লালগোলাপ❤
Part-01+2
Writer-Moon Hossain
“ছেলেটা পাগল!শুধু পাগল বললে ভুল হবে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় এমন পাগল।দুটো কাজের লোক মাডার করেছে ছেলেটা এমন ভাসা ভাসা খবরও শোনা যায় লোকের কাছ থেকে। এখন মেন্টাল হসপিটাল থেকে বিয়ের জন্য ছুটি নিয়ে এসেছে।
” মা দরজা খুলে দাও। ”
– যদি প্রধানমন্ত্রী বললেও খুলব না।
– মা কথা শোন।নিজের ক্ষতি করোনা। তুমি তো পর্দাশীল ধার্মিক মেয়ে,আত্মহত্যা মহা পাপ সেটা তো জানো? নাকি জানো না?
– আমি আত্মহত্যা করতে চাইনা। তুমি আমাকে বাধ্য করছো। আমার প্রতি তোমার কোন মায়া মমতা নেই।
-কি বলছো মা? তুমি আমার চোখের মনি। তোমরা দুই বোন আমার জীবন।
ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে না। কিছু করে বসলো নাতো? হাজী কাশেম আলী মেয়ের জন্য বিয়ে ঠিক করেছেন। শুক্রবার দুপুরে বিয়ে পরানো হবে। উনি নিতান্ত একজন সহজ সরল মানুষ। একবার হজ্জ করেও এসেছে। গ্রামের কলেজের ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক।ছাতা নিয়ে মাথা নিচু করে কলেজে যায় ঠিক সময়ে ক্লাস নিয়ে আবার ঠিক সময়ে চলে আসেন। গ্রামে যথেষ্ট সুনাম আছে।দুই মেয়ের জন্য সুনাম টা একটু বেশি আছে। রুপে গুনে অনন্য উনার মেয়েরা।
উনার সরলতা কে কাজে লাগিয়ে পাগল ছেলের জন্য বড় মেয়ে কোমলের বিয়ে ব্যপারটা কৌশলে ঠিক করা হয়েছে।
কলেজের প্রিন্সিপাল বিয়ের ঘটক। প্রিন্সিপালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছেলের বাবা। হাজী কাশেম আলী জানতেন না ছেলেটা পাগল।
প্রিন্সিপাল কে অনেক বছর যাবৎ চেনেন উনি। উনার দুই মেয়ে কে নিজের মেয়ে মনে করেন প্রিন্সিপাল। সব সময় প্রিন্সিপাল বলতেন –
-ভাই সাহেব আপনার দুই মেয়ে আমার মেয়ে।
ওদের নিয়ে টেনশন করবেন না। দেখে শুনে বিয়ে দেব। নাকে তেল দিয়ে ঘুমান।
-জি আল্লাহ ভরসা!
একদিন প্রিন্সিপাল খুশি মুখ করে বললেন বড় ঘরের সুপাত্র হাতে এসেছে। বড় মেয়ে কোমলের সাথে খুব মানাবে।
হাজী কাশেম আলী ছেলের বাড়িতে দুই একবার গিয়েছিলেন। বিশাল বাড়ি। দেখে মনে হয়েছিলো আস্তো একটা রাজপ্রাসাদ।ছেলেকে দেখে তিনি খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। দেখতে রাজপুত্র। তবে একটা খটকা লেগেছিলো ছেলেটা একদম চুপচাপ ছিল। একটা কথাও বলেনি৷ সালাম বা সালামের উওর পর্যন্ত দেয়নি।
বাড়িতে খুব হৈচৈ পড়ে যায় কোমল কে নিয়ে। গ্রামেও বেশ হৈচৈ শুরু হয় এতো বড় ঘরে কোমলের বিয়ে হবে বলে।
বিয়ের আর দু’দিন বাকি। পুরো বাড়ি জুড়ে মেহমানে ভর্তি।
পাড়া প্রতিবেশীরা হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা চিৎকার চেচামেচি করে বিয়ে বাড়িটা কে আরও রমরমা করে ফেলেছে। বাবর্চিরা বাড়ির বৈঠক খানার সামনে বিশাল বিশাল হাড়িতে রান্না বসিয়েছে। দুটো কারিগর আলাদা করে মেহমানদের জন্য গরম গরম জিলিপি, মিস্টি বানিয়ে পরিবেশন করছে। বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা তাই হাজী কাশেম আলী একটা হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়েছেন। ব্যাংকে যা ছিলো তা সবটাই বিয়ের খরচে লাগিয়ে দিয়েছে।
উনার স্ত্রী শায়লা বেগম বলল- সবকিছু এক মেয়ের পেছনে ঢেলে দেওয়া ঠিক হবে? ছোট মেয়ের কথা ভাবতে হবে না?
– কি যে বলো! সবকিছুর আল্লাহ তায়ালা মালিক।
-তাই বলে অন্য মেয়েকে বঞ্চিত করবে? ওর তো মন খারাপ হবে।
-আমার ছোট মায়ের মন বিশাল বড়। ওর সাথে আলোচনা করেই তো সিদ্ধান্ত নিলাম। ও আমাকে সবার চেয়ে বুঝতে পারে।
পাড়ার মহিলারা মুখ ভরে পান খেয়ে এক জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে আলোচনা করছে ছেলেরা কত পয়সাওয়ালা। “এতো সুখ কি মেয়ের কপালে সইবে? হা! হা! হা! করে হাসতে হাসতে সবাই গড়িয়ে পড়ছে।
ঠিক এই সময় ছেলে পাগল এই ঘটনার জানাজানি হয়। যে সে পাগল না একেবারে খাতায় কলমে পাবনার পাগল।শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় দিনরাত। দুটো মাডার করে বাড়ির আঙিনায় পুঁতে ফেলা হয়েছে এসব খবরও নাকি অনেকটা সত্যি।
এই খবর শুনে কোমলের বাবার মাথায় বাজ পড়ে সেই সাথে প্রিন্সিপালের। তিনিও নাকি বিষয়টা জানতেন না৷
-সুন্দর আপা মনি আপনার জামা টা তো খুব সুন্দর।
– যেতে দিন।
একি হাত দিচ্ছেন কেন? পাগল লোকটা শীতলের পেছন দিক থেকে অনেকটা জামা ছিঁড়ে ফেলে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো।
শীতল কাঁদতে কাদঁতে বাড়ি ফিরেছিলো। ক্লাস ফাইভের ঘটনা আবারও সপ্ন দেখে ভয়ে শীতল ঘুম থেকে উঠলো।শীতলের এতো ভয় লেগেছে যে সারা শরীর অসার হয়ে ঘামে চটচট করছে। ওর অনেকটা পাগল ভীতি আছে। শীতল যখন নাইনে পড়ে তখন স্কুলের সামনে এক পাগল দাড়িয়ে থাকত কোর্ট টাই পড়ে।
-আপা মনি কি খবর?
-আলহামদুলিল্লাহ।
-আপা মনি একটা ম্যাজিক দেখবেন?
-না।
-আরে দেখেন, বলেই পাগলটা নিজের লুঙ্গি খুলে ফেলে দিয়ে মুখ ভেঙাতে লাগলো। শীতল হতভম্ব! এক চিৎকারে জ্ঞান হারিয়ে ছিলো সেদিন। এরপর থেকে শীতলের পাগল ভীতি খুব। বাবার হাত ধরে স্কুল, কলেজ পার করছে সে।
শীতল টেবিলে অনেক গুলো শাপলা ফুল দেখতে পেলো। তার খালাতো ভাই আব্দুল কাদির এনেছে। ছেলেটা তাকে চোখে হারায়। কলেজের সামনে বিশাল যে পুকুর সেখানে ফুটেছিলো।
-ভাইয়া দেখ কি সুন্দর শাপলা।
-তোর লাগবে?
-না, এমনিই বলেছি।
এই, এই কি করছো। একটু পর তোমার চাকরির ইন্টারভিউ।
আব্দুল কাদির সাতার কেটে ভিজে সপসপে হয়ে শাপলা ফুল গুলো শীতলের জন্য এনে দিলো।
একবার শীতের রাতে সারা রাত দাঁড়িয়ে ছিলো শীতলের রাগ ভাঙানোর জন্য। শীতলের হাত ধরাতে শীতল খুব রাগ করেছিলো। কান ধরে কনকনে শীতে ওঠবস করেছিলো।
আবদুল কাদিরের বাবা মা শীতল কে খুব পছন্দ করে তাই ছেলের পছন্দ মতো শীতলের সাথে বিয়ে ঠিক করে। কোমলের বিয়ের পর ওদের বিয়ে হবে।
কোমল ছেলে পাগল শুনে দরজা বন্ধ করে দেয় ভেতর থেকে। গায়ে কেরাসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় যদি বিয়ে না ভাঙে।
-মা দরজা খোল।
আত্মহত্যা মহাপাপ। নিজেকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিয়ো না। আল্লাহ তায়ালা যা করেন ভালোর জন্য করেন।
আমি তো জানতাম না ছেলেটা এমন। জানলে এতোদূর আসতাম না। বিয়ের পর যদি জানতে পারতে তাহলে কি করতে?
-বিয়ে হয়নি। বিয়ের পরের খবর জানিনা। আল্লাহ তায়ালা বিয়ের আগে ছেলের আসল পরিচয় জানিয়েছেন যেন বিয়েটা না হয়।
-মা হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ো না। পাগল হলেও মানুষ তো।
তোমার সেবায় ভালো হয়ে যেতে পারে।
-আর যদি না হয়।
মেয়ের কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন।
-কথা বলছো না কেন?
-বাড়ি ভর্তি মেহমান। আজ গায়ে হলুদ। কাল বিয়ে। এগুলোর কোন মানে নেই তোমার কাছে?
-মেহমান তো কি হয়েছে? মানে আছে আমার কাছে সেটা হলো পাগল কে কোন সুস্থ মানুষ বিয়ে করতে পারেনা জেনেশুনে।
– আমাকে এখন কি করতে বলো? একটু পর ছেলের বাড়ির লোকেরা আসবে।
– আমি ছাড়াও তোমার আরেকজন মেয়ে আছে। পাগলরাও মানুষ আর বিয়ের পর সেবা পেলেই ভালো হয়ে যাবে তাহলে তোমার ছোট মেয়ে শীতলের সাথে বিয়ে দিয়ে দাও।
.
শীতলের হাত থেকে আব্দুল কাদিরের দেওয়া জলপাইয়ের আচারের কাঁচের বয়াম টা পড়ে গেলো কোমলের কথা শুনে।
.
আবদুল কাদির কোমলের বিয়ে আয়োজন সব নিজ হাতে করেছে। তার নিজের বিয়ের জন্যও নাকি নিজ হাতে সাজাবে সবকিছু। বেচারা জানেনা সে ঠিক কার বিয়ের জন্য সাজিয়েছে বাড়িটা।
– আসসালামু আলাইকুম!বাবা ভেতরে আসবো?
-হ্যাঁ এসো।
-বাবা তোমার গায়ে খুব জ্বর।
এসো মাথায় পানি দিয়ে দিই।
– থাক মা।
-বাবা আমি মাথায় পানি দিয়ে ছাড়ব। তোমার শরীর খুব খারাপ বাবা।
নবীজি বলেন,”জ্বর আসে জাহান্নামের তাপ থেকে!সুতরাং,জ্বর কে পানি দ্বারা প্রশমিত কর! —(সহীহ বুখারী,, খন্ড: ৭:অধ্যায় ৭১:হাদিস)
শীতল মাথায় পানি দিচ্ছে আর মাথায় হাত বুলাচ্ছে।
হঠাৎ করে বাবার চোখের কোণে পানি দেখতে পেলো শীতল।
-বাবা তুমি কি কিছু বলতে চাও?
-মা আমি কোন পথে যাব?
তুমি আমাকে বুঝতে পারো। তুমি একটা পথ দেখাও। বাড়ি ভর্তি মেহমান আর এখন যদি বিয়ে না হয়।
-বাবা পথ তোমার সামনে বাবা।
.
পাগল পাত্রের সাথে শীতলের বিয়েটা হয়ে গেলো। শীতল এখনো পাত্রকে দেখেনি। সবাই বলেছে পাত্র নাকি দেখতে রাজপুত্র। আফ্রিকান না একেবারে গ্রীক রাজপুত্র।
পাত্রের নাম পর্যন্ত জানেনা ঠিক করে। বিয়ে পরানোর সময় কাজী কি নাম বলেছিল সেটাও খেয়াল নেই।
সে ভাবছে ক্লাস ফাইভ, নাইনের মতো তার পাগল স্বামীও কি ওমন কিছু করবে?
-দুলাভাইয়ের পাঞ্জাবির বোতাম গুলো উল্টো পাল্টা।
-কি বলিস?
-জুতোর ফিতে পর্যন্ত লাগিয়ে আসেনি।
– কি বলছিস?
-মাথায় লম্বা লম্বা চুল চিরুনি ছাড়া এলোমেলো।
শীতল বান্ধবীর কথা শুনে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো।
তখনই কোমল রুমে ঢুকে শীতলকে দেখে আবার বের হয়ে গেলো। বাহির থেকে চেচামেচি আসছে নতুন জামাই নাকি কাকে ধরে মেরেছে। শীতল ভাবছে তাকেও কি মারধর করবে নাকি?
শীতলের বিধায়ের সময় বাবার রুমে ঢুকে বিধায় নিতে এলো।
হাজী কাশেম আলী মাথা নিচু করে বলল – আমাকে মাফ করে দিয়ো মা। আমার স্নেহের দাম তেমাকে মিটিয়ে দিতে হলো আজ।
-বাবা আমি রাগ করিনি। মাফ চেয়ে নিজেকে ছোট করো না।
-মা দেখবি তোর কপালে অনেক সুখ আছে।
শীতল কাঁদছে।
-একটা কথা মনে রাখবে। জীবিত অবস্থায় স্বামীর ঘরে ঢুকছো ঠিক তেমন মৃত হয়ে বের হবে। পাগল বলে অবহেলা করবে না। উনি তোমার স্বামী।
শীতল মাথা নাড়ালো।
.
কাদির কে আর দেখা গেলো না গ্রামে। সে বিয়ের আগেই কোথায় যেন চলে গিয়েছে পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে যা কেউ জানেনা।
এটা তোমার শশুর বাড়ি। শীতল তার শশুরের কথা শুনে বাড়িটা দেখলো।
বিশাল বড় বাড়ি।গাড়ি থেকে কিছু মহিলারা নামালো শীতলকে।
গেইট দিয়ে ঢোকার সময় মনে হচ্ছিল এই বাড়িটা তার কবর যেন তার জীবনটা এখানেই শেষ। পুরো বাড়িটা উচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা জেলখানার মতো।
শীতলের এমনিতে সাহসী তবে এখন খুব ভয় করছে। মনে হচ্ছে এক ছোটে পালিয়ে যেতে কারণ এই বাড়ি থেকে এক পা বাহিরে যেতে পারবে না কখনো। বাড়ির আঙিনায় অসংখ্য লাল টকটকে গোলাপ ফুটে আছে।
-বৌমা! লালগোলাপ গুলো দেখছো? এগুলো তোমার স্বামীর হাতে লাগানো ফুল। রাজের কিছু ভালো গুন আছে। ধীরে ধীরে তুমি রাজের গুন দেখতে পারবে।
“রারারাজজজজ, শীতল মন মনে নামটা বলছে।
বাড়ির ভেতর দেখে শীতল চমকে গেলো। কি বিশাল ড্রয়িং রুম শপিং মলের মতো। পুরো বাড়িটা বিদেশি সব জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। এক সাইডে অগণিত কাজের লোক একই ড্রেস পড়ে দাড়িয়ে আছে।
উপর থেকে কারও চিৎকারের আওয়াজ শোনা গেলো। চিৎকার বললে ভুল হবে গর্জন।
-আমার রাজ কে আজ তোমার হাতে তুলে দিলাম মা। ও উপরে আছে। যাও মা ওর কাছে যাও। পরিচিত হয়ে নাও তুমি ওর বউ। আমার রাজ কে সামলানোর দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। শীতলের প্রাণ বেরিয়ে পড়বে পড়বে এমন অবস্থা ভয়ে আতঙ্কে। সে কি করে সামলাবে শিকলে বাধা অমানুষিক পাগল কে।
শীতল বোরখা খুলে বড় ঘোমটা দিয়ে সিড়িতে ছোট ছোট পা ফেলে উপরে যাচ্ছে যেখানে ওর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
চলবে…………..
#লালগোলাপ
Part-02
Writer-Moon Hossain
যে মেয়েটা পাগল কে ভয় পেত সে মেয়েটার আজ পাগল উন্মাদ এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে। শীতলের বাবা চেয়ারে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। তার পায়ের কাছে বসে শীতলের মা কাঁদছে।
-মেয়েটা কিভাবে সংসার করবে পাগলের সাথে?
-আল্লাহ্ ভরসা।
-মেয়েটা পাগল দেখে ভয় পায় ভীষণ।
-ওকে আল্লাহর উপর সমর্পণ করেছি।
-পাগল টা যদি আমাদের মেয়েটা কে খুন করে ফেলে?
-পাগল বলছো কাকে?
পাগল হলেও মানুষ। সে এখন এই বাড়ির জামাতা। আমাদের মেয়ের স্বামী।
স্ত্রীকে শান্তনা দিলেও তিনি নিজে মেয়ে কে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় আছেন। না জানি মেয়েটার মনের অবস্হা কি? আজ তিনি নিজের কামরায় নামাজ পড়ে নিলেন শরীর খারাপ থাকায়। তিনি হাঁটতেই পাচ্ছেনা।
পুরো কামরা ভাংচুর হয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে সিডর, আয়লা, নার্গিস, তিতলি, বুলবুল বয়েছে কামরার উপর দিয়ে।
কাঁচের টুকরো গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার উপর একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে। লম্বা চওড়া, স্বাস্হ্যবান, লম্বা লম্বা দাড়ি আর কোঁকড়া চুলের জন্য গায়ের রং, বয়স কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। প্যান্টের সাথে সবুজ পাঞ্জাবি পড়ে আছে। মাথায় পাগড়ি আছে।মৌলানা দের মতো লাগছে। সব মিলিয়ে দেখতে অসাধারণ দেখা যাচ্ছে।ছেলেটার প্যান্টের জিপার খোলা। এটা দেখে শীতলের খুব লজ্জা লাগতে শুরু করলো। শক্ত করে চোখ জোড়া বন্ধ করল সে।
– কে তুমি? হু আর ইউ?
-(নিশ্চুপ )
-টেল মি হু আর ইউ?
শীতল একটু চমকে উঠলো। লোকটার চোখ দুটো লম্বা চুলের জন্য ঢেকে আছে।চোখ দুটো থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে।
-শীতল। মোছাঃ শীতল ওয়ারদুন।
-ওআচ্ছা। আমি রাজ। মোঃ আব্দুস সাত্তার রাজ। নাইস টু মি টু বলেই রাজ হাত বাড়িয়ে দিলো শীতলের দিকে।
শীতলও হাত বাড়িয়ে দিলো। তার স্বামীর প্রথম ছোঁয়া তাকে যেন ভালোলাগার একটা ঝটকা দিয়ে গেলো।
রাজ হ্যান্ডশেক করতে করতে বললো-
-তোমার হাত খুব নরম।
-আপনার হাত খুব শক্ত।
-ওহ সরি। তোমার ব্যাথা লাগছে মেবি।
শীতল ভাবছে লোকটা তো ভালো। তো সবাই পাগল কেন বলে?
-কামরা টার এই অবস্থা কে করেছে?
-আমি।
-কেন?
-আসলে আমাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে তাই রেগে জিনিসপত্র ভাংচুর করেছি। জানো, আমার খুব রাগ।
শেকল দেখে শীতলের মনে ব্যাথা শুরু হলো। সে শেকল খোলার জন্য রাজের কাছে গেলো।
অনেক চেষ্টা করেও শেকল ভাঙতে পারলো না।
রাজ চুপচাপ দাড়িয়ে আছে পকেটে হাত দিয়ে। শীতলের ঘোমটার আড়ালে মুখটা দেখার জন্য চেষ্টা করছে।
-উঁকি ঝুঁকি দিয়ে লাভ নেই মিঃ।
-আমি কিছু দেখতে চাচ্ছিনা কিন্তু।
শীতল হাসলো। আসলে মানুষ যতটা বলে ততটা নয়। লোকটার একটু ছেলেমানুষী টাইপ শুধু। এর থেকে কিছু না। আর সবাই কিনা কি বলে বেড়াচ্ছে লোকটার সমন্বয়ে।বদ্ধ উন্মাদ, পাগল, খুনী।
-চাবি দিয়ে খোল বৌমা।
শীতল শশুরের কথা শুনে উঠে দাঁড়ালো।
– উনাকে কেন বেঁধে রাখা হয়েছে? উনি তো ভালো।
-আমি জানি ও ভালো। কে বলল পাগল?
এসব মানুষের রটানো কথা।
শীতল চাবি নিয়ে শেকলের তালা খুলে দিলো।
রাজ শীতলের দিকে তাকিয়ে বলল – থ্যাংক ইউ নতুন বউ।
শীতল হাসলো।
– আচ্ছা তুমি কার বউ?
-আমাকে বউ কেন মনে হলো?
-বউরা ঘোমটা দেয়।
আচ্ছা তুমি কার বউ?
শীতল শশুরের দিকে আহত চোখে তাকালো।
নিজের বউকে বলছে কার বউ।
এটা কোন মেয়ে সহ্য করতে পারবে না।
রাজের বাবা বলল – আসলে ও একটু অবুঝ। কোন মতে বিয়ে পরানো শেষ হতেই তোমাদের এখানের লোকজনের সাথে ঝামেলা করেছিল। তাই কিছু না বলেই ওকে তোমার আগেই এখানে এনে বাঁধা হয়েছে। । মাঝে মাঝে ওর ব্রেইন আউট হয়ে যায়। প্রচন্ড গরম হয়ে যায়। যার কারণে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
তুমি একটু সাবধানে থেকো ওর থেকে।
-উনাকে আর বেঁধে রাখবেন না বাবা।জীব জন্তু নন যে বেঁধে রাখা হবে। উনি মানুষ। কোন মানুষ কে বেঁধে রাখলে এমনিতেই পাগল হয়ে যাবে। উনাকে আমি এখন থেকে দেখেশুনে রাখব।
-আমি এমন একটা বউ চেয়েছিলাম আমার অবুঝ ছেলেটার জন্য। যে ছেলেটা কে শেকল থেকে মুক্ত রাখবে। এখন মনে হয় আমার আশা পূরণ হয়েছে। শীতলের চোখ বার বার জিপারের দিকে যাচ্ছে। ছেলেটা বুঝতেও পাচ্ছে না কিছু। আচ্ছা শীতল কি লাগিয়ে দেবে? না না তার দ্বারা হবে না এই কাজ।
রাজের বাবা রাজের প্যান্টের জিপার লাগিয়ে দিলো।শীতলের অস্বস্তি লাগছে।
রাজ অনেক্ষণ শীতলের মুখ দেখার জন্য উঁকি দিলো তবুও লাভ হলো না। রাজ বলল -বাবা ও কে?
শীতল কে সামনে দাড় করিয়ে উনি বলল – তোমার বউ। আজ থেকে তোমার সাথে থাকবে।
-বউ!
-হ্যাঁ বউ।
-বউ মানে কি? ও কেন আমার সাথে থাকবে?
বউ হলে কি একসাথে থাকতে হয়?
-হ্যাঁ বাবা। বৌমা তুমি ওর প্রশ্নের উওর গুলো দাও। ওর দ্বায়িত্ব তোমার হাতে।
আমি লোক পাঠাচ্ছি কামরা পরিষ্কার করার জন্য।
শীতল নিজেই ঘোমটা তোলার আগে রাজ ঘোমটা তুলে দিলো। শীতলকে দেখে রাজ থমকে গেলো।
শীতল চোখের পাপড়ি বার বার নাড়িয়ে নাড়িয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলো।
-তুমি এতো সুন্দরী? পরী। তুমি মানুষ না।
-হ্যাঁ ঠিক বলেছেন। আমি পরী। প্রতিটি স্বামীর কাছে তার বউ পরীর মতো।
-তোমাকে একটু ছুয়ে দেখব?
-হ্যাঁ।
রাজ ভয়ে ভয়ে শীতলের গালে হাত রেখে আবার ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলো।
-না থাক। তুমি মারবে।
-আমি আপনাকে মারব কেন?
-তোমার মতো ঘোমটা দেওয়া মেয়ে কে ছুঁতে গিয়েছিলাম আমার মা ভেবে। তারপর আমাকে মেরেছিল।
-আপনার মা কোথায়?
-আমি যখন ছোট তখন চলে গেছে। একদিন স্কুলে এসে দেখি মা নেই।
রাজের হাসি মাখা মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শীতল রাজের হাত নিজের গালে রেখে বলল – আমাকে যখন ইচ্ছে তখন ছুঁয়ে দেখবেন।
-তুমি মারবে না?
-মারব। যদি না ছুঁয়ে দেখেন তাহলে!
রাজ হাসতে শুরু করলো। রাজ পুরো শরীর দুলিয়ে নিঃশব্দে হাসে। একবার দেখলে রাজের হাসি চোখে লেগে থাকার মতো।
কামরা পরিষ্কার করা হয়েছে। রাজ খাটে বসে শীতল কে দেখছে। শীতল নামাজ পড়ছে। রাজের ইচ্ছে করছে শীতলের সাথে নামাজ পড়তে কিন্তু কেন যেন পড়ছেনা।
.
-আচ্ছা বউ মানে কি?
-বউ মানে হলো নিজের জীবনে অন্য একজন কে জায়গা দেওয়া।
এখন থেকে আমি আপনার সাথে থাকব সবসময়।
-রাতেও কি থাকবে? তোমাদের বাড়িতে যাবে না?
-দিন-দুপুর-বিকেল-রাত সব সময় থাকব। আমি কোথায় যাব? এটাই তো আমার বাড়ি।
-তোমার বাড়ি কিভাবে হলো? এটা আমার বাড়ি।
-আপনার বাড়ি তো আমার বাড়ি।
-তুমি মিথ্যে বলছো, এটা তোমার বাড়ি না। আগে তো এই বাড়িতে দেখিনি।
-আগে বিয়ে করেন নি তাই।
– বিয়ে করলে কি এই বাড়িতে থাকতে হয়?
-হ্যাঁ। আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন তাই আপনি যেখানে থাকবেন আমিও ওখানে থাকব।
রাজ মাথা চুলকিয়ে বলল – বিয়ে করলাম কখন! বিয়ে কি সেটাই বুঝতে পারলাম না। এই সুন্দর মেয়েটা আমাদের বাড়িতে কেন থাকবে? ওর বাবা মা টেনশন করবে না। আর রাতে তো হাত পা ছড়িয়ে একাই খাটে শেকল বেধে সে ঘুমায় তাহলে শীতল কোথায় ঘুমুবে। খাটে তো জায়গা নেই।
রাজের মনে এসব কথায় ঘুরছে। কিছু ঢুকছেনা তার মাথায়।
বিশাল ডাইনিং টেবিলে সবাই খেতে বসেছে।শীতলের চাচী, খালা, ফুপু শাশুড়ী আর রাজের বোন, কাজিনরা শীতলের জন্য টেবিলে ওয়েট করছিল। শীতল লম্বা ঘোমটা দিয়ে রাজ কে নিয়ে খেতে বসেছে। সবাই রাজ কে দেখে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে।
শীতল কিছু বুঝতে পারলো না। শীতলের শশুর সবাই কে বসার জন্য ইশারা করলো। শীতল লুকিয়ে শশুর বাড়ির লোকজনদের দেখছে। সবাই আল্টা মর্ডান। ধর্মীয় বিষয়ে কারও কোন শিক্ষা নেই তা বোঝা যাচ্ছে।
রাজ অনেক দিন পর সবার সাথে টেবিলে খেতে বসেছে।
রাজ হাত দিয়ে খাচ্ছে, খাবার মুখে যাওয়ার থেকে টেবিলের নিচে পড়ে যাচ্ছে বেশি। নতুন বউ বলে শীতলের লজ্জা করছে। নয়ত সে খাইয়ে দিতো।আচ্ছা ছেলেটা কি খেতেও জানেনা? কাজের লোক ভর্তি তবুও কেউ হেল্প করছে না কেন? সবার চেহেরা ভয়ংকর কিছু দেখে যেমন হয় তেমন হয়ে রয়েছে।
রাজ কেমন পাগল আর ঠিক কি লেভেলের পাগল তা শীতল দেখে কেঁপে উঠলো।
রাজ নিজের প্লেট রেখে অন্যের প্লেটে হাত দিলো। আর বলল – আমি একা সব খাব। কেউ হাত দেবে না খাবারে।
রাজের চাচী বলল – কেন বাবা? আমরা সবাই মিলে ডিনার করি, কেমন?
রাজ কে না করতেই রাজ ভয়ংকর রেগে টেবিলের সব খাবার ফেলে দিলো সবার উপর। রাজকে তার ফুপু ধমক দিতেই সে ফুপুর মাথায় প্লেট ছুড়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিলো।
রাজের বাবা রাজ কে থামাতে গেলে তাকেও জখম হতে হয়। রাজ ভয়ংকর ধরনের আওয়াজ করতে করতে চিৎকার শুরু করলো। সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই আঘাত করছে। পরিস্হিতি নিমিষেই ভয়াবহ হয়ে উঠলো। বেশ রক্তারক্তি কান্ড ঘটে যাচ্ছে। শীতল এসব দেখে হতভম্ব হয়েছে। কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না। শীতলের চোখ থেকে পানি পড়ছে। সামান্য বিষয় নিয়ে কেউ সবাই কে আঘাত করতে পারে তা ধারণার বাহিরে ছিলো। শীতল রাজের হাত ধরে বাঁধা দিলে রাজ শান্ত হয়। পরক্ষণেই সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলো শীতল।
রাজ একি করছে! রাজ দৌড়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে লাফিয়ে পড়লো নিচে।
বেডরুমে রাজকে শেকল দিয়ে বাঁধা হয়েছে খাটের সাথে। শীতল শশুর বাড়ির অনেকের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখতে পেলো।
রাজের শরীরের অনেক জায়গা কেটেছে। রক্ত পড়ছে। ইনজেকশন দিয়ে রাজকে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। একটু জ্ঞান থাকা কালীন রাজ শরীর দুলিয়ে হেসে শীতল কে বলেছিল। -শ্রেয়সী তুমি কাঁদছো কেন?
শীতল দরজায় পর্দার আড়ালে রাজের অবস্হা আর তার ভবিষ্যৎ দেখে কাদঁছিলো।
-শ্রেয়সী
তোমার বাড়ি চলে যাও।ঘুম থেকে উঠে তোমাকেও মেরে ফেলতে পারি সবার মতো।
রাজের পাগল নয় বদ্ধ উন্মাদ। রাজের মধ্যে প্রবল আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে সবাই বলাবলি করছে।
শীতল মনে মনে শুধু আল্লাহ তায়ালার নাম নিচ্ছে। তার ভাগ্য কেন এমন হলো! এতো দুঃখ কষ্ট তাকে কেন দিচ্ছে আল্লাহ তায়ালা!
শীতলের কাঁধে হাত রেখে তার শশুর বলল -নবী (সাঃ) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দুঃখ-কষ্টে ফেলেন।’’ (সহীহুল বুখারী ৫৬৪)
তুমি এই বাড়িতে রাজরানী হয়ে থাকবে মা। চোখের পানি মুছে নাও।
রাজকে শেকল থেকে কখনো মুক্ত না করার কথা সবাই বলছে।
চলবে…….(আগের আইডি ডিজেবল ডিয়ার পাঠক পাঠিকা। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)#লালগোলাপ
Part-02
Writer-Moon Hossain
যে মেয়েটা পাগল কে ভয় পেত সে মেয়েটার আজ পাগল উন্মাদ এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে। শীতলের বাবা চেয়ারে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। তার পায়ের কাছে বসে শীতলের মা কাঁদছে।
-মেয়েটা কিভাবে সংসার করবে পাগলের সাথে?
-আল্লাহ্ ভরসা।
-মেয়েটা পাগল দেখে ভয় পায় ভীষণ।
-ওকে আল্লাহর উপর সমর্পণ করেছি।
-পাগল টা যদি আমাদের মেয়েটা কে খুন করে ফেলে?
-পাগল বলছো কাকে?
পাগল হলেও মানুষ। সে এখন এই বাড়ির জামাতা। আমাদের মেয়ের স্বামী।
স্ত্রীকে শান্তনা দিলেও তিনি নিজে মেয়ে কে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় আছেন। না জানি মেয়েটার মনের অবস্হা কি? আজ তিনি নিজের কামরায় নামাজ পড়ে নিলেন শরীর খারাপ থাকায়। তিনি হাঁটতেই পাচ্ছেনা।
পুরো কামরা ভাংচুর হয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে সিডর, আয়লা, নার্গিস, তিতলি, বুলবুল বয়েছে কামরার উপর দিয়ে।
কাঁচের টুকরো গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার উপর একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে। লম্বা চওড়া, স্বাস্হ্যবান, লম্বা লম্বা দাড়ি আর কোঁকড়া চুলের জন্য গায়ের রং, বয়স কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। প্যান্টের সাথে সবুজ পাঞ্জাবি পড়ে আছে। মাথায় পাগড়ি আছে।মৌলানা দের মতো লাগছে। সব মিলিয়ে দেখতে অসাধারণ দেখা যাচ্ছে।ছেলেটার প্যান্টের জিপার খোলা। এটা দেখে শীতলের খুব লজ্জা লাগতে শুরু করলো। শক্ত করে চোখ জোড়া বন্ধ করল সে।
– কে তুমি? হু আর ইউ?
-(নিশ্চুপ )
-টেল মি হু আর ইউ?
শীতল একটু চমকে উঠলো। লোকটার চোখ দুটো লম্বা চুলের জন্য ঢেকে আছে।চোখ দুটো থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে।
-শীতল। মোছাঃ শীতল ওয়ারদুন।
-ওআচ্ছা। আমি রাজ। মোঃ আব্দুস সাত্তার রাজ। নাইস টু মি টু বলেই রাজ হাত বাড়িয়ে দিলো শীতলের দিকে।
শীতলও হাত বাড়িয়ে দিলো। তার স্বামীর প্রথম ছোঁয়া তাকে যেন ভালোলাগার একটা ঝটকা দিয়ে গেলো।
রাজ হ্যান্ডশেক করতে করতে বললো-
-তোমার হাত খুব নরম।
-আপনার হাত খুব শক্ত।
-ওহ সরি। তোমার ব্যাথা লাগছে মেবি।
শীতল ভাবছে লোকটা তো ভালো। তো সবাই পাগল কেন বলে?
-কামরা টার এই অবস্থা কে করেছে?
-আমি।
-কেন?
-আসলে আমাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে তাই রেগে জিনিসপত্র ভাংচুর করেছি। জানো, আমার খুব রাগ।
শেকল দেখে শীতলের মনে ব্যাথা শুরু হলো। সে শেকল খোলার জন্য রাজের কাছে গেলো।
অনেক চেষ্টা করেও শেকল ভাঙতে পারলো না।
রাজ চুপচাপ দাড়িয়ে আছে পকেটে হাত দিয়ে। শীতলের ঘোমটার আড়ালে মুখটা দেখার জন্য চেষ্টা করছে।
-উঁকি ঝুঁকি দিয়ে লাভ নেই মিঃ।
-আমি কিছু দেখতে চাচ্ছিনা কিন্তু।
শীতল হাসলো। আসলে মানুষ যতটা বলে ততটা নয়। লোকটার একটু ছেলেমানুষী টাইপ শুধু। এর থেকে কিছু না। আর সবাই কিনা কি বলে বেড়াচ্ছে লোকটার সমন্বয়ে।বদ্ধ উন্মাদ, পাগল, খুনী।
-চাবি দিয়ে খোল বৌমা।
শীতল শশুরের কথা শুনে উঠে দাঁড়ালো।
– উনাকে কেন বেঁধে রাখা হয়েছে? উনি তো ভালো।
-আমি জানি ও ভালো। কে বলল পাগল?
এসব মানুষের রটানো কথা।
শীতল চাবি নিয়ে শেকলের তালা খুলে দিলো।
রাজ শীতলের দিকে তাকিয়ে বলল – থ্যাংক ইউ নতুন বউ।
শীতল হাসলো।
– আচ্ছা তুমি কার বউ?
-আমাকে বউ কেন মনে হলো?
-বউরা ঘোমটা দেয়।
আচ্ছা তুমি কার বউ?
শীতল শশুরের দিকে আহত চোখে তাকালো।
নিজের বউকে বলছে কার বউ।
এটা কোন মেয়ে সহ্য করতে পারবে না।
রাজের বাবা বলল – আসলে ও একটু অবুঝ। কোন মতে বিয়ে পরানো শেষ হতেই তোমাদের এখানের লোকজনের সাথে ঝামেলা করেছিল। তাই কিছু না বলেই ওকে তোমার আগেই এখানে এনে বাঁধা হয়েছে। । মাঝে মাঝে ওর ব্রেইন আউট হয়ে যায়। প্রচন্ড গরম হয়ে যায়। যার কারণে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
তুমি একটু সাবধানে থেকো ওর থেকে।
-উনাকে আর বেঁধে রাখবেন না বাবা।জীব জন্তু নন যে বেঁধে রাখা হবে। উনি মানুষ। কোন মানুষ কে বেঁধে রাখলে এমনিতেই পাগল হয়ে যাবে। উনাকে আমি এখন থেকে দেখেশুনে রাখব।
-আমি এমন একটা বউ চেয়েছিলাম আমার অবুঝ ছেলেটার জন্য। যে ছেলেটা কে শেকল থেকে মুক্ত রাখবে। এখন মনে হয় আমার আশা পূরণ হয়েছে। শীতলের চোখ বার বার জিপারের দিকে যাচ্ছে। ছেলেটা বুঝতেও পাচ্ছে না কিছু। আচ্ছা শীতল কি লাগিয়ে দেবে? না না তার দ্বারা হবে না এই কাজ।
রাজের বাবা রাজের প্যান্টের জিপার লাগিয়ে দিলো।শীতলের অস্বস্তি লাগছে।
রাজ অনেক্ষণ শীতলের মুখ দেখার জন্য উঁকি দিলো তবুও লাভ হলো না। রাজ বলল -বাবা ও কে?
শীতল কে সামনে দাড় করিয়ে উনি বলল – তোমার বউ। আজ থেকে তোমার সাথে থাকবে।
-বউ!
-হ্যাঁ বউ।
-বউ মানে কি? ও কেন আমার সাথে থাকবে?
বউ হলে কি একসাথে থাকতে হয়?
-হ্যাঁ বাবা। বৌমা তুমি ওর প্রশ্নের উওর গুলো দাও। ওর দ্বায়িত্ব তোমার হাতে।
আমি লোক পাঠাচ্ছি কামরা পরিষ্কার করার জন্য।
শীতল নিজেই ঘোমটা তোলার আগে রাজ ঘোমটা তুলে দিলো। শীতলকে দেখে রাজ থমকে গেলো।
শীতল চোখের পাপড়ি বার বার নাড়িয়ে নাড়িয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলো।
-তুমি এতো সুন্দরী? পরী। তুমি মানুষ না।
-হ্যাঁ ঠিক বলেছেন। আমি পরী। প্রতিটি স্বামীর কাছে তার বউ পরীর মতো।
-তোমাকে একটু ছুয়ে দেখব?
-হ্যাঁ।
রাজ ভয়ে ভয়ে শীতলের গালে হাত রেখে আবার ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলো।
-না থাক। তুমি মারবে।
-আমি আপনাকে মারব কেন?
-তোমার মতো ঘোমটা দেওয়া মেয়ে কে ছুঁতে গিয়েছিলাম আমার মা ভেবে। তারপর আমাকে মেরেছিল।
-আপনার মা কোথায়?
-আমি যখন ছোট তখন চলে গেছে। একদিন স্কুলে এসে দেখি মা নেই।
রাজের হাসি মাখা মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শীতল রাজের হাত নিজের গালে রেখে বলল – আমাকে যখন ইচ্ছে তখন ছুঁয়ে দেখবেন।
-তুমি মারবে না?
-মারব। যদি না ছুঁয়ে দেখেন তাহলে!
রাজ হাসতে শুরু করলো। রাজ পুরো শরীর দুলিয়ে নিঃশব্দে হাসে। একবার দেখলে রাজের হাসি চোখে লেগে থাকার মতো।
কামরা পরিষ্কার করা হয়েছে। রাজ খাটে বসে শীতল কে দেখছে। শীতল নামাজ পড়ছে। রাজের ইচ্ছে করছে শীতলের সাথে নামাজ পড়তে কিন্তু কেন যেন পড়ছেনা।
.
-আচ্ছা বউ মানে কি?
-বউ মানে হলো নিজের জীবনে অন্য একজন কে জায়গা দেওয়া।
এখন থেকে আমি আপনার সাথে থাকব সবসময়।
-রাতেও কি থাকবে? তোমাদের বাড়িতে যাবে না?
-দিন-দুপুর-বিকেল-রাত সব সময় থাকব। আমি কোথায় যাব? এটাই তো আমার বাড়ি।
-তোমার বাড়ি কিভাবে হলো? এটা আমার বাড়ি।
-আপনার বাড়ি তো আমার বাড়ি।
-তুমি মিথ্যে বলছো, এটা তোমার বাড়ি না। আগে তো এই বাড়িতে দেখিনি।
-আগে বিয়ে করেন নি তাই।
– বিয়ে করলে কি এই বাড়িতে থাকতে হয়?
-হ্যাঁ। আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন তাই আপনি যেখানে থাকবেন আমিও ওখানে থাকব।
রাজ মাথা চুলকিয়ে বলল – বিয়ে করলাম কখন! বিয়ে কি সেটাই বুঝতে পারলাম না। এই সুন্দর মেয়েটা আমাদের বাড়িতে কেন থাকবে? ওর বাবা মা টেনশন করবে না। আর রাতে তো হাত পা ছড়িয়ে একাই খাটে শেকল বেধে সে ঘুমায় তাহলে শীতল কোথায় ঘুমুবে। খাটে তো জায়গা নেই।
রাজের মনে এসব কথায় ঘুরছে। কিছু ঢুকছেনা তার মাথায়।
বিশাল ডাইনিং টেবিলে সবাই খেতে বসেছে।শীতলের চাচী, খালা, ফুপু শাশুড়ী আর রাজের বোন, কাজিনরা শীতলের জন্য টেবিলে ওয়েট করছিল। শীতল লম্বা ঘোমটা দিয়ে রাজ কে নিয়ে খেতে বসেছে। সবাই রাজ কে দেখে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে।
শীতল কিছু বুঝতে পারলো না। শীতলের শশুর সবাই কে বসার জন্য ইশারা করলো। শীতল লুকিয়ে শশুর বাড়ির লোকজনদের দেখছে। সবাই আল্টা মর্ডান। ধর্মীয় বিষয়ে কারও কোন শিক্ষা নেই তা বোঝা যাচ্ছে।
রাজ অনেক দিন পর সবার সাথে টেবিলে খেতে বসেছে।
রাজ হাত দিয়ে খাচ্ছে, খাবার মুখে যাওয়ার থেকে টেবিলের নিচে পড়ে যাচ্ছে বেশি। নতুন বউ বলে শীতলের লজ্জা করছে। নয়ত সে খাইয়ে দিতো।আচ্ছা ছেলেটা কি খেতেও জানেনা? কাজের লোক ভর্তি তবুও কেউ হেল্প করছে না কেন? সবার চেহেরা ভয়ংকর কিছু দেখে যেমন হয় তেমন হয়ে রয়েছে।
রাজ কেমন পাগল আর ঠিক কি লেভেলের পাগল তা শীতল দেখে কেঁপে উঠলো।
রাজ নিজের প্লেট রেখে অন্যের প্লেটে হাত দিলো। আর বলল – আমি একা সব খাব। কেউ হাত দেবে না খাবারে।
রাজের চাচী বলল – কেন বাবা? আমরা সবাই মিলে ডিনার করি, কেমন?
রাজ কে না করতেই রাজ ভয়ংকর রেগে টেবিলের সব খাবার ফেলে দিলো সবার উপর। রাজকে তার ফুপু ধমক দিতেই সে ফুপুর মাথায় প্লেট ছুড়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিলো।
রাজের বাবা রাজ কে থামাতে গেলে তাকেও জখম হতে হয়। রাজ ভয়ংকর ধরনের আওয়াজ করতে করতে চিৎকার শুরু করলো। সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই আঘাত করছে। পরিস্হিতি নিমিষেই ভয়াবহ হয়ে উঠলো। বেশ রক্তারক্তি কান্ড ঘটে যাচ্ছে। শীতল এসব দেখে হতভম্ব হয়েছে। কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না। শীতলের চোখ থেকে পানি পড়ছে। সামান্য বিষয় নিয়ে কেউ সবাই কে আঘাত করতে পারে তা ধারণার বাহিরে ছিলো। শীতল রাজের হাত ধরে বাঁধা দিলে রাজ শান্ত হয়। পরক্ষণেই সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলো শীতল।
রাজ একি করছে! রাজ দৌড়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে লাফিয়ে পড়লো নিচে।
বেডরুমে রাজকে শেকল দিয়ে বাঁধা হয়েছে খাটের সাথে। শীতল শশুর বাড়ির অনেকের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখতে পেলো।
রাজের শরীরের অনেক জায়গা কেটেছে। রক্ত পড়ছে। ইনজেকশন দিয়ে রাজকে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। একটু জ্ঞান থাকা কালীন রাজ শরীর দুলিয়ে হেসে শীতল কে বলেছিল। -শ্রেয়সী তুমি কাঁদছো কেন?
শীতল দরজায় পর্দার আড়ালে রাজের অবস্হা আর তার ভবিষ্যৎ দেখে কাদঁছিলো।
-শ্রেয়সী
তোমার বাড়ি চলে যাও।ঘুম থেকে উঠে তোমাকেও মেরে ফেলতে পারি সবার মতো।
রাজের পাগল নয় বদ্ধ উন্মাদ। রাজের মধ্যে প্রবল আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে সবাই বলাবলি করছে।
শীতল মনে মনে শুধু আল্লাহ তায়ালার নাম নিচ্ছে। তার ভাগ্য কেন এমন হলো! এতো দুঃখ কষ্ট তাকে কেন দিচ্ছে আল্লাহ তায়ালা!
শীতলের কাঁধে হাত রেখে তার শশুর বলল -নবী (সাঃ) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দুঃখ-কষ্টে ফেলেন।’’ (সহীহুল বুখারী ৫৬৪)
তুমি এই বাড়িতে রাজরানী হয়ে থাকবে মা। চোখের পানি মুছে নাও।
রাজকে শেকল থেকে কখনো মুক্ত না করার কথা সবাই বলছে।
চলবে