শিকড় পর্ব-১০

0
176

শিকড়
পর্ব -১০

সকালের মেঠো পথ ধরে হাটছে আবিদ,সাথে আছে আসাদ।আবিদের হাতে অনেকগুলো চকোলেট। হাটতে হাটতে সেই মক্তবের সামনে এসে থামলো ওরা।
-এখনো মনে হয় ছুটি হয় নি?
-কার?
-বাচ্চাদের।
-ওদের দিয়া আপনের কাম কি?
-কিছুই না।

হইহই করতে করতে বেড়িয়ে আসে বাচ্চারা।কি সুন্দর দৃশ্য! আবিদ ওদের থামায়। টুকটাক কথা বলে, গাল টিপে আদর করে,নির্মল হাসি উপহার পায়।এবার চকোলেট বের করে ওদের দেয়।অবাক হয়ে তারা একে অপরের দিকে তাকায়।আসাদ বলে
-নেও নেও,বিদেশি চকোলেট মজা পাইবা।উনি আমাগো বাড়ির মেহমান।

চকোলেট নিয়ে খিলখিল করতে করতে চলে যায় ওরা।ফেরার পথে আবিদ বলে
-তোমাদের পারিবারিক কবরস্থানে নিয়ে চলো তো।
-ক্যান।
-যিয়ারত করতে,আবার কেন?
-চলেন।

বাড়ি ফিরে সবাই একসাথে চা খায়।আজ আর গল্প জমে না,সবাই ব্যস্ত।কতো কাজ বাকি এখনো।কাজ নেই শুধু আবিদের।এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে সবার কাজ দেখছে ও।আরও কিছুক্ষন পর থেকেই একে একে অতিথিরা আসতে থাকেন।জমির আলীর বোনরা আবিদকে দেখে কেমন চমকে যায়।ফিসফাস কানাঘুষো চলতে থাকে মহিলা মহলে।বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়িটা জমজমাট হতে থাকে।আবিদও সবার সাথে গল্পে মেতে উঠে। বেশ ভালো লাগছে ওর।আস্তে আস্তে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হয়। কয়েক বারে খাওয়ানো হয় সবাইকে। ভিতরের উঠোনে আড্ডায় বসেন অনেকে। রুমে আসে আবিদ।গাড়ি আসলেই ও বেড়িয়ে পরবে।একটা ফোন দিয়ে জানতে হবে গাড়ি কখন আসবে?উঠোনের কথাবার্তা শুনা যাচ্ছে সব।আড্ডা এবার আর আড্ডা নেই, উত্তেজিত আলোচনা চলছে। জমির আলীর বোনের গলা
-আমরা কতো জিকাইলাম,আসমাতো মুখে কুলুপ আইট্যা রইলো।নিজ বাড়ির লাইগ্যা মন পোড়ে, না অইলে আমরা এইহানে আসতাম না।আপনেরা ওতো মাইয়ারে কিছু কন না।
-কি কমু?কম তো কই নাই।আমি আর ওর বাপে কতো জিকাইছি,কিছুই তো কয় না। এহন আর জিকাই না, বাদ দিয়া দিছি।
-বাদ তো দিবেনই।নাইলে যে মাইয়ার দোষ বাইর অইবো,আমগো ভাইটাও হইছে তেমন।কতো কইলাম একটা বিয়া কর,বংশতো রক্ষা করা লাগবো।কেডা হুনে আমরার কথা।
-বুবু,এইসব কথা না কইলে কি তোমরা শান্তি পাওনা?সবাইরে ডাইকা খুশির বদলা এমন কথা ক্যান হুনা লাগে বারবার।আইজ আমি কইয়া দিলাম,এমন আয়োজন আইজই শেষ।আর হইবো না।
-হ,আমরার কথায় তো তুই দোষই খুইজা পাস।

ভিতর থেকে আবিদ বুঝতে পারছে কি নিয়ে কথা চলছে, তার ও যে কিচ্ছু করার নেই। গাড়িটা আসলেই ও এখান থেকে বেড়িয়ে যাবে। কোন পিছুটান রাখবে না।হঠাৎ দেখে দরজা দিয়ে আসাদের সাথে ঢুকছেন শাহেদ -রেনু।
-তোমরা??আমি না বারন করলাম।
-তোর আম্মুর বারন শুনেছি অনেক দিন,আর কারও বারন শুনতে পারবো না।

উনাদের বসিয়ে আসাদ ভিতরে যায় খবর জানাতে,কিন্তু এমন কথা চালাচালির মাঝে সে কিছু বলার সুযোগই পাচ্ছে না।আবিদের মতো সবকিছু শুনছেন ওর আব্বু আম্মুও।প্রত্যক্ষভাবে আসমা আর ওর বাবা মা কে দোষ দিয়ে যাচ্ছে সবাই। জমির আলীর প্রতিবাদ কাজেই আসছে না।বরাবরের শান্ত আসমা এবার বলেন
-মা গো,আমারে তোমরা মাফ কইরা দিও।বারবার তোমাগো ডাইকা আনি কিন্তু মান রাখতে পারি না।তোমাগো জামাইর লাহান আমিও চাই, এই আয়োজন আইজকাই শেষ। পরের বার থাইকা আর কাউরে ডাকুম না।( গলা ধরে এলো উনার)
-বা বা বা,কথা তো ভালাই জানা আছে, তাইলে আমরা কিছু জিকাইলে উত্তর পাইনা ক্যান?হু?কিয়ের লাইগ্যা এই আয়োজন হেইডা ওতো কইবার সাহস নাই। বড় বড় কথা কও কোন মুখে?আমরা দেইখ্যা এহনও তোমার হাতের রান্ধা খাই,আর কেউ অইলে……..

-আসসালামু আলাইকুম।
শাহেদ চৌধুরীর কন্ঠ শুনে থেমে যায় সবাই। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি সবার, শুধু চাপা উত্তেজনা আসমা আর জমির আলীর। একে অপরের সাথে যেন চোখে চোখে কথা বলছেন। জমির আলীর দিকে এগিয়ে যান তিনি।
-চিনতে পেরেছেন
জমির আলী জবাব দেন না,ছলছল চোখে শুধু তাকিয়ে আছেন। উনার হাত ধরে শাহেদ বলেন
-ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম,কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার কোন মুখ নেই।এতো বড় অপরাধের ক্ষমা হয় না।
-সব দোষ আমার, আমিই উনাকে আটকিয়ে ছিলাম(বলে উঠেন রেনু)

-আপনেরা কারা?কিয়ের দোষ করছেন। বাড়ির ভিতর পর্যন্ত আইসা পরছেন কেমনে।কে নিয়া আইলো?
-বুবু,চুপ করো,উনারা আমাগো বাড়িত কুটুম,কোন অসম্মান যেন না হয়।আসাদ,দুইডা চেয়ার নিয়া আয়।

চারিদিকে চোখ বুলিয়ে রেনু খুজছেন আসমা কে।না চিনলেও বুঝতে কষ্ট হয়নি কে আসমা।ধীরপায়ে এগুচ্ছেন তিনি,মনে ভয় আর অপরাধবোধ। কাছে গিয়ে কাধে হাত রাখতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন আসমা।কাঁদছেন রেনুও।আসমার কান্নায় হতবাক সবাই। বিরক্ত জমির আলীর বোন এবার রীতিমতো চেচিয়ে উঠেন
-নাটক শুরু করছো তোমরা?তোমাগো নাটক দেইখা আমাগোর কাম নাই।আমরা চললাম।

-আপা দাড়ান।যাবার আগে আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর জেনে যান।
-মানে?
-আমি শাহেদ চৌধুরী আর উনি আমার স্ত্রী রেহনুমা চৌধুরী।
এতোদিন ধরে আপনারা যা জানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি,সেটাই আজ জানাতে এসেছি।
-সোজাসাপটা কইলে ভালা অয়।
-ত্রিশ বছর আগে নিজের বংশের বাতি দিয়ে যাদের আলোকিত করেছিলেন উনারা, আমরাই তারা।

আবিদকে যেমন বলেছিলেন তিনি, একইভাবে পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন আবার।
-কিন্তু ওদের ঘর যে অন্ধকারই থাকলো, সেটা আমরা ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারিনি।

পিনপতন নীরবতা উঠোন জুড়ে। থেকে থেকে শুধু কান্নার শব্দ ছাড়া কোন শব্দ নেই। ঘরের ভিতর বসে কাঁদছে আবিদও।একবার ভেবেছিল বেড়িয়ে পরবে ও কিন্তু পা যেন আটকে আছে। টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ও পাচ্ছে না।
-এতো বড় কথাখান তোমরা লুকাই রাখলা,কতো কথা শুনছি মা গো,তুই বেইচ্যা দিছস কইতেও ছাড়ে নাই,তাও কিছু কইলি না।তোর বাপেরে কইতে পারলি না। কেমন বাপ আমি।( বিলাপ করে উঠেন আসমার বাবা)।আর আপনেরা,যতো যা ই কন, কামডা কি ঠিক করছেন। পোলাডারে বিদেশ লইয়া যাওনের আগে একবারও ওগো কথা ভাবলেন না।ওরা তো নিজেগো থাইকা আপনাগো কথাই বেশি ভাবছিল।
আবার আইছেন ও একলা।পোলারে বিদেশ থুইয়া এহানে আইয়া কি লাভ হইলো?

-হ,ঠিক কইছেন তালুই।আপনেরা যদি হাছাই মাফ চাইতে আইতেন,তাইলে পোলারে লইয়া আইতেন।( জমির আলীর বোন)

-আপনেরা যে মানুষ ভালা না, আবার পরমান দিলেন।একবারও মনে হইলো না, ওগোর কি লাগতাছে এহন,পোলাডারে দেখলেও এক কথা আছিল।(আরেক বোন)

চারদিক থেকে ছুটে আসা কথার তীরে জর্জরিত দুজন মানুষ মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। বেশ বুঝতে পারছেন সবাই শান্ত না হলে পরবর্তী কথা বলে লাভ নেই। জমির আলী এবার মুখ খুলেন

-অনেক হইছে, অনেক কিছু কইছেন সবাই, আর না।এতোদিন আমরারে কইছেন,এহন উনাগো।জবানের দাম রাখতে চুপ ছিলাম আমরা,কেউ কথা কইতে ছাড় দিলা না।আড়ালে আসমারে কে কি কও,আমরা সবই জানি।উনাগো কথা হুনাও ক্যান।উনারা কি চুরি করছে, আমরা নিজে দিছি, উনাগো দোষ কই।উনারা তো আর জোর করে নাই।
-ভাইরে,তুই এহনও এইগুলা কইবি।আমরা জানি আমরা তোগো কথা হুনাইছি,তয় উনারা যদি ভালমানুষ হইতো,পোলাডারে থুইয়া আইতো না।
-পোলারে উনারা থুইয়া আয় নাই,লইয়াই আইছে,তোমরাতো কওনেরই সুযোগ দিতাছো না।

শাহেদ – রেহনুমা চোখাচোখি করেন।বাবা মা ঠিকই চিনতে পেরেছেন নিজ সন্তান কে।
-লইয়া আইছে??
-হ
-তাইলে কই?
হাত দিয়ে বৈঠকখানা দেখান তিনি।আসমা একদৌড়ে স্বামীর কাছে যান।স্বামীর চোখে এক পলক তাকিয়েই ছুটেন বৈঠকখানায়।আবিদের বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরেন।জড়িয়ে ধরে আবিদও। বৈঠকখানা থেকে আসা কান্নার শব্দে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। উঠোনে থাকা একটা মানুষেরও চোখ শুকনো নয়। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছেন বৈঠকখানায়। উঠোনে চুপচাপ বসে আছেন জমির আলী, শাহেদ আর রেহনুমা।
বৈঠকখানার ভিতরে কান্নার রোল পরেছে যেন।আবিদের নানু ও ফুফুরাও কেঁদে চলেছেন সমানতালে। ছোট ফুফু বলছেন
-এতোগুলা দিন আমাগো রক্ত আমাগো থাইকা সরাই রাখছো তোমরা, এহন একটু আদর করবার সুযোগ তো দিবা।
সবার আদর ভালোবাসায় সিক্ত আবিদ নিজেকে ধাতস্থ করে মায়ের সাথে ভিতরের উঠোনে আসে।এগিয়ে যায় জমির আলীর দিকে। দুই হাত দিয়ে ছেলেকে আকড়ে ধরেন তিনি।নিজ বুকে ছেলেকে টেনে নেন জন্মদাতা বাবা,পাশে দাঁড়িয়ে ছেলের কাঁধে হাত রেখে সাহস যোগান আরেকজন বাবা।আবিদ দুই হাতে তার দুই বাবাকে জড়িয়ে ধরে। কাছে ডাকে দুরে দাঁড়িয়ে থাকা রেনুকেও।অপূর্ব মিলন।তবুও যেন এই আনন্দের মাঝে শুনা যায় ভাঙ্গনের সুর।শাহেদ বলেন
-এবার তো আমাদের ফিরতে হবে।
-কি কন ভাইজান।
-হ্যাঁ,পৌছুতে বেশ রাত হয়ে যাবে। আবিদের কথা বলছি না,আমরা আসি।
-আইজ আমাগো ঈদ।কেউ কোথাও যাওন চলবো না।আমি সকল মেহমানরে অনুরোধ করতাছি,আইজ রাইতে থাকনের লাইগা। যারা না গেলেই না,তারা রাইতে খাইয়া যাইবেন।আইজ আর কইতে কোন বাধা নাই,এতোগুলা বছর ধইরা আয়োজন করছি কারন,আইজ আমাগো পোলার জন্মের তারিখ। ও আসাদ, রমজান বাবুর্চিরে খবর দে,তোর চাচীর হাতে এহন আর কাম উঠবো না।

অগত্যা শাহেদ চৌধুরী গাড়ি ছেড়ে আসেন।দরকার মতো ফোন দিলে যেনো আসে এটাও বলে দেন।শাহেদ – রেনুর বুকে চাপা ব্যাথা থাকলেও ভালো লাগছে তাদের। অনেক হালকা লাগছে যেন, তাছাড়া এতোদিন আত্নীয়-স্বজন ছাড়া একা কাটিয়েছেন, এই কোলাহল খুব উপভোগ করছেন। জমির আলীর নিষেধাজ্ঞায় কেউ আর তাদের দিকে আঙুল তুলছে না বরং আবিদের বিভিন্ন সময়ের গল্প শুনছে।আসমা যেন ফড়িং এর মতো উড়ছেন, ছেলেকে একটু পরপর এসে আদর করেন,আবার চা-নাস্তার আয়োজনে ছুটেন।রাতের খাবার যতোই বাবুর্চি রাঁধুক, তদারকি তো করতেই হয়।সবাই মিলে চা নিয়ে আড্ডা বসিয়েছেন ভিতরের উঠোনে। চেয়ার,চৌকি,মোড়া ছাড়াও বড় বড় দুটি শীতলপাটি বিছানো হয়েছে। আস্তে আস্তে সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে আবিদ।কে তার কোন সম্পর্কের ভাই /বোন জানছে।শীতলপাটির উপর আরাম করে বসে আছে ও।আসাদ এসে পাশে বসে। খুব খুশি ও।আবিদ ভাবছে
-কি থেকে কি হয়ে গেল।ওতো ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।নিজের বাবা মাকে পেয়ে ভালো লাগছে সত্যি, সাথে ভয়ও হচ্ছে। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তার। আব্বু আম্মু তো আর এখানে থাকবেন না।বাবা মা ও ঢাকা যাবেন না।সে কোনদিকে যাবে।আবারও চিন্তা, আবারও সেই টানাপোড়েন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এই ভয় তার আগে থেকেই ছিল, তাই চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয়নি। এবার কি করবে সে?

-বিদেশি হও আর যাই হও আমাগোরইতো মানুষ, আমাগো নাতিরে আল্লাহ দেহাইছেন, হাজার শুকরিয়া। তা আমাগো চিনন লাগবো না?
-চিনি তো।আপনি ওই ঘরের দাদু,আর আপনি এই ঘরের। হয়েছে?
-হইছে, হইছে।তোমার দাদা-দাদি থাকলে আইজকা কি খুশি করতো।একটা আক্ষেপ লইয়া দুনিয়া ছাড়লেন তারা।

আবিদ হাত ধরে বসায় তাদের। অনেক গল্প যেন জমানো সবার। আসমা যে কতোবার জানতে চাইলেন ছেলে কিছু খাবে কি না।রেহনুমাকে বিশ্রাম নেয়ার জন্য বিছানা ঠিকঠাক করে দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু বেশিক্ষণ বিছানায় থাকেন নি তিনি।সেই আবার উঠোনে চলে আসেন।দুপুরের মতো এখনও কয়েকবারে খাওয়া হয়।যারা থাকবেন না,তারা আগে খেয়ে বিদায় নিয়ে চলে যান।সবশেষে একসাথে বসেন বাড়ির সবাই।

( চলবে)