায়নি যে, উড়ে উড়ে আমার টেবিলের ওপর এসে পড়বে।”
“তোর আজাইরা কথা শোনার সময় নেই আমার। একটু পর বেরোতে হবে। রেস্ট নিতে দে। নিজের কাজে যা।”
ওনার কন্ঠে বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। বুঝলাম, উনি এই নিয়ে কথা বলতে চাইছেন না। এড়িয়ে যেতে চাইছেন। তাই ডায়রিটা বিছানায় রেখে আমিও বিছানায় এক পা তুলে বসে পড়লাম। তাজ ভাই ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসলেন। পুনরায় বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“কী সমস্যা? যেতে বলছি না তোকে?”
“আপনি বললেই আমি চলে যাব?” ত্যাড়াভাবে বললাম আমি।
“ইলু, ঘাড়ত্যাড়ামি করবি না বলছি। যেতে বলছি।”
“এড়িয়ে যেতে চাইছেন?”
তাজ ভাই ধমকের সুরে বললেন,
“কী এড়াব? বড়োদের মুখে মুখে কথা বলা শিখেছিস কোত্থেকে? বেয়াদব মেয়ে। বেরো রুম থেকে।”
আমি শান্ত স্বরে বললাম,
“আপনার মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন তাজ ভাই? কন্ঠে রাগ থাকলেও মুখে নেই। কী ব্যাপার বলুন তো?”
“ইলু”, চোখ পাকিয়ে পুনরায় ধমকে উঠলেন তাজ ভাই।
আমি এবার দুটো পা-ই বিছানায় তুলে বসলাম। স্পষ্ট ভাষায় বললাম,
“শুনুন, ওই লোকদের আসতে না বলে দিন। আমি বিয়ে করব না।”
তাজ ভাই চোখ দুটো সরু করে বললেন,
“ফাজলামি করছিস? ওনারা সন্ধ্যায় আসবেন। এমনও হতে পারে আজই বিয়ের পাকা কথা বলে যাবেন।”
“আমি মোটেও ফাজলামি করছি না। এই বিয়েতে আমার মত নেই।”
“কেন?”
“হতেও তো পারে আমার পছন্দের কেউ আছে। তা না জানতে চেয়েই আপনারা আমার বিয়ের পাকা কথা বলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কী মনে করে? মানে যার বিয়ে তারই খবর নেই!”
“মামুকে বল গিয়ে।”
“বলব‌, তার আগে আপনাকে বলে রাখলাম। আমি যখন বলেছি ওই ছেলেকে বিয়ে করব না, তো করবই না।”
“কাকে পছন্দ তোর?” গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন তাজ ভাই।
“জানেন না?”
“আমার জানার তো কথা না।”
“আপনাকে”, ফট করে বলে বসলাম আমি।
তাজ ভাই বোধ হয় একটু থমকালেন। তড়িঘড়ি করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নড়েচড়ে বসলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
“ফালতু কথা বলতে এসেছিস এখানে?”
আমি মৃদু হেসে বললাম,
“আপনি খুব ভালো করেই জানেন আমার কোনো কথাই ফালতু না।”
“আমাকে নিয়ে পড়েছিস কোন দুঃখে তুই? তোর বিয়ের ব্যাপারে আমাকে টানবি না, খবরদার”, চোখ পাকিয়ে বললেন তাজ ভাই।
আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বললাম,
“কেন? আমাকে ভালোবাসেন না?”
তাজ ভাই থতমত খেয়ে গেলেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে চোয়াল শক্ত করে বললেন,
“এসব কোন ধরণের কথা? অসভ্য মেয়ে। চাপড়ে কথা শিখিয়ে দিব। দুদিন পর বিয়ে হয়ে যাবে, আর তুই এসেছিস ফাজলামি করতে?”
আমি এবার কেঁদেই ফেললাম। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে রাগত স্বরে বললাম,
“আপনি আড়ালে ভালোবাসতে পারবেন, আর আমি জিজ্ঞেস করতে পারব না? আমাকে কি দু বছরের বাচ্চা মনে হয়? কিচ্ছু বুঝি না আমি? আপনি মুখ ফুটে বলেননি বলেই আমি কোনোদিনও বুঝতে পারব না ভেবেছেন? এসব নাটক বন্ধ করুন। আমার আর ভালো লাগছে না। এত লুকোচুরি, এত ভয় কিসের আপনার? ভয়ের কথা আগে মনে ছিল না। আমার মনকে দুর্বল করে এখন আপনার ভয়ের কথা মনে পড়েছে? আগলে রাখার সাহস না থাকলে ভালোবাসার কী দরকার ছিল? একা ছিলাম, বেশ ছিলাম। কোনোরকমে চলে যেত জীবন। যেচে এলেন কেন আমার জীবনে। এসে আবার আমাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যাওয়ারও ব্যবস্থা করছেন। বাহ্, বাহ্! সবকিছু আপনার মন মতোই কেন হবে? আমার জীবনের প্রতি আমার কোনো অধিকার নেই? আমাকে কী পেয়েছেন আপনি?”
তাজ ভাই হতবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার কথা শেষ হতেই উনি শান্ত গম্ভীর স্বরে বললেন,
“ইলু, অতিরিক্ত কথা বলছিস কিন্তু তুই। আমার মাথা গরম করিস না বলে দিলাম।”
“সত্যি কথা বললেই অতিরিক্ত হয়ে যায়? নিজে তো পারেন শুধু লুকোচুরি খেলতে। ভালোবাসা? ভালোবাসার মর্ম বোঝেন আপনি? বুঝলে দূরে ঠেলে দিতে না চেয়ে আগলে রাখতে চাইতেন।”
সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই আমার বাঁ হাতের বাহু শক্ত করে চেপে ধরলেন। ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম আমি। উনি চোখ-মুখ শক্ত করে গর্জে উঠলেন,
“আজকাল মুখে খুব বুলি ফুটেছে তোর। ভালোবাসা? কিসের ভালোবাসা? এই কিসের ভালোবাসা রে? আবেগে ভেসে যাচ্ছিস? তাজওয়ারের পায়ের নখের সমান যোগ্যতা আছে তোর? তোকে আমি ভালোবাসতে যাব কোন দুঃখে? এত সস্তা মনে হয় আমাকে? সুইডেনে কত সুন্দরী মেয়েদের আমি রিজেক্ট করেছি, ধারণা আছে তোর? তুই তো ওদের কাছে কিছুই না। সুন্দরী, স্মার্ট, হট, অ্যাডুকেটেড, কোন দিক আছে তোর? আছে কোনো দিক, যা দিয়ে আমাকে আয়ত্তে আনবি? আবেগ দিয়ে আমাকে পটানো যায় না, এটা ভালোভাবে ঘিলুতে ঢুকিয়ে নে। চুপচাপ বিয়ে কর, সংসার কর, সুখে থাক। ভুলেও আমার পেছনে পড়তে আসিস না। আমি তাজওয়ার, মুখ ফুটে একবার প্রেম-ভালোবাসার কথা বললে সুন্দরী মেয়েদের লাইন লেগে যাবে। তোর মতো একটা অযোগ্য মেয়ের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট থাকবে, এ কথা কেবল স্বপ্নেই সত্যি হবে, বাস্তবে নয়।”
হাতের ব্যথার থেকে বেশি ব্যথা হচ্ছে মনে। ওনার প্রত্যেকটা কথা এসে বুকের মধ্যে তীরের সুচালো ফলার মতো বিঁধে গেল। বুকের মধ্যে অনবরত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। হাতের ব্যথা তো তার কাছে অতি তুচ্ছ। আমি নির্বাক হয়ে শুধু ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনে গেলাম। অশ্রুসিক্ত স্তব্ধ চোখ জোড়া সহসা সরাতে পারলাম না। কন্ঠনালি শব্দ তুলতেও ভুলে বসে আছে। মস্তিষ্কের মধ্যে অনবরত বেজে চলেছে, এ আমি কাকে দেখছি? এ আহনাফ তাজওয়ার হতেই পারে না, কিছুতেই না। আমার মস্তিষ্কের ধারণা ভুল প্রমাণ করে তাজ ভাই আমার বাহু থেকে ওনার হাতটা একপ্রকার ছিটকে সরিয়ে নিলেন। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার।”
বলার মতো কোনো কথা আমি খুঁজে পেলাম না। রোবটের ন্যায় অতি সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। দরজার দিকে পা বাড়াতেই ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। কাঁপা গলায় বলে উঠলাম,
“ভাইয়া!”
রাজ ভাইয়া অবাক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি দ্রুত নিজের চোখের পানি মুছে নিলাম। তাজ ভাই আমার মুখে ভাইয়া ডাক শুনে ফিরে তাকালেও, কিছু বললেন না। রাজ ভাইয়া রুমে ঢুকে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
“কী হয়েছে তোদের?”
আমি মাথা নিচু করে ডানে-বায়ে দুলিয়ে বললাম,
“কিছু না।”
কথাটা বলে আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলাম না। দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। ডায়রিটাও নিতে ভুলে গেলাম। রুমে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। বেশিক্ষণ নিজেকে সামলে রাখা সম্ভব হলো না। দু হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। যে মানুষটা সবসময় আমার কথাই আগে ভাবত, সে-ই কি না আজ আমাকে সহ্য করতে পারছে না! কদিন আগেও উনি কতশত অজুহাতে আমাকে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে সামনে বসিয়ে রেখেছেন।‌ আর আজ? সেই উনিই আমাকে এভাবে ধমকে রুম থেকে তাড়িয়ে দিলেন? এত কেয়ার, এত চিন্তা-ভাবনা কোথায় গেল সব? শেষমেষ আমাকে এভাবে অপমান করলেন! এতটা ছোটো করলেন! ছিহ্! রাগে-দুঃখে নিজের মাথার চুল টেনে ধরলাম। মাথার মধ্যে দপদপ করছে। এক মুহূর্তেই পুরো পৃথিবীটা কেমন বিষাদময় লাগছে। ইচ্ছে করছে অজানা কোথাও হারিয়ে যেতে। যেখানে ভালোবাসার জন্য একটা মানুষও থাকবে না। তাহলে হয়তো এই অলুক্ষুনে ভালোবাসার জন্য আমাকে এভাবে কাঁদতেও হবে না। দীর্ঘদিন পর আজ হঠাৎ করেই আম্মুকে খুব মনে পড়ল। ঠিক আগের মতো, যখন একাকীত্বে ভুগতে-ভুগতে আমি আম্মুর জন্য সময়-অসময়ে কাঁদতাম। আমার সেই নিয়মমাফিক কান্নাটা তাজ নামক পাষাণ লোকটা এসে পুরোপুরিভাবে ভুলিয়ে দিয়েছিল। শেষ কবে আমি আম্মুর কথা ভেবে কেঁদেছিলাম, তা এখন আমার নিজেরই মনে পড়ে না। ওই লোকটা হুট করে এসে আমার জীবনে জুড়ে বসেছিল। ম্যাজিকের মতো আমার সব দুঃখ-কষ্ট, একাকীত্ব ভ্যানিশ করে দিয়েছিল। হাজার বকঝকা, শাসন, ব্ল্যাকমেইলের মাঝেও আমার যত্ন আর খুশির কথা আগে ভাবত। আজ যেন এক নিমিষেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। অভিমানের পাহাড় আকাশ ছুঁলো। সে আর আজ মাথা নোয়াবে না। তাজ নামক পাষাণ লোকটার ওপর তার অজস্র অভিমান ক্রমশ বেড়েই চলল। ঠিক যেন অশ্বের গতিতে ছুটল তার অভিমানের গতিবিধি। আর সেই অশ্বখুরের প্রতিটি শব্দ বুকের বাঁ পাশে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করল। এত এত বেশি কষ্ট কি আমার মতো আবেগী মেয়ের সহ্য ক্ষমতার মধ্যে পড়ে? একসময় ঠিকই ভেঙে পড়তে হলো। বালিশে মুখ গুঁজে ঘন্টাখানেক কাঁদার পরও আবেগী মন শান্ত হলো না। একসময় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে ভালোভাবে পানির ঝাপটা দিয়ে এসে ফোনটা হাতে নিলাম। রুমের দরজা বাইরে থেকে লক করে সোজা ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। সন্ধ্যায় মেহমান আসবে বলে মিতা, রিতা, মারজিয়া খালা কাজে ব্যস্ত। বাবা দুপুরের পর আজ আর অফিসে যায়নি। বিশ্রাম নিচ্ছে। জেনিফার ভাবি আর জেসিকাও আশেপাশে নেই। ফাঁকা ড্রয়িংরুম পেরিয়ে আলগোছে দরজা খুলে আমি অনায়াসেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। কেউ টেরও পেল না। তীব্র অভিমানগুলো মাথায় জেঁকে বসেছে। এই মুহূর্তে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কথাই মাথায় আসেনি। গেইটের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম। দারোয়ান কাকা আমাকে একা দেখলে যদি গেইট না খোলে? কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে সাহস জুগিয়ে এগিয়ে গেলাম। দারোয়ান কাকা আমাকে দেখেই বললেন,
“কী গো মামনি? কী খবর?”
“গেইট খুলুন কাকা। আমি বাইরে যাব।”
“তোমার লগে তো কাউরে দেখতাছি না। একলা বাইরে যাইবা?”
“না কাকা। আমার এক বান্ধবী আসছে, তাই একটু সামনে এগোব।”
“ও, আইচ্ছা যাও তাইলে।”
দারোয়ান কাকা আমার কথাটা সত্যি ভেবে গেইট খুলে দিলেন। গেইট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আমি রাস্তার পাশ ধরে সোজা হাঁটা শুরু করলাম। একটানা অনেকক্ষণ হাঁটার পর কিন্ডার গার্টেনের সামনে এসে থামলাম। ফোন লাগালাম শ্রেয়ান ভাইয়ার নাম্বারে। চারবার রিং হতেই ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা শোনা গেল,
“ইলোমিলো? কেমন আছো?”
“এই তো ভালো। আপনি?”
“ভালো। হঠাৎ নিজে থেকে ফোন করলে যে?” কিছুটা অবাক হয়ে বললেন শ্রেয়ান ভাইয়া।
আমি ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
“আপনি কি ব্যস্ত আছেন ভাইয়া?”
“এই না, না। তুমি রাগ করলে না কি? আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম।”
“রাগ করিনি ভাইয়া। আপনি কি একটু আমাদের বাড়ির বাঁ দিকের রাস্তার পাশের কিন্ডার গার্টেনের সামনে আসতে পারবেন?”
“ওখানে এখন কেন? এই ওয়েট ওয়েট, কোনোভাবে তুমি বাড়ি থেকে পালিওনি তো?” সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করলেন শ্রেয়ান ভাইয়া।
আমি শান্ত স্বরে জবাব দিলাম,
“আমি এখন কিন্ডার গার্টেনের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি ভাইয়া। বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়াতে পরব না। আপনি আসতে পারলে আসুন, নইলে আমি অন্য ব্যবস্থা করছি।”
শ্রেয়ান ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“এই না ইলোমিলো, তুমি ওখানেই দাঁড়াও। ওখান থেকে এদিক-ওদিক কোথাও যাবে না। আমি এক্ষুনি আসছি। ওকে?”
“একটু তাড়াতাড়ি আসুন ভাইয়া।”
“বাইক নিয়ে আসব তো, বেশি সময় লাগবে না। ওয়েট করো তুমি।”
“আচ্ছা। আর শুনুন, তাজ ভাই ফোন করলে কিছু বলবেন না আমার ব্যাপারে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। রাখছি।”
শ্রেয়ান ভাইয়া ফোন কেটে দিলেন। আমি ফুটপাতের কিনারায় চুপ মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম ওনার পথ চেয়ে। ভেবে নিলাম শ্রেয়ান ভাইয়া এলেই ফোনটা বন্ধ করে দিব। জানি, শ্রেয়ান ভাইয়াকে বারণ করলে উনি কাউকে বলবেন না আমার কথা। তারপর যত ইচ্ছা খুঁজুক। খুঁজতে-খুঁজতে পাগল হয়ে যাক। আমার কী? বিয়ে দিবে, তাই না? বিয়ে দেওয়ার শখ মিটে যাক। একবার শিক্ষা দিলে জীবনে আর কোনোদিন বিয়ের নাম নিবে না। আমাকে কাঁদানোর ফল এবার হারে হারে টের পাবেন ডিটেকটিভ সাহেব।

চলবে………………🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৪৩

“ইলোমিলো, ফোনটা দিবে প্লিজ?”
শ্রেয়ান ভাইয়ার অনুরোধ শুনে আমি মুখ তুলে তাকালাম। অতঃপর দাঁত কেলিয়ে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললাম,
“আমি গেমস খেলছি ভাইয়া।”
শ্রেয়ান ভাইয়া হতাশ গলায় বললেন,
“এতক্ষণে ওদিকে হুলস্থূল কাণ্ড বেঁধে গেছে। পাগল না হলেই হয় কেউ।”
আমি গেমসে মনোযোগ দিয়ে বললাম,
“আপনার জানেজিগার বন্ধু পাগল হলেই বাঁচি ভাইয়া। দোআ করুন।”
“তুমি ফোন দিবেই না?”
“না।”
“আমি কিন্তু মায়ের ফোন থেকে কল করব গিয়ে।”
“নাম্বার মুখস্থ আছে?”
এবার শ্রেয়ান ভাইয়া চুপ মেরে গেলেন। আমি ওনার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম উনি হতাশ চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মিনিট খানেক পর রুমের দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন,
“কী আর করা? থাকো, আমি আসছি এক্ষুনি।”
আমি মৃদু হাসলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে ওনার বাড়ি নিয়ে এসেছে। বাড়িতে শুধু ওনার বয়স্ক বাবা-মা। তারা আমাকে দেখে দারুণ খুশি হয়েছেন। ওনারা তাজ ভাই আর বাবাকে ভালোভাবেই চেনেন। তবে আমি অবাক হয়েছি এটা দেখে যে, আমাকে বাড়িতে আনা সত্ত্বেও শ্রেয়ান ভাইয়াকে ওনারা কিছু জিজ্ঞেসও করলেন না। একটা মেয়েকে বাড়িতে আনার কারণ তো অন্তত জিজ্ঞেস করবেন। ধারণা করলাম, হয়তো শ্রেয়ান ভাইয়া আগেই কিছু একটা বলে রেখেছেন। এখানে আসার পর আমার মন অনেক খারাপ ছিল। শ্রেয়ান ভাইয়ার মা আমার সাথে অনেক গল্প করেছেন। এমনকি আমাকে তাদের বাড়িটাও ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। এসে হতে কাজের মেয়েকে দিয়ে একটার পর একটা খাবার এনে সামনে উপস্থিত করছেন। আমার কোনো বারণই শুনছেন না। এখানে যখন এসেছিলাম তখন ছিল বিকাল, আর এখন সন্ধ্যার শুরু। শ্রেয়ান ভাইয়ার রুমে বসিয়ে উনি আমাকে অনেক কথা বুঝিয়ে বললেন। এদের মা-ছেলের পাল্লায় পড়ে মন খারাপ কর্পূরের মতো উবে গেছে। এখানে আসার আগেই আমি আমার ফোন সুইচ অফ করে রেখেছি। এসে হতে তাজ ভাই শ্রেয়ান ভাইয়াকে বারবার কল করে চলেছে। শ্রেয়ান ভাইয়া তিনবার রিসিভ করেছিলেন। তাজ ভাই আমার খোঁজ করতেই ওনাকে কল করেছিলেন। শ্রেয়ান ফোন লাউড স্পিকারে রাখায় তাজ ভাইয়ের উত্তেজিত কন্ঠ শুনে বেশ বুঝতে পেরেজি ওনার বর্তমান অবস্থা। মজাই পেয়েছি, এই শিক্ষাটারই দরকার ছিল ওনার। শ্রেয়ান ভাইয়াকে বাইরে বেরোনোর জন্য তাজ ভাই বারবার কল করেছেন। যতদূর বুঝেছি, শ্রেয়ান ভাইয়া বেশিক্ষণ মিথ্যা কথা টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। তাই হুট করে ওনার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছি। আমাকে যাদের দেখতে আসার কথা, তারা কি এসেছেন? এলে বেচারারা পেঁচার মতো মুখ করে বাড়ি ফিরে যাবে। আমি ফোন রেখে শ্রেয়ান ভাইয়ার বিছানার মুখোমুখি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলাম। রামিশা আপুর বড়ো একটা ছবি ঝুলানো। কী সুন্দর হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত ছবি! নিঃসন্দেহে সে আমার থেকে হাজার গুণ বেশি সুন্দরী। এই মেয়েটার জন্য আজো একটা মানুষ নীরবে চোখের পানি ফেলে, অথচ সে জানেই না। শ্রেয়ান ভাইয়ার ভাষ্যমতে সে রামিশা আপুকে সবসময় অনুভব করে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আর সকালে ঘুম থেকে উঠে রামিশা আপুর মুখ দর্শণের জন্যই তার ছবি বিছানার মুখোমুখি টাঙানো। বলতে গেলে তার রাতের শেষ এবং সকালের শুরুটাও হয় রামিশা আপুকে ভেবে। অথচ এই মেয়েটা হয়তো রাতে স্বামীর বুকে গুটিসুটি মেরে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে, আর সকালে উঠে স্বামীর উষ্ণ চুম্বনে অতীতকে ভাবার আর সময় হয়ে ওঠে না। হয়তো একটা অপূর্ণতা সে-ও মাঝে মাঝে টের পায়। তবে তা তার ব্যস্ত জীবনের তলে পিষ্ট হতেও এক মুহূর্ত সময় লাগে না।
রামিশা আপুকে নিয়ে ভাবতে-ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টেরও পাইনি।
ঘুম ভাঙল শরীরে ঝাঁকুনি অনুভব হতেই। হুট করে চোখ খুলে আমি ধড়পড়িয়ে সোজা হয়ে বসলাম। কিন্তু একি! চোখের সামনে এক ঝাঁক গাড়ি দেখা যাচ্ছে। তার মানে এটা রাস্তা, আর আমি এখন গাড়িতে বসে আছি। জ্যামে আটকে আছি বোধ হয়। ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে অবাক কন্ঠে বললাম,
“আপনি!”
তাজ ভাইয়ের কটমট দৃষ্টি তখন আমার মুখের ওপর নিবদ্ধ। মনে হচ্ছে এখনই আমাকে টপ করে মুঠোয় চেপে ধরে, টুপ করে গিলে ফেলবেন। ওনাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। উনি এসবই করতে পারবেন। হঠাৎ তাজ ভাইয়ের কান্ডে আমি ভীষণভাবে হকচকিয়ে উঠলাম। উনি ঝুঁকে এসে এক হাতে আমার গলা টিপে ধরলেন। বলা বাহুল্য উনি কষে নয়, আস্তেই ধরেছেন। আমি ব্যথা না পেলেও ওনার হাত সরানোর চেষ্টা করলাম। উনি আমার হাতও নিজের অপর হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলেন। অতঃপর চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন,
“এত বড়ো সাহস কে দিয়েছে তোকে? কাউকে না বলে একা-একা বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে এটা মাথায় আসেনি যে, পথে কোনো বিপদ হতে পারে? আবার বাসার সবাই খুঁজে-খুঁজে হয়রান হবে? আমার কথা না হয় না ভাবলি, কিন্তু মামু? তার কথা মুন্ডুতে ছিল না? মাথামোটা। তোকে কোথায়-কোথায় খুঁজেছি ধারণা আছে তোর? সত্যি সত্যিই যদি কোনো বিপদ হয়ে যেত। তখন? নিজেও মরবি, অন্যকেও মারবি?”
এ পর্যায়ে এসে আমি তেতে উঠলাম। ঝাঁজালো গলায় বললাম,
“কে মরবে আমার জন্য? আমি মরলে তো খুশি হওয়ার কথা। কারো পথের কাঁটা সরে যাবে। বেঁচে থেকে মরার থেকে, সত্যিকারের মৃত্যু ভালো। তাছাড়াও, আমি মরি, বাঁচি, বিপদে পড়ি, তাতে আপনার কী? এসবে মাথা ঘামানোর আপনি কে? আমাকে শাসন করার অধিকারই বা আপনাকে কে দিয়েছে?”
তাজ ভাইয়ের হাতের বাঁধন আপনা-আপনি আলগা হয়ে গেল। হাত সরিয়ে নিয়ে উনি বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইতোমধ্যেই আমার দুচোখে বর্ষণ হানা দিয়েছে। ক্ষোভে, দুঃখে আমি ওনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে ব্যস্ত হলাম। মিনিট দুয়েক পরেই জ্যাম থেকে নিস্তার মেলল। বাকিটা রাস্তা আর তাজ তাজ ভাই আমার সাথে কথা বলা তো দূর, ফিরেও তাকালেন না। থমথমে মুখে চুপচাপ ড্রাইভ করেছেন। বাড়িতে ঢুকেই আমি বাবার মুখোমুখি হলাম। সঙ্গে বাকি সবাইও ছিল। আমি মাথা নিচু করে বাবার ধমকের অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু আমার ধারণার কিছুই সত্যি হলো না। বরং বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। থমথমে কাঁপা গলায় বলল,
“এমন কাজ কেউ করে বোকা মেয়ে? আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানিস? বিয়েতে অমত থাকলে তো তুই আমাকে তা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেই পারতি। অযথা অভিমান করে এভাবে একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলি কীভাবে? যদি কোনো বিপদে পড়তি?”
আমি ফুঁপিয়ে উঠে বাবাকে আঁকড়ে ধরলাম। কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,
“সরি বাবা।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। কাঁদতে হবে না। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে, যা।”
বাবা আমাকে ছেড়ে দিতেই আমি সোজা রুমে চলে এলাম। আশেপাশের আর কারোর দিকে তাকালামও না। রুমে ঢুকে বিছানায় বসতেই জেমি দৌড়ে এসে এক লাফে আমার কোলে চড়ে বসল। দীর্ঘক্ষণ আমাকে না দেখায় আমার গালে গাল ঘষতে লাগল। আমি মৃদু হেসে ওকে আদর করলাম। শ্রেয়ান ভাইয়ার রুম থেকে আমি কী করে তাজ ভাইয়ের গাড়িতে চলে গেলাম তা নিয়ে ভাবনা পেতে বসলাম। আমি ঘুমানোর পর কি শ্রেয়ান ভাইয়া তাজ ভাইকে ফোন করেছিল? হতেও পারে। নইলে তাজ ভাই জানল কীভাবে আমি ওখানে ছিলাম? এবার শ্রেয়ান ভাইয়ার ওপরও অভিমান জমা হলো। ওনাকে বারণ করা সত্ত্বেও উনি কেন তাজ ভাইকে বলে দিলেন? গাল ফুলিয়ে নড়েচড়ে বসতেই হঠাৎ কানে এল বাবার রাগত কন্ঠ। বাবা তো কখনও বাড়িতে এভাবে রাগারাগী করে না। তাহলে? দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার পরপরই মনে মনে বেশ খুশি হলাম। কারণ বাবা তাজ ভাইকে বকছেন। সবসময় নির্দয়ের মতো শুধু আমাকেই ধমকে যায়। এবার নিজেও ভুক্তভোগী। একদম ঠিক হয়েছে, বুঝুক মজা। খুশিমনে আমি নাচতে-নাচতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলাম জেনিফার ভাবি গোমড়া মুখে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখেই সে গাল ফুলিয়ে ঠান্ডা গলায় কয়েকটা বকা দিয়ে বসল। মূলত আমার কান্ডের জন্য বাড়ির সবার হয়রানি, আর বিশেষ করে তাজ ভাই বাবার কাছে বকা শুনেছে বলে সে আমার ওপর অসন্তুষ্ট। তার প্রাণের দেবর বলে কথা। তার ভাষ্যমতে তাজ ভাই পাগলের মতো এখানে-ওখানে ছোটাছুটি করেছে আমাকে খোঁজার জন্য। এতকিছুর পরও সেই ওনাকেই কেন বকা শুনতে হলো? আমি কেন ইচ্ছে করে এমন একটা কান্ড বাঁধালাম? আমি জানি জেনিফার ভাবি তাজ ভাইকে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। তাই হয়তো তাজ ভাই বকা শোনায় তার খারাপ লেগেছে। সেজন্য আমি চুপ মেরে তার কথা শুনে গেলাম। টু শব্দটি পর্যন্ত করলাম না। জেনিফার ভাবি চলে যেতেই আমি ধপাস করে বিছানায় সটান শুয়ে পড়লাম। স্বস্তি আর মিলল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই মহারাজ তাজওয়ার তার চাঁদপানা মুখ নিয়ে সম্মুখে উপস্থিত হলেন। তার হাতে একটা ছোটো প্যাকেট। দেখে মনে হচ্ছে খাবারের প্যাকেট। আমি এক পলক দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অপর দিক ঘুরে কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম, যেন ওনাকে দেখিইনি। তাজ ভাই গম্ভীর গলায় বললেন,
“শ্রেয়ান এগুলো দিয়েছে। খেয়ে নে।”
আমি ওনার দিকে না তাকিয়েই ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আবার ওনার কাছে কী খাবার দিয়েছেন? তাজ ভাই পুনরায় বললেন,
“উঠছিস না কেন? তোর অখাদ্য ফুসকা দিয়েছে।”
ফুসকার কথা শুনে জিবে জল আসার উপক্রম হলো। কিন্তু আমি তো আজ ওনার দিকে ফিরেও তাকাব না, কিছুতেই না। বস্তা ভর্তি ফুসকা আনলেও না। তাজ ভাই বার কয়েক ঠান্ডা গলায় ডাকল; তবু আমি কোনো রকম সাড়া দিলাম না। ওপাশ ফিরে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। শেষমেষ উনি অধৈর্য হয়ে আমার বাঁ হাতের কব্জি চেপে ধরে টেনে তুলে বসিয়ে দিলেন। বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“সমস্যা কী তোর? ঢং শুরু করেছিস? আমাকে তোর সার্ভেন্ট মনে হয়?”
এবার আমি বাঁকা চোখে তাকিয়ে কৌতুক করে বললাম,
“যেচে সার্ভেন্ট হলে আর তাকে কী বলা যায়?”
তাজ ভাই বাজেভাবে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। ঠান্ডা গম্ভীর গলায় বললেন,
“তুই কিন্তু বড্ড বেশি কথা বলা শিখেছিস ইলু।”
“আপনিই তো বলেছিলেন ধীরে ধীরে আপনার থেকে অনেক কিছু শিখব। তারই সামান্য বাস্তবায়ন মাত্র।”
তাজ ভাই মুখ দিয়ে ‘চ’ সূচক বিরক্তিকর শব্দ তুললেন। তারপর ফুসকার প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে ধরে বললেন,
“এটা নে আগে।”
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
“খাব না।”
“কেন?”
“ইচ্ছে নেই?”
“ইচ্ছে নেই কেন?”
“ইচ্ছে না থাকারও কারণ লাগবে? আশ্চর্য! আমার খেতে ইচ্ছে করছে না তাই খাব না, ব্যস।”
“তো এগুলো কী করব?”
“জানি না।”
“শিওর?”
আমি এবার কোনো উত্তর দিলাম না। তাজ ভাই পকেট থেকে আমার ফোনটা বের করে কোলের ওপর ফেললেন। এতক্ষণ ফোনের কথা মনেই ছিল না আমার। তারপর উনি ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও আবার কী মনে করে পিছিয়ে এলেন। ফুসকার প্যাকেটটা বিছানায় রেখেই হনহন করে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। উনি চলে গেছেন নিশ্চিত হতেই আমি দ্রুত গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। উৎফুল্ল মনে ফুসকার প্যাকেট খুলে বসলাম। ফোনটা পাওয়ার অন করে শ্রেয়ান ভাইয়াকে কল করলাম। ফোনটা কানে চেপে ধরে ফুসকা মুখে পুরতে লাগলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতেই আমি গাল ফুলিয়ে অভিমানী সুরে বললাম,
“আপনি আমার কথা রাখলেন না ভাইয়া।”
শ্রেয়ান ভাইয়া কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন,
“আমি আবার কী করলাম ইলোমিলো? তুমি আমার ওপর রেগে আছো কেন?”
“আপনি তাজ ভাইকে বললেন কেন আমার কথা?”
“আমি তো বলিনি। ও নিজেই এসেছে।”
আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,
“মানে?”
“ইলোমিলো, তোমার আজকের কাজটা সত্যিই ঠিক ছিল না। আঙ্কেল খুব বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। আর তাজ যখন এসেছিল, তখন ওর অবস্থা আমি দেখেছি। চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। তোমার সব বান্ধবীদের বাসায় পর্যন্ত পাগলের মতো খুঁজেছে। ও নিজেও আজ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মুখ দেখে মনে হয়েছিল এখনই বুঝি কেঁদে ফেলবে। আমার ফোন বন্ধ পেয়েই ওর মনে সন্দেহ জেগেছিল। তাই সোজা আমার বাড়িতে চলে এসেছিল। বাড়িতে ঢুকেই তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল, তখন ওর অবস্থা দেখে আর আমি মিথ্যে বলতে পারিনি। ঘুমন্ত অবস্থাতেই তোমায় কোলে তুলে নিয়ে গেছে।”
কথাটা শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখে শুনে আমি ইতস্তত বোধ করলাম। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে নড়েচড়ে বসলাম। শয়তান লোকটা আবার আমাকে কোলে তুলেছে, ভাবতেই মেজাজ চটে গেল। মেজাজকে পাত্তা না দিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়াকে প্রশ্ন করলাম,
“আপনি এই ফুসকা কখন দিলেন?”
“তাজ আসার আগেই আমি বাইরে থেকে ফুসকা এনেছিলাম তোমার জন্য। তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে বলে আর জাগাইনি। তোমাকে নিয়ে যাচ্ছিল তাই তাজের কাছেই দিয়ে দিয়েছিলাম। প্রথমে নিতে চাচ্ছিল না, জোর করে ধরিয়ে দিয়েছিলাম।”
আমি দাঁত কেলিয়ে হেসে বললাম,
“এই কাজটা ভালো করেছেন ভাইয়া। থ্যাংক ইউ।”
শ্রেয়ান ভাইয়া মৃদু শব্দ তুলে হাসলেন। পর মুহূর্তেই বললেন,
“তাজকে না কি আঙ্কেল বকেছে?”
“বাহ্! এটুকু সময়ের মধ্যে এই খবরও পাচার হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, তাজের মনটা একটু খারাপ হয়েছে। আঙ্কেল না কি আজই প্রথম ওকে এভাবে বকেছে।”
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
“ভালো হয়েছে, উচিত শিক্ষা। বেশি বাড়াবাড়ি করতে গিয়েছিল কেন?”
“আচ্ছা ঠিক আছে, বাদ দাও। কী করছো তুমি?”
“ফুসকা খাচ্ছি।”
“আচ্ছা খাও তাহলে। পরে কথা হবে। তাজ আবার কল করছে।”
“আপনার সাথে দুঃখ বিলাস করবে”, হেসে বললাম আমি।
শ্রেয়ান ভাইয়াও হেসে বললেন,
“তুমি আসলেই খুব পাজি হয়ে গেছো ইলোমিলো। রাখছি, বাই।”
আমি ‘বাই’ বলার সঙ্গেই ওপাশ থেকে ফোন কেটে দেওয়ার শব্দ ভেসে এলো। আমি ফোন রেখে ফুসকা খেতে-খেতে দারুণ এক ফন্দি আঁটলাম। তা হচ্ছে, তাজ ভাই আজ ডিনারের সময় আমাকে ডাকতে-ডাকতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকলেও, আমি দরজা খুলব না। উনি যেন ভালোভাবে বুঝতে পারেন আমি এখনও ওনার ওপর রেগে আছি। নিজের রাগ বুঝানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস এটা। আমার এই ফন্দির বিশেষ সুযোগ হচ্ছে, সত্যি সত্যিই আজ আমি ডিনার করব না। কারণ এতগুলো ফুসকা খেয়ে পেট ভর্তি হয়ে গেছে। ভরা পেটেই না খেয়ে থাকার নাটক করব। নিজের প্ল্যান মতোই কাজ করলাম। ডিনারের সময় রাজ ভাইয়া আর তাজ ভাই পরপর এসে দরজায় টোকা মেরে ডেকে গেছেন। আমি গলাটা যথাসম্ভব থমথমে করে এক কথায় বলে দিয়েছি, খাবো না।
তবু তাজ ভাই অনেকবার ডেকে গেছেন। কিন্তু আজ আমার মাথায় জেদ চেপে বসেছে। উনি এটাও বললেন, আমি যেন অন্তত ফুসকাটুকু খাই। তাতেও আমার উত্তর ছিল ‘খাবো না।” অথচ ততক্ষণে ফুসকার শূন্য প্যাকেট আমার সামনে পড়ে আছে। যত যা-ই হোক, আমি ওনাকে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়ব আমি ওনার ওপর রেগেমেগে না খেয়ে আছি।

চলবে………………🍁