ভুলিনি তোমায় পর্ব-০৫

0
4021

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :৫

“ছেঁচড়া ছেলেদের দেখলে মন এমন জিনিস করতে চায় যেটা বলতেও ইচ্ছা করে না।এখন তো আমার সব ছেলেদেরই এমন লাগে।ঠাসস ঠাসস করে দুইটা থাপ্পর দিতে পারলে শান্তি লাগতো, যত্তসব ফালতু ছেলে।

একটু আগে গাড়ী থেকে নামতেই পিলারের সাথে ধাক্কা খেলাম।কপালে হাত বুলাতে বুলাতে উপরে তাকাতেই ইয়া বড় একটা ছেলেকে আমার দিকে হা করে তাকাই থাকতে দেখলাম।ওমা তার মানে ওটা পিলার ছিলো না, জ্বলজ্যান্ত দানব ছিলো। আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি নিজেকে ভালো করে দেখতে লাগলাম।কিছু দেখা যাচ্ছে কী না?না, সব তো ঠিকঠাক আছে।তো এমন করে তাকাইতেছে কেনো?নিশ্চয় ব্যাটা লুচু,,আমি বুঝি না এই ছেলেগুলো এত লুচু হয় কেনো?

ছেলেটার কোনো হেলদোল না দেখে আমার রাগ লাগতে লাগলো।আমি ফোসফোস করে ওপর দিক দিয়ে বের হয়ে গেলাম।আমার নড়চড় দেখে ছেলেটা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো।তারপর গাড়ীর ভেতর থেকে মালপত্র নামাতে লাগলো।মনে হয় বাড়ীর কেয়ার টেকার।

বাবার পাশে দাড়াতেই দেখলাম রেদোয়ান ভাইয়া আর ছেলেটা মিলে গাড়ী থেকে মালপত্র নামাচ্ছে। ছেলেটা একটু পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে।সবগুলো গাড়ী থেকে নামিয়ে আমার কাছে এসে আমার হাত থেকে কাপড়ের ব্যাগ নেওয়ার ভান করে আমার হাত টাচ করলো।বিষয়টা আমি টের পেতেই হাত থেকে ব্যাগ ছেড়ে দিলাম।ছেলেটা অবাক হয়ে গেলো, আমি দ্রুত ওর কাছ থেকে সরে ওপাশে চলে গেলাম।আমাকে এমন করতে দেখে সবাই কেমন করে তাকালো আমার দিকে।সাথে সাথে আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।যতসব, ছেঁচড়া।
.
.
.
ফুফিদের ডাইনিং রুমে বসে আছি আপুদের সাথে।নাস্তা সামনে দিয়ে রাখছে তাও খেতে মন চাইতেছে না।বড় আপুর উপরে রাগ লাগতেছে,,আপু শুধু জ্ঞান দিতেছে।রাগ এ কারনে লাগতেছে না যে আপু জ্ঞান দিতেছে বরং এ কারনে লাগতেছে আপুর কথা শুনে বারবার সৌরভের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।আপু কী বুঝে না ওর কথা মনে পড়লে আমার কষ্ট হয়,কান্না পায়। কিন্তুু আমি এ মুহূর্তে উনাদের সামনে কাঁদতে চাইতেছি না। আপুকে কোনোরকম মাথা ব্যথা বলে রেস্টের ব্যবস্থা করলাম।

আজকেও সেদিনের রুমে থাকতে দেওয়া হলো।ওয়াসরুমে ফ্রেশ হতে গিয়ে দেখলাম আমি উল্টা বোরকা পড়েছি।তার মানে পুরো রাস্তা উল্টো বোরকা পড়ে ছিলাম,এজন্যই তো সবাই কেমন করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো।আয়নার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, আগে আমি কোথাও যাওয়ার কথা শুনলে একদম পরিপাটি হয়ে নিতাম,সবকিছু ভালো করে দেখতাম,কত সুন্দর করে সাজু করতাম,,,আর আজ সাজগোজ তো দূর বোরকা টাও ঠিক মত পরি নি।” কতটা বদলে গেলাম,তাই না?কিন্তুু কী করবো এসব আর ভালো লাগে না, সবকিছুতে আগে যেমন আমেজ পেতাম এখন তা পাই না।সব কেমন বিষাদ, বিষাদ লাগে।সৌরভের একটা সিদ্ধান্তেই আমার জীবনের সব হাসিখুশি মুহূর্তেই হারিয়ে গেলো।ওর সাথে সাথে আমার জীবনের রং গুলোও চলে গেলো।কেনো এমন করলে সৌরভ?আমাকে কেনো ভালোবাসলে না?আমি কী এতটাই খারাপ ছিলাম?বিশ্বাস করো,, আমার এই ছোট্ট জীবনে মানুষের কটু কথা,অকথ্য গালিগালাজ, নোংরা ব্যবহার সবকিছু শোনার পর ততটা কষ্ট লাগে নি যতটা তোমার দেওয়া ধোঁকাতে লেগেছে।আল্লাহর কাছে দোয়া করি তুমিও যেনো একদিন এমন কষ্ট পাও,যাতে বুঝতে পারো আমি কত কষ্টে আছি।

আমি তোমাকে ভুলে যাবো,তোমার দেওয়া কিছুই রাখবো না। তুমি একটা বেইমান,আমাকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়েছো।যখন আমাকে ভালোইবাসো নি তাহলে কেনো আমার আবেগ বাড়ালে।কেনো আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করলে?কেনো সুখের সংসার বুনার স্বপ্ন দেখালে?কেনো করলে?বলেই বালিশ জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে দিলাম।আমার কান্না কী কখনো থামবে না?কোনোদিন কী তোমাকে ভুলতে পারবো না?আল্লাহ গো, আজ আমি যতটা কান্না করতেছি, ঠিক ততটাই ওর কপালে কান্না রেখো।কারো মন ভাঙ্গলে সে কতটা কষ্টে থাকে, কতটা ডিপ্রেশনে থাকে,কত অপমান,কত লজ্জার স্বীকার হয়, সবটাই যেনো ও হাড়ে হাড়ে টের পায়।

কান্না করতে করতে চোখ মুখ ফুলে গেছে,চোখের নিচে কালিও পড়ে গেছে।তবুও কান্না থামছে না,এ যেনো মরন কান্না যা থেমে যাবার নয়।বিচ্ছেদ কেনো এত কষ্টের? কেনো কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে এত কষ্ট পেতে হয়? জানি না কবে আমার এ কান্না শেষ হবে।
ছোট থেকেই যখন আমি বেশি কান্না করতাম তখনই ঘুমিয়ে পড়তাম,আজও ব্যতিক্রম হলো না।কান্না করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
_____________________________

কারো আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো,চোখ পিটপিট করে খুলে দেখি বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে ডাকতেছেন।আমি দ্রুত উঠে সোজা হয়ে বসলাম।বাবার দিকে তাকাতেই বাবা হাত দিয়ে আমার চোখের কোনে জমে থাকা পানি মুছে দিলো,সাথে সাথে আমি হকচকিয়ে গেলাম।

বাবা আমার সামনে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,,,”ভালোবাসা কী জিনিস তা আমি খুব করে বুঝি।ভালোবাসর মানুষগুলো যখন ছেড়ে চলে যায় তখন কতটা কষ্ট হয় তা আমার থেকে ভালো কেউ বুঝে বলে মনে হয় না।যখন ছেড়ে চলে যায় তখন ইচ্ছে করে মরে যাই,বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা থাকে না।উপরে যতই স্বাভাবিক থাকি না কেনো ভেতরে ভেতরে পঁচে মরি।জীবনের সুখ আনন্দ সব নিমিষেই শেষ হয়ে যায়।ওরা শুধু নিজের দিকটাই চিন্তা করে,অপর পাশের ব্যক্তির জন্য একটুও চিন্তা করে না।কাউকে ভালোবাসা যতটা সহজ ততটাই কঠিন তাকে বুঝানো। জীবনে সবসময় পাশে থাকবো বলা মানুষগুলোই মাঝপথে ছেড়ে দেয়। যেমন তোর মা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। বিশ্বাস কর আমার তখন মনে হয়েছিলে আমি বাঁচতে পারবো না।ওকে পাগলের মত বুঝিয়েছিলাম,তোর জন্য অন্তত থেকে যেতে বলেছিলাম কিন্তুু ও মানে নি চলে গেছে আমাকে একা করে।এটুকু বলেই বাবা হু হু করে কেঁদে উঠলো।

বাবার কান্না দেখে আমারও চোখের পানি চলে এসেছে।কত ভালোবাসে বাবা,অথচ মা একবারও উনার কথা ভেবে দেখলো না।বাবা কয়েক মুহূর্ত কেঁদে নিজেকে হালকা করে নিলেন।চোখের পানি মুছে আবারো বলতে লাগলেন,,” ও চলে যাওয়ার পর আমি একদম ভেঙ্গে পড়ি।রাতদিন কান্না করতাম,তখন তুইও ছোট ছিলি।কতবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম,কিন্তুু তোর মুখের দিকে তাকিয়ে পারলাম না। নিজেকে কোনোমতেই সামলাতে পারছিলাম না,তোর প্রতি প্রথম প্রথম যত্ন নিলেও পরে আর নেই নি।কারন আমি এতটাই ডিপ্রেশন ছিলাম যে তোর খবর নেওয়ার অবস্থা ছিলো না।”ভালোবাসার মানুষগুলো কেনো এমন হয়?তাদেরকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসলে তারা কাঁদিয়ে চলে যায়।” তোর মা চলে যাওয়ার পর তোর দাদী আমাকে জোর করেছিলেন দ্বিতীয় বিয়ের জন্য,কিন্তুু আমি মানি নি উল্টো উনার সাথে ঝগড়া করেছিলাম।যার কারনে উনি আমার সাথে রাগ করে তোর চাচার বাসায় চলে গিয়েছেন, আমার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছিলো।তোর সামনে আসলে তুই সারাদিন তোর মায়ের কথা জিজ্ঞাস করতি,মা আসে না কেনো?মা কই?সারাক্ষন মায়ের জন্য কান্না করতি,তখন আমার খুব খারাপ লাগতো, খুব বেশি।এরপর আমি আরো ভেঙ্গে পড়ি। এত ডিপ্রেশন চলে যাই যে সুইসাইড এটেম্পট করি,কিন্তুু তখন আমার এক বন্ধু আমাকে বাঁচায়।আমাকে সাপোর্ট করে,তোর জন্য বাঁচতে বলে।আমিও ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে থাকি,কিন্তুু যতক্ষন ঘরে থাকি ততক্ষণ তোর মায়ের কথা মনে পড়ে।পুরোনো স্মৃতিগুলো আমার ভেতরটা ক্ষত করে দেয়।আমি জানি তোর জীবন টা আমার আর তোর মায়ের কারনেই নষ্ট হয়েছে।”মায়ের সুখ যখন সন্তানের থেকে বেশী হয় তখন এমনই হয়।” বলেই বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

আমি অপলক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম।বাবা একটু দম নিয়ে আবারো বলতে লাগলেন,,”তুই হয়তো ভাবতেছিস আমি তোকে এসব কেনো বলতেছি? আমি তোকে এসব বলতেছি এই কারনে যাতে তুই নিজেকে সামলাতে পারিস।তোর সামনে পুরো জীবন রয়ে গিয়েছে,এখনই যদি আশা ছেড়ে দিস তাহলে কী হবে?আমি কখনো জানতে চাইবো না ছেলেটা কে, কীভাবে হয়েছে তোদের সম্পর্ক?আর না কোনোদিন বলবো ছেলেটাকে ভুলে যেতে।কারন কাউকে মন থেকে থেকে ভালোবাসলে তাকে কোনোদিন ভুলা যায় না যেমন আমিও তোর মাকে পারি নি।ও বলেছিলো আমি ওকে ভুলে যাবো কিন্তু দেখ এখনও ওকে ভুলতে পারি নি।ওকে বলতে ইচ্ছে করে দেখো আমি #ভুলিনি_তোমায়। আমি জানি তুইও ওকে ভুলতে পারবি না,কিন্তুু মা তাই বলে কী তুমি ওর জন্য নিজেকে শেষ করে দিবে?আমিও তো তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছি তাহলে তুমি কী পারবে না আমার জন্য বেঁচে থাকতে?এতগুলো বছর তোমার মুখ চেয়ে বেঁচে রইলাম আর এখন যদি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তাহলে আমি কী নিয়ে বাঁচবো?মা গো, আমার জন্য হলেও অন্তত নিজের কিছু করো না।তুমি কী পারবে না আমার জন্য কষ্ট করে বেঁচে থাকতে?”

চলবে,,