প্রেমমানিশা পর্ব-২১+২২+২৩

0
215

#প্রেমমানিশা(২১)

সবেমাত্র সানার ক্লাস শেষ হয়েছে। অনেকদিন পর আবার ক্লাস করতে পেরে আনন্দিত সানাহ্। পড়াশুনায় সে বরাবরই ভালো। স্কুল জীবনে ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিল। তবে এখন সময়ের প্রভাবে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার তীব্র চাপে টপ করাটা আর হয় না। ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়া তো কম কঠিন নয়। পড়তে পড়তে আর মুখস্ত করতে করতেই দিন পেরিয়ে যায়। ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়া আর আর্টসের ইতিহাস বিষয়ের সাল মুখস্ত করার মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পায় না সানাহ্।

যদিও অনার্স লেভেলে পড়া খানিকটা কঠিন হয়ে উঠে তবে সানাহ্ এখনও তার বুদ্ধিবলে সেরা স্টুডেন্ট। টপ করতে না পারুক, তার নাম সবসময় টপ থ্রিয়ের মধ্যে থাকবেই। এটা তার চিরাচরিত গন্তব্য। অবশ্য এর জন্য ভার্সিটি মহলে সে বেশ ঈর্ষণীয় বটে।

সানার অতি মাত্রায় সুন্দর রুপ আর তার ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টের জন্য কলেজ লাইফ থেকে শুরু করে ভার্সিটি লাইফের সফর অব্দি তার পাওয়া প্রপোজালের শেষ নেই। প্রায় প্রতিদিনই তার কাছে প্রপোজাল আসে কিন্তু ভার্সিটি মহলে সকলেই তার ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তার নির্লিপ্ত গলায় রসকষহীন ভাবে ‘ সরি, আই ক্যান্ট একসেপ্ট ইট ‘ বলার জন্য সকলেই তাকে আড়ালে এক অন্য রকমের উপাধি দিয়েছে। খুবই বিশেষ সেই উপাধি ‘ callous ‘ ।

যেই মেয়ে মেয়ে হয়েও তার মাঝে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বিন্দু মাত্র কোনো আকর্ষণ নেই সে নিঃসন্দেহে ক্যালেস ছাড়া কিছু নয়। সানাহ্কে যারা ভার্সিটির লাইফের প্রথম থেকে শেষ অব্দি দেখেছে তারা নিজেরাই অবাক। একটা মেয়ে কি পরিমান ক্যালেস হলে এতগুলো ছেলের আকর্ষণীয় প্রস্তাব নিষ্ঠুরভাবে ফিরিয়ে দিতে পারে।

সানার স্বভাব সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহাল। সানাহ্ যে যেকোনো ধরনের সম্পর্কের প্রতিই উদাসীন সেটা তার বন্ধু মহল দেখলেই বোঝা যায়। ভার্সিটি লাইফে আজ পর্যন্ত কোনো বন্ধুই সে জুটাতে পারেনি কিংবা চেষ্টা করেনি। ভার্সিটি লাইফে যেখানে বন্ধু বানানো ডান হাতের খেলা সেখানে সানার একটাও বন্ধু না থাকা সবাইকেই অবাক করেছে। সাথে সবাই এটাও বুঝেছে যে সানার কোনো বন্ধু আদো জীবনে সম্ভব না।

বন্ধু না থাকার দরুন সানাহ্ বরাবরই বাড়ি থেকে ভার্সিটি আর ভার্সিটি থেকে বাড়ি একাই আসা যাওয়া করে। তার যাতায়াতের মাধ্যম হলো রিক্সা। বিকেলের মেঘলা পরিবেশে ভার্সিটি থেকে ফিরতে সময় হালকা রোদ গায়ে মেখে একলা ফিরে আসাই যেন সানার জন্য পরম আনন্দের ব্যাপার। এই আনন্দ সে কারোর সঙ্গে ভাগ করতে রাজি নয়।

সানাহ্ তখন সবে ক্লাস করে বের হচ্ছিল। হঠাৎ নজরে পড়লো বিল্ডিংয়ের করিডোরের শেষ মাথায় ফারহান ফোনে কারোর সঙ্গে কথা বলছে। একবার মনে হলো চিৎকার দিয়ে ডাকলে হয়তো ফারহান শুনতে পাবে কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এমনটা করলে সবাই ওদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। এছাড়াও কাজটা তার এথিক্সের বাইরে হয়ে যাবে। তাই সানাহ্ নিঃশব্দেই পথ চলতে লাগলো। উদ্দেশ্য হুট করে ফারহানের সামনে গিয়ে তাকে চমকে দিবে।

তবে সানার আর চমকে দেওয়া হলো না। তার দৃঢ় পদক্ষেপ থেমে গেছে। ফারহানকে ফোন রেখে ম্যাডাম রিয়াশার সঙ্গে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। রিয়াশার সঙ্গে বেশ হেসে হেসেই কথা বলছে ফারহান। কী সুন্দর তার হাসি। বাহ্ দুজনকে কি সুন্দর মানিয়েছে ? আচ্ছা কার সঙ্গে ফারহানকে বেশি মানায় ? সানার সঙ্গে নাকি রিয়াশার সঙ্গে। রিয়াশার সঙ্গেই ভালো মানানোর কথা কারণ তারা একসময় কলেজ লাইফের বন্ধু ছিল আবার দুজন তো সমানে সমানে।

এতকিছু ভেবে সানার আর ফারহানের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করলো না। ফারহানের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ভার্সিটি গেটের দিকে হাঁটা ধরলো। উদ্দেশ্য ভার্সিটির সামনে থেকে রিক্সা নিয়ে সোজা বাড়ি যাবে। বিকেলের মেঘলা আকাশ দেখতে দেখতে বাড়ি যাওয়ার মজাই আলাদা। যেই ভাবা সেই কাজ।

সানাহ্ ধীর পায়ে হেঁটে ভার্সিটির বাইরে চলে এলো। বাইরে আসতেই চোখের সামনে ধরা পড়লো অগণিত খালি রিকশা। এর মধ্যে একটা রিক্সা বেছে নিয়ে বললো ‘ ধানমন্ডি লেক ‘ । সানার কথা শুনে রিক্সাওয়ালাও প্যাডেল চালালো। প্রথমে ভেবেছিল বাড়ি যাবে কিন্তু হঠাৎ মনে হলো একটু একা একা কোথাও ঘুরে আসা যাক। নিজের সঙ্গে নিজের সময় কাটানোও হবে আবার লেকের স্বচ্ছ ধারাও দেখা হবে।

রিক্সা ধানমন্ডি লেকে এসে থামতেই সানাহ্ রিক্সা ভাড়া দিয়ে রিকশাওয়ালাকে মুক্ত করে দিলো। টাকা হাতে নিয়ে রিকশাওয়ালা পান খাওয়া ৩২ পাটি দাত দেখিয়ে হেসে চলে গেলো। সানাহ্ সেই দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার গন্তব্যে হাঁটা ধরলো।

ধানমন্ডির এক অন্যতম টুরিস্ট স্পট হলো ধানমন্ডি লেক। ধানমন্ডি লেক আসলেই চারদিকে শুধু মানুষদের আনাগোনা চোখে পড়ে। সবাই যে যার যার মতো ব্যস্ত। কেউ নিজের পরিবার নিয়ে তো কেউ গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ব্যস্ত। আবার কিছু কিছু হিন্দু দম্পতিও এসেছেন একটু ঘুরে বেড়ানোর। সকলের মুখেই কত সুন্দর হাসি।

মাঝে মাঝে নিজের আশেপাশে এত হাসতে থাকা মানুষদের দেখে সানার মনে হয় এই পৃথিবীতে একমাত্র সেই অসুখী। কিন্তু সত্য তো এটাই অনেকেই মুখোশের আড়ালে নিজেদের দুঃখকে লুকিয়ে রেখে মুখে ফুটিয়ে তুলে নকল হাসি। প্রত্যেকটা মানুষেরই দিনশেষে কোনো না কোনো দুঃখ থাকে।

এই জগতে সকলেই একা সে তার যতই আপনজন থাকুক। সারাদিন ঘর, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা, স্বামী নিয়ে ব্যস্ত থাকা স্ত্রীও দিনশেষে একসময় একা। মানুষ যেমন একলা পৃথিবীতে আসে তেমনি একলা জীবন কাটিয়ে আবার একলাই ফিরে যায়। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও একলা থাকাটাই মানব জাতি। কেউ কেউ কাছের মানুষ থেকেও একলা আবার কেউ কেউ না থেকেই একলা।

যাহ এরকম ইমোশনাল কথাবার্তা সানার ভাবতে ইচ্ছা করছে না। মাইন্ড ডাইভার্ট করা দরকার। সানাহ্ মাথা থেকে সব আজাইরা চিন্তা ভাবনা ছেড়ে সেতুর দিকে এগিয়ে গেলো। ধানমন্ডি লেকে একটা সেতু আছে। সেই সেতুতে দাড়িয়ে ধানমন্ডি লেক দেখতে আরও চমৎকার লাগে। সেখানকার দৃশ্য আসলেই চমৎকার।

সানার মনে হচ্ছে সে আস্তে আস্তে তার মামণির মতো হয়ে যাচ্ছে। তার মামণিও এরকম নীরবে নিভৃতে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করত। যখনই সুযোগ পেত একলা ঘুরতে চলে যেত। অবশ্য কখনও কখনও ছোটো সানাহ্কে নিয়েও যেত। তার মামণি সুযোগ পেলেই প্রকৃতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করত। আজ সেসব অতীত।

আজ অনেকদিন পর রাস্তার ধারে যেখানে বাচ্চাগুলোকে শেষবারের মত দেখে গিয়েছিল সেখানেই এসেছে অতসী। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো অলি গলি চিপা চুপা খোজার পরও তাদের খোঁজ মিলেনি। চিন্তায় অতসীর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এতগুলো বাচ্চা একসঙ্গে কোথায় গেলো ? এতগুলো আস্ত মানুষ কি করে কর্পূরের মত উবে গেলো ?

অতসীর অনেক চিন্তা হচ্ছে কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। কথাগুলো কি দাদুকে জানাবে ? নাহ্ দাদুকে জানালে যে দাদু চিন্তায় পড়ে যাবে। উফফ অতসী ভাবতে পারছে না। ওর মাথা কাজ করছেনা এতগুলো বাচ্চা একসঙ্গে কোথায় গেলো। এসব ভাবতে ভাবতেই অতসী ফুটপাতের উপর থাকা চেয়ারে মাথা চেপে বসে পড়লো। সকালে রোদ পড়ায় মাথা ধরেছে।

হঠাৎ অতসী খেয়াল করলো রাস্তার ওই পাড়ে বিল্টু দাড়িয়ে আছে। সাথে সাথে অতসী লাফিয়ে উঠে বিল্টুকে ইশারা করলো সে ওখানেই আসছে বিল্টু যেন দাড়ায়। বিল্টু অতসীর ইশারা বুঝলো কিনা কে জানে তবে ওখানেই দাড়িয়ে রইলো। অতসী কোনোমতে রাস্তা পার করে বিল্টুর কাছে গেলো। হাপাতে হাপাতে বিল্টুর কাধে হাত রেখে বলল ‘ তোরা সবাই কোথায় উধাও হয়েছিস ? ‘

‘ আমাদেরকে ঐযে একটা ভাইয়া আছে না যে রোজ আসতো সে একটা আশ্রমে নিয়ে গেছে। তোমরা কি যেন বলো ওটাকে ? হুম এনজিও… ওখানে। ওখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। ‘ বিল্টু বললো।

‘ কিহ, উনি বললেন আর তোরাও রাজি হয়ে গেলি ? তোদের না আমি বলেছি আমাকে না বলে কিছু করবি না ? তাহলে তোরা কেন রাজি হয়েছিস ? ‘ অতসী রেগে গিয়ে বললো। একটা স্বল্প পরিচিত দুই দিনের মানুষ এসে তার কাছের মানুষদের এভাবে করুণা দেখিয়ে নিজের দিকে টেনে নিবে সেটা কিছুতেই মেনে নিবে না অতসী। মানুষটার সঙ্গে অতসীর অনেক খাতির থাকলেও অতসীর কাছে বিল্টু,ময়না, সন্ধ্যা ওদের থেকে কেউ বেশি না।

‘ রেগে যাচ্ছ কেন দিদি ? কী করে বলতাম তোমাকে বলো ? এতদিন তো আমরা আর ভাইয়া তোমার জন্য কত অপেক্ষা করলাম কিন্তু তুমি এলেই না। ভাইয়া রোজ এসে জিজ্ঞেস করতো তুমি এসেছো নাকি ? কিন্তু শেষে যখন তোমার কোনো খোঁজ নেই তখন পরশুদিন ভাইয়া আমাদের ওই এনজিওতে নিয়ে গেলো আর বললো প্রত্যেকদিন তুমি যেই সময় আসো সেই সময়ে এসে যেন দেখে যাই তুমি এসেছ কিনা। দেখা হলে এই চিরকুটটা দিতে বলেছে। ‘ বলে বিল্টু অতসীর দিকে একটা কালো খাম এগিয়ে দিল।

অতসী বিনা বাক্য ব্যয়ে খামটা হাতে দিল। আসলেই তো সে কাউকে না জানিয়েই আসা এক প্রকার বন্ধ করে দিয়েছিলো। তাই ওই মানুষটাকেও দোষ দেওয়া যায় না। এখন চিরকুটে কি লিখেছে সেটা পড়তে পারলে শান্তি। অতসী চিরকুট খুলে দেখল আবারও একই ভাবে কালো কাগজে শুভ্র রঙে রঙ্গিন কালি দিয়ে লিখা ‘ এতদিন আসোনি কেন ? আমি আর ময়না,বিল্টু ওরা তোমার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি। ভাবলাম একবার খোঁজ নিয়ে তোমাকে খুঁজে বের করি। কিন্তু তারপরই মনে হলো থাক না কাগজের সম্পর্কগুলো কাগজেই সীমাবদ্ধ। দরকার কি তাকে টেনে হিচড়ে বের করে আনার। যখন সময় হবে তখন আপনিতেই বেরিয়ে আসবে।

তুমি আসছ না বলে আমি নিজেই বিল্টু, ময়না ওদের থাকার একটা পার্মানেন্ট জায়গা ঠিক করে দিলাম। বাচ্চাগুলোকে একা এভাবে রাস্তায় থাকতে দেওয়াটা সেফ না। তার থেকে আমি যেখানে ওদের থাকার জন্য ব্যবস্থা করেছি সেটা ওদের থাকার জন্য পারফেক্ট। তোমার দেখতে ইচ্ছা করলে বিল্টুকে বলো। বিল্টু তোমাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে এনজিও দেখিয়ে আনবে। আবারও কথা হবে…. ‘

চিরকুটটা পড়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে চিরকুটটা নাকের কাছে নিয়ে চিরকুটের গন্ধ নিলো অতসী। মনে হচ্ছে চিরকুটের গায়ে মানুষটার গন্ধ লেগে আছে। হয়তো মানুষটা নিজের সঙ্গে সঙ্গে চিরকুটকেও পারফিউম দিয়েছিলো। এবার নিজের গন্ধ নেওয়ার কাজে ইস্তফা লাগিয়ে বিল্টুকে বললো ‘ তোদের ভাইয়া তো বললো তোকে বলতে । তুই নাকি এনজিওর রাস্তা চিনিস ? ‘

অতসীর কথা শুনে মুখে হাত চেপে হাসলো বিল্টু। কথা তার ভাইয়া ঠিকই বলেছে। বিল্টু আসলেই জায়গাটা চিনে। বিল্টু মানুষ হিসেবে খুবই প্রখর জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন। যা একবার দেখে তাই মনে রাখে। বিল্টু বললো ‘ হ্যাঁ চিনি তো,তুমি আমার সঙ্গে চলো। ‘

বিল্টু আর অতসী হাঁটছে রাস্তার ফুটপাত দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে কৌতূহল বশত অতসী বললো ‘ তোরা এতদিন যেখানে ছিলি সেখান থেকে এনজিও যেতে কতক্ষন সময় লাগে ? ‘

‘ এই তো পাঁচ মিনিটের রাস্তা, এই যে এসে গেছি ‘ বলে বিল্টু আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিল অতসীকে। বিল্টুর ইশারা অনুসরণ করে সামনের দিকে চোখ দিতেই অতসীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। অস্ফুটে বলে উঠলো ‘ এটা তো দাদুর এনজিও ‘
বিল্টু অতসীর কথা পুরোপুরি শুনতে না পারলেও শেষের কয়েকটা কথা তার কানে ঠিকই পৌঁছেছে। বিল্টু সেটা শুনে বললো ‘ হ্যাঁ দাদুর তো, এই এনজিও নাকি ভাইয়ার দাদুর। প্রণয় ভাইয়া নিজে বলেছে, ‘

এবার আর অতসীর বুঝতে বাকি রইলো না সেই চিরকুট দেওয়া মানুষটা প্রণয় নিজেই। অথচ অতসী এতদিন বুঝতেই করেনি মানুষটা প্রণয়। প্রণয় নিজেও হয়তো জানেনা যাকে সে চিরকুট দেয় সে তারই স্টুডেন্ট অতসী। কিন্তু অতসী ভেবে পাচ্ছে না পৃথিবীটা কি এতই ছোট ? সেই ঘুরে ফিরে প্রণয়ের সঙ্গেই সে প্রণয় বাঁধালো। নাকি এটা তাদের টক ঝাল মিষ্টি প্রতিশোধের শুরু মাত্র ?

‘ দিদি ভিতরে যাবে না ? ‘ বিল্টু অতসীর হাত টেনে বললো।

‘ হুম চল ‘ বলে অন্যমনস্ক হয়ে এনজিওতে ঢুকলো। এনজিওতে ঢুকতেই তার দেখা হলো লিজার সঙ্গে। লিজা হলো এনজিওর অ্যাকাউন্ট্যান্ট। জালাল সাহেবের তৈরি করা এই এনজিও হাজার হাজার বাচ্চার ভরণপোষণের দায়িত্বে আছে বলে এর অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলোও নেহাৎ বড় নয়। সেই কারণেই মূলত একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে যতগুলো পোস্টে কাজ হয়ে থাকে সেগুলো এই এনজিওর মধ্যেও হয়ে থাকে।

একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী আর জনকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার কারণে জালাল সাহেবকে সরকার একটা মোটা অংকের টাকা দেয় যেটা জালাল সাহেব এনজিওর কাজেই লাগান। অতসী কয়েক বছর ধরেই এই এনজিওর সঙ্গে যুক্ত তাই লিজার সঙ্গে তার ভালই সখ্যতা। অবশ্য লিজা তার বড় কিন্তু দুজনকে একসঙ্গে দেখলে কেউ তা ধরতেই পারবে না।

লিজা তো অতসীকে দেখে বেশ খুশি। দৌড়ে এসে অতসীকে জড়িয়ে ধরে বললো ‘ কতদিন পর এলে অতসী ? আমার কথা মনে পড়ে না ? জানো আমি তোমাকে কত মিস করেছি ? ‘

অতসী লিজাকে জড়িয়ে ধরে লিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো ‘ অনেক পেরা দিয়ে গেলাম এতদিন। এই কয়দিনে কত ঝড় যে গেলো তুমি ভাবতেও পারবে না। ‘

অতসীর কথা শুনে লিজা ওকে ছেড়ে দিয়ে বললো ‘ আচ্ছা তাহলে তুমি আমার কেবিনে গিয়ে বসো। ওখানেই কথা বলবো। ‘

লিজার কথা শুনে অতসী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বিল্টুকে বললো ‘ তুই এখন যা…. আমি একটু পড়ে এসে তোদের সঙ্গে দেখা করবো। এখনই কাউকে বলিস না যে আমি এসেছি ‘

বিল্টু অতসীর কথা শুনে “ আচ্ছা দিদি ‘ বলে চলে গেলো।
অতসী লিজার সঙ্গে লিজার কেবিনে এসে লিজাকে বললো ‘ লিজা দরজাটা একটু লাগিয়ে দাও। ‘
লিজা অতসীর কথা মতো দরজা লাগিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো আর অতসী ওর মুখোমুখি ডেস্কের সামনে থাকা চেয়ারে বসলো।

‘ চেহারার একি অবস্থা করেছ ? এরকম হলো কি করে ? আর এতদিন এলে না কেন ? ‘ অতসীর দিকে তাকিয়ে বললো।

‘ আর বলো না। প্রথম কতদিন সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট পরীক্ষা গেলো। এরপর তো আমার আপাইয়ের বিয়ে ঠিক হল। বিয়ের ঠিক হওয়ার পরপরই আপাই আবার অসুস্থ হয়ে পড়লো। আর অসুস্থ হলে তো জানোই সে কি করে । ‘ অতসী মলিন গলায় বললো ।

অতসীর কথা শুনে লিজা অবাক হয়ে বললো ‘ উনি কি আবার পালিয়ে গেছেন ? এবার কে ফিরিয়ে এনেছে উনাকে ? নাকি নিজেই ফিরে এসেছেন ? এর আগেরবার তো নিজেই ফিরে এলেন। ‘

‘ হুম পালিয়ে গেছিলো, তবে এবার দুলাভাই ফিরিয়ে এনেছে। নাহ নিজে ফিরেনি। ওর যে জেদ.. দুলাভাই জোর খাটিয়ে ফিরিয়ে এনেছে। ওর জন্য ভাইয়া এক সপ্তাহ চাকরি বাকরি ছেড়ে শুধু ওকেই খুঁজেছে। ‘

‘ বাহ তোমার আপু তো দেখি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে। বিয়ের আগেই বর সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে ফিরিয়ে আনলো। মনে হয় তোমার আপুর বিবাহিত জীবন সুন্দর হবে। তা তোমার আপুর হবু শাশুড়ি রেগে যাননি ? না মানে তার ছেলেকে দিয়ে তার হবু ছেলের বউ এত কষ্ট করালো। ‘ লিজা হাসতে হাসতে বললো। অতসীর বোন অবশেষে সুখী হতে চলেছে জেনে তার খুব ভালো লাগছে। ওই মানুষটা তার কাছেই বড়ই চমৎকার। একটু পাগলাটে কিন্তু তার কথাগুলো ওর ভালো লাগে অবশ্য সে কখনো সানাহ্কে সরাসরি দেখেনি। শুধু অতসীর কাছেই শুনেছে।

‘ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালে কি হবে ? নিজের ভালো তো একেবারেই বুঝে না। নিজের ভালো পাগলেও বুঝে আর আপাই বুঝে না। এটা ঠিক যে আপাইয়ের কপাল ভালো যে ফারহান ভাইকে পাচ্ছে। নাহলে আপাইয়ের যা স্বভাব তাতে ওর কপালে বর জুটত না। আন্টি কিছু বলেননি। উনি তো দিদিকে অনেক ভালোবাসেন। আসলে আন্টি আমার মায়ের বন্ধু। ‘ অতসী বললো।

‘ যাক তাহলে তো ভালই। ‘

‘ লিজা আমাকে একটা হেল্প করবে ? তোমার হেল্প আমার দরকার। ‘ অতসী অনুরোধের সুরে বলল।

‘ কি হেল্প ? এভাবে বলছো কেন ? তুমি বললে কি আমি হেল্প করবো না ? ‘ লিজা ভ্রু কুচকে বললো।

‘ বিল্টু,ময়না ওদের যেই মানুষটা নিয়ে এসেছিল আমি চাইনা সে জানুক আমি কে। আমি চাইনা সে জানুক আমিই বিল্টুর অতস দি। মোট কথা আমি উনার কাছ থেকে আমার পরিচয় লুকাতে চাই। আমি চাই না সে আমাকে জানুক,চিনুক। এর জন্য আমার তোমার হেল্প লাগবে। তুমি প্লিজ সবাইকে বলে দাও যেন কাইন্ডলি কেউ আমার নাম বা পরিচয় উনার সামনে না নেয়। প্লিজ ডু ফর মি.. ‘ অতসী অসহায় হয়ে বললো।

‘ ঠিকাছে সেটা তো বলবো কিন্তু তুমি কেন চাচ্ছো তোমার পরিচয় লুকাতে ? ওই মানুষটা কে যে তুমি তার কাছ থেকে তোমার পরিচয় লুকাতে চাও ? আমি যতটুকু জানি উনি জালাল স্যারের নাতি তবে আমি উনাকে দেখিনি। আমি পরশু একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। ‘ লিজা অবাক হয়ে বললো।

‘ সরি লিজা কিন্তু আমি তোমাকে আসল সত্যিটা বলতে পারবো না। প্লিজ তুমি জানতে চেওনা। তুমি শুধু একজন বন্ধু হিসেবে আমাকে সাহায্য করো। এর জন্য আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো। ‘ অতসী আবারও অনুরোধ করে বললো।

‘ আচ্ছা আচ্ছা আমি জানতে চাইব না। আমি সবাইকে বলে দিবো যেন কেউ তোমার কথা না বলে। ‘ বলে অতসীকে সান্ত্বনা দিলো লিজা।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#প্রেমমানিশা(২২)

‘ মামা এক প্লেট ঝাল দিয়ে ফুচকা দিন তো ‘

কথাটা বলেই সানাহ্ ফুচকা স্টলের সামনে থাকা চেয়ারে বসলো। তার সামনে একটা প্লাস্টিকের টেবিল আছে যার সামনে একটা চেয়ার আর দুই পাশে দুটো চেয়ার। ফুচকাওয়ালা মামা সানার কথা মতই ইচ্ছামত কাচা মরিচ আর লাল মরিচ দিয়ে ফুচকা বানিয়ে দিয়ে গেলেন। হুট করে কি হলো। সানার রাগে দুঃখে কান্না পাচ্ছে।

সানাহ্ তার কান্না আটকে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। হাত বাড়িয়ে ফুচকার প্লেটটা সামনে নিলো। একটা ফুচকা মুখে নিতেই সানার নাক ফুলে যেতে শুরু করল আর চোখ লাল হয়ে উঠতে শুরু করল। ফুচকার তীব্র ঝালে তার চোখ মুখ মাত্রাতিরিক্ত লাল হয়ে গেছে তবুও সে তার জেদ বজায় রাখতে থামলো না। একের পর এক ঝাল ফুচকা গোগ্রাসে গিলে চললো।

ফুচকা শেষ করে যখন সানাহ্ আশেপাশে তাকালো তখন দেখলো আশেপাশে যারা ছিল তারা অনেকেই হাঁটাচলা করতে সময় তার দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে, হয়তো তার রক্তিম বর্ণ ধারণ করা চেহারার জন্য। সানাহ্ বিষয়টা পাত্তা দিলো না। ইশারায় ফুচকাওয়ালা মামার সহকারী ছেলেটাকে বললো ফুচকাওয়ালা মামাকে ডাকতে। ছেলেটা ডাক দিতেই ফুচকাওয়ালা মামা ছুটে এলেন আর সানাহ্ ব্যাগ থেকে ফুচকার টাকা বের করে মামার দিকে এগিয়ে দিল।

ফুচকাওয়ালা মামা ফুচকার টাকা নিতে সময় সানার দিকে তাকিয়ে ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলেন। সানার মুখের যা অবস্থা তাতে যে কারোর ভয় পেয়ে যাওয়ার কথা। সানাহ্ ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে বললো ‘ একটা পানির বোতল এনে দিন। ‘ ফুচকাওয়ালা নিজে দৌড়ে গিয়ে পানির বোতল নিয়ে এলো, হয়তো নিজের দোষের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। সানাহ্ বোতলটা হাতে নিয়ে বোতল থেকে পানি নিয়ে মুখ ধুয়ে নিল। মুখ ধুয়ে আবারও বোতলটা ফিরিয়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছলো। মুখ মুছে বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে পানি খেয়ে ফেললো। পানি খেয়ে এতক্ষণে শান্তি লাগছে।

মুখের লাল লাল ভাবটা কমে এসেছে। মুখে তৈরি হওয়া গরম ভাবটাও অনেকটা কমেছে। সানাহ্ এবার আকাশের দিকে চোখ দিলো। ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি। বাড়ি ফেরা দরকার নাহলে মা হাজার প্রশ্ন করবে। সানার এখন কোনো ঝামেলায় যেতে ইচ্ছা করছে না তাই সে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো।

বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সাড়ে আটটা বেজেছে সানার। রিক্সা থেকে নেমে রিক্সাওয়ালাকে তার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে যখন সিড়ির দিকে যেতে ব্যস্ত তখনই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মিসেস কায়নাত। সানাহ্কে ফিরতে দেখে কপালের ঘাম শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে এগিয়ে এসে বললেন ‘ এসে গেছিস ? খিদে পেয়েছে নিশ্চই… ফ্রেশ হয়ে আয়। কী খাবি ? ‘

যদিও বাইরে সেই ভয়ংকর ঝাল দেওয়া ফুচকা খেয়ে সানার এখন খাওয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই তবুও মায়ের উপর সরাসরি কিছু বললো না। ঝামেলা করার মনমানসিকতা তার নেই এখন। তাই বললো ‘ থ্রি টোস্টেড ব্রেড, ওয়ান পোচড এগ অ্যান্ড ওয়ান মাসালা এগ মামলেট। একেবারে রাতের খাওয়া। এখন দিওনা মা… রাত দশটায় আমি নিজে এসে খাবো। ‘

সানার মুখে মা ডাক শুনে থমকে গেলেন মিসেস কায়নাত। আহ্ কত মায়া ভরা সেই ডাক.. মেয়েটার মুখে এক মুহুর্ত মা ডাক না শুনলে মিসেস কায়নাতের কান তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠে। কথাটা ভাবতেই আপনিতেই মিসেস কায়নাতের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মিষ্টি হেসে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন তবে ক্লান্ত সানার তার মায়ের মুখের স্নিগ্ধ হাসি চোখেই পড়লো না। সে যেন আপন জগতেই ব্যস্ত।

রুমে এসেই ব্যাগপত্র রেখে বারান্দায় চলে গেলো সানাহ্। ক্লান্ত গা এলিয়ে দিল বারান্দায় থাকা ডিভানে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছে। অন্যদিন এতটা ক্লান্ত থাকে না সানাহ্। আজ হয়তো মন খারাপটাই শরীরের উপর প্রভাব ফেলছে। কোথাও শুনেছিলাম মন সুস্থ থাকলেই শরীর সুস্থ তবে আজ সেটার প্রমাণও পেলাম।

প্রেম বিরহে আজ সানার মন ক্লান্ত। ইচ্ছে করছে আবারও সব ছেড়ে চলে যেতে কিন্তু এবার আর সানাহ্ যাবে না। তাকে এখানে উপস্থিত থেকে ফারহানের ওই বন্ধুর সঙ্গে ফাইট করতে হবে। দেখিয়ে দিতে হবে ফারহান সানাহ্কে ভালোবাসে ওই রিয়াশা ফিয়াশাকে না। এর জন্য সানাহ্কে যা যা করতে হবে সে তাই করবে তবু নিজের অধিকার ছাড়বে না। এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্রী সে নয়।

সবেমাত্র খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরে এসেছে সানাহ্। হট শাওয়ার নিয়ে মায়ের হাতে খেয়ে এখন ঘুম পাচ্ছে। কতদিন পর মিসেস কায়নাত সানাহ্কে খাইয়ে দিয়েছেন হিসাব নেই। সানাহ্ তার হাতে খেতেই চায় না। সানার নিজ হাতে খাওয়া পছন্দ। মা তাকে খাইয়ে দিবে তারপর ঐ একই এটো হাতে নিজেও খাবে ব্যাপারটা সানার পছন্দ না।

ঘুম চোখ ফেটে আসছে অথচ সানাহ্ একটু পড়তে চেয়েছিল। আর কয়েকদিন পর ফাইনাল এখন না পড়লে কি করে হয়। কোন কুক্ষণে যে বিছানায় শুয়েছিল। এই জন্যই তো হতচ্ছাড়া ঘুম চোখে এসে ধরা দিল। ধুর চোখ মুখ ধুয়ে পড়তে বসতে হবে ভেবে সানাহ্ বিছানা ছেড়ে উঠলো। বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে আসলো। তারপর পড়তে বসলো। বই খুলে পড়ছে কিন্তু ঘুমঘুম ধরছে তবে সানাহ্ হার মানবে না। আজ কেউ পারবে না তাকে পড়া থেকে দূর করতে।

হঠাৎ ফোনের রিংটোনে সানার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটলো। বিরক্তিতে তার চোখ মুখ কুঁচকে গেল। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাজতে থাকা ফোনের দিকে। তারপর না দেখেই ফোন কেটে দিলো। সানাহ্ যখন আবার পড়ায় কনসেনট্রেট করতে চেষ্টা করলো তখনই ঘর কাপিয়ে আবারও ফোন বেজে উঠলো। সানাহ্ বিরক্তিতে ফোনই ধরলো না। ফোন আবারও কিছুক্ষণ বেজে বন্ধ হয়ে গেলো।

তবে কলদাতা যে থামার পাত্র নয় সেটা সানাহ্ একটু পরেই বুঝতে পারল। আবারও ফোন বাজছে। সেই একই রিংটোন… এই রাত তোমার আমার। এবার আর সানাহ্ বসে রইলো না। দ্রুত কল রিসিভ করে কিছু বলার জন্য উদ্যত হলো কিন্তু তার কথা মুখেই রয়ে গেলো। ফোনের ওপার থেকে ফারহান তেজ দেখিয়ে বললো ‘ এতক্ষণ লাগে ফোন ধরতে ? ফোন ধরছিলে না কেন ? ‘

ফারহানের তেজি স্বর শুনে কিছু বলার সাহস পেলো না সানাহ্। কোথায় সে যাচ্ছিল চিৎকার চেঁচামেচি করতে অথচ এখন ফারহান গলা বাজাচ্ছে। সানাহ্ শুধু আমতা আমতা করে বললো ‘ না মানে…. ‘

‘ কথা পরে বলো। আগে তোমার বারান্দায় এসে দাড়াও । ‘

এবার সানার মাথা চড়ে গেল। একে তো তেজ দেখাচ্ছে আবার এইদিক দিয়ে এই ঠান্ডায় বারান্দায়ও যেতে বলছে। মগের মুল্লুক নাকি ?
সানাহ্ থমথমে গলায় বললো ‘ এই শীতের রাতে আমাকে বারান্দায় ঢুকতে বলার কারণ কি জানতে পারি ? ‘

এবার সানার গলায় কম্পনের মাত্রা ফারহানের কানে ঠেকলো। বুঝতে পারলো সানাহ্ রেগে যাচ্ছে। কিন্তু এখন তো সে সানার মন ভালো করতে চায় তাই তাকে রাগালে চলবে না। সানাহ্কে হাসানোই তার একমাত্র কাজ। ফারহান নরম গলায় একটু অধিকার খাটিয়ে বললো ‘ আরে আসো না। বিশেষ কথা আছে। ‘

সানার কি হলো কে জানে। ফারহানের এহেন নরম গলা শুনে কঠোর সানাহ্ও গলে গেলো। কোনো আপত্তি করতে পারলো না। নিঃশব্দে বারান্দার স্লাইড খুলে বারান্দায় এলো। বারান্দায় এসেই সানার চোখ কপালে উঠে গেলো। একি ফারহান তার বারান্দার বাহিরে ফোন কানে নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সানাহ্ চোখ দুটো গোলগোল করে ফারহানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো ‘ আপনি এখানে ? আপনি এত রাতে এখানে এসেছেন কোন দুঃখে ? ‘

‘ সব জানতে পারবে, আগে নিচে এসো। দুজনে মিলে একটা জায়গায় যাবো। ‘ ফারহান ফিসফিসিয়ে বললো।

‘ আরে আজব নিচে কি করে আসবো ? আমার বারান্দায় তো আর আপনার বারান্দার মত সিড়ি নেই। তাছাড়া মেইন গেট দিয়ে আসতে গেলে মা ধরে ফেলার চান্স আছে। ‘ সানাহ্ অবাক হয়ে বললো। ফারহানকে এই সময় সে এখানে মোটেও আশা করেনি।

‘ তার ব্যবস্থাও আমি করে রেখেছি। দেখো তোমার বারান্দার ডান দিকে মই লাগিয়েছি। ওটা দিয়ে নামো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমাকে চোখের সামনে না পেলে আমি কিন্তু তোমার ঘরে আসবো। তুমি কি চাও আমি সেটা করি ? ‘ ফারহান বললো।

‘ দাড়ান আসছি…. ‘ বলে সানাহ্ ফোনটা রেখে ঘরে চলে গেলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রাউজারের বদলে একটা জিন্স পড়ে এলো। পকেটে ফোনটা রেখে এবার মই দিয়ে নামতে শুরু করলো। কিন্তু অর্ধেক নামতে না নামতেই মই কাপতে শুরু করেছে। সানার ভয়ে হাত পা কাপছে। সে এখনও মাটির থেকে তিন চার ফুট উপরে আছে। এখান থেকে পড়লে মরুক না মরুক কিন্তু হাত পা ঠিকই ভাঙবে। সানাহ্কে থেমে যেতে দেখে ফারহান বললো ‘ থামলে কেন ? ‘

‘ নামতে পারছিনা কবি সাহেব, মই কাপছে। এখান থেকে পড়লে হাত পা আস্ত থাকবে না। ‘

‘ আরে ভয় নেই আমি আছি। তুমি আরেকটু নামো। যদি পুরোটা নামতে পারো তাহলে ভালো নাহলে পড়ার আগে ধরে নিবো। ‘

‘ আমি পড়ার আগেই কেন বলছেন পড়বো ? আপনি কি চান আমি পড়ে যাই ? ‘ কটমট করে বললো সানাহ্ ।

‘ আমি সেটা কখন বললাম ? আমি শুধু বলছি তুমি আমার ভরসায় নামো। বাকিটা আমি দেখে নিবো ‘ ফারহান অসহায় গলায় বললো।

‘ কিন্তু…. ‘

‘ কথা বলে সময় নষ্ট করো না সানাহ্। আমাদের কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আমি তো মই ধরেছি। তুমি নামো, আমি সামলে নিবো। ‘

ফারহানের কথায় আশ্বাস পেয়ে সানাহ্ সব ভয় দূর করে দিয়ে নামতে শুরু করলো। অবশেষে মই থেকে নেমে যখন হাফ ছেড়ে দাড়ালো তখন ফারহান ওর হাত টেনে বললো ‘ এই জন্যই বলেছিলাম কিছু হবে না। এখন তাড়াতাড়ি চলো। ‘

‘ কিন্তু আমরা কোথায় যাবো ? ‘ সানাহ্ অবাক হয়ে বললো। ওর মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না এত রাতে ফারহান তাকে নিয়ে কোথায় যেতে চাইছে। এত রাতে কোন জায়গা খোলা যে ফারহান যাবে।

‘ সে তো গেলে দেখা যাবে। এখন এত কথা না বলে চলো ‘ বলেই ফারহান সানার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। সানাহ্কে কোনো কথা বলারই সুযোগ দিলো না ফারহান। সোজা তাকে সিটে বসিয়ে তার সিটবেল্ট বেধে নিজেও ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। ড্রাইভিং সিটে বসেই গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি এখন ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের।

গাড়ি যখন এক ঘন্টা পর তার গন্তব্যে পৌঁছলো তখন সানাহ্ গাড়ি থেকে নেমে অবাক। সানাহ্ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না তারা নদী কিনারে এসেছে। জায়গাটা যে নদীর তীরে সেটা বুঝলেও কোন নদী সেটা বুঝেনি সানাহ্। নদীর তীরে আগে কখনও আসেনি সানাহ্। এতদিন শুধু তার মামণির নদীকে ঘিরে বিভিন্ন সুখকর স্মৃতির ছবি দেখেছে কিন্তু বাস্তবে কোনওদিন আসা হয়নি।

সানাহ্ গাড়ি থেকে নামতেই ফারহানও গাড়ির চাবি তার পকেটে রেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির পিছনের ডিকি খুললো। ডিকি খুলে সেখান থেকে একটা মাঝারি সাইজের হোয়াইট কালারের পলিথিন ব্যাগ নামালো। তারপর ডিকি বন্ধ করে সেই ব্যাগ হাতে নিয়ে সানার কাছে এসে দাঁড়ালো।

‘ ভালো লেগেছে ? ‘

হুট করে ফারহান কখন পিছনে এসে দাঁড়ালো বুঝতেই পারল না সানাহ্। সে তখন ব্যস্ত প্রকৃতির লীলাখেলা দেখতে। সময় এখন কত জানা নেই সানার। তবে সূর্যোদয় হতে এখনও বেশ দেরি। ফারহান আবারও জিজ্ঞেস করলো ‘ ভালো লেগেছে ? ‘

‘ খুব ভালো লেগেছে…. এটা কোন নদী ? আপনি জানেন আমি আগে কখনও কোনো নদী দেখিনি। আমার কখনও সেই সৌভাগ্য হয়নি। তবে আজ আপনার কারণে দেখলাম। আমি খুব খুশি কবি সাহেব। ‘ সানাহ্ আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল।

‘ এত খুশি হতে হবে না। এখনও অনেক কিছু বাকি আছে। তোমাকে খুশি করবো বলে সারা সন্ধ্যা লাগিয়ে খোজ নিয়েছি কোন নদীতে এলে ভালো হবে। আজকাল নদীর যা অবস্থা হচ্ছে। নদী বলে তো বাংলাদেশে কিছুই বাকি নেই। অনেক খোঁজ নিয়ে জানলাম শীতলক্ষ্যা নদীতে আসলেও আসা যেতে পারে। তাই টাকা দিয়ে মাঝি ঠিক করলাম সকাল আটটা পর্যন্ত। এখন আমরা নৌকায় উঠবো আর সেখান থেকে মাঝ নদীর কাছাকাছি যাবো তারপর বাকিটা সিনারি এভাবেই ইনজয় করবো। হবে না ? ‘ ফারহান হেসে সানার কাধ ঝাঁকিয়ে বললো।

‘ চলবে মানে.. দৌড়বে ‘ বলে হেসে দিল সানাহ্। আর ফারহান সানার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#প্রেমমানিশা(২৩)

‘ এই ঠান্ডায় আপনি আইস্ক্রিম খাবেন কবি সাহেব ? ‘

সানাহ্ অবাক হয়ে বললো কথাটা। এত শীতেও যে কেউ আইস্ক্রিম খেতে চাইতে পারে সেটা তার জানা ছিলনা। এই শীতে আইস্ক্রিম খাওয়া মানে নির্ঘাত সিজনাল ফিভার আর ঠান্ডায় ভোগা। কিন্তু এখন এই কথা ফারহানকে কে বোঝাবে ? সে তো নিজের জন্য আইস্ক্রিম এনেছেই সাথে সানার জন্যও এনেছে।

‘ আইস্ক্রিম খাওয়ার জন্য ঠান্ডা আর গরম মেটার করে নাকি ? আইসক্রিম তো যখন ইচ্ছা তখন খাওয়া যায়। আর শুধু আমি না তুমিও আমার সঙ্গে আইসক্রিম খাবে। আজকে দুজনে মিলে অনেকগুলো আইসক্রিম খাবো। ‘ ফারহান ব্যাগ থেকে দুটো আইস্ক্রিমের কাপ বের করে একটা সানাহ্কে দিল আরেকটা নিজে নিলো।

‘ অবশ্যই আইস্ক্রিম খাওয়ার জন্য ঠান্ডা গরম মেটার করে। এত ঠান্ডায় আইস্ক্রিম খেয়ে ঠান্ডা লাগানোর কোনো মানে হয় না। আইস্ক্রিম খাওয়া হবে না। আমি তো খাবই না আপনিও খাবেন না। এটাই ফাইনাল। ‘ সানাহ্ তেজী গলায় বলল। পাগলামির একটা লিমিট থাকে। কিন্তু ফারহান তো সেই লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

‘ তুমি না করছো সানাহ্ ? বিয়ের আগেই এভাবে কথা বলছো আমার সঙ্গে ? বিয়ের পরে তাহলে কি করবে ? এরকম করো না.. বরের কথা শুনতে হয়। ‘

ফারহানের কথা শুনে সানাহ্ আকাশ থেকে পড়লো। ফারহানের ব্যবহার ওর স্বাভাবিক লাগছে না। কেমন উদ্ভট ব্যবহার করছে কয়েকদিন ধরে। নাহ্ এই পাগলামিকে প্রশ্রয় দেওয়ার মানেই হয় না। ফারহান পাগলামি করলে যে তাকেও পাগলামি করতে হবে তার কোনো কারণ নেই।

‘ হ্যাঁ আমি না করছি। আর আমি আপনার সঙ্গে এভাবেই কথা বলবো। আজব তো ভুল করলে কি আপনাকে আমি আদর করবো ? আপনি ভুল করলে আলবাত আমি সেটা ধরবো। বিয়ের আগে হোক আর পরে আপনি ভুল করলে আমি সবসময় সেটা শুধরে দিবো। ‘

‘ ওকে ফাইন, আজই লাস্ট। এরপর আর কখনও এরকম করবো না। আমি এখন চাচ্ছি আজকের রাতটা যেন আমরা সুন্দর করে কাটাই। বিয়ের আগে আর কতদিনই বা আছে ? এই কয়টা দিন আমি তোমার সঙ্গে আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো কাটাতে চাই। তুমি আমার এইটুকু কথা রাখবে না ? ‘ ফারহান করুন গলায় বললো।

‘ কিন্তু…. ‘ সানাহ্ কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু ওদের কথার মাঝে মাঝি ভাই বললেন ‘ সাহেবের কথা শুইনা নেন ম্যাডাম। কত ভালোবাসা নিয়ে আপনারে অনুরোধ করতাছে। হক্কলে এমনে ভালোবাসবার পারে না। আপনি হের কথা শুনেন। হে আপনারে ভালোবাসে বইলাই বিয়ে ঠিক হওয়া সত্ত্বেও আপনারে নিয়ে কোনো হোটেলে না উইঠা এইখানে আইসে। আজকাল ছেলে মেয়েগো যা অবস্থা। নিজেগো স্বার্থ সিদ্ধি হলেই ছাইড়া যায়গা। সাহেব আপনারে বহুত ভালবাসে…. হের কথা শুনেন। ‘

মাঝির কথায় সানাহ্ বেশ অসস্তিতেই পড়লো। অসস্তির জেরে খানিকটা চুপ হয়ে গেলো। তারপর কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে দেখলো ঠিকই তো মানুষটা এত শখ করে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে যাতে একসঙ্গে সময় কাটাতে পারে অথচ সে তখন থেকেই না না করে যাচ্ছে। সানাহ্ কবে থেকে কথায় কথায় না না করা শিখল ? আগে তো করতো না।

‘ ঠিকাছে শুধু আজকের জন্য। এরপরে কোনওদিন অসময়ে এসব আনহাইজেনিক খাবার খাবেন না। এমনিতেই সন্ধ্যায় ওসব খেয়ে আমার শরীর বেহাল ‘

শেষের কথাটা খানিকটা বিড়বিড়িয়ে বললো যার কারণে কথাগুলা ফারহানের কানে পৌঁছানোর আগেই বাতাসে মিলিয়ে গেলো। সানার অনুমতি পেয়ে ফারহান খানিকটা এগিয়ে এসে সানার সঙ্গে হেলান দিয়ে বসলো। রাতের খোলা আকাশের নিচে বসে বসে প্রেমিকার সঙ্গে আইস্ক্রিম খাওয়ার মজাই আলাদা। তাও যদি সেটা শীতকাল হয় তাহলে তো কথাই নেই।

নৌকা তার অবস্থান নিয়েছে মাঝ নদীতে। নৌকার এক কোণায় বসে আছে মাঝি। আরেক দিকে নৌকার মেঝেতে শুয়ে আছে ফারহান। ফারহানের পাশেই সানাহ্ও গা এলিয়ে দিয়েছে নৌকার পাটাতনে। দুজনেই হাতে হাত রেখে রাতের আকাশ দেখতে ব্যস্ত। তাদের মাঝে থেমে থেমে চলছে মধুর সংলাপ। ফারহান সানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো ‘ এই যে দেখছো এই রাতটা । জানো এই রাতটা কার ? ‘

‘ কার ? ‘ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো সানাহ্। ফারহানের এই অদ্ভুত কথায় অবাক হওয়ার সাথে সাথে হাসিও পাচ্ছে সানার। হুট করে কবি ফারহান এখন প্রেমিক ফারহান হয়ে গেছে। প্রেমে মানুষ যেমন নেশায় ধরা মানুষের মত আবোল তাবোল বকে ফারহানও তাই বকছে। এই রাতটা কার মানে কি ? এটা আবার কেমন প্রশ্ন ?

‘ এই রাত তোমার আমার…. শুধুই আমাদের রাত। তুমি হয়তো খেয়াল করনি আমাদের দেখা হওয়ার দিন থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের যতবার কথা হয়েছে ততবারই বেশিরভাগ সময় রাত ছিল। বেশিরভাগ সময়ই আমরা রাতে কথা বলেছি। আমাদের যত সুখের স্মৃতি আছে সব রাতে তৈরি হওয়া, আর যত দুঃখের স্মৃতি আছে সেগুলোও রাতে তৈরি হওয়া। আর শুধু কয়েকটা দিন তারপর থেকে প্রত্যেকটা রাত তোমার আমার হবে। প্রতিটা ক্ষণ তোমার আমার হবে। ‘ ফারহান সানার হাতে আলতো চুমু খেয়ে বললো।

‘ আই উইশ তাই যেন হয় ‘ সানাহ্ও স্নিগ্ধ হেসে ফারহানের পাশে নৌকার পাটাতনে শুয়ে নির্বিঘ্নে কথাটা বলল সানাহ্।

রাতের স্নিগ্ধ পরিবেশ উপভোগ করতে করতে কখন যে সানাহ্ ঘুমিয়ে পড়েছিল সেটা বুঝতেই পারেনি। ঘুম ভাঙলো ফারহানের ডাকে। ফারহান সানাহ্কে মৃদু গলায় ডাকছে। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নৌকায় উঠে বসলো। ফারহানকে ডাকাডাকি করতে দেখে হাত ঘড়িতে একবার সময় দেখলো। একি এখনও আটটা বাজেনি অথচ ফারহান তাকে ডেকে তুলেছে।

সানাহ্ ফারহানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
সানার দৃষ্টি দেখে ফারহান সানাহ্কে ইশারা করলো সামনের দিকে তাকাতে। ফারহানের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি। ফারহানের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকাতেই সানার দৃষ্টি স্থবির হয়ে গেলো। কিছু বলার মত ভাষাই খুঁজে পেলো না সে। মাঝ নদী থেকে যে এত সুন্দর সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখতে পারবে সেটা তার জানা ছিল না। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য ! মনে হয় রং তুলিতে আঁকা কোনো চিত্র।

‘ এটাই আজকের মূল আকর্ষণ। আমি গেস করেছিলাম এরকম দৃশ্য হয়তো তুমি আগে কখনও দেখনি। তাই অনেক ভেবেচিন্তে তোমাকে এখানে এনেছি। এখন তোমার রিয়াকশন দেখে আমি শিওর আমার আন্দাজ ভুল ছিল না। আমি পেরেছি তোমাকে চমকে দিতে। তুমি চেয়েছিলে হঠাৎ হঠাৎ চিঠি লিখে আমাকে চমকে দিবে কিন্তু এর বদলে আমিই তোমাকে চমকে দিলাম। ‘

সানাহ্ যখন মুগ্ধ হয়ে সূর্যোদয় দেখছে তখনই কথাগুলো ফারহান। সানাহ্ তার কথা শুনে তার দিকে অশ্রু সজল চোখে তাকালো। সানাহ্কে কাদতে দেখে এক মুহূর্তের জন্য ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গেলো ফারহান। সে বুঝতে পারলো না সানার হুট করে কাদার কারণ কি। সে কি এমন করেছে যে সানাহ্কে কাদতে হলো ?
এবার সানাহ্ ফারহানকে আরও অবাক করে দিয়ে বললো ‘ আমাকে এখনই বাড়ি পৌঁছে দিন…. আমি বাড়ি যেতে চাই। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবো না। ‘

আচমকা সানার বিপরীতমুখী আচরণে ফারহান চমকে গেলো। কী এমন হলো যে সানাহ্ চলে যাওয়ার জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফারহান অবাক হয়ে বললো ‘ হঠাৎ কি হলো তোমার ? মন খারাপ তোমার ? হুট করে যেতে চাইছ কেন ? ‘

‘ আমার কিছু হয়নি। আমি শুধু এখন বাড়ি যেতে চাচ্ছি। আপনি দয়া করে আমাকে পৌঁছে দিন…. আর কোনোদিন নিজের জান্তে হোক আর অজান্তে আমার জন্য কিছু করবেন না। আমার মত মেয়েরা এসব ডিজার্ভ করে না। স্টোন হার্টেড মেয়েরা এসবের যোগ্য না। ‘ ফারহানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো সানাহ্।

এবার ফারহানেরও রাগের পারদ চড়লো। মেজাজ তার এখন আকাশচুম্বী। ইচ্ছা করছে এক চড় মারতে মেয়েটাকে তবে নিজেকে সামলে নিলো। থমথমে গলায় বললো ‘ এরকম এবনরমাল বিহেভ করার কারণ কি ? কী হয়েছে ? ‘

‘ হুম আমি এবনরমাল বলেই এবনরমাল বিহেভ করছি। আপনি প্লিজ আমাকে পৌঁছে দিন। আমি এখানে থাকতে চাচ্ছি না। আপনি যদি এখন আমাকে পৌঁছে না দেন তাহলে আমি মাঝ নদীতে ঝাঁপ দিবো ফারহান। জিনিসটা কি আপনার জন্য ভালো হবে ? আপনি হয়তো জানেন না কিন্তু আমি সাঁতার জানিনা। ‘ সানাহ্ কান্না ভেজা গলায় বললো।

‘ বাহ্ এত তাড়াতাড়ি কবি সাহেব থেকে ফারহান হয়ে গেলাম ? ওয়েল আমি তোমাকে পৌঁছে দিবো আর সেটা এখনই। কিন্তু আমি অপেক্ষা করবো। অপেক্ষা করবো তোমার আমার কাছে ফিরে আসা পর্যন্ত। আমি যেমন তোমার এবনরমাল বিহেভিয়ার ডিজার্ভ করি তেমনই নরমাল বিহেভিয়ারও ডিজার্ভ করি। আই ডিজার্ভ ইউর ইচ অ্যান্ড এভরিথিং। ‘ কথাগুলো শক্ত গলায় বলেই ফারহান মাঝিকে বললো নৌকা আবার তীরে ফিরিয়ে নিতে।

বাড়ি থেকে যেভাবে বেরিয়েছিল সেভাবেই আবার ফিরে এলো সানাহ্। আজ এখনও কেউ উঠেনি কিন্তু সানার মা মিসেস কায়নাত রান্নাঘরে কাজ করছেন। সকাল সকাল উঠে উনার সানার ঘরে উকি দেওয়া সানার পছন্দ না বলে সানাহ্ ঘরের দরজা বন্ধ করেই ঘুমোয়। এছাড়াও মিসেস কায়নাত নিজেও মেয়েকে বিরক্ত করতে চাননা বলে মেয়ের ঘরে উকি দেননা।

ঘরে ফিরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল সানাহ্। মন তার ভারাক্রান্ত। সে পরিস্কার বুঝতে পারছে এরকম চলতে থাকলে ফারহানের প্রতি তার দূর্বলতা প্রকাশ পেতে দেরি হবে না। কিন্তু সে যে এখনই চায়না তার দূর্বলতা প্রকাশ করতে। সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেই সময়ের আগে কোনোকিছু করা মানে পরিস্থিতি বদলানোর মত ভয়াবহ কাজ করা। আর সানাহ্ চায়না তার ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বদলাক। সময় যখন আসবে তখন জীবনের গতিপথ জীবন নিজেই ঠিক করে নিবে।

সানাহ্ বিছানা ছেড়ে উঠলো। ঠিক করলো এখন আগে গোসল করবে। গোসলে ঢোকার আগে অতসীকে ম্যাসেজ দিয়ে বললো বিশ মিনিট পর যেন তার রুমে এসে হাজির হয়। সকাল সকাল গোসল করে কলেজ গেলে মাথা এত গরম হবে না। কলেজ যেতে এখনও দেরি আছে কিন্তু সানাহ্ এখনই গোসলটা সেরে নিল। মেয়ে মানুষের চুল শুকাতে যে সময় লাগে এত সময় হয়তো গরু দিয়ে ক্ষেতে হাল চাষ করতেও লাগে না।

ভেজা চুল পিঠের উপর ছেড়ে দিয়ে ডেস্ক টেবিলের চেয়ারে বসলো। একটা সুন্দর সাদা কাগজ বের করলো। কাগজে প্রথম লাইনেই লিখলো ‘ শ্রদ্ধাস্পদেষু কবি সাহেব ‘ । ফারহানকে সে এখন চিঠি লিখবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো চিঠিটা এখনই দিবে না। আজ থেকে প্রতিদিন একটা করে চিঠি লিখবে। তারপর সবগুলো জমিয়ে ওদের বিয়ের পর এক বিশেষ দিনে দিনে। নাহ্ বাসর রাতে দিবে না। তাদের বিয়ের ছয়মাস পূর্তি হলে দিবে।

স্বার্থের পৃথিবীতে কেউই স্বার্থ ছাড়া জন্মায়নি। সকলেরই কোনো না কোনো স্বার্থ থাকে। তারা নিজেদের স্বার্থেই অন্যকে ভালবাসে, অন্যকে আগলে রাখে। আবার অনেকে নিজ স্বার্থেই অন্যের কাছে আগলে থাকে। সানাহ্ও তাদের ব্যতিক্রম নয়। সেও নিজ স্বার্থেই ফারহানের কাছে থাকতে চেষ্টা করে। তার নিজ স্বার্থেই দরকার ফারহানের মত এক কঠিন, নিরাপদ ছত্রছায়ার।

ফারহানকে চিঠি লিখে উঠলো সানাহ্। চিঠিটা আলমারির ডান দিকের পাল্লা খুলে ড্রয়ারে রেখে ড্রয়ারে চাবি দিয়ে দিলো। এখন চিঠিটা সেফ। ওই ড্রয়ারে আরও কিছু চিঠি আছে যেগুলো সিলেট থাকাকালীন লিখেছিলো সানাহ্। এইসব চিঠিই একদিন একসঙ্গে করে ফারহানকে দিবে। সেদিন হবে তাদের জীবনের সবথেকে সুন্দর দিন।

সানাহ্ যখন তার ভাবনায় মশগুল তখনই ওর কানে কারোর দরজায় নক করার শব্দ এলো। সানাহ্ মৃদু গলায় বললো ‘ কাম ইন ‘ । সানার আদেশ মেনে ঘরের দরজা খুলে ঘরে উকি দিলো অতসী। দেখলো সানাহ্ চুল ছেড়ে চলন্ত ফ্যানের নিচে দাড়িয়ে চুল শুকাচ্ছে। গুটিগুটি পায়ে সানার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো অতসী। হাত বাড়িয়ে সানার ভেজা চুলগুলো ঝেড়ে দিতে লাগলো। সানাহ্ বুঝতে পেরেও কিছু বললো না, নিজের হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে বোনের সেবা উপভোগ করতে লাগলো।

‘ আপাই তুই ডেকেছিলি ? কোনো দরকার ছিলো ? ‘ সানার চুলের পানি ঝেড়ে দিয়ে সানার ঘরে থাকা বিন ব্যাগে বসে বললো অতসী।

‘ কেন দরকার ছাড়া তোকে ডাকতে পারিনা ? সবসময় দরকার হলেই ডাকতে হবে ? নাকি এটা তোর এথিক্স যে কেউ দরকার ছাড়া ডাকলে আসবি না। ‘ সানাহ্ থমথমে গলায় বলল। তার রাগ হচ্ছে। কেন এ বাড়ির সবাই মনে করে তাকেই সবার প্রয়োজন। সবার কি তাকে প্রয়োজন হতে পারে না ? সে কি কারোর প্রয়োজনের গন্ডিতে পড়ে না ?

‘ নাহ্ অবশ্যই ডাকতে পারিস। আসলে এমন সময় ডাকিস নাতো তাই। ‘ অতসী মিনিমিনিয়ে বললো। তার আপাই যে রেগে যাচ্ছে । তাকে শান্ত করার জন্যই এই চেষ্টা।

‘ প্রয়োজনের কোনো টাইম টেবিল নেই অতসী। প্রয়োজন যখন তখন দেখা দিতে পারে। যাই হোক এই চেকটা নে,ব্যাংকে গিয়ে টাকাটা তুলে জালাল সাহেবের এনজিওতে দিবি। ‘ বলেই সানাহ্ আলমারি থেকে নিজের সই করা একটা চেক নামিয়ে অতসীর সামনে ডেস্কের উপর রাখলো।

সানার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলো অতসী। তোতলাতে তোতলাতে বললো ‘ না..মা…মানে…. আমি এত টাকা দিয়ে কি করবো ? তু..তুই আমাকে এত টাকা দিচ্ছিস কেন ? ‘

‘ কেন দিচ্ছি সেটা তুই ভালো করেই জানিস অতসী। তুই মনে করিস তুই কি করিস সেটা আমি জানিনা ? তুই যে অনেক বছর ধরেই জালাল সাহেবের এনজিওর সঙ্গে যুক্ত আছিস সেটা আমার জানা। তোর প্রত্যেকটা স্টেপের খবর আসে আমার কানে। আর তুই আমার থেকে লুকাচ্ছিস কেন ? আমি কি তোকে কিছু বলেছি না মেরেছি ? এটা কি কোনো খারাপ কাজ যে তোকে এরকম হেড ডাউন করতে হবে। আমি এখনও অতটা বদলে যাইনি যে ভালো কাজকেও খারাপ বলে অভিহিত করবো । টাকাটা নে। ‘

সানার কথা শুনে অতসী চোখ তুলে সানার দিকে তাকালো। ওর আপাই যে ওকে এতটা ভালোবাসে সেটা জানা ছিলনা অতসীর । সানাহ্ বরাবরই অতসীর সামনে এহেন ভাব ধরতো যেন অতসী মরে গেলেও সানার কোনোকিছুই যায় আসেনা অথচ ওর পিছনে লোক লাগিয়ে রেখেছে যাতে ওর প্রত্যেকটা কাজের খবর পায়। সানাহ্ ওকে যতই ভালোবাসুক টাকা কি করে নিবে ও ? অতসী বললো ‘ না মানে আপাই, টাকা লাগবে না। আমি ম্যানেজ করে নিবো। তুই কেন তোর টাকা দিবি ? ‘

‘ টাকা লাগবে কি লাগবে না সেটা ভাবার কাজ তোর না। আমি যখন তোকে টাকা দিচ্ছি তখন তুই টাকাটা নিবি আর এনজিওতেও দিবি। টাকাটা তো আমার একাউন্ট থেকে যাচ্ছে তাই আমার মনে হয় না এতে তোর কোনো প্রবলেম হওয়ার কথা। ব্যাস, আমি আর কথা শুনতে চাচ্ছি না। চেকটা নিয়ে বিদায় হ। ‘

সানার কথা ফেলতে পারল না অতসী। নীরবে চেকটা হাতে তুলে নিল। নিঃশব্দেই বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু কিছু একটা মনে করে আবার ফিরে এলো। চট করে সানার গালে একটা চুমু এঁকে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। আচমকা এসবে সানাহ্ অবাক হলো না। তার অতসীর স্বভাব জানা আছে। অতসীকে সানাহ্ যখনই তার কাঙ্ক্ষিত কিছু দেয় তখনই এরকম করে টুকুস করে সানার গালে চুমু দিয়ে পালিয়ে যায়। সানার কথাটা মনে পড়তেই মৃদু ঝংকার তুলে হেসে উঠলো।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্…..