ফেইরিটেল পর্ব-৬০ এবং শেষ পর্ব

0
1003

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Last Part (প্রথম অংশ)

আকাশের বুকে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে কৃষ্ণ-কালো মেঘের ভেলা। চারিদিকে মন খারাপ হওয়ার মতো বিষন্নতা। ইরা জানালার দিকে এগিয়ে এলো। আকাশ কালো হয়ে এসেছে৷ দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আকাশের পানে৷ তার খুব রাগ উঠছে। ড্রয়িংরুমে মামা-মামী বসে আছেন। তারা বাসায় এসেছেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সে ভার্সিটি থেকে এসেই অবাক। মা কত সাবলীলভাবে কথা বলছেন ওনাদের সঙ্গে। ইরাকে দেখামাত্র বলল, ” চা বানিয়ে আনতে।”

ইরা অবশ্য চা বানিয়ে আনেনি। নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। ডাইনিং টেবিলে সাদ আর ইমাদ বসে বসে দাবা খেলছিল। সাদ ইশারায় তাকে কিছু বুঝালো কিন্তু ইরা বুঝতে সক্ষম হয়নি৷ তার রাগে গা কাঁপছে। ওই বিশ্রী দিনটার কথা স্মরণ হতেই তার গা গুলাচ্ছে। সে দম ফেললো ছোট করে। সাদ ইতিমধ্যেই তাকে দশ বার কল করেছে। ইরা ফোন রিসিভ করতেই বলে উঠে, ” ওনারা চলে গেছে। তুমি বাইরে আসো।”

ইরা ফোন কাটলো। অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ঘটনার পর তার সাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় অনলাইনে। অবশ্য ইমান ভাইয়ার ছোট ভাই জেনেই সে কথোপকথন আগায়। নাহলে ঐ দুর্ঘটনা পর সে অপরিচিত কাউকেই বিশ্বাস করে না আর। ছয় বছরে সাদ তার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গেছে। তার জীবনে ঘটে যাওয়া খুটিনাটি সব শেয়ার করে ওর সাথে।

সে খট করে দরজা খুলে সরাসরি সুপ্তি বেগমের কাছে গেলেন৷ সুপ্তি বেগম তখন ইমাদের জন্য আলাদা করে ঝাল ছাড়া সবজি বানাচ্ছিলেন৷

ইরা মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” মামা-মামী কেন এসেছিল? আর তুমি ওনাদের কেন বাসায় এনে চা-পানি খাওয়ালে।”

সুপ্তি বেগম মুচকি হাসলেন এরপর জবাব দেয়” ওনারা সাহায্যের জন্য এসেছিল। বোন হইতো, থাকতে পারিনি।”

–” কিসের সাহায্যে চাই তাদের? লজ্জা করলো না ওনাদের আমাদের কাছে সাহায্য চাইতে?”

সে আস্তে আস্তে বললো, ” অনিক তিন মাস ধরে জেলে আছে। ভাই নিজের সব জায়গা-জমি, টাকা দিয়ে জামিনের ব্যবস্থা করছে। লাভ হয়নি।কোন জানি মন্ত্রীর ভাগ্নির সঙ্গে অনিক ঝামেলা করেছে। বর্তমানে সে ভুগছে। এখন ভাইয়ের ঢাকায় থাকার আশ্রয় নাই। গ্রামের বাড়ি যাবে৷ তাদের খুব অভাব যাচ্ছে৷ কিছু আর্থিক সাহায্য চাইলো। আমি না করতে পারি নি।”

ইরা মাকে আর কিছু বলল না। শুধু হতবুদ্ধি হয়ে সবটা শুনলো। সে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসতেই সাদ বলে, ” তোমার মামা খুব কাঁদছিলেন৷ আমার নিজেরই খারাপ লাগলো। আর মামি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছিল বারবার। ”

তখনি ধরনী কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামে৷ ইরা সাদের দিকে তাকিয়ে বলে, ” নিউইয়র্কবাসী, চলুন আজকে আপনাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখাই।”

–” নিজেকে দেখাবা?”

ইরা হেসে বলে, ” ” চলো আজ বৃষ্টিতে ভিজি।”

সাদ অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে। তারা দু’জন সুপ্তি বেগমের চোখে ফাঁকি দিয়ে ছাদে উঠে যায়৷ ইমাদকে ঘুষ স্বরুপ সাদ তার ফোনে গেইম অন করে দিয়ে গেছে। দিন-দুনিয়া ভুলে ইমাদ গেইম খেলায় ব্যস্ত।

একটু পর খাবার নিয়ে সুপ্তি বেগম আসলেন। ইমাদ মোবাইলে গেইম খেলতে খেলতে নানীর হাতে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়।

সুপ্তি বেগম প্রশ্ন করে, ” বাবু, তোমার মিমো কোথায়? তোমার চাচ্চুকেও দেখছি না যে?”

ইমাদ গম্ভীরমুখে স্ক্রীন থেকে চোখ না সরিয়ে বললো, ” জানি না নানিমনি।”

তারা চুপি চুপি ছাদে উঠে এসে ছাদের দরজা লাগিয়ে দেয়। আকাশ ভেঙে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। থেকে থেকে পূর্বদিক থেকে হীম শীতল বাতস আসছে। ইরা খোলা ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো। দু’হাত মেলে আকাশের দিকে চোখ বুজে ভিজতে লাগে। সাদও বৃষ্টির তোড়ে ভিজে যাচ্ছে। তবে সে মুগ্ধ নয়নে খুব সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে চোখজুড়ে দেখছে। একটা সময় পর সে নিজের দৃষ্টি কেবল ইরার চোখ ও মুখের দিকে রাখল। বৃষ্টির পানিতে কাকভেজা ভিজে ;ওর জবজবে শরীরটার সঙ্গে সুতি সালোয়ার কামিজ লেপ্টে আছে।

ইরার বুঝি আজ মনে রঙ লেগেছে। সে হাত মেলে রেখেছে, ছাদে জমে যাওয়া পানিতে পা দিয়ে সামান্য লাফ দিচ্ছে আর গুনগুন করে বাংলা বা হিন্দি গানের এক-দুই লাইন গাইছে৷

সাদ তার সামনে এসে আলতো করে তার হাত ধরে বলে, “পানির তৃষ্ণা পেলে মানুষ পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করে৷ কিন্তু তুমি আমার মনের এমন এক তৃষ্ণা যেটা মেটানো যাচ্ছে না৷ আমার চোখের এমন এক পিপাসা তুমি যা থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। বরং মন বা চোখ জুড়ে যতোই তোমায় দেখি ততোই তৃষ্ণা বাড়ে। এই তৃষ্ণায় চৌচির আমার মন। চোখ পিপাসায় কাতর।”

তার দুই গালে নিজের ভেজা হাতের পরশ দেয় সে। ইরা শিউরে ওঠে তার স্পর্শ পেয়ে৷

সাদ তার গালে স্লাইড করতে করতে বলে, ” তুমি কিন্তু একবারও আমাকে ভালোবাসো তা বলো নি। প্লিজ একবার বলে দাও তুমিও আমার মতো করেই আমায় ভালবাসো! একটা বার কষ্ট করে বলে দিলেই চলবে।”

ইরা ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে, ” যদি না বলি?”

–” তাহলে আমি গুলিস্তানে গিয়ে গামছা বেচা শুরু করে দিব।”

ইরা শব্দ করে হেসে উঠল এরপর দুষ্টুমি করে বলে, ” ওকে দ্যাটস সাউন্ডস গ্রেট। তাহলে তোমার দোকান থেকে আমার জামাইয়ের জন্য গামছা কিনব। ফিফটি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট চাই।”

সাদ যেন সামান্য ক্ষুব্ধ হলো। সে ইরার কোমড় চেপে ধরে তাকে নিজের বুকে মিশিয়ে নিয়ে বলে, ” যদি সম্ভব হত, তবে তোমাকে নিজের বুকের মধ্যে বন্দিনী রাজকন্যা বানিয়ে রাখব আর তুমি অন্য পুরুষের কথা বলো! নট ফেয়ার এট ওল৷”

ইরার তখন কী যে ভালো লাগলো তা বোঝানো অসম্ভব। ” ভালোবাসা” এতো মধূর কেন? সে সাদের চোখে তার জন্য সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে। তাকে হারানোর ভয়ও ছেলেটার মধ্যে কাজ করছে। ইরার বলতে মন চাইল, ” আমাকে হারানোর ভয় পেতে হবে না। আমি তোমার মায়ায় আটকা পড়েছি। ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। হয়তোবা আরোও আগেই ভালোবেসেছি কিন্তু বুঝতে পারিনি। তাইতো নিজের এক্স বয়ফ্রেন্ডদের মধ্যে তোমার প্রতিচ্ছবি খুঁজে বেড়াতাম।”

সাদ নিজের পুরুষালি বুকে ইরাকে ঠায় দিল। প্রবল বেগে ঝমঝম শব্দ তুলে বৃষ্টি পড়ছে। সে গান গেতে লাগলো,

” তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না”

ইরা তার বুকের উষ্ণতা অনুভবে মগ্ন ছিল তখন।

★★★

পিটার সাহেব নাস্তা না করে টেবিলে চুপচাপ বসে আছে। জুই অনেকবার তাকে অনুরোধ করছে নাস্তা খাওয়ার জন্য। কিন্তু তার এক কথা, জুইকে আজ ফাইনাল সিদ্ধান্ত দিতে হবে। নাহলে পিটার খাওয়া বন্ধ রাখবে৷

জুই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ” আমি এখনো কিছু ভাবি নি পাপা।”

পিটার বলে উঠে, ” রবার্ট ছেলেটা ছয় বছর ধরে তোমার হ্যাঁ শোনার অপেক্ষায় আছে আর তুমি ওকে নিয়ে ভাবার জন্য এক মিনিট সময় পাও না?”

জুই কাচুমাচু করে বলে, ” দেখি, ওনার সঙ্গে আজ কথা বলব।”

–“রবার্ট পার্ক এভিনিউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তুমি যাও৷ কথা বলো ওর সাথে এক্ষুনি। ”

জুই বুঝল পাপা আর রবার্ট প্লান করেই কাজ করছে। পিতার আদেশ রক্ষার্থে সে পার্ক এভিনিউয়ের দিকে রওনা দেয়৷ পরনে তার বেবি পিংক রঙের শার্ট। কাঁধ অব্দি ব্রাউন চুলগুলো সে ছেড়ে রাখল।

পার্ক এভিনিউ মূলত কোন ঘুরার জায়গা নয়৷ এটা মূলত রাস্তা। গাড়ি যাওয়া-আসা করছে সুশৃঙ্খলভাবে। ফুটপাত আছে। রাস্তাকে ঘিরে গড়ে উঠে বিশাল বড় বিল্ডিং। পার্ক এভিনিউয়ের কাছে অবস্থিত চার্চটা রবার্টের প্রিয় জায়গা। এই চার্জকে ঘিরে তার শৈশবের কিছু আনন্দময় মুহূর্ত আছে। সে নিউইয়র্ক এলেই এদিকে ঘুরে যায়। আজকে অবশ্য জুইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। মিষ্টার পিটার ফোন করে জানিয়েছে জুই আসছে তার সঙ্গে মিট করার জন্য। তখন থেকে তার মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে৷

রবার্ট দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় জুইকে গাড়ি থেকে নামতে দেখা গেল৷ ওকে দেখা মাত্র সে হাত নেড়ে হাই জানালো। জুই হাই ব্যাক করে তার দিকে এসে বলে, ” কেমন আছেন?”

–” খুব একটা ভালো নেই।”

জুই হেসে উঠে বলে, ” আপনাকে বিসনেজম্যান ভেবেছিলাম কিন্তু আপনি তো দেখছি রোমিওকেও ফেল মারলেন।”

–” মজা নিবে না প্লিজ।”

–” চলুন সামনে আগাই।”

–” কোথায় যাবে? কোন রেস্টুরেন্টে বসবে? নাকি সেন্ট্রাল পার্ক যাবে? ”

–” কোথাও যেতে মন চাইছে না। তারচেয়ে আশেপাশেই হাটাহাটি করি।”

–” এজ ইউর উইশ।”

রবার্ট আর জুই রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর রবার্ট বলে উঠে, ” একটা সময় আমি লাভ-ক্ষতি ছাড়া কিছু বুঝতাম না। জীবনটাকেই ব্যবসা ভাবতাম। পাকা ব্যবসায়ী যাকে বলে সম্ভবত আমি তাই ছিলাম। একদা তোমার বাবার কোম্পানির সঙ্গে প্রজেক্ট করার প্রস্তাব পাই। আমি গেলাম তোমাদের অফিসে। মিটিং রুমে বসলাম। সেদিন প্রথম দেখলাম তোমায়। সাদা শার্ট পরেছিলে। ভীষণ নার্ভাস ছিলে তুমি। কারন ওটা তোমার প্রথম প্রেজেন্টেশন ছিল। তুমি মনোযোগ দিয়ে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করলে আর আমি মনোযোগ দিয়ে তোমায় দেখলাম। কাজের কোন কথাই কানে গেল না৷ প্রেজেন্টেশন শেষ হওয়ার আগেই ডিল সাইন করি। আমার এসিস্ট্যান্ট প্রশ্ন করে, ” এতো ফালতু প্রেজেন্টেশন দেওয়ার পরও আমি কেন তোমাদের সঙ্গে কাজ করব!” আমি উত্তর দিইনি। তোমাদের সঙ্গে প্রজেক্ট করে আমার বিরাট অংকের লস হলো তাও পরবর্তীতে লসের কথা ভুলে কেবল তোমার জন্য আবারও অফিশিয়ালি জড়িত হই।শুধু মাত্র তোমাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাব জন্য! ”

জুই সব শুনে বলল, ” আমি খুব খারাপ একটা মেয়ে। তুমি জানো আমি মিষ্টার খানকে খুব ভালোবাসতাম। সে বিবাহিত জেনে আমি মেনে নিতে পারিনি। তাকে নিজের করার জন্য মরিয়া হয়ে জঘন্য একটা কাজ করে ফেলি। ওনাকে মিথ্যা পুলিশি মামলায় ফাসিয়ে তার সামনে দুইটা কন্ডিশন রাখি– হয় আমাকে বিয়ে করতে হবে নয়তো জেলে যেতে হবে৷ ইমান নিজ ইচ্ছায় জেলে যেতে রাজী হয়৷ তখন রিয়ালাইজ করি ইমান কখনই আমার হবে না। সে অন্যকারো ভালোবাসা। আমি এরপর সবকিছু থেকে সরে আসি। মিথ্যা মামলা তুলে তাকে মুক্তি দেই। আমি সেদিন থেকে অনুতাপের আগুনে পুড়ছি। লজ্জায় ওর সামনে যেতে পারি না৷”

রবার্ট ওর হাত ধরে বলে, ” নিয়তি ইচ্ছা করেই আমাদের দ্বারা ভুল করায়৷ পরীক্ষা করায় আমাদের। দেখতে চায় আমরা পরবর্তীতে অনুতপ্ত হই কিনা, ক্ষমা চাই কিনা। জুই, তুমি জানো বেশিরভাগ মানুষই ক্ষমা চায় না। খুব কম মানুষ অনুতপ্ত হয়। তুমি যেমন আমি সেভাবেই তোমাকে ভালোবাসি।তোমাকে এবং তোমার সব ভুলকে মেনে নিয়েই তোমার সাথে বাকি জীবন কাটাতে চাই।”

জুই রবার্টের দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপর বলে, ” আমি পাপার আসল মেয়ে না। আমার মা খুব জঘন্য একজন মহিলা ছিল। এরপরও আমাকে মেনে নিবে?”

রবার্ট কিছুক্ষণ চুপ রইল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, ” জন্মের উপর আমাদের কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। বলেছি না একবার? তুমি যেমন আছো সেভাবেই তোমায় গ্রহণ করব।”

জুই তাকে খুব সুন্দর একটা হাসি উপহার দিল৷ বিনিময়ে রবার্টও হাসল৷ জুই খেয়াল করল, রবার্টকে হাসলে খুব হ্যান্ডসাম লাগে৷ আজকের ব্লু শার্টেও তাকে হ্যান্ডসাম লাগছে।

নিউইয়র্কের পার্ক এভিনিউয়ের মতো বিজি সড়কেও দুইজন মানুষের হৃদয় জুড়ে গেল আজ৷

সে বাসায় এসে পিটারকে তার সিদ্ধান্ত জানালো। পিটার খুশিতে ইউরেকা বলে নাচলো কিছুক্ষণ। অতঃপর খুব সাধারণ ভাবে কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও ফ্রেন্ডকে ইনভাইটেশন দিয়ে বিকেলেই চার্চে রবার্ট আর জুইয়ের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। জুই বিয়ের সময় পিটারের স্ত্রীর হুয়াইট ব্রাইডাল গাউনটা পরেছিল। চুলে একটা ফ্লাওয়ার ক্রাউন আর মাথায় সাদা নেটের ঘোমটা লাগিয়েছিল। হাতে ছিল অর্কিডের তোড়া। রবার্ট সাদা শার্ট আর ব্লাক স্যুট পরলো৷ স্যুটের পকেটে রেড রোজ ছিল। বিয়ের পর যখন রবার্ট তাকে কি*স করে তার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। সারাজীবন নিজেকে আমেরিকান ভাবলেও সেসময় তার মনে হলো সে আসলে আমেরিকান নয়। তার রক্তে বাংলা আছে। নাহলে কি’সিং টা’ই’মে সে লজ্জা পেত না৷ স্বাভাবিক একটা ট্রেডিশন হিসেবে নিত৷

____________________________

চট্টগ্রামের আউটলেট ওপেনিংয়ের দিন সকাল থেকে কোলাহলপূর্ণ ছিল। ভাইরাল ছবির জন্য দারুণ মার্কেট পায়। প্রচুর কাস্টমার ভীড় করে নতুন আউটলেট ভিজিটিং করার জন্য। কাস্টমারদের জন্য উপহারের ব্যবস্থাও ছিল৷ কিন্তু বেশিরভাগ কাস্টমার ভাইরাল হওয়া পিকচার দেখে হুজুগে এসেছে। দিনটা খুব ভালো কাটলো। সাকসেস পার্টির আয়োজন করা হলো। ন্যান্সি ম্যাডাম খুব খুশি৷ তাদের টিম যেই হোটেলে উঠেছে সেখানেই পার্টি ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। মিরা খুব সুন্দর একটা কালো রঙের শাড়ি পরে ইমাদকে কল দিল। রাগের কথা ইমাদ ততোক্ষণে ভুলে গেছে। ইমাদ জানালো সে বাইশ তারিখ সৃজার জন্মদিনে যাবে। তাকে যেন যেতে দেয় মা। মিরার খেয়াল হলো কাল রাতে সৃজার আম্মু কল করেছিল। কি গিফট নিবে সেটা নিয়ে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করল ইমাদ৷

মিরা পার্টির হলে আসলো৷ ইমান তখন একজন এমপ্লয়ির সঙ্গে গল্প করছে। তাদের দু’জনের মধ্যে চোখাচোখি হলো। আজ মিরা চোখ সরিয়ে নিল না। সে চোখে চোখ রেখে হাসল৷ ইমান নিজের বুকের দিকে আংগুল দিয়ে ইশারা করে। এর অর্থ তার হাসি সোজা ওর বুকে গিয়ে লেগেছে৷ মিরা খিলখিল করে হাসলো তার কাণ্ড দেখে৷

মিরা তার দিকে এগিয়ে আসলেই ইমান বলে উঠে,
“She walks in beauty, like the night
Of cloudless climes and starry skies;
And all that’s best of dark and bright
Meet in her aspect and her eyes;”

~ Lord Byron~

মৃদ্যু রোমান্টিক মিউজিকে ইমানের বলা জনপ্রিয় কবিতাটা শুনে মিরার মনে হচ্ছে এই কবিতাটা কেবল তাকে উৎসর্গ করে লেখা। ইমান তার সঙ্গে ডান্স করার জন্য প্রোপোজাল দেয়। সে না করল না। একটা চমৎকার মিষ্টি প্রেমময় টিউন বাজছে। দু’জনের মনেই প্রেমের প্রদীপ দাউদাউ করে জ্বলছে৷ আলো-আঁধারির এক অদ্ভুত মিশ্রণে দুজনে কাছাকাছি এসে হাতে হাত রাখে। চোখে চোখ রাখে। আজ মিরার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে বড় ভালো লাগছে। ইমানের বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল চোখ দুটি চোখের ভাষা দিয়ে তাকে অনেক কিছু বলতে চাইছে৷ মিরা সেই চোখের ভাষায় লেখা উপন্যাসটা পড়ার চেষ্টা করছে৷ অবশেষে কিছুক্ষণের মধ্যে সে সবটা পড়ে ফেলে!

সাকসেস পার্টি শেষ হলে মিরা আর ইমান বীচে গেল। বীচ পুরা সুনশান। হোটেলের আলোয় অন্ধকার কিছুটা লোপ পেয়েছে। তবে আজ জোৎস্না রাত। চাঁদের আলো সমুদ্রের ঢেউয়ে উপচে পরছে৷ পানিতে চাঁদের প্রতিফলন এবং বহুদূর থেকে ঢেউ এসে তাদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। শোশো বাতাসের মাঝে তারা হাঁটছে। মিরার চুলগুলো যখন এলোমেলো করে উড়ছে সে বিরক্ত হয়ে চুলে হাত খোপা করতে চাইলে, ইমান বাঁধ সাধে বলে, ” কন্যা রে কন্যা তোর বাকা চুলেতে আর খোপা বাইধো না।”

মিরা আরেকবার খিলখিল করে হাসলো। আজ বহুদিন বাদে সে খুশি। মন খুলে হাসছে। সামনে থাকা মানুষটাকে তার বিশ্বাস করার জন্য মন নিজ থেকে সায় দিচ্ছে। ভরসা করতে মন চাইছে। শুধু তাই না, আরেকবার কোন কারণ ছাড়াই ভালোবাসতে মন চাইছে। ওর প্রতি রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা বা অভিমান সব আজ সমুদ্রের ঢেউয়ে চোখের দৃষ্টিসীমার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, সমুদ্রের ঢেউতে, সাগরের বুক থেকে ভেসে আসা কোন শামুকের খোলস থেকে দামী মুক্তার মতো ভালোবাসা বেরিয়ে আনতে মন চাইছে তার!

ইমান হুট করে তার ডান হাত ধরল। এরপর অন্যহাতে মাথা চুলকে আগাতে লাগে। মিরা মৃদ্যু হেসে তার সঙ্গে পথ চলা শুরু করে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। ও হাত ধরলেই বুকে টান লাগে। প্রচণ্ড ভালোলাগা বুকে এসে ভর করে৷ মিরা তার অন্যহাত দিয়ে মুখ থেকে এলোমেলো চুল সরিয়ে নিয়ে বলে, ” ইমাদের আব্বু শুনছেন?”

ইমান বলে, “কী?”

মিরা খুব আদূরে কণ্ঠে বলে, ” I need You like a sky needs a moon! ”

সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ তোলার শব্দে, বিশাল শূণ্য আকাশে, বৃত্তাকার জোছনা ঝড়ানো চাঁদের নিচে এমন বাক্য শুনে হতভম্ব হয়ে পরে ইমান। সে যেন নিজের কানে ভুল শুনল৷ এই বাক্যটা তাদের দু’জনের ভালোবাসা প্রকাশের অঘোষিত ট্যাগ লাইন। তারা কেউই “আই লাভ ইউ” বলাটা তেমন পছন্দ করে না। তার মানে……. মিরা আরেকটাবার তাকে ভালোবাসলো? আবারো তাকে নিজের করে নিতে আমন্ত্রণ জানালো? ইমানের চোখ ভিজে উঠে। আজ এতো শান্তি লাগছে কেন? কেন সমুদ্রের সৌন্দর্য হুহু করে একশ গুণ বেশি সুন্দর হয়ে গেল? কেন সে রাত্রিবেলাও ঝলমলে রংধনু দেখতে পারছে?

মিরা তার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। সে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থেকে এক প্রকার পাগলের ন্যায় মিরাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। দুইজনই চুপ। আজ শুধু অনুভূতি বুঝে নেওয়ার দিন। এদিনে কেউ বলে না। শুধু একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে, হাত হাত রেখে, নিজের ভাগের ভালোবাসাটুকু অনুধাবন করে। বুক পেতে মনের ভেতরকার সব কথা শুনে নিতে হয়।

মিরারা যখন ঢাকা পৌঁছে তখন সকাল সাতটা। সেদিন সকালে আর তারা অফিস গেল না। ছুটি নিল রেস্ট নেওয়ার জন্য। বাসায় এসে ইমাদের সঙ্গে দেখা হলো না। সে স্কুলে চলে গেছে ততোক্ষণে। তবে ইমাদ স্কুল থেকে ফিরে বাবা-মাকে দেখে খুব খুশি হলো৷ বাবার কাছে নিজের আবদারের ঝুলি নিয়ে খুললো৷ ড্রয়িংরুমে সে মায়ের হাতে ভাত খাচ্ছিল আর বাবার সঙ্গে গল্প করছিলো৷ ইমাদ খেতে খেতে বললো,” বাবা আমার একটা কিউট ছোটবোন চাই। সৃজার ছোট বোন আছে৷ আমার নাই কেন? তুমি আমাকে একটা ছোটবোন এনে দাও না প্লিজ৷”

ছেলের আদুরে আবদারে ইমানের মন আনন্দে মেতে উঠে। সে দুষ্টু হেসে মিরার দিকে তাকালো। মিরা রাগতে চেয়েও না রেগে বলে, ” বাবু, খাওয়ার সময় এতো কথা বলতে হয় না।”

ইমান অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ তুলল। সে বলে উঠে, ” ছেলের সব আবদার তো বাবাকেই পূরণ করে দিতে হবে৷”

মিরা কটমট করে তাকিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে আস্তে করে বলে, ” এক বাবুর বাপ হয়ে সাধ মিটে নি?”

–” উহু মিটে নি, এবার রাজকন্যার পিতা হতে চাই।”

বিকেলের দিকে ইমাদ বায়না ধরল সে সৃজার জন্য গিফট কিনতে যাবে সঙ্গে নিজের জন্য শার্ট কিনবে নিউ৷ ইমান ছেলের কথা শুনে রুমে এসে মিরাকে জিজ্ঞাসা করল, ” সৃজা কী ইমাদের গার্লফ্রেন্ড হয়?”

মিরা তার প্রশ্ন শুনে রেগে উঠে বলে, ” আপনি কী পাগল নাকী ছাপল?”

ইমান কাচুমাচু করে বলে, ” যেমন কেনাকাটা করার আবদার করছে মনে হচ্ছে ছেলে আমার শ্বশুড়বাড়ি যাবে৷”

বিকেলে ইমাদকে নিয়ে শপিং করে আনা হলো। রাতে সকলে একসঙ্গে খাওয়ার সময় ইমান জানল, তার বাবা-মা দেশে আসছে। শুধু তাই না, হাসনাহেনা ইরার বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ইরা লজ্জায় হ্যাঁ বা না বলছে না। ওর চোখ-মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুশি৷

ইমান বলে উঠে, ” জামাই-বউ রাজী থাকলে আমাদের কী কিছু করার আছে? ”

সুপ্তি বেগম বলে, ” না, কিছু করার নেই।”

সাদ জোরে বলে উঠে, ” আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

সবাই হাসাহাসি শুরু করল৷ পরেরদিন মিরা অফিস গেল না। ইমান একা বেরিয়ে যায়। দুপুরের দিকে, ইমাদ নতুন শার্ট পরে মায়ের কাছে এসে বলল, ” আম্মু, বাবার পারফিউম আমার গায়ে মেখে দাও তো।”

মিরা বলে, ” কেন? ”

–” তাহলে আমিও বাবার মতো হ্যান্ডসাম হয়ে যাব।”

মিরা হেসে ছেলেকে চুমু খেল৷ ড্রাইভার তাকে নিয়ে গেল। এ যাবত যা যা ঘটছিল সবকিছু রুপকথা মতো সুন্দর ছিল৷ কিন্তু জীবন কখনো রুপকথা নয়। জীবন বারবার আমাদের ভয়ংকর সব পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করাবে৷ চোরাবালিতে চুবিয়ে মারবে৷

দুপুর তিনটায় সৃজার মায়ের কল এলো মিরার ফোনে। সে কল রিসিভ করতেই উনি বলে উঠে, ” ভাবী ইমাদ হুট করে খুব অসুস্থ হয়ে পরলো। ওকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে৷ আপনি আসেন৷”

মিরা চোখে আঁধার দেখা শুরু করল। এখন দিন নাকি রাত সে ভুলে গেল৷ ছুটে গেল ছেলের কাছে৷ হাসপাতালে যাওয়া তার জন্য মোটেও সুখকর অনুভূতি ছিল না। বরং ওখানে তার জন্য বিরাট বড় এক দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল। যেই দুঃসংবাদ তার জীবনের সময়কে থমকে দিল৷

চলবে।

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Last Part (শেষ অংশ)

সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা মেঘলা ছিল। আকাশের বজ্রপাতে হঠাৎ করে হাসপাতালের গুমোট রুমটা বিদ্যুৎ গতিতে আলোকিত হয়ে উঠে মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেল৷ কারেন্ট চলে গেল। এরপর এক-দুই সেকেন্ডের মধ্যে জেনারেটর অন হলো। জেনারেটরের ভট ভট আওয়াজে মিরার মাথা ধরে যায়। তার কানে ভোভো শব্দ হচ্ছে। সৃজার আম্মু ডাক্তার লুবনা তাকে কিছু বলছে যার একটা শব্দও মিরা কর্ণপাত করল না৷ সে নিষ্পলক চাউনি মেলে বেডে ঘুমন্ত ইমাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ নিষ্পাপ, আদুরে, ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে এক মিনিটের মাথায় সে মুখে ওড়না চেপে কাঁদা শুরু করল৷ ইমাদ এখন জেগে থাকলে, নিশ্চয়ই লাফ দিয়ে তার বুকে এসে তাকে ঝাপ্টে ধরে জিজ্ঞাসা করত, ” আম্মু তুমি কাঁদছো কেন?” তার ছেলে কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। শুনলেই মন ভরে যায়। কেন আজ তবে বাবু কথা বলছে না?

ডক্টর লুবনা বলে উঠে, ” দুপুরে ওরা সবাই একসঙ্গে লাঞ্চ করে খেলা-ধুলায় ব্যস্ত ছিল। হুট করে ইমাদের কি হলো! সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল৷ আমি দেরি না করে সাথে সাথে আমাদের ক্লিনিকে এনেছি৷ কিছু টেস্ট করতে দিয়েছি। রিপোর্ট এখনো আসেনি। ”

–” আপনি কেন এসব হাবি-জাবি টেস্ট করলেন? আমার ছেলে সুস্থ আছে। শুধু শুধু টেস্ট কেন করাচ্ছেন?”

লুবনা নরম সুরে বলে, ” আমি জানি ইমাদ সুস্থ আছে। কিন্তু….. ”

মিরা কঠিন চোখে তাকালো তার দিকে। তিনি অসহায় গলায় বলে, ” আমার কিছু ডাউট হচ্ছে। রিপোর্ট আসলেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে৷ ইমাদের আব্বুকে কল করেছেন? আমি জানাচ্ছি ভাইকে৷”

ডক্টর লুবনা এরপর কি করলেন মিরা দেখেনি। সে বাবুর পাশে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল। গভীর নিন্দ্রায় আচ্ছন্ন সে৷ মিরা তার কপালে অসংখ্য চুমু খেল৷ এই মূহুর্তে তার মাথা ফাঁকা। কোনকিছু করার ক্ষমতা নেই৷ ইমানকে যে ফোন করবে সে শক্তি বা সেন্স কোনটাই নেই তার। শুধু না চাইতেও চোখের জল ফেলছে সে।

ইমান এলো আরো আধা ঘন্টা পর। ইমান আসতেই মিরা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ল। তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলো। ইমান নিজেই হতবিহ্বল। কোন কিছু ঠাওর করতে পারছে না সে। সে নিজেই শক্ত থাকতে পারছে না৷ ইমাদের সামান্য সর্দি-কাশি জানলেই খাওয়া হারাম হয়ে যায়, সেখানে তার বাচ্চা নাকি এতো গুরুত্বর অসুস্থ হলো যে হসপিটালে ভর্তি। বিকেলের আগেই পরিবারের বাকি সদস্যরা এসে পৌঁছে হাসপাতালে। প্রত্যকেই ভেতরে ভেতরে চিন্তিত এবং কষ্টে আছে৷

বিকেলের পর ডক্টর লুবনা ইমাদের পেরেন্টসকে স্পেশালি তার কেবিনে ডাকল৷ তারা দু’জন কেবিনে প্রবেশ করল। এসির বাতাসে হীম শীতল কেবিনের পরিবেশ।

সৃজার আম্মু চোখের চশমা খুলে বলল, ” ভাবী, ইমাদ একদম আমার ছেলের মতো৷ আমার মেয়ে যেমন আমার কাছে আমার জীবন, তেমনই ইমাদও আপনাদের প্রাণশক্তি। আসলে একটা ব্যাড নিউজ আছে।”

ইমানের বুক ধক করে উঠল। মিরা হয়তোবা ওনার কথা কানে তুলছে না। সে মাথা নিচু করে অনড়ভাবে বসে আছে৷

লুবনা বলে উঠে, ” ইমাদের কিছু টেস্টের সঙ্গে সিটি স্ক্যান করলাম। বলতে গেলে আমি নিজের ডাউট ক্লিয়ার করার জন্য ফুল বডি একবার চেক আপ করিয়েছি। এন্ড হিজ মেডিকেল রিপোর্ট ইজ শোয়িং…….. ”

ইমান নিস্তেজ গলায় বলে, ” প্লিজ এমন কিছু বলবেন না যেটা আমাদের সহ্য সীমার বাইরে।”

লুবনা মুখ কালো করে বলে, ” আই এম সর‍্যি। আমি নিজেই মানতে পারছি না৷ আপনাদের কীভাবে বলব!”

মিরা কেঁদে উঠে বললো, ” আমি কিছু শুনতে চাই না। আমি জানি আমার বাবু সুস্থ আছে। ”

লুবনা ইমানের দিকে তাকিয়ে রিপোর্ট এগিয়ে দিয়ে বলে, ” ইমাদের ব্রেইন টিউমার।

সেইদিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হলো মিরার নতুন যুদ্ধ। ছোট্ট ইমাদের সঙ্গে হওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি নিজের ভাগ্যের পরিহাস ভাবতে শুরু করল৷ ইমাদ কিছু-ই বুঝল না। সে ব্রেইন টিউমার মানে কী তাই জানে না। শুধু এতোটুকু জানল, সে সামান্য অসুস্থ। আম্মুর কথামতো চললে একদম সুস্থ হয়ে যাবে সে। বরং ও আরোও খুশি হয়, স্কুল মিস দিতে পারবে বলে!

তাকে রাতের মধ্যে রিলিজ দেওয়া হলো৷ ডক্টর লুবনা জানালেন, রেগুলার চেক আপে রাখতে আর ভয় না পেতে৷ আজকাল চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব উন্নত। ইমাদ ইনশাআল্লাহ রিকোভার করবে৷

মিরা শতভাগ নিশ্চিত তার ছেলে সুস্থ আছে৷ ভবিষ্যতেও সুস্থ থাকবে৷ সৃষ্টিকর্তা তার পরীক্ষা নিচ্ছে। তাকে মেয়ে হিসেবে সহনশক্তির পরীক্ষা দিতে হয়েছে৷ স্ত্রী হিসেবে ধৈর্য্যশক্তির পরীক্ষা দিতে হয়েছে৷ এখন মা হয়ে পরীক্ষা দিবে সে। পরের দিন থেকে শুরু হলো নতুন সংগ্রামী জীবন। এবারের সংগ্রামের দিনে সে ইমানকে সর্বদা পাশে পেয়েছে৷ মিরা তার চাকরিটা ছেড়ে দিল৷ আপাতত এই মূহুর্তে তাকে খুব কেয়ারফুলি ইমাদের যত্ন নিতে হবে৷ মেডিসিনের এক ডোজও এক মিনিট পরে খাওয়াবে না৷ বাসার হাসি-খুশি পরিবেশ যেন মুহূর্তেই আগুনে পুড়ে যাওয়া ছাই হয়ে গেল। মিরার বাবা পরেরদিনই ইমাদকে দেখতে আসলেন। আজ কেউ কোনধরনের তর্কে জড়ালো না। কিন্তু মিরা তার সাথে কোন কথা বলেনি। এরপর দেখা গেল প্রতিদিনই কোন না কোন আত্মীয় আসছে দেখা করতে। সবাই দুঃখ প্রকাশ করছে৷ সান্ত্বনাবাণী দিচ্ছে৷ ওই সব সান্ত্বনাবাণী ইমান আর মিরার জন্য ছিল বিষভরা কাঁটা। দুর্বিষহ রাত গুলোতে অজস্র চোখের পানি ফেলতে লাগলো মিরা৷ দু’জনেরই রাতের ঘুম হারিয়ে যায় কোন এক চোরাবালির কবলে পরে৷

___________________

জহির সাহেব ও হাসনাহেনা যেদিন বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে পৌঁছে, ঠিক তার আগেরদিন হুট করে ইমাদ গুরুতর অসুস্থ হলো। হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আবারও। এয়ারপোর্টে তাদের সাদ একা আনতে গিয়েছিল। ইমাদের হাসপাতালে ভর্তির কথা শুনে হাসনাহেনা তার বাড়িতে যেতে চাইল না৷ বরং সরাসরি হাসপাতালের দিকে যায় তারা৷ জহির খান আর হাসনাহেনা হাসপাতালে যেতেই ইমানের সঙ্গে দেখা হলো। ইমান তাদের দেখে এগিয়ে এসে বলে, ” কেমন আছো বাবা?”

জহির খান ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠে। কতদিন পর বাবা বলে ডাকলো ছেলে! ছেলেটার চেহারার দিকে তাকালো যাচ্ছে না। চোখের নিচে কালি জমে গেছে৷ নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারে না। তারা দু’জন প্রথমবার সরাসরি নিজের নাতিকে হাসপাতাল বেডে দেখল৷ হাসনাহেনা মুখ চেপে কেঁদে অনেকক্ষণ ইমাদের হাত ধরে বসে থাকলেন। এই নিষ্পাপ বাচ্চাটার চেহারায় এতো মায়া! আসামাত্র কতো কিছু জিজ্ঞাসা করলো দাদা-দাদীকে। সে নাকি ফেসবুকে তাদের ছবি দেখে প্রায়। ইমাদ জেগে থাকতে থাকতে দাদা-দাদীর সঙ্গে অনেক কথা বলে ফেলত। ভাসা ভাসা চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। সে আরোও অনেক গল্প করতে চাচ্ছিল অসুস্থ জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবুও সে জানায় তার ফেসবুক একাউন্ট খোলার খুব ইচ্ছা৷ কিন্তু আম্মু তাকে ফেসবুক খুলে দিবে না। এটাও জানালো তার ভীষণ মাথাব্যথা করছে। চোখ খুলে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। তার কিছুক্ষণ পর নার্স এসে ইঞ্জেকশন পুশ করল। হাসনাহেনা অবাক হয়ে দেখল এইটুকু একটা বাচ্চা অথচ ইঞ্জেকশন পুশ করার সময় একবিন্দু ভয় পেল না৷ একটু পর সে ঘুমিয়ে গেল। ঘুমন্ত বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থেকে সে চোখ দিয়ে পানি ফেলে। এতো কষ্ট হচ্ছে কেন বুকে?

সন্ধ্যার পর জহির খান আর হাসনাহেনাকে জোর করে সুপ্তি বেগম বাসায় আনলেন৷ সঙ্গে ইমানও আসলো৷ মানুষ গুলো এতো দূর জার্নি করে এসে সোজা হাসপাতাল গিয়েছে৷ খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, ফ্রেস হওয়া নেই ওভাবেই পরে ছিল নাতির সঙ্গে। জহির সাহেব তো আসতেই চাচ্ছিলেন না। ইমান জোরাজোরি করে আনলো। গাড়িতে তারা খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলল যেন তাদের মধ্যে কখনোই কোনদিন কোন ঝগড়া, ঝামেলা ছিল না৷

জহির সাহেব থমথমে গলায় বলে, ” ডাক্তার কী বলছে? ”

ইমান ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিয়ে বলে, ” ডাক্তার তো তেমন কিছু পজিটিভ কথা বলছে না। টেস্টের ওপর টেস্ট দিয়েই চলেছেন।”

জহির খান উত্তেজিত হয়ে গেল এবং বলল, ” তুমি ওকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার ট্রাই করছো না কেন? আমেরিকা নিয়ে আসো। আমাদের কী টাকার অভাব আছে? এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আমার আস্থা নাই।”

ইমান বলে উঠে, ” বিগত পনের দিন তো ভালোই চলছিল সবকিছু। আমি চেষ্টা করছি। খুব শ্রীঘ্রই ওকে নিউইয়র্ক নিয়ে যাব৷”

বাসায় এসে গোসল সেড়ে হাসনাহেনা ভাত খেলেন। যদিও গলা দিয়ে ভাত নামছিল না। তাও জোর করে খেয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলেন৷ বারান্দায় ঢুকতেই তার বুক মুচড়ে উঠে। বারান্দায় একপাশে খেলনা দু’টো গাড়ি পরে আছে। তার আরেক পাশে খেলনা সুপারম্যান পুতুল৷ নিশ্চয়ই এগুলো দিয়ে তার নাতি খেলা-ধুলা করে৷ একটু পর ইমান নিজে চা নিয়ে আসলো। তার হাতে চা দিয়ে বারান্দার ফ্লোরে বসে ধপ করে ইমান। হাসনাহেনা মোড়ায় বসে ছিলেন৷ ইমান খেলনা গুলোর দিকে তাকিয়ে বেদনাভরা কণ্ঠে বলে,” পড়শু দিনও ইমাদ সুস্থ ছিল৷ মেডিসিন চলছিল৷ আর আজকে…….. ”

তার গলা ধরে আসলো। সে হাসনাহেনার চোখে চোখ রেখে কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় না৷ ক্ষণেই সে হাসনাহেনার হাঁটুতে মাথা রেখে প্রায় কেঁদে উঠে বললো, ” মা, আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আর পারছি না, মা। কেন বারবার আমার সাথেই এমন হয়? কেন? আচ্ছা আমি কী খুব খারাপ একটা মানুষ? সৃষ্টিকর্তা কী আমায় পাপের শাস্তি দিচ্ছে? মা, আমার আদরের ছেলেটার সঙ্গে কেন এমন হলো? সবই তো ঠিক চলছিল। কেন? কেন সৃষ্টিকর্তা আমার সঙ্গে এমন করলো?”

হাসনাহেনা থমকে যায় ইমানের মুখে “মা” ডাক শুনে। সে কম্পনরত হাতে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” ধৈর্য্য ধরো বাবা। সব ঠিক করে দিবে সৃষ্টিকর্তা।”

–” আর কী-ই বা ঠিক হবে? ”

বলেই ইমান থামলো এরপর করুণ গলায় বলে, ” ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে তাদের পক্ষে কিছু করা পসিবেল না৷”

হাসনাহেনার বুক ধুক করে উঠলেও সে শক্ত হয়ে বলে, ” এক ডাক্তার পারবে না বললেই কী হলো নাকি? পৃথিবীতে আরোও অনেক ডাক্তার আছে৷ আমরা বেস্ট ডাক্তার দেখাবো। সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। তুমি শক্ত হও। তাহলে মিরা আর ইমাদকে কে সামলাবে? ”

ইমান হাসনাহেনার হাঁটুতে মাথা লুকিয়ে চোখের পানি ফেললো৷ এই কান্নাটা তার জন্য খুব দরকার ছিল৷ মন হাল্কা করার প্রয়োজন ছিল৷ মন হাল্কা নাহলে নিজেকে পাথরের মতো মজবুত রাখা সম্ভব হচ্ছিল না৷

জহির খান আড়াল থেকে সবটা শুনল। সে দ্রুত রুমে ফিরে এলো এবং ওযু করে জায়নামাজ বের করে। জায়নামাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক দূরের আত্মীয়ের মতো। বাংলাদেশে থাকতে তাও যা জায়নামাজের ভাঁজ খোলা হত৷ কিন্তু নিউইয়র্ক গিয়ে তা একদমই হত না৷ কিন্তু আজ সে হাজার পাপিষ্ঠ হলেও সৃষ্টিকর্তার করুণা চায়। তার দরবারে কাঁদতে চান তিনি৷ জীবনে এখন একটাই চাওয়া তার — তার নাতি ইমাদ যেন পুরাপুরি সুস্থ হয়ে যায়৷

বিশ দিনের মাথায় ইমাদকে নিউইয়র্ক নিয়ে যাওয়ার সকল অফিশিয়াল কাজ সম্পন্ন হয়৷ এই বিশদিনে ওর হেলথ কন্ডিশনের উন্নতি হয়নি। বিশ দিনের মধ্যে পনের দিনই সে হাসপাতালে ভর্তি ছিল৷ ইমান খুব দ্রুত টিকিটও কেটে ফেলল। একটা মিনিটও তারা অপচয় করতে চায় না। হাসনাহেনা-জহির খান, সাদ তারাও ইমাদকে সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্ক যাচ্ছে৷ তাদের সঙ্গে ইমান-মিরাও যাচ্ছে। আবারও নিউইয়র্কে। একটা নতুন আশা বুকে চেপে নিয়ে অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধানে সমুদ্র তের নদী অতিক্রম করতে যাচ্ছে।

যাওয়ার দিন সুপ্তি বেগম খুব কাঁদছিলেন৷ ইমাদের শরীর তখন খুব একটা ভালো না। নাদুসনুদুস শরীরটা শুকিয়ে গেছে৷ ইমাদ খুব অবাক হয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে সি অফ করতে অনেকেই এসেছে। তাদের স্কুলের সবচেয়ে রাগী ম্যাথ মিস সহ আরো চারজন স্যার-ম্যাডাম৷ তার কয়েকজন ক্লাসমেট এসেছে৷ প্রত্যকেই তাকে “গেট ওয়েল সুন” কার্ড দিয়েছে৷ কিন্তু সৃজা আসেনি৷ ইমাদ বার কয়েক খুঁজলো তাকে। পেল না। নানাভাই ও এসেছে এবং বাবার হাত ধরে খুব আকুতিভরা কণ্ঠে কিছু বলছে৷ নানাভাই হাত দুটো এক করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করলে বাবা সঙ্গে সঙ্গে তার হাত চেপে ধরে কিসব বলল। ইমাদ দূর থেকে শুনতে পায়নি৷ অপরদিকে তিনজন বিদেশী মানুষও এসেছে৷ ওনাদের মধ্যে মাঝেরজন তার খালামনি হয়৷ যদিও বা ইমাদ সোনালী খালামনি ছাড়া আর কাউকেই খালা হিসেবে ডাকে না কিন্তু এই মানুষটাকে তার পছন্দ হয়েছে৷ একবার হাসপাতালে তাকে দেখতে এসে বলেছিল, ” আমি যদি আগে তোমার সাথে মিট করতাম তাইলে তোমাকেই বিয়ে করে নিতাম৷ এই যে মিষ্টার তুমি এতো হ্যান্ডসাম কেন শুনি? ”

ইমাদের খুব লজ্জা লেগেছিল আবার আনন্দও হচ্ছিল। ওর বহুদিনের শখ ছিল হ্যান্ডসাম হওয়ার। ইমাদ নানির কাছে ছুটে গিয়ে টুপ করে চুমু খেল এরপর গম্ভীর মুখ করে বলে, ” নানিমনি তুমি নিজের খেয়াল রাখবে। মিমোকে বলবে আমার খেলনায় যেন হাত না দেয়৷”

সুপ্তি বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ” আচ্ছা আমার সোনাপাখি।”

ইরা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। ইমাদ বুঝতে পারছে তার বড় ধরনের কোন অসুখ করেছে কিন্তু আম্মু তাকে এসব জানাচ্ছে না৷ তাকে বিদায় দেওয়ার জন্য আরোও হাজির হয়েছিল । তার বড় নানুও এসেছে। সবার কাছ থেকে বিদাই নিয়ে সে বাবা-মায়ের হাত ধরে এয়ারপোর্টের ভেতর দিকে হাঁটা ধরে। সে তবুও পেছনে ফিরে সবাইকে দেখে নিল। সৃজা শেষ সময়ে তাকে সি অফ করতে এলো কীনা এটাও একবার চেক করে নিল । কিন্তু সৃজার দেখা মিলল না।

সুপ্তি বেগম দাঁড়িয়ে রইলেন মূর্তির মতো শক্ত হয়ে৷ ইমাদকে তার দেখা যাচ্ছে না। ভেতরে প্রবেশ করেছে তারা৷ ইরা তাকিয়ে থেকে বলে, ” আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা। বুক ফেটে যাচ্ছে৷”

তখনই সৃজা এবং তার মা ডক্টর লুবনা এসে উপস্থিত হলো। ইরা জানালো ইমাদরা ভেতরে প্রবেশ করেছে৷ সম্ভবত তার সঙ্গে দেখা হবে না। সৃজা মন খারাপ করে তার মায়ের দিকে তাকালো। লুবনা অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকালো।

ইরা সৃজার গালে হাত রেখে বলে, ” মন খারাপ করো না। ইমাদ যখন ফিরে আসবে তখন আবার দেখা করো৷”

ডক্টর লুবনা আকাশের দিকে তাকালো। সে নিজে একজন ডক্টর। ইমাদের রিপোর্ট খুটিনাটি সব মুখস্থ করেছে৷ সবসময়ই নেগেটিভ কিছুরই আভাস পেয়ে আসছে৷ তবুও করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করে, যেন অসম্ভব কিছু ঘটে৷ মিরাকেল কিছু হোক।

আকাশভর্তি ঘন কালো মেঘ। বিজলি চমকাচ্ছিল। ধুলো বাতাসের তোড়ে চোখে ধুলো ঢুকে জ্বালা করা শুরু করল৷ ডক্টর লুবনার চোখ দিয়ে মেয়ের ক্লাসমেটের জন্য চোখের জল গড়িয়ে পরে৷

__________________________

পরিশিষ্টঃ

সেদিন ওয়েদার খুব খারাপ ছিল। যেকোন সময় স্নোফল শুরু হবে। সাদ ফোন করে জানালো আজকে আসতে পারবে না। চেম্বারেই থেকে যাবে৷ রুগীর সিরিয়াল প্রচুর৷ কাল সকাল সকাল ওয়েদার ভালো থাকলে রওনা দিবে।

ইরা ফোনের মধ্যেই তাকে ঝাড়তে লাগলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” আসছে আমার সাইকোলজিস্ট রে! তুই ছাড়া এই নিউইয়র্কে আর বুঝি কোন সাইকোলজিস্ট নাই? কালকেও তুই লেইটে বাসায় আসছিলি। পড়শু ফ্রেন্ডের সঙ্গে পার্টি করে রাত একটায় আসলি।”

সাদ আর শুনে নি। ফোন কেটে দিয়েছে৷ ইরা এবং তার দম্পত্য জীবন ভালোই কাটছে। শুধু ইরা রেগে গেলে তাকে তুই বলে ডাকে। এছাড়া তাদের মধ্যে কোন সমস্যা নেই। তারা হ্যাপিলি ম্যারিড কাপল৷ সাদ ফোন রেখে এসিস্ট্যান্টকে পরবর্তী রোগীর হিস্ট্রি ফাইল দিয়ে যেতে বললো৷

ইমান গাড়ি ড্রাইভ করে বাসায় ফিরল সন্ধ্যা সাতটায়৷ মিরাকে প্রমিজ করেছিল আজ জলদি ফিরবে৷ মিরা তাকে কী যেন বলবে তাই ইমানের মূল্যবান সময় চাই তার। এজন্য সে প্রমিজ করেছিল পাঁচটার আগেই আসবে৷ কিন্তু অফিসে চাপ ছিল৷ জুই আর রবার্ট দশমবারের মতো হানিমুনে গেছে৷ পিটার আর জুই তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর অনুরোধ করে পুনরায় অফিসে জয়েন্ট করতে। ইমান আর না করেনি৷ ওদের দু’জনের অবর্তমানে সব কাজের চাপ তার উপর দিয়ে যাচ্ছে৷ সে বাড়ি ফিরতেই হাসনাহেনা গেইট খুলে দিয়ে বলে, ” বাবা রে আজকে তোমার কপালে শনি আছে৷”

–” মিরা আবার রেগে গেছে মা?”

–” তা নয়তো কী? তুমি পাঁচটায় আসবে বলে আসো নি জন্য ও নাক ফুলিয়ে স্নোবুট পরে তোমার বাবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে৷”

–” বাবা ওকে কেন গাড়ির চাবি দিল?”

হাসনাহেনা বলে উঠে, ” তুমি তো জানোই, তোমার বাবা তার বড় পুত্রবধূকে কতোটা স্নেহ করে৷ মিরাকে সে কোনদিন না করবে না।”

ইমান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে৷ হাসনাহেনা এক গ্লাস জুস এগিয়ে দিল। সে জুস খেয়েই বললো, ” যাই শেহজাদীর রাগ ভাঙ্গিয়ে আনি৷”

হাসনাহেনা হাসলেন৷ ইমান জানে মিরা কোথায় কোথায় যেতে পারে৷ সে গাড়ি বের করল। বরফ পরতে শুরু করেছে। পেঁচা তুলোর মতো নরম বরফ হাওয়ায় ভাসছে। পাশের বাসার ইটালিয়ান ফ্যামিলির কর্তা তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোমার ওয়াইফ আবারোও রাগ করে বেরিয়ে গেছে? ”

–” ইয়েস৷”

ইমান যখন ব্রুকলিন ব্রীজের সামনে এসে থামে তখন রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে৷ তবে এখনো সেইভাবে তুষারপাত শুরু হয়নি।ওয়েদার রিপোর্ট থেকে জানা গেছে গভীর রাতে তুষার ঝড় বইবে৷ ইমান মিরার নির্দিষ্ট প্রিয় জায়গাটায় এসে দাঁড়াতেই দেখল হার হাইনেস পেছনে ঘুরে বসে আছে। সে পিছনে থেকেই ওর চোখ তার হাত দিয়ে বন্ধ করে বলে, ” আমি যা দেখি তুমি কী তা দেখো?”

–” চোখ বন্ধ করে রাখলে কেউ কীভাবে দেখবে? ”

— হৃদয়ের আঁখি মেলে দেখবে৷ এবার বল আমি যা দেখি তুমি তা দেখো?”

— ” আপনি কী দেখছেন? ”

–” আমি দেখতে পাচ্ছি খুব চমৎকার একটা রাজপ্রাসাদ, যেখানে চারিদিকে ফুল আর ফুল। পাখি গান গায়। প্রজাপতি নেচে বেড়ায়। সেই রাজ্যের শেহজাদী সাদা একটা শাড়ি পড়ে রাজপ্রাসাদের পালিত পায়রা দিয়ে খেলছে এবং তার প্রহরী লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে মুগ্ধ নয়নে দেখছে। এবার বলো তো, তুমি কী সেই রাজকন্যাটাকে দেখতে পাও?”

–” না, পাই না।”

ইমান চোখ খুলে দিয়ে তার কপালে চুমু দিয়ে বলে, ” সর‍্যি ডিয়ার৷ আর লেইট করব না৷”

–” আচ্ছা ঠিক আছে৷”

— চল ফিরে যাই।”

–” কোথায়?”

–” ফেইরিটেলে যেখানে কোন দুঃখ, কষ্ট নেই।”

মিরা হাসল। দুজন গাড়ির সামনে হেঁটে আসল৷ ইমান বলে, ” তুমি আমাকে ফোনে বলেছিলে একটা গুড নিউজ দিবে৷ কী সেটা?”

মিরা সরাসরি তার চোখের দিকে তাকায়৷ ইমান বুঝল মেয়েটা নীরবে কাঁদছে। মেয়েটা এক জীবনে আর কত কাঁদবে?

মিরা বলে উঠে, ” ইমাদের আব্বু?”

ইমান যেন চমকে উঠে। একটা সময় “ইমাদের আব্বু” নাম ধরে ডাকলেই তার মুখে হাসি ফুটত। কিন্তু আজ দু’টো বছর পর এই সময়ে, বর্তমানে দাঁড়িয়ে এই নামটা তার বুকে খালি ব্যথা দেয়। জীবনটা অসার্থক লাগে। নিজেকে বড় অসহায় লাগে৷

তবুও সে হাসিমুখে বলে, ” বল?”

–” আজ একটা স্বপ্ন দেখলাম। খুব সুন্দর একটা বাগানে অনেকগুলো ছোট বাচ্চা ফুটবল খেলছে। আমাদের ইমাদও ছিল সেখানে। সে খেলায় এতো ব্যস্ত যে মায়ের দিকে তাকানোর সময় নেই তার। কী হাসছিল সে খেলার সময়। যেন আজ ঈদ লেগেছে তার মনে।”

এরপর নিজ থেকে সে কেঁদে উঠে বললো, ” ইমান আমি আর কাঁদতে চাই না। সুখে থাকতে চাই৷ আপনি প্লিজ আমার সব দুঃখ ঘুঁচিয়ে দিন। আপনার কল্পনা করা ওই ফেইরিটেলে নিয়ে যান যেখানে কোন দুঃখ-যন্ত্রণার অস্তিত্ব নেই।”

ইমান নীরবে তার গালে চিকচিক করা অশ্রু মুছে দিল। ল্যাম্পপোস্টের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে মেয়েটার সঙ্গে সেও কাঁদছে৷ দু’বছর আগে, মৃত্যু নামক ভয়ানক এক দানব তাদের ছোট্ট বাবুটাকে মায়ের বুক থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিনিয়ে নিয়ে গেছে৷ ইমানের মনে হয়, মৃত্যুর কোন বিবেক নেই। মৃত্যুর উচিত ইমাদকে তাদের থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেওয়া। “সন্তান ” হারানোর মতো যন্ত্রণা এই দুনিয়ায় আর একটাও নেই৷ মানুষ বলে সবকিছুর রিপ্লেসমেট হয়৷ কিন্তু ইমান জানে দুনিয়াতে মা-বাবা আর সন্তানের কোন রিপ্লেসমেন্ট হয় না৷ তাদের মধ্যে কেউ একজন হারিয়ে গেলে আজীবন তাদের জায়গাটা শূন্য রয়ে যায়। তার শূন্যস্থানটা কারো সাধ্য নেই পূরণ করার! নিউইয়র্কে ইমাদের অপারেশন করানো হয়৷ সেই অপারেশনের পর বাহাত্তর ঘন্টা লাইফ সাপোর্টে থেকে ও হারিয়ে যায়। নিজে চলে যাওয়ার সঙ্গে মা-বাবার সব সুখ নিজের সাথে নিয়ে গেল৷

–” ইমাদের আব্বু?”

ইমান চমকে উঠে। প্রতিবার এই নামটা কানে আসলে সে ঠিক প্রথম দিনের ন্যায়ই কষ্ট পায়৷

মিরা তার বুকে মাথা রেখে আস্তে আস্তে বললো, ” ইমাদের ছোট্ট বোন আসতে চলেছে৷”

মিরার দেওয়া সুসংবাদটা শুনে ইমান বিষ্মিত হয়ে পরে। মুখে কিছু বলতে পারল না। কেবল প্রেয়সীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অনেক অনেক চাপা বেদনাভরা দীর্ঘ রজনীর পর বুঝি এতোদিনে সৃষ্টিকর্তা তাদের উপর করুণা করলো। তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের কালো ভয়ংকর আধার বুঝি ফুরিয়ে গেল। কাল নিশ্চয়ই তাদের জীবনে একটা নতুন সূর্যোদয় আসবে৷ উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হবে তাদের জীবন। মিরা আবারও হাসবে মন থেকে। ছোট শিশুর হাসি-কান্নায় মৃত দেয়ালগুলোও মরে যেতে চাওয়া গাছে পানি দিয়ে সতেজ হওয়ার মতো সজীব হবে। তার খুব ইচ্ছা করছে এই চমৎকার মেয়েটাকে নিয়ে ভীনদেশে পাড়ি দিতে৷ অজানা কোন গন্তব্যে। কিংবা কোন ফেইরিটেলে? পৃথিবীতে আদৌ কোন ফেইরিটেলের অস্তিত্ব আছে? অস্তিত্ব থাকলে ইমান সেই ফেইরিটেলের ঠিকানা চায়।

বাসায় আসার পর হৈচৈ শুরু হয়ে গেল৷ ইরা সঙ্গে সঙ্গে পায়েস বানাতে শুরু করল৷ গুড নিউজ শোনার পর মিষ্টিমুখ করা দরকার। বাসার মানুষগুলো অনেকদিন পর আজ হাসলো। ইমান তার পরিবারের দিকে চেয়ে থাকল। সবাই মিরাকে ঘিরে রেখেছে৷ হাসনাহেনা নিজ হাতে জুস খাইয়ে দিচ্ছে। এতো এতো সুখের মধ্যেও ইমান অনুভব করে বুকের কোন এক কোণে শূন্যতা বিরাজ করছে৷

ঘন্টা তিনেকের মধ্যে নিউইয়র্কের বুকে তুষারপাত তাণ্ডব চালাতে শুরু করল৷ নিস্তব্ধ রাত৷ আপাতত এই নিশিরাতে নিউইয়র্ক নামক টুয়েন্টি ফোর আওয়ার জেগে থাকা সিটিটাকে গহীন কোন জঙ্গল ভেবে যে’কারো ভুল হতে পারে। নিউইয়র্কের মতো হাস্যজ্বল শহরের মন খারাপ হয়।

জীবন অদ্ভুত সুন্দর। হাজারও দুঃখ বুকে পুষে আমরা আগামীকালের আশায় থাকি। ভালো কিছু ঘটার আশায় আড়ি পেতে রই৷

~The End~

[ ভালোবাসার গল্প ২০২২,
ভালোবাসার গল্প কাহিনী,
ভালোবাসার গল্প কষ্টের,
ভালোবাসার গল্প কথা,
ভালোবাসার গল্প কষ্টের
ভালোবাসার গল্প ছবি
সেরা ভালোবাসার গল্প

ভালোবাসার গল্প by golpopoka,
ভালোবাসার গল্প 2022,
ভালোবাসার গল্প 2022,
বাংলা ভালোবাসার গল্প,
বাংলা ভালোবাসার গল্প 2022,
নতুন ভালোবাসার গল্প,
ইসলামিক রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প,
আবেগি ভালোবাসার গল্প,
ভালোবাসার গল্প পড়তে চাই,
বাংলা ভালোবাসার গল্প by গল্পেরমহল,
না বলা ভালোবাসার গল্প,
ভালোবাসার গল্প পড়তে চাই,
মজার ভালোবাসার গল্প,
ভালোবাসার গল্প 2022,
ভালোবাসার গল্প fb,
বিয়ের পর ভালোবাসার গল্প,
রোমান্টিক ভালোবাসার ছোট গল্প,
রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প কাহিনী,
রোমান্টিক বিয়ের গল্প,
হঠাৎ বিয়ের রোমান্টিক গল্প,
বউয়ের ভালোবাসা পাওয়ার উপায়,

বাসর রাতের রোমান্টিক গল্প,
রোমান্টিক গল্পের লিংক,
ভালোবাসার গল্প,
ভালোবাসার গল্প কাহিনী,
ধারাবাহিক গল্প,
রোমান্টিক ধারাবাহিক গল্প,
রোমান্টিক প্রেমের গল্প ১৮+,
অসমাপ্ত গল্প,
অসমাপ্ত ভালোবাসার কষ্টের গল্প,
ধারাবাহিক গল্প 2022,
Valobashar golpo,
Valobashar golpo by golpermohol,
Valobashar golpo by golpo mohol,
Valobashar romantic golpo, Romantic Love story by golpermohol,golpermohol noton golpo,golpermohol new story,golpo poka best story,
Dharabahik golpo,balobashar golpo, bashor rather golpo,best Love story bangla,best love story bangla by golpermohol,golpermohol noton golpo,
Emosional love story bangla,bangla emosional love story,bangladeshi love story,bangladeshi love story by golpermohol
Golpermohol bangladeshi golpo,golpermohol, golpermohol, golpo mohol,golpermohol.com,sad love story bangla,sad love story 2022,sad love story 2022,sad love story bnahla 2022, romantic love story,bashor rather golpo রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প ,
Valobasar golpo bangla lekha,
Valobashar kobita,