বুক পিঞ্জরায় পর্ব-১০

0
48

#বুক_পিঞ্জরায় (১০)
ফাতেমা তুজ জোহরা

দশ.

মেহরাবকে একা ফিরতে দেখে বন্ধুদের একজন বলে উঠলো, “কি রে ব্যাটা, বউ রেখে একাই আসলি ? আমার মনে হয় তোর বউ দেখার মতো না। তাই আমাদের সামনে আসতে চায় না।”

মেহরাবের ভ্রু-যুগোল মৃদু কোঁচকালো। মেহের যথেষ্ট দেখতে। তাকে নিয়ে এমন কটু কথা ঠিক হজম হলো না। মেহরাবের সেই বন্ধুর বাক্যখানী শেষ হতে না হতে বাকী বন্ধুরা হো হো করে হেসে উঠলো। যেন উক্ত বাক্যে বেশ মজা পেয়েছে। ওদের হাসি থামার পর মেহরাব এক গাল হেসে বলল, “আচ্ছা শোন, তোদের সম্পত্তির কিছু অংশ কী আমাকে দিবি ?”

রাসেল বলে উঠলো, “আমার সম্পত্তির ভাগ তোকে দিতে যাবো কোন শোকে ? আমিতো যথেষ্ট সুখে আছি।”

বাকী ফ্রেন্ডগুলোও বেশ একইরকম বুলি আওড়ালো। এসব শোনার পর মেহরাব বলল, “আমার স্ত্রী আমার সম্পত্তি। একদম সিল গালা করা সম্পত্তি। তাহলে তাকে কেন তোদের সামনে প্রদর্শনীর বস্তুর মতো প্রদর্শন করাতে হবে ?”

মাহিম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কি রে ব্যাটা, বিয়ে করতে না করতেই পল্টি খেয়ে ফেলছিস। আমাদের বউকেতো চোখে গিলছিস কতবার। এখন নিজের বউকে সিন্ধুকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিস। ওয়াহ, হাউ বিউটিফুল !”

মাহিমের সাথে সাথে বাকীরাও উঠে দাঁড়ালো। মেহরাব মুচকি হেসে বলল, “নিজেইতো হাত-পা ভেঙে বসে আছি। তাহলে উল্টি-পল্টি কিভাবে দেবো ? আচ্ছা আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে আগে। তোদের সম্পত্তির ভাগ কি আমাকে দিবি ? বেশি না, সবার থেকে অল্প অল্প করে দিলেই হবে।”

রাসেল একটু কড়া গলায় বলল, “আমাদের সম্পত্তি তোকে কেন দিবো ? এক প্রশ্ন কতবার করছিস ?”

মেহরাব হেসে বলল, “প্রশ্ন বারবার করার কারণ আছে। আচ্ছা শোন তাহলে, আমার সম্পত্তি কেন তোদের সামনে শো অফ করবো ?”

মাহিম বলল, “ফাজলামো করছিস আমাদের সাথে ? তোর সম্পত্তি শো অফ করতে কখন বলেছি আমরা ?”

মেহরাব বলল, “এই যে আমার স্ত্রীকে দেখতে চাইছিস। তোদেরকে আপ্যায়ন করতে চাইছিস। আমার স্ত্রী আমার একার সম্পত্তি। কবুল বলে সিলগালা করে নেয়া সম্পত্তি। তাকে কেন তোদের সামনে আনতে হবে ?”

রাসেল বলল, “আমাদের বউদের কিভাবে দেখেছিস ? বউ দেখালে কি কমে যাবে বা ক্ষয় হয়ে যাবে ?”

মেহরাব বলল, “ঘরের মেয়ে মানুষ সবচেয়ে দামী সম্পত্তি…”

মেহরাবের কথা শেষ হতে না হতেই সোহেল বলে উঠলো, “থাম তুই। অনেকক্ষণ যাবত তোর ফাউল মার্কা কথা শুনছি। এক্সিডেন্টের সাথে তোর মাথাটাও গেছে। তোর সাথে সম্পর্ক এখানেই আমি চুকিয়ে দিলাম। আর কখনো যোগাযোগ করছিস না আমাদের সাথে। এত ফালতু সময় নেই। এই চল তোরা।”

সোহেলের কথার পৃষ্ঠে কেউ আর কিছু বলল না। একেকজনের চেহারায় বিরক্তের ছাপ। সবাই বের হয়ে গেলো বাসা থেকে। মেহরাব চুপ করে এক জায়গায় স্থির রইলো বেশ কিছুক্ষণ। এতদিনের ফ্রেন্ডশিপ শেষ হয়ে গেলো। কেন যে এত কথা বলতে গেলো তা নিজেও বুঝতে পারছে না। এইরকমতো হওয়ার কথা ছিল। কী হলো হঠাৎ করে ? মেহেরের বলা কথাগুলো শোনার পরে মনের ভেতর কিসের উৎপাত যে শুরু হলো তা বুঝা যাচ্ছে না। অনুভূতিটা বেশ অন্যরকম। বন্ধুদেরকে এতগুলো কথা বলেও যেন গভীরভাবে আফসোস হচ্ছে না।

কিছুক্ষণ পর নিজ কাঁধে কারো স্পর্শ পেলো মেহরাব। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো তার বাবা রেদোয়ান দাঁড়ানো। মেহরাব মুচকি হেসে বলল, “আব্বু কখন এলে ?”

রেদোয়ান বলল, “এইতো, যখন তোমার বন্ধু নামক শত্রুগুলো বের হয়ে গেলো।”

মেহরাব বলল, “আব্বু, তুমি ওদের শত্রু কেন বলছো ? আমার ক্ষতিতো আর করেনি।”

রেদোয়ান হেসে মেহরাবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার চার আনার উপরকারও তারা করেনি। ওরা যেভাবে চলাফেরা করে তা শোভনীয় নয়। ধর্মীয় কোনো নিয়ম কানুন ওদের মধ্যে নেই। তোমার কী এটা ক্ষতির দিক মনে হয় না?”

মেহরাব শান্ত গলায় বলল, “আব্বু, আমিতো আর ওদের মতো চলিনি।”

রেদোয়ান বলল, “চলেছো। তবে আজকে যা করেছো শুনলাম, তা উচিৎ কাজই করেছো। প্রতিটা সম্পর্কই সুন্দর, যদি তা নিয়মানুযায়ী রাখা যায়।”

মেহরাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বাদ দাও আব্বু। ওদের সাথে পথচলা হয়তো আজই শেষ।”

রেদোয়ান হেসে মেহরাবের কাঁধে চাপড় দিতে বলল, “শেষ হলেই আলহামদুলিল্লাহ। নিজের দিকে একটু তাকাও। অবশ্যই তুমি ভালো মন্দ বুঝো। তোমার এই বন্ধুগুলো যে উপকারী না তা তোমাকে এতকালেও বুঝাতে পারিনি। আজ যে বুঝতে পেরেছ তার জন্য শুকরিয়া। আল্লাহ তোমাকে পূর্ণ হেদায়েত দান করুন, আমিন।”

বাবা-ছেলে হাসলো। এ হাসি ভিষণ সুন্দর। রেদোয়ান তার ছেলের সাথে ওঘরে বসেই এশার আজান পর্যন্ত কথাবার্তা বললেন। এশার নামাজের পর রাতের খাবার খেতে বসলো সবাই একসাথে। খুব আনন্দঘন মুহুর্ত কাটালো নতুন পরিবারের মানুষজন। মেহেরের মনে হচ্ছে না যে সে এখন শ্বশুর বাড়ি আছে। নিজ বাবা-মায়ের মতো সাফিয়া-রেদোয়ান যথার্থ স্নেহ করছেন। মেহের মনে মনে দোয়া করছে, এরূপ স্নেহ-ভালোবাসা যেন আজীবন থেকে যায়।

খাওয়া দাওয়া শেষে বাকী রইলো দুটো কাজ। এক, মেহেরকে বধূ সাজানো। দুই, মেহরাবের ঘরটাকে সাজানো। মেহেরকে সাজানোর দায়িত্ব দিলো রাবাব ও মাইশাকে। ওদিকে ঘর সাজানোর দায়িত্ব কাঁধে নিলেন দুই বুড়ো-বুড়ি। কাজ ভাগাভাগি করতে শুনে মেহরাব বলল, “আমি কী তাহলে ফোকাসের বাহিরে ? না মানে আমার কি সাজসজ্জা লাগবে না ?”

রাবাব হাসতে হাসতে বলল, “ভাইয়া, তোমার নিজের দায়িত্ব নিজেই পালন করো। নয়তো আব্বুর অপেক্ষা করো। তোমার ঘর সাজানোর কাজ হলে পরে তোমাকে সেট আপ করে দিবে।”

মেহরাব কথা বাড়ালো না। কথাটা বলে নিজেরই জানি কেমন লজ্জাবোধ হচ্ছিলো। এরকম হওয়ার কথা নয়। আগেতো কখনো হয়নি। একদিনের ভেতর কিভাবে এত চেঞ্জ হতে পারে ? কারো কারো খাশ দিলের দোয়া হয়তো আল্লাহ তা’আলা কবুল করে নিয়েছেন। নয়তো এই হেদায়েত পাওয়া সম্ভব ছিল না।

রাত প্রায় বারোটার কাটা ছুঁইছুঁই। শুভ্র রঙের গাউনে মেহের বসে আছে মেহরাবের বিছানায়। উঁহু ঘর আজ থেকে তারও। ঘরটা স্বল্প সময়ে যতটুকু সাজানো যায় ততোটুকই সাজানো হয়েছে। যাকে বলে হালকার মধ্যে গর্জিয়াছ। মেহেরের হাতের তালু ঘামছে। সারাদিনে যতটা না নার্ভাস লেগেছে, তার থেকে ঢেরবেশি এই মুহুর্তে নার্ভাস লাগছে। মনের ভেতর হরেক রঙের অনূভুতির আন্দলোনের তোপে নিতান্তই মেহের দূর্বল হচ্ছে।

মেহরাব ঘরে এলো ঠিক বারোটা বেজে এক মিনিটে। মেহের উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানালো। মেহরাবকে বিছানায় উঠতে সাহায্য করলো। বিছানায় বসার পর মেহরাব বলল, “এভাবে নিজের জীবন নষ্ট না করলেও পারতে। আমি এখন বোঝা ছাড়া আর কিছুই নই। আমাকে দয়া দেখানোর জন্য বিয়ে না করলেও পারতে।”

মেহের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “প্রথমত, আপনাকে দয়া দেখানোর জন্য আমি বিয়ে করিনি। দয়া দেখাতে হলে বিয়ের প্রয়োজন হয় বলে আমার মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, বিয়েসাদী আল্লাহর হাতে। যার সাথে যার জুড়ি লেখা, তার সাথে তার আটকা পড়তেই হবে। বিয়ে নিজের হাতে থাকলে কয়েক বছর প্রেম করা প্রেমিককে রেখে অন্য কাউকে কেউ বিয়ে করতো না।”

মেহরাবের মাথায় হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁটে এলো। মেহেরের কথা শেষ হতে না হতেই মেহরাব বলল, “তোমার কী তাহলে বিয়ের পূর্বে কোনো সম্পর্ক ছিলো ? যেকারণে প্রথমে এই বিয়েতে রাজি হওনি ?”

মেহরাবের প্রশ্ন শুনে মেহের ঠিক কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে যা কয়েক সেকেন্ড ভাবার পর মৃদু হেসে বলল, “আমি আমার স্বামীর জন্য। কোনো প্রেমিক পুরুষের জন্য নই। হালালের স্বাদ কখনো হারাম সম্পর্কে থাকে না।”

মেহরাব মৃদু হাসলো। এতটাই মৃদু যে ঠোঁটের পানে গভীর ভাবে না তাকালে তা বুঝা সম্ভব নয়। মেহের তা লক্ষ করেনি। এই মুহুর্তে সে মেহরাবের দিকে তাকাতে পারছে না। দুচোখ জুড়ে লজ্জারা চেপে বসেছে। মেহের নিচের দিকে তাকিয়েই মেহরাবকে বলল, “চলুন তাহলে, নতুন সূচনা করা যাক।”
অতঃপর দু’জন দু’জনাকে বুঝতে পারার পালা। দু’জনের স্বপ্ন আর চাওয়া পাওয়া নিয়ে যত গল্প জমে আছে, তা আজ উন্মোচনের পালা।

চলবে…