শিকড় পর্ব-০৯

0
159

শিকড়
পর্ব-৯

রিক্সায় বসে আবিদ ভাবতে থাকে, কি করা উচিৎ ওর।নিজের সাথে যে বাজি ধরেছিল তাতে পুরোপুরি হেরে গেছে সে।এখানে এসে তার ভূল ধারণা ভেঙে গেছে। ভাগ্যিস উনারা তার এমন ভাবনার কথা জানেন না,না হলে উনাদের সামনে সে কোন মুখ নিয়ে দাড়াতো।ওর আম্মুর রাগ করার কারনও সে এখন বুঝতে পারছে। উনারা কোন টাকা – পয়সা নেয়ার প্রশ্নই আসে না, যথেষ্ট ভালো অবস্থা উনাদের আগে থেকেই। আর মহান সাজার জন্য করে থাকলে তো গ্রামের সবাই জানতো বিষয়টা।আসাদের বউয়ের মতো আরো অনেকেই হয়তো উনাকে কটু কথা বলে। হেরে গিয়ে তার অস্থিরতা বেড়ে গেছে বহুগুণ। কি করবে সে,কি করা উচিৎ, ভেবে পাচ্ছে না ও।নিজের পরিচয় কি জানাবে,না চেপে যাবে????এদিকে আব্বু আম্মুর সাথে এ নিয়ে আলোচনা করতেও মন সায় দিচ্ছে না।কতোটা কষ্টে উনারা আছেন সেটা সে ভালোই বুঝে। রিক্সাওয়ালার ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আবিদ
-কই যাইবেন এহন?জমির চাচার বাড়িত দিয়া আসমু?
-না,এখানে জামা কাপড়ের ভালো কোন দোকান আছে?
-আছে তো,যাইবেন?
-হ্যাঁ।
-আপনের কি এইগুলান ভালা লাগবো? কত্তো বড় বড় দোকান থাইকা আপনেরা কিনেন।এইগুলা কিন্তু ওতো বড় না।
-আচ্ছা, সমস্যা নাই। গিয়ে তো দেখি।
বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরে দেখে আবিদ। আসলেই তেমন কিছু এখানে নেই, আবার একবারে খারাপও না।আসমার জন্য ও দুটি শাড়ি পছন্দ করে, জমির আলীর জন্য পাঞ্জাবি-পায়জামা নেয়,আসাদের জন্যও শার্ট নেয়।দোকান থেকে চলে আসবে এমন সময় আবার ফিরে যায় দোকানে।আসমা বেগমের বাবা মায়ের জন্য শাড়ি -পাঞ্জাবি কিনে আবিদ।
এবার ফেরার পথ ধরে। জিনিসগুলো কিনলো বটে কিন্তু কিভাবে দিবে সে।কি বলেই বা দিবে।উনারা যদি নিতে না চান,না চাইতেই পারেন,ধুর,,এতো চিন্তা আর ভালো লাগছে না।দিতে না পারলে না বলে রেখে চলে যাবে।বাজারে পৌঁছে গেছে ও। জমির আলী বাড়ি যাননি। ওর জন্য অপেক্ষা করছেন।একসাথে যাবেন বলে।রিক্সায় উঠে বসেন উনি,কোন কথা বলছেন না।আবিদই বললো
-হেটেই যাওয়া যেতো
-না,রইদ বেশি
-আপনি আগে চলে গেলেই পারতেন
-সমস্যা নাই,কাজ হইলো?
-হুম
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান ওনি,চোখ সরিয়ে নেয় আবিদ।কথা আর এগুয় না।বাড়িতে ঢুকেই জমির আলী ভিতরে চলে যান। বুক ফেটে কান্না আসছে। কিন্তু কাঁদতেও পারছেন না।ছেলেটা কে?এতো আপন আপন লাগে, আবার ঔ ঘটনাও জানতে ইচ্ছুক।দরদর করে ঘামতে থাকেন তিনি। আসমা বেগম ঘরে ঢুকে উনার এই অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যান
-কি হইছে আপনের? কি হইছে? এমন করতাছেন ক্যান?
ধপ করে পরে যান জমির আলী।আসমা বেগমের চিৎকারে বাড়ির অনেকেই দৌড়ে আসে।আসে আবিদও।চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেয়া হয়।আস্তে আস্তে চোখ খুললেন তিনি।ডাক্তার হিসাবে আবিদের কাছে প্রশ্ন আসে,কি হয়েছে? এই প্রথমবার নিজের ডাক্তারিবিদ্যা নিয়ে অসহায় অনুভব করে ও।স্টেথোটা পর্যন্ত সঙ্গে নেই। এছাড়া সে যেটা বুঝতে পারছে তা বলতেও পারছে না।সবাইকে বললো কড়া রোদে গরমে এমন হয়েছে হয়তো।কিন্তু সে ঠিকই বুঝতে পারছে প্রচন্ড মানসিক চাপের ফল এটা।চুপচাপ শুয়ে আছেন জমির আলী। ইচ্ছে করেই চোখ বন্ধ করে রেখেছেন। উনাকে বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে সবাই চলে যান।আবিদ নামাজ পড়তে সামনের ঘরে আসে।নামাজ শেষে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কোন পথে সে হাটবে দিশা খুঁজে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়, আজই চলে যাবে সে।
আগামীকাল তার জন্মতারিখ। তার খুব ইচ্ছে ছিল, সে কাছ থেকে দেখবে, এই দিনটি কারও মনে আছে কি না,এই দিনে ওকে কেউ মনে করেন কি না।কিন্তু এখন আর কোন কিছু দেখার সাহস পাচ্ছে না সে।ঢাকায় গিয়েই আম্মু আব্বুকে বুঝিয়ে ওদেশে ফিরবে।কোন কিছু আর উলট পালট করার দরকার নাই, নিজের ভিতরের ক্ষতটা না হয় লুকানোই থাক।
বিকেলের দিকে আবিদ জমির আলীর সঙ্গে দেখা করতে ভিতরে যায়।একইভাবে শুয়ে আছেন তিনি। শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকান।
-খেয়েছেন আপনি?
উপর নিচে মাথা নাড়েন তিনি,মানে খেয়েছেন। পাশ থেকে আসমা বেগম বলেন
-মিছা কথা, এক্কেবারে খায় নাই। একটু মুখে দিয়াই থুইয়া দিছে।তুমিওতো কিচ্ছু খাইলা না বাবা,সব পইরা রইলো।
-আপনি খেয়েছেন?
-হ,সবাই না খাওয়া আর আমি পেট পুইড়া খামু।
ইচ্ছে করেই আবিদ বলে, আমার এখন খুব খিদে পেয়েছে
-আইচ্ছা, খাবার নিয়া আসি আমি।ভাত খাইবা বাবা,না হাতের সেমাই করছিলাম,লুচি দিয়া খাইবা।
-এক কাজ করেন, আপনিসহ সবার জন্য দুধ নিয়ে আসেন।আমি আসছি।
লাগেজ খুলে দুটো কর্নফ্লেক্সের প্যাকেট নিয়ে আসে ও।দুটো বাটিতে নিয়ে দুজনকে খেতে দেয়।বাকিটা আসমার হাতে দেয় রাখার জন্য।
-নিন খেয়ে নিন এবার।
-তুমি না কইলা ক্ষিদা লাগছে। তোমার লাইগ্যা নিলা না যে।
-আমি আপনার বানানো সেমাই লুচি খাবো
-তাইলে নিয়া আসি
-না,একটু পরে খাবো, আপনারা খাওয়া শেষ করেন।
চুপচাপ খাচ্ছেন জমির আলী। একটা কথাও বলছেন না। আবিদ আড়চোখে মাঝে মাঝে দেখছে। আসমা বেগম বলেন
-গরমে মাথা ঘুরছে তো বুঝলাম,এমন ঝিম মাইরা গেলেন ক্যান।শরীরে কি অসুবিধা না কইলে বুঝমু কেমনে? এতোগুলান কাম এহন কে সামলাইবো।আসাদেও তো পারবো না সব করতে।
যথারীতি চুপ জমির আলী। একা একা কথা বলতে থাকেন আসমা।আনমনা আবিদের কানে সব কথা যাচ্ছে না।আসমা বেগম আবিদকে খাবার এনে দেন।সবার খাওয়া শেষ হলে আবিদ বলে
-আমি আজ চলে যাবো।
-চইলা যাইবা( বিষন্ন আসমার কন্ঠ)
-জি,আমার কাজ শেষ।
– ওহ
-আমি ভাবছিলাম কালকের দিনডা থাকবা
-নাহ,কাজ যখন শেষ তখন চলেই যাই
-আসলে বাবা,কালকে আমাগোর বাড়িতে অনেক মেহমান আইবো,এহন তুমি চইলা গেলে কেমনডা লাগে কও।তাছাড়া আমরাও আশা করছিলাম তুমি থাকবা।
-কাল কি কোন অনুষ্ঠান আছে?
-সেসব কিচ্ছু না,বছরের এই দিন আমরা সব আত্নীয় স্বজনদের নিয়ে কাটাই।দুপুরে সবার দাওয়াত থাকে।
-কোন বিশেষ দিন কি?

দিশেহারা বোধ করেন আসমা। কি জবাব দিবেন। নিজের জীবনের সবচেয়ে বিশেষ দিন কিন্তু কি বলবেন?
-আমার অনুরোধ বাবা।কাইলকার দিনডা থাকো।আপনেও উঠেন। বিছানায় পইরা থাকলে খারাপ লাগবো বেশি। একটু হাটা চলা করলে ভালা লাগবো। সদাই-পাতি তো সকালেই আইনা দিলেন,বাকি কাজ আসাদরে নিয় আমিই করমু নে।
এঁটো প্লেটবাটি নিয়ে চলে যান তিনি। রান্নাঘরে গিয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে উঠেন। আর পারছেন না। এই ছেলেটার জন্য এতো টান কেন হচ্ছে?
ওদিকে জমির আলী আলতো করে আবিদের হাত ধরেন।শিহরিত হয় আবিদ। কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পরে দুজনের চোখ থেকেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আবিদ বল
-চলুন,মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে আসি।নিয়ে যাবেন না আমাকে?
মাথা নেড়ে সায় দেন তিনি।

-আব্বু কি করো?
-এইতো আছি, তোর খবর বল বাবা।
-আমি আজই চলে আসতে চেয়েছিলাম,কিন্তু পারলাম না।কাল বিকেলে রওয়ানা হবো।আম্মুকে বলে রেখো,এসেই ফিরে যাওয়ার টিকেট করবো কিন্তু।
-কি হয়েছে? কোন সমস্যা? বল আমাকে।
-কোন সমস্যা নেই আব্বু, আমার এখানে ভালো লাগছে না মোটেও।
-ফিরতে তো আমাদের হবেই,ওখানে তো কিছু গুছিয়ে আসিনি আমরা।
-সেটাই, ফিরতে যখন হবে, তখন দেরি কেন?
-ওদের কিছু বলবি না?আমাদেরও তো দেখা করা বাকি।
-তোমরা পরে সময় করে এসো,আমি কিচ্ছু বলতে চাই না
-কেন?
-তুমি না চেয়েছিলে সব স্বাভাবিক চলুক।
-হ্যাঁ,কিন্তু ওদের বলতেও তো চেয়েছি আমি।সব ঠিক থাকবে, তুই দেখিস।
-আব্বু প্লিজ, কিছুই ঠিক থাকবে না। তুমি বুঝতে পারছো না।উনারা দাবি করতেই পারেন যেন আমি এখানেই থেকে যাই।কারন……
-কারন???
-কারন তোমাদের মতো উনারাও একা আব্বু। উনাদেরও কেউ নেই।
-কি বলছিস আবিদ?আল্লাহ কি আমাকে কখনো মাফ করবেন? ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
-গ্রামের সবাই উনাদের পছন্দ করে, সম্মানও করে। একইসাথে যে কোন শুভ অনুষ্ঠানে এড়িয়ে চলে।অনেকে আবার কটু কথা বলতেও ছাড়েনা।অবশ্য সবাই নয়।
-আমি আর শুনতে পারছিনা বাবা,খুব ছোট লাগছে নিজেকে।
-কষ্ট পেও না আব্বু। যা হওয়ার হয়ে গেছে, আমি কিন্তু কালই ফিরছি।পৌঁছাতে রাত হবে।তুমি একটা গাড়ি পাঠিয়ে দিও বিকেলে। আমিতো এখানে কিছুই চিনি না।
-হুম
-আব্বু রাখি,কাল দেখা হবে।আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আস সালাম।

-ডাক্তার সাব আসমু?
-এসো আসাদ।
-আমার বউরে নিয়া আসি,একটু দেইখা দিবেন?
-না
-জি??
ঠিকই শুনছ।না করেছি।কারন যার মনে সমস্যা তারে দেখে কে কি করতে পারবে।সে থাক তার মতো, তুমি চলো আমার সাথে, ভিতরে যাবো।
কাপড়ের প্যাকেটগুলা নিয়ে নেয় সাথে। মাত্র চা রেডি করে ওকে দিতে যাচ্ছিলেন আসমা,ওকে দেখে হাসেন।
-আসো,এইহানে চা খাও আইজকা।
-তাইতো চলে এলাম।
-ভালা করছো।এক্কেরে ঘরের পোলার মতো কাম করছো।
-আমি কিন্তু আপনার কথা শুনেছি, আজ যাইনি।এবার আপনাকেও আমার কথা শুনতে হবে যে।
-কি কথা বাবা।
-আমি খুবই সামান্য কিছু উপহার এনেছি, এগুলো আপনাদের নিতে হবে।
-কিন্তু বাবা….
-না হলে আমি এখনও রওয়ানা দিতে পারবো কিন্তু।
-আচ্ছা, আচ্ছা, আগে চা খাও।
চা পর্ব শেষে আবিদ উপহারগুলো বের করে। আসাদতো যারপরনাই খুশি।সে কল্পনাও করে নি ডাক্তার সাহেব ওকে উপহার দিবেন। বাকি দুজন প্যাকেটগুলো আদরে জড়িয়ে রেখেছেন, ভিতরে কি আছে দেখার কোন ইচ্ছেই হচ্ছে না,পুরো প্যাকেট জুড়েই যেন শুধু মায়া। আসমা বেগমের হাতে বাকি দুটো প্যাকেট দিয়ে আবিদ বলে

-চারজন মুরুব্বির মধ্যে দুজনকে আমি পেলাম না।বাকি দুজনকেও দেখিনি ঠিক কিন্তু উনাদের জন্য কিছু কিনতে ইচ্ছে হল।আশা করছি আপনি অমত করবেন না।

কথা হারিয়ে ফেলেছেন আসমা।বারবার মনে হচ্ছে কে এই ছেলেটি?ও কি তার…..। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
-আগামীকালের বিষয়টা কি?
-চাচা-চাচী কাইলকা আমাগো বেবাগ আত্নীয়রে দাওয়াত করছে। এই বাড়ির যারা বাইরে থাহে তারাও আইবো।চাচীর বাপের বাড়ির মানুষও আইবো।বছর বছর সবাই এই দিনে একলগে হয়।
-আচ্ছা, খুব ভালো তো।আমি তাহলে যাওয়ার আগে সবার সাথে দেখা হয়ে যাবে।
-হ,কিন্তু আপনে চইলা যাইবেন?
-যাবো না?যেতে তো আমাকে হবেই।

(চলবে)