মৃণালিনী পর্ব-৪৬

0
255

#মৃণালিনী
#পর্ব ৪৬
বৌদির কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেই যে দোতলায় উঠলেন, আর রাতে খেতেও নামলেন না শ্যাম সুন্দর। তাঁর মুখ ভারী হয়ে রইলো। এতদিনের ভোগ দখল করা সম্পত্তি, যার জন্যেই শুধু বৌদি কে বাপের বাড়ি যেতে না দিয়ে গিন্নি সাজিয়ে রাখা, সে যে এতো সহজে তাঁর হাতের বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে, এ তিনি কখনোই ভাবেন নি। এই সমস্ত কিছুর জন্যে তিনি মনে মনে বউমা কে দোষারোপ করতে লাগলেন। তাঁর অঙ্গুলি হেলনে চলা সংসারের ভিত যে তলায় তলায় নড়ে গেছে, তা তিনি টের পাচ্ছিলেন। তাঁর শিক্ষিতা বৌমার সঙ্গ যে অন্য দের মনেরও পরিবর্তন করে ফেলেছে কখন তা তিনি এতো বুদ্ধিমান হওয়া সত্বেও বুঝতে পারেন নি। এখন নিজের বুদ্ধিহীনতার জন্যে মনে মনে আফসোস করতে লাগলেন।

সৌম্য খেয়ে উঠে ওপরে চলে গেলো, বাড়ির কর্তার রাতে খেতে না আসায় মেয়েরা সবাই না খেয়ে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। করুণার আসন পেতে জলের গেলাস রাখা হয়ে গিয়েছিলো, বামুন দিদি ভাতের থালা সাজিয়ে রেখে তৈরি ছিলেন কিন্তু শ্যাম সুন্দর নিচে নামলেন না। শ্বশুর মশাইয়ের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে মৃণালিনী পারুল বালার খাবার নিয়ে তাঁর ঘরে উপস্থিত হয়। আজ শ্বশুর মশাই খেতে নামছেন না দেখে বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করে সে বড়ো মার খাবার নিয়ে পারুল বালার ঘরের দিকে যেতে উদ্যত হলো। তাকে খাবারের থালা হাতে তুলে নিতে দেখে বামুন দিদি আটকালেন, একটু সংশয়ের গলায় বললেন,

বউমা! বাবুর খাওয়া হয় নে একনো, কত্তা মা খাবেন নে! বাড়ির পুরুষ মানুষ না খেয়ে তাকলে, মেয়েরা কি খেতে পারে! ও থালা তুমি নিয়ে যেও নে!

কেউ যদি ইচ্ছে করে না খেয়ে থাকেন, তাহলে কি অন্যরাও না খেয়ে থাকবে? এতে পুরুষ মানুষ, মেয়ে মানুষের কি আছে? আজ পর্যন্ত তো কখনো আমাদের খাওয়ার জন্যে এ বাড়ির ছেলেরা অপেক্ষা করে নি। নিজেরা খেয়ে উঠে যাবার পরে আমরা খেলাম কিনা, জানতেও চায় নি কোনোদিন। বড়ো মার শরীর খারাপ, তাঁর বেশি রাত পর্যন্ত না খেয়ে থাকা উচিত নয়! বাবার আসার জন্যে অপেক্ষা করে আমি বড়ো মার শরীর আরো খারাপ হোক, সেটা চাই না!

গলা তুলে বেশ জোরেই বললো মৃণালিনী, তার কথা সম্ভবত দোতলায় শ্যাম সুন্দরের কানেও পৌঁছলো। পারুল বালার থালা গুছিয়ে মৃণাল হাতে তোলার আগেই, তিনি ওপর থেকে নেমে এসে নিজের আসনে বসলেন। বামুন দিদিও আর কথা বাড়ালেন না, মৃণাল থালা হাতে বড়ো মার ঘরে উপস্থিত হলো। পারুল বালা খাটে শুয়ে ছিলেন, বউমা কে থালা হাতে ঢুকতে দেখে উঠে বসলেন। প্রতিদিনের মতো তাঁর প্রথম প্রশ্ন ছিলো ওটাই,

ঠাকুর পোর খাওয়া হয়েচে?

মৃণাল মাথা নাড়লো,

নাহ! এখনও হয় নি, সবে খেতে বসেছেন।

তাইলে এট্টু পরে আনলে না কেনো?

শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন পারুল বালা, মৃণাল তাঁকে থামিয়ে দিলো।

বড়ো মা! আপনার শরীর খারাপ, এখন সময় দেখে খেতে হবে, কারোর জন্যে অপেক্ষা করা চলবে না। ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন। বাবার খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে অনেক দেরি হয়ে যাবে, আপনি শুরু করুন।

একটু ইতস্তত করে থালা হাতে তুলে নিলেন পারুল বালা, এই প্রথম বার দেওরের খাওয়া শেষ হবার আগেই তিনি নিজের খাবারের থালায় হাত দিলেন।

পরের দিন সকাল হতে না হতেই সুরেশ কে সঙ্গে নিয়ে বাবার কাছে উপস্থিত হলো সৌম্য, বড়মার সম্পত্তির অংশ থেকে ইস্কুলের জমির ভাগের দাবি নিয়ে। গম্ভীর মুখে জমি দানপত্রের ব্যবস্থা করতে লাগলেন শ্যাম সুন্দর, ছেলের সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটাও কথা বললেন না।

জমির দখল নিয়ে নতুন ইস্কুল গড়ার কাজ শুরু হলো। শরিকি জমিতে চলা ইস্কুলও প্রতিদিনই কলেবরে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, ওই টুকু জায়গায় অতো মেয়ের বসার মতো জায়গা আর ছিলো না। তাই ইস্কুলের নতুন বাড়ি তৈরি হবার জন্যে সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। দিন এগিয়ে চলেছিলো, মৃণালের পরীক্ষার সময় ক্রমশই এগিয়ে আসছিলো। অসুস্থ শরীরেই সে ইস্কুলের দেখাশোনার সঙ্গে সঙ্গে নিজের পড়াশুনাও চালিয়ে যাচ্ছিলো। পারুল বালার শরীরও ভালো যাচ্ছিলো না, প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন কোনো শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছিলো। ইতিমধ্যেই সরমাও কলকাতা থেকে বউ দিদির ইস্কুলের দায়িত্ব নিতে এসে গিয়েছিলো। দেখতে দেখতে কলকাতা যাবার দিন এগিয়ে এসেছিলো, বাড়ির বড়ো দের প্রণাম করে বিভা এবং সরমা র হাতে ইস্কুলের দায়িত্ব ছেড়ে কলকাতা যাবার জন্যে প্রস্তুত হলো মৃণালিনী।

যাবার দিন সকালে অসুস্থ শরীরেই পারুল বালা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন, কুমুদ প্রসাদী ফুল বউমার কপালে ছুঁইয়ে আশীর্বাদ করলেন। মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও যাওয়ার সময় কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না করেই বউমা কে আশীর্বাদ করলেন শ্যাম সুন্দরও, তাই মৃণালিনীর কলকাতা যাওয়া পর্ব নির্বিবাদেই মিটলো।

বড়ো মা, নিজের খেয়াল রাখবেন! ডাক্তারবাবুর কোনো কথা অমান্য করবেন না, ফিরে এসে যেনো আপনাকে সুস্থ হয়ে যেতে দেখি!

যাবার আগে পারুল বালার পায়ে হাত ছুঁইয়ে বললো মৃণালিনী, পারুল বালা স্মিত হাসলেন,

নতুন মানুষরে না দেকি যাবো নে! তোমার আসা পজ্জন্ত নিচ্ছই বেঁচে তাকবো মা গো।

মাস খানেক পরে পরীক্ষা পর্ব মিটলো, কিন্তু তার শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাওয়ার এখনও দেরি ছিলো। প্রসবের দিন ক্রমশই এগিয়ে আসছিলো, সৌম্যর প্রতি শনিবার বাড়ি যাওয়ার দৌলতে ইস্কুলের এবং বাড়ির খবর মৃণালের কানে পৌঁছতে লাগলো। বড়ো মার আরও বেশি অসুস্থতার খবর স্বামীর কাছ থেকেই শুনতে পাচ্ছিলো মৃণালিনী, কিন্তু তার যাওয়ার কোনো উপায় ছিলো না।

কিছুদিন পরে কলকাতার হাসপাতালে কন্যা সন্তানের মা হলো মৃণালিনী। রমণী বাবু মিষ্টি বিতরণ করলেন। সৌম্যর হাত দিয়ে বেয়াই বাড়ির উদ্যেশ্যে মিষ্টি দিয়ে পাঠালেন। সৌম্য যখন মেয়ে হবার সুখবর নিয়ে মিষ্টি হাতে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লো, তখন পারুল বালার এখন তখন অবস্থা।

শ্যাম সুন্দর নিচেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, পাশের গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার বাবু জবাব দিয়ে গেছেন বলে জানালেন। কুমুদ ছেলে কে দেখেই হাতের ইশারা করে ডাকলেন, বড়ো মার শারীরিক অবস্থার বাড়াবাড়ির কথা শুনেই, মায়ের হাতে মিষ্টির হাঁড়ি ধরিয়ে সে বড়ো মার ঘরে ছুটে গেলো।

বড়ো মা! তোমার শরীর এতো খারাপ হয়েছে! আর এখানে তোমাকে রাখা যাবে না! চলো তোমাকে কলকাতা নিয়ে যাই,

পারুল বালা মাথা নাড়লেন,

না বাছা! আমায় আর টানা হ্যাঁচড়া কোরো নে, এ আমার স্বামীর ভিটে! একানেই একটু শান্তিতে যেতে দাও! তার খপর বলো? শরীর গতিক ঠিক আচে তো?

সৌম্য মনের উদ্বেগ চেপে রেখেই হাসি মুখে মেয়ে হওয়ার খবর দিলো। পারুল বালা খুব খুশি হলেন, কুমুদ বেয়াই মশাইয়ের পাঠানো মিষ্টি রেকাবী তে এনে বড়ো জার সামনে রেখেছিলেন, সেটুকু খেতেও আপত্তি জানালেন না। মিষ্টি খেয়ে হাতের ইশারায় সৌম্য কে কাছে ডেকে বললেন,

তাদের এট্টু নে আসতে পারো? যাবার আগে তাদের দেকতে বড়ো মন চায়!

বড়ো মার এই কথাটুকুই যথেষ্ট ছিলো, সৌম্য আর একটুও দেরি করলো না। পরের দিন সকালে উঠেই সে গাড়ি নিয়ে কলকাতার উদ্যেশ্যে রওনা হলো। মৃণাল সদ্যোজাত কন্যা নিয়ে মাত্র দুদিন আগেই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছিল, তাই তার এই অবস্থায় শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার কথায় বামুন দিদি আপত্তি জানালেন। জন্মের প্রায় পরেই মাতৃহীন মৃণালের তিনি প্রায় অভিভাবিকা ছিলেন, তাঁর কথায় যথেষ্টই জোর ছিলো। কিন্তু রমণী বাবু শুনলেন না, তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়েই সৌম্যর সঙ্গে মৃণাল কে শ্বশুর বাড়ির উদ্যেশ্যে রওয়ানা করিয়ে দিলেন।

গাড়িতে সারা সময় উদ্বেগে ছট ফট করতে লাগলো মৃণালিনী। তারা যখন সারা দিনের দীর্ঘ যাত্রার পরে বাড়ির দরজায় পা দিলো, তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে। গাড়ির আওয়াজে হারু ছুটে এসে দরজা খুললো, মেয়ে কে শাশুড়ির কোলে দিয়েই প্রায় ছুটে বড়ো মার ঘরের দরজায় উপস্থিত হলো মৃণালিনী। বড়ো মার অনুমতি নেবার আজ আর প্রয়োজন ছিলো না, শুয়ে থাকা বড়ো মার কাছে গিয়ে মৃদু গলায় ডাকলো মৃণালিনী,

বড়ো মা! আমায় দেখতে চেয়েছিলেন!

বন্ধ চোখ অনেক কষ্টে খুলে তাকালেন পারুল বালা, মাথা নেড়ে বললেন,

হ্যাঁ,সেই কবে তে খুঁজচি! কিন্তু সে কই! তারেও যে দেকতে ইচ্ছে করে গো!! তার জিনিস যে আমার কাচে রয়ে গেচে! তারে না দে তো শান্তি তে মরতেও পারবো নে!

কুমুদ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন, কোলে রাখা একরত্তি নাতনি কে বড়ো জায়ের সামনে তুলে ধরলেন। হাত বাড়িয়ে ইশারা করে সৌম্য কে নিজের গয়নার পুঁটলি এনে দিতে বললেন পারুল বালা, সৌম্য ছুটে আলমারি থেকে বড়মার গয়নার পুঁটলি এনে দিলো। বামুন দিদি ওখানেই বসে ছিলেন, গয়নার পুঁটলি কত্তা মা র হাতের সামনে এগিয়ে দিলেন। পুঁটলিটা নাতনির হাতে ছুঁইয়ে মৃণালের হাতে তুলে দিলেন পারুল বালা,

তুমি যকন ইস্কুলের স্বপন দেকেছিলে, তকন আমি ছিলুম। তাই তোমায় জমি দে যেতে পেরেছিলুম! এ যকন কিচু স্বপন দেকবে, তকন আমি থাকবো নে! যেনো ট্যাকার জন্যে তার কিচু আটকে না যায়! তাই এগুলো তার জন্যে রেকে গেলুম তোমার কাচে। এ কিন্তু তার, সে যকন চাইবে, তার হাতে তুলে দেবে।

বড়ো মা!

মৃণালিনীর চোখ জলে পরিপূর্ন হয়ে উঠলো। পারুল বালা চোখ বন্ধ করলেন, আর খুললেন না। তিনি যেনো মৃণালের আসার অপেক্ষাতেই ছিলেন! কুমুদ মুখে আঁচল চাপা দিলেন, বামুন দিদি তাড়াতাড়ি সৌম্যর দিকে গঙ্গাজলের ঘটি এগিয়ে দিলেন,

এট্টু মুকে জল দাও বাবা!

সৌম্যর দেওয়া গঙ্গাজল ভেতরে গেলোনা, পারুল বালার বন্ধ ঠোঁটের ধার দিয়ে গড়িয়ে পড়লো।
ক্রমশ