শিকড় পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
279

শিকড়
পর্ব -১১
(শেষ পর্ব)

সেদিনের মতো একইভাবে পুকুর ঘাটে বসে আছে আবিদ। ভিতরে উথাল-পাতাল চিন্তা। কোন সঠিক দিশা পাচ্ছেনা
ল ও।এমন একটা সমস্যা, যা নিয়ে কারও সাথেই আলোচনা করে লাভ হবে না।একমনে ভেবেই চলেছে সে।

বৈঠকখানায় আরও অনেকের সাথে বসে আছেন শাহেদ চৌধুরী ও জমির আলী। বাড়ির অনেকেই চলে গেছেন, আবার আবিদের নানা-নানু,ফুফুদের পরিবারের লোকজন থেকে গেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে কথা চলছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, আন্তর্জাতিক সব বিষয়ই উঠে আসে আলোচনায়।

ভিতরের ঘরে আসমা,রেনু,আবিদের নানু ও ফুফুরা জমিয়েছেন গল্পের আসর।রেনু আবিদকে পাওয়ার আগে তার জীবনের কষ্টের অধ্যায়ের কথা বলছেন। শ্বাশুড়ি ও ননদের আচরণ কি রকম ছিলো, সেকথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। উনার দুঃখ স্পর্শ করে উপস্থিত প্রতিটি মানুষকে। আসমার মা রেনুর মাথায় হাত বুলিয়ে কাছে টেনে নেন। অনেকদিন পর মন খুলে কাঁদছেন রেনু।
-আর কাইন্দো না মা,থাউক সেইসব কথা, ওগুলান মনে আইনা আর কষ্ট পাইও না।এমনিতেই তুমি অসুইখ্যা মানুষ।

মায়ের কথায় সায় দেন আসমাও
-মায় ঠিকই কইছো,ওইসব মন থাইকা সরায় দেন আফা,কারো লাইগ্যা আর দুঃখ পুইষা রাইখেন না।আল্লাহ তো সবই দেখতাছেন।
-তোমার মতো আমি এতো ভালোমানুষ না আসমা।উনাদের এই ব্যবহার জীবনেও ভুলতে পারবোনা আমি।
-নিজে কি আর বুঝা যায়, নিজে কেমন?
-আমার কি ধারণা ছিল জান?
-কি আফা?
-তোমরা আমাদের অপমান করে তাড়িয়ে দিবে,আমাদের কোন কথাই হয়তো শুনবে না।
-না,তা করুম ক্যান।আমাগো বাড়িত আইছেন আপনেরা,আপনাগো অসম্মান করি কেমনে?
-আচ্ছা আসমা,আবিদকে দিয়ে আসার পর তোমার বাড়ি থেকেও কি….. .
-না না আফা,আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ভালাই। এইতো বুবুরা এইহানে আছেন। যহন অনেকবার জিগাইয়াও কেউ কোন উত্তর পাইতো না,তহন রাগ দেহাইতো।আর এইটাতো আফা তাগো ভূল না।শেষদিকে তো আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আর কিছু জিগাইতেনই না।
-আসলে তোমরা পরিবারের সবাই অনেক ভালো। একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে।
-কি কথা আফা?
-আবিদতো তোমার পেটে আসা প্রথম সন্তান, তখন তুমি একদম কমবয়সীও ছিলে,তাহলে আর কোন সন্তান নিলে না কেন?
-আল্লায় না দিলে কার কি করার আছে?
-ডাক্তার দেখাওনি?
-নাহ,আমি আর কোনদিন ওই হাসপাতালেই যাই নাই।
-হাসপাতাল ছাড়াওতো ডাক্তার দেখানো যেতো।
-হ যাইতো।আল্লাহর হাতে ছাইড়া দিছি আমরা।
-তোমাকে আবারও কষ্ট দিয়ে ফেললাম।
-না না, কি যে কন।আর কোন কষ্ট নাই আমার।
রেনু হাত বাড়িয়ে আসমাকে কাছে টানেন।পাশে বসিয়ে আদর করে বলেন
-আমাকে মাফ করেছো বোন?
-এইসব আর কইয়েন না,হেয় তো কইলোই,আপনাগো উপরে রাগ নাই।
-আর তোমার?
-আমারও নাই।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন রেনু।এখন মরলেও আর কোন দুঃখ নাই।আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়ার মুখ তো এখন আছে। জমির আলীর বোন বাটিতে করে তেল গরম করে নিয়ে আসেন। রেনুর মাথায় তেল দিতে বসলে আনন্দে কেঁদে ফেলেন রেনু।

আবিদের চিন্তা-ভাবনা একই জায়গায় আটকে আছে। কুল কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। এরমধ্যেই আসে আসাদ
-ও ভাইজান,আইজও মশা কামড়ায় নাই।
-না তো।
-তাইলে মশা মনে অয় খবরখান পায় নাই।
-কি খবর?
-এই যে, আপনে মেহমান না,বাড়ির পোলা।হের লাইগ্যাইতো এহনও সম্মান দিছে।

হেসে উঠে দুজনেই। ধীরপায়ে সেখানে এসে উপস্থিত হয় আসাদের স্ত্রী।
-ভাইজান, আমারে মাফ কইরা দেন।আমি চাচীআম্মার কাছেও মাফ চাইতে যামু।
-আমার কাছে মাফ চাওয়ার কিছু নেই, নিজের ভূল বুঝলেই হবে।আমি আসাদকে বলে দিবো,তোমাকে ঢাকা নিয়ে গাইনি ডাক্তার দেখিয়ে আনবে। এখন ঘরে যাও।
আবিদ আর আসাদও রওয়ানা হয় ঘরে। ততক্ষণে বৈঠকখানা অনেকটাই ফাঁকা। আসমা এসে ছেলের খোঁজ করছিলেন,তখনই ঘরে ঢুকে ও।
-কই আছিলা বাবা?
-পুকুর ঘাটে বসেছিলাম।
-এতো রাইতে পুকুরে ক্যান গেছো? সাতার জান?
-মাথা নাড়িয়ে আবিদ জানায়,জানে।
-আইচ্ছা বও তোমরা,তোমাগো লাইগা দুধ লইয়া আসি।
জমির আলী আর আসাদও আসমার সাথে ভিতরে চলে যান।সকালে বাজার সদাই লাগবে,এখনই সব বুঝে নেয়া ভালো।আবিদ আর শাহেদ চৌধুরী বসে আছেন বৈঠকখানায়।
-তোকে এমন লাগছে কেন আবিদ?
-তোমার তো বুঝার কথা আব্বু,সবসময় বন্ধু হয়ে সবকিছু বুঝলে,আজ বুঝতে পারছোনা কেন?
-বুঝতে পারছি না কে বললো?
-তবে?
-তোর বাবা মায়ের মতো এমন মানুষ খুব কমই আছেন, তারা তোকে কিছু চাপিয়ে দিবেন না।আর আমরা তো প্রশ্নই আসে না।তোর সিদ্ধান্তই সব।
-সে-ই তো।আমার সিদ্ধান্ত। আমি কি সিদ্ধান্ত নিবো?
-তোর মন কি চায়?
-কিছুই চায় না,
-রাগ করছিস কেন।তুই এখন বড় হয়েছিস,প্রতিষ্ঠিতও হয়েছিস।তুই নিশ্চয়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবি।ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ বাবা।

ট্রেতে করে সবার জন্য দুধ নিয়ে এলো আসাদ।আসমা রেনুসহ সবাই এখন বৈঠকখানায়।টুকটাক কথা চলছে সবার সাথে সবার। এরই মাঝে আবিদের নানা সেই কথাটাই তোলেন, যা নিয়ে ও আতংকিত
-এহন তো ভাই এইহানেই থাকবা,তাই না?
-না মানে….
-এহনও মানে মানে করলে চলবো।নিজের বাপ মার কথা একবার ভাবো।
-নানাভাই, বাবা মায়ের কথা আমার মাথায় আছে কিন্তু আব্বু আম্মুর কথাওতো না ভাবলে হবে না,তাই না?

আবিদের মুখে বাবা মা শুনে আনন্দে আত্মহারা জমির আসমা। আল্লাহর কাছে মনে মনে শুকরিয়া জানান দুজনেই। জমির আলী বলেন
-আব্বা,এতোদিন তো আমরা ওরে ছাইড়া থাকতে পারছি,এহনও পারুম।আমাগো পোলা যেইহানে ভালা থাকবো,সেইহানেই থাকুক।কেউ ওরে জোড়াজুড়ি কইরেন না।
অসহায়ের মতো আবিদ বলে
-বাবা,আব্বুর মতো তুমিও আমার উপর সব ছেড়ে দিলে? কেন?আমি কোন পথে হাটবো কেউ তো বলে দাও।আমি আর নিতে পারছি না।
-এহন তুমি হাটবা তোমার পথে
-মানে?
-তুমি ডাক্তার অইছো।ওইদেশে চাকরি করো।তোমার জীবন যেইভাবে ভালো হয়,সেইভাবেই করবা।কারও মুখের দিকে চাইয়া কোন ভূল করবা না।আর তুমি বিদেশে থাকো,আর ঢাহায় থাকো,কিংবা এইহানে, তুমি কিন্তু একইরকম থাকবা আমাগো কাছে।
বিভ্রান্ত আবিদের দুই পাশে বসেন দুই মা।আসমা বলেন
-বাবা হুন,তুমি বিদেশে মানুষ অইছো।এইহানে সবসময় তোমার ভালা নাও লাগতে পারে। তাছাড়া আফা অসুইখ্যা মানুষ। তারেতো একলা ছাড়ন যায় না।
আসমা কথাগুলো বলে ছেলেকে আদর করে দেন।ভালো লাগে আবিদের। আগের মতো এখনও কোন লোভ নেই বাবা মায়ের।
অপরদিকে বাধ সাধেন রেনু,,,
-এতোগুলো দিন তো একাই কাটালে তোমরা,ছেলেকে কাছে রাখার অধিকারতো তোমাদেরই বেশি। আমি এখন মোটামুটি ভালোই আছি, কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছি। আমার কথা ভেবো না।
হতভম্ব আবিদ রীতিমতো ফুঁসে ওঠে
-আচ্ছা আম্মু, তোমরা কি শুরু করেছো বলতো।মহান হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছো নাকি সবাই। আমার কথাটা একবার ভাবো।পারলে আমাকে পথ দেখাও।
– পারবো না কেন?
-তাহলে সেটা বলো,প্লিজ।
-আবিদ
-হু
-আমাদের তো কথাই ছিলো, তুই একজন পরিপূর্ণ ডাক্তার হওয়ার পর আমরা দেশে চলে আসবো, বিদেশে আর নয়।
-হুম
-আর আমাদের যে ঢাকাতেই থাকতে হবে এমন তো কোন কথা নেই, তাই না?
-তবে??
-তোর জন্মের সময় আমরা যেখানে ছিলাম,সেই শহরে আপাতত বাসা ভাড়া করে থাকতে পারি।তুইও নিজের এলাকার মানুষের সেবা করার সুযোগ পাবি।আর এখানে – ওখানে দুজায়গাতেই থাকতেও পারবি,আসা যাওয়া করতেও পারবি।এখন বাকিটা তুই ভেবে দেখ।
– আম্মু, তোমার কিন্তু চিকিৎসার সুবিধার্থে ঢাকায় থাকা দরকার।
-না, দরকার নেই। তুই তো কাছেই থাকবি,তাছাড়া বাড়াবাড়ি হলে যেতে আর কতো সময়ই বা লাগবে।
-আব্বু, তুমি কি বল?
-তোর আম্মুর বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়। আমি একমত।তবে একটা বিষয় ছাড়া।
-কি বল?
-আমাদের সব গোছগাছ করে আসতে বেশ কয়েক মাস লেগে যাবে। এই সময়ের মধ্যে আমরা জায়গা কিনে বাসা করে নিতে পারবো ইনশাআল্লাহ।আমার ভাই তো আছেই। জমির সব ব্যবস্হা করবে।আর কাজ শেষ না হলে কিছুদিন না হয় ভাইয়ের বাড়ি থাকবো।কি বলো জমির?
-আলহামদুলিল্লাহ, খুবই উত্তম প্রস্তাব ভাইজান।
-তাহলে আবিদ টিকিট বুকিং দাও।আগে গেলে আগে ফিরতে পারবো।
অনেক বড় একটা পাথর নেমে যায় সবার বুক থেকে। বেশ রাত পর্যন্ত গল্প জমায় সবাই। মধ্যমনি আবিদ এখন নির্ভার।কাওকে দূরে ঠেলতে হচ্ছে না,সবার কাছাকাছি থাকতে পারবে সে।তার উপর তো চারজন মানুষেরই একইরকম অধিকার, কোনটাই সে অস্বীকার করতে পারবে না।

তিনদিন পরের টিকিট পায় আবিদ। তাড়াহুরোর কিছু নেই, কারণ সেই তো গিয়ে হোটেলে থাকবে। আরও দুইদিন সবাই মিলে একসাথে কাটান।তৃতীয় দিন ভোরে সবাই মিলে রওয়ানা হন ঢাকার পথে। জমির,আসমা আর আসাদও আসেন সাথে। আসাদ তো খুবই খুশি। ঢাকা চিনে আসবে, পরে বউকে নিয়ে যাবে। হোটেলে এসে আরও দুটো রুম নিয়ে সবাই ফ্রেস হতে যান।খাওয়া দাওয়া করতে করতে তাদের বেরুবার সময় হয়ে যায়।মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ বসে থাকে আবিদ। আসমার কান্না দেখে বলে
-কেঁদো না মা,তোমার ছেলে তোমার বুকে ফিরবে বলেই এখন যাচ্ছে। অনেক কষ্ট পেয়েছো তোমরা,অনেক খারাপ কথাও শুনেছো।কিন্তু আর কোন কষ্ট তোমাদের পেতে দিবো না আমি।ফিরে আসবো যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।
সবাই মিলে রওয়ানা হন বিমানবন্দরে। ফ্লাইটের অপেক্ষায় সবাই। আসাদ অবাক হয়ে দেখছে সব।
-এতোদিন খালি আসমানে বিমান দেখছি,কত্ত ছোডু দেখা যায়। আসল বিমান দেহি অনেক বড়।ভাইজান আমারে বিমান উঠতে দিবো?
-এখন দিবে না আসাদ,আমি ফিরে এসে তোমাকে বিমানে উঠাবো,ইনশাআল্লাহ।

যাওয়ার সময় হয়ে আসে,বিদায়ের ঘন্টা বেজে ওঠে। মা বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে যায় আবিদ। শাহেদ-রেনুও বিদায় নেয় জমির -আসমার কাছ থেকে। বুক ফেটে কান্না আসছে আসমার।ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকেন ছেলের যাওয়ার পথে।

একবুক আশা নিয়ে যখন জমির আলী আর আসমা ফিরার পথ ধরেন,তখন আবিদের বিমান ঠিক মাথার উপরে।

(সমাপ্ত)