পিচ্চি বউ পর্বঃ ১১

0
3150

পিচ্চি বউ।
পর্বঃ ১১

লেখাঃ রাইসার আব্বু।

আমি দরজাটা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে, বালিশে মুখটা লাগিয়ে কাঁদতে লাগলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, রাজ একটা ডাইরি দিয়ে গেছে। টেবিলের উপর থেকে ডাইরিটা তুলে বুকে জড়িয়ে নিলাম।

.

ডাইরিটা খুলতেই চমকে গেলাম,

.

“আমার এই হৃদয়ে লিখিলাম তোমারি নাম”

ডাইরির পরের পাতা উল্টাতেই,

.
ওগো হৃদয়রাঙিনী,

জানিনা কিভাবে শুরু করবো, আমি যে অনেক বড় অপরাধী! তোমার অবুঝ ভালবাসাকে অবহেলা করেছি। জানো যেদিন তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি, সেদিন বুঝেছি তুমি কতটা জুড়ে আমার জীবনে ছিল।

জানো, প্রতিদিন তোমার জন্য কেঁদেছি। মাঝরাতে উঠে আল্লাহর কাছে চাইতাম যেন, তোমাকে আমার করে দাও।
প্রতিরাতে তোমার ছবিটা বুকে নিয়ে ঘুমাতাম।
তোমার ছবি বুকে নিয়ে কাঁদতাম। জানো, মানুষ মারা গেলে নাকি তারা হয়ে যায়। তাই প্রতি সন্ধায় আকাশের তারাদের সাথে কথা বলতাম। বলতাম, যেন আমার হৃদয়রাঙিনীকে তারা যেন কষ্ট না দেয়। রাতের আকাশের সব চেয়ে উজ্জল তারাকে তুমি মনে করে, কাঁদতাম আর বলতাম, অভিমান ভেঙে এসো না, জড়িয়ে নাও না তোমাতে আমি যে আর পারছি না তোমার বিরহে। এসব বলে কাঁদতাম। কিন্তু তুমি এতটাই আমার প্রতি অভিমান করেছিলে, যার জন্য আমার সাথে কথা বলো না, শুধু করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে। সত্যি কি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না? জানো খুব ইচ্ছা করে তোমাকে এই মরুরবুকে জড়িয়ে নিয়ে, শান্ত করতে আমারি প্রাণ।

.

জানো আজ একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখে তোমার কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে। বাচ্চাটা দেখতে ঠিক তোমার মতই। আমি এতটাই হতভাগী নিজের বাচ্চাকে নিজের হাতে নষ্ট করেছি। জানো এখনো সেই রাতের কথাগুলো ভুলতে পারি না। তোমাকে দেওয়া প্রতিটা চড়ের আঘাত আমার কলিজাতে লেগেছে!

.

জানো পরের দিন যখন বাচ্চাটাকে ব্ল্যাড দিলাম, সেদিন মনে হয়েছে, আমার খুব কাছের কাউকে রক্ত দিচ্ছি।

.

বাচ্চাটার জন্মদিনে বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে নিতেই, তোমার শরীরের গন্ধ পেলাম। কিন্তু যখনি সিড়িতে তোমার মতোই কাউকে দেখলাম, তখন সত্যি ভেবে নিয়েছিলাম, আল্লাহ্ আমার ডাক শুনেছে। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন শুনেছিলাম, তুমি কথা নও, আমাকে চিনো না, তখন আমার কলিজাটা ফেঁটে যাচ্ছিলো। যখন রফিক সাহেব এসে হাত ধরল, আমার কাছে তখন মনে হয়েছিল, কেউ যেন কলিজাটা ধুমড়ে মুচড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে!

.

জানো তুমি নেও যেনেই নিজের অজান্তে পাগলামী করেছি। আর বাসায় এসে কেঁদে বুক ভাসিয়েছি! পরের দিন ঠিক করলাম, তোমার জন্য লেখা ডাইরিটা তানিয়া আপুকে দিয়ে তোমার কাছেই চলে আসবো,।

.

আমি যে আর পারছিনা, মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই! তোমাকে ছাড়া যে এখন আমার নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়, কষ্টটা আরো বেশি হয় যখন তোমারি মতো তানিয়া নামক মেয়েটা তাঁর স্বামীর হাত ধরে আমারি সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। জানো তখন বড্ড বেশি তোমার কথা মনে পড়ে। কি করবো, আমি তোমাকে ছাড়া আর যে বাঁচতে পারছি না। তোমাকে নিয়ে লেখা শেষ অবলম্বনটা তোমাকে মনে করে তানিয়া আপুকেই দিয়ে গেলাম। জানো খুব কষ্ট হচ্ছে লেখাগুলো লিখতে।

.

ডাইরিটা পড়তেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। আজকে কথার একটা মিথ্যার জন্যই রাজ মৃত্যুর কিনারায়। খুব কষ্ট হচ্ছে কথার, রাজের মুখটা বার বার কথার সামনে ভেসে ওঠছে। কথার কানে বার বার বাজছে, রাজের শেষ কথাগুলো।

.

হঠাৎ, বাহিরে কিছু ভাঙার শব্দ পেল!

.
কথা রুমের বাহিরে এসে দেখে,

রাইসা কাঁদছে, খাবারের প্লেট ফেলে দিয়েছে।

.

মা রাগ করে না, খেয়ে নাও!

.

আমাকে মা বলবে না, আমাকে বাবাই এর কাছে নিয়ে যাও! আর তুমি আমার বাবাইকে কষ্ট দিয়েছো, আমার সাথে কথা বলবে না।

.

প্লিজ রাইসা মা আমার, তোমার বাবার কিছুই হবে না, প্লিজ কান্না করো না! খেয়ে নাও। ( কান্না চেপে

.

আমাকে বাবাই এর কাছে নিয়ে যাও!
বাবাইকে না দেখে খাবো না।

.

হঠাৎ, সবুজ কে আসতে দেখেই কথা ভাইয়া বলে কেদে দিয়ে বলল” ভাইয়া রাজ বাঁচবেনা, রাজকে ছাড়া আমিও যে বাঁচবো না।

.
সবুজ কথাকে বুকে নিয়ে বলল, কান্না করিস না বোন, আল্লাহ তায়ালায় সব ঠিক করে দিবেন।

.
তোর কান্না যে দেখতে পারি না। মা – বাবাকে তো ছোটবেলায় হারিয়েছি। তানিয়াটাকেও প্রথম দেখাতেই হারিয়ে ফেলেছি। তুকে খুন করার জন্য, সাথী নামের মেয়েটা কন্টাক্ট করেছিল। তোকে খুন করতে এসে তোর গলার লকেট দেখেই চিনে ফেলি তুই আমার ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া বোন কথা । কিন্তু সেসময়, তানিয়াকে গাড়ির নিচে পিস্ট হতে দেখি। তোর চেহেরা তানিয়ার মতোই ছিল, তাই যখন দেখলাম, তানিয়া রাস্তায় পাশে পড়ে আছে, দৌঁড়ে বুকে টেনে নেই! সন্ত্রাসী ছিল, মানুষের রক্ত দেখলে হাসি পাইতো, কিন্তু যখন নিজের বোনটার রক্ত আমার শার্ট ভেজে যাচ্ছিল, তখন বুঝেছি, আপন মানুষদের রক্ত শুধু তাঁদের শরীর থেকে ঝড়ে না, অাপন মানুষটির কলিজা থেকেও ঝড়ে। তোকে আর তানিয়াকে পেয়ে, অন্ধকার রাস্তা থেকে সরে আসি।

.

তারপর রাজের বাবার প্ল্যান অনুযায়ী, তানিয়াকে কথা বানিয়ে রাজের বাড়িতে পাঠাই, আর রিচি পায় তাঁর মাকে।

.

রিচির বাবার রফিক ভাইয়ার সাথে সব প্ল্যান করি। কিন্তু এ জন্য যে রাজ আজকে মৃত্যুর মুখামুখি হবে, তা জানলে কখনো, এতটা মিথ্যার আশ্রয় নিতাম না!

.

হঠাৎ রাইসা দৌড়ে এসে, কথাকে জড়িয়ে ধরে বলল” মম চলো না বাবাই এর কাছে, আমার সাথে বাবাই কথা বলবে, তোমাদের সবার সাথে রাগ করে থাকলেও আমার সাথে বাবাই রাগ করে থাকতে পারবে না। বাবাই জানে আমার সাথে, অভিমান করলে, তাকে কান ধরে উঠবস করতে হবে!

.
কথাকে কিছু বলতে দেওয়ার আগেই রাইসা কথাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গাড়ি চালাতে বলল! কথা রাইসাকে নিয়ে হসপিটালে আসতেই, রাজের বাবার সাথে দেখা হয়।

.

মা’রে কেমন আছিস!

.

বাবা আমি সত্যি অনেক বড় অপরাধী হয়ে গেলাম। নিজের স্বামীকে কোন স্ত্রী এতটা কষ্ট দিতো না। বাবা সত্যি রাজকে ছাড়া বাঁচবো না।

অন্যদিকে রাইসা তার বাবার রুমে গিয়েই বলতে লাগল” ও বাবাই, বাবাই কেমন আছো তুমি?
কথা বলবে না আমার সাথে বাবাই? জানো বাবাই তোমাকে মম কষ্ট দিয়েছে বলে, মমের সাথে আড়ি দিয়েছি! ঠিক করেছি না বাবাই। বাবাই তুমি আমাকে বুকে নিবে না, আমাকে জড়িয়ে ধরে আম্মু ডাকবে না!

.

হঠাৎ একটা নার্স এসে বললো” মামনী এখানে কথা বলা যাবে না!

.
আপনি চুপ করেন তো, দেখছেন না? আমি আমার বাবাই এর সাথে কথা বলছি! কথা বলবেন না, বাবাই রাগ করবে ।

ও বাবাই তুমি জানো? মা তোমার জন্য কতো কান্না করে। তুমাকে আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি, মায়ের সাথে একটি ছবিতে। বাবাই স্কুলের সব মেয়েরা তাঁর বাবাই এর সাথে ঘুরে বেড়ায়। তাঁদের বাবাই, চকলেট আইসক্রিম কিনে দেয়, আমি এসব কিচ্ছু চাই না। তুমি কথা বলো বাবাই তাহলেই হবে। কথা বলছো না কেন? দেখছো না, তোমার রাইসা কাঁদছে। প্লিজ বাবা কথা বলো, আর চুপ করে থেকো না। আমাকে বুকে নাও, তোমার বুকে যেতে খুব খুব ইচ্ছে করছে। ও বাবাই এত্তো অভিমান কিসের তোমার। মা কাঁদছে বাবাই, বাবা মা তোমার জন্য রাতে কান্না করে। আমাকে বুকে নিয়ে তোমার নাম বলে ঘুমের ঘরেও কান্না করে। তুমি দেখো, দাদুভাই কাঁদছে। কথা বলবে না আমার সাথে? আমি কিচ্ছু খাইনি! তুমি খাইয়ে দিবে আমায়? তুমি খাইয়ে না দিলে আমি কিন্তু খাবো না । ও বাবা কথা বলছো না কেন? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বাবাই,আমার বুকের মাঝে ব্যাথা করছে বাবাই। কথা গুলো বলছে আর কাঁদছে।

.

এদিকে রাইসার কান্না দেখে, সবাই কাঁদছে। কথার কাছে মনে হচ্ছে, তাঁর কলিজাটা ফেঁটে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর রাজ কেমন জানি করতে লাগলো। ডাক্তার এসে দেখতেই রাজ কেমন যেন নড়াচাড়া বন্ধ করে দিল।

.

রুম থেকে বের হয়ে ডাক্তার চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, সরি!

” কথাটা শুনেই কথা হসপিটালে ফ্লরে পড়ে গেল।

চলবে”””””””””””