রাগে অনুরাগে পর্ব-০৫

0
2613

#রাগে_অনুরাগে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব-০৫
.

আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম,
‘সানাফ ভাই!’
উনি আমার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বললেন,
‘চুপ করে থাক। কোনো কথা নয়।’
ক্ষণকাল দু’জনেই নীরব রইলাম। দু’জনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। আমার হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। ঠোঁটগুলো কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। উনি উনার পকেট থেকে কালো কাপড় বের করলেন। তারপর আমার চোখ বেঁধে দিয়ে ছাদের মাঝ বরাবর নিয়ে গেলেন।
আমি নিচু গলায় বললাম,
‘কী করছেন? চোখের বাঁধনটা খুলুন। এভাবে কেউ আমাদের দেখে নিলে ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না।’

আমার কথার জবানে সানাফ ভাই টু শব্দটিও করলেন না। কিছুক্ষন পর নিজেই চোখের বাঁধন খুলে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। চারদিকে তাকিয়ে আমি বিস্মিত হয়ে যাই। উনি হাতে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে আমায় ইঙ্গিত করে বললেন,
‘নিধি, এই ভালোবাসার লাল গোলাপগুলো শুধুই তোর জন্য এনেছি আমি। দেখ্, এই রাতের আকাশের চাঁদ, তারাদের সাক্ষী রেখে আমি তোকে প্রেম নিবেদন করছি। গ্রহণ করবি না তুই আমার এই আয়োজন?’

এ বলেই উনি উনার হাতের একগুচ্ছ গোলাপ আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি তখনও বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমার চারপাশে হাজারটা মোমবাতি জ্বলছে। সাথে এমনভাবে উনি আমায় প্রেম নিবেদন করছেন। সবটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছিলো। আমি বাকরুদ্ধ, হতভম্ব।

সানাফ ভাই আবার বললেন,
‘কীরে আমায় গ্রহন করবি না?’

এবার আমার হুশ ফিরলো। কন্ঠে লাজুকতা এনে বললাম,
‘আপনাকে গ্রহণ করা ছাড়া আমার আর বিকল্প কোনো পথ নেই। দু’দিন পর আপনিই আমার সব হবেন। আমার ভালো-মন্দের সব কিছু যেমন আপনার দায়িত্বে থাকবে। তেমন আপনার ভালো-মন্দের সব কিছুর দায়িত্বও আমাকে নিতে হবে।’

কথাগুলো বলেই উনার হাত থেকে ফুল গুলো নিলাম। চাঁদের আলোয় চারদিক ফকফকা। সানাফ ভাইকে এতোদিন মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও আজ কেন জানি না মেনে পারলাম না। উনার মুখের দিকে তাকালাম। উনি নীল দিগন্তে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। হয়তো কিছু ভাবছেন। লোকটা সত্যিই অদ্ভুত!

মাঝেমাঝে আমি উনাকে বুঝে উঠতে পারি না। এমন গম্ভীর ধরনের মানুষটাও যে এমন করে ভালোবাসতে পারে, আমার জানা ছিলো না। টুপ করে আমার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। এ কান্না কীসের জন্য, তা উপলব্ধি হলো না। হয়তো এই প্রথমবারের মতো সানাফ ভাইকে মন থেকে মেনে নেওয়ার আনন্দ থেকেই এই অশ্রু ঝরেছে। কে জানে!

আমি ধীর পায়ে সানাফ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। শীতল কন্ঠে বললাম,
‘সানাফ ভাই!’

উনি ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘শোন্ নিধি, এসব প্রেম নিবেদন দেখে আবার আমার মাথায় চড়ে বসিস না। এগুলো জাস্ট ফরমালিটি। আমার বন্ধুদের পাল্লায় পরে করেছি। শালারা আমায় চ্যালেঞ্জ দিয়েছে আমার মতো গম্ভীর ছেলে না কি প্রেম নিবেদন করতে পারবে না। আর করলেও না কি সেটা তুই গ্রহণ করবি না। চ্যালেঞ্জে আমি জিতে গেছি। এবার দশ প্যাকেট গোল্ড লিফ নিবো শালাদের থেকে।’

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই উনি প্যাকেট থেকে এক সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে নিলেন।

উনার কথা শুনে আমি আরেক দফা অবাক হলাম। রাগে আমার সর্বাঙ্গে আগুন ধরে গেলো। সিগারেটের ধোঁয়াতে আমি কাশতে আরম্ভ করলাম। তাও উনি সিগারেট ফেললেন না। আমি আর সইতে না পেরে নিজেই উনার হাত সিগারেট কেড়ে নিলাম। তারপর তা ছুড়ে মারলাম নিচে।

চেঁচিয়ে বললাম,
‘আপনি মানুষ হবেন না, না? এভাবে আমার ইমোশন নিয়ে খেললেন কেন? আমি কি বলেছিলাম আমায় এভাবে প্রপোজ করতে? আর যখন করলেনই, তবে সেটার আমেজটা এভাবে নষ্ট করলেন কেন?’

কথাগুলো বলতে বলতেই উনার পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলাম আমি।

উনি ধমক দিয়ে বললেন,
‘নিধি, শান্ত হো। তুই এতো গুন্ডি, এটা তো আমার জানা ছিলো না।’

উনার কথার পিঠে আমি আরো জোর গলায় বললাম,
‘এখন জেনে নিয়েছেন তো আমি গুন্ডি? ব্যস এতেই হলো। এরপর থেকে আমার দু’চোখের সামনে আর আসবেন না।’

‘আমি একশো বার আমার বউয়ের চোখের সামনে আসবো। তাতে তোর কী?’

‘আমারই সব। বদ লোক একটা। একদম খুন করে ফেলবো আপনাকে।’

রাগে আমার মুখ দিয়ে যা আসছিলো, তাই বলে যাচ্ছিলাম অনবরত। আর এদিকে আমার এই অবস্থা দেখে সানাফ ভাই হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছিলেন।
কেমন ইতর লোক হলে এভাবে রোমাঞ্চকর মুহুর্ত নষ্ট করে দিতে পারেন, ভেবেই আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিলো। আর আমি কিনা এই লোকটার এসব কথাকে পাত্তা দিচ্ছিলাম! ধুর থাকবোই না উনার সামনে। হনহনিয়ে চলে আসলাম বাসায়। আমার মেজাজের বারোটা বাজিয়ে অসভ্য লোকটা হেসেই যাচ্ছিলেন। আজব!

__________
কাকভোরে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। আজকেই শেষ পরীক্ষা। তাড়াতাড়ি করে বইয়ে চোখ বুলিয়ে নিলাম। এই পরীক্ষাটা শেষ হলেই বাঁচি। এক মাস একটা প্যারায় ছিলাম। দু’দিন থেকে সানাফ ভাইয়ের ফোন রিসিভ করি না। বেচারা ফোন দিতে দিতে নাজেহাল। মেসেজও দিয়েছিলেন কয়েকটা। সেগুলো দেখে আরো চটে গেছি আমি। সরি বলার নাম-গন্ধ নেই; উনি আমাকে ক্ষ্যাপাতে ব্যস্ত। এমন লোকের সাথে আমি সারাটা জীবন কাটাবো কী করে? হায় আল্লাহ!

পড়তে বসেও এসব ভেবে যাচ্ছিলাম। ধ্যান ভাঙলো আপুর ডাকে,
‘এই নিধি? কী ভাবছিস তুই?’

আমি বই বন্ধ করে টেবিলের উপর মাথা রেখে বললাম,
‘আপু বিয়েটা ভেঙে দেওয়া যায় না? আমি ঐ অসভ্য লোকের সাথে সংসার করতে পারবো না রে।’

আপু চমকে তাকালো আমার দিকে। অবাক কন্ঠে বললো,
‘কী বলছিস তুই এসব? বিয়ের মাত্র দু’দিন বাকি আর এখন তুই এমন কথা বলছিস! আর সানাফ তো বেশ ভালো ছেলে। ওকে অসভ্য বলছিস কেন?’

‘তুই আর কী বুঝবি আমার জ্বালা। লোকটা সারা দুনিয়ার সামনে ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকে। শুধু আমিই চিনি তাকে, কেমন উনি।’

বিড়বিড় করে বললাম।
আপু আমায় ধাক্কা দিয়ে বললো,
‘এই তুই কী এমন বিড়বিড় করছিস? স্পষ্ট করে বল্। সানাফের সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে?’

আমি মাথা উঠিয়ে বললাম,
‘নাহ, কিচ্ছু হয়নি। কেন ডেকেছিস সেটা বল্?’

আপু আমার কথায় সন্তুষ্ট হলো, সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝলাম। হাসিমুখে বললো,
‘শোন্, আজ তো তোর লাস্ট এক্সাম। তাই কাল শপিংয়ে যাবো ভাবছি। কী বলিস তুই?’

আপুর কথাটাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে বললাম,
‘তোদের ইচ্ছে।’

আমার উত্তরে বেচারির মুখটা একেবারে চুপসে গেলো। ওর এমন মুখ দেখে আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। তারপর আবার বললাম,
‘আচ্ছা ঠিক আছে কালই শপিংয়ে যাবো। হ্যাপি?’

আপু আমার হাতের উপর হাত রেখে খুশিতে গদগদ হয়ে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলো। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেগুলোর সাথে তাল মিলালাম।

আপু রুম থেকে বের হওয়ার সময় বললো,
‘নিধি, সানাফ তোর জন্য চকলেট পাঠিয়েছে। তোর আলমারিতে রেখেছি। সাথে একটা চিরকুট। অবশ্য সেটা আমি পড়িনি। তুই পড়ে নিস।’

‘চকলেট গুলো তুই রাস্তায় ফেলে না দিয়ে আমার আলমারিতে কেন রেখেছিস আপু?’

‘নিধি, বাড়াবাড়ি না করে খেয়ে নিস ওগুলো। আমি যাই তোর দুলাভাই ডাকছে।’
ধমক দিয়ে আপু কথাটা বললো।

‘ধুর! খাবো না ওগুলো আর চিরকুট ও দেখবো না আমি।’
দাঁত কিড়মিড়য়ে বললাম।

এমন সময় মিলির গলা পেলাম ড্রইংরুমে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম নয়টার উপরে বাজে। তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নিলাম। তারপর মিলির সাথে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় মিলি আমায় কিছু কৌশল শিখিয়ে দিলো সানাফ ভাইয়কে নাজেহাল করার। কৌশলগুলো জানার পর আমি বড্ড বেশি খুশি হলাম। পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পেলেও হয়তো এমন খুশি হবো না।

‘সানাফ ভাই, এবার আপনি টের পাবেন, নিধি কোন ঝাঁঝের মরিচ!’
আহা, ইচ্ছে করছে মিলিকে কলিজার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলি। উৎফুল্ল কন্ঠে বললাম,
‘মিলি, আজকে তোকে ডাবল ট্রিট দিবো। চল্ আগে মনের আনন্দের সহিত পরীক্ষাটা দিয়ে নিই।’

.
(চলবে…)