রাগে অনুরাগে পর্ব-০৪

0
3102

#রাগে_অনুরাগে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব-০৪
.

কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। সানাফ ভাইকে সেদিনের জন্য মন থেকে আমি ক্ষমা করতে পারিনি। আবার আমার প্রতিজ্ঞাও রক্ষা করতে পারিনি। উনার কাছে ফের পড়তেও হয়েছিলো। তবে, সেদিনের পর থেকে উনিও কেমন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। চুপচাপ আসতেন, পড়াতেন, ব্যস চলে যেতেন। আমার আর সপ্তাখানেক পরেই ফাইনাল এক্সাম। সানাফ ভাই আজকেই শেষ পড়াবেন আমাকে। এরপর এক্সামের প্রিপ্রারেশন। আব্বুও দেশে এসেছেন গত সপ্তাহে। আমার এক্সাম এবং বিয়ের জন্য।

রোজকার সময়ে সানাফ ভাই এসে উপস্থিত হলেন আমার রুমে। আমিও মনোযোগ সহকারে কিছু ম্যাথ সলভ করছিলাম। বেখেয়ালে আমার ঘোমটা পড়ে যায়। আর সেই সাথে ওড়নাটাও খানিকটা গলার পাশ থেকে সরে যায়। সানাফ ভাই চেয়ার টেনে বসেই বললেন,

‘নিধি, তুই আমায় খুন করতে চাস?’

আমি চকিতে তাকালাম। অস্পষ্ট স্বরে বললাম,
‘মানে?’

উনি লোভাতুর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন,
‘খুন করার জন্যই গলার নিচ বরাবর তিলটাকে দেখিয়ে রেখেছিস, না রে?’

উনার কথাশুনে আমার শ্বাস বন্ধ যাওয়ার উপক্রম। তাড়াতাড়ি ওড়নাটা ঠিক করে দিয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম। নিঃশ্বাস এলোমেলো আমার। বুকের ভেতর মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। আমি নিশ্চুপ! সানাফ ভাই এখনো আমার দিকে ঝুঁকে আছেন। মনে হচ্ছে, চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে আমায়।

এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে কী করা উচিত? জানা নেই আমার। আমি দু’হাত কচলাতে লাগলাম। চোখেমুখে আমার লজ্জার আভা ফুটে উঠেছে। সানাফ ভাই আরেকটু ঝুঁকলেন।
লোকটা করতে চাইছে কী? মনে মনে আওড়ালাম। দৃষ্টি উনার অস্থির।

উনি ফিসফিস করে বললেন,
‘তুই আগের থেকেও বেশি সুন্দর হয়ে গেছিস, জানিস?’

আমি এবার কাচুমাচু হয়ে বসলাম। বেশি নড়াচড়া করার ফলে কপালে কয়েকগাছি চুল এসে পড়েছে আমার। উনি সেগুলো কানের পাশে গুজে দিতে দিতে বললেন,
‘তোর এই অবাধ্য চুলগুলোর মতোন আমিও তোর প্রেমে অবাধ্য হয়ে উঠেছি। ইচ্ছে করছে তোর ভালোবাসায় ডুবতে ডুবতে হারিয়ে ফেলি নিজেকেই; তোকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নিই। নিধি তুই শুধু আমার। শুধুই আমার। তোর মনে প্রাণে শুধু আমিই বিচরণ করবো। শুধু আমিই!’

উনার বলা প্রতিটা শব্দে আমার সর্বাঙ্গে শিহরণ সৃষ্টি করছে। ছিঃ কী নির্লজ্জ লোকটা! সরাসরি কেউ এসব কথা বলে? উনি বুঝতে পারছেন না একটা মেয়ের কাছে এসব কথা শোনা কতোটা লজ্জাজনক।
মুহুর্তের মধ্যেই আমার বুকের ভিতর ঢিপঢিপ শব্দটা তরঙ্গ আকারে বাড়তে লাগলো। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে।

সানাফ ভাই আমার অবস্থা বুঝতে পারলেন কি না জানি না; তবে সরে আসলেন আমার কাছ থেকে। তারপর বই হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ এক ধ্যানে সেদিকেই তাকিয়ে রইলেন। মাঝের এই কিছুক্ষণ সময়ে আমি নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিছুটা সামলেও নিলাম।
পড়া শেষ করার সময় বললেন,

‘আমি আগামী একমাস আসবো না। আমি আসলে তুই অস্বাভাবিক হয়ে যাস। আর পরীক্ষার সময় তোকে অস্বাভাবিক করতে আমি মোটেও ইচ্ছুক নই। তুই ভালো করে পরীক্ষা দিবি। যাতে ভালো কোনো ভার্সিটিতে চান্স পাস। বুঝলি?’

ভার্সিটির কথা শুনে আমি ঠোঁট উলটে বললাম,
‘বিয়ের পর আমি আর পড়বো না। তাই ফেইল করলেও কোনো অসুবিধে নেই।’

সানাফ ভাই আমার মুখে এমন কথা শুনে চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে তাকালেন। বললেন,
‘বিয়ের পর পড়বি না মানে?’

‘তো পড়ার জন্য বিয়ে করছি না কি? বিয়ের পর চুটিয়ে সংসার করবো। ব্যস এতেই হবে। আর এমনিতেও আমার পড়াশোনা ভালো লাগে না। সেটা তো আপনি জানেনই। টেনেটুনে পাশ করি। আর এতো পড়ে কী করবো? চাকরি তো আর করতে দিবেন না আপনি।’

‘কানের নিচে একটা দিবো। চাকরি করতে দিবো না বলে আর পড়ালেখাই করবিনা? আর পড়ালেখা কি মানুষ শুধু চাকরির জন্যই করে? স্বশিক্ষিত হওয়ার জন্যও মানুষ পড়াশোনা করে। আর তুই যদি মনে করিস ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলেই তুই স্বশিক্ষিত হয়ে যাবি সেটা ভুল। আমি তো ইন্টারমিডিয়েট পাশ করাকে পড়ালেখার প্রাথমিক লেভেল মনে করি। এরপর আরো পড়তে হবে। স্টাডির সবকটা লেভেল তোকে পার করতে হবে। আর তুই স্বশিক্ষিত হতে চাইতে নাই পারিস, তবুও আমার সন্তানদের জন্য হলেও তোকে স্বশিক্ষিত হতে হবে।’
উনি ধমক দিয়ে কথাগুলো বললেন।

আমি চেঁচিয়ে বললাম,
‘আমি পারবো না বিয়ের পর আর পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে। পড়ালেখা করার হলে তো আমি বাড়িতে থেকেই পড়ালেখা করতে পারতাম। শুধু এই পড়ালেখার প্যারার থেকে বাঁচার জন্যই বিয়ে নামক প্যারায় রাজি হয়েছি। ধ্যাৎ! মুডটাই নষ্ট করে দিলেন।’

‘তুই পড়বি, তোর জামাইও পড়বে।’

‘সে আপনি পড়েন, আমার কী? আমি পড়বো না।’

‘নিধি, রাগ উঠাস না আমার। তাহলে মার খাবি।’

‘হ্যাঁ, আপনি তো শুধু মারতেই পারেন। এই কাজটা করার জন্যই তো বিয়ে করতে চাইছেন।’
অভিমানী কন্ঠে বললাম।

সানাফ ভাই এতোক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমিও বেডের পাশ থেকে সরে এসে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। উনি আচমকা হেঁচকা টান দিয়ে আমাকে নিজের দিকে টেনে নিলেন। তারপর আমার নাকে হালকা টোকা দিয়ে বললেন,
‘সব অভিমান বাসর রাতে ভেঙে দিবো। আপাতত তুই পরীক্ষায় মন দে।’

আমি উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌঁড়ে পালালাম রুম থেকে। সানাফ ভাই হয়তো পিছু ডেকেছেন। তবে সেই শব্দ আমার কান অবধি পৌঁছেনি। উনি হয়তো আমাকে এমন লজ্জাজনক কথাবার্তা বলে বেশ মজা পান। নিশ্চয়ই মজা পান, সেই কারণেই তো বারংবার আমায় এমন লজ্জা দেন। অসভ্য লোক একটা। চরম অসভ্য!

_________
আর মাত্র দু’টো পরীক্ষা বাকি আছে। এরপরেই বিয়ের তোরজোড় শুরু হবে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুইদিন পরেই বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে। এতো তাড়াহুড়ো করার একটাই কারণ; আব্বুর ছুটি শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহ বাকি। আর আব্বু চান আমার বিয়ের পর মেয়ে জামাইকে নিয়ে কিছুটা দিন একসাথে কাটাবেন। আর সানাফ ভাইও খুব একটা দেরি করতে চান না। বিয়ের ছয়মাস পর উনাকে দেশের বাহিরে যেতে হবে কোম্পানির কাজে। এক বছর ফিরবেন দেশে। তাই উনি চাচ্ছেন বিদেশ যাওয়ার অন্তত ছয় মাস আগে বিয়েটা করে যেতে।

আজ সানাফ ভাইয়ের বাড়ি থেকে লোক আসবেন। আমার জন্য না কি হাতের বালা বানাবেন, সেটারই মাপ নিতে। বিকেলেই আসার কথা উনাদের। আমি পরীক্ষা দিয়ে এসে সবে ফ্রেশ হয়েছি। এমন সময় আপু এসে খবরটা দিলো আমায়।

ঘুমানো দরকার খানিকটা সময়। কিন্তু সানাফ ভাইয়ের আম্মু আসবেন শুনে আর ঘুমালাম না। হাতের টুকটাক কাজ সেরে নিতেই উনারা চলে আসলেন। সানাফ ভাইও এসেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে কেমন মিটমিট করে হাসছেন। মনে হচ্ছে, আমি কোনো সার্কাসের জোকার। রাগ হচ্ছে আমার খুব। উঠে চলে আসলাম উনার সামনে থেকে।

কাল পরীক্ষা আছে। দরজা লাগিয়ে পড়ছিলাম। বেশ কিছুক্ষন আগেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সানাফ ভাইরা এখনো আমাদের বাসায়। হয়তো ডিনার করেই ফিরবেন।

এর মধ্যে আমার মোবাইলে একটা মেসেজ এসেছে। সানাফ ভাই লিখেছেন,
‘নিধি, আজকের আকাশটা দেখেছিস? দেখিসনি আমি জানি। জানিস, আজকের চাঁদটা ঠিক তোর মতোন সুন্দর। আচ্ছা নিধি, চাঁদটা তোর মতো সুন্দর না কি তুই চাঁদের মতো সুন্দরী? কোনটা? আমার কিন্তু বেশ গুলিয়ে যাচ্ছে।
যাকগে, চাঁদ আর তুই একই রকম। আমি তো চাঁদটাকে ছুঁতে পারবো না, কিন্তু তোকে ঠিকই ছুঁতে পারবো। ছুঁয়ে একদম তোকে নিজের করে নিবো।’

উনার মেসেজটা দেখেই আমার নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুঁটে উঠলো। মানুষটা এতো পাগল কেন? মাঝে মাঝে উনার এসব পাগলামি সত্যিই বিমোহিত করে আমায়।

মেসেজটা পড়া মাত্রই ফোনে আরেকটা মেসেজ আসলো। তবে সেটা আননোউন নাম্বার থেকে।
‘নিধি, একটু ছাদে আসো তো।’

মেসেজটা দেখে আমার খটকা লাগতে আরম্ভ করলো। সানাফ ভাই তো আমাকে ‘তুই’ ছাড়া সম্বোধন করে না। আর এটা সানাফ ভাইয়ের নাম্বারও না। তাহলে এ অসময়ে আমায় ছাদে ডাকলো কে?

অর্ণব? হ্যাঁ অর্ণব তো প্রায় মাঝে মাঝেই আমাকে তুমি ডাকে। কিন্তু অর্ণব এই সময়ে এখানে কেন? তাহলে ও কি সানাফ ভাইকে আমাদের বাসায় দেখে ছাদে চলে গেছে। আর কোনো বিশেষ দরকার ছাড়া তো ওর এসময়ে আসার কথা না। আমি সাত-পাঁচ না ভেবে ফোন দিলাম নাম্বারটায়। কিন্তু নাম্বারটা সুইচ অফ করে দিয়েছে। আশ্চর্য! মাত্রই তো মেসেজ আসলো।

চিন্তা হচ্ছে খুব। আর সময় নষ্ট না করে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম। ছাদের দরজার সামনে যেতেই কেউ একজন আমার দু’হাত ধরে টান দিয়ে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। আমিও আচমকা তাল সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়লাম তার বুকে।
মানুষটার শরীরের গন্ধ আমার খুব চেনা। হ্যাঁ, এই মানুষ আমার অপরিচিত কেউ নয়। ওকে চিনি আমি। খুব করে চিনি!

.
(চলবে…)