#ভালোবাসি_হয়নি_বলা
#পর্ব_৩
লেখিকা #Sabihatul_Sabha
পাখির কিচিরমিচির শব্দে সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলো নূরের।
শুয়া থেকে উঠে ঘরের জানালা খোলে দিলো।
সকালে মিষ্টি বাতাস ঘরে আসছে।
জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। তারপর মাথায় ঘুমটা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে গেলো।
সকাল সকাল গ্রামটা কতটা স্নিগ্ধ সুন্দর লাগে। মিষ্টি বাতাস মনকে এক নিমিষেই শান্ত করে দেয়।
নূর আনমনে হাঁটছে আর এইসব ভাবছে। তখন খেয়াল করলো ওকে পেছন থেকে কেউ ডাকছে।
পেছন ফিরে দেখে ইভা দৌড়ে ওর কাছেই আসছে।
ইভা নূরের কাছে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেললো।
নূর ইভার দিকে তাকিয়ে বললো,’ তুমি এভাবে দৌড়ে আসতে গেলে কেনো ইভা..?’
ইভাঃ তুমি তো গ্রামের কিছুই চিনো না যদি হারিয়ে যাও…
নূর ইভার কথা শুনে কিছুটা অবাক হলো।
নূরঃ ইভা আমি ছোটো বাচ্চা নই যে হারিয়ে যাবো! আমি তো সকালে এই মিষ্টি আবহাওয়াটা উপভোগ করতে এসেছি। দেখো কতটা স্নিগ্ধ বাতাস। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে।
ইভাঃ আমি প্রায় দাদাজানের সাথে সকালে হাঁটতে বের হই। আমারও খুব ভালো লাগে।
নূরঃ আচ্ছা খুব ভালো।
ইভাঃ আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি..?
নূরঃ হুম জিজ্ঞেস করতে পারো..
ইভাঃ তুমি এই গ্রামে কিভাবে রাস্তা হারালে..?
নূরঃ আসলে ইভা আমি এখানে কাউকে খুঁজতে এসেছি।
ইভা অবাক হয়ে নূরের দিকে তাকালো।
ইভাঃ তুমি তো বললে রাস্তা ভুলে গেছো..
নূরঃ অসব তো বলেছি তোমাদের বাড়িতে কাল কের রাতটা থাকার জন্য।
ইভাঃ তারমানে যাকে খুঁজতে এসেছো তাকে পেয়ে গেছো…!
নূরঃ না…
ইভাঃ তাহলে..?
নূরঃ খুঁজে বের করে নিবো।
ইভাঃ আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আমিও তোমাকে সাহায্য করবো। ছেলেটা দেখতে কেমন..?
নূরঃ তা তো জানিনা..
ইভাঃ কিইইই!! যাকে খুঁজতে এসেছো তারপর চেহারাই জানোনা কি আজব।
নূর কিছুই বলে না।
কিছু দূর যেতেই ইভা বলে উঠলো,’ নূর দেখো আমাদের গ্রামে হসপিটালের কাজ চলছে..
নূর সে দিকে তাকিয়ে বললো,’ তাহলে তো খুব ভালো ইভা।
ইভাঃ দাদাজী নিজে হসপিটালের কাজ করাচ্ছেন আর এই হসপিটালের প্রথম ডাক্তার হিসেবে আসবে আমার সুপারম্যান ভাই রুদ্র চৌধুরী।
নূর কিছুটা অবাক হয়ে বললো,’ তোমার ভাই কি ডাক্তার..?
ইভাঃ হুম, দাদাজীর স্বপ্ন ছিলো এটা।
নূরঃ আচ্ছা এই গ্রামে তোমাদের বাড়ি বাঁধে আর কয়টা চৌধুরী বাড়ি আছে..?
ইভাঃ অনেক গুলোই আছে.. কিন্তু কেনো..?
নূরঃ না এমনি….আচ্ছা তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে…?
ইভাঃ না, আমাদের পরিবারের নিয়ম কেউ প্রেম ভালোবাসা এইসব করতে পারবে না।
নূরঃ কেনো..?
ইভাঃ তা তো জানিনা..
নূরঃ আর যদি করে..?
ইভাঃ তাহলে এই পরিবার ছেড়ে দিতে হবে।
নূর খুশিতে অবাক হয়ে বললো,’ তোমাদের পরিবারের এই নিয়ম কি কেউ ভেঙেছে..?
ইভাঃ বাদ দাও এইসব, আম খাবে..?
নূরঃ হুম খাওয়া যায়।
ইভাঃ তাহলে গাছে উঠতে পারো..?
নূরঃ না..
ইভাঃ সমস্যা নাই আমি পারবো আর তুমি পাহাড়া দিবে..
নূরঃ আচ্ছা।
নূর আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছে আর ইভা আম চুরি করে পাড়ছে।
নূরঃ ইভা আমার মনে হচ্ছে কেউ আসছে নেমে আসো।
ইভাঃ আচ্ছা, আম গুলো তোমার ওড়নার মধ্যে নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দাও।
নূর আম গুলো নিয়ে ইভার কথা মতো পেছনে ফিরে দেখে এক মহিলা হাতে লাঠি নিয়ে এদিকে আসছে। ভয়ে একদৌড় দিলো।
কিছু দূর যেতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে সব আম নিয়ে নিচে পড়লো৷
নূরঃ আল্লাহ আমার কোমর শেষ!!
রুদ্রঃ এই মেয়ে তুমি কি দেখে চলতে পারো না!! আর কি চুরি করেছো..?
নূর রেগে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,’আপনি একটা বেয়াদব ছেলে। দেখে শুনে হাঁটতে পারেন না! চোখ কি পকেটে নিয়ে রাখেন। আর চুরি করেছি মানে..? আপনার আমাকে দেখে চুর মনে হয়…!?
রুদ্রঃ অবশ্যই.. ওড়নার মধ্যে আম আর তুমিও এমন ভাবে দৌড়াচ্ছো মনে হচ্ছে গাছের মালিকের হাতে দৌড়ানি খেয়েছো!!
নূর কিছু বলার আগেই ইভা দৌড়ে এসে বললো,’ নূর দৌড় দাও গাছের মালিক আসছে লাঠি নিয়ে….
রুদ্রঃ খুব তো বাহাদুরি দেখিয়ে বলে ছিলে তোমাকে দেখে চুর মনে হয় কিনা। এদিকে চুরি করে এসেছো বলে না চুরের মায়ের গলা বড়। আজ তা প্রমাণ ও পেলাম।
নূরঃ ঝগড়াটে মহিলা।
রুদ্র রেগে বলে উঠলো, ‘ আমাকে দেখে তোমার কোন দিক দিয়ে মহিলা মনে হয়!!
নূরঃ আপনার মতো পায়ে পা দিয়ে মহিলারাও ঝগড়া করতে পারবে না!!
ইভাঃ প্লিজ ঝগড়া পড়ে করো এখন তো চলো।
রুদ্রঃ আমি কেনো পালাবো..? আমি তো চুরি করিনি।
নূরঃ তাহলে এখানে বসে থাকেন, চলো ইভা।
সবাই দৌড়ে বাড়ির সামনে এসে থামলো। নূর আর ইভা আম নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।
আয়েশা বেগম রান্না ঘরে কাজ করছেন। নূর এক পা দু পা করে গিয়ে উনার পাশে দাঁড়ালো।
আয়েশা বেগম নূরের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,’ কিছু লাগবে মেয়ে…?’
নূরঃ না আন্টি কিছু লাগবে না।
আয়েশা বেগম কাজ করতে করতে বললো,’ তোমার নাম কি…??
নূরঃ নূর…
আয়েশা বেগমঃ বাহ খুব সুন্দর নাম।
নূরঃ আন্টি আমি আপনাকে সাহায্য করি..?
আয়েশা বেগমঃ তার প্রয়োজন নেই।
নূরঃ করি না আন্টি আমি বাসায় আম্মুর সাথে সব কাজ করি।
আয়েশা বেগমঃ তাহলে তো তুমি খুব লক্ষী মেয়ে। তুমি কাজ করতে হবে না দাঁড়িয়ে থাকো।
নূরঃ আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে গল্প করি।
আয়েশা বেগম কিছু সময় নূরের মুখের দিকে তাকিয়ে হেঁসে বললো,’ ঠিক আছে। ‘
রুদ্র নিজের রুমে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে বন্ধুদের কল দিলো।
~হ্যালো রুদ্র..
রুদ্র ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে নিচে গেলো। রান্না ঘরে নূরের শব্দ পেয়ে উঁকি দিলো।
নূর আর নিজের আম্মুকে এভাবে হাসাহাসি করে গল্প করতে দেখে কিছুটা অবাক হলো।
আয়েশা বেগম চুপচাপ প্রকৃতির মহিলা বেশি কথা একদম বলেন না। খুব কম হাসেন৷
রুদ্র কিছু সময় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না অচেনা একটা মেয়ের সাথে ওর আম্মু এভাবে হাসাহাসি করে কথা বলছে!!
ইভা আর নীলাও নিচে নেমে আসলো। রুদ্র কে এভাবে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওরা ও তাকালো।
নীলাঃ ভাই এই নূর মেয়েটা আমার মনে হয় জাদু জানে…?
ইভাঃ এমনটা কেনো মনে হলো তোর..?
নীলাঃ দেখ সবার সাথে কিভাবে এতো কম সময়ে মিশে যাচ্ছে!
রুদ্র নূরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।
সালমা বেগম রান্না ঘরে গিয়ে নূরকে দেখে বললো,’ আরে মেয়ে তুমি এখানে কেনো…?’
নূরঃ আসলে আন্টি গল্প করার জন্য মানুষ পাচ্ছিলাম না তাই এখানে চলে আসলাম।
সালমা বেগমঃ ভালো করেছো। শশুর আব্বা তোমাকে উনার রুমে যেতে বলেছে৷
নূরঃ আচ্ছা…
নূর রান্নাঘর থেকে বের হতেই হসপিটাল থেকে কল আসলো।
নূরঃ হ্যালো অভিক ভাইয়া..
অভিকঃ নূর তুমি কোথায়..?
নূরঃ আমি এখন নানাজীর রুমে যাচ্ছি।
অভিকঃ খুঁজে পেয়েছো..?
নূরঃ হুম..
অভিকঃ কিভাবে.?
নূরঃ হসপিটাল এসে বলবো..?
অভিকঃ আচ্ছা। আন্টির শরীর বেশি ভালো না।
নূরঃ আমি দুই দিনের মধ্যে উনাকে নিয়ে আসছি ভাইয়া…
অভিকঃ সাবধানে.. নিজের খেয়াল রেখো..
নূরকিছু না বলে ফোন কেটে দিলো। আজ কাল ফারাজের কথা জেনো একটু বেশিই মনে পড়ছে। যত ভুলার চেষ্টা ততই যেনো বেশি মনে পড়ে। মনে প্রশ্ন জাগে মানুষটার কি সত্যি বিয়ে হয়ে গেছে..?
নূর আনোয়ার চৌধুরীর রুমে বসে আছে।
আনোয়ার চৌধুরীঃ কাল অনেক ক্লান্ত ছিলে তাই পরিচিত হতে পারিনি।
নূর জোর পূর্বক মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললো,’ আমি নূর। ভার্সিটিতে পড়ি। আমার আব্বু নেই আম্মু হসপিটালে ভর্তি। আর কিছু জানার আছে..?
আনোয়ার চৌধুরীঃ তোমার আম্মুর নাম কি..?
নূরঃ রাবেয়া বেগম।
আনোয়ার চৌধুরী অবাক চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে রেগে গেলেন৷
আনোয়ার চৌধুরীঃ তোমার সাহস কি করে হয় এই বাড়িতে পা রাখার..?
নূরঃ আমি কখন আপনার বাড়িতে পা রাখতাম না, যদি না আজ আমার আম্মু মৃত্যুর সাথে লড়াই না করতো!!
আনোয়ার চৌধুরীঃ তুমি এখন এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে!
নূরঃ আমার থাকারও কোনো ইচ্ছে নেই। তবে আপনাকে একটু আমার সাথে যেতে হবে..
আনোয়ার চৌধুরীঃ কোথায়..?
নূরঃ আপনার মেয়ের কাছে..
আনোয়ার চৌধুরীঃ আমি তোমাকে প্রথম দেখেই চিনতে পেরেছি কারন তুমি একদম তোমার মায়ের মতো হয়েছো…কিন্তু আমি এমন মেয়ের মুখ দেখতে চাই না..!
নূরঃ কেনো..? ভালোবাসা অপরাধ নয়। আমার আব্বু আপনার মেয়েকে কষ্টে রাখেনি বরং আম্মুকে সুখে রাখার জন্য জীবনের সাথে যুদ্ধ করে গেছে প্রতিটা মূহুর্ত।
আনোয়ার চৌধুরীঃ আমি কি কম আদর ভালোবাসা স্নেহ দিয়ে তোমার মাকে লালন-পালন করেছি..?
নূরঃ এতোটাই ভালোবেসেছেন যে মেয়েকে ভালোবাসার মানুষটির সাথে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছেন। মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়তো আর কয়েকদিন এর অতিথি প্লিজ একবার মায়ের সাথে দেখা করুন। আম্মুর শেষ ইচ্ছে আপনাকে এক নজর দেখার। আমার আম্মু হয়তো আপনার মতো শক্ত মনের মানুষ নয়। তাইতো শেষ মুহূর্তেও আপনাকে দেখার জন্য মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। বলেই কান্না করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
আনোয়ার চৌধুরীর চোখে পানি টলমল করছে৷ হঠাৎ বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। নিজের আদরের একটা মাত্র মেয়েকে দেখার জন্য।
নূরকে কান্না করে আনোয়ার চৌধুরীর রুম থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে রুদ্র নূরের পিছু নিলো।
নূর ছাঁদে গিয়ে জোরে জোরে হেঁচকি তুলে কান্না শুরু করলো। মা ছাড়া তো আর ওর এতো বড় পৃথিবীতে কেউ নেই। আগলে বুকে নেওয়ার কেউ নাই। মাথায় হাত রাখার কেউ নেই। এতো বড় পৃথিবীতে সে একা একদম একা।
রুদ্র নূরের পেছনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কান্না করলেও বুঝি মেয়েদের মতোটা সুন্দর লাগে…?
কতটা সময় পেরিয়ে গেলো জানা নেই।
নূরের কান্না থেমে গেছে রুদ্র নূরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে চোখের পানি মুছে দিলো৷
নূর অবাক হয়ে রুদ্রের দিকে তাকালো।
রুদ্রঃ কি হয়েছে..? দাদাভাই কিছু বলেছে..?
চলবে…
ভুলত্রুটি মার্জনীয়…