মৃণালিনী পর্ব-২১

0
303

#মৃণালিনী
#পর্ব ২১
বিভার এই সম্বন্ধ টিও খুব বেশি এগোলো বলে মনে হচ্ছিলো না, সরাসরি নেতি বাচক না হলেও সুভাষের বাড়ি থেকে নতুন করে সম্মতি সূচক কোনো উত্তর এসে পৌঁছয় নি। তাতে শুধু যে বিভার বাবা, মা চিন্তিত হলেন তাই নয়, গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলির মধ্যেও চিন্তার রেশ ছড়িয়ে পড়লো।

তাদের সবারই যথেষ্ট পয়সাকড়ি আছে, কিন্তু এ যুগে শুধু মাত্র সেটাই যে পাত্র পক্ষের এক মাত্র চাহিদা নয় ক্রমশ সবাই সেটা বুঝতে পারছিলেন। পরিবারের ছেলেদের বাইরে পাঠিয়ে শিক্ষা দিলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে তাঁরা কিছুই করেন নি। তাঁদের টাকার জোর আর মেয়ের সৌন্দর্য্য কে ভরসা করে যে আর খুব বেশি দিন ভালো ছেলে পাওয়া সম্ভব নয় সেটা তাঁরা নিজেদের ছেলেদের দেখেই বুঝতে পারছিলেন। তাঁদের নিজেদের বাড়ির শিক্ষিত ছেলেরাই শিক্ষিত মেয়ে ছাড়া বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিলো না আর। এই চিন্তার রেশ মৃণালিনীর শ্বশুর বাড়িতেও ছড়িয়ে পড়লো।

কবে থেকে তোমায় মেয়ের জন্যে পাত্তরের কতা কোয়েছি ঠাকুর পো, তুমি তো কানেই তোলো নে, আর কতো কাল মেয়ে কে বাড়ি বসিয়ে রাখবে! বয়স তো আর তার কমছে নে বাপু!

দুপুরে দেওরের খাবার সময় পাশে বসে পাখার বাতাস করতে করতে বললেন পারুল বালা, সরমা শুকনো মুখে বৌদির দিকে তাকালো।

খোঁজ কি করছিনা বৌদি, কিন্তু সবাই শিক্ষিত মেয়ে চায় যে!

খেতে খেতেই বললেন শ্যাম সুন্দর, পারুল বালা অবাক হয়ে গালে হাত দিলেন!

কি যে বলো তুমি ঠাকুর পো, পিথিবির সব ছেলে কি তোমার ছেলে নাকি! সবাই মোটেই তারা শিক্কিত বউ চায় নে কো! কতো লোকেই তো আমাদের মেয়ের সম্বন্ধের কতা কয়, তো সে তুমি দিতে চাও নে তাই আমিও মানা করে দেই তাদের।

ঠিক আছে, তাহলে দেখো তুমি বৌদি, যদি হয় তাহলে তো ভালই,

রাজি হয়ে গেলেন শ্যাম সুন্দর, সরমা মুখ কালো করে ওখান থেকে উঠে গেলো।

রাতে খেয়ে উঠে নিজেদের ঘরের দরজা লাগাতেই সরমা বলে উঠলো,

আমি তাঁকে লিখে দিয়েছি বউ দিদি, আর তো বিয়ে আটকানো যাবে না মনে হয়! এবার তাঁকে কিছু করতেই হবে।

একটু থমকে গেলো মৃণাল, বিমলের পক্ষে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব বলে তার মনে হচ্ছিলো না। গরীব ঘরের অনাথ ছেলে বিমল যতই সরকারী চাকরি করুক, পাত্র হিসেবে তাকে শ্বশুর মশাই বা বড়ো মা কেউই মেনে নেবেন না! সেটা সে খুব ভালো করে বোঝে, মন টা খারাপ হয়ে গেলো তার। শেষ চেষ্টা হিসেবে সে সৌম্যর শনিবারে বাড়ি ফেরার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।

শনিবারের রাত টা অন্য রাতগুলোর থেকে সব সময়ই আলাদা, ছেলের সঙ্গে বসে একসঙ্গে খাবেন বলে এই দিনগুলোয় শ্যাম সুন্দর নিজে অপেক্ষা করেন। সারাদিনে ব্যস্ততার মাঝেও বার বার ঘড়ির কাঁটায় চোখ রাখে মৃণালিনী, গোছানো ঘর আবার নতুন করে গুছিয়ে তোলে, সন্ধ্যে নামতেই উদগ্রীব হয়ে গাড়ির আওয়াজের দিকে কান পেতে বসে থাকে সে।

রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে হেঁসেল বন্ধ হলে নিজের ঘরে এসেই সৌম্য কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো মৃণাল, সৌম্য খুশি হলো। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই তাদের মধ্যে মাঝে মাঝেই বড়ো মা অশান্তির সৃষ্টি করেছেন, সেই অশান্তি তাদের সম্পর্কে কিছুটা হলেও দূরত্ব সৃষ্টি করছিলো। বিশেষ করে সুভাষের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে তিনি যা কাণ্ড করেছিলেন, তাতে বাস্তবিকই লজ্জিত হয়ে ছিলো সৌম্য, তাই আজ বউয়ের নিজের থেকেই এগিয়ে আসা দেখে একটু হলেও শান্তি পেলো সে। পেছনে ঘুরে সেও মৃণাল কে কাছে টেনে নিলো।

বড়োমা সরমা র জন্যে ছেলে দেখছেন,

খাটে শুয়ে গল্পের ছলে সৌম্য কে বললো মৃণালিনী,

তাই নাকি! ভালোই তো,

সৌম্য খুব খুশি হলো।

আমার কিন্তু বিমল দা কে বেশ পছন্দ ছিলো, সরমার সঙ্গে বেশ মানাতো, তাই না?

বিমল! সে ছেলে খারাপ নয়, কিন্তু বাড়ি ঘর নেই, তাছাড়া বাবা ওকে কিছুতেই যোগ্য পাত্র হিসেবে মেনে নেবেন না!

স্বামীর কথা শুনে খুবই আশাহত হলো মৃণাল, সৌম্য যে এক কথায় তার প্রস্তাব কে নাকচ করে দেবে সেটা সে একটুও ভাবতে পারেনি।

কাকে বলে যোগ্য পাত্র? শুধু পয়সা থাকলেই হয় বুঝি! সরমার দিক টা দেখেছো? আজকাল সবাই লেখাপড়া জানা মেয়ে চায়, বিভার তো সেই জন্যেই বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে বার বার!

খানিকটা ক্ষোভের সুরেই বললো মৃণাল, সৌম্য কোনো উত্তর দিলো না। এবার আরো বেশি করে রাগ হয়ে যাচ্ছিলো তার,

তুমি তো নিজেও শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলে! চাও নি? তাহলে? কি করে আশা করো, অন্য ছেলেরাও তোমার মতই চাইবে না! বরং বিমল দা আমাদের অনেক বেশি চেনা শোনা, পাল্টি ঘর! তাছাড়া তিনি তোমার কথা তে যে অমত করবেন না আমি জানি সেটা!

এবার বেশ বিরক্তির গলায় বলে উঠলো সৌম্য,

এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেনো! এতে তোমার এতো মাথা ঘামানোর প্রয়োজন কি? বড়ো মা বা বাবা কি তোমার মতামত চেয়েছেন? সব ব্যাপারেই কি তোমাকে ঢুকতে হবে? এই নিয়ে আবার বাড়িতে নতুন কোনো অশান্তি বাধিয়ে ফেলো না দয়া করে!

চুপ করে যাওয়া ছাড়া, এই কথার পর আর কিছু করার ছিলো না মৃণালের, খুব সাধারণ বিষয় নিয়েই আবার নতুন করে তাদের মধ্যে মনো মালিন্য সৃষ্টি হলো।

বউ কে চুপ করে থাকতে দেখে একটু পরে নিজে থেকেই কথা বললো সৌম্য,

আমি দু দিনের জন্য মাত্র বাড়িতে আসি মৃণাল, অন্যের জন্যে আমাদের মধ্যে কেনো অশান্তি হবে! বিমল ভালো ছেলে, সরমার পাত্র পাওয়া মুশকিল, সব কিছুই ঠিক, কিন্তু এটা তো আমাদের বিষয় নয়। অহেতুক মাথা ঘামিয়ে লাভ কি!

সরমা আর বিমল দা দুজন দুজনকে ভালোবাসে, সরমা অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায় না!

মৃণাল এর পক্ষে আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না, সৌম্যর সাহায্য ছাড়া যে একাজে এগোনো একটুও সম্ভব নয় সেটা সে বুঝতে পারছিলো।

বউয়ের কথায় চমকে উঠলো সৌম্য, সে এতকাল একসঙ্গে থেকেও কিছুই বুঝতে পারে নি!

তুমি কি ভাবে জানলে?

জানি অনেকদিন থেকেই, আমি ওর হয়ে চিঠি লিখে দিয়েছি বিমল দা কে,

কুণ্ঠিত গলায় বললো মৃণালিনী, সৌম্য একদম অবাক হয়ে গেলো!

তুমি লিখে দিয়েছো! কোনো কাজ ভেবে করো না মৃণাল! ওই চিঠি কারো হাতে যদি পড়তো! এটা কলকাতা নয়! আর লিখো না কখনো,

এখন সরমা নিজেই লেখে, কিন্তু তুমি বড়ো মা কে বলে দিও না ও লিখতে জানে। তাহলেই বড়ো মা আবার শিবু ঘটক কে ডেকে পাঠাবেন

সৌম্য উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছিলো, তার ছোটো বোন টি যে এতদূর এগিয়ে গেছে সেটা জেনে সে যথেষ্টই চিন্তিত হয়ে পড়লো।

ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায়। তবে এ কিন্তু তাড়াহুড়োর জিনিস নয়, ধৈর্য্য ধরতে হবে। তুমি এখনই সরমা কে কিছু বলো না,

মৃণাল ঘাড় নাড়লো, নিজের চিন্তা স্বামীর ঘাড়ে তুলে দিয়ে সে অনেকটাই নিশ্চিন্ত হলো। সৌম্যর বুদ্ধির ওপর তার অগাধ আস্থা।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো সৌম্য, নিচের বাগানে ফুল তুলছিলো মৃণালিনী, এমন সময় সুরেশ এসে দরজায় কড়া নাড়ল। করুণা দরজা খুলে দেবার পরে ওপরে উঠে এলো সুরেশ, সে শ্যাম সুন্দরের সঙ্গে দেখা করতে চায়।

বাবা, সুরেশ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে,

বাবার ঘরের দরজায় বন্ধু কে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো সৌম্য, শ্যাম সুন্দর মুখ তুলে তাকালেন,

কাকাবাবু, আপনার জমি তে স্কুল হলো তাই কাল তার উদ্বোধনে কিন্তু আপনাদের সবার আসা চাই,

মাথা নাড়লেন শ্যাম সুন্দর , সবাই কে নিয়েই যাবেন, কথা দিলেন।

কাল ওখানে তো সবাই আসবেন, সেখানে আমরা সবাই মিলেই একটু বিদ্যুতের জন্যে বলবো ভেবেছি, আপনি থাকলে আরো সুবিধা হতো,

খুব খুশি হলেন শ্যাম সুন্দর, এই সুযোগ তিনিও হারাতে চান না। সুরেশ শেষ পর্যন্ত সৌম্য কেও আটকে দিলো, কালকের অনুষ্ঠানে তাকে থাকতেই হবে, সেই কাজ না শেষ করে সে কিছুতেই কলকাতা ফিরতে পারবে না। সৌম্যর নিজেরও খুব ইচ্ছে ছিলো তাই শেষ পর্যন্ত সেও রাজি হয়ে গেলো সহজেই, নিজের চেষ্টায় জোগাড় করা জমিতে তৈরি স্কুলের উদ্বোধন তার কাছেও যথেষ্টই আনন্দের ছিলো।
ক্রমশ