বুক পিঞ্জরায় পর্ব-০৯

0
70

#বুক_পিঞ্জরায় (০৯)
ফাতেমা তুজ জোহরা

নয়.

মেহরাবের প্রশ্নের জবাবে মেহের বলল, “দেখলে কমে যাবো না। তাই বলে পরপুরুষ এর সামনে আমাকে কেন যেতে হবে ?”

মেহরাব বলল, “হাসপাতালে জব করতে সময়তো আর পা থেকে মাথা অব্ধি ঢেকে কাজ করোনি। চেহারাতো খোলাই ছিল। বিয়ের পরপরই কেন পল্টি খাচ্ছো ? বন্ধুদের সামনে আমার সম্মান না খোয়ালেই খুশি হবো।”

মেহের বলল, “আপনার বন্ধুগুলোও আপনার মতো জ্ঞানহীন ফাঁকা কলসি। নাহলে বন্ধুর বউকে কেন তাদের দেখতে হবে ? আল্লাহ প্রতিটা সম্পর্কের একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বেঁধে দিয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন। নিজের বউকে যদি অন্যের থেকে আড়াল করতে না পারেন, হেফাজতে রাখতে না পারেন তবে শেষ বিচারের দিন রবের নিকট কী জবাব দিবেন ?”

মেহেরের এসব জ্ঞান দেয়ার কথা মেহরাবের ভালো লাগছে না। এত বুঝানোর কি আছে। মেহরাব কি জ্ঞানহীন নাকি ? মেহরাব কথা না বাড়িয়ে ঘর হতে বের হয়ে গেলো। হুইলচেয়ারে বসে থাকাটা এখন আর ভালো লাগছে না তার। এক হাতে ফ্র‍্যাকচার আর এক হাত দিয়ে চেয়ার ঠেলা আসলেই বিরক্তিকর। যদিও ইলেকট্রিল হুইলচেয়ার। সবসময়তো আর সুইচের কথা মাথায় থাকে না। দরজা পর্যন্ত গিয়ে মেহরাব বলল, “এত কিছু শুনতে চাচ্ছি না। সন্ধ্যায় তৈরি থাকবে, ব্যস।”

মেহের ছলছল নেত্রে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ মেহরাবের প্রস্থানের পানে। লোকটাকে কী করে সামলাবে সেটাই চিন্তা। বিয়ের প্রথমদিনেই কোথা থেকে বন্ধুরা এসে হানা দিচ্ছে। এসের শিক্ষা দেয়ার দরকার। কিন্তু কিভাবে কী করা যায় ?

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা চলে এলো। মাগরিবের পরপরই মেহরাবের চারজন বন্ধু চলে এলো। শাহিন নামের একজনের শুধু বউ আছে। সে অবশ্য তার স্ত্রীকে সাথে করে নিয়ে এসেছে শো অফ করার জন্য। সেই সাজগোজ করেছে শাহিনের স্ত্রী। মেহের আড়াল থেকে শুনছিলো ওদের আড্ডাবাজি। মেয়েটা জরজেট শাড়ি পড়ে এসেছে। দেহের আগা থেকে গোড়া অব্ধি সবকিছুই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। ছেলেগুলো সৌন্দর্য নিয়ে কমেন্ট করতে ব্যস্ত। মেহরাবও সেখানে সামিল হয়েছে। মেহেরের ভিষণ রাগ হচ্ছে। তার সদ্য হওয়া স্বামী কিনা অন্য একটা মেয়ের রূপের প্রসংশায় পঞ্চমুখ। ভাবি ভাবি ডেকে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। বেশ খানিক্ষন আড্ডার পর সবাই জেদ ধরছে মেহরাবের নতুন বউ দেখার জন্য।

একটা কক্ষেই বসা ছিল সব বন্ধুরা। রাবাব এসে ওদের নাস্তা পানি দিয়ে গিয়েছিল। সাফিয়ার কাছে মেহরাবের এই বন্ধুগুলো ভালো ঠেকে না। রেদোয়ান এই মুহুর্তে বাড়িতে নেই। মেহরাব মেহেরকে ডাকার জন্য নিজে কক্ষের দিকে এগোলো। মেহের আড়াল থেকে দেখেছে সেটা। দ্রুতই সে ঘরের ভেতর চলে গেলো। মেহরাব ঘরে প্রবেশ করে বেশ অবাক হলো। মেহেরকে দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ। মেয়েটা করলোটা কী ?” মেহরাব এসে দেখলো মেহের বোরকা পড়ে পুরো পরিপাটি হয়ে গিয়েছে। চোখ দুটো ব্যতীত আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

মেহরাব দ্রুত বলল, “এটা কি করেছে তুমি ? এভাবে প্যাকেট হয়েছে কেন ? আমার এক ফ্রেন্ডের ওয়াইফ এসেছে, সেখবে সে কত স্মার্ট। পরিবেশ বুঝে সে। তোমাকে এতবার বলার পরেও তুমি বোরকা পড়ে আছো ঘরের ভেতর। বিয়ের প্রথমদিনেই যা অবাধ্য হচ্ছো, আর ক’দিন পার হলে না জানি কী হয়। তোমার মতিগতি বেশ বুঝতে পারছি। বন্ধুদের সামনে আমার অপমান না করলে শান্তি হচ্ছে না তোমার।”

মেহের বলল, “আপনার মতো কী আমাকেও নির্লজ্জ ভাবেন ?”

মেহরাব দাঁত কটমটিয়ে বলল, “আমার মতো মানে ? নির্লজ্জের মতো করেছি টা কী ? বুঝেছি, ঝগড়া বাঁধাতে চাচ্ছো।”

মেহের হাফ ছেড়ে বলল, “অন্যের বউয়ের দিকে গোল আলুর মতো বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে থাকেন। একেকজন মজা করার ছলে কী বাজে বাজে মন্তব্য করছে, আপনি বসে বসে সেসব গিলছেন। ওখানে আপনার ওই বন্ধুর বউয়ের মতো গেলে আমিও যে ওমন বাজে মন্তব্য পাবো না তার কী গ্যারান্টি ?”

মেহরাব বলল, “আমার বউকে এসব কেউ বলবে না। এত সাহস কাউকে দিই নি।”

মেহের তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, “অন্যকে সম্মান না দিলে আপনাকেও কেউ সম্মান দিবে না। অন্যের বউকে নিয়ে করা রংতামাশায় যুক্ত হলে নিজের বউকেও ওরা এমন বাজে কথা বলবে। আপনাদের চোখে পর্দা থাকলে এসব কিছুই হতো না।”

মেহরাব বলল, “আমাদের আবার কিসের পর্দা ? কি বুঝাতে চাইছো ?”

মেহের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “নারী-পুরুষ উভয়ই পর্দা মেনে চলা ফরজ। সত্যি কথা বলতে পুরুষের জন্যই পর্দার আয়াত প্রথমে নাযিল হয়েছে। পরবর্তীতে নারীর পর্দার আয়াত নাযিল হয়েছে।

সুরা নূরের ৩০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ্‌ বলেছেন, ‘মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে।’

এর পরের আয়াত অর্থাৎ সুরা নূরের ৩১ নম্বর আয়াত মহান আল্লাহ্‌ নাযিল করেছেন নারীদের পর্দার জন্য।

এখন কোনো পুরুষের চোখে যদি কোনো নারীর সৌন্দর্য দর্শন করার অনুমতি পায়, তাহলে তাহলে একমাত্র নিজের স্ত্রীর। একজন পুরুষের জন্য নিজ স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন নারীর চেহারার সৌন্দর্য দেখা বা অন্য কোনো নারীর দেহ আকৃতি অন্তরে অনুভব করা ‘হারাম’।

এ সম্পর্কে মহানবী (স.) বলেছেন, যদি কোন মহিলার দিকে হঠাৎ নজর পড়ে যায়, তাৎক্ষণিক দৃষ্টি সরিয়ে নেবে এবং তার দিকে আর দ্বিতীয়বার তাকাবে না।

আল্লাহ পবিত্র কুরানের সূরা আন-নুরের ৩০নং আয়াতে নারীদের পর্দার ব্যাপারে নিষেধ করার আগে পুরুষের চোখের পর্দা হেফাজত করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ যখন তা জেনেও এই নিষেধ মান্য করা থেকে নিজেকে দূরে রাখলো না তখন সে যেন কুরআনে আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশ কে অবজ্ঞা করল।

সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ বলেছেন, ‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যারাই আমার আয়াত সমূহকে অবজ্ঞা করবে, আমি তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব। তাদের চামড়াগুলো যখন জ্বলে-পুড়ে যাবে, তখন আমি সেখানে নতুন চামড়া দিব, যাতে তারা আজাব পূর্ণভাবে আস্বাদন করতে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী।’ (সূরা আন নিসাঃ ৫৬)”

মেহরাব মেহেরের কথাগুলো শোনার পর কী বলবে তা ভাবছে। মেহরাব বলল, “আচ্ছা বুঝলাম যে আমাদের চোখের পর্দা করতে হবে। কিন্তু তুমি এত প্যাকেট হচ্ছো কেন ? স্বাভাবিক পোশাকেইতো থাকতে পারো নাকি ? আমার ফ্রেন্ডগুলো আমার নিজ ভাইয়ের মতোই। এদের সামনে অন্ততপক্ষে একবার যেতেই পারো নাকি ? ঘরের ভেতর এমন লোক হাসানো হিজাব না পড়লেওতো হয়।”

মেহেরের মনে হচ্ছে সে হেরে যাচ্ছে। তবুও লড়তেই হবে। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করতে হলে সে সেটাই করবে। মেহের আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হিজাব পরা মানে মানুষকে দেখানো নয় যে আমি হিজাব পরছি। এটা আমার প্রয়োজনে পড়া। হিজাব পরা মানে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন আমার শরীরের সৌন্দর্য পর-পুরুষ থেকে ঢেকে রাখতে। যা দেখার অনুমতি বা প্রদর্শন করার অনুমতি দিয়েছে একমাত্র আমার স্বামীর সামনে। তাহলে আমি অন্য পুরুষের সামনে নিজেকে কেন প্রদর্শন করবো ? নারী কখনো প্রদর্শনীর বস্তু নয় মেহরাব। চলো আমি সূরা নূরের ৩১ নম্বর আয়াতের অনুবাদ শোনাচ্ছি।

আয়াতটির অনুবাদ এই যে, “মহান আল্লাহ্‌ বলেছেন, ‘ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে ও নিজেদের দেহ-সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, কেবল সেসব অংশ ছাড়া যা আপনা আপনি প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

আর যেন তারা তাদের মাথার কাপড় দিয়ে বুকের ওপরটা ঢেকে রাখে এবং তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে শুধুমাত্র তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র,নিজ অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ তারা ব্যতীত।

আর তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণ না করে। হে মুমিন লোকেরা ! তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর নিকট তওবা কর, আশা করা যায় তোমরা কল্যাণ লাভ করবে।’ (সূরা আন-নূরঃ ৩১)

আল্লাহ্‌ তায়ালা আরও বলেছেন, ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণ ও কন্যাদেরকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না।’ (সূরা আহযাবঃ ৫৯)

আমি কেন আপনার বন্ধুদের সামনে যেতে চাইছি না তা আশা করছি এখন বুঝাতে পেরেছি।”

মেহরাব মেহেরের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ কথাগুলো শুনলো। মেহেরের কথা শেষ হবার পরেও যেন মেহরাব ধ্যানে আছে এমন ভাবে তাকিয়ে রইলো। মিনিট খানেক এভাবেই সময় পার হলো। মেহের অপেক্ষা করছে মেহরাবের জবাবের। কিন্তু সে কোনো সাড়াশব্দ করলো না। কিছুক্ষণ পর মেহরাব হুকুম করার স্বরে বলল, “এসব প্যাকেট থেকে বের হও। এমনিতেই প্রচুর গরম। কাপড় পালটে বসে থাকো এখানে। এক পা-ও বের হবে না এঘর হতে।”

কথা শেষ হতে না হতেই মেহরাব চলে গেলো ঘর হতে। মেহেরের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা মিললো। কিছুটা আশার আলো হয়তো পাওয়া গেলো মেহরাবের কাছ থেকে। মেহরাব চলে গেলো বন্ধুদের কাছে। মেহেরের কথাগুলো শোনার পর নিজের মনের ভেতর কেমন খচখচ করছে।

চলবে…