#-সেই তুমি
#-সানজিদা সন্ধি
#- পর্ব-৮
আহনাফ রুমে আসার পর আবির চৌধুরী বললেন, “আহনাফ! আমার বন্ধু সাজ্জাদ খান খানিকক্ষণ আগে আমাকে ফোন করে বললো আমার কলেজের আহনাফ চৌধুরী নামের টিচারকে ট্রান্সফার করিয়ে দিতে। কারণ তার মেয়ে চাচ্ছেনা আহনাফ চৌধুরী এই কলেজে থাকুক। সাজ্জাদ একজন পলিটিকাল লিডার। কলেজ জীবন থেকে তার সাথে আমার পরিচয়। নানান কারণে তোমার সাথে তার পরিচয় হয়ে ওঠেনি। আর তার মেয়ে হলো সুহাইলা মুবাররাক জাফনা। সাজ্জাদের মেয়ে জাফনাকে আমি চিনি। ভীষণ লক্ষ্মী মেয়ে সে৷ আর সে যেহেতু তোমার ট্রান্সফার চাইছে তারমানে কিছু হয়েছে। তোমার নাম সাজ্জাদের মুখে আর জাফনার এরকম চাওয়া শুনে আমি অবাক হই ভীষণ। কি কাজ যে তুমি করেছো! আমি জানি তোমার রাগ বেশি, হুটহাট ডিসিশান নাও। তবে কলেজের কোনো স্টুডেন্ট তোমার ট্রান্সফার চাইবে এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা। তুমি আমাকে পুরো বিষয়টা খুলে বলো। জাফনা সাজ্জাদকে খুব বেশি কিছু বলেনি তাই সাজ্জাদ পুরো বিষয়টা জানে না। তবে জাফনা তার একমাত্র মেয়ে। তার জন্য সে দুনিয়া এনে দিতে পারে। আমি ওকে শান্তনা দিয়ে বলেছি বিষয়টা আমি দেখবো। কাল জাফনা আর তুমি আমার রুমে আসবে। আমি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে তোমার আর জাফনার ঝামেলা মেটাতে চাই৷ এবার তুমি আমাকে বলো বিষয়টা। কি হয়েছে তোমাদের মধ্যে? ”
আবির চৌধুরীর মুখে পুরোটা শুনে শুরুতে ভীষণ রাগ হলো আহনাফের। সাহস কতো মেয়ের! এতদূর অবধি এগিয়েছে। তবে আহনাফও তাকে ছেড়ে দেবে না। এতক্ষণে আহনাফ বুঝলো জাফনা কেন এতো জোর গলায় তাকে থ্রেট দিয়েছে। পলিটিকাল পাওয়ার থাকার কারণে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। মনে মনে হেসে উঠলো আহনাফ আর বললো, এসব পাওয়ার দেখিয়ে লাভ হবে না জাফনা। আমার হাত থেকে তোমার কিছুতেই নিস্তার নেই আর তুমি না পারবে আমার সাথে জিততে।
আবির চৌধুরীর ডাকে আহনাফের ধ্যান ভাঙলো, তিনি ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস বললেন,আহনাফ আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি। আহনাফ অট্টহাসি হেসে বললো, বাবা একটা সিম্পিল বিষয় নিয়ে জাফনা এতো বাড়াবাড়ি করবে আমি বুঝিনি৷ হ্যাঁ জাফনার সাথে কলেজের প্রথম দিন থেকেই আমার পরিচয়। একটা বিষয় নিয়ে দুজনের মধ্যে হালকা ঝামেলা হয়েছে। যাইহোক কলেজের বিষয় সেখানেই থাকুক। কাল নাহয় মুখোমুখি বসেই এর হেস্তনেস্ত করবো।
আবির চৌধুরী ধমকে বলে উঠলেন,টিচার আর স্টুডেন্টের মধ্যে কীসের ঝামেলা হ্যাঁ? একজন শিক্ষক আর ছাত্রের সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে এসেছো? শিক্ষার্থীরা হয় সন্তানের মতো। তারা ভুল করলে বোঝাবে, শাসন করবে তবে ঝামেলা শব্দটার স্থান হলো কীভাবে?
জাফনার ক্ষেত্রে সন্তান শব্দটা শুনে আহনাফের কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠলো৷ ঝোঁকের বসে বলেই উঠলো,বাবা আমাকে কি বুড়ো মনে হয় তোমার? যে কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা আমার সন্তান হবে? কত মেয়ে আমার জন্য পাগল জানো? আর জাফনা মোটেই আমার মেয়ে নয়! বেফাঁস কথা বলে নিজেই থমকালো আহনাফ। তার বাবা ছাত্র আর শিক্ষকের সম্পর্ক বুঝিয়েছে। তার সাথে স্টুডেন্টদের নয়। মুখটা চোরের মতো কাচুমাচু করে আহনাফ বলে উঠলো, কালকে যা হবে সামনাসামনিই হবে। এখন এসব নিয়ে কথা বলতে আমি মোটেই ইচ্ছুক নই। আমি ঘরে গেলাম।
ছেলের হাবভাব কিছুই বুঝে উঠলেন না আবির চৌধুরী। কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন তার ছেলে কবে থেকে এটা নোটিশ করছে যে তার পেছনে মেয়েরা ঘোরে? নোটিশ করলে তো ভালোই হতো। ছেলেটা অতীতের কাহিনীর পরে সম্পর্ক কথাটা সহ্যই করতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবির চৌধুরী ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। ড্রইং রুমের সোফায় আতিয়া চৌধুরীর বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখে তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন তার কাছে। আতিয়ার হাতে কতগুলো ব্যাগ, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেগুলো কিনতে সে গিয়েছিলো। আবির এসেই আতিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ব্যাস্ত গলায় বলে উঠলেন, কি হয়েছে আতিয়া? তোমার শরীর খারাপ করছে? ডক্টরের কাছে যাওয়া দরকার। কষ্ট করে একটু রেডি হয়ে নাওতো। আবিরকে ব্যাস্ত হতে দেখে আতিয়া বললো, আমি ডক্টরের চেম্বার থেকে এসেছি কেবল। তুমি চিন্তা করোনা আমি ঠিক আছি। আবির চৌধুরী কাঁদোকাঁদো গলায় বললো, তুমি মোটেই ঠিক নেই আতিয়া। আবির চৌধুরী আতিয়াকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আতিয়ার মূল্য সে ভালোই দিতে জানে। দুই বছর আতিয়ার পেছনে ঘোরার পরে তবেই আতিয়া রাজি হয়েছিলো আবিরের প্রেম প্রস্তাবে।
আতিয়া তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। কিশোরী বয়সের রূপ যেন ঠিকরে পড়তো তার মধ্যে। কোমড় অবধি ঘন কালো চুল, দুধে- আলতা গায়ের রঙ, ঘন পাপড়ি যুক্ত ডাগর ডাগর চোখ, ভরাট মুখ আর অসাধারণ শারীরিক গঠন। সবমিলিয়ে পাগল করা রূপ। আতিয়ার জন্য আসা বিয়ের প্রস্তাব সামলাতে সামলাতে হাঁপিয়ে উঠতেন তার বাবা। গ্রামের, বৃদ্ধ, যুবক কারোরই নজর ফিরতো না তার দিক থেকে। গাঁয়ের লোকগুলো তাকে দেখলেই চোখ দিয়ে গিলে খেতো, এতোকিছুর পরেও আতিয়ার মধ্যে নিজেকে আড়াল করার কোনো হেলদোল দেখা যেতো না। সরল মন নিয়ে সে ঘুরে পাড়াতো এই পাড়া, ওই পাড়া।
এদিকে ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আতিয়ার দেখা পায় আবির। প্রথম দেখাতেই চোখ থমকে যায় তার আর তারপর শুরু হয় এক অন্যরকম পাগলামি। এলাকার বেশ কয়েকটা ছেলেকে নিয়ে সারাদিন আতিয়ার পেছনে পড়ে থাকা। এর ওর হাত দিয়ে চিঠি পাঠানো। আতিয়া এসবের কিছুই বুঝতো না। এদিকে আবির নিয়ম করে এসব করে যেতো। যেই আবির কখনো কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যেতে চাইতোনা সেই আবিরই সুযোগ পেলেই ফুপুর বাড়ি এসে পড়ে থাকতো। ভার্সিটি পড়ুয়া একটা ছেলের এসব কাজকর্ম ভীষণ হাস্যকর। একপর্যায়ে তার ফুপুও সবটা বুঝতে পেরে তাকে ধৈর্য ধরতে বলেন। দশম শ্রেণীতে ওঠার পর হুট করেই যেন আতিয়া বড় হয়ে গেলো, নিজ থেকে পাড়া বেড়ানো বন্ধ করলো, লেখাপড়ার পাশাপাশি ঘরকন্নার কাজে মন দিলো আর আবিরের পাগলামি আসলে কি সেটাও বুঝতে পারলো। কিন্তু আবিরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সে তখনও অনড়। সেই বছর শেষের দিকে এসে আবিরকে গ্রহণ করে আতিয়া। এরজন্য অবশ্য বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আবিরকে। আতিয়া কলেজ পাশ করলে তাদের বিয়ে হয় আর বিয়ের পরেও সে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। অনেক সাধনায় পাওয়া আতিয়ার কখনো অযত্ন হতে দেয়নি আবির। কিছু হলেই পাগল হয়ে যায় সে।
আবিরকে খুব বেশি চিন্তিত হতে দেখে আতিয়া শান্ত হতে বলে সবটা খুলে বললো তাকে, জানো আবির! আজ অনেকদিন পরে সঞ্জয়ের সাথে দেখা হলো। ও তোমার কলেজেরই একজন টিচার। এ কথা শুনে আবির বললো, হ্যাঁ আমি জানি। ভেবেছিলাম তোমাকে আর আহনাফকে সারপ্রাইজ দেবো কিন্তু তুমি তো জেনেই গেলে। তারপর? আতিয়া আবার বলতে লাগলো, আহনাফের সঙ্গেও দেখা হয়েছে সঞ্জয়ের। সঞ্জয় কিছু না জেনেই অদিতির কথা জিজ্ঞেস করে ফেলে আবিরকে। আর এরপর আবির ওর সাথে বাজে ব্যাবহার করে। আবিরের আচরণের পেছনের কারণ জানতে চেয়েছিলো সঞ্জয় আর সেসব বলতে গিয়েই খানিক অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি।
আতিয়ার কথা শুনে আবিরের কপালে ভাজ পড়লো৷ অদিতির কথা শুনে আহনাফ এখনো রিয়্যাক্ট করে। তবে কি এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি আহনাফ?
আতিয়ার ফোনের রিংটোনে সম্বিত ফিরে পায় আবির। ফোনের স্ক্রিনে আননোন একটা নম্বর ভাসছে। ফোন রিসিভ করতেই সঞ্জয়ের গলা শুনতে পেলো আতিয়া। আতিয়ার শরীরের অবস্থা জিজ্ঞেস করার পরপরই আতিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে পরের ঘটনা জানতে চায়। সঞ্জয় বলে মামনি আমি কিছু না জেনে শান্তি পাচ্ছি না আর আমার ধৈর্যও ভীষণ কম তুমি তো জানোই৷ তোমার শরীরের এই অবস্থায় আমি এসব জানতে চাচ্ছি বলে মাফ করো।
আতিয়ার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে আবির কথা বলতে লাগলো৷ সঞ্জয় কুশল বিনিময় করেই জানতে চাইলো অদিতি কেন আহনাফকে ছেড়েছিলো।
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো, অদিতি আহনাফকে একদিন হুট করে জানায় সে আর আহনাফের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারবেনা আর আহনাফ সেটা শুনে পাগলের মতো তার কাছে ছুটে যেতে গিয়ে একটা ছোটখাটো এক্সিডেন্ট করে। এরপর আহনাফের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে অদিতি বলে সে ফাজলামো করেছে সাথে ক্ষমাও চায়। কিন্তু একদিন অদিতির সাথে অন্য একটা ছেলের সম্পৃক্ত থাকার কথা জানতে পারে আহনাফ আর সরাসরি অদিতির মুখোমুখি হয় এরপর অদিতি বলে আহনাফের সাথে সম্পর্কে থাকাকালীনই সে অন্য একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায় আর সে কারণেই আহনাফকে ছাড়তে চায়।
কথাগুলো শুনে সঞ্জয় এবার চরম ধাক্কা খেলো। মনে মনে বললো কোথাও একটা ভুল আছে। অদিতি এমন মেয়েই নয়।
চলবে,,,,