মৃণালিনী পর্ব-৪৪+৪৫

0
251

#মৃণালিনী
#পর্ব ৪৪
বড়ো মা! আপনি কি করে জানলেন?

পারুল বালা সবে করুণার সমস্যার সমাধান করে, নিজের ঘরে পা দিয়েছিলেন, মৃণাল আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরেই পেছন পেছন ঢুকে এলো। স্মিত হাসলেন পারুল বালা,

চুলগুলো কি আর এমনি পেকেচে মা গো! হারু কে নে বাপ মরে যাওয়ার পর যকন তার মা একেনে এলো, তকন সে উদোম হয়ে আমার পেছন পেছন বেড়াতো! তারে আমি জন্মাতে দেকিচি! তার মুক শুকনো করে ঘুরে বেড়ানো কি আমি দেকিনি! চেপে ধরতেই সব উগরে দেলো!

বড়ো মা! একটা কথা বলার ছিলো! হারু আমাকে বলেছিলো সে করুণা কে বিয়ে করতে চায়, আমি রাজি হই নি।

বউমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন পারুল বালা,

আসলে আমার মনে হয়েছিলো ও শুধুই হারু কে ব্যবহার করেছে এতদিন! ভালোবাসে নি!

মৃণাল এর কথায় সম্মতি জানালেন পারুল বালা,

শুনলুম তোমার আপত্তি ছেল, হারু কয়েলো আমায়। কিন্তু একখান কতা! সে একখান ভুল করেচে তাই কি তার সব আটকে তাকবে মা? আমার ভাইপো কি বে না করে বসে তাকবে? তার তো মে র অভাব হবে নে কো! এ বরং ভালো হলো, সিককে তো সে পেয়েচে, আর ভুল সে করবে নে কো! আর হারু আমাদের সাদাসিদে ছেলে, ওর জন্যি এইরম মে দরকার, নাইলে নোকে ঠকিয়ে নেবে!

মৃণাল হেসে ফেললো, সে আর কিছু বলার আগেই হঠাৎ করেই নিজের থেকেই বলে উঠলেন পারুল বালা,

গয়নার পুঁটলিখান তোমার কাচেই থাকুক একন, আমার দরকার পড়লে চে নেবোখন। দোষ আমারই, কাঙাল কে শাকের ক্ষেত দেকালে, সে তো যাবেই!

মৃণাল চুপ করে গেলো, পারুল বালা নিজেও আর ওই প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে যেতে চাইলেন না। করুণার বিয়ের তোড়জোড় চলতে লাগলো। করুণার মুখের খুশি সবারই চোখে পড়ছিলো, সে যে আলোকের সঙ্গে হওয়া সম্পর্ক ভুলে নতুন করে এগিয়ে যেতে চাইছে, সেটা বাড়ির সবাইকেই যথেষ্ট স্বস্তি দিচ্ছিলো।

হারুর সঙ্গে করুণার বিয়ে হয়ে গেলো। অসুস্থ শরীরেই পারুল বালা যথেষ্টই ধুমধাম করে তাদের বিয়ে দিলেন। বিয়ে উপলক্ষ্যে বিমল সরমা কে নিয়ে কলকাতা থেকে উপস্থিত হলো। সৌম্য এবং মৃণাল সরমা কে ইস্কুলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্যে অনুরোধ করলো। তাদের দুজনের কারোরই এই প্রস্তাবে আপত্তি ছিলো না, তবে কোনো প্রথাগত শিক্ষা না থাকায় সরমা একা দায়িত্ব নিতে ইতস্তত বোধ করতে লাগলো।

তাদের আলোচনা চলাকালীনই বিভা সরমা র সঙ্গে দেখা করতে উপস্থিত হলো। দুই সই এ অনেকদিন পরে দেখা হলো, নতুন প্রাপ্তি ছিলো বিভার বিয়ের খবর, সেই সব নিয়েই মৃণাল, সরমা এবং বিভার মধ্যে উচ্ছসিত আলোচনা চলতে লাগলো। কথায় কথায় ইস্কুলের দায়িত্ব নেওয়ার কথা উঠলো, সরমা একা দায়িত্ব নিতে ভয় পাচ্ছে সেটা জানিয়ে মৃণাল বিভা কে তাকে সাহায্য করার প্রস্তাব দিলো। দুজনেরই প্রথাগত শিক্ষা ছিলো না, কিন্তু মেয়েদের শুধু মাত্র বর্ণ পরিচয় করানো টুকু তাদের পক্ষে খুব কঠিন ছিলো না, বিভা সহজেই সম্মত হলো।

মৃণাল নিশ্চিন্ত হলো, এর পরের ধাপ ছিলো বড়ো মা র কাছে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার অনুমতি চাওয়া। বিয়ে পর্ব সমাধা হবার পরে একদিন সৌম্যর সঙ্গে আলোচনা করলো মৃণালিনী। সৌম্যর কলকাতা ফিরে যাবার সময় এসে গিয়েছিলো, সে ফিরে যাওয়ার আগেই, একদিন রাতের খাবার নিয়ে বড়ো মার ঘরে গিয়ে কথা তুললো মৃণাল।

বড়ো মা, একটা কথা বলার ছিলো!

পারুল বালা মুখ তুলে তাকালেন,

আমি পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চাই বড়ো মা! মাস চারেক পরেই আমার পরীক্ষা! আগের বার আপনাকে না জানিয়েই পরীক্ষা দিয়েছিলাম! এবার আর করতে চাই না! আপনি অনুমতি দেবেন তো?

মৃদু হাসলেন পারুল বালা,

জানি আমি, বেয়াই মশায় আমারে কলকেতায় থাকতে কয়েছিলেন! তিনি বোধ করি সত্যি টা জানতেন না! তুমি নিজে থেকে কবে কও, সে আশায় ছিলেম!! আর পরিককে তো দিতেই হবে, নিজে না শিকলে অন্য কে শেকাবে কি করে?

মৃণাল স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। বড়ো মার এতো সহজে রাজি হয়ে যাওয়ার আশা তার ছিলো না। দিন কাটছিলো, সৌম্য কলকাতায় ফিরে গেলো। আবার তার সাপ্তাহিক যাতায়াত শুরু হলো। শরিকি জমি দখলে এনে মৃণাল এর আটচালার ইস্কুল শুরু হলো। সরমা কলকাতা ফিরে গিয়েছে বউ দিদির পরীক্ষার সময় এসে ইস্কুলের দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, তাই আপাতত বিভার সাহায্যেই ইস্কুল কে চালিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছিলো মৃণালিনী।

পড়াশুনা মেয়েদের জন্যে কতটা প্রয়োজনীয় সেটা সম্ভবত সবাই অনুধাবন করছিলেন, তাই ক্রমশই ছাত্রী সংখ্যা বাড়ছিলো। শুধু এই গ্রাম নয়, আশে পাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের মধ্যেও সবেধন নীলমণি বলতে এটিই মেয়েদের একমাত্র ইস্কুল হওয়ায় সেই সব গ্রাম থেকেও ক্রমশই ছাত্রীরা এই ইস্কুলে ভিড় করছিলো। এতো ছাত্রীর ভিড় সামলাতে মৃণাল এবং বিভা দুজনেই হিমশিম খাচ্ছিলো। বিভার বিয়েও প্রায় এগিয়ে আসছিলো, তাই তাকে একটু চাপ মুক্ত রাখার চেষ্টায় মৃণালিনী নিজের কাঁধেই ইস্কুলের দায়িত্বের বেশির ভাগটাই তুলে নিয়েছিলো।

এই রকম সময়ে একদিন ইস্কুল থেকে ফিরেই মৃণাল তার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। সন্ধ্যে হয়ে গেলেও যখন সে তুলসিতলায় প্রদীপ জ্বালাতে উঠলো না, তখন কুমুদ করুণা কে ওপরে পাঠালেন। করুণা ওপরে গিয়ে মৃণাল কে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখে নিচে ছুটে গিয়ে খবর দিলো। তার খবর শুনে অশক্ত শরীরেই পারুল বালা বেরিয়ে এলেন। নিচে বেশ হৈ চৈ শুরু হলো। নিচের থেকে আসা হৈ চৈ এর আওয়াজে মৃণাল বিছানা ছেড়ে উঠে, উদ্বিগ্ন মুখে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

হবে নে! শরীলের আর দোষ কি!! এতো খাটুনি কি আর সজ্জ হয়! কতো বার কোয়েচি, এট্টু কম করো মা গো! তা তিনি শুনলে তো!

তাকে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াতে দেখেই উঠোনে দাঁড়িয়েই চিৎকার করলেন পারুল বালা, এতক্ষনে বড়ো মার উদ্বেগের কারণ যে আসলে সেই, সেটা বুঝেই লজ্জিত হলো মৃণালিনী।

আমার কিছু হয়নি বড়ো মা! খুব ক্লান্ত লাগছিলো, তাই একটু শুয়ে ছিলাম। আমি সন্ধ্যে দেখিয়ে দিচ্ছি!

থাক বাছা! আমারে আর মিছে কতা কইতে হবে নে! তোমার কিচু হয়েছে কিনা সে তোমার মুক দেকেই বোজা যাচ্ছে!

ধমকের সুরে বলে উঠলেন পারুল বালা, হারুর মাও তাতে সঙ্গত করলো।

হ্যাঁ গো কত্তা মা! কদিন ধরেই বউমা রে কেমন যেনো শুকনো শুকনো দেকচি গো! একবার ডাগদার বাবুরে খপর করো দিকি।

তখনই শ্যাম সুন্দর সদর থেকে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। আলোকের যাবার পর থেকে, তিনি একাই যাতায়াত করেন। তাঁর নতুন চালক বাড়িতে গাড়ি ঢোকানোর আগেই কুমুদ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন,

ও গো শুনছো! বউমার শরীল টা কেমন যেনো ঠিক মনে হচ্ছে নে! একবার ডাক্তারখানায় নে গেলে হতো নে!

শ্যাম সুন্দর উদ্বিগ্ন হলেন, তবে তাঁর বাড়ির বউ নিজে ডাক্তারের কাছে যাবে, এটা তাঁর মনঃপূত হলো না। তিনি গাড়িতে করে ডাক্তার বাবু কে নিয়ে আসার জন্যে চালক কে পাঠিয়ে দিলেন। মৃণাল বারবার আপত্তি জানাতে লাগলো, সে যে এমন কিছু অসুস্থ নয় সেটা বোঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা তার ব্যর্থ হলো। যদিও ডাক্তার বাবু আসার আগেই হারুর মা তার রোগ নির্ণয় করলো।

ওমা! বউমা যে পোয়াতি গো! কেমন ধারা শাওড়ি তোমরা মা গো! কিচুই বোজনে! তাই তো বলি বউমা দিন দিন এরকম শুইকে যায় কেনে!

পারুল বালা এবং কুমুদ দুজনেই একটু সংশয়ের দৃষ্টিতে বউমার দিকে তাকালেন, মৃণাল লজ্জিত হলো। বামুন দিদিও হারুর মার কথাতেই সহমত প্রকাশ করলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই শ্যাম সুন্দরের পাঠানো গাড়িতে পাশের গ্রামের একমাত্র ডাক্তার বাবু তড়িঘড়ি উপস্থিত হলেন। তাঁর চিকিৎসার খুব বেশি প্রয়োজন ছিল না, হারুর মা যে ডাক্তারেরও কান কাটে সেটা ক্রমশই বোঝা যাচ্ছিলো। সন্তানসম্ভবা থাকাকালীন বিভিন্ন রকম সাবধানতা অবলম্বনের উপায় বলে যাওয়ার সময়, পারুল বালার দেওয়া গোটা কয়েক নারকেল, এবং ব্যাগ ভর্তি আম সহযোগে তিনি বিদায় নিলেন।

চৌধুরী বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেলো। শনিবারে যখন সৌম্য বাড়িতে ফিরলো তার আগেই হারুর মায়ের সৌজন্যে গোটা গ্রামেই চৌধুরী বাড়িতে বংশধর আসার খবর রটে গিয়েছিলো। সৌম্য ট্রেন থেকে নামতেই তার সঙ্গে সুরেশের দেখা হলো, সে কোনো কাজে সদরে গিয়েছিলো। তার কাছ থেকেই সৌম্য নিজের পিতৃত্বের সুখবর পেলো। খবরটি তার জন্যে এতটাই আনন্দের ছিলো যে নিজের উচ্ছাস বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত চেপে রাখা তার পক্ষে দুষ্কর হয়ে উঠছিলো।

বাড়িতে ঢুকতেই সে মা এবং বড়ো মা দুজনেরই মুখোমুখি হলো, তাঁরা অধীর আগ্রহে ছেলে কে সুখবর দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। মৃণাল দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সৌম্য র আসার প্রতীক্ষা করছিলো। কিন্তু পারুল বালা এবং কুমুদ কিছু বলে উঠবার আগেই হারুর মা ধৈর্য্য রাখতে না পেরেই সৌম্য কে বউমার পোয়াতি হবার খবর দিয়ে ফেললো। সৌম্য সে খবর ইতিমধ্যেই পেয়েছিলো, তার মুখে কোনো বিস্ময় ফুটলো না, কিন্তু কুমুদ এই সুযোগ না পেয়ে রাগ করলেন,

সব তাতেই তোমার এতো কতা কিসের হারুর মা! এট্টু নিজের মতো থাকতে পারো নে! গেরস্থের নিজের কতা কিচু থাকবে নে!

হারুর মা মুখ গোমড়া করে কত্তা মা র দিকে তাকালো। কিন্তু পারুল বালা নিজেও বিরক্ত হয়েছিলেন, তিনি হারুর মায়ের গোমড়া মুখ ধর্তব্যের মধ্যেই আনলেন না। সৌম্য কে উদ্যেশ্য করে বললেন,

সবই তো শুনলে বাছা! এরকম সময়ে বেশি ছোটা ছুটি চলে নে কো! তুমি বরং তারে পরীক্ষা দেতে নে গে ওখানেই রেকে এসো। একেবারে সব মিটিয়ে এনো। একেনে তো ডাক্তার বদ্যি নেই কো! যাদের উপায় নেই তারা বাধ্য হয়েই তাকে, তবে তার তো সেরকম নয়। যার বাপ কলকেতা তে আচে, তার আবার চিন্তে কিসের!

কুমুদ সহমত পোষণ করলেন, এমনকি এই ব্যাপারে শ্যাম সুন্দর নিজেও কোনো অমত করলেন না। শেষ পর্যন্ত সন্তান প্রসবের সময়টুকু পর্যন্ত মৃণালিনীর কলকাতায় গিয়ে বাপের বাড়িতে থাকা সাব্যস্ত হলো।
ক্রমশ

#মৃণালিনী
#পর্ব ৪৫
চৌধুরী বাড়িতে বংশধর আসার খবর অচিরেই গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো, তার পেছনে হারুর মায়ের অবদানই ছিলো বেশি। পারুল বালা এবং কুমুদের সাবধানবাণী কে অগ্রাহ্য করেই হারুর মা চৌধুরী বাড়ির বউয়ের দৈনন্দিন কার্যকলাপের বর্ণনা পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে আসতে লাগলো। হারুর মা তার এই স্বভাবের জন্যেই মহিলা মহলে যথেষ্টই জনপ্রিয় ছিলো, একদিন রাস্তায় তাকে মনোরমা পাকড়াও করলেন।

ইদানিং তাঁর চৌধুরী বাড়িতে যাতায়াত অনেকটাই কমে গিয়েছিলো, তার মুখ্য কারণ ছিলো পুত্র বিভাস। বিভাস এর সঙ্গে আলোকের যথেষ্টই যোগাযোগ ছিল, বন্ধুর অপমান, সর্বোপরি প্রকাশ্য আলোচনা সভায় তার নিজের অপমান ভোলা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। অনেকটা তার আপত্তিতেই মনোরমা বাধ্য হয়েছিলেন যাতায়াত কমাতে, কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে মৃণালিনীর সন্তান সম্ভবা হবার খবর তাঁর কানেও পৌঁছেছিল, সেই থেকেই তিনি খবরের সত্যতা যাচাই করবার জন্যে ছটফট করছিলেন। হারুর মা কে বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখেই তিনি ডাক দিলেন,

ও হারুর মা, তোমাদের ঘরে যে নতুন খবর শুনলুম গো!

হারুর মা এগিয়ে এলো, সোৎসাহে বললো,

হ্যাঁ, গো মা! তবে সে তো আর নতুন খবর নেই! গেরামের সবাই তো কবে তে জানে!

সে আমার কপাল গো! নইলে আমার তে তাদের আর নিজের লোক কে আচে বলো? কিন্তু গোটা গেরাম খবর পেলো, আমি পেলুম নে!

সেই তো মা! তুমি তো একন আর যাওনে তেমন, তাইতে খপর খান পাওনি! নইলে এ খপর কি তোমায় আর অন্যের মুক তে শুনতি হয় গো!

একটু দুঃখিত গলায় বললো হারুর মা, মনোরমা খুশি হলেন, গলায় মধু ঢেলে বললেন,

তা খপর একখান আমার কাচেও আচে বাপু! তোমাদের কত্তা মার ভাইপোর তো বে লেগেচে গো, কালই শুনলুম! তা তেনারা আমার আপনার জন, তাদের খপর না দিয়ে কি বসে থাকতে পারি? তাই তোমায় হেথা দে যেতে দেকি ডাকলুম এট্টু!

হারুর মা হাঁ হয়ে গেলো। তার আগেও যে কেউ এতো গুরুত্বপূর্ন একটা খবর সংগ্রহ করে ফেলতে পারে, এ তার ধারণার বাইরে ছিলো। আর অন্য কারোর কাছে এ খবর পৌঁছানোর আগেই সে দ্রুত মনোরমার কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে সে যখন বাড়িতে ঢুকলো, তখন হেঁসেলের দাওয়ায় কুমুদ বসেছিলেন, তাকে হাঁফাতে দেখে খানিকটা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,

কি হলো হারুর মা? তুমি এমন হাঁফাতে লেগেচো কেনো?

হারুর মা যথেষ্টই গোছানো স্বভাবের, যে কোনো খবর পরিবেশনের আগে ভূমিকা রাখতে ভোলে না সে। হাত পা নাড়িয়ে সে সবে মাত্র আলোকের বিয়ের খবর পরিবেশন করতে যাচ্ছিলো, তার আগেই ছোটো জায়ের উদ্বিগ্ন গলা পারুল বালার কে দরজার বাইরে বার করে নিয়ে এলো। কত্তা মা কে বাইরে আসতে দেখেই তার উৎসাহ দ্বিগুণ হলো, সে পারুল বালা কে উদ্যেশ্য করে সোৎসাহে বলে উঠলো,

কত্তা মা! তোমার ভাইপোর বে নেগেচে গো, ওই বিভাস দাদাবাবুর মার তে শুনি এলুম!

পারুল বালার মুখ বিকৃত হলো, হারুর মা কে সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে ছোটো জায়ের উদ্যেশ্যে কড়া গলায় বললেন,

বে যকন নেগেচে তকন দিদির কতা মনে নিচ্ছই পড়বে! ট্যাকা ছাড়া তো আর বে হবে নে! ঠাকুর পো রে কয়ে দিস, এ বাড়ির চৌকাঠ যেনো তারা না পেরোয়!

হারুর মা থতমত খেয়ে চুপ করে গেলো, পারুল বালার এমন প্রতিক্রিয়া সে সম্ভবত আশা করেনি। কুমুদ একটু চুপ করে থেকে মৃদু গলায় বললেন,

দিদি! এমন কতা কইতে আচে! তারা যে আমাদের বড়ো কুটুম গো!

বড্ড দরদ তোর! সেই তে দেকচি!

রাগের গলায় আরও কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন পারুল বালা, এমন সময় দোতলা থেকে মৃণালিনী ইস্কুলে যাবার জন্যে তৈরী হয়ে নেমে এলো। তাকে দেখেই কুমুদ তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন, শাশুড়ি দুধের গেলাস এগিয়ে দিতে মৃণাল মুখ বিকৃত করলো। দুধ খেতে তার একটুও ভালো লাগে না, কিন্তু ইদানিং তাকে সকাল বিকেল দুধ খাবার নির্দেশ দিয়েছেন বড়ো মা। তার মুখের বিকৃত ভাব দেখেই ছোটো জায়ের ওপরের রাগ এবার তার ওপরেই পড়লো পারুল বালার। বউমা কে উদ্যেশ্য করে কড়া গলায় বললেন,

জেবন খান তাকলি তবেই নেকা পড়া! দুধ খেলি কি কি উবগার হয়, সে সব কি তোমার ওই বইয়ে নেকা থাকে নে?

বড়ো মার এই কথাকেই বড্ড ভয় পায় মৃণালিনী, তাই আরও বেশি কিছু শোনার আগেই সে নাক চেপে দুধ গলাধঃকরণ করলো। বউমা কে কথা শুনতে দেখে কিছুটা শান্ত হলেন পারুল বালা। ইতিমধ্যেই অসুস্থ শরীরে চিৎকার করে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়ে ছিলেন, হেঁসেলের দেওয়ালে তাঁকে হেলান দিয়ে বসতে দেখে কুমুদ উদ্বিগ্ন হলেন, বামুন দিদির ইশারায় মসলা বাটা থামিয়ে করুণা জলের গেলাস তাঁর সামনে রাখলো। এমন সময় শ্যাম সুন্দর বাড়ি ঢুকলেন, হেঁসেলে বাড়ির সবাই কে উপস্থিত থাকতে দেখে পারুল বালা কে উদ্যেশ্য করে বললেন,

বৌদি, আজ কোর্টের সামনে তোমার ভাই এসেছিলো। আলোকের বিয়ে, সবাই কে যেতে বলেছে সে! বোধ করি তোমার ভয়েই আর বাড়ি আসেনি! আমরা সবাই যাবো বলে তাকে কথা দিয়েছি।

মৃণাল চমকে উঠলো, এতো কিছুর পরেও যে শ্বশুর মশাই বিয়ে বাড়িতে যাবেন বলে কথা দিয়ে আসবেন, এটা সে ভাবে নি। বড়ো মার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি থমথমে মুখে বসে আছেন। শ্যাম সুন্দর কারোর মতামতের জন্যে অপেক্ষা না করেই দোতলায় উঠে গেলেন। দু এক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে মৃণাল ইস্কুলে রওনা হলো। বউমা বেরিয়ে যাওয়ার পরে কুমুদ ধীরে ধীরে দোতলায় উঠে এলেন। তিনি যখন ঘরে ঢুকলেন তখন শ্যাম সুন্দর হিসাবপত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

বে তে কি যেতেই হবে? করুণার কতা খান এট্টু ভাববে নে! দিদিও তো দুঃখ পাবে!

স্বামী কে উদ্যেশ্য করে বললেন কুমুদ, শ্যাম সুন্দর হিসাব মেলাতে মেলাতেই মাথা নাড়লেন,

বাড়ির কাজের মেয়ের জন্যে কুটুমের সঙ্গে সম্বন্ধ নষ্ট করবো? আর বিয়ে তো করুণাই করতে চায়নি, এতে আলোকের দোষ কোথায়?

তুমিও তো তারে জেলে দে এসেছিলে! তার বেলা? আর যাঁর ভাইপো তিনিই যকন চান না…,

দ্রুত হাত তুললেন শ্যাম সুন্দর,

অন্যায় করেছিলো তাই দিয়েছিলাম, কিন্তু সে পর্ব মিটে গেছে। এখন তাকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। বৌদি কে বলো, তিনিও যেনো বিয়েতে উপস্থিত থাকেন, বিভাস কে জব্দ করতে গেলে, ওকে আমার আবার লাগবে।

কুমুদ স্থির দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন,

তাই বলি, হটাৎ করে কুটুম্বিতে মনে পড়লো কেনো! বিভাস রে জব্দ করার জন্যে সবাই রে টেনে নে যেতে হবে! দিদির মান অপমানও ভাববে নে! বাড়িতে এলে তাঁরা নিচ্ছই বড়ো কুটুম, তা বলে তাঁদের বাড়ি গে কুটুম্বিতে দেকাতে পারবো নে। তোমার পেয়জন তুমি যেও, আমরা যাবো নে।

কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন কুমুদ, স্ত্রীর গমন পথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন শ্যাম সুন্দর। আর নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করলেন না তিনি, তাই আলোকের বিয়েতে যাওয়ার প্রসঙ্গ ধামাচাপা পড়লো। বাড়ির রাশ ক্রমশই যে হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছিলেন শ্যাম সুন্দর।

দিন এগিয়ে চলেছিলো, পারুল বালা দিন দিন ক্রমশই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। ইদানিং আর ছাদে উঠতে পারেন না তিনি, মনোরমা এখন এই ছাদে পা দেন না, বিভার মা মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। এইসব বিভিন্ন কারণে মজলিশ তার জৌলুস হারাচ্ছিলো কিছুদিন ধরেই, তার সঙ্গে নতুন সঙ্গত যোগাল বিদ্যুৎ।

এ গ্রামে শেষ পর্যন্ত বিদ্যুৎ এলো, সেটা সমবেত চেষ্টার জোরেই। তাতে মূল ভূমিকা যে সুরেশের ছিলো, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মাথার ওপরে ঘুরতে থাকা পাখা, দুপুরের মজলিশের থেকে দিবা নিদ্রা কে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তুলছিলো। তাই অচিরেই মজলিশ বন্ধ হয়েছিলো। যদিও বিদ্যুতের আসা যাওয়ার পরিমাণ হিসেব করলে পাল্লা যাওয়ার দিকেই ভারী হতো তবুও বিদ্যুৎ এসেছে এই ভাবনা টুকুই গ্রামের মানুষের জন্যে অনেক ছিলো।

পারুল বালার ঘরে যেদিন আলো লাগানো হলো খুব উৎসাহ নিয়ে দেখলেন তিনি, বার বার করে কলকাতার কথা বলতে লাগলেন। মৃণালিনীর বাপের বাড়িতে থাকাকালীন যে দৃশ্য তিনি দেখে এসেছিলেন, সে দৃশ্য যে তাঁর গ্রামেও কোনোদিন দেখা যেতে পারে তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিলো না।

কেমন লাগছে বড়ো মা? বেশ সুবিধা না?

বড়ো মার কাছে বসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো সৌম্য, মৃণালিনী পাশেই বসে ছিলো। পারুল বালা মাথা হেলালেন,

হ্যাঁ, বাবা খুব সুবিধে। আলো থাকলে সব কিচু পরিষ্কার লাগে কেমন। মনের ভেতরও কেমন পরিষ্কার হয়ে যায়, কোনো ময়লা থাকে নে! আঁধার যে মনের ময়লাও বাড়ায় বাবা!

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা মৃণালিনীর দিকে তাকালেন তিনি,

হা করে শুনচে দেকো! কিছুই বোজে নে! এ নাকি শিক্কার আলো দেকাবে!

সৌম্য হেসে ফেললো, লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো মৃণালিনী। বড়ো মার এই বকুনি গুলো কে এখন তার খুব ভালো লাগে, এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাগুলো তার চোখে ধরা পড়ে।

সুরেশ তার সর্বশক্তি দিয়ে ইস্কুলের জন্যে সরকারি সাহায্যের চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সে সাহায্য যেনো হয়েও হচ্ছিলো না। সাহায্য পেতে গেলে আরো জমির প্রয়োজন ছিলো, ওইটুকু জমিতে ইস্কুল তৈরির অনুমতি সরকার দিতে রাজি ছিলো না। গ্রাম আস্তে আস্তে স্বনির্ভর হয়ে উঠছিলো। আপাতত বিভা এবং সরমার ভরসায় ইস্কুল রেখে মৃণালিনী কলকাতায় পরীক্ষা দিতে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছিলো।

দিনটা ছিলো রবিবার, আগের দিন রাতেই সৌম্য বাড়ি এসেছিলো। সকাল বেলায় ঘরের বিছানা তুলতে তুলতে স্বামীর হাঁক ডাক শুনে ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দৌড়ে বেরিয়ে এলো মৃণালিনী, উঠোনে মেলা লোক জড়ো হয়েছে। বাড়ির সবাই মোটামুটি সৌম্যর চিৎকারে উঠোনে এসে উপস্থিত হয়েছে,

বাড়ি যেনো মাতায় করলো গা! কি হয়েছে ক দেকি!

বলতে বলতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন পারুল বালা,

বড়ো মা, খুব খুশির খবর! স্কুল টা সরকারি সাহায্য পেয়ে যাবে গো! আর কোনো চিন্তা রইলো না! শুধু আর কিছুটা জমি পেলেই হলো, বাকি সব সমস্যা মিটে গেছে!

মৃণাল বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিলো, তার স্বামী যতটা খুশি ছিলো সে ততটা ছিলো না। সরকারি সাহায্য পাওয়াটাই যথেষ্ট নয়, তার জন্যে জমিরও দরকার আছে। ছেলেদের স্কুলের জমি তার স্বামী যে কিভাবে জোগাড় করেছিলো তা সে জানে। এতো জমি কোথায় পাবে সে, এই ভাবনা তার মন কে বিদ্ধ করছিলো। রান্না ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে কুমুদ তাকে লক্ষ্য করছিলেন, এতো খুশির মুহূর্তেও বউয়ের ম্লান মুখ তাঁর নজর এড়ালো না।

এতো খুশির দিনে তোমার মুখ শুকনো কেনো মা গো!

কুমুদ এর দৃষ্টি লক্ষ্য করে সবার দৃষ্টিই মৃণালিনীর দিকে ঘুরল, নিজেকে সামলে নিয়ে অল্প হাসলো মৃণালিনী।

না মা, আমি খুব খুশি হয়েছি!

ঠিক সেই মুহূর্তেই বাড়ির কর্তা শ্যাম সুন্দর সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন, তাঁকে দেখেই উচ্ছসিত হলেন কুমুদ,

ও গো শুনছো! মেয়েদের ইস্কুল নাকি সরকারের সাহায্য পাবে!

বিরক্ত দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন শ্যাম সুন্দর, সঙ্গে সঙ্গেই আগের বারের তাঁর সঙ্গে ছেলের স্কুল নিয়ে করা চালাকিটা মনে পড়লো।

তা ভালো! তবে আগের বারের মতো এবার আর কোনো অজুহাতে আমার কাছে জমি চেয়ো না সৌম্য! আর এক কাঠা জমিও আমি দেবো না এখানে দাঁড়িয়েই বলে দিলাম!

সৌম্য হতাশ মুখে দোতলার বারান্দায় দাঁডিয়ে থাকা স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালো, বউয়ের ম্লান মুখ তার মনেও কষ্টের সঞ্চার করলো। তার খুব আশা ছিলো অন্য কারুর জন্যে না হলেও পুত্রবধূর মুখ চেয়ে তার বাবা জমি দেবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু শ্যাম সুন্দর বউ এর ইস্কুল করা কখনই সমর্থন করেন নি, তাই জমির অভাবে যে সরকারি সাহায্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই খবর তাঁকে যথেষ্টই পুলকিত করলো।

মৃণাল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তার শ্বশুর মশাই যে যথেষ্টই হিসাবী মানুষ সেটা সে জানতো। তার স্বামীর মতো ভুল ধারণা তার ছিলো না বলেই এতো আনন্দের সংবাদেও সে একটুও খুশি হতে পারেনি। এতদিন নিজের প্রয়োজনে তিনি মৃণালিনী কে ডেকেছেন এবং তার মতামত নিয়েছেন, কিন্তু তার বদলে যে মৃণালিনী কে তিনি জমি দেবেন সে বান্দা শ্যাম সুন্দর নয়। তিনি নিজের স্বার্থের বাইরে কবেই বা কাকে গুরুত্ব দিয়েছেন! তাঁর ইচ্ছা অনুসারেই এ বাড়ির প্রতিটা ব্যক্তি চলেছে এতদিন। তাঁর ইচ্ছের ওপরে কথা বলার ক্ষমতা তিনি কাউকে দেন নি। ইদানিং সেই ইচ্ছের বিরোধিতা তৈরি হচ্ছিলো মাঝে মাঝেই, আজ তাই নিজের হাতে সুযোগ পেয়ে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন তিনি।

দাঁড়াও ঠাকুর পো! কিচু কতা বলি তোমায়! দাদার সম্পত্তি তো কম দিন ভোগ দকল করলে নে! এবার ওকান তেকে বিঘা খানেক ইস্কুল কে লিকে দাও দিকি! মেয়েগুলো একটু ঠিক ভাবে বাঁচুক!

দোতলার সিড়ি দিয়ে ওপর দিকে উঠতে থাকা শ্যাম সুন্দর কে থামিয়ে দিলো বৌদির কড়া গলা, অবাক বিস্ময়ে তিনি পারুল বালার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বড়ো মা!

উচ্ছসিত হয়ে সৌম্য জড়িয়ে ধরলো পারুল বালা কে। অন্য কেউ হলে সব মাত্র স্নান করে আসা পারুল বালা কে জড়িয়ে ধরার ক্ষমতা কারুর ছিলো না, কিন্তু সৌম্য কে তিনি বরাবরই অন্য চোখে দেখেন। তাই তার ভাগ্যে শুধু মৃদু ধমক জুটলো,

আহ! দিলে তো বাছা ছুঁয়ে! এখন আবার নাইতে যেতে হবে!

মৃণাল একদৃষ্টে দোতলা থেকে তাকিয়ে ছিলো, তার ঝাপসা হয়ে আসা চোখে পারুল বালা যেনো অনেক দূরের মানুষ, যাকে ইচ্ছে করলেই ছুঁতে পারা যায় না।
ক্রমশ