#প্রেমমানিশা(২৪)
আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে সকলে বাড়িতেই আছে। ছুটির দিন হওয়ায় যে যার যার মতো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। এমন কি চিরকাল রুটিন মেনে চলা সানাহ্ও। তার সবসময়ের রুটিন হলো ছুটির দিনে সে সকাল নয়টার আগে উঠবে না। সেটা মেনেই সে এখন গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাকিদের জন্য হলেও সেটা মিসেস কায়নাতের জন্য না। সাপ্তাহিক ছুটিতেও উনি বরাবরের মতো ভোরেই উঠেন। ভোরে উঠে সকলের জন্য নাস্তা তৈরি করেন।
আজ ফারহান আর মিসেস আশার ব্রেকফাস্টে আসার কথা বলেই মিসেস কায়নাতের চিন্তার অন্ত নেই। যতই বান্ধবী হোক তবুও তো হবু বেয়াইন। একটু মান মর্যাদা তো দিতেই হবে। এসব ভেবেই মিসেস কায়নাত আজ আয়োজন করেছেন হরেক রকমের খাবার। নাস্তায় সকলের জন্য কাচা আটার পরোটার পাশাপাশি চিকেন তন্দুরি করেছেন। সেই সঙ্গে মিষ্টি হিসেবে পায়েস তো আছেই।
সকালে সবাই এত অইলী খাবার খেলেও সানাহ্ সেটা খাওয়ার পাত্রী না। সে বরাবরই কম তেলে রান্না করা খাবার খায়। তাই সানার জন্য স্পেশালি চিকেন টাকোস করেছেন। টাকো সানাহ্ বেশ আগ্রহ নিয়েই খায়। বরাবরই পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি সানার আগ্রহ বেশি। নিজ গন্ডির মধ্যে থেকে যতটা নিজেকে পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে জড়ানো যায় ততটাই জড়ায় সে।
সানার ফিরে আসার পর আজই প্রথম একসঙ্গে ওরা সকলে খাবে। একসঙ্গে খাবার আয়োজন করার মূল কারণ হলো আজ সানাহ্ আর ফারহানের বিয়ে নিয়ে যাবতীয় প্ল্যানিং প্লটিং করা হবে। কাকে ইনভাইট করবে, কোথায় অনুষ্ঠান করবে, অনুষ্ঠানে মেনু কি কি থাকবে এগুলোই। তাছাড়া অনুষ্ঠানের জন্য সানাহ্ আর ফারহানের ড্রেসও বাছাই করতে হবে। অনেক কাজ পড়ে আছে। বিয়ে বাড়িতে কি কাজ কম থাকে ? তার উপর ওরা মেয়ে পক্ষ। খাটনি তো নেহাৎ কম নয়।
ফারহানদের বাড়িতেও তোরঝোর চলছে। মিসেস আশা রান্নাঘরে ব্যস্ত তার হবু ছেলের বউয়ের পছন্দের খাবার তৈরি করতে। আজ সানার জন্য উনি টরটিলা উইথ চিকেন স্টাফিং নিয়ে যাবেন। মেয়েটা চিকেন দিয়ে তৈরি সবই খেতে পছন্দ করে। তার মধ্যে টাকোস আর টরটিলা অন্যতম। এগুলো দেখলে সানাহ্কে খাওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না।
এইদিকে মিসেস আশা ব্যস্ত থাকলেও ফারহান বসেছে তার কলেজের কিসব কাগজপত্র নিয়ে। কাল থেকে এগুলোই করে যাচ্ছে। স্টুডেন্টদের এসাইনমেন্টের ওয়ার্ক পেপার দেখা চলছে। কাগজে সে চোখ বুলাচ্ছে ক্ষিপ্র গতিতে। মন তার বড্ড আনচান করছে। এতদিন কতকিছু ভেবে রেখেছিল যে সানাহ্ ফিরে এলে তাকে নিয়ে উইকেন্ডগুলোতে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু ঘুরা তো দূর কাল সকালের পর তাদের মধ্যে কোনো কথাই হয়নি।
সেই যে সানাহ্কে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে তারপর না আছে কোনো ম্যাসেজ, না আছে কোনো ফোন কল। এমন কি কলেজেও দেখা হয়নি দুজনের। অবশ্য ফারহান চেয়েছিল সানার সঙ্গে দেখা করতে কিন্তু খুজেই পায়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো সানাহ্ ক্লাস শেষ হতেই বেরিয়ে গেছে। ফারহানের আর বুঝতে বাকি রইলো না সানাহ্ তাকে ইচ্ছা করে ইগনোর করছে। রাগে দুঃখে ফারহানও আর আগ বাড়িয়ে কোনোকিছু করলো না। কেন সে কেন করবে ? সানার কি দায়িত্ত্ব ছিলনা ফারহানকে ফোন করে তার খোজ নেওয়ার ? সব দায়িত্ত্ব শুধু ফারহানই কেন করবে ?
মিসেস আশা মিনিট দশেক পর ফারহানকে বললেন ফারহান যেন রেডি হয়ে নেয়, উনি এখনই ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বের হবেন। ফারহান মিসেস আশার কথা শুনে মাথা নেড়ে সায় দিল কিন্তু জায়গা ছেড়ে উঠলো না। তার জানা আছে এখন তার মা এক ঘন্টা ধরে গোসল করবে তারপর রেডি হবে। ততক্ষণে ফারহানের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আর দুটো পেপার আছে।
সানাহ্ সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমেছে। বাড়িতে থাকায় একটা কালো হাটুর নিচ অব্দি টিশার্ট আর একটা ট্রাউজার পড়েছে। গায়ে জড়ানো আছে সাদা কালো মিনি স্কার্ফ। নিচে নেমে দেখলো নিচে কেউ নেই। রান্নাঘরে গিয়েও দেখলো কেউ নেই। একটু খুজাখুজি করে দেখলো তার জন্য টাকোস বানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বাকি সব তথাকথিত শাহী খানাও চোখে পড়ল। খাবারগুলো দেখে মুখ ভেংচি দিলো সানাহ্। ছিঃ সকাল সকাল এত অইলি খাবার কে খায়।
সানাহ্ তার প্লেটটা মাইক্রোওয়েভে দিয়ে খাবার একটু
করে নিলো। খাবার গরম হতেই মাইক্রোওয়েভ থেকে বের করে যখন খাবার ঘরের দিকে পা বাড়াবে তখনই মাথায় একটা প্রশ্ন এলো। এত সকাল সকাল কোন গেস্ট আসবে যে এত খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। বস্তুত সানাহ্ ফারহানদের আসার কথা জানে না। মিসেস কায়নাত ওকে বলেননি হুট করে চমকে দিবেন বলে।
যাক বাড়িতে গেস্ট আসলে তাতে সানার কি ? সানাহ্ থরী গেস্টদের অ্যাপায়ন করবে। তাই কে আসবে সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে কাজে লেগে যেতে হবে। আজকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন তাই নিজের ঘরটা পরিষ্কার করা দরকার। ঘর ঝাড়া, জানালা মোছা, ফার্নিচার ব্রাশ করা, ফ্যান মোছা আর ঘরটা ভালো করে লাইজল দিয়ে মোছা। আহ্ আজ অনেক কাজ। তাড়াতাড়ি কাজে লেগে না পড়লে এগুলো করতে করতেই বেলা পেরিয়ে যাবে।
ফারহানের মন আনচান। মন তার ছুটছে সানাহ্দের বাড়ির দিকে। কিন্তু মন ছুটলে কি হবে ? তার মা তো আর হাত চালাচ্ছে না। সে ধীর গতিতে কিসব খবর ঢোকাঢুকি করছে। আজব তো খাবার নেওয়ার কি আছে ? ওরা তো ওখানে খেতেই যাচ্ছে নাকি ?
অবশেষে মিসেস আশা যখন তার সব কাজ শেষ করে বাড়ির সদর দরজায় লক দিয়ে বের হলেন তখন ফারহানের কলিজায় পানি এলো। অপেক্ষা করতে করতে সে ক্লান্ত। মায়েরা সব কাজে এত সময় নেয় কেন ? সব জায়গায়ই কি খাবার গাট্টি বোঁচকা বেধে নিয়ে যেতে হবে ? একদিন না নিলে কি হয় ? ফারহান ভেবে পেলো না ।
মিসেস আশা যখন উনার জিনিসগুলো গাড়ির ব্যাক সিটে রেখে সামনে বসলেন তখন ফারহান বললো ‘ এতক্ষণ কি করছিলে মা ? তোমার হবু ছেলের বউয়ের পছন্দের খাবার বানাতে এত সময় লাগে ? কি এত বানাচ্ছিলে ? বিরিয়ানি করলে নাকি ? ‘
‘ নাহ্, সানার অইলী খাবার পছন্দ না। তাই ওর জন্য টরটিলা উইথ চিকেন স্টাফিং করেছি। যাই হোক এখন তাড়াতাড়ি হাত চালা…. পৌঁছতে হবে তো ‘
ফারহান আর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি আস্তে আস্তে বাড়ির চত্বর পেরিয়ে রাস্তায় উঠে এলো। সানার বাড়ি এখান থেকে গাড়িতে প্রায় দশ মিনিটের পথ। পথ নিতান্তই অল্প কিন্তু এই দশ মিনিটও যেন ফারহানের কাছে দশ বছর মনে হচ্ছে। এতটা আগ্রহ নিয়ে কখনও কোনো মেয়েকে দেখার জন্য অপেক্ষা করেনি। সানাহ্ ছাড়া আজ পর্যন্ত কারোর জন্য ফারহান এতটা যন্ত্রণাময় অনুভূতি হয়নি। করেনি কারোর প্রতি টান অনুভব। এমনকি রিয়াশা যখন কলেজ জীবনে প্রপোজ করেছিল তখনও না।
বসার ঘরে সকলে জড়ো হয়েছে। ফারহানরা এসেছে সবে দশ মিনিট পেরিয়েছে। মিসেস আশা আর মিসেস কায়নাত নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত। মিস্টার কবিরও ফারহানের সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু ফারহানের মন সেদিকে নেই। ফারহানের চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে বিদেশিনীকে। এসে থেকে একবারও নিচে নামেনি অথচ আন্টি বললেন সে নাকি বাড়িতেই আছে। তাহলে কি ফারহান এতটাই বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে যে তাকে দেখতে একবার নিচেও নামা যায় না ?
কথার মাঝেই মিস্টার কবির খেয়াল করলেন তার হবু জামাইয়ের চোখ শুধু এইদিক ঐদিকেই ঘুরঘুর করছে যেন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মিস্টার কবিরের হাসি পেলো, বেচারা এসে থেকে যাকে খুঁজছে সে তো জানেই না যে ফারহান এসেছে। মিস্টার কবিরের ফারহানের অবস্থা দেখে হাসি পেলেও অন্তর্দেশে একটা সূক্ষ্ম ভালো লাগা তৈরি হলো। যাক তার মেয়েটাও এত বছর পর আবার সুখের হাতছানি পেতে চলেছে।
‘ তুমি কিন্তু গিয়ে সানাহ্কে দেখে আসতে পারো। সিড়ি দিয়ে উঠে লাস্টের কামরা,টু দ্যা সাউথ সাইড ‘
ফারহান সানাহ্কে খুঁজতে ব্যস্ত থাকলেও ওর কানে মিস্টার কবিরের কথা ঠিকই ঢুকলো। কথাটা শুনে একটু লজ্জা পেলো সেই সঙ্গে অসস্তিতেও পড়ল। অসস্তি কাটানোর নিরন্তর চেষ্টা করে বললো ‘ না না…. না মানে আঙ্কেল ‘
‘ সমস্যা নেই…. তুমি যাও, আমি এখানে সামলে নিবো। আই থিঙ্ক সানাহ্ যদি জানত তুমি এসেছো তাহলে হয়তো এক আধবার নিচে ঢু মারলেও মারত। তুমি যাও আমি দেখছি ‘
মিস্টার কবিরের কথা শুনে সস্তি পেলো ফারহান। যাক বউ না বুঝলেও বউয়ের বাপ ঠিকই তার বেয়াড়া মনকে বুঝতে পেরেছে। মিস্টার কবিরের দিকে তাকিয়ে নিরুচ্চারে বললো ‘ হ্যাটস অফ টু ইউ শশুরজি ‘
প্রকাশ্যে কিছুই বললো না। শুধু একবার মিস্টার কবিরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মিসেস কায়নাত আর মিসেস আশাকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো। উনারা গল্প করতে ব্যস্ত। আর অতসী এখানে নেই। সে এখনও ঘুমোচ্ছে। এই একটা দিনই যা ছুটি পায় তাতে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়।
ঘর ঝেড়ে, জানালা মুছে এখন শুধু সানার ফ্যানটা মুছে ফার্নিচারগুলো মুছলেই হবে। এরপর লাইজল দিয়ে ঘরটা মুছে সে ফ্রী। এই কাজগুলো সানাহ্ প্রতি সপ্তাহেই করে। এছাড়াও প্রতিদিন ফার্নিচার মোছা তো আছেই। বাড়ি লোকালয় থেকে একটু দূরে হওয়ায় রোজ ফার্নিচার না মুছলেও চলে কিন্তু সানার খুঁতখুঁতে মন মানতে নারাজ। সে প্রতিদিনই ঘর টিপ অ্যান্ড টপ রাখবে। এটাই তার ন্যাচার।
হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দে সানার কাজে ব্যাঘাত ঘটলো। কাজে ব্যাঘাত ঘটায় সানাহ্ বিরক্ত হলো না। এটা জানা কথা উইকেন্ড আসলেই সবার মাথার পোকা নড়ে উঠে। ঐদিনই সবার সানার ঘরে আসার কথা মনে পড়ে। এমনিতে সানাহ্ বাড়ি না থাকলে বুয়া এসে ঘর পরিষ্কার করা ছাড়া কেউই সচরাচর ঘরে ঢুকে না। কিন্তু উইকেন্ড এলেই সকলে যত ইচ্ছা ঘরে উকি ঝুঁকি মারে।
স্পেশালি সানার মা। সানাহ্ বাড়ি থাকলে ঘরে উকি দেওয়া উনার স্বভাব। আর এতে সানার কিছু করার নেই। একদিন বলে একটু মুখ বুজে সহ্য করে নেয় কিন্তু যেদিন মেজাজ গরম থাকে সেদিন বাড়ির উপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে যায়। পুরো ঘর সানার চোখের আগুনেই যেন ভস্ম হয়ে যায়। সেইদিন নম্র, ভদ্র, সভ্য সানাহ্ও বাঘিনীর মত গর্জে উঠে। তবে আজ সানার মন এভারেজ। ভালোও না খারাপও না।
‘ কাম ইন প্লিজ…. ‘
সানার পারমিশন পেয়ে ঘরের দরজা খুলতেই সানাহ্কে দেখে চমকে গেলো ফারহান। চোখ দুটো বড় বড় রসগোল্লার আকার ধারণ করলো। ঘরে ঢুকেই যে সানাহ্কে এরকম অবস্থায় দেখবে ভাবেনি। ফারহান স্থানুর মত দাড়িয়ে আছে। তার চোখ সানার দিকে। ঘরের এসি বন্ধ করে কাজ করায় সানার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ঘরে চতুর দিকে শুধু পানির লীলাখেলা। রুমের অবস্থা যাচ্ছে তাই, একেবারে হুলুস্থুল বেজে আছে। হয়তো ঘর গোছাচ্ছে বলেই। বুক শেলফের সবগুলো বই নামানো।
সানাহ্ বিছানার তোষকের উপর মোড়া রেখে তার উপর দাড়িয়ে ফ্যান মুছছে। কাজে ব্যস্ত থাকা সানাহ্কে অপূর্ব দেখাচ্ছে। তার চুলগুলো উচুঁ করে খোঁপা করা আর মুখে একটু আধটু ঘরের ঝুল লেগে আছে। ফারহান এক দৃষ্টে সেই দৃশ্য দেখছে। এই সানাহ্কে দেখে ফারহান নিজ মনেই তাদের বিয়ে পরবর্তী সংসারের দৃশ্য সাজিয়ে ফেললো। যেখানে ফারহান সারাদিন পর ভার্সিটি থেকে আসবে আর সানাহ্ ওর জন্য ভালবেসে শরবত বানিয়ে আনবে। ফারহান সেই শরবত তৃপ্তি নিয়ে খাবে আর সানাহ্ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে। কী চমৎকার ভাবনা তাইনা ?
ঘরে আগত ব্যক্তির সাড়া শব্দ না পেয়ে এবার সানাহ্ চোখ তুলে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে স্ট্যাচুর মত দাড়িয়ে থাকা ফারহানকে নজরে পড়ল। হুট করে ফারহানকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে মোড়ার থেকে নামলো সানাহ্। ভাগ্যিস কাজ করবে বলে গায়ে বড় ওড়না জড়িয়েছিল যাতে শরীরে বেশি ময়লা না পড়লে। ওড়নাটাই আজ বাঁচিয়ে দিলো। কিন্তু এখন ফারহানকে মোটেই এক্সপেক্ট করেনি সানাহ্। ওর ঘরে চিরকালই ওর মা,বাবা আর অতসীর পদধূলি পড়েছে। আজ সেই নিয়ম ভেঙে যে ফারহানের চরণ পড়বে সেটা সানার কল্পনাতীত।
‘ আপনি ? ‘
হুট করে ফারহানকে দেখে অপ্রস্তুত সানাহ্ বললো। ফারহান সানার প্রশ্ন শুনে নিজেকে সামলে নিল। এগিয়ে গিয়ে সানার রুমের বিন ব্যাগে বসে বললো ‘ হুম আমি। তুমি তো এলেনা…. তাই আমারই আসতে হলো। তুমি কালকের পর থেকে এমন ব্যবহার করছো যেন আমাদের ঠিক হওয়া বিয়ে ভেঙে গেছে তাই তুমি আমাকে ইগনোর করছো যাতে অন্য কোনো ছেলেকে বিয়ে করতে পারো। ‘
কথাগুলো ফারহান রসিকতা করে বললেও সেগুলোর প্রভাব সানার উপর অন্য ভাবে পড়লো। সানাহ্ কথাগুলো সিরিয়াসলি নিয়ে কটমট চোখে ফারহানের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো ‘ তাহলে আমার মতো প্লে গার্লকে বিয়ে করছেন কেন ? দুনিয়ায় কি মেয়ের অভাব পড়েছে ? আমার থেকেও অনেক সুন্দরী মেয়ে পাবেন। ওদের বিয়ে করুন। একটা কেন দশটা বিয়ে করুন। এক বউকে নিয়ে সংসার করতে বোর হয়ে গেলে অন্য বউকে নিয়ে সংসার করবেন। ‘
‘ আরে আরে তুমি সিরিয়াসলি নিচ্ছো কেন ? আই ওয়াজ জোকিং। দেখলে এখনই তোমার মধ্যে বউ বউ ভাইবস আসছে। আমি একটা বললাম আর তুমি দশটা শুনালে। ভালো ভালো…. প্রগ্রেস ভালো হচ্ছে। এরপর বিয়ে হলে এভাবেই ঝগড়া করবে আমার সাথে। ঠিকাছে ? আইডিয়াটা ভালো না ? ‘ ফারহান দাত বের করে হাসতে হাসতে বললো।
সানাহ্ রেগে দাত কিরমির করতে করতে কাজে মন দিল সানাহ্। সানার রাগে গা জ্বলছে। ফারহানকে দেখলেই তার মনে পড়ছে ফারহান কিভাবে হেসে হেসে ওইদিন ওই রিয়াশা ফিয়াশার সঙ্গে কথা বলছিল। ফারহান সানাহ্কে এভাবে রাগতে দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠল আর সানাহ্ ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সানাহ্ বুঝে উঠতে পারছে না সে এমন কি বললো যে ফারহান হাসছে তাও এত জোরে। এরপর তো বেশি হাসলে ফারহানের পেট ব্যাথা করবে।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….
#প্রেমমানিশা(২৫)
সানাহ্ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। তার দৃষ্টি কিছুতেই সরছে না ফারহানের থেকে। ফারহানকে এভাবে ভিলেন মার্কা উচ্চহাসিতেও যে এত সুন্দর লাগবে সেটা সানার জানা ছিলনা। হাসতে হাসতে ফারহানের গালে টোল পড়েছে। সেই দৃশ্যও মারাত্মক নজরকাড়া। কতদিন এরকম কাউকে হাসতে দেখেনি। বাড়ির সকলে তো তার ভয়েই তটস্থ থাকে যার কারণে সামনে কেউ হাসেনা। কিন্তু এরকম হাসিও একজনকে অনেক বছর আগে হাসতে দেখেছিল সানাহ্।
সানার বাবাই আফজাল সাহেবও ঠিক এভাবেই হাসতেন। হাসলে গালে টোল পড়তো। কপালের রগগুলো ভেসে উঠতো। সানার বড় ভালো লাগতো সেই দৃশ্য। সানার মামণিও ঠিক এভাবেই সানার বাবাইকে হাসতে দেখে এক নজরে তাকিয়ে থাকতেন। যেন মিটিয়ে নিচ্ছেন তার সারাজীবনের তৃষ্ণা। আজ সানাহ্ও তার মায়ের দেখানো পথে হাঁটছে আর ফারহান সানার বাবাইয়ের পথে।
‘ আর কত হাসবেন কবি সাহেব ? এভাবে হাসলে তো পেট ব্যথা করবে । ‘ বলে সানাহ্ ওর হাতের ফ্যান মুছার কাপরটা রেখে বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে গেলো। ফারহানের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফারহানের সামনে দাঁড়ালো। ফারহান হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালো। ওর হাসি যেন থামতেই চাইছে না। সানাহ্কে রাগাতে
তার বেশ ভালো লাগে। রেগে গেলে সানার ফর্সা মুখ যেন লাল আপেলের মতো হয়ে যায়। তখন ফারহানের ইচ্ছা করে টুক করে সেই আপেল খেয়ে ফেলতে।
ফারহানকে থামানোর উপায় পাচ্ছে না সানাহ্। ফারহানের এরকম হাসাহাসি তার ভালো লাগছে না। ফারহানের ঝংকার তোলা হাসি তাকে আরও দূর্বল করছে। উপায় না পেয়ে সানাহ্ এবার এমন কিছু করলো যার পর ফারহানের হাসি আপনিতেই বন্ধ হয়ে গেলো।
ফারহানের বাম হাতের তালুতে এমন জোরে চিমটি কাটলো যে ব্যথায় ফারহানের হাসিই বন্ধ হয়ে গেলো। ফারহান ভাবেনি সানাহ্ হুট করে তাকে এভাবে চমকে দিবে। সানার কথা তাহলে ঠিকই। সে ঠিকই প্রতি নিয়ত ফারহানকে চমকে দিচ্ছে কিন্তু পার্থক্য এটাই যে সেটা চিঠি লিখে নয় নিজের উদ্ভট সব কাজকর্ম দিয়ে। ফারহান এবার সানার দিকে তাকালো। ফারহানকে চুপ করাতে পেরে বিজয়ের হাসি হাসছে সানাহ্।
সানার ঠোঁটের কোণে এই দুর্লভ,অপার্থিব আর প্রচ্ছন্ন হাসি আরেকবার ফারহানকে বাধ্য করলো সানার প্রেমে পড়তে। সর্বদা গম্ভীর ভাব ধরে রাখা চেহারায় ক্ষনিকের জন্য ফুটে উঠা হাসি যেন ফারহানের চোখে এক অদৃশ্য ঘোর তৈরি করলো। ফারহান এই ঘোরের মাঝে পড়ে আটকে রইলো সানার ওই দূর্লভ হাসির মাঝেই। মনের অজান্তেই সানার হাসি যেন ফারহানের মনে চিরদিনের জন্য জায়গা তৈরি করে নিলো। মনে সাধ জাগলো যদি সানাহ্ এভাবেই সবসময় হাসতো তাহলে কতই না ভালো হতো।
‘ আপনারা যে আসবেন কোথায় মা তো বললো না। ‘
আচমকা সানাহ্ তার চিরাচরিত সত্ত্বায় ফিরে এসে ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বললো কথাটা। সানার কথা শুনে ফারহানও তার কল্পনার দুনিয়া ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি টেনে আবারও বিন ব্যাগের উপর গিয়ে বসলো। এক পা আরেক পায়ের উপর রেখে বললো ‘ হয়তো আন্টি চাননি তুমি জানো যে আমরা আসছি। আই গেস আন্টি তোমাকে চমকে দিতে চাইছিল। তোমার মা তো তোমার মতোই হবে। চমকে দেওয়াতে ওস্তাদ। বাই দ্যা ওয়ে আমাদের আগের একটা গেট টুগেদার ডিউ ছিল তাই আজ ব্রেকফাস্টে ডেকে সেটা পুষিয়ে নিলো। ‘
‘ তাহলে তো ভালই। কিন্তু আপনারা যে শুধু দেখা করতে এসেছেন তাতো নয়। আমার মাকে আমি যতটুকু চিনি তাতে এইটুকু বলতে পারি যে সে নিশ্চয়ই আন্টির সঙ্গে কোনো জরুরি কথা ডিসকাস করবে। তাই হয়তো এভাবে ব্রেকফাস্টের নাম করে ডেকে এনেছে। মেবি আমার আর আপনার বিয়ে নিয়ে প্ল্যানিং করবে। ‘ সানাহ্ এবার ফ্যান মোছার ময়লা পানির বালতিটা বাথরুমে নিয়ে রাখলো। তারপর হাত দিল বইয়ের তাক গোছানোর কাজে।
সানাহ্ যখন তার অতি মূল্যবান বইগুলো তাকে রাখতে ব্যস্ত তখন ফারহান বললো ‘ বাহ্ তোমার গেসিং ট্যালেন্ট তো মারাত্মক। না জেনেই গেস করে নিলে। আসলে তুমি ঠিকই বলেছ। মা আর আন্টি মিলে আমাদের বিয়ের যাবতীয় যত প্ল্যানিং সব আজকেই সেরে নিবে যাতে পরবর্তীতে কাজ শুরু করতে পারে। যাই হোক বিবি সাহেবা এখন দয়া করে আপনি নিচে চলুন। আপনাকে খেতে ডাকা হয়েছে। ‘
ফারহানের প্রত্যেকটা কথা সানাহ্ কাজ করতে করতেই মনযোগ দিয়ে শুনল। ফারহানের কথা শুনে সরাসরি কোনো ভনিতা না করেই বলল ‘ আপনি মাকে বলে দিন আমি এখন যেতে পারবো না…. আমার অনেক কাজ আছে। তাছাড়া আমি তো খেয়েই নিয়েছি। বাকি রইলো কনে হিসেবে আপনাদের প্ল্যানিং অ্যাটেন্ড করা তাইতো ? হয়ে যাবে…. আমার আর একটু কাজ আছে। কাজ শেষ হলেই আসছি…. ‘
‘ তাহলে বলছো আমি যেন নিচে একা যাই তাইতো ? তোমাকে নিতে এলাম অথচ খালি হাতে ফিরবো ? এটা কি মানা যায় ? ‘ ফারহান মৃদু গলায় বললো।
‘ না মানার কিছু নেই। আমি তবুও খেয়েছি কিন্তু আপনি আর বাকিরা কিছুই খাননি। আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকার মানে হয় না। আমি যদি জানতাম আপনারা আসবেন তাহলে খেতাম না। মা তো বলেনি, তাই এই ডিজাস্টারটা হলো। ‘ সানাহ্ বই গোছাতে গোছাতেই ফারহানের দিকে তাকিয়ে এমন একটা ভাব করলো যেন সে এতকিছু জানলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
ফারহান বিনিময়ে কিছুই বললো না। উঠে এগিয়ে গেলো সানার দিকে। সানার হাত ধরে সানাহ্কে ঘরের আয়নার সামনে নিয়ে দাড় করালো ফারহান। সানাহ্ শুধুই অবাক হয়ে দেখছে তার কবি সাহেবের গতিবিধি।
এবার ফারহান আয়নার সামনে সানার পিছন থেকেই সানার ঠোঁটের নিচে নিজের আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরলো। ফারহানের এমন কাজে সানার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। ফারহানকে কিছু বলতে উদ্যত হয়েছিল কিন্তু তার আগেই ফারহান সানার ঠোঁটের নিচে নিজের স্পর্শ হালকা করে বললো ‘ আজ যেই ঠোঁটের নিচে শূন্যতা বিরাজ করছে সেই ঠোঁটের নিচেই একদিন হাসি থাকবে। তোমার অস্তিত্ব রেঙে উঠবে আমার গভীর ছোঁয়ায়। আমি অপেক্ষা করবো ততদিন যতদিন না তোমাকে একান্তই নিজের করে পাচ্ছি। তোমার এই শূন্য চুলে বিরাজ করবে আমার ভালোবেসে আনা বকুল ফুলের মালা। আমি অপেক্ষা করবো ততদিন যতদিন না তুমি আমায় তোমার অন্তর্দেশে লুকিয়ে থাকা গভীরতম অনুভূতিগুলো জানাচ্ছ। ‘
ব্যাস আর কিছু বললো না ফারহান। নিজেকে সানার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিলো। পা বাড়ালো ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। তবে কিছু একটা মনে পড়তেই সানার দিকে ফিরে তাকালো। আলতো হেসে বলল ‘ তাড়াতাড়ি এসো, প্রফেসর ফারহান ইজ ওয়েটিং ফর ইউ। ‘
কথাগুলো বলেই বেরিয়ে গেলো ফারহান। সানাহ্ এখনও ফারহানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। তার ঘুরে ফিরে সেই একই কথা বারবার মনে পড়ছে ‘ তাড়াতাড়ি এসো, প্রফেসর ফারহান ইজ ওয়েটিং ফর ইউ ‘ । আলাদা কিছু একটা ছিল এই কথায়। প্রবল ভালোবাসার অধিকারবোধ। সানাহ্ লম্বা দম নিয়ে ভাবলো ফারহান তবে এসেছে তার ভালোবাসার অধিকার নিয়ে।
ফারহান নিচে নামতেই এবার মিসেস আশা আর মিসেস কায়নাতের মুখোমুখি হলো। মিসেস আশা ইয়া বড় এক হাসি দিয়ে বললো ‘ হবু বউকে দেখতে গেছিলি বুঝি ? ‘
ফারহান ওর মায়ের কথায় অপ্রস্তুত হলো। তেজ দেখিয়ে কথাটা কাটাতে চেয়ে বললো ‘ আরে ধুর এসব কি বলছো। আমি সানাহ্কে দেখতে যাইনি। আঙ্কেল বলেছিলেন সানাহ্কে ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডেকে আনতে। আমি তাই গিয়েছিলাম ‘
‘ তো ডেকে আনলে ওকে ? ‘
এবার মিসেস কায়নাত পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। এক মুহূর্তের জন্য হবু শাশুড়ির এরকম গম্ভীর মুখ দেখে ঘাবড়ে গেছিলো ফারহান। কেন জানি মিসেস কায়নাতকে দেখলেই ওর গা টা ভয়ে ছমছম করে উঠে। অথচ ভাগ্যের কি লেখন দেখো। সেই মিসেস কায়নাতই ওর শাশুড়ি হতে চলেছেন।
ফারহান নিজেকে সামলে দৃঢ় কন্ঠে বলল ‘ গিয়েছিলাম ডাকতে কিন্তু ও তো কাজ করতে ব্যস্ত। ঘর পরিস্কার করছে সে। আমরা যে আসছি এটা ওকে জানাননি বলে সানাহ্ সকাল সকালই খেয়ে নিয়েছে। তাই বললো কাজ শেষ করে আসবে। ‘
‘ আল্লাহ্ ও খেলো কখন ? আমি তো সারাক্ষণ এখানেই ছিলাম। একবারও ওকে নিচে নামতে দেখলাম না। তুই রাগ করিস না আশা। আসলে আমারই দোষ। ওকে সারপ্রাইজ দিবো বলে জানাইনি যে তোরা আসছিস। ও জানলে কখনোই সবাইকে ফেলে খেত না। ‘ ফারহানের কথা শুনে ৪৪০ ভোল্টের শক খেয়ে কথাগুলো বললেন মিসেস কায়নাত।
‘ হয়তো তুমি যখন উপরে গিয়েছিলে তখন ও নিচে নেমেছিল আর ব্রেকফাস্ট রেডি দেখে খেয়ে নিয়েছে। দোষ তো তোমারই। তুমি জানতে না সানাহ্ প্রত্যেক উইকেন্ডে ঘুম থেকে উঠেই খেয়েদেয়ে নিজের ঘর পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে? ও যে সবসময় আমাদের সবার আগে খায় সেটাও তো তোমার জানা। তুমি যেহেতু ওকে বলনি যে আশারা আসছে সেহেতু এই ডিজাস্টারের দায়িত্ত্ব তোমার। আশা তুমি কিছু মনে করো না। দোষটা কায়নাতের, ও কাউকেই বলেনি যে তোমরা আসছো। আমিও তোমরা আসার পরই জানলাম। ‘ মিস্টার কবির এতক্ষণ দূরে দাড়িয়ে দুই বান্ধবী আর ফারহানের কথা শুনছিলেন। কিন্তু ফারহান আর মিসেস কায়নাতের কথোপকথন শুনে নিজে আর কথা না বলে থাকতে পারলেন না।
‘ না না ভাইজান আমি কিছু মনে করিনি। দয়া করে আপনি রাগ করবেন না কায়নাতের উপর। ও বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা এরকম হয়ে যাবে। তার থেকে আমরা নাহয় এখন খাওয়া দাওয়া করে ফেলি। তারপর সানাহ্ এলে নাহয় ওদের বিয়ের প্ল্যানিং করা যাবে। ‘ মিসেস আশা মিসেস কায়নাতকে ইশারায় আশ্বস্ত করে বললেন।
মিসেস আশার ইশারা বুঝে মিসেস কায়নাত সস্তির নিশ্বাস ফেললেন। মিস্টার কবিরও মিসেস আশার কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন। এরপর ওরা সকলে খেতে বসলো। এর মাঝে অতসীও এসে হাজির। ওকে দেখে মনে হচ্ছে সারারাত অনেক কান্নাকাটি করেছে।
ব্যাপারটা ফারহানের চোখে পড়লো কিন্তু বাকিরা কথায় এতটাই মশগুল ছিল যে জিনিসটা এড়িয়ে গেলো। হঠাৎ করে সকাল সকাল ফারহানদের দেখে থতমত খেয়ে গেছিলো অতসী। পরে জানতে পারলো আজ মূলত এতকিছু আয়োজন করা হয়েছে যাতে ফারহান আর সানার বিয়ে নিয়ে কথা বলা যায়।
অতসীও আর কথা না বাড়িয়ে খেতে বসে পড়ল কিন্তু ফারহান ওর দিকে খেতে খেতে বার কয়েক সরু চোখে তাকালো। কেন জানি ফারহানের মনে হচ্ছে কিছু তো একটা হয়েছে নাহলে অতসীর মত রসিকতা প্রিয় মানুষ কখনও এতটা দীর্ঘ সময় কথা না বলে চুপ করে থাকতে পারে না।
খাওয়া দাওয়া শেষে সকলে একসঙ্গে জড়ো হয়েছে বসার ঘরে। অপেক্ষা চলছে সানার জন্য। বসার ঘর বড় হওয়ায় সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। মিসেস কায়নাত আর মিস্টার কবির একসঙ্গে। অতসী আর ফারহান সামনাসামনি বসেছে। আর মিসেস আশা আলাদা একটা সোফাতে বসেছেন যার অপর পাশ খালি। সকলেই টুকিটাকি আলাপ করছেন। এই যেমন বিয়েটা কোথায় হলে ভালো হয়, কিরকম জায়গা হলে ভালো হয় ইত্যাদি।
ফারহান বারবার সিড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তার চোখ সেই ঘুরে ফিরে সিড়িতেই আটকে আছে। ভাবছে সানাহ্ এখনও নামছে না কেন ? কী এমন করছে মেয়েটা ? একটা দিন কি কাজ না করলে হয়না ? এরকম চলতে থাকলে তো বিয়ের পর সানাহ্কে কাছেই পাবে না। ধুর এত দেরি করলে হয় ? ফারহানের কি সানাহ্কে দেখতে ইচ্ছা করে না ? সানার নাহয় দেখতে ইচ্ছা করেনা কিন্তু ফারহানের তো করে। সানাহ্ নাহয় সাধু সন্যাসী, ওর মনে নাহয় কোনো অনুভূতি নেই কিন্তু ফারহানের মনে তো আছে। ফারহানের তো ইচ্ছা করে সারাদিনই দেখতে।
অবশেষে সেই মহেদ্রক্ষন এলো যখন সানাহ্ নিচে এলো। সানার পরনে আজ একটা খয়েরী পার কালো শাড়ি। সানাহ্কে দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাত্র গোসল সেরে এসেছে। ভেজা চুলগুলো পিঠের উপর ছেড়ে দেওয়া। সেই চুল থেকে একটু আধটু পানি পড়ছে। মনে হয় তাড়াহুড়োয় চুল ভালো করে মুছেনি। কোনোমতে জাস্ট চুলে টাওয়েলটা ছুঁয়ে চলে এসেছে।
ফারহান সানাহ্কে নামতে দেখেই সানার দিকে চোখ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিল নিজের বেয়াড়া চোখ দুটো। আজকাল চোখগুলো যা অবাধ্য হয়ে উঠেছে তাতে এভাবে চলতে থাকলে তার নিজেরই ক্ষতি। সানার রুপে মুগ্ধ হওয়া চোখ দুটো কোনওদিন যদি সানার উপর নজর লাগিয়ে দেয়। তাহলে তো ফারহানের ক্ষতি। সদ্য গোসল করা সানার রুপ যেন উপচে পড়ছে। ফারহান চেয়েও পারছে না চোখ সরাতে। অবাধ্য চোখ জোড়া ঘুরে ফিরে সানার দিকেই যাচ্ছে। সানাহ্কে দেখে ফারহান মনে মনে বললো ‘ তাহলে বিবি সাহেবা দেখি আমাকে বারবার তার প্রেমে না ফেলে ছাড়বেনই না। ‘
সানাহ্ নিচে এসে কোনদিকে তাকালো না। সরাসরি মিসেস আশার পাশে গিয়ে বসলো অথচ ফারহান আর অতসী দুজনের পাশেই বসার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল। সানাহ্ মিসেস আশার পাশে বসতেই মিসেস আশাকে সালাম দিয়ে বললো ‘ সরি আন্টি কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে জানতাম না আপনারা আসবেন। জানলে আরও আগেই আসতাম, আপনাদের এতক্ষণ ওয়েট করাতাম না আর আপনাদের রেখে খেতামও না। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। ‘
সানার এহেন অপরাধী ভাব নিয়ে কথা বলা দেখে মিসেস আশা ফিক করে হেসে দিলেন। হাসি আটকে চেহারায় গম্ভীর ভাব এনে বললেন ‘ অবশ্যই আমি কিছু মনে করেছি।। আর এর জন্য তোমাকে শাস্তিও পেতে হবে। অনেক বড় শাস্তি পেতে হবে। ‘
মুহূর্তেই মিসেস আশার কথা শুনে সানার উজ্জ্বল মুখ পাংশুটে হয়ে গেলো। করুন চোখে তাকিয়ে রইলো ফারহানের দিকে। ফারহানও অবাক তার মায়ের ব্যবহারে। তার মা যে এরকম কিছু বলবে ভাবেনি। সানাহ্ এবার ফারহানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অসহায় গলায় মিসেস আশাকে জিজ্ঞেস করলো ‘ কি শাস্তি ? ‘
‘ শাস্তি বেশি কিছু না…. মাত্র দুইটা শাস্তি। প্রথম শাস্তি হলো এখন থেকে আমাকে মা বলে ডাকার অভ্যাস করে নাও। কাল পরশু তোমার ফারহানের সঙ্গে বিয়ে। বিয়ের পরও যদি তুমি এভাবে আন্টি ডাকতে থাকো তাহলে পাড়ায় আমার মন সম্মান থাকবে না। দ্বিতীয় শাস্তি হলো…. তোমার জন্য টরটিলা উইথ চিকেন স্টাফিং এনেছি। ‘
মিসেস আশার কথা শুনে সানার খুশি আর দেখে কে। তবে সানাহ্ তার হাসি আটকে সহজ সরল মুখ করে মাথা উপর নিচে করে সরল ভঙ্গিতে মিসেস আশার কথায় সায় দিল। সানার সায় দেওয়ার ভঙ্গি দেখে মিসেস আশা হো হো করে হেসে উঠলেন।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….
#প্রেমমানিশা(২৬)
বসার ঘরে বিস্তর আলোচনা চলছে। ফারহান আর সানাহ্ বিয়ে নিয়েই সব আলোচনা। সকলে মিলে আলোচনা করলেও এই আলোচনার নিরব শ্রোতা দর্শক হিসেবে সানাহ্, ফারহান আর অতসী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ওরা তিনজন খুবই মনযোগ দিয়ে বড়দের আলোচনা শুনছে। বিয়ে সানাহ্ আর ফারহানের হলেও বিয়ের সব কাজের দায়ভার যেন মিসেস আশা আর মিসেস কায়নাতই নিয়েছেন। দুজনে ঘণ্টার পর ঘন্টা শুধু এটাই আলোচনা করছেন গয়নাগাটি, সানার বিয়ের লেহেঙ্গা এসব নিয়ে।
অতসী মনমরা হয়ে বসে আছে আর ফারহান সানাহ্ নীরবে ইশারায় ইশারায় প্রেম নিবেদন করে চলেছে। হঠাৎ সানার কানে ওর মায়ের বলার একটা কথা যেতেই সানার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো। এতক্ষণ ফারহানের দিকে মনযোগ দিয়ে রেখেছিল বলে পূর্বের আলোচনা কিছুই কানে ঢুকেনি। মনে হলো জননীদের এখনই থামানো দরকার নাহলে ওর বিয়ে অথচ কোনোকিছুই ওর ইচ্ছা মতো হবে না।
সানাহ্ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ফারহান ইশারায় ওকে থামতে বলল। ফারহানের ইশারায় সানাহ্ আর কিছু বললো না তবে এবার ফারহান বললো ‘ আঙ্কেল আমি জানিনা আপনারা আমার কথা কিভাবে নিবেন কিন্তু আমি কথাগুলো বলতে বাধ্য। কাল পরশু সানাহ্ আর আমার বিয়ে। দুই দিন পর আমরা স্বামী স্ত্রী হতে যাচ্ছি তাই এই কথাগুলো ক্লিয়ার না করলে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে এটার প্রভাব পড়বে।
আমি শুনেছি আপনারা বলছিলেন যে বিয়ের অনুষ্ঠান আপনারা ধুমধাম করে করবেন। আমি তাতে কোনো দোষ দেখছিনা কারণ সানাহ্ আপনাদের বড় মেয়ে। কিন্তু একটা প্রবলেম আছে। এত লোকজনকে নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে সানাহ্ আদৌ খুশি তো ?
আমি যতটুকু জানি ও হলো নিঃসঙ্গতা প্রিয় মানুষ। তাই এতজন মানুষ নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো ওর পছন্দ হওয়ার কথা না। আমি নিজেও চাইবো না এতজন মানুষের মধ্যে এতগুলো অনুষ্ঠান করতে। তার থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো বাদ দেওয়া যায়। আপনাদের একান্তই ইচ্ছা থাকলে বিয়ের বৌভাত করতে পারেন।
আবার সানার গয়না নিয়েও আপনারা আলোচনা করছিলেন যে আপনারা সানাহ্কে ভরি ভরি গয়না দিবেন আর আমার কিছু দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি কি জানতে পারি কেন আমি কিছু দিবো না ? সানার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তাই সে আমার থেকে সবকিছু পাওয়ার দাবিদার। আমি যদি দিতে অক্ষম হতাম তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু আমার সামর্থ্য অনুযায়ী সানাহ্কে গয়না দেওয়া আমার জন্য কঠিন কোনো ব্যাপার না। হ্যাঁ হয়তো আপনাদের মতো লাক্সারিয়াস গয়না দিতে পারবো না কিন্তু দিতে তো
পারবো আর আই থিঙ্ক সানাহ্ তাতেই খুশি। ব্যাস আপনার এগুলোই বলার ছিল। এখন আপনারা যদি রাজি থাকেন তাহলে তো ভালই নাহলে কিইবা আর করবো। ‘ কথাগুলো বলেই ফারহান সানার দিকে দৃষ্টি দিলো। সানাহ্ ফারহানের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে। গভীর সেই দৃষ্টি। যেন দৃষ্টিতে ডুবে আছে সানার প্রতি এক রাশ ভালোবাসা।
ফারহান যতটা আশা করেছিল সকলে ততটা শকিং রিয়াকশন দেয়নি বরং অনেকটা স্বাভাবিক ভাবেই ফারহানের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। আবার মিসেস কায়নাত আর মিস্টার কবির ফারহানের সিদ্ধান্তে বেশ অনেকটা খুশি হয়ে ফারহানের অনেক প্রশংসাও করেছেন। সেই সঙ্গে বিয়ের আগেই সানার মন বুঝতে পারার কথা বলে এক রাশ লজ্জা তো আছেই। ফারহান সবটাই নতমুখে মেনে নিয়েছে।
অবশেষে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে মিসেস আশা আর ফারহান নিজেদের নীড়ে ফিরে গেলেন। যাওয়ার আগে সানাহ্ আর ফারহানের বিয়ের দিনও ঠিক করে গেছেন। পূর্বে নির্ধারিত দিনের এক সপ্তাহ আগেই আকদের দিন ঠিক হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে ঠিক করার পিছনে অবশ্য যুতসই কারণ আছে। বিয়ের পরপরই সানার ইয়ার ফাইনাল আর বিয়ের চক্করে কিছুদিন তো তার পড়াই হবে না।। তাই যাতে পরীক্ষার সময় পড়ার সুযোগ হয় এই জন্যই এই ব্যবস্থা।
বিয়ের দিনক্ষণ হিসেবে পহেলা বসন্তের দিন ঠিক হয়েছে। মিসেস আশার বিশ্বাস পহেলা বসন্তের শুভ রং সানাহ্ আর ফারহানের বিবাহিত জীবনেও শুভেচ্ছা বয়ে আনবে। বসন্তের রঙে রাঙিয়ে দিবে সানাহ্ আর ফারহানের পরবর্তী জীবন।
আকদের পরপরই মেয়ে উঠিয়ে নেওয়ার নিয়ম থাকলেও এই ব্যাপারে মিসেস আশা নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। যেহেতু সানার বিয়ের পরপরই ইয়ার ফাইনাল তাই এখনই সানাহ্কে উনি পুত্রবধূ রুপে বাড়িতে তুলে সানার পড়ালেখার উপর থেকে মনযোগ সরাতে চাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে সানাহ্ তার পরীক্ষা বাপের বাড়ি থেকেই দিবে এবং পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সানাহ্কে উনি যোগ্য পুত্রবধূ রুপে পূর্ণাঙ্গ সম্মান দিয়ে নিজ হাতে বরণ করে বাড়িতে তুলবেন। এর মধ্যে নাহয় ফারহান ফাঁকে ফাঁকে এসে সানার সঙ্গে দেখা করে যাবে।
ব্যাপারটা সকলেই লাইটলি নিয়েছে। একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। বিয়ের পরপরই সানাহ্ সাংসারিক ব্যাপারে জড়িয়ে গেলে সানার পড়ালেখার ব্যাপারটা হ্যাম্পার হওয়ার পসিবিলিটিজ থেকে যেত তাই মিসেস আশার সিদ্ধান্ত বেশ পছন্দ হয়েছে সবার। ফারহান, সানাহ্ নিজেদের কথা ভেবে মিসেস আশার সিদ্ধান্ত সসম্মানে মেনে নিয়েছে।
‘ আপাই খেতে চল… মা খেতে ডেকেছে ‘
আচমকা অতসীর ডাকে সানার চিন্তায় ছেদ পড়ল। সানাহ্ ব্যস্ত ছিল ওর আর ফারহানের বিয়ের পরবর্তী জীবনের ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে। তবে অতসীর ডাকে আর সেই দিকে মাথা ঘামালো না। নিঃশব্দেই অতসীর কথায় সায় দিয়ে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
—-
‘ আমি জানি তুমি আমাকে ইচ্ছা করে ইগনোর করছো মিস ইন্ডিয়া। আমি এই কদিনে তোমাকে যতগুলো চিরকুট দিয়েছি সেই সব যে তোমার হাতে গেছে সেটা আমাকে সন্ধ্যা জানিয়েছে। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছিনা তুমি কেন আমাকে এড়িয়ে চলছ। কথা ছিলো তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে কিন্তু তুমি তোমার নামের মতোই মিস ইন্ডিয়া। মিস ইন্ডিয়ার মতো আমার সামনে ধরা দাওনি। প্লিজ আমার সঙ্গে দেখা করো মিস ইন্ডিয়া। আমি ফর দা লাস্ট টাইম তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। প্লিজ…. ডু ইট ফর মি। প্লিজ ফর গড সেক আমার সঙ্গে দেখা করো নাহলে আমি নিজে তোমাকে খুজে বের করবো। তুমি কি চাও আমি তোমাকে খুজে বের করি ? ‘ হাতে থাকা কালো রঙের চিরকুটে শুভ্র রঙে রাঙা লেখাগুলো দেখে নিজের অজান্তেই অতসীর চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা অশ্রু।
অশ্রু যখন কাগজের কোলে আপন মহিমায় শিলায় পরিণত হতে ব্যস্ত অতসী তখন নিজেকে শক্ত করে চিরকুটটা জিন্সের পকেটে রেখে নিজের ব্যাগ থেকে এক টুকরো হলুদ কাগজ বের করে তার পিঠে লিখলো ‘ Ok, meet me at seven in the evening at Dhanmondi lake’s cafe after one week ‘ । চিরকুটটা লিখেই সন্ধ্যার হাতে ধরিয়ে দিল অতসী। সন্ধ্যা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অতসীর দিকে। সে অতসীর চোখের অশ্রুর মানে বুঝতে অপারগ তবে এটা বুঝলো তার অতসদি ভালো নেই। একেবারেই ভালো নেই। তবুও কিছু বললো না। চুপচাপ চিরকুট হাতে চলে গেলো।
জরুরী এক হিসাব নিয়ে বসেছে লিজা। কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছে না সে। বারবার যেন হিসাবে গরমিল লেগে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই উল্টাপাল্টা হিসাবের জেরে লিজার গরম মাথাটাই না ব্লাস্ট হয়ে যায়। নাহ এখন এই হিসাব রেখে এক কাপ গরম ধোঁয়া ওঠা চা খাওয়া উচিত। তাহলে যদি মাথাটা এক ঠান্ডা হয়। কী অদ্ভুত কথা তাইনা ? গরম খেলে মাথা ঠান্ডা হবে। এটাই তো পার্থিব পৃথিবীর অপার্থিব চাওয়া।
ফোন করে বলতেই লিজাকে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা দিয়ে গেলো পিয়ন। লিজা সেই চা নিয়ে কেবিনের জানালার ধারে এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক সিপ এক সিপ করে চা খাচ্ছে আর বাহিরের মনোরম পরিবেশ দেখছে। হঠাৎ কেবিনের দরজায় কারোর করাঘাত শুনে লিজার ভাবনায় ছেদ ঘটলো। হাতে থাকা খালি চায়ের কাপটা ডেস্কে রেখে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো। আবার নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে দ্রুত গলায় বললো ‘ কাম ইন প্লিজ ‘
লিজার বরাবর সামনে অতসী বসে আছে। অতসীর মুখের দিকে তাকাতে পারছে না লিজা। কাদতে কাদতে যেন অতসীর চোখ মুখ বসে গেছে। অতসীর এই অনবরত কান্নার কারণ জানা নেই লিজার। তবে সে কারণ জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু ক্রন্দনরত অতসী কিছুতেই সেই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। বারবার শুধু কেঁদেই চলেছে। অতসীকে এভাবে কাদতে আগে কখনও দেখেনি লিজা। তবে কান্নার কারণ না জানলে তো লিজা কিছু করতে পারবে না। এক পর্যায় লিজা রাগী গলায় বললো ‘ কি হয়েছে তুমি কি আমাকে কিছু বলবে অতসী ? যদি কান্নাই করার থাকে তাহলে তুমি এই রুম থেকে বের হয়ে যেতে পারো। আমার কেবিনে কান্নাকাটি এলাউ না। নেক্সট টাইম সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দিবো যেন দ্বিতীয়বার কেউ কাদতে না আসে। ‘
এবার মনে হয় লিজার কথা কিছুটা কাজে দিয়েছে। অতসী তার ফ্যাসফ্যাস করা কান্না বন্ধ করেছে। মুখ চেপে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। এতক্ষণ কান্না করার কারণে নিশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। অতসী কোনোমতে ওর মুখ চেপে বড় বড় নিশ্বাস নিল। তারপর নিজেকে শান্ত করলো। এবার নিজেকে শান্ত করে ধীর স্থীর গলায় বললো ‘ আমি তোমাকে আমার ফ্রেন্ড মানি লিজা তাই ফর দা লাস্ট টাইম তোমার কাছে একটা সাহায্য চাইছি। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে লিজা ? আই রিয়েলি নিড ইউর হেল্প…ফর দা লাস্ট টাইম ‘ ।
লিজা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অতসীর দিকে।আজকের মতো বিদ্ধস্ত অবস্থায় অতসীকে সে আগে কখনও দেখেনি। এমন কি কখনও মনেও হয়নি এরকম ভাবে অতসীকে দেখতে হবে। অতসীর এরকম অবস্থায় পিছনে কারণ কি ? অতসীকে জিজ্ঞেস পড়ার পরও তো সে কিছু বলেনি। তাহলে কি ব্যাপারটি প্রেম ঘটিত কিছু ?
কাদতে কাদতে অতসীর চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে উঠেছে। বিভৎস দেখাচ্ছে তাকে। যেই অতসীর দিকে লোকে একবার তাকাল ফের একবার তাকালে বাধ্য হতো সেই অতসীকে আজ দেখলে লোকে দেখতেই চাইবে না। কোথায় গেলো অতসীর রূপ লাবণ্য ? সব কি ধুয়ে মুছে গেছে প্রণয়ের বিরহে ? কেন অতসী নিজেকে প্রণয়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে ? কেউ জানেনা এই প্রশ্নের উত্তর..
‘ Ok, meet me at seven in the evening at Rabindra Sarobar’s cafe after one week ‘
লেখাটা আনমনে বারবার পড়ছে প্রণয় তবুও যেন তার বিশ্বাস হতে চাইছে না যে ওর মিস ইন্ডিয়া ওর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছে। বারবার মনে একটাই প্রশ্ন আসছে মিস ইন্ডিয়া এত তাড়াতাড়ি রাজি কি করে হয়ে গেলো ? যেখানে মিস ইন্ডিয়া ওকে তিন চারদিন এমনিতেই ইগনোর করেছে সেখানে একটা হুমকির ভয়ে রাজি হয়ে গেল ? ব্যাপারটা কি অস্বাভাবিক না ? আর রাজিই যদি হয়ে থাকে তাহলে সেটা এক সপ্তাহ পরে কেন ? আজকে কেন নয় ?
নাহ্ আর ভাবতে পারছে না প্রণয়। এই ব্যাপারে যত ভাববে মাথার ভোতা যন্ত্রণাটা ততই বাড়বে। এখন কিছুতেই সে আর এই ব্যাপারে ভাববে না। কিন্তু ভাবতে না চাইলেই কি মন পোষ মানে ? মন তো শুধু তার নিজ ইচ্ছায় চলে। মন বলছে তার মিস ইন্ডিয়া কিছু একটা লুকচ্ছে তার কাছ থেকে ? কিন্তু জিনিসটা কি সেটাই জানা নেই প্রণয়ের।
দুই দিন পর….
ক্লান্ত, উদাসীন আর উদ্ভ্রান্ত টলমলে পায়ে সিড়ি দিয়ে নেমে আসছে সানাহ্। গাঁয়ে এখনও কাল রাতের সেই ফুল হাতা নাইট ড্রেস জড়ানো। চোখগুলো রক্তিম ও টলমলে। কপালের রগ জানান দিচ্ছে আবারও সেই সর্বনাশা জ্বরের প্রকোপে পড়েছে সানাহ্। কাল রাতটা সানার নিদারুণ কষ্টে কেটেছে। আবারও দুশ্চিন্তা আর ডিপ্রেশন ঘর করেছে মনে। নতুন করে বাসা বেধেছে বিয়ে আর ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা।
কাল সারারাত চিন্তায় চিন্তায় এক মুহুর্ত চোঁখ দুটো মেলাতে পারেনি সানাহ্। সানার এই দুশ্চিন্তার শুরু যবে থেকে ওর আর ফারহানের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে। বারবার শুধু একই কথা মাথায় ঘুরছে সে পারবে তো সংসার পড়াশুনা সামলে শাশুড়ির মন যুগিয়ে চলতে। সংসারের মত সমরঙ্গণে যেকোনো বীর যোদ্ধাও ভয়ে তার মুখ লুকায়। সেখানে সানাহ্ তো নেহাৎই নস্যি। ছোটো ছোটো ব্যাপারে আত্ম বিশ্বাস হারা হওয়া তার জন্যই স্বাভাবিক বটে।
ক্লান্ত উদ্ভ্রান্ত সানাহ্ দুই দিন ধরেই শান্তির ঘুম বিসর্জন দিয়েছে। এই দুই দিনে আজ যাও বা ভোরের দিকে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুমিয়েছিল সেটাও এখন উড়ে গেলো। এখন বাজে সকাল আটটা আর এই সময়েই দীর্ঘ দুই ঘণ্টার ঘুম তার পথযাত্রার ইতি টানল।
সানাহ্ ক্লান্ত হলেও তার এখনও কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার শক্তি উধাও হয়নি। সারারাত জেগে থাকায় খিদে এমন লেগেছে যে মনে হচ্ছে খিদের জেরে সানার পক্ষে আট-দশটা ব্রেড টোস্ট খাওয়া মোটেই কঠিন কিছু হবে না। সানাহ্ যখন উদাস ভঙ্গিতে টোস্টেড ব্রেডের গাঁয়ে বাটার লাগাতে ব্যস্ত ঘর্মাক্ত মিসেস কায়নাত তখন এক ঝলক দেখা দিয়ে গেলেন সানাহ্কে যেন মেয়ে তার ডেরাতেই ফিরেছে তার নিশ্চয়তা নিচ্ছেন।মিসেস কায়নাতকে দুই-একবার ঢু মারতে দেখেও সানাহ্ কিছুই বললো না। খিদের তাপে তার এখন কোনদিকেই চোখ দেওয়ার জো নেই। নিজের খুদা মিটানই তার এখন মূল উদ্দেশ্য….
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….