ফেইরিটেল পর্ব-৩৩+৩৪+৩৫

0
727
ফেইরিটেল
গল্পেরমহল ধারাবাহিক গল্প

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–33

রাস্তার ধারেই গাড়ি পার্ক করা আছে। বিশাল বড় ভবনের পাশে৷ ইমান শপিংমলের পেছন সাইডে আইসক্রিম শপের সামনে গাড়ি থামিয়েছে৷ সে নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। এরপর ড্রাইভিং সীটের পাশের সীটটার দরজা খুলে দিয়ে বলে, “আসো।”

মিরা চোখ-মুখে তখনো রক্তিম আভা ফুটে আছে৷ চোখে নোনাপানি টলমল করছে। অথচ ইমান নির্বিকার। তাকে জোর করে হলেও আইসক্রিম খাওয়াবে৷ কি আশ্চর্য! এতোবড় একটা বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছে৷ এই মূহুর্তে কে এমন শপে এসে উৎসবের আমেজ নিবে? ছেলেটা দিন দিন গাধা হয়ে যাচ্ছে৷

এবারে ইমান দরজার ভেতর দিয়ে নিজের শরীর এগিয়ে এনে নিজ গরজে সীটবেল্ট খুলে তাকে টেনে বের করে।

মিরার সামনে আবারো দৃশ্যমান হলো আইসক্রিম শপটা।শপটা না একচুয়ালি! বিরাট বড় স্ক্রিনে বেশ ডিজাইন করে বড় করে, উজ্জ্বল করে লেখা, “Carvel” এই শপের নাম আগে কোনদিন শুনেনি মিরা। তবে ভেতরে না ঢুকেই অনুমান করা যাচ্ছে এটা খুব বিখ্যাত কোন দোকান। কাঁচের দেয়ালে “ওপেন” লেখা। অর্থাৎ শপ এখন খোলা আছে।

ইমান আবারো তার হাত ধরে এরপর আস্তে করে আগাতে থাকে। হাতে টান লাগায় সে আরেকবার পেছনে ফিরে৷ মিরা তখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে৷ ইমান ভ্রুকটি করে তাকায় এরপর নিজে দু’কদম ফিরে এসে বলে, “তোমার উপর কিছু চাপাতে চাই না আমি। এই সংসার, আমাদের বিয়ে, মিথ্যা ভালোবাসা সব ভুলে যাও আজকের জন্য। ইনফ্যাক্ট শুধু আজকের জন্য না। যতোদিন তুমি ট্রমা থেকে বের হচ্ছো না ততোদিন আমাকে প্রতারক স্বামী হিসেবে না দেখে, বরং ট্যুর গাইড হিসেবে দেখতে পারো। ইনজয় ইউর ডেস ইন নিউইয়র্ক। শাহরুখ খানের একটা ডায়লগ আছে, ” কাল হো না হো” আগামীকাল আমাদের জীবনে আসবে কীনা কে জানে। ইটস আনসারটেন।”

মিরা তার পানে তাকালো। ইমান খুব সুন্দর করে হাসল। সে হাসলে তার করাত দাঁতটা ঝিলিক মেরে উঠে। ভালো লাগে দেখতে। ব্লু শার্টটা গায়ে মানিয়েছে বেশ৷

মিরা বলে, ” আমরা এখন কোথায়?”

–” মানহাতানে। আর আপাতত ম্যাচি’স হেরাল্ড স্কয়ারের সামনে। ওইপাশে মেইন গেইট। আমি পেছন দিক দিয়ে এসেছি জন্য বুঝতে পারছো না৷ এইটা নিউইয়র্কের অন্যতম বৃহম মল। ভেতরে ঢুকলেই বুঝতে পারবে৷ ”

মিরা আশপাশে তাকালো। বিদেশের রাস্তাগুলোও ভারী সুন্দর। এ জায়গায় ভালোই ভীড়। এখন মনে হচ্ছে এদেশে মানুষ বাস করে!

ইমান তাকে নিয়ে বৃত্তাকার পথে ঘুরে একদম এন্ট্রি পয়েন্টে আসলো। গেটের সামনেই একটু উপরে লেখা, “The World’s largest Store.” একটা স্টার চিহ্নের লোগোও সেটে দেওয়া আছে পোস্টারের ওইদিকে। থ্রি ডাইমেনশনে।

মিরা সামান্য বিষ্মিত হয়ে তাকালো। আসলেই কী এটা সবচেয়ে বড় স্টোর? বিশ্বাস হচ্ছে না।এরচেয়ে তো আমাদের গাউছিয়া-নিউমার্কেটে ভীড় বেশি থাকে!

ইমান তাকে নিয়ে মলের ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে যেতেই মিরার চোখ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। এতো বিশাল হবে এটা বাইরে থেকে সে কল্পনা করেনি৷অতিরিক্ত আলোয় সবকিছু ঝলমল করছে। চোখ ধাধা খেয়ে যাচ্ছে।

ইমান তাকে নিয়ে সিড়ি বেয়ে সাততলায় উঠে। সিড়ি দিয়ে উঠার সময় মলটার এক অংশ তার চক্ষু দিয়ে দেখা হলো। তারা সপ্তম ফ্লোরে অবস্থিত কার্ভেলে ঢুকলো। মিরার একটা জিনিস ভালো লাগলো যে ইমান লিফট দিয়ে উঠেনি। সত্যি বলতে মিরা আর জীবনেও লিফটে উঠবে না৷

কার্ভেলে ঢোকামাত্র এসির হীম বাতাসে ঠাণ্ডা অনুভুতি হলো। এখানকার সবখানে এসির টেম্পারেচার অনেক কমানো থাকে কীনা কে জানে! আশ্চর্যজনক ভাবে শপটা সাততলায়। মিরা ভেবে পেল না সে গাড়ির ভেতর থেকে সাততলায় অবস্থিত এই দোকান কীভাবে দেখলো? অবশ্য সর্বপ্রথম এ দোকানের পোস্টার সে গাড়ির মিররের রিফ্লেক্ট দেখে অনুমান করেছিল ইমান তাকে আইসক্রিম খাওয়াতে এনেছে৷

তারা প্রবেশ করতেই একজন ওয়েটার হাসিমুখে এসে তাদের অভ্যথর্না জানায়। ইমান হেসে বলে, ” আমাদের কর্ণারের একটা টেবিল দিন।”

সে হতভম্ব হলো ইমানের কথায়৷ ওর বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নেই? অসভ্যতা এখনো কমেনি? কীভাবে ওয়েটারকে ডেকে বলে কর্ণারের টেবিল চাই। বেশরম ছেলে! একটু আগেই বলল,তাকে স্বামী হিসেবে ভাবতে না৷ অথচ কর্ম তো লুচ্চা বয়ফ্রেন্ড থেকেও অধমে!

মিরা কটমট করে বলে, ” আমি কর্ণারের টেবিলে বসব না। একদম মাঝে বসব৷ আর আপনি মোটেও আমাকে স্পর্শ করবেন না। এই অধিকার বিয়ের রাতেই হারিয়ে ফেলেছেন।”

ইমান বিষ্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকালো। পুরা ব্যাপারটা ধাতস্থ করতে সে সময় নিল। এরপর হেসে বলে, ” বেশ৷ মাঝের ওই ফুলদানীর পাশের টেবিলে গিয়ে বসি৷ আসো।”

ইমানের শান্ত স্বভাবটা ভালো লাগছে। আগের সেই রগচটা অভ্যাসগত আচরণ আপাতত এই মূহুর্তে আর করছে না। বরং শান্ত, নরম সুরে কথা বলছে সবসময়। গলার স্বরে বিন্দুমাত্র শ্লেষ নেই৷ তারা চেয়ারে বসতেই ইমান ইচ্ছা করে তাকে খচা মেরে বলে, ” তুমি কী ভেবেছিলে আমি তোমাকে নিয়ে কর্ণারের টেবিলে বসে ওইসব আজেবাজে কিছু করব?”

মিরা একবার চোখ পাকিয়ে তাকালো। ইমান মেন্যু কার্ডে চোখ বুলাতে বুলাতে হেসে দিয়ে বলে, “তুমি এখনো ম্যাচুউর হওনি৷ বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছি।”

কথাটা শেষ হওয়ার পর তারা দুইজনই দুজনের দিকে তাকালো। বেশ বিব্রতকর অবস্থা। তাদেরকে উদ্ধার করতে ওয়েটার আসল অর্ডার নিতে৷ ইমান নিজের সব মনোযোগ অর্ডার দেওয়ায় ঢেলে দিল৷ ওয়েটার যাওয়ার পর ইমান বলে উঠে, ” তুমি জুইকে সত্যটা বলোনি কেন?”

মিরা ঠাওর করতে পারলো না কাকে সে কোন সত্য বলেনি? ক্ষণেই মনে পড়ে গেল, জুইয়ের কথা৷ নতুন পরিচয় হওয়া জুই জানতে চেয়েছিল সে ইমানের কে হয়? যদিও বা প্রশ্নটা ইমানকে করা হয়েছিল কিন্তু জবাব সে দিয়েছিল।

মিরা বলে, “আমি কাউকেই কিছু বলিনি।”

— “সেটা তো দেখতেই পারছি৷ কিন্তু কেন? তুমি চাইলেই আমার বাসায় সব সত্য বলে দিতে পারতে।”

— “যে কথাটা আপনি বলেননি সে কথাটা আমার মুখ থেকে বলা শোভা দেয়না। আমি নিজ থেকে আপনার পরিবারের কাউকেই সত্যটা কোনদিন বলব না৷ ”

–” তুমি কী আমার উপর অভিমান করে আছো?”

— ” আপনার উপর অভিমান করার অধিকার আমি নিজেকে দিইনি।”

— বাব্বা। আজকাল দেখছি তুমি অধিকার নিয়ে অনেক সোচ্চার।”

মিরা অন্যদিকে তাকালো। রেস্টুরেন্টে আরো অনেকেই আছে। চারটা টেবিল বুকড। একটা টেবিলে কাপল বসেছে৷ তারা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে চু*মু খেল। তা দেখে মিরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে তব্দা খেল। ইমানের বেশ হাসি পেল৷

ওয়েটার আইসক্রিম নিয়ে আসলো। ইমান সবার আগে নিজে খাওয়া শুরু করল। যদিও সে আইসক্রিম-চকলেট খায়নি৷ কিন্তু মিরার নাকি সবচেয়ে প্রিয় আইসক্রিম এইজন্য এখানে আসা৷ এখানকার আইসক্রিম বেস্ট। অবশ্য এই বেস্ট রেটিং সে দেয়নি। জুইয়ের রিকমেন্ডেশন এটা৷ মিরা তাকে দেখে চামচে করে আইসক্রিম মুখে দিল। তার কাছে বেশ মজা লাগলো। বাটার স্কচের সঙ্গে চকলেটের একটা ফ্লেভার পাচ্ছে সে।

ইমান বলে, “কালকে সোনালী আপুর সঙ্গে কথা হয়েছে৷”

মিরা চোখ তুলে তাকালো৷ ইমান বলে উঠে, “তুমি জানো বাসায় সবাই তোমার জন্য কত দুশ্চিন্তা করছিল? এভাবে না বলে আসাটা কিন্তু বাচ্চামো।

–” সোনালী আপু আপনাকে সব বলে দিয়েছে?”

–” মোটামুটি ভাবে সব জানি। আসলে আমি তোমাদের সম্পর্কে কিছু জানতাম না। যোগাযোগ ছিল না বিধায় তোমরা যে আলাদা থাকছো এটা জানি না৷”

–” মা রাগ করে মামা বাসায় শিফট হয়েছে আমাদের নিয়ে।”

–” ভালো করেছে। আগেই এমনটা করা উচিত ছিল।”

মিরার মুখটা ভার হয়ে আসল। তা দেখে ইমান চুপ মেরে যায়। আজকে এইসব কথা উঠানো ঠিক হবে না৷ মেয়েটার সঙ্গে পরে ধীরে-সুস্থে কথা বলতে হবে।

আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে ইমান বলে, “আমাদের লাঞ্চ করা উচিত ছিল৷ এসময় কে আইসক্রিম খায়।”

মিরা বলে, ” আপনার আম্মু আমার জন্য আজকে স্পেশাল ডিশ করবে দুপুরে৷”

ইমানের মুখ কঠিন হয়ে আসে৷ সে নিজেকে সামলিয়ে বলে, “আমার মা বহু আগেই গত হয়েছে। তুমি কার কথা বলছো?”

মিরা সামান্য চমকে উঠে বলে, “আপনার স্টেপ মাদার আরকি।”

–” নিজের মা আর স্টেপ মায়ের মধ্যে তফাত আছে৷ হুট করে আপনার মা বলাটা বিভ্রান্ত সৃষ্টি করে৷ ”

–” কিন্তু…….. ”

–” নেক্সট হলিডিতে সাদকে নিয়ে ডিজনি ল্যান্ডে যেতে পারো৷ চল এখন বাসায় যাই। তোমার রেস্ট নিতে হবে৷ মেডিসিনও নিতে হবে। লেটস গো৷”

_______________

তারা বাসায় যখন পৌঁছে তখন লাঞ্চ আওয়ার। সাদ আর হাসনাহেনা ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছিল। তাদের আসতে দেখে সাদ খুশি হয়ে বলে, ” তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একসঙ্গে লাঞ্চ করব। কাম৷”

হাসনাহেনাও যোগ দিয়ে বলে, ” আজকে মেক্সিকান একটা ডিশ করেছি। চিকেনের একটা প্রিপারেশনও আছে৷ ওটা অবশ্য তুর্কি স্টাইলে বানাবো। আসো মিরা৷ সেকি তোমার কপালে কী হয়েছে?”

মিরা টেবিলে বসে বলে, ” দুর্ঘটনার কবলে পড়ে গিয়েছিলাম৷”

ইমান কখনোই বাসায় খায় না। তাই ডাইনিং রুম অতিক্রম করে যেতে ধরলে, হাসনাহেনা বলে উঠে, ” তুমি উপরে কেন যাচ্ছো? খেয়ে যাও।”

আজকে ইমান মিরার সামনে ঝামেলা করল না৷ টেবিলে মিরার পাশে বসল। মিরা শর্টকাটে সবটা বলল। হাসনাহেনা বলে, ” আল্লাহর রহমত তোমার কিছু হয়নি৷”

তারা নিঃশব্দে খেয়ে উঠে৷ মিরা খেয়ে উপরে উঠে যায়৷ ইমানের খাওয়া শেষ হয়নি৷ সে টাইম নিয়ে ফোন চালাতে চালাতে খাবার চিবাচ্ছে৷

হাসনাহেনা বলে, “খাওয়ার সময় ফোন চালাতে হবে? ”

ইমান উঠে পড়ে। তার প্লেটে খাবার বাকি ছিল। সেগুলো আর খেল না৷ উপরে উঠে দেখল মিরা আজকেও ডিভানে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে৷ এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে কেউ কীভাবে ঘুমাতে পারে?
ইমান তাকে পাজো কোলে তুলে বেডে শুইয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে দিল। এরপর নিজে গোসল করতে বাথরুমে ঢুকে৷

খানিকক্ষণ পর সে খালি গায়ে বের হলো বাথরুম থেকে। আসলে গেঞ্জি সঙ্গে নিতে ভুলে গিয়েছিল। রুমে মিরা ঘুমাচ্ছে ভেবে সে বের হয়৷ কিন্তু মিরা তখন ঘুম থেকে উঠে বসে আশেপাশে তাকাচ্ছে। তাদের চোখাচোখি হতেই ইমান বেশ বিব্রতবোধ করে। এখনই ওর ঘুম ভেঙে উঠে বসতে হলো৷

মিরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, ” আমি না ডিভানে ছিলাম। বেডে আসলাম কীভাবে? ”

ইমান কাবার্ড থেকে গেঞ্জি বের করে পরিধান করে বলে, “আমি কীভাবে জানব? ”

— “মানে এটা কিভাবে পসিবেল?”

— ” আমি রুমে এসে তোমাকে এই জায়গায় দেখেছি।”

–” কিন্তু আমি ডিভানে ছিলাম। ক্লিয়ারলি মনে আছে৷”

–” তাহলে মনে হয় ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে এসেছো৷ আই মিন স্লিপ ওয়াক।”

মিরা হা হয়ে গেল। সে স্লিপ ওয়াক করে! মাই গড! কী ভয়ংকর রোগ! যদি সে ঘুমাতে ঘুমাতে বাইরে বের হয়ে যায়?

চলবে৷

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–34

ইমান ঠোঁটে টিপে হাসছে। বহু কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে৷ হাসির চাপে রাখায় মনে হচ্ছে পেট ফেটে যাবে৷

মিরার ফেস দেখে মনে হচ্ছে সে হিসাব কষছে। ঘুমের মধ্যে হাটার জটিল হিসাব যার সমীকরণ সে মিলাতে পারছে না৷

ইমান গলা ছেড়ে বলে, ” যারা বেশি বেশি খায়, তারা স্লিপ ওয়াক করে।”

মিরা তার দিকে ছোট করে তাকালে, সে সিরিয়াস মুড নিয়ে বলে, “সত্যি বলছি।”

এরপর ফোন নিয়ে হাঁটা দিল। একটু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফিরে এসে বলে” আর এক শ্রেণির মেয়েরা স্লিপ ওয়াক করে।”

–“কারা?”

–” সুন্দরী কিন্তু ডাফর।”

মিরা রাগান্বিত চোখে তার দিকে তাকালো। ইমান এমন একটা ভ্যান ধরল যেন সে কিছুই বলেনি। ফোন হাতে নিয়ে রুমের শেষ প্রান্তে চলে গেল। ওদিকে বারান্দা আছে। মিরা ওইদকে আসা অব্দি একবারও যায়নি৷ দোতলার অর্ধেক জায়গা জুড়ে ইমান থাকছে। এটা যেন ওর নিজস্ব রাজ্য। ছোট খাটো একটা সংসার আছে এখানে। দুই রুম মিলে বিশাল একটা রুম বানালো হয়েছে। এই রুমটা যে আর্কিটেক্ট ডিজাইন করেছে সে চমৎকার একটা প্লান দিয়েছে৷ দুটো রুম মিলে তৈরি রুমটাতে একবারের জন্যও মনে হয় না অতিরিক্ত জায়গা পড়ে আছে। স্পেস বেশি। মাঠের মতো লাগে। বরং মনে হবে রুমটা এমন না হলেই বাজে দেখাত৷ আচমকা মিরার মাথায় একটা একটা চিন্তা খেলে যায়। তারা যে হাসবেন্ড-ওয়াইফ এটা শুধু তারা দুজন জানে৷ কিন্তু বাসার অন্য সদস্যরা তো কিছু জানে না। তারা কী ভাবছে? একসঙ্গে, একরুমে থাকাটাকে বাকা চোখে দেখবে না? তাকে খুব বাজে মেয়ে ভাবছে কী?

সে একটু জোরে করে বলে, ” এই যে শুনুন?”

ইমান ততোক্ষণে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷ মিরার ডাকে ঘার ঘুরালো। এবং ভাবলেশহীন ভাবে বলে, “আমার নিজের একটা নাম আছে৷ কাইন্ডলি আমার নাম ধরে ডাকুন।”

মিরা বিরক্তিতে চ বর্ণ উচ্চারণ করে বলে, ” যতোসব ঢং৷”

ইমান শুনতে পায়নি। সে বারান্দা থেকে বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।এরপর বলে উঠে, ” বলেন।”

মিরা সামান্য ভ্যাবাচেকা খেল। হুট করে তাকে আপনি বলাটা হজম হচ্ছে না৷ মনে হচ্ছে তিরিস্কার করছে।

সে বলে উঠে, ” আমরা যে একরুমে থাকছি আন্টি কি ভাববেন? আমি কিন্তু কাউকেই কোনদিন বলব না আমাদের সম্পর্কের কথা৷”

শেষ বাক্যটা কর্ণকুহর হওয়া মাত্র ইমান সামান্য নড়েচড়ে উঠে৷ এরপর আবারো ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বলে, ” আমাদের একসঙ্গে থাকা তো পাপ না৷ সুতরাং কে কী ভাববে সেটা দিয়ে তোমার কী কাজ?”

— “তারপরও আন্টি……..”

— ” আমার সঙ্গে না থাকলে আর কই থাকবে তুমি? হলরুমে? এদেশে সার্ভেন্টরাও হলরুমের ফ্লোরে থাকে না। এক্সট্রা কোন রুম নাই আমাদের। সাদের রুমে নিশ্চয়ই থাকবে না। তোমার আন্টির এত প্রব্লেম হলে বল তোমাকে ওনার রুমে নিয়ে যেতে। এরপর আব্বু আর ওনার মাঝখানে ঘুমাইও।”

ইমানের কথা শুনে মিরার চোখ বড় হয়ে আসে৷ সামান্য একটা কথাকে কি বিশ্রিভাবে বললো!

এরপর ইমান বলে, ” সবাই জানে আমার রুমটা আমার মনের মতো বিশাল। চোখে দেখো না কতবড় আমার রুম! পর্দা টেনে দিলে দুটো আলাদা রুম মনে হবে৷

মিরা হতভম্ব হয়ে বলে, ” এ রুমে পর্দা টানতে তো একবারও দেখলাম না৷”

ইমান হাত দিয়ে দেখালো ওইযে পর্দা গুজে দেওয়া আছে৷ পর্দা দেখার জন্য সে উঠে দাড়ালো। এবং পর্দা দেখে মিরা অভিভূত হলো। এটাকে পর্দা বলে? সাদা ফিনফিনে কাপড়ের মেটেরিয়াল। দিলেও যা না দিলেও তাই। ওপাশ থেকে এপাশ সব ক্লিয়ারলি দেখা যাবে৷ মিরা কটমট করে তাকায়।

ইমান ফোন পকেটে রেখে বলে, “সাদ বলছিল তোমাকে নিয়ে বিকেলে বাইরে যাব। রেডি থাকবে। আমি অফিস যাচ্ছি।”

সে বেরিয়ে গেল এক সেকেন্ডের ব্যবধানে। মিরার জানতে ইচ্ছা করল ইমানও যাবে কীনা তাদের সঙ্গে। কিন্তু সংগত কারণে জিজ্ঞেস করেনি এবং কিছু জিজ্ঞেস করার টাইমও পায়নি সে।

সে একবার পরখ করে রুমটা দেখল। এরপর রুমের মধ্যখানের এককোণে গুজে রাখা পর্দা টেনে দিয়ে ডিভানে গিয়ে শুলো। এটা তার রাজ্য৷ ওটা ইমান সাহেবের রাজ্য৷ এদিকে সে ইমানকে আসতে দিবে৷ হুট করে চোখে একগাদা ঘুম চলে এলো। ঘুমু ঘুমু অবস্থায় তার মনে হলো কেউ তার চুলে হাত বুলাচ্ছে। সে চোখ মেলতে চাইলে কারো উষ্ণ হাতের ছোয়া তার চোখে অনুভব হলো। তার চোখ বন্ধ করে দিয়েছে। চোখ খুলতে পারলো না সে। ঘুমের সাগরে সে তলিয়ে গেল৷

_____________

বিকেলের দিকে রুমের দরজায় ঠকঠক শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল৷ সে উঠে বসে। এরপর রুমের দরজা খুলতেই সাদকে দেখতে পেল। সাদ তাকে দেখে বলে, “তুমি রেডি হওনি? ভাইয়া তোমাকে কিছু জানায়নি?”

–” জানিয়েছে৷ আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সর‍্যি।”

— হেই ডোন্ট সে সর‍্যি। তুমি একটু নিচে আসবে৷ মাম্মা তোমাকে ডাকছে৷”

মিরার মনটা ভালো হয়ে গেল। কত ভালো একটা ছেলে সাদ। অথচ ওর বড়ভাই কীনা ওমন রাক্ষস! সে সাদের সঙ্গে নিচে নেমে আসলো। হলরুমে হাসনাহেনা স্যুটকেস বের করেছে৷ সেটা মেয়েদের জামাকাপড় দিয়ে ভর্তি৷ মিরা বলে, ” আন্টি, আমাকে ডেকেছেন? ”

হাসনাহেনা স্যুটকেস থেকে একটা জিন্স আর টপস বের করলেন। টপসটা খুব সুন্দর। ক্রিম কালারের৷

উনি বললেন, “আজকে তেমন শীত নেই৷ এটা পরতে পারো৷ আমার তো কোন মেয়ে নাই৷ কে পরবে এসব! খুব শখ ছিল একটা মেয়ে হবে৷ যাইহোক তোমরা নাকী ঘুরতে যাচ্ছো, এটা পরে যাও৷

মিরা ভদ্রতাসূচক বলে, ” আন্টি আপনিও আমাদের সঙ্গে আসুন না প্লিজ।”

হাসনাহেনার কথাটা খুব মনে ধরল। এবাসায় তাকে নিয়ে কেউ একবিন্দু চিন্তা করে না। কারো সময় নেই তার সঙ্গে কোথাও যাওয়ার একা একা দোকানে যায় সে। ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে যাওয়া হয় আজ কতদিন হলো!

তিনি নরম গলায় বলেন, ” আজকে তোমরা যাও৷ অন্য আরেকদিন যাব।”

মিরা তার দেওয়া জিন্স আর টপস পড়ল। সঙ্গে একটা শীতের টুপিও ছিল। সে টুপিটা মাথায় দিয়ে আয়নায় তাকালো। মাই গড! তাকে পুরা বিদেশিণীর মতো লাগছে৷ মা তাকে দেখলে এখন নিশ্চয়ই কপালে চুমু খেত৷ যেদিন করে মিরা সুন্দর করে সাজত, মা তার কপালে চুমু দিত৷ মায়ের কথা মনে পড়তেই তার মন খারাপ হয়ে আসে৷

কিছুক্ষণ পর সাদ তাকে নিয়ে বাসার মেইন রাস্তা অব্দি হেটে গেল। এরপর মেইন রোড থেকে ক্যাব হায়ার করে৷ ট্যাক্সি চালককে সে বলল, “সিটি হল পার্ক যাব৷”

ট্যাক্সিচালক বলে, ” সিটি হল পার্কের কোন জায়গায়?”

–” ব্রুকলিন ব্রীজে যাব৷”

এবারে মুখ খুলল মিরা৷ সে বলে উঠে, “ব্রুকলিন ব্রীজ! এটা কোথায় সাদ?”

–” তুমি ব্রুকলিন ব্রীজের নাম শুনোনি?”

–“উহু।”

–” ওকে। সমস্যা নাই। সরাসরি দেখে নিও।এটা খুব ফেমাস একটা জায়গা।”

তারা ক্যাবে উঠে পড়ে৷ প্রায় বিশ মিনিটের মধ্যে সিটি হল পার্কে এসে পৌঁছায় তারা। সেখান থেকে একটু হাঁটলেই মানহাটানের সঙ্গে লাগানো ব্রুকলিন ব্রীজের দেখা মিলবে৷ মিরাকে নিয়ে সাদ ব্রুকলিন ব্রীজের কাছে আসলো। রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়ে আছে তারা।টুরিস্ট স্পট হওয়ায় এখানে ভালোই ভীড়। সবাই পারফেক্ট ভিউয়ে পিকচার তুলায় ব্যস্ত৷ মিরা আশপাশে তাকিয়ে দেখছে৷ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে সবটা।

সাদ বলে, ” এটা আমাদের সিটি মানে মানহাটান আর ব্রুকলিন শহরের ডামবোর মধ্যকার সেতু। তুমি কী এখনোই ব্রীজে উঠবে নাকী রিভারটা একবার দেখে নেবে?”

–” চল নদীটা দেখে আসি।”

সাদ তাকে নিয়ে ব্রীজের নিচেই নদীর ধারে গেল। নদীতে নামা নিষেধ। তবে বাউন্ডারি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করা যাবে৷ নদীর তীর ঘেঁষে ছোট-বড় পাথর আছে। নদীর পানি স্বচ্ছ। নীল রংয়ের দেখাচ্ছে। সাদা ফ্যানা তোলা ঢেউ এসে পাথর আছড়ে পড়ছে। সো সো বাতাস। নীল আকাশে পাখি উঠে যাচ্ছে।

মিরা বাউন্ডারির কাছে গিয়ে দাড়ালো। দূর থেকে দেখলে মনে হবে নদী তেমন একটা গভীর না৷ কিন্তু কাছে গিয়ে এর স্রোত দেখলে সামান্য ভয়ই লাগবে। যদি পড়ে যায় কেউ, তার অবস্থা কাহিল৷ নদীর বুক দিয়ে স্টিমার, ইঞ্জিনচালিত বোট যাচ্ছে। দূর থেকে আমেরিকার পতাকা উড়ছে৷ বীচ ভিউ, উপরে ব্রুকলিন ব্রীজ কী অপূর্ব দৃশ্য৷

সাদ বলে, “এটা ইস্ট নদী৷ এখানে আমি আমার প্রথম গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ডেটে এসেছিলাম। সানসেটের সময় এই জায়গাটা খুব চমৎকার লাগে। এখন এতোটা সুন্দর লাগবে না৷ আচ্ছা ব্রীজের উপরে চল। ভাইয়া আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছে৷”

মিরা অবাক হয়ে বলে, ” তোমার ভাইও এসেছে?”

–” আসার কথা ছিল না। কিন্তু হুট করে বলল সেও জয়েন করবে আমাদের সঙ্গে।”

মিরার বুক দুরুদুরু করতে লাগলো। কেন যেন ইমানের সামনে আসতে তার ভারী লজ্জা লাগে৷ সাদ তাকে নিয়ে ব্রীজের উপরে উঠে৷ ব্রীজে উঠা অব্দি সে এক পলকের জন্য চোখ বন্ধ করে। পুরা দৃশ্যপট মুগ্ধ হয়ে দেখেছে৷ তারা ব্রীজের মধ্যে, একদম টপে উঠে অয়াশ দিয়ে সাইকেলও যাচ্ছে। নিচের লেনে হাই স্পিডে গাড়ি যাতায়াত করছে৷ ওয়াক লেন দিয়ে হাঁটছে তারা৷ একদম মেইন ভিউ পয়েন্টে আসতেই মিরার মনে পড়ে গেল, কাল হো না হোর গানের শুটিং তো এখানে হয়েছিল৷ ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে শাহরুখ খান নেচেছিল। ওহ মাই গড! তার বিশ্বাস হচ্ছে না সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে! এ যেন স্বপ্ন!

আচমকা তার বাহু ধরে কেউ টান দিল। সে টাল সামলাতে না পেরে, ব্যক্তির বুকে গিয়ে ঠেকল। মাথা থেকে তার টুপি পরে গেল৷

মিরা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে ইমান তাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করেছে। আশপাশ দিয়ে কত মানুষ হাঁটছে! অথচ বেহায়া ছেলেটা তাকে টান মেরে নিজের বুকে এনে ধাক্কা দিল!

সে ঝারি মেরে উঠে বলে, ” আপনার সমস্যা কী? আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলতে চাচ্ছেন কেন?”

ইমান প্রথমে অবাক হলো। এরপর বলে উঠে, “সেই দশ মিনিট ধরে পেছনে থেকে ডাকছি। শুন না জন্য হাত ধরে টানলাম। আমি তো জানতাম না তুমি পরে যাবে৷”

মিরা সরে আসতে ধরলে, ইমান তার কোমড় শক্ত করে ধরে নিজের সঙ্গে মিশে নেয়৷

মিরা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ” এখন সরতে দিচ্ছেন না কেন? আটকে ধরছেন কেন?”

–” তুমি বুকে থাকলে শান্তি লাগে খুব।”

–” কী বললেন? ”

–” বললাম ব্রুকলিন ব্রীজ অনেক সুন্দর। আমার একটা শখ আছে, জানো সেটা?”

–” জানি না। জানতেও চাই না৷”

ইমান তার কোমড় চেপে ধরে মুখটা তার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলে, ” আমি আমার লাইফের ফাস্ট লি*প কিসটা এই ব্রীজের সামনে দাঁড়ায় আমার বেটারহাফকে গিফট দিব। ব্রুকলিন ব্রীজকে সাক্ষী রেখে কিস করব৷ ”

চলবে৷

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–35

মিরা বিষ্ফোরিত চোখে তাকালো। তার কোমড় চেপে ধরায় সে না পারছে তার বুকে নেতিয়ে থাকতে আর না পারছে সরে যেতে। ইমানের বেশরম কথাগুলো তাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। এসব কথা শুনলে কার না লজ্জা লাগবে? ছেলেটা আসলেই দিন কে দিন ষ্টুপিড, লাজহীন হচ্ছে!

সে চেচিয়ে উঠে বলে, ” আমাকে ছাড়ুন।”

আচমকা তার চেচানোর ফলে আশেপাশে সকলে তাকালো। সবাই আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে গেল৷ ইমান নিজেও হতভম্ব। এমন কী মিরা স্বয়ং নিজের কাণ্ডে সামান্য চমকে উঠে। মাঝে-মাঝে তার যেন কী হয়। ভুল-ভাল কাজ করে বসে৷ এই যে ছয়জন শেতাঙ্গরা তাদেরকে ঘিরে দাড়ালো। এদের কী বলবে সে? একজন বুঝি নাইন ওয়ান ওয়ানেও কল দিতে চাচ্ছে৷ উশখুশ করে একে অন্যের সঙ্গে তারা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু করল। তাদের মধ্যে কেউই ইমান বা তার সঙ্গে একটা কথাও বলছে না। এমন সময়, ইমান দারুণ স্মুথলি তাকে আবারো নিজের দিকে টেনে আনল৷ এরপর আস্তে করে পরিষ্কার বাংলায় বললো, “সবসময় ঝামেলা বাঁধাও৷ ওরা আমাকে ইভটিজার ভাবছে মেবি৷ পুলিশ কল করবে মুশকিল হবে৷ এখন আমি যা করব সবটায় সায় দিবা৷ নইলে কিন্তু আমার বিপদ। আর আমার বিপদ মানে তোমার শনিবার৷”

মিরা বুঝে পেল না ইমানের বিপদ কেন তার শনি হবে? মঙ্গলবারও হতে পারে৷ ক্ষণেই সে যেন আকাশ উঠে গেল৷ আরেক দফায় চিৎকার দিল সে। ইমান তার কোমড়ে হাত রেখে একদম ফিল্মি স্টাইলে তাকে উপড়ে তুলেছে। এভাবে কোলে তো আমির খান তার নায়িকাকে তুলে শুটিং করে। নিজেকে বলিউডের সুন্দরী কন্যা মনে হচ্ছে যেন!

ইমান তার আস্তে করে নিচে নামায়, সম্পূর্ণ নয়। তার পাজোড়া তখনো মাটি স্পর্শ করেনি। ইমান তার সম্পূর্ণ ভার নিজ হাতে বহন করছে৷ এমন সময় ইমান আস্তেধীরে, খুব স্লোলি নিজের মুখের কাছে মিরাকে আনে। এরপর তার কপালে গাঢ় করে চুমু দিল। এবং আবারো ফিসফিস করে বলে, ” ঠোঁটে চু*মু খা*ও*য়াটা তোলা থাকলো৷”

সে ধাম করে তাকে নিচে নামিয়ে দেয়৷ মিরা টাল সামলানোর জন্য হলেও ওর কাঁধে হাত রেখে থমকে দাড়ালো। দুজনের মধ্যে দূরত্ব একদম ঘুচে গেছে। এতো কাছাকাছি অবস্থান করায় সে ওর হৃদপিণ্ডের ধুকপুক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। ছেলেটাকে খুব করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে মন চাচ্ছে। ইমান এবারে ভীড় করা লোকজনের দিকে তাকিয়ে খুব সুন্দর করে হাসল। এরপর বিনীত গলায় কাট কাট পরিষ্কার আর আমেরিকান একসেন্টে বলে উঠে, “একচুয়ালি আমরা রোমান্টিক কাপল ফটোশুট করছি৷ উই আর কাপল। ডোন্ট টেক মি রঙ গাইজ৷”

ওর বলার বাচনভঙ্গিতে কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই। সে যাই বলে মানুষ বিশ্বাস করে ফেলে। সঙ্গে ওই মনোমুগ্ধকর হাসি তো আছেই। এই হাসির দিকে তাকালে মানুষ তাকে ভুল বুঝতেই চাইবে না৷ এই যে সে ডাহা মিথ্যা বলে দিল, কেউ একটাবার তাকে সন্দেহ করল না। কেউ জিজ্ঞেস অব্দি করল না, ফটোগ্রাফার কই? মার্কিন মুলুকের মানুষকেও এই ছেলে বলদ বানালো! হাহ্!

মিরা সরে এসে দাঁড়িয়ে তাদের প্রত্যকের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলো। লাজুক হাসি। যদিও এদেশের মেয়েরা এতো লজ্জা পায় না। তাও ও লজ্জা পাওয়া ভঙ্গিমায় হাসে যেন তারা ইমানের বলা কথা বিশ্বাস করে৷ সত্যি তারা বিশ্বাস করল। যে মোবাইল বের করেছিল সে মোবাইল আবার পকেটে ঢুকিয়ে বলে, “ওকে, ইনজয় ইউর ডে৷”

তারা প্রস্থান করলে, ইমান চারপাশে তাকিয়ে বলে, “সাদ আহাম্মকটা কই? তুমি একা ছিলে কেন তখন?”

মিরা উত্তর দিল, ” ওর কল এসেছে। কল এটেন্ড করতে ওইদিকে গেল৷ আমি দাঁড়িয়ে ব্রীজটা দেখছিলাম। এরপর আপনি এসে টান মারলেন৷”

ইমান ফোন দিল সাদকে। সাদ জানালো ওর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছে। ওরা ব্রেকাপ কববে এখন। তাকে যেতে হবে ইমার্জেন্সি।

ইমান মুখে তেতো ভাব এনে বলে, ” কয় নাম্বার ব্রেক আপ এটা?”

— ” সাত।”

ইমান ফোন রেখে দিয়ে বলে, ” চল ব্রীজের ওপারে যাই। ব্রুকলিনের ওইদিক থেকে দৃশ্য আরো বেশি সুন্দর। সানসেটের সময় বেশি সুন্দর হয়। হেঁটে যেতে পারবে?

— ” একশ একবার পারব ”

— “গুড। মাত্র ত্রিশ মিনিট থেকেও কম লাগবে।”

মিরা তার আগে আগে হাঁটা ধরল। ইমান তাকে পিছু ডেকে থামিয়ে দিল। মিরা ঘার ঘুরিয়ে দেখে ইমান কুচো হয়ে মাটি থেকে তার টুপি কুড়িয়ে নিয়ে হাতে ধরল। এরপর তার দিকে এগিয়ে এসে নিজ থেকে টুপি মাথায় পরিয়ে দিয়ে তার গাল টানল বেশ জোরে। তার এহেন কাণ্ডে মিরা বিষ্মিত হলেও, গালে হাল্কা লাগলোও। এতো জোরে কেউ গাল টিপে দেয়?

ইমান মুচকি হেসে বলে, ” ইউ আর লুকিং ড্যাম কিউট। এই লুকে তোমাকে প্রথম দেখলাম ”

— “আমি ওয়েস্টার্ন ড্রেস তেমন পরি না।”

–” প্রশংসা করলে ধন্যবাদ দিতে হয়।”

–” ওয়েলকাম।”

ইমান মুখ তেতো করল। কিছু বলল না। এই মেয়ে আশেপাশে থাকলে তার বড্ড সিগারেটের তৃষ্ণা পায়। এখনো একসঙ্গে তিনটা সিগারেট টানতে মন চাচ্ছে। নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে রেখে সে, মিরার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটা ধরে। ইচ্ছা করেই আস্তে হাটছে। এই পলটা সে বন্দী করে রাখতে চায়৷কিন্তু সেটা আদোতে অসম্ভব।

হাঁটতে হাঁটতে সে গুনগুন করে গাইতে লাগলো,

“I found a love for me
Oh, darling, just dive right in and follow my lead
Well, I found a girl, beautiful and sweet
Oh, I never knew you were the someone waiting for me”

মিরা মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকালো। ইশ কি সুন্দর গায় সে। তার কেন এত্তো সুন্দর ভয়েজ নেই? কেন সে বেগুন হয়ে জন্মালো? মা কী তাকে ধরে-বেঁধে গান গাওয়া শেখাতে পারত না?

ইমান গান গাওয়া থামিয়ে দিয়ে তার পানে চেয়ে প্রশ্ন করে, “এমন ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে কী দেখছো”

–” কিছু দেখছি না।”

মিরা মনে মনে বলে উঠে, ” গান গাওয়া থামালেন কেন? আর একটু গান না। আপনি যখন গাচ্ছিলেন আমি নিজেকে অন্য ভূবনে দেখছিলাম।”

তারা হেঁটে ব্রীজের ঔ প্রান্ত থেকে এই প্রান্তে এসে হাজির হলো। তারা মানহাটন থেকে ব্রুকলিনে আসলো। মিরা ক্লান্ত হয়ে গেছে। পিপাসা পেয়েছে তার। দিনের শেষভাগ তখন। ব্রীজের উপরে তুমুল পাগলাটে বাতাস ছিল। তার চুল এলোমেলো হয়ে একদম ঝাউ গাছ বনে গেছে৷ সূর্য তখন আস্ত যাবে। এমন সময় ইমান তাকে নিয়ে নিচে নেমে এসে নদীর ধারে এসে থামলো। এখানে সবুজ ঘাস আছে। দুটো বাচ্চা ফুটবল খেলছে৷ মিরা ক্লান্ত হয়ে ঘাসের উপর স্যান্ডেল খুলে বসে পরে৷ তাকে অনুসরণ করে ইমানও বসল। সানসেট এখান থেকে পুরাপুরি দেখা না গেলেও প্রকৃতির মাঝে আকাশের লালাভ রং হওয়া থেকে আস্তে আস্তে দুনিয়াতে অন্ধকার ঢলে আসা উপভোগ করা যায়। সঙ্গে সাইড ভিউ হিসেবে ব্রুকলিন ব্রীজ যেন সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।

সানসেট হওয়ার পরের দৃশ্য আরো সুন্দর। অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রুকলিন ব্রীজের আনাচে-কানাচেতে সব জায়গা থেকে চোখ ধাধানো আলো জ্বলে উঠে৷ অপূর্ব সুন্দর লাগছে দেখতে! মিরা যেন চোখ ফেরাতে পারল না। তার সব ক্লান্তি চুকে গেল৷ তিরতির বাতাসে তার কাঁধে লেপ্টে থাকা চুলগুলো নড়ছে। হুট করে ইমান তার চুলগুলোর দলা নিজের হাতে এনে রোল করতে লাগলো। এতে সে সামান্য কেপে উঠে। মিরা তার দিকে বিরক্তিভরা নয়নে তাকালো। কিন্তু কিছু বলল না। সম্ভবত এতো সুন্দর একটা সন্ধ্যা উপহার দেওয়ার জন্য মনে মনে মিরা তার উপর কৃতজ্ঞ৷ এখানে আসার আইডিয়া সাদকে ইমানই দিয়েছিল৷

সে বলে, ” আমাকে তিন দিনের জন্য নিউইয়র্কের বাইরে যেতে হবে৷”

–” তো আমি কী করব?”

–” আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?”

একথায় মিরা তাচ্ছিল্যভরা হাসি হাসে। এরপর বলে, ” আমাকে নিয়ে কোনদিন ভেবেছেন একবার ও”

ইমান ঘাসের উপর থেকে উঠে দাড়ালো এরপর বলে, ” অফিসের কাজে যাব৷”

মিরাও উঠে দাড়িয়ে বলে, ” বাসায় ফিরব কখন”

–” সবচেয়ে চমৎকার জায়গাটায় এখনো যাইনি।”

–” সেটা কই?”

–” সামনেই। আমার কাছে টাইম আউটের রুফটপ সবচেয়ে বেস্ট লাগে। ওখানে গেলে সব স্ট্রেস আপনা-আপনি উধাও হয়ে যায়৷”

–” টাইম আউট জিনিসটা কী?”

–” মার্কেট একটা। ওদের রুফটপ সবার জন্য উম্মুক্ত। চল ঘুরে আসি।”

তারা দুজন চুপচাপ আগাতে লাগলো। দুজনের মধ্যে সীমাহীন দূরত্ব। আশেপাশে প্রতিটা কাপল কতোটা প্রানবন্ত হয়ে হাসছে, মজা করছে। তাদের দেখলেই মিরার ভালো লাগছে। তার ভালোবাসা প্রতরক হয়েছে হোক, অন্য কারো ভালোবাসা যেন বেঈমান নাহয়!

টাইম আউট মার্কেটের ভেতর ভীড় ভালোই। ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দোকানে যাচ্ছে৷ রেস্টুরেন্টে, ফুডকোর্টে জায়গা হচ্ছে না দেখে অনেকে অন্য সাইডে খাবার নিয়ে বসছে। ইমান বেভারেজ কিনল। ব্লু ল্যাগন ড্রিংক কিনলো দুটো। এরপর রুফটপে চলে যায় তারা। রুফটপের রেলিংয়ের ধারে গিয়ে মিরার অজ্ঞান হতে মন চাচ্ছে। এতো চমৎকার কেন এই ভিউটা! উপর থেকে সমস্ত সিটির নাইট ভিউ দেখাচ্ছে৷ সমস্ত নিউইয়র্ক বুঝি মিরা এখান থেকে দেখতে পাচ্ছে। দূর থেকে ব্রুকলিনের ঝলমলে আলো আর ক্ষ্যাপা বাতাসে মন-হৃদয় জুড়িয়ে যাচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে মুহুর্তটা অনুভব করল৷ সেখান কিছুক্ষণ থেকে ইমান বলে, ” ডিনার করে নেই চল৷”

মিরা ঠোঁট উল্টিয়ে অভিমান সুরে বলে, ” সকালে আমার খাওয়া নিয়ে আপনি খোটা মেরেছেন৷ আমি কিছু খাব না৷”

ইমান মনে করতে চেষ্টা করে কোন সময় সে বোকাবতীকে খাওয়া নিয়ে খোটা মারলো? কিন্তু আফসোস মনে করতে পারল না৷ তারা মার্কেট থেকে বের হলো। ইমান উবার কল করে। গাড়িতে বসামাত্র হাই স্পিডে গাড়ি চলতে আরম্ভ করে৷ নিউইয়র্কের রাত বেশি সুন্দর। সবকিছু এত মনোমুগ্ধকর যে চোখ ফেরানো দায়। মিরার চোখে উপচে পড়া সীমাহীন উত্তেজনা। সে কাচের গ্লাস দিয়ে বাইরের সৌন্দর্য দেখছে৷ আর ইমান আড় চোখে তাকে দেখছে৷

কতোক্ষণ তারা গাড়িতে ছিল মিরার মনে নেই৷ গাড়ি তাদের মানহাটনের বাসায় গিয়ে থামলো৷ ইমান ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকে৷ জহির সাহেব বাসায় নেই। উনিও জরুরি কাজে শহরের বাইরে৷ ইমানও যাবে শুনে হাসনাহেনা কিছুক্ষণ গজগজ করলেন৷ ইমান আমলে নিল না। সে নিজের রুমে এসে বসল। রুমে আসতেই মনে পড়ল মিরা তো বেড শুবে না৷ এখন উপায়? কি করা যায়? তার নতুন একটা বেড কেনা উচিত?

একটুপর মিরা রুমে এসে বলে, ” আপনি রুমের ওইদিকে থাকবেন, আর আমি এদিকে৷ খবরদার আমার সাইডে আসবেন না।”

— কেন? কেন যাব না? এটা কী বাংলাদেশ ভারত বর্ডার যে গেলেই ডিস্কিয়াও।”

–” এতোসব জানি না। আমি যতোদিন আছি আপনি এদিকে আসবেন না৷ আমি পর্দা টেনে রাখব। দুটো আলাদা রুম হবে। ”

ইমান বালিশের নিচে মাথা রেখে বলে, ” আমি নাহয় ওদিকে গেলাম না। কিন্তু তোমার ওয়াশরুম পেলে কী করবে? ওয়াশরুম তো আমার ভাগে পড়েছে।”

মিরা সামান্য বিচলিত হলো৷ এরপর সমাধান দিল। তার ওয়াশরুমে যেতে হলে সে পারমিশন নিয়ে পর্দার ওদিকে যাবে আর ইমান রুম থেকে বের হতে চাইলে মিরার কাছে পারমিশন নিবে৷ কারণ মিরার ভাগ করা অংশে দরজা পড়েছে৷ সে শর্তে রাজী হলে মিরা ডিভান টেনে এনে নিজের দিকে রাখল। ডিভানটা এতো হাল্কা হবে সে কল্পনাও করেনি যাইহোক ডিভানে বসে সে মাত্র চোখ বুজেছে ওমনি ইমান একটা নোটপ্যাড ছুঁড়ে মারল৷ নোটে লেখা,

১৪.০৪.২০২২

বিনীত নিবেদন এই যে, আমার এই মূহুর্তে রুমের বাইরে যাওয়া অত্যাবশকীয়। আপনি যদি আমার সকল দিক বিবেচনা করে আমাকে বর্ডার ক্রস করতে দেন৷ আমি খুব কৃতজ্ঞ হবে৷

বিনীত নিবেদন এই যে, আপনি আমার বিষয়টা ভেবে আমাকে বর্ডার ক্রস করতে দিয়ে আমাকে বাধিত করবেন।

পুনশ্চঃ শেষ ক্লাস সিক্সে বাংলায় এপ্লিকেশন লিখেছিলাম। এই বয়সে এসে বাংলা অক্ষর ভুলতে বসেছি৷ কাজেই আবেদন পত্র লেখায় ক্রুটি হলে ক্ষমাপ্রার্থী।

মিরা আবেদনপত্র পড়ে কিছুক্ষণ দম ফাটা হাসি হাসল। বহুদিন পর সে হাসলো। এরপরে নোটে লিখলো, গ্রান্টেড।

চলবে৷