দুই_পৃথিবী পর্ব-০৪

0
1116

#দুই_পৃথিবী
#লেখিকা-রিতু
#পর্ব-৪
আজ স্নেহাদের বাড়ির অবস্থা খুবই অস্বাভাবিক।বাকি দিন গুলোর মত আজ বাড়িটা নিরব না।হই হুল্লোড়ে মুখরিত হয়ে আছে বাড়িটা।কারণ আজ স্নেহার বিয়ে।হঠাৎ করেই আনিস সাহেব আজ দুপুরে বাড়ি এল।স্নেহা বাবাকে এই ভর দুপুরে দেখে জানতে চাইলো
-শরীর টরীল খারাপ হলো নাকি বাবা?
আনিস সাহেব বারান্দায় বসতে বসতে বললো
-না মা।আমার কাছে একটু এসে বয় তো।
স্নেহা বাবার পাশে বসে বললো
-এই তো বসলাম।
-একটা কথা জানার ছিল।
-কি কথা বাবা?
-তোর কি পছন্দের কেউ আছে মা?
-কেন বলো তো বাবা?
আনিস ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলো
-তুই তো জানিশ তোর মা কে তোর নানা জোড় করে আমার সাথে বিয়ে দিয়েছিল।আর এটা ছিল আমার অজানা।কিন্তু বিয়ের কিছুদিন এর মাথায় আমি জানতে পারলাম তোর মা অন্য একজন কে ভালবাসে।তখন তুই তোর মায়ের পেটে।না পারছিলাম কিছু বলতে না পারছিলাম সহ্য করতে।তবুও তোর নানা কথা শুনে চুপ থাকলাম।উনি বলেছিল ধৈর্য ধরতে,সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক ঠাক হয়ে যাবে।কিন্তু কিছুই পড়ে আর ঠিক হলো নাহ।চলেই গেল সে আমাদের ফেলে।
-এসব কথা বলছো কেন বাবা?
-আমি চাই মুহিব যেন আমার পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে না যায়।তাই আগেই জিজ্ঞাসা করে নিলাম।
-কিন্তু এখানে মুহিব ভাই আসবে কিভাবে!
-মা আমি তোর সাথে মুহিবের বিয়ে দিতে চাই।আমার শরীর ভালো না।মরার আগে একটা গতি করে যেতে চাই তোর।তোর আপত্তি আছে মা?
স্নেহা খানিকক্ষণ সময় চুপ করে থাকলো।তারপর অস্পষ্ট গলায় বাবা কে বললো
-আমার কোন আপত্তি নেই বাবা।

বিয়েটা বেশ ঘরোয়া ভাবেই হবে।সন্ধ্যা ৭ টার মাঝে মুহিবরা চলে এল স্নেহাদের বাড়ি।বরযাত্রী হিসেবে এসেছে মুহিবের সাথে মুহিবের মা,বড় বোন মুন্নি আর তার বর।রাকিন আর কিছু বন্ধু বান্ধব।মুহিব এসেই আনিস সাহেবের পা ধরে সালাম করে বললো
-ভালো আছেন ফুপাজি?
-হ্যা।আল্লাহ রাখছে।তুমি বসো।আমি একটু ওদিক টা দেখে আসি।
বলেই আনিস সাহেব চলে গেল।রাকিন মুহিবের কাধে হাত রেখে বললো
-শালা,কাম তো সাইরা ফেললি।
-আসতে বল।
-ট্রিট কিন্তু মামা কালই দিবা।
মুহিব বিরক্তের ভঙ্গিতে বললো
-আচ্ছা।
-আর রাতে কি কি করলা সব কাল এইচডি দেখাইবা।
বলেই চোখ মারল রাকিন।
বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে মুহিব রাকিন এর পাশ থেকে উঠে গেল।রাকিন হাসতে হাসতে বললো
-শালা,গালি দিবি নাহ।গালি দিলে তোর বিয়া হবে নাহ।আর বিয়া হইলেও বাচ্চা হবে নাহ।

৯ টার দিকে কাজি সাহেব উপস্থিত হল।কিন্তু এর মাঝেই স্নেহা কে নিয়ে সমস্যা তৈরি হলো বিয়ে বাড়িতে।

আফসানের সাথে স্নেহার পরিচয় হয়েছে ৪ মাস হলো।এই অল্প দিনেই কেন যেন মেয়েটাকে খুব আপন আপন লাগে আফসান এর।অবশ্য স্নেহার সাথে পরিচয়ের ৪ মাস হলেও আফসান তো ১ বছরের বেশি হলো চেনে স্নেহা কে।মেয়েটার সৌন্দর্যের কোন তুলনা হয় না।আল্লাহ তাকে কোন একটা খুত দিয়ে তাকে দুনিয়ায় পাঠায়নি।সব দিক দিয়ে একদম পার্ফেক্ট সে।কিন্তু একটা জিনিশ আফসান এই কয়েক মাসে ভালো করেই বুঝেছে যে ‘মেয়েটার মানুষিক দিক দিয়ে ফিট না।হঠাৎ করে কেমন কেমন কথা বলে ফেলে।’কিন্তু তারপরও আফসানের কিছু দূর্বলতা কাজ করে স্নেহার প্রতি।এটা কি ভালোবাসা!যদি এটা ভালোবাসা হয় তাহলেই বিপদ।আফসান সেদিন নাম্বার চাওয়ার পর স্নেহা ম্যাসেজ টা সিন করে এফবি থেকে চলে গিয়েছিল।টেনশনে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল আফসান তখন।কিন্তু তার ৩০ মিনিট পরই অনলাইনে এল স্নেহা।এসেই নাম্বার টা দিয়ে তাকে বললো
Sneha Sarkar-017389*****
১ মিনিট এর মাঝে কল দিবেন।নয় তো আর কখনওই ফোনে কথা বলবো নাহ?।
আফসান ম্যাসেজটা দেখে আনন্দে প্রায় আত্মহারা হয়ে যাচ্ছিল।কিন্তু পরক্ষণেই আবার ১ মিনিট কথা মনে হতেই তাড়াতাড়ি কল দিয়েছিল স্নেহা কে।সেদিন তারা ভোর ৫ টা পর্যন্ত ফোনে কথা বলেছিল।এরপর থেকেই নিত্যদিন ফোনে কথা বলা তাদের অভ্যাস হয়ে গেল।পুরো রাত জেগে জেগে কথা বলতে থাকলো তারা।
আফসানের সাথে আজ বিকেলে দেখা করার কথা ছিল স্নেহার।কিন্তু দুপুরে স্নেহা ফোন দিয়ে মানা করে দিয়েছে আফসান কে।তারপর থেকে আফসান নিম্নে ১০০ বার ফোন দিয়েছে স্নেহাকে।কিন্তু ফোন বন্ধ!”এভাবে এতক্ষণ ফোন বন্ধ করে রাখার মানে টা কি!কিন্তু স্নেহা যে ধরনের মেয়ে তার পক্ষে ফোন এতক্ষণ ধরে বন্ধ রাখা কোন কঠিন বিষয় নয়।”বলেই নিজের মন কে সান্তনা দেয় আফসান।

কাজি আসার পর স্নেহা কে নিয়ে আসা হলো ছাদে।ছাদে বর আর বউ বসানোর জন্য স্টেজ সাজানো হয়েছে।সেখানেই বসে বসে অপেক্ষা করছিল মুহিব স্নেহার জন্য।স্নেহা কে যখন নিয়ে আসা হলো তখন কিছুক্ষণ স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে রইল মুহিব স্নেহার দিকে।বধু বেসে স্নেহা কে যে অপরূপ লাগবে সেটা আগেই ভেবেছিল মুহিব।কিন্তু এতোটা অপরূপ লাগবে সেটা কল্পনা তেও ভাবে নি মুহিব।খয়েরি রঙের জামদানি,চুল গুলো খোঁপা করা হয়তো।মাথায় কাপড় থাকার কারণে দেখা যাচ্ছে না।কপালে টায়রা,নাকে নথ।আরো হাবিজাবি কি সব পড়ানো।এত কিছুর নাম জানে না মুহিব।তাই কি পড়ানো সেটায় মনোযোগ না দিয়ে মুহিব স্নেহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।এই সময় রাকিন এসে মুহিবকে বললো
-মামা মুখ চাপা।মশা ঢুকবো তোহ।
মুহিব তার কোঁকড়ানো চুল কপাল থেকে টেনে হালকা কিছু টা উপরে তুলে বললো
-আমি কি হা করে আছি নাকি!যাহ তোহ সামনে থেকে।
-যামুই তোহ।এখন তো আমাদের ভাল্লাগবো না।বউ পাইছো নাহ!বউরেই এখন খাও।
ঠিক সেই সময় স্নেহা উঁচু স্বরে বললো
-আমি এই বিয়ে করবো নাহ।
সবাই তার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো স্নেহার দিকে।আনিস মেয়ের দিকে এগিয়ে এসে বললো
-মা কোন সমস্যা?
-বাবা আমি বিয়ে করবো নাহ।
করুন গলায় আনিস বললো
-কেন মা?
-আমি তোমাকে একা রেখে মার মতো চলে যেতে পারবো নাহ।আমি এতটাও স্বার্থপর না।
-এটাকে আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া বলে নাহ।তুই তো আছিস ই।যখন ইচ্ছা হবে চলে আসবি।
-নাহ নাহ নাহ।আমি তোমাকে রেখে কোথাও যাব নাহ।আমি ঠিক তোমাকে কতোটা ভালবাসি তুমি জান না বাবা।মা চলে যাওয়ার পর তুমি কিভাবে নিজেকে সামলে নিয়েছ আমি দেখেছি।ছোট ছিলাম।কিন্তু আমি বুঝতাম বাবা।আমার কথা ভেবে তুমি বিয়েটাও করো নি।রাতে উঠে তুমি যে মার ছবি নিয়ে কাঁদো সেটাও আমার অজানা নয়।তখন আমি ছোট ছিলাম।আমাকে আকরে ধরেই বেচে ছিলে তুমি।আমি চলে গেলে তোমার কি হবে এটা খুব ভালোভাবেই জানি আমি বাবা।আর আমাকে জোড় করে যে কিছু হবে না সেটা তুমি জান।
আনিস সাহেব চোখে পানি।অনেক চেষ্টার পর ও আটকে রাখতে পারলেন না।আসলেই স্নেহার মা কে খুব ভালোবাসে সে।তাই হইতো তার জায়গায় আজ অন্য কাউকে নিয়ে সংসার শুরু করার কথা মাথাতেও আনে নি সে।আর স্নেহা যে বলছে এটাও মিথ্যে নয়।স্নেহা যাওয়ার পর এই বিশাল বাড়িতে একা একা থাকবে সে কি করে!একদিন দেখা যাবে দম বন্ধ হয়ে মরে পড়ে আছে এক কোনায় সে।কিন্তু তাই বলে তো স্নেহা কে সারাজীবন কাছে রাখতে পারবে না সে।মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে সে।পরের বাড়ি একদিন যেতেই হবে।
এতক্ষণ মুহিব হতভম্ব হয়ে শুনছিল সব কিছু।এ পর্যায়ে সে মুখ খুললো
-ফুপাজি স্নেহা ঠিকই বলেছে।
বলেই নিরব হয়ে বসে রইলো মুহিব।সবাইকে চুপ থাকতে দেখে স্নেহা মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললো
-মুহিব ভাই।তুমি চাইলে কিন্তু আমাদের বিয়েটা সম্ভব।
তীক্ষ্ণ চোখে মুহিব স্নেহার দিকে তাকালো।স্নেহা আবার বলতে শুরু করলো
-হ্যা।তুমি আজ আমাকে বিয়ে করে চলে যাও।আমি থাকবো আমার বাবার কাছে আর তুমি তোমার মার কাছে।মাঝে মাঝে আসতে চাইলে আসবে এখানে।
মুহিবের মুখ দেখে বোঝা গেল তার এই প্রস্তাব টা পছন্দ হয়েছে।কিন্তু মাঝখানে আবার ঝামেলা শুরু করলো মুহিবের মা মিতানুর।এমন বিয়ে সে করাবে নাহ।
একটাই ছেলে তার।আর তার ছেলের বৌ কে ঘরে না নিতে পারলে আর কিসের সুখ!কিন্তু মিতানুর কে মানাতেও বেশি সময় লাগলো না মুহিবের।আপাতত সবাই রাজি।রাত ১১ টার মাঝেই বিয়ে সম্পন্ন হলো মুহিব আর স্নেহার।তারা আজ থেকে স্বামী স্ত্রী।দীর্ঘজীবন একসাথে থাকার জন্য আজ তারা রাজি।পারবে কি তারা বাকিটা জীবন একসাথে দুজন দুজনার হাত ধরে বাকিটা পথ হাটতে!

রাতে মুহিব স্নেহাদের বাড়িতে থেকে গেল।আজ তার বাসর রাত।আর আজ নাকি সে তার বিয়ে করা বৌ তার নিজের সম্পত্তির থেকে দূরে থাকবে!প্রশ্নই উঠে না।কিন্তু এই থেকে যাওয়ার কাজ টাও করতে হলো তাকে অনেক পরিশ্রম করে।কারণ রাকিন।শালাটা এত্ত খারাপ।নিজে বিয়ে করে নি জন্য আর কেউ যে বউ এর সাথে থাকুক এই সুখ টা ওর সহ্য হচ্ছিল নাহ।সবার মাঝে বার বার ওকে নিয়ে যাবার কথা বলছিল।আর মুহিব ও মুখফুটে কিছু বলতে পারছিল নাহ।কিন্তু মনে মনে ঠিকই রাকিনের ১৪ গুষ্টি উদ্ধার করছিল মুহিব।কিন্তু মুহিবরা চলে আসার ঠিক আগ মুহূর্তে একটা মিরাকেল হলো।মুহিবের বোনের বর বেকে বসলো।সে নাকি আজ এ বাড়িতে থাকবে।শালার বিয়েতে কোলাদাড়া গিরি করবে নাহ এটা তো হয় না।শেষ মেশ ঠিক হলো মুহিব আর তার কোলদাড়া আজ এ বাড়িতে থাকবে।মুহিব বাসর ঘরে ঢুকবে এই সময় তার দুলাভাই এসে বললো
-শালক তোমার বাসর টা কিন্তু শুধু আমার জন্য হচ্ছে।
-হ্যা তা তো বটেই।
-সারাজীবন মনে রাখবা এটা।তোমাদের প্রথম মিলন আমি করাইছি।
বলেই প্রাণ খুলে হাসতে হাসতে চলে গেল সে।মুহিব মনে মনে বললো
‘আপনি তো বউ বিরহ বুঝবেনই।বিয়ের পর বউ ছাড়া থাকা আর লবণ ছাড়া তরকারি এক’।

বাসরঘরে অনেক্ষণ হলো বসে ছিল স্নেহা।মুহিব কে ঢুকতে দেখেই বললো
-তুমি এত দেরি করলা কেন?
মুহিব কিছু বললো নাহ।মুহিবের চুপ থাকা দেখে স্নেহা আবার বললো
-মুহিব ভাই??
মুহিব কিছুটা বিরক্তের সাথে বললো
-ভাই বলিস না তোহ।
-তোহ কি বলবো মুহিব ভাই?
-ভাই বলিস না।মুহিব করে বল।
-আরে!!তুমি এত বড়।আর তোমাকে আমি নাম ধরে ডাকবো!
-হ্যা।কারণ আমি এখন তোর বর।
-আচ্ছা তাহলে তো ডাকায় যায়।
মুহিব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।তারপর ইতস্তত করে বললো
-তোর হাত টা ধরতে পারি?
স্নেহা হাত টা এগিয়ে দিয়ে বললো
-পার।
মুহিব হাত টা ধরে কিছুক্ষণ বসে রইলো।স্নেহা মুহিবের হাতে একটা চিমটি কেটে বললো
-শুধু হাত ধরে বসে থাকলেই হবে?চুমু খেতে চাচ্ছ না কেন?
মুহিব কথা টা শুনে স্নেহার দিকে এগিয়ে আসতেই স্নেহা বললো
-মুহিব ভাই কাছে এস না।
মুহিব বিরক্ত চোখে স্নেহার দিকে তাকিয়ে বললো
-বললাম না ভাই বলবি নাহ।
-সরি মুহিব ভাই।কিন্তু একটা কথা কি জান?মেয়েরা প্রেম করার জন্য খোজে স্মার্ট ছেলে আর বিয়ের জন্য খোজে হাবাগোবা ধরনের এক ছেলে।তুমি কি বুঝতে পারছো আমি তোমাকে কাদের দলে ফেলেছি মুহিব ভাই?
বলেই খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো স্নেহা।আর পাশে মুহিব নামে ছেলেটি আসলেই হাবাগোবা হয়ে বসে আছে।তার মাথায় এখনো কিছু ঢুকছে না যে সে কোন দলের।
(চলবে)