বুক পিঞ্জরায় পর্ব-০২

0
191

#বুক_পিঞ্জরায় (০২)
ফাতেমা তুজ জোহরা

দুই.

মেহের রেস্টুরেন্টের গেইটে আসতেই ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেলো। পড়া হলো মহা মুশকিলে। সাথে ছাতা নেই। যেই টেক্সি রেন্ট করেছে সেটা আসতে নিম্নে হলেও পনেরো-বিশ মিনিটের মতো লাগবে। রাস্তায় জ্যামে আটকে পড়ার দরুন এত সময় লাগবে। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। মেজাজটা এমনিতেই বিগড়ে আছে। তার উপর এই চৈত্র মাসের বৃষ্টি। আবার টেক্সিও লেট করবে। এসবের মধ্যে এখন মাথা ঠান্ডা রাখা জরুরি। মেহের বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছাতাটা সাথে থাকলে এখন মেইন রোডের সাইটে গিয়ে দাঁড়াতে পারতো। এখন টেক্সি আসলেও রেস্টুরেন্ট থেকে মেইন রোডের দূরত্বটুকুতে ভিজে এগোতে হবে। আজকের দিনটাই যেন খারাপ। বৃষ্টির ঝাপটা মাঝেমধ্যেই ছিঁটেফোঁটা দিয়ে জামা ভিজিয়ে দিচ্ছে। রাগ কমানোর জন্য মেহের বিরবির করে সূরা তেলওয়াত করতে আরম্ভ করলো।

প্রায় দশ মিনিট পর তার পাশে এসে কেউ একজন দাঁড়ালো। মেহের সেদিকে নজর দেবার প্রয়োজনবোধ করলো না। পাশে থেকে লোকটা বলল, “আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন নাকি ?”

ঝট করে মেহের সেদিকে তাকালো। দেখলো মেহরাব এই কথা বলেছে। মেহের সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো মেহরাবের থেকে। দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সামনের রাস্তায়। মেহরাবের প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে হলো না তার। মিনিটখানেকের মধ্যেই রেন্ট করা টেক্সি এসে থামলো রেস্টুরেন্টের সোজা। মেহের পা বাড়াতে নিলো রাস্তায়। এমন সময় খেয়াল করলো তার শরীরে পানি পড়ছে না। উপরে তাকিয়ে দেখলো ছাতা। মেহরাব ছাতা মেলে ধরেছে। মেহেরের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে।

মেহের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো মেহরাবের। তারপর বলল, “নিজের সীমারেখায় থাকুন। আমার উপকার করতে বলিনি আপনাকে।”

এই বলে মেহের হ্যান্ডব্যাগটা মাথার উপর ধরে ছুটে গেলো টেক্সির দিকে। কোনোরকমে টেক্সিতে উঠে হাঁফ ছাড়লো সে। বিরক্তি আজ যেন তার পিছুই ছাড়ছে না। মেহরাবের ছাতা নিয়ে উপকার করতে আসা ব্যাপারটা ঠিক ভালো লাগলো না মেহেরের কাছে। নিশ্চয় এমন কিছু করে বসতো যা অসম্মানের।

মেহেরের বাসায় পৌঁছাতে ঘন্টাখানেকের বেশি সময় লাগলো। বাড়ির ভেতর পা রাখতেই আয়শা ছুটে এলেন মেহেরের দিকে। আয়শা হলেন মেহেরের মা। দুই কন্যা ও এক পুত্রের জননী সে। আয়শা মেহেরের কাছে যাওয়ার আগেই মাইশা আগে ছুটে এলো। মেহেরের হাত থেকে ভেজা ব্যাগটা নিয়ে বলল, “ইশ আপু, আজকেও ছাতা নিয়ে যাওনি ?”

মাইশা মেহেরের ছোট বোন। আয়শা বলল, “তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টাও গিয়ে। তোমারতো আবার সর্দি ছাড়েই না। কত যে বলি ছাতাটা সাথে রাখতে।”

মেহের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “উফ মা, এই ছাতার টপিক বাদ দাওতো। মেজাজটা এমনিতেই ফোর টুয়েন্টি হয়ে আছে। কোন বাঁদরের কাছে যে পাঠিয়েছিলে আজ।” এই বলে মেহের ঘরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেয়।

আয়শা থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “বাঁদর ! রেস্টুরেন্টে বাঁদর আসলো কোত্থেকে ?”

মাইশা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, “বুঝলে না মা ? আপু সম্ভবত তার হবু বরের কথা বলেছে।”

আয়শা মৃদু রাগ দেখিয়ে বললেন, “হবু বরকে বাঁদর বলা ? দিন দিন মেয়েটা ম্যানারলেস হয়ে যাচ্ছে। স্বভাব এমন হতে থাকলে শ্বশুর বাড়ির ভাত তাহলে কপালে জুটবে না।”

কথাটুকু বলা শেষে আয়শা চলে গেলেন নিজ কক্ষের দিকে। মাইশাকে বলে গেলেন ওদের আব্বু ও মেজো ভাই আসীরকে ডেকে আনতে। পাত্র দেখা শেষে মেহেরের মন্তব্য শুনতে বসবে সবাই। বিয়ে যেহেতু মোটামুটি রকমের ঠিকই হয়ে আছে সেহেতু মেহের না বললেও আয়শা মেনে নিবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমন ভালো ছেলে আর পরিবার কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চান না মাহফুজ-আয়শা।

মেহের গোসল সেরে তবেই ঘর হতে বের হলো। বাহিরে এসে দেখে বাবা-মায়ের ঘর হতে কথা বলার আওয়াজ আসছে। এগিয়ে গেলো সেদিকে। মেহেরকে দেখে মাহফুজ আদর করে কাছে ডেকে বসালেন। ঘরের সদস্য সবাই এখানে উপস্থিত। মাইশা বসে বসে পেয়ারা খাচ্ছিলো। এক টুকরো পেয়ারা মেহেরের দিকে এগিয়ে দিলো। মেহের নাকোচ করে দিলো খেতে। পেঁয়ারা পছন্দের ফল হলেও এখন সে দুটো কারণে খাবে না। এক. মেজাজ খারাপ, দুই. উপরের মাড়ির দাঁতের মাঝে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তাই খাবে না সে। মেহের খাবে না বলে মাথা নিয়ে না করছে। আয়শা এটা দেখে মাইশাকে ঝাড়ি দিয়ে বলল, “এখন সিরিয়াস কথা চলবে। চুপ করে বসে থাকতে না পারলে অন্য ঘরে গিয়ে খাও। কোনো ডিস্টার্ব করবে না এখানে।”

মাইশা আর কিছু বলল না। চুপচাপ নিজের পেয়ারা চাবানোতে মতো দিলো। এদিকে আসীর মেহেরকে প্রশ্ন করে বসলো, “হবু দুলাভাইকে কেমন দেখলে আপু ?”

মেহের বলল, “দেখতে ভালোই।”

মাহফুজ হেসে বলল, “তাহলে বিয়ের তারিখ একেবারে পাকাপোক্ত করি, কি বলো আয়শা ?”

আয়শা বলল, “শুভ কাজে দেরি কিসের ? কথা বলুন আপনার বন্ধুর সাথে।”

মেহের বাঁধ সাধলো। বলল, “বইয়ের প্রচ্ছদটা বেশ চাকচিক্যময়, তবে ভেতরের গল্পটা জঘন্য।”

আয়শা কিছুটা ঝাড়ি দিয়ে বলল, “এটা কেমন কথা ? যা বলার খোলাসা করে বলো। দেখতে ভালো আর ভালো ঘরের ছেলেও সে। এখানে আর সমস্যা কোথায় ?”

মেহের বলল, “সমস্যা গোড়ায় মা। ছেলের চেহারা দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই। কিন্তু ছেলেটার ধর্মীও জ্ঞান একেবারেই নেই। খোঁজ নিয়ে দেখো সে আমার মতো মেয়ে পছন্দ করে না। তার খোলামেলা আধুনিক মেয়ে পছন্দ। শুধু তা-ই নয়, আমি দীর্ঘ চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর সে উপস্থিত হয়েছে। ফ্রেন্ডের সাথে ছিল বলে নাকি আজকে সাক্ষাৎ করার কথা ভুলে গিয়েছে। খাবার অর্ডার করার সময় নিজের ইচ্ছামত সব অর্ডার করেছে। ভবিষ্যৎ সংসার নিয়ে তার মাথাব্যথাই নেই। এমন একটা ছেলের হাতে কিভাবে আমাকে তুলে দিতে চাও মা ?”

আয়শা বলল, “বিয়ের আগে ছেলেরা এমন একটু হয়ই। বিয়েটা হয়ে যাক, পরে ঠিক হয়ে যাবে। এই নিয়ে এত মাথাব্যথার কিছু নেই।”

মেহের উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “সত্যি করে বলো তো আমি তোমাদের মেয়ে কিনা ? আসল মেয়ে হলে শুধু বন্ধুত্ব রক্ষার খাতিরে ওমন বন্ধুর ছেলের হাতে আমাকে তুলে দিতে চাইতে না।”

মেহের দাঁড়ায় না এক মুর্হুত। এ ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে পড়ে। ভিষণ কান্না পাচ্ছে এখন তার। নিজের পরিবারের মানুষ যখন মতের বিরুদ্ধে হাঁটে তখন একা হয়ে হাঁটতে পারা কষ্টের।

অপরদিকে মেহরাব বাড়ি পৌঁছে নিজে কক্ষে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই মুহুর্তে বাবার সামনে পড়তে চাইছে না সে। সামনে পড়ুক বা না পড়ুক, পাত্রী সম্পর্কে কথা বলতে বাবা রেদওয়ান আসবেই আসবে। ঠিক দু মিনিটের মাথাতেই দরজায় টোকা পড়লো। বিরক্ত নিয়ে দরজা খুললো মেহরাব। খুলে দেখলো মা সাফিয়া দাঁড়িয়ে আছেন। মেহরাব জোর করে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, “কিছু বলবে আম্মু ?”

সাফিয়া বললেন, “তোর জন্য আমরা দুই বুড়ো-বুড়ি অপেক্ষা করছি। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বের হবি। জরুরি কথা সব সারতে হবে।”

এই বলে সাফিয়া চলে গেলেন। মেহরাব বেশ বুঝতে পারছে যে কিসের জরুরি কথা বলবে তার বাবা-মা। কিছু করার নেই। মুখোমুখি হতে হবে ওনাদের। তবে তাদের ইচ্ছে এভাবে মেহরাবের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে না, এরকমই ভাবছে মেহরাব। আজই এই মেহের টপিক ক্লোসড করতে হবে। দরজাটা বেশ জোরেই লাগালো। বেশ অনেকটা সময় লাগিয়ে ফ্রেস হয়ে বাবা রেদোয়ানের সামনের এলো।

মা-বাবা মেহেরের কথা জিজ্ঞেস করার আগেই মেহরাব বলে উঠলো, “দেখো বাবা, তোমার সব কথাই আমি মেনে চলি বা চলার চেষ্টা করি। কিন্তু এই বিয়ের ব্যাপারটা মানতে পারবো না। ওরকম প্যাকেট হয়ে চলা মেয়ের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া অসম্ভব। এত প্যাকেট হয়ে থাকে যেন তার অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যা আছে। যেকারণে সবার থেকে সৌন্দর্য আড়াল করতে চায়।”

রেদোয়ান বেশ ক্ষিপ্ত হলেন মেহরাবের কথায়। রেগে উঠে দাঁড়ালেন ছেলেকে কষে এক থাপ্পড় দেয়ার জন্য। এমন সময় ছোট মেয়ে হাতে রেদোয়ানের ফোনটা নিয়ে ছুটে এসে বলল, “বাবা, মাহফুজ আঙ্কেল কল করেছে।”

রেদোয়ান চিন্তায় পড়ে গেলো যে মাহফুজকে এখন কি বলবে ?

চলবে