মৃণালিনী পর্ব-৪৭ এবং শেষ পর্ব

0
730

#মৃণালিনী
#পর্ব ৪৭
চৌধুরী বাড়ি কে অনাথ করে পারুল বালা চলে গেলেন। তাঁর চলে যাওয়ার খবরে বাড়ির উঠোনে গোটা গ্রাম ভেঙে পড়লো। কতো মানুষ যে তাঁর কাছে বিভিন্ন ভাবে উপকৃত ছিলো তা তাদের স্মৃতিচারণায় ক্রমশ প্রকাশ্যে আসতে লাগলো। নিজের হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা তাঁর সংসার, যাকে আঁকড়ে ধরে তিনি বাঁচতে চেয়েছেন সারা জীবন, তা অবহেলায় পেছনে পড়ে থাকলো। যে ক্ষমতা দখলে রাখার জন্যেই এতো লড়াই, ঝগড়া, সংসারিক কচকচি, সে ক্ষমতা এরপরে কার হাতে গেলো, সে বিষয়েও আর তাঁর কোনো কৌতুহল রইলো না!

তাঁর কড়া গলা, রাশভারী মেজাজ, তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মাতৃ রূপের ছবি আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগলো। তাঁর নিকনো উঠোন, তুলসী মঞ্চ, ঠাকুর ঘর, সব কিছু কে পেছনে ফেলে ঈর্ষা, দ্বেষ, শোক, আনন্দের পৃথিবী ছেড়ে এক অন্য জগতে পাড়ি দিলেন পারুল বালা।

জীবন বহমান, কারোর জন্যেই থেমে থাকে না। চৌধুরী বাড়ি তার বড়ো গিন্নির চলে যাওয়ার শোক কাটিয়ে ক্রমশই স্বাভাবিক ছন্দে আবার ফিরে আসতে লাগলো। একমাত্র মৃণালিনীর অন্তরে তিনি ফিরে ফিরে আসতে লাগলেন। সে তার শয়নে, স্বপনে, জাগরণে বড়ো মার অভাব প্রতি মুহূর্তে অনুভব করতে লাগলো। তাঁর শাসন, ভালোবাসা, মাতৃ স্নেহ যা যা সে বড়ো মার কাছে পেয়েছিলো, সে সবই তার জীবনের অমূল্য সঞ্চয় হয়ে রইলো।

যুগে যুগেই পারুল বালারা আসেন, থাকেন এবং চলে যান। তাঁদের কারো কারো জীবনে মৃণালিনীরা আসে, তাঁদের হাত ধরে উত্তরণের পথে নিয়ে যায়। চলে যাওয়ার পরেও তাঁরা রেশ রেখে যান, পরের প্রজন্মের কাছে উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখিত হন।

দিন কাটছিলো, মেয়ে কে শাশুড়ির তত্ত্বাবধানে রেখে ইস্কুলের পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়লো মৃণালিনী। সারাদিন ইস্কুলে কেটে গেলেও বাড়িতে ফিরলেই তাঁর বড়ো মার জন্যে মন খারাপ হতে লাগলো। সবাই থাকা সত্বেও শুধু একটি মানুষের অনুপস্থিতি যেনো গোটা বাড়ি কে নিস্তব্ধ করে রাখছিলো।

চলে যাওয়ার আগে তিনি যে নিজের সারাজীবনের সম্পদ গয়নার পুঁটলি তার হাতে মেয়ের জন্যে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই গয়না সে তৎক্ষণাৎ নিরাপদে মেয়ের ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রেখেছিলো। সরকারি সাহায্য, সুরেশের চেষ্টা আর বড়ো মার জমি, সব কিছুর সাহায্যেই তার ইস্কুল বাড়ি দ্রুত তৈরি হবার পথে এগিয়ে চলেছিলো।

ইস্কুলের উদ্বোধনের দিন এগিয়ে আসছিলো। শ্যাম সুন্দর এতদিন কোনো ব্যাপারেই কথা বলেন নি। বস্তুত দাদার নামের জমি বৌদির কথায় বাধ্য হয়েই ইস্কুল কে দিতে হওয়ায় মনে মনে যথেষ্টই ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলেন। এখন ইস্কুলের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের আগমনের কথায় তিনি নড়ে চড়ে বসলেন। ইস্কুলের নাম ফলক বসানোর তোড়জোড় চলছিলো, সেখানে দাঁড়িয়েই তিনি সুরেশ কে ইস্কুল কে দাদার নামে করার আদেশ দিয়ে এলেন। সুরেশ থতমত খেলো, ইস্কুলের নাম করণ সংক্রান্ত কোনো আলোচনা তখনও পর্যন্ত হয়নি। সে একটু মৃদু গলায় বললো,

কাকাবাবু, এ বিষয়ে আমার সৌম্য বা বৌদি কারোর সঙ্গেই কোনো আলোচনা হয় নি। ইস্কুলের নাম বৌদি সম্ভবত ঠিক করবেন।

সুরেশের এই কথাই শ্যাম সুন্দর কে রাগিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিল। তিনি থাকতে তাঁর বাড়ির বউ, তাঁর দেওয়া জমিতে চলা ইস্কুলের নাম ঠিক করবে, এ মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিলো। তিনি বাড়ি ফিরেই উত্তেজিত গলায় ছেলে কে ডাকলেন। সৌম্য ইস্কুলের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিলো, বাবার উত্তেজিত গলা শুনে দোতলা থেকে নিচে নেমে এসে বাবার মুখোমুখি দাঁড়ালো।

তোমার বউ ঠিক করবে, আমার জমিতে হওয়া ইস্কুলের নাম? এতো সাহস তার! জমি আমার! নামও আমার পছন্দেই হবে! তাকে বলে দিও, বাইরে বসে মেয়ে পড়ানো মেনে নিয়েছি বলেই সে যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা পেয়ে যায় নি! আমি কখনোই তাকে সেই স্বাধীনতা দিই নি, আর ভবিষ্যতেও দেবো না!

সৌম্যর চোয়াল শক্ত হলো, কুমুদ এতক্ষনে হৈ চৈ শুনে নাতনি কে কোলে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর মুখেও বিরক্তির রেখা ফুটলো। তাঁরা দুজনেই কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন, দোতলার বারান্দায় দাঁড়ানো মৃণালিনীর শীতল কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

আমার বাবা সব সময় বলেন, স্বাধীনতা কেও কাওকে দয়া করে দেয় না বাবা, সেটা অর্জন করতে হয়। ইস্কুলের জমি বড়ো মার, বাকিটা সরকারের, তাহলে কোন অধিকারে আপনি সেই ইস্কুলের নামকরণ করতে চান? যে ইস্কুল শুরু হোক, বড়ো হোক, সেটুকুই আপনি চান নি কখনো, আজ তাহলে তার নামকরণ নিয়ে আপনার উদ্বেগ কেনো? জ্যেঠুর নামে ইস্কুলের নাম দিয়ে আপনি শুধু নিজের অহংকার কেই প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাই না বাবা!! ছেলেদের ইস্কুল, মেয়েদের ইস্কুল সব জায়গাতেই শুধু আপনার পিতৃ পুরুষরা ছড়িয়ে থাকবে, সেই তো আপনার গর্ব তাই না?

পুত্রবধুর এই ধৃষ্টতা শ্যাম সুন্দরের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিলো, কিন্তু যথাযোগ্য উত্তর না থাকায় তিনি ক্রুদ্ধ মুখে স্থান ত্যাগ করলেন। সৌম্য তাঁকে উদ্বোধনে যাওয়ার জন্যে নিমন্ত্রণ করতে আসায় তিনি সেই নিমন্ত্রণ নিতে অস্বীকার করলেন। উদ্বোধনের দিন কিন্তু অন্য রকম হলো, তাঁর পছন্দের নাম না নেওয়া সত্বেও গণ্য মান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে পাছে অনুষ্ঠানের সব আলো পুত্র এবং পুত্রবধূর মুখের ওপরেই পড়ে, তাই তিনি তাঁর রাগ সরিয়ে রেখে যথা সময়েই ইস্কুলের মাঠে উপস্থিত হলেন। সেখানে তখন সবাই উপস্থিত ছিলো, শ্বশুর মশাই কে আসতে দেখে মৃণালিনী তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলো,

আসুন বাবা, আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম!

মঞ্চের মাঝখানে তাঁর চেয়ার রাখা ছিলো, পুত্রবধূর দেখানো চেয়ারে গিয়ে হাসি মুখেই তিনি উপবিষ্ট হলেন। কুমুদ নাতনি কোলে বসেছিলেন, বউমার সঙ্গে তাঁর দৃষ্টি বিনিময় হলো, দুজনের মুখেই মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। এরপরের অনুষ্ঠান খুব শান্তিপূর্ন ভাবেই মিটে গেলো। সম্পূর্ন নিজের চেষ্টায় মৃণালিনী কি ভাবে এই ইস্কুল তৈরি করেছে, সেই খবরে উপস্থিত সরকারি কর্তাব্যক্তিরা ধন্য ধন্য করতে লাগলেন।

এরপরের পর্ব ছিলো নামফলক উন্মোচন। উপস্থিত জেলার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব যখন পর্দা সরালেন, তখন সেখানে পারুল বালার নাম দেখে চারিপাশে গুঞ্জনের সৃষ্টি হলো। শ্যাম সুন্দর নিজের বিরক্তি চেপে রেখে, হাসি মুখে বাধ্য হয়েই উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যেতে লাগলেন।

নতুন দোতলা বাড়িতে হওয়া ইস্কুল ক্রমশই কলেবরে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। আশেপাশের গ্রামের মধ্যে একমাত্র মেয়েদের ইস্কুল হওয়ায় চাপ বাড়ছিলো মৃণালিনীরও। এরই মধ্যে সুরেশের পরামর্শে সে বি টিও পাস করেছিলো। আস্তে আস্তে সরকারি তকমা পাওয়ার সুবিধে নিয়েই আরও নতুন নতুন শিক্ষিকা সেখানে যোগদান করছিলেন।

কিন্তু তাও মৃণালিনীর জীবনে ছুটি বলতে কিছুই ছিলো না, সে সোমবার হোক বা রবিবার, একবার অন্তত ইস্কুলে না গিয়ে থাকা কোনো মতেই তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। প্রতিদিনের মতোই আজও সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে ইস্কুলের সামনে উপস্থিত হয়েছিলো। কাল রাতে সৌম্য বাড়ি ফিরেছে, আজ রবিবার, তবু তার নিয়মের কোনো অন্যথা হয়নি।

মৃণাল! আজ তো রবিবার! আজও তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো!

সৌম্য কখন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলো, সে খেয়াল করে নি। অন্য মনস্ক থাকায় চমকে উঠে,পেছনে ঘুরে স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসলো মৃণালিনী। এই রবিবার দিনটাই যে তার কাছে বড়ো কষ্টের! সারা সপ্তাহ মেয়েদের কল কাকলি তে ভরে থাকে মাঠটা, ঘর গুলো থেকে শোনা যায় চেঁচিয়ে পড়া নামতার আওয়াজ, সেই দিনগুলোয় ও শান্তি পায়। রবিবারের এই নিস্তব্ধতা ওকে ঘরে বসে থাকতে দেয়না, বার বার টেনে নিয়ে আসে এখানে। সামনের বিশাল মাঠটার পরে যে হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটা দেখা যায়, সেটা ও বার বার দেখে। অদ্ভুত এক তৃপ্তিতে মনের ভেতরটা ভরে ওঠে।

এই ইস্কুল ওর সন্তান সম, নিজের সন্তান কে চোখের সামনে বড়ো হয়ে উঠতে দেখলে মায়ের যে তৃপ্তি হয়, সেই তৃপ্তি ও এই ইস্কুলের দেওয়াল, মাঠে কাঠের বেঞ্চগুলোয়, গেটের পাশে গজিয়ে ওঠা বট গাছটার মধ্যে খুঁজে পায়। আলতো ছোঁয়ায় তাদের স্পর্শ ও চোখ বন্ধ করে উপভোগ করে। সন্ধ্যে বেলায় ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে এই হলুদ বাড়িটার দিকে।

চলো, এবার বাড়ি চলো,

দেওয়ালের এক ফাঁক দিয়ে গজিয়ে ওঠা অশ্বত্থ গাছের চারাটাকে টেনে তুলে হাত থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে স্বামীর সঙ্গে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে মৃণালিনী।

উফফ! তোমার নজর! একটা চারা আর কতো ক্ষতি করতো মৃণাল!

মৃদু হাসে মৃনালিনী,

কে জানে ওই চারাই কখন মহীরুহের আকার নেয়! এই ইস্কুলের দেওয়ালে একটা আঁচড়ও আমার বুকে এসে লাগে জানো!

ধীরে ধীরে স্বামীর সঙ্গে বাড়ির পথে এগিয়ে যায় ইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মৃণালিনী, পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে তার স্বপ্নের ইস্কুল। যত বড়ো হয় ইস্কুল, ততই ডাল পালা মেলে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার ছাত্রীরা। আর যতো বার ছাত্রীদের মুখে উচ্চারিত হয় তাদের প্রিয় ইস্কুলের নাম, ঠিক ততবারই সবার প্রিয় বড়দি মৃণালিনী চৌধুরীর সঙ্গেই একসাথে উচ্চারিত হন পারুল বালা, আর চৌধুরী বাড়ির গৃহকর্ত্রী পারুল বালার মতোই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে তাঁর নামাঙ্কিত ইস্কুল, ” পারুল বালা চৌধুরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।”
প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত
( অনেকদিন ধরেই গল্পটি নিয়ে সঙ্গে ছিলাম আপনাদের, মৃণালিনী আপনাদের প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছে। অনেকেই চাননি গল্পটি শেষ হয়ে যাক, কিন্তু আমি প্রথম থেকেই গল্পটিকে দুটি অধ্যায়ে ভেবেছিলাম। সেই মতো এটাই প্রথম অধ্যায় শেষ করার উপযুক্ত সময় বলে আমার মনে হয়েছে। মৃণালিনী দ্বিতীয় অধ্যায়ে অবশ্যই পরে ফিরে আসবে আবার। আপাতত অন্য নতুন গল্প থাকবে। যাঁরা এতদিন ধরে পড়েছেন গল্পটি, আজকের শেষ পর্বে তাঁদের সকল কে মতামত দেওয়ার অনুরোধ রইলো🙏)