ভালোবাসি হয়নি বলা পর্ব-০২

0
452

#ভালোবাসি_হয়নি_বলা
#পর্ব_২
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

বৃদ্ধ লোকটি তার ছেলের সাথে চলে যেতেই নূর হাঁটা ধরলো গ্রামের আঁকাবাকা রাস্তা দিয়ে।

বৃদ্ধ লোকটি আর কেউ নয় আনুয়ার চৌধুরী ছিলেন।

সারাদিন এদিকে ওদিকে ঘুরে সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে নূর একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো।
এভাবে খুঁজলে সে কখনোই সেই চৌধুরী বাড়ি খুঁজে পাবে না।
আগে থাকার জন্য জায়গা খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু এই গ্রামে ওকে থাকতে কে জায়গা দিবে..? অন্তত আজকের রাতে থাকার জন্য জায়গা খুঁজে বের করতে হবে আগে৷

এই গ্রামে থাকার জন্য কোনো হোটেল নেই।

নূর বিরক্ত হয়ে পেছন ফিরে তাকালো।
কিছু লোককে ওর দিকে আসতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। এক তো অচেনা গ্রাম তার উপরে সন্ধ্যা নেমে আসছে অজানা ভয়ে নূরের বুক কেঁপে উঠলো।

লোকগুলো নূরের সামনে এসে ওকে ভালো করে দেখলো। তারপর একজন বলে উঠলো, ‘ এই মেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো..?
নূর কি বলবে বুঝে পাচ্ছে না চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
আরেক জন বলে উঠলো,’ মেয়েটা মনে হয় কথা বলতে পারে না।’

নূর কিছু বলার আগে গেইটের ভেতরে থেকে একটা মহিলার কন্ঠ ভেসে আসলো।

~ লতিফ ভাই কে এই মেয়ে..??
লোকগুলো সরে গেলো নূরের সামনে থেকে।
মহিলাটা নূরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চেহারা কারো সাথে খুব মিল।

লতিফঃ বেগম সাহেবা গেইটের সামনে একঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই মেয়েটি। জিজ্ঞেস করাতে কিছুই বলছে না হয়তো কথা বলতে পারে না।

নূর ভ্রু কুঁচকে লোকটার দিকে তাকালো। তারপর বলে উঠলো,’ টাকলু আঙ্কেল আমি তো দশ মিনিট হবে এখানে দাঁড়িয়েছি। আপনি মিথ্যা কেনো বলছেন..?

লোকটা হা করে নূরের দিকে তাকিয়ে নিজের মাথায় হাত দিলো। আজ মাথায় চুল নেই বলে এভাবে লজ্জা দিলো বেগম সাহেবার সামনে।

মহিলাটি নূরকে বললো,’ তোমার বাড়ি কোথায়..?
নূরঃ আমার বাসা শহরে আমি ভুল করে এই গ্রামে ঢুকে পড়েছি আজকের জন্য কি থাকার জায়গা হবে আন্টি…?
মহিলাটি নূরকে ইশারা করলো উনার সাথে বাড়ির ভেতরে যেতে।
নূর ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ির ভেতর। দেখতে মহিলাকে ভালো মনে হলেও কার মনে কি আছে কেউ তো আর বলতে পারে না।

নূর সদর দরজার সামনে দাঁড়াতেই এক জগ পানি এসে পরলো ওর উপর।
নূর দুই হাতে নিজের মুখ ডেকে নিলো।
বাড়ির সবাই দরজার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কে জানতো এই সময় দরজা দিয়ে কেউ প্রবেশ করবে!।
নূর নিজের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আহারে বেচারি দেখ বাড়িতে প্রবেশ না করতেই তোর অবস্থা কি করেছে…বলেই সামনে তাকালো। জগ হাতে একটা সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনে কিছু বাচ্চা নূরের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে।

নূরকে ভেতরে নিয়ে আসা মহিলাটি নূরের কাছে এসে বললো,’ তুমি ঠিক আছো তো..? আসলে আমাদের বাড়ির বাচ্চা গুলো খুব পাঁজি ভেতরে চলো আমার সাথে।

নূর রাগী চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মহিলাটির সাথে গেলো৷ আর মনে মনে হাজারটা বকা দিয়ে দিলো বেয়াদব ছেলে সুদর্শন হলে কি হবে শয়তানের নানা।

মহিলাটি ভেতরে নূরকে একটা রুম দেখিয়ে দিলো। খুব সুন্দর পরিপাটি রুমটা।

নূর কৃতজ্ঞতার একটা হাসি দিলো। মহিলাটি নূরকে ভেতরে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে নিতে বললো।

রাতে নূর হসপিটাল কল দিলো।

নূরঃ হ্যালো অভিক ভাইয়া…
ডাক্তারঃ হুম নূর বলো..
নূরঃ আম্মু কেমন আছে এখন..?
ডাক্তারঃ এখন আগের মতোই আছে নূর। তুমি কোথায় এখন..?
নূরঃ ঠিক জানানেই। তবে ভালো আছি। আমি না আসা অব্দি আপনি আম্মু কে একটু দেখে রাখবেন ভাইয়া আমি খুব জলদি চলে আসবো।
ডাক্তারঃ বাড়ি খুঁজে পেয়েছো..?
নূরঃ না..
ডাক্তারঃ এখন কি করবে..?
নূরঃ আমি ঘুমানোর আগে আপনাকে কল দিবো ভাইয়া।
ডাক্তারঃ আচ্ছা ঠিক আছে।

নূর তাকিয়ে দেখে দরজার সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নূর মেয়েটার দিকে তাকাতেই মেয়েটা হাসি দিয়ে বললো,’ আপনাকে আম্মা বলেছে নিচে যেতে…
নূরঃ কেনো.?
মেয়েটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,’ খাবারের সময় হয়েছে। আমাদের বাড়িতে সবাই এক সাথে খাবার খায়।
নূরঃ ওহ আচ্ছা।

নূর মেয়েটার সাথে কথা বলতে বলতে নিচে নেমে আসলো। মেয়েটার নাম ইভা, ভার্সিটিতে পড়ে তারমানে নূর আর ইভা ক্লাসমেট।

আর যেই মহিলাটি নূরকে বাড়িতে জায়গা দিয়েছে উনি এই বাড়ির বড় বউ সালমা বেগম।

নূর নিচে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
এই বৃদ্ধ লোকটা এখানে কেনো..? নূর এক হাত দিয়ে নিজের মুখ ডেকে নিলো।
ইভা নুরের দিকে তাকিয়ে বললো,’ কি হয়েছে..?’
নূর জোর পূর্বক হাসি দিয়ে বললো, ‘ ইভা আমার খিদে নেই আমি রুমে চলে যাচ্ছি।
ইভাঃ আরে হালকা কিছু খেয়ে নাও। একদম না খেয়ে থাকা ভালো না।
নূর এখন কি করবে..? এই লোক তো ওকে দেখলেই চিনে ফেলবে।

ইভা নুরকে টেনে এনে বৃদ্ধ লোকটির পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলো।
লোকটি নূরের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের মতো বসে রইলো।
নূর কিছুটা অবাক হলো লোকটির আচরণে।

আসতে আসতে করে পরিবারের সব সদস্যরা এসে উপস্থিত হলো।

এই বাড়ির একটা নিয়ম নূরের খুব ভালো লাগলো। খাবার খাওয়ার সময় পরিবারের ছোটো বড় সবাই একসাথে বসে খায়। আগে টেবিলে সব কিছু সাজিয়ে নিবে তারপর সবাই একসাথে বসে খাবার খাবে।

নূর অনেকক্ষন ধরে খেয়াল করছে সামনে বসে থাকা ছেলেটা অকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
নূর বিরক্ত হয়ে অন্য দিকে ফিরে গেলো৷ এটা দেখে ছেলেটা মিটমিট করে হাসছে৷ নূর চোখ রাঙিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো।
ছেলেটার হাসি যেনো অবাকে পরিণত হলো।
নূর কিছুই বুঝলো না৷ তখনি পেছন থেকে একটা মেয়ে বলে উঠলো, ‘ রুদ্র ভাই তুমি আমাকে দেখে দেখে হাসছো কেনো..? আমাকে দেখে কি তোমার জোকার মনে হচ্ছে ..?
নূর বুঝলো সে ভুল জায়গায় ভুল রিয়েক্ট করে ফেলেছে৷ এইছেলে ওকে নয় অন্য কাউকে দেখে হাসছিলো। নূর লজ্জায় নিচের দিকে ফিরে গেলো।

সবাই খাবার টেবিলে বসতেই একজন মহিলা বলে উঠলো,’ এই মেয়েটা কে..??’
সবাই এবার নূরের দিকে তাকালো।
নূর ভয়ে থম মেরে আছে।

সালমা বেগম বলে উঠলো,’ মেঝো ও এখন আমাদের বাড়ির মেহমান। ‘
এই বাড়ির মেঝো বউ বলে উঠলো,’ কেমন মেহমান..?
সালমা বেগমঃ গ্রাম ঘুরতে এসে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে কয়েকদিন থাকবে গ্রাম ঘুরে দেখবে।
মেঝো বউঃ দিন দিন বাড়িটা রাস্তার মানুষের হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা হারালে এই বাড়িতে জায়গা দিতে হবে! কে কি মতলব নিয়ে আসে কে জানে..! আমার কথাতো আবার কারো ভালো লাগবে না।

আনুয়ার চৌধুরীঃ মেঝো বউ তোমার এই আগে আগে বেশি বোঝাটা কমাও আর কোথায় কি কথা বলতে হয়। সেটাও কি আজও শিখতে পারোনি!!

নূর লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে৷

আনোয়ার চৌধুরী নূরের দিকে তাকিয়ে বললো,’ তোমার যতদিন ইচ্ছে থাকো গ্রাম ঘুরে যাও আর আজ অনেক রাত হয়ে গেছে কাল সকালে আমি তোমার সাথে কথা বলবো। কারো কথা মাথায় না নিয়ে খাবার খাও।’

এই বাড়ির মেঝো বউ কুলসুম। কারো ভালো সে দেখতে পারে না৷ সারাদিন মানুষের ভুল ধরা, পিছে লেগে থাকা উনার প্রধান কাজ। নূরের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি কেটে খাওয়া শুরু করলো।

এই বাড়ির ছোটো বউ আয়েশা বেগম খুবি নরম মনের মানুষ । সবার সাথে খুব কম কথা বলে যাকে উনার বেশি ভালো লাগে তার সাথেই কথা বলে বেশি । সারাদিন সংসার ছেলে মেয়ে নিয়েই তার দিন কেটে যায়।

আয়েশা বেগম রুদ্রকে আর ওর ছোটো বোন নীলা কে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে।

নূর সেই দিকে তাকিয়ে একটা মলিন হাসি দিলো৷ মনে পড়ে গেলো নিজের মায়ের সাথে কাটানো দিন গুলোর কথা। চোখের কোনে পানি জমে গেলো। কষ্ট করে দুই লোকমা মুখে দিয়ে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো।

রুদ্র আরচোখে নূরের হঠাৎ এমন পাল্টে যাওয়াটা খেয়াল করলো৷ মেয়েটার চোখে পানি কেনো আসলো..? নিজের মায়ের দিকে একবার তাকালো। মেয়েটার কি মা নেই.!!.??

[ রুদ্র চৌধুরী খুবি মিশুক আর দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে। রাশিয়া থেকে ডাক্তারি পড়া শেষ করে এসেছে। কিন্তু সে অন্য ডাক্তারদের মতো গম্ভীর, বদমেজাজী, রাগী নয়। তবে কম বেশি সবারি রাগ থাকে আর মিশুক, দুষ্ট ছেলেদের রাগ আরও বেশি ভয়ংকর হয়। তারা যখন-তখন রেগে যায় না তবে কখোনো যদি রেগে যায় তাহলে সেই রাগ কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সব লান্ড ভন্ড করে দেয়। ]

নূর রুমে এসে হাতে মুখে পানি দিয়ে রুমে এসে দেখে রুদ্র হেলান দিয়ে ওর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
নূর ভ্রু কুঁচকে রুদ্রের দিকে তাকালো।
রুদ্রঃ আপনার এই বাড়িতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য কি…??
নূর কিছু সময় রুদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলো এতো ভদ্র ইনোসেন্ট দেখতে ছেলেরা বুঝি এটার মতোই বেয়াদব মার্কা হয়!
নূরঃ এই বাড়িতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য হলো আজকের রাতটা থাকা।
রুদ্রঃ কাল তাহলে চলে যাচ্ছেন..?
নূরঃ আপনাকে বলতে বাধ্য নই।
রুদ্রঃ আমার বাড়িতে থেকে আমাকে বলবেন না কি সাঙ্গাতিক কথা!! তা কি চুরি করতে এসেছেন..?

নূর মুখে জোর পূর্বক হাসি ঝুলিয়ে বললো,’ কারো মন…
রুদ্র অবাক হয়ে বললো,’ কারো মন চুরি করতে এই বাড়িতে এসেছেন! এই বাড়িতে হ্যান্ডসাম, স্মার্ট, কিউট, ইনোসেন্ট, ভদ্র, সুদর্শন যুবক বলতে আমিই আছি তার মানে আপনি আমার….
রুদ্র আর কিছু বলার আগেই নূর রুদ্র কে থামিয়ে বললো,’ আমি এই বাড়ির কথা কখন বললাম..? আমি এই গ্রামের কথা বলেছি…
রুদ্র তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,’ এই গ্রামে আমার থেকে সুদর্শন ছেলে আর একটাও পাবে না বুঝলে..? আর যার মন চুরি করতে এসেছো সে কি তোমার প্রেমিক..?
নূরঃ হুম আমার প্রেমিক উত্তর পেয়েছেন..?
রুদ্রঃ উত্তর তো মিলেনি। এই গ্রামে তোমার প্রেমিক থাকলে তুমি তার কাছে কেনো যাওনি..?
নূরঃ কারন তাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
রুদ্রঃ সে কি পলাতক..?
নূরঃ এতো কিছু যেনে আপনার কাজ কি..?
রুদ্রঃ তুমি আমাদের বাড়িতে আছো উত্তর দিতে বাধ্য…
নূরঃ আমি কি এখানে ইন্টারভিউ দিতে এসেছি..?
রুদ্রঃ ইন্টারভিউ দিলে কাজের মেয়ের চাকরিও পাবে না। বলেই পকেটে হাত দিয়ে চলে গেলো।

নূর রেগে রুদ্রের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। বেয়াদব ছেলে নিজ থেকে এসে কতোগুলো কথা শুনিয়ে গেলো। আমি কেনো কাজের মেয়ের চাকরি করতে যাবো! আজ বিপদে পড়ে এসেছি না হলে কখনো আসতাম না। কাল সকালেই আমি খুঁজে সবাই কে বের করবো তারপর চলে যাবো।

দরজা বন্ধ করে রুমে এসে মোবাইল হাতে নিতেই ওয়ালপেপার এ ফারাজ এর মুখটা ভেসে উঠলো৷ সারাদিন কাজে ব্যাস্ত থেকে ফারাজের স্মৃতি কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়ে ছিলো। নূর ফারাজের ছবির উপর হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,’ আপনি আমার না বলা ভালোবাসা.. হয়তো কখনো আপনাকে পাবোনা তবে থেকে যাবেন সব সময় আমার বুকের বা’ পাশে। আপনার জায়গাটা কেউ নিতে পারবে না। আমি ক্লান্ত ফারাজ আজ আপনার বুকটা আমার খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো। একটু শান্তিতে কান্না করার জন্য, আপনাকে দরকার ছিলো জড়িয়ে ধরে শান্তির শ্বাস নেওয়ার জন্য। আজ আমার নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। আমার মনে সাহস জাগানোর জন্য আপনার হাতটা খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো। চোখ থেকে গড়িয়ে পরছে পানি। ছবিটা বুকে চেপে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো নূর।

চলবে….
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।