ফেইরিটেল পর্ব-৫৬+৫৭

0
546

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–56

বিপদের আভাস টের পেতেই মিরা দিশেহারা বনে গেল। তার নিজের বুদ্ধিমত্তা যেন লোপ পাচ্ছে। একটা মানুষ অনেক বৃহৎ আকারের ব্যথা অনায়াসে সহ্য করতে পারলেও সন্তানের মুখে সামান্য “আহ্” যেন সোজা কলিজায় গিয়ে বিঁধে৷ সে তড়িৎবেগে ইমাদের দিকে ছুটে যায়। নিষ্পাপ, সর্বদা হাসি-খুশি উজ্জ্বল মুখটা যেন কাহিল হয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে। সে গিয়ে ইমাদের হাত ধরলো। ভীষণ জোড়ে কাঁপছে ওর হাত৷ নিজের বুকের সঙ্গে ইমাদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল সে৷ মাথা যেন হ্যাংক মেরে বসে আছে৷ সে সাহায্যের জন্য আশেপাশে তাকাচ্ছে। আজ বাসায় কেউ নেই। টিভিতে তখনোও ডোরেমন চলছে। মিরা সেন্টার টেবিলের উপর নিজের ফোন দেখতে পেল। সাত-পাঁচ না ভেবে সে ইমানের নাম্বারে কল দিল৷ ইমাদের শরীরের তাপমাত্রা হুহু করে বেড়েছে। বুকের ভেতর জড়িয়ে নেওয়ায় সে ছোট্ট শরীরটার উষ্ণতা অনুভব করে৷ অপরপ্রান্তে দু’বার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। মিরা ব্যতিব্যস্ত, বিচলিত, আতংকিত, অস্থির এবং ক্রন্দনরত স্বরে বলে উঠে, ” ইমান আপনি জলদি বাসায় আসেন৷ বাবু হুট করে কেমন জানি করছে। আমার খুব ভয় হচ্ছে৷ আপনি এক্ষুনি আসুন।”

ওপাশ থেকে ইমান কী উত্তর দিল মিরা শুনতে পেল না। ফোন কেটে যায়৷ করুণাময় সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে মিনিট দশেকের মধ্যে ইমাদের হাত কাপা-কাপি বন্ধ হলো। সে নিশ্চুপ হয়ে মায়ের বুকে নেতিয়ে থাকলো। মিরা চুপচাপ তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকলো। হাসপাতাল যাওয়া উচিত। কিন্তু এতো বৃষ্টি হচ্ছে। ইমান আসা অব্দি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই৷ আরো পনের মিনিট পর গাড়ির হর্ণ বাজলো। ক্ষণেই ইমান এবং সাদ হুড়মুড় করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে৷ মিরা এক ঝলক তার পানে তাকালো। ইমানের চুল, শার্ট সহ সমস্ত শরীর ভিজে গেছে। সে ছুটে ইমাদের কাছে আসলো৷ মিরার কোল থেকে নিজের কোলে তুলে নিল। দু’দন্ড পর্যবেক্ষণ করে এবং মিরার মুখে বাকি ব্যাখা শুনে সে বলে উঠে, ” বাবুর খিচুনি উঠেছিল। আমার আম্মারও জ্বর বা সাডেন শক পেলে খিচুনির রোগ দেখা দিত। ছোট্ট বাচ্চাদের জ্বর বা বিভিন্ন কারণে খিচুনি হতে পারে৷”

এরপর সে পরপর ইমাদের গালে চুমু খেল। সাদ পানির গ্লাস এনে মুখে-চোখে পানি দিল৷ একটুপর পিটপিট করে ইমাদ চোখ খুলে বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আমার ভালো লাগছে না বাবা৷ মাথাব্যথা করছে। ”

মিরা উঠে এসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ” আমার সোনা বাচ্চার কী হলো হুট করে?”

ইমাদ সঙ্গে সঙ্গে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পরে৷ কোনো একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছেন, মায়ের পরশ মহাঔষধ। মায়ের বুকে কোন ধরনের অসুস্থতা, অশান্তি, মন খারাপ হানা দেয় না৷

ইমান ডাক্তার কল করল। কিন্তু বৃষ্টির জন্য ডাক্তারের আসতে সময় লাগবে জন্য নিজে গাড়ি নিয়ে ডাক্তারের বাসায় গেল। ডাক্তার এসে চেক করলেন। ওনার মতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়৷ মেজর অসুখও নয় তাই টেনশন নেওয়ার কিছু নেই। সিরাপের নাম লিখে দিল৷ ইমান দ্রুত সেই ঔষধ কিনে আনল৷ ইমাদকে খাওয়ানো হলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যে জ্বর নেমে গেল। রাত নয়টার পর বাবু সম্পূর্ণ সুস্থ। সুপ্তি বেগম ও ইরার আসতে লেইট হয়েছিল। তাদের পরবর্তীতে সাদ গিয়ে এনেছে৷ ইমাদের জন্য সকলেই চিন্তিত হয়েছিল কেননা সে এই বাসার প্রাণ। তাকে কেন্দ্র করেই এ’বাসার প্রতিটা মানুষ নতুন করে হাসতে শিখেছে৷ রাতে কেউ ঠিকমতো খাবার খেল না৷ ইমাদ খুব দ্রুত আরাম করে মা-বাবার মাঝে ঘুমিয়ে যায়৷ মিরা আর ইমাদ সে’রাতে ঘুমায়নি৷ সম্পূর্ণ রজনীতে তাদের বহুবার দৃষ্টিবিলাস ঘটেছে৷ ইমান বারবার মিরাকে ঘুমিয়ে যেতে বলে কিন্তু মিরার দু’চোখে ঘুম ধরা দিল না৷ সকালবেলা সব স্বাভাবিক। ইমাদের শরীর একদম সুস্থ। রাতের সমস্ত অসুস্থতা সে ঝেরে ফেলে সকালে উঠেছে। আজও স্কুলে গেল না জন্য সে দারুণ খুশি। সকালে মায়ের সঙ্গে নাস্তা করল। দেশের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাতে ঘূর্নিঝড় ধেয়ে এসেছে এজন্য এর প্রভাব রাজধানীতেও কম-বেশি পরেছে৷ আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে রাজধানী ঢাকায় একটানা ছয়দিন বৃষ্টি থাকবে। শহরবাসী বৃষ্টি পছন্দ করে। বৃষ্টি নামলে কেউ কেউ বৃষ্টিতে ভিজে, বেশিরভাগ বাসায় খিচুড়ি বানানো হয়৷ অনেকেই কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনে। মানুষ সোশালমিডিয়ায় বৃষ্টির ছবি তুলে পোস্ট দেয়৷ বলতে গেলে জমজমাটভাবে উৎযাপন করে তারা। কিন্তু সেটা একদিনের জন্য। দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হয় ভোগান্তি ও বিরক্তি। আজকে অফিস কামাই দেওয়া সম্ভব নয়৷ ইমান-মিরা দুজনই বের হবে৷ কিন্তু ড্রাইভার আবারোও ছুটি নিয়েছে৷ মিরা যখন রেডি হচ্ছিল তখন দেখা গেল বাপ-বেটা মিলে নিচে নামলো। যাওয়ার আগে ইমান তার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আনলো৷

মিরা যখন নিচে নামলো সে দেখতে পেল ড্রাইভিং সীটে বাবা-ছেলে বসে মিছি মিছি গাড়ি চালাচ্ছে। আবার ইমান বাবুকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে। ভাবখানা এমন যেন ইমাদ সত্যিকার অর্থে গাড়ি চালানো শিখছে৷ মিরা কাঁচের জানালায় টোকা দিল। কাঁচ নামাতেই ইমাদ বলে উঠে, ” আম্মু আমি গাড়ি চালানো শিখছি। কাল থেকে আমি তোমাকে অফিস নিয়ে যাব৷”

মিরা ছেলের কথায় হেসে বলে, ” আমার বাবাই তো দেখছি অলরাউন্ডার।”

ইমান ইমাদকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, ” এখন তাহলে বাসায় যাও বাবা৷ আমরা অফিসে যাব৷”

ইমাদ লিফটে করে উপরে উঠে গেল। ইমান ড্রাইভিং সীটে বসে থাকল। কিন্তু মিরা গাড়িতে উঠতে ইতস্ততবোধ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলে, ” আপনি যান৷ আমি পরে আসছি রিকশা…… “।

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ইমান নেমে পরে বলে, ” যাও তুমি।”

কথাটি শেষ করে সে গ্যারেজ থেকে বের হলো৷ মিরপুরের এ’বাসাটা সাততলা। বিল্ডিংয়ের পাশ ঘেঁষে বিশাল বড় কৃষ্ণচূড়া গাছে আছে। গ্রীষ্মকাল হওয়ায় গাছের ডালে-ডালে, থোকায় থোকায় লাল ফুল উঠেছে। বাতাসে ফুল বৃষ্টির মতো ঝরছে। সারা রাস্তা জুড়ে লাল ফুলে ভরে গেছে৷ অপূর্ব দৃশ্য। শুধু কৃষ্ণচূড়া নয়, সোনালী রঙের সোনালু ও জারুল ফুলে শহর ছেয়ে গেছে। গ্রীষ্মকালের ঢাকাও এতো সুন্দর ইমান ভাবতেও পারেনি। নাকি এবার শহরে বেশ ফুল ফুটেছে? তখনই টুপ করে একটা কৃষ্ণচূড়া তার কাঁধে এসে পরে আটকে যায়। সে ফুল হাতে নিয়ে ধরে থাকলো৷ হর্ণের শব্দে ঘোর কাটে। মিরা গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে হর্ণ বাজাচ্ছে। রাস্তা সম্পূর্ণ ফাঁকা তাও কেন হর্ণ বাজাবে?

মিরা কাঁচ নামিয়ে বলে, ” যখন-তখন আবারো বৃষ্টি নামবে। গাড়িতে উঠুন। ”

ইমান মুচকি হেসে বলে, ” এমনই করে প্রতিদিন বৃষ্টি ঝরুক আর তুমি আমায় আপন করে নাও প্রিয় কৃষ্ণচূড়াময়ী!”

সে গাড়িতে উঠে মিরার কানে সেই কৃষ্ণচূড়া গুঁজে দেয়। সে ভ্রুকটি করে তাকাতেই ইমান বলে, ” তুমি কৃষ্ণচূড়ার থেকেও বেশি প্রিয়৷ ”

______________________________

ইরা আজকে বেশ সেজেগুজে ভার্সিটির উদ্দেশ্য বের হলো। বাসার সামন থেকে রিকশা ঠিক করে যখনই কেবল বসলো। আসমান থেকে টপকে সাদ তার রিকশায় লাফ দিয়ে উঠে বসে। সে বিষ্ময়ে অবাক হয়ে গেল।

সাদ এক গাল হেসে চুল ব্রাশ করে বলে, ” হ্যাপি ব্রেক আপ। সুইট সিক্স। ”

ইরা বলে, ” আমার ব্রেক আপে দারুণ খুশি মনে হচ্ছে। ”

–” অফ কোর্স খুশি। ব্রেক আপ হলেই তো আমি চান্স পাব৷”

ইরা মুখ কুচকে “ইউউ” ধ্বনি উচ্চারণ করে৷ সাদ তার দিকে তাকালো এরপর বলে, ” এম আই নট গুড লুকিং?”

–” আমি তোমাকে নিজের ফ্রেন্ড ভাবি।”

–” ফ্রেন্ড কী প্রেমিক হতে পারে না বা প্রেমিক কেন ফ্রেন্ড হতে পারবে না শুনি?”

–” আমার কাছে প্রেম-ভালোবাসা মানে টাইম পাস।”

–” তাহলে আসো টাইম পাস করি।”

রিকশা গলির মোড় থেকে রোডে আসল। মেইন রাস্তায় এক হাঁটু সমান পানি জমে আছে। মরা জ্যাম বেঁধেছে৷ গাড়ি-রিকশা, মোটরসাইকেলে রাস্তা ভরে আছে৷ মানুষ চলাচলের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। ফাক-ফোকর দিয়ে মানুষ সমানে হেঁটে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় সাদ ইরাকে প্রোপোজ করে বসে৷ ইরার সপ্তমতম বয়ফ্রেন্ড হতে চাওয়ার জন্য প্রোপোজ করল৷

ইরা বলে, ” না।”

–” সি, এক হাঁটু ময়লা বৃষ্টির পানিময় জ্যামের মধ্যে আমিই প্রথম কোন বান্দা যে প্রেম-নিবেদন করছিব। রাজী হও প্লিজ৷”

–” আমি রাজী হলে কততম গার্লফ্রেন্ড হবো?”

–” দশম। অরিজিনালি প্রথম এবং শেষ।”

–” বিষয়টা এমন দাঁড়ালো না, হোয়েন এ ফা/ক/ব/য় মিট এ প্লে’য়া’রগা’র্ল!”

সাদ হোহো করে হেসে ফেলে। ইরার হাত ধরতে ধরলে সে হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, ” রিমেম্বার এটা কিন্তু জাস্ট ফর ফান। টাইম পাশ। টেম্পরারি।”

সাদ মাথা নাড়ালেও মনে মনে বলে, ” তোমার টেম্পোরারি কমিটমেন্টকে দ্রুত পার্মানেন্ট করে নিব৷ প্যারা নাই, চিল।”

★★★

মিরার ভীষণ মেজাজ খারাপ। দু’ঘন্টা ধরে সে অফিসে বসে অন্যের কাজ সামলাচ্ছে। বিনামূল্যে কামলা খাটছে সে। বৃষ্টির জন্য আজ ছয়জন আসেনি। তাদের কাজ গুলো অন্যদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে ন্যান্সি ম্যাডাম। মিরা তার ভাগের কাজ শেষ করে ফাইল হাতে কেবিন ছেড়ে বের হলো। ন্যান্সি ম্যাডাম তার রুমে নেই। সেজন্য সে আনিস ভাইকে ডেকে বলে, ” ম্যাম কোথায়?”

আনিস মিয়া বলে, ” ম্যাডাম তো কমনরুমে আছে। আফা চা খাবেন?”

–” না।”

–” ক্যান্টিনে কলিজার শিঙ্গাড়া বানানো হয়েছে৷ খাবেন আফা?”

–” না, আনিস ভাই খাব না৷”

কমনরুমে ইমান আর ন্যান্সি ম্যাডামকে কথা বলতে দেখা গেল৷ মিরা যেতেই ফাইলটা ইমান চাইল। তাকে ফাইল দিতেই সে ফাইল চেক দিয়ে কিছু ভুল ধরে বলে, ” রুফটপে আসো।তোমাকে বাকিটা প্রোপারলি বুঝিয়ে দিব।”

মিরার বিরক্তিতে মুখ কালো হয়ে আসলো। সে ইমানের সঙ্গে দশতলা রুফটপে গেল৷ রুফটপের মাঝখানে টেবিল আর দুটো চেয়ার দেওয়া। তারা আসতেই আনিস ভাই দু’মগ কফি দিয়ে বিদাই হলো। ইমান চেয়ার টেনে মিরাকে বসার আহ্বান জানিয়ে বলে, “একদা তোমার সাথে কফি ডেটে যেতে চেয়েছিল। সেই সৌভাগ্য তো হলো না। তাই এখন সাধ পূরণ করছি।”

মিরা চেয়ারে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলে, ” দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন?”

ইমান হাসল এরপর চেয়ার টেনে বসে বললো,” মিরা?”

–” কিছু বলবেন?”

–” হ্যাঁ।”

–” সর‍্যি বলতে চাইলে নো নিড টু সে।”

–” এটাই বলতাম।”

–” কাজের ভুল গুলো শুধরে দিন।”

ইমান হাসতে হাসতে বলে, ” কোন ভুল নেই। হুদা প্যারা দিলাম।”

মিরা আজকে বিরক্ত হওয়ার বদলে হাসলো। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলো ইমান। বৃষ্টু থামার পরমুহূর্তে রুফটপে বসা সেই আত্মবিশ্বাসী রমণীর উপর ক্রাশ খেল ইমান৷ কত তম বার ক্রাশ খেল সেটা ইয়াত্ত নেই। কফির সঙ্গে ক্রাশ খাওয়া চিবিয়ে খেয়ে ফেলে বলে, ” ন্যান্সি ম্যাডাম ককক্সবাজারে আউটলেট আগামী সপ্তাহে ওপেন করবেন৷ একটা টিম বানানো হয়েছে যারা ওপেনিংয়ের সময় সেখানে উপস্থিত হবে৷”

–” আমি আছি কী সেই টিমে?”

–” তোমার ডিজাইন করা কালেকশন দিয়ে আউটলেট সাজানো হচ্ছে সো তুমি ইনভাইটেট ”

–” কক্সবাজার যাওয়ার মুড নেই।”

–” তোমার ওই মায়াভরা চোখ তো সমুদ্রের চেয়েও গভীর।”

–” লেইম ছিল।”

চলবে৷

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–57

আজ বাসার পরিবেশ বেশ উৎসবময়। সোনালী আপু ঘুরতে এসেছে সঙ্গে প্রান্ত ভাই আর তাদের পুচকে মেয়ে সায়মা এসেছে। সুপ্তি বেগম জামাই আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঘরে দু’জন জামাই অবস্থান করছে আজ। রান্না-বান্নায় কমতি রাখা যাবে না৷ চুলায় পোলাও চড়িয়ে এসে ইমাদের কাছে দাড়ালো সে। ইমাদ আর সায়মা প্রায় কাছাকাছি বয়সের হওয়ার দরুণ তাদের মধ্যে ভাব বেশ। দু’জনই খেলছে। কিন্তু ইমাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাকে রোগ-অসুস্থতা আক্রমণ করেছিল। বাচ্চা মানুষ খেলা নিয়ে তুমুল ব্যস্ত, লাফালাফি করলেও দুর্বলতা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। সুপ্তি বেগম ভাবলেন এখন থেকে দিনে দু’গ্লাস দুধ বাবুকে খাওয়াবেন৷ তখনই বেল বাজে৷ ইমাদ খেলনা ছুঁড়ে ফেলে গেইটের দিকে ছুট লাগায়। তার আম্মু-আব্বু এসেছে৷ সুপ্তি বেগম নাতির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এই তো সেদিনের কথা তার মিরা এমন ছোট্ট ছিল। দুই ঝুটি বেঁধে স্কুল যেত। আজ চোখের পলকে তার মেয়ে বড় হয়ে গেল। সময় কী অদ্ভুত! অথচ তার স্পষ্ট মিরার নবজাতক চেহারা চোখে ভাসে৷

মিরার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে৷ ছেলের সঙ্গে কথা বলছে সে। ইমাদ গেইট খুলে মা-বাবাকে দেখতে পেয়ে বেজায় খুশি। সারাদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটলো। মা যখনই বাসায় ফেরে তার আনন্দ লাগে। মাঝে মাঝে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আম্মুর জন্য সে অপেক্ষায় থাকে।

ইমান ছেলের জন্য চকলেট বের করল পকেট থেকে। ইমাদ বলে উঠে, ” সায়মা আপুও এসেছে বাবা৷”

মিরা বলে, ” তোমরা দু’জন শেয়ার করে নিও চকলেটটা।”

ড্রয়িংরুমে সবাই বসে ছিল। হাসাহাসির আওয়াজ আসছে৷ ইমান গিয়ে সাদের পাশে বসল। সাদ ভাইয়ের দিকে তাকালো। ইমান তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোকে অনেক খুশি বলে মনে হচ্ছে? ”

সাদ অর্থপূর্ণ হাসল। যার অর্থ তুমি ঠিক ধরেছে৷ এই ছয় বছরে সাদের সঙ্গে ইমানের সম্পর্ক অনেক গভীর হয়েছে। সাদ হুট করে ম্যাচিউর হয়ে গেল। পরিস্থিতি বুঝতে শিখে গেল৷ সবচেয়ে বড় কথা, “ভালোবাসা” মানে কী সেটা উপলব্ধি করেছে৷ ভাইয়া যতোবারই অন্য কোথাও শিফট হতো সে গিয়ে অন্তত ভাইয়ের সঙ্গে এক-দু’সপ্তাহ থেকে আসত। দু’ভাই মিলে একসঙ্গে ডিনার করত। রান্না করত। তার টাকার প্রয়োজন পড়লে ভাইকে পাশে পেয়েছে। ভাই-ব্রাদারের সম্পর্ক এখন অনেক মজবুত।

প্রান্ত ভাইয়া বলে উঠে, ” আজকে অনেকদিন পর সবাই একসঙ্গে। সেই লাস্ট মিরার বিয়ের দিন আমরা সবাই একসঙ্গে এভাবে গল্প করেছি। এরপর সবাই এতো বিজি হয়ে পড়লাম যে দেখা-সাক্ষাৎ কমে গেল৷”

ইমান হাসল। এরপর বলে, ” আমি তো দেশেই ছিলাম না৷”

প্রান্ত ভাইয়া বলে, মিরা-ইমানের বিয়ে কথা আমি কোনদিন ভুলব না। সে কী বৃষ্টি! বর নিজে কাজী ডাকতে গিয়েছিল। হাহা৷ গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকলো। বেজায় ঝামেলা হয়েছিল সেদিন৷”

ইমান খেয়াল করেছে সোনালী আপু আগের মতো আগে আর ভাইয়ের আদর দেয় না। ইন ফ্যাক্ট কথাও বলে না। একসঙ্গে বসলেও তাদের মধ্যে আর আগের মতো কথা হয় না ম নিশ্চয়ই তাকে এখনো ভুল ভেবে বসে আছে। ইমান সবার সামনেই বলে উঠে, “সোনালী আপু? ”

আপু যেন চমকে উঠে তার ডাকে। মিরাও রুমের দিকে যাচ্ছিল, সে হাঁটা থামিয়ে দিল৷

ইমান উঠে এসে আপুর সামনে মেঝেতে বসে তার একটা হাত ধরে বলে, ” মা যখন মারা গেল আমি খুব বেশি বড় ছিলাম না। বাবা জেল যাওয়ার পর আমার ঠায় হলো নানাবাসায়। মা হারা একলা আমি। বুক ভর্তি কান্না। ওই সময় তুমি আমাকে মায়ের মতো আগলে রাখলে৷ একবার আমার টাইফয়েড হলো। রাতে জ্বর আসলো। তুমি সারারাত জেগে সেবা করলে। ফযরের আযানের পর আমি চোখ মেলে জিজ্ঞেস করি, কেন সারারাত জেগে থাকলে? তুমি তো আর আমার মা নও। মনে আছে তুমি কী উত্তর দিয়েছিলে? বলেছিলে বোনেরা দ্বিতীয় মা হয়। যার মা নেই তার বোন থাকলেও মায়ের অভাব বেশ খানিকটা কমে যায়৷ ওইদিন থেকে তোমাকে আমি সবচেয়ে বেশি সম্মান করি। ভালোবাসি আপু৷”

ইমানের কথায় পরিবেশ যেন গম্ভীর হয়েছে। সবাই চুপ। কেবল সিলিং ফ্যানের আওয়াজ হচ্ছে৷

সোনালী আপুর চোখে পানি চলে এসেছে। এটা সত্য সে ইমানকে অনেক আদর করে ছোট থেকেই। মা হারা হওয়ার পর এই মায়া-মমতার টান অধিক মাত্রায় ফুলে-ফেঁপে বেড়ে গিয়েছে৷ কিন্তু গত ছয়টা বছর ধরে সে রাগ করেছে ইমানের উপর। ওর কর্মের উপর। সে নাক টেনে বলে, ” মিরুও আমার ছোট বোন। ওকেও আমি ভালোবাসি৷। তুই কেন আমার বোনকে কষ্ট দিলি?ইমান করুন চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ” তোমার বোনকে কষ্ট দিয়ে কী আমি সুখ পেয়েছি? বরং প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয়েছি। ”

মিরা চুপ থাকতে না পেরে বলে, ” আপু, আমি জানি তুমি আমাদের দু’জনকেই ভালোবাসো। আমাদের সম্পর্কের ফাটলের জন্য ভাই-বোনের সম্পর্কে দূরত্ব এনো না প্লিজ।”

সোনালী আপু ইমানের মাথায় হাত রাখলো। এরপর বলে, ” তোর রাজকপাল যে মিরার মতো কাউকে পেয়েছিস। সাত রাজার ধনের সমান ও। কিন্তু সম্পদ সামলে রাখতে পারিস নি। তোর জন্যই আফসোস হচ্ছে আমার।”

ইমান মাথা নিচু করে নিল। এরপর রুমজুড়ে পিনপতন নীরবতা।

সাদ বলে উঠে, ” তোমরা কী জানো, সাইকোলজি মতে, প্রতিটা মানুষের হাসি-খুশি, আনন্দে থাকা উচিত। দীর্ঘদিন আনন্দ না করলে একজন স্বাভাবিক মানুষ মানসিক ভাবে অসুস্থ হতে পারে? এ বাসায় আসা থেকে দেখছি ইমাদ বাদে সকলে বুকে দুঃখের গোডাউন নিয়ে ঘুরো।”

সাদের কথায় সবাই হাসলো। প্রান্ত ভাইয়া দুষ্টুমি করে বলে, “তো সাইকোলজি বিশেষজ্ঞ আমাদের আনন্দে থাকার উপায় কী?”

সাদ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশে দেখল। তার নজর আটকে যায় ইমাদের খেলনার বক্সের দিকে। বিশাল বড় লুডু বোর্ড দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে লুডু বোর্ড বের করে বলে, ” লেট’স প্লে।”

তার কাজ-কর্ম সবটা সবাই মজার ছলে নিয়েছিল। কিন্তু একটা সময় লুডু খেলা নিয়ে সবাই সিরিয়াস হলো৷ নব্বই দশকের ছেলে-মেয়েদের কাছে লুডু হলো একটা আবেগ৷ লুডুর বোর্ড দেখলে তারা নস্টালজিক হয়ে পড়ে। টিন এইজের কথা স্মরণ হয়। সবাই লুডু খেলতে আগ্রহ দেখালো। বাদ পড়ল না, সুপ্তি বেগমও। টিম করা হলো। সুপ্তি বেগম এবং ইরা এক টিমে। সোনালী আপু, প্রান্ত ভাই এক টিমে। তাদের সঙ্গে সায়মাও যুক্ত হয়েছে৷ সাদ, মিরা আর ইমান একা খেলবে। তবে ইমাদ তার মায়ের কোলে এসে বসল৷ বাবা আসার পর মাকে সে কম সময় দিচ্ছে। এইজন্য এখন আম্মুর কাছে এসে বসেছে সে। এছাড়াও তার শরীর ভালো লাগছে না, ঘুমাতে মন চাইইমান বলে, ” ইমাদকে নিয়ে যাব। ও একা হোটেল কী করবে জন্য ভাবছি যদি ইরাও আসে ভালো হত।”

তখনই ইমাদ তার বিশ্ববিখ্যাত গম্ভীর মুখে বলে, ” কিন্তু বাবা আমি তো ওলরেডি চাচ্চুর সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার প্লান করেছি। আমি যাব না৷”

— ” আম্মু যাবে তোমার। আমরাও ঘুরব বাবাই। তুমি একলা থাকতে পারবে না।”

–” চাচ্চুর সঙ্গে বেশি মজা হবে৷ আমি যাব না। তুমি আম্মুর সঙ্গে যাও বাবা৷ আম্মু কিন্তু একা রাতে ঘুমাতে পারে না। এজন্য আমি আম্মুর সঙ্গে ঘুমাই। তুমি কিন্তু আম্মুর সঙ্গে ঘুমাবে বাবা৷”

তার কথায় ইমান লজ্জা পেল। ছেলে তার বিরাট বেফাঁস কথা বলে দিচ্ছে৷

ইমাদ আরো সংযোজন করে বলে, ” আম্মুর যখন ঘুম আসে না, অন্ধকারে ভয় পায়, আমি আম্মুকে জড়ায় ধরে ঘুমাই। ওখানে গিয়ে আম্মু ভয় পেলে, আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে বাবা। ”

ইমান বলে উঠে, ” আচ্ছা রে আমার বাপ।”

মিরা কটমট করে তার দিকে তাকালো। ইমান বাদে বাকি সবাই মিটমিট করে হাসলো৷

খাওয়া শেষ করে বাসার তিন পুরুষ ছাদে যায় সি’গা’রে’টে সুখটান দিতে। প্রান্ত সন্ধ্যা থেকে খেয়াল করেছে সাদ আর ইরা খালি ইশারায় কথা বলে। প্রেম করার সময় সে আর সোনালীও এমন করত৷ তাই চেপে বসে সাদকে সত্য বলার জন্য।

ইমান অর্ধেক বুঝে বলে, ” সাদ তুই না বদলে গেছিস? ট্রু লাভের মিনিং বুঝেছিস? তোর এংরি বার্ড ছাড়া কাউকে চোখে পড়ে না৷ ভালো লাগে না কাউকে আর৷ তাহলে বাংলাদেশে এসে আবারো এসবে জড়ালি ক্যান?”

সাদ তাকে বলে, ” প্রান্ত ভাই যার কথা বলছে সে-ই আমার প্রিয় রাগী-কন্যা, মাই এংরি বার্ড! ওকে ভালোবাসার পর আমি অন্য নারীতে আসক্ত হতে পারি নি আর। বারবার ওর কাছেই মন আটকে পরেছে আমার এন্ড লাকিলি তুমি তাকে চেনো ব্রো।”

–” কে সে? কথা প্যাচাবি ন।”

–” তোমার একমাত্র শালিকা। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই৷ ভাই প্লিজ সবকিছু ম্যানেজ করে দাও।”

ইমান যেন টাস্কি খেল৷ ইরা আর সাদ! কেমনে কী? মাই গড! তার নাকের ডগায় এতোকিছু ঘটে গেছে?

চলবে..