শিকড় পর্ব-০৬

0
191

শিকড়
পর্ব -৬

আজ ২৮ জুন।গতকাল ২৭ জুন ছিল আবিদের জন্মদিন। ছোট থেকে এই দিনটির জন্য আবিদ কি ভীষন অপেক্ষা করতো।অথচ এবারের জন্মদিনে ও জানতে পারলো এটা ওর আসল জন্মতারিখ নয়।শাহেদ চৌধুরী আর রেহনুমা চৌধুরীর একমাত্র সন্তান আবিদ চৌধুরীর আসল জন্মতারিখ ৩০ শে জুন।

কিছুদিন আগে যখন রেহনুমা আবিদকে বললেন,
-এবার তোর জন্মদিন দেশে হবে, আমরা দেশে যাবো,সব ব্যাবস্হা কর।আবিদ যে কি খুশি হয়েছিল, বলার মতো না।ওর আম্মুকে বললো
-সব হয়ে যাবে,চিন্তা নেই। তার আগে তো শপিং করতে হবে, এতো বছর পর যাচ্ছি আমরা,তোমার শরীর কি ঠিক আছে এখন?
-কোন শপিং করতে হবে না। আমরা কারও সাথে দেখা করবো না। হোটেলে থাকবো।
-মানে???
-আমরা একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজে ঢাকা যাবো, এখন আর কাউকে বলার দরকার নাই।
-কিন্তু আম্মু, আমি ভিডিও কলে খালা,মামা, চাচা,ফুফুদের পরিবারের সবার সাথে পরিচিত হয়েছি।এখন তাদের সাথে ভালোই যোগাযোগ হয় আমার, ওদের কাছে গিয়েও দেখা করবো না?
-আমাদের জীবনের নৌকাটা যখন মাঝনদীতে ডুবতে বসেছিল, তখন এই তথাকথিত আপনজনের কেউ এগিয়ে আসে নি। বরং কয়েকজন চেয়েছিল নৌকাটা একেবারে ডুবিয়ে দিতে। সম্পুর্ন অচেনা দুজন মানুষ তখন নৌকাটা আবার চলতে সাহায্য করেন। আমরা উনাদের খোঁজেই যাচ্ছি।
-সবাই যদি তথাকথিত হন,তবে কেন তাদের সাথে সম্পর্ক রেখেছো বলো?
-কারন আমি জানি, যে ব্যাক্তি আত্নীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। অবশ্য এমনিতেও আমি যে গুনাহের ভাগিদার, ক্ষমা না পেলে…..
-আমি কিছুই বুঝতে পারছি না আম্মু।
-সময় হলে সব বুঝবে।
আবিদের মনে তবুও খুশির আমেজ।সে গিয়ে বেশ অনেক রকম চকোলেট, ক্যান্ডি,পারফিউম, ওয়ালেট সহ অনেক উপহার সামগ্রী কিনে ফেললো।

অবশেষে গতকাল সকালে তারা পা রাখে ঢাকার মাটিতে। ডিনারের পরে ওর আব্বু কিউট একটা কেইক নিয়ে আসে। তিনজন মিলে কেইক কেটে পরে রুমে যায় ওদের রুটিন আড্ডা দিতে। কিন্তু আড্ডা যেন জমেনি। কালই সে জানলো তার জন্মতারিখ ভূল। শাহেদ চৌধুরী বললেন
-আজ কিন্তু তোর আসল জন্মদিন নয়,তোর জন্মদিন ৩০শে জুন।
-কি বলো আব্বু?
-হ্যাঁ রে,ঠিকই বলছি।
-কিন্তু সব সার্টিফিকেটে ২৭ শে জুন কেন?ভূল করে নাকি?
-আবিদ বাবা শোন,তোকে কিছু কথা বলবো,শক্ত হয়ে শুন।
-কি বলো?
-সার্টিফিকেটে শুধু তারিখ না,বাবা মায়ের নামেও অমিল।
-মানে??(রেহনুমার কান্না দেখে কোনরকমে বলে ও)
-আমরা তোর আব্বু আম্মু, এটা সত্যি। কিন্তু তোর জন্মদাতা জন্মদাত্রী আমরা নই বাবা।

হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন রেহনুমা। কাঁদছেন শাহেদও।শুধুমাত্র পাথরের মতো বসে আছে আবিদ।পাগলের মতো কেঁদেই চলেছেন রেহনুমা।
-আবিদ,বাবা, কথা বল।
-আমি সবটা জানতে চাই।
-সব বলতেই তো বসেছি আজ,কিন্তু তোকে ঠান্ডা মাথায় শুনতে হবে যে।
-আমি ঠিক আছি আব্বু,তুমি বলো।
বেশ অনেকটা সময় নিয়ে শাহেদ বলতে শুরু করেন

-ত্রিশ বছর আগের কথা।আমাদের বিয়ের তখন ১১ বছর চলছে। তোর আম্মু ছিলেন প্রেগনেন্ট।এটা অবশ্য প্রথমবার নয়,চতুর্থবার ছিলো। আগের তিনবারই বাচ্চা পেটেই মারা যায়।সংঘাতিক রকম মানসিক অশান্তিতে কাটতো আমাদের দিন রাত।এদিকে তোর দাদুরও শুরু হয় অত্যাচার।সারাক্ষণ রেনুকে কথা শোনাতেন। আমি সপ্তাহে একরাতই মাত্র বাসায় থাকতাম,ঐ একটি রাতই আমার কাটতো বিভীষিকার মতো। এই মেয়েকে দিয়ে বংশ রক্ষা হবে না,চৌধুরী বংশের বাতি দরকার হেনতেন।আমি অনেক বুঝিয়েছি,এতে তো রেনুর কোন দোষ নেই,বেচারি নিজেই কতোটা খারাপ অবস্থায় আছে দেখো।তাছাড়া আমার তো আরও দুজন ভাই আছে। তাদের সন্তানরাওতো চৌধুরী বংশের বাতি। মা যেন কিছুই বুঝতে চাইতেন না,রাগ করে বলতেন অন্যের সন্তান তোমার শেষ বয়সে লাঠি হবে না কোনদিন।তোমার নিজের বাতিই আলো ছড়াবে।।
মা কে সবসময় ইন্ধন যোগাতো আমার বোনেরা।তারাও রেনুর সাথে যা নয় তা ব্যবহার করতো।তোর ছোট ফুফুতো তার এক দূরসম্পর্কের ডিভোর্সি ননদের সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়ে ফেলে। আমি বা রেনু কিছুই জানতাম না।তাদের এসব কথাবার্তায়, ব্যবহারে মাঝে মাঝে আমিও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতাম।কথা শোনাতাম রেনুকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকেন তিনি।ওদিকে অঝোরে কেদেঁ চলা রেনুর হাত ধরে সান্ত্বনা দেয়ারও যেন কেউ নেই আজ।আবার শাহেদ শুরু করেন

-ঘটনার দিন পনেরো আগে,একরাতের জন্য বাসায় গিয়েছি।রেনুর শরীর তখন প্রচন্ড খারাপ, হাত-পায়ে পানি চলে এসেছে। অনেক ফোলা।কিন্তু কারও কাছ থেকে কোন ধরনের সহানুভূতি পাচ্ছে না সে।এরমধ্যেই খাবার টেবিলে মা আমাকে বলেন,
-তোর জন্য মেয়ে দেখেছি, মোটামুটি ঠিকঠাক।
-মানে??
-না বুঝার মতো তো কিছু বলিনি।
-মা,রেনুর এই অবস্থায় তুমি এসব কথা বলছো কি করে?
-কি অবস্থা?? নতুন তো কিছু না,আর ফলাফলও সবার জানা।
-মাআআআআ।
-চিৎকার করোনা শাহেদ। ভালো করে শোনে রাখো।আমি শুধু ঔ সময়টার অপেক্ষা করছি।এবারও যদি আগের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি হয়,তার ঠিক এক সপ্তাহ পরেই তুমি বিয়ের জন্য তৈরী থাকবে।
-কিন্তু মা……..
-আমার শেষ কথা বলে দিয়েছি আমি।

সেইরাতের পর থেকে তোমার আম্মু একদম চুপচাপ হয়ে যান। কারো সাথে কথা বলেন না,কোন কথার উত্তর দেননা। নিজের দিকেও কোন খেয়াল নেই। একরাতের জন্য গেলেও আমি ওকে রেখে আসতে পারলাম না।তিনদিন পর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।পুরনো ডাক্তার, সবই জানা।আমিও কিছু না লুকিয়ে সবটাই খুলে বলি উনাকে।উনার পরামর্শে আমি পরদিন রেনুকে নিয়ে ফিরে আসি আমার কর্মস্থলে।

আমার সাথে এসেও ওর তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।সারাক্ষণ যেনো ধ্যানে থাকতো। কয়েকদিন পরই শুরু হয় ওর ব্যাথা।সদর হাসপাতাল আমার কোয়ার্টার থেকে কাছে থাকায় ওখানেই নিয়ে যাই ওকে।২৭ শে জুন জন্ম হয় এক ছেলের কিন্তু
-কিন্তু???
-………
-কিন্তু কিইইইই?
-মৃত।

নিশ্চুপ তিনজন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের কোন শব্দ নেই।হঠাৎ করে একসাথেই যেন থমকে গেছে সব।কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত রেনুও যেন মুর্তি হয়ে গেছেন।পরবর্তী অংশটা শোনার, জানার বা জিজ্ঞেস করার কোন শক্তি যেন নেই আর আবিদের।শাহেদ এসে আবিদের একদম কাছে বসে আবার শুরু করেন

-রেনু তখন পাগলপ্রায়। বেশির ভাগ সময় ওকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো।জেগে থাকলে শুধু চিৎকার করে কান্না করতো আর নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করতো।শুধু নিজের না,আমাকেও মেরে ফেলতে চেয়েছে কয়েকবার। আমিও খবরটা আমার বা রেনুর বাসায় জানাইনি।তিনদিন পর পাশের কেবিনে জন্ম নেয়া এক বাচ্চার কান্না শুনে ওর পাগলামি বেড়ে যায়।একদৌড়ে পৌঁছে যায় ওখানে। ওর বাচ্চা, ওর বাচ্চা করে চিৎকার দিতে দিতে এগিয়ে যায় বাচ্চার কাছে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায় বাচ্চাটির মা।অবশ্য ভয় পাওয়ারই কথা, নিতান্তই এক বালিকা সে।গ্রামে মেয়েদের বিয়ে অনেক সময় কম বয়সে হয়।আর তার প্রথম সন্তানের জন্ম হলো আজ।কিছুতেই রেনুকে সামলাতে না পেরে আবারও ইনজেকশন পুশ করা হয়।ঘুমিয়ে পরে সে।
ততক্ষণে মেয়েটির স্বামী চলে এসেছে। নামাজে গিয়েছিল সে।তারও বয়স অনেক কম।এসে সবকিছু শুনে আমাকে বারান্দা থেকে ডেকে নিয়ে যায়।
-আপনের মনে হয় কিচ্ছু খাওয়া হয় নাই,এই পাউরুটি আর কলাডা খান।
-ধন্যবাদ, আমার খিদে নেই।
-খিদে না থাকলেও খান।নিজের শক্তি না থাকলে আরেকজনরে সামলাবেন কেমনে?
এই প্রথমবার আমি মন খুলে কাঁদলাম। সবকিছু খুলে বললাম ওদের।সবশুনে ছেলেটি বললো,
-একটা কথা জানেন তো,আল্লাহর হিসাবে কোন ভূল নাই।আফসোস কইরেন না।
-আমি মনে হয় রেনুকে হারিয়ে ফেলবো।
এই প্রথম মেয়েটার কথা শুনা গেলো
-কিচ্ছু হইবো না ভাইসাব।সব ঠিক হইবো, এহনতো আপনের নিজেরে ঠিক রাখা লাগবো আগে।
ঘন্টাখানেক পরেই জেগে যায় রেনু। কিন্তু এবার আর ঔ কেবিনে ঢুকেনি।জানলা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
-আমার বাচ্চাটা দিয়ে দাও না গো।তোমাকে আমি সোনা দিবো,হীরে দিবো।পাঁচশ টা করে হাতি আর ঘোড়া দিবো।
হেসে উঠে সহজ সরল মেয়েটি।রেনুও ঢুকে যায় কেবিনে।কোন পাগলামি নেই ওর।বাচ্চাকে আদর করে ওর পাশে বসে থাকে। ওদেরও বাড়ি ফেরার তাড়া।আসলে ওরা হাসপাতালে এসেছে, এটা ওদের বাড়ির কারও পছন্দ হয়নি।ওদের সবার বাচ্চাই দাই ডেকে বাড়িতে হয়।সবার কথা অমান্য করায় কেউ সাথে আসেননি। সব ভালোয় ভালোয় শেষ,এবার তো বাড়ির বাচ্চা বাড়ি যাবে।কিন্তু রেনুতো কিছুতেই ছাড়বে না।
ওর কান্নায় হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স পর্যন্ত কেঁদে ফেলেন।
ছেলেটি তখন ওর স্ত্রীকে বলে
-দেখছো বউ,আল্লাহর হিসাব কেমন। নাইলে সকলের কথা উল্টাইয়া আমরা এইহানে আসুম ক্যান।
-কি কন আপনে?
-তুমি ঠিকই বুঝছ বউ।
-নাআআআ।আমি পারুম না।
-পারবা।এক মা হইয়া আরেক মায়ের সংসার,জীবন তুমিইতো বাঁচাইতে পারবা।মনে করো হেরা তোমার আপন,তোমার বইন,অহন কও তো,পারবা না??
দুইহাত জোর করে শাহেদ চৌধুরী মেয়েটিকে বলেন,

-বোন,তোমার বয়স কম,আল্লাহর ইচ্ছায় তুমি আবার মা হবে। তোমার কোল ভরে উঠবে,কিন্তু আমাদের তো সব আশা শেষ।তুমি আমাদের একটু দয়া করো।
দৃপ্ত কন্ঠে মেয়েটির উত্তর
-দয়া আল্লাহ ছাড়া কেউ করতে পারে না,আপনেরা পোলাডারে ভালোমতো মানুষ কইরেন। নামাজ-কালাম শিক্ষা দিয়েন।জবান দিয়ে গেলাম,এই ঘটনা কেউ জানবো না।নিজের কলিজার টুকরাকে চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে একদৌড়ে চলে যায় মেয়েটি।আর ছেলেটি এসে তার সন্তানকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে
-তুই তো আসলেই বাতিরে বেডা।নিজের ঘরের না হউক,আরেকডা আন্ধাইর ঘরের বাতি তো হইলি।আদর করে চলে যায় ছেলেটিও।

আবারো যেনো নীরবতার প্রতিযোগিতায় নামেন তিনজন। আবিদ,শাহেদ, রেনু।হঠাৎ নীরবতার অবসান ঘটিয়ে আবিদ বলে
-বিনিময়ে কতো টাকা দিলে ওদের??

(চলবে)