সেই তুমি পর্ব-০৭

0
3208

#- সেই তুমি
#-পর্ব-৭
#- সানজিদা সন্ধি

স্বপ্নে দেখলো আহনাফ তাকে একটা ঘরে বন্দি করে ইচ্ছেমতো মারছে। জাফনা চিৎকার করে ছাড়া পেতে চাইছে কিন্তু আহনাফ আঘাত করে চলেছে জাফনাকে৷ এরকম স্বপ্নের হেতু বুঝে উঠতে পারলো না জাফনা। তবে ভেবে নিলো আহনাফকে নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনার ফলেই এমন হয়েছে।

ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে গেলো জাফনা। তার বাবা সাজ্জাদ খান টেবিলে বসে আছেন। জাফনা তাকে দেখেই বাবা বলে জড়িয়ে ধরে কথার ঝুড়ি খুলে বসলো। সাজ্জাদও সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে মেয়ের সাথে গল্প মত্ত হলেন। একপর্যায়ে জাফনা বলে উঠলো, বাবা আমি কিছু চাই তোমার কাছে। জাফনার কথা শুনে সাজ্জাদ হোসেনের মুখে প্রশস্ত হাসির রেখা দেখা গেলো। জাফনা সচারাচর খুব প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া কিছুই চায়না বাবা – মায়ের কাছে। তাই আজ যখন সে নিজ থেকে কিছু চেয়ে বসলো তখন সাজ্জাদ হোসেন বেজায় খুশি হলেন। সাজ্জাদ হোসেন একজন পলিটিক্যাল লিডার। ভীষণ দাপট তার। তিনি চাইলে অনেক কিছুই করতে পারেন। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও মা? জাফনা বললো,” আমাদের কলেজে একজন নতুন টিচার জয়েন করেছে। আমি তার ট্রান্সফার চাই। এবং সেটা যেকোনো কিছুর বিনিময়ে। ” জাফনার কথা শুনে সাজ্জাদ খান ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। এমন কিছু চাওয়ার মেয়ে সে নয়। চেয়েছে যেহেতু এরমানে বড় কোনো ঝামেলা আছে। জাফনাকে চিন্তা করতে নিষেধ করে তিনি বলে উঠলেন, এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না মা। তুমি যা চেয়েছো সেটা পেয়ে যাবে। কিন্তু তুমি বিনা কারণে এমন করবে এটা আমি বিশ্বাস করিনা। বলো কি হয়েছে। জাফনা মৃদু হেসে বলে উঠলো, আমি বিষয়টা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে নিষেধ করছি বাবা। আশা করি বিষয়টা নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। জাফনার উত্তর শুনে সাজ্জাদ খান আর কোনো কথা বাড়ালেন না। আহনাফের সমস্ত ইনফরমেশন নিয়ে কলেজের প্রিন্সিপালকে বিষয়টা জানালেন। ঘটনাক্রমে আবির চৌধুরী আর সাজ্জাদ খান পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু। সাজ্জাদকে নিশ্চিত থাকতে বলে আবির আহনাফকে ঘরে ডেকে পাঠালো।

অসুস্থ শরীর নিয়েও আতিয়া চৌধুরী সুপার শপে গিয়েছে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে। বাড়ির কাজের লোকেরা অন্য কাজে ব্যাস্ত থাকায় তিনি নিজেই এসেছেন। এদিকে সঞ্জয় এখনো বিয়ে করেননি। ব্যাচেলর লাইফে যাবতীয় কাজকর্ম তাকে একাই করতে হয়। কেনাকাটা করতে এসে আতিয়া চৌধুরীকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে আসে সঞ্জয়৷ এসে আদাব দিয়েই জড়িয়ে ধরে মামনি বলে। পাবলিক প্লেসে যুবক একটা ছেলে এসে তাকে জড়িয়ে ধরায় তিনি বিব্রত হয়ে পড়েন। কিন্তু ছেলেটার মুখ দেখে তিনিও উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন৷ আতিয়া পরম মমতায় সঞ্জয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ” বাবা কত বড় হয়ে গিয়েছিস রে! কি সুন্দর চেহারা হয়েছে। আগে তো তালপাতার সেপাই ছিলি। তবে ফেস কাটিং কিন্তু আগের মতোই আছে! তাই চিনেছি। যাইহোক আমার সাথে এখন কথা বলতে আসবি না, এতোদিন খোঁজ নেয়নি আর এখন এসেছে ঢং করতে। ” শেষের কথাগুলো বেশ অভিমানের সুরেই বললেন তিনি।তাকে বাচ্চাদের মতো অনর্গল কথা বলতে দেখে সঞ্জয় বললো, একটু তো জিরোও মামনি। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। আর তোমার সাথে অনেক কথা বলার আছে আমার। এই বলে আতিয়া চৌধুরীকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো সঞ্জয়। খাবার অর্ডার করে টুকটাক শরীরের হাল জিজ্ঞেস করেই সঞ্জয় বেশ ইতস্তত গলায় বলে উঠলো, মামনি আহনাফের কি কোনো মানসিক ব্যাধী দেখা দিয়েছে? আর অদিতি কোথায়? কেমন আছে? সঞ্জয়ের কথা শুনে আতিয়া চৌধুরীর মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করলো। এতে সঞ্জয় ভালো করেই বুঝলো নিশ্চয়ই কোনো বড়সড় ঘাপলা আছে। সঞ্জয় আতিয়াকে কোল্ডড্রিংক্স খেতে দিয়ে কিছুটা জিরোতে বললো।

স্কুল জীবন থেকে আহনাফের বাড়িতে যাতায়াত সঞ্জয়ের। আহনাফের অন্যতম কাছের বন্ধু হওয়ায় সঞ্জয় প্রায়ই যেত তাদের বাড়ি। সেই সুবাদে আহনাফের জীবনের অনেক কাহিনীই জানে সঞ্জয়। আর সবার সাথে বেশ সখ্যতাও রয়েছে তার।

আতিয়া চৌধুরী কোল্ড ড্রিংকস টা শেষ করে বলতে লাগলো, আহনাফ এবং আমাদের কারো সাথেই তোর দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিলো না ! এর মাঝ খানে অনেক কিছু হয়ে গেছে। আমার সাজানো সংসার এলোমেলো হয়ে গেছে। আতিয়ার কথার আগামাথা কিছু বুঝতে না পেরে সঞ্জয় বললো মামনি পুরোটা খুলে বলো আমাকে। সবটা জানা দরকার আমার। আর আহনাফের অদ্ভুত বিষয়ের পেছনে রহস্যটাও। সঞ্জয়ের কথা শুনে আতিয়া বলে উঠলো, আহনাফের সাথে কোথায় দেখা হয়েছে তোর? আর কীসেরই বা অদ্ভুত ব্যবহার? আহনাফ সকালের পুরো বিষয়টা খুলে বলতেই, আতিয়া চৌধুরী বুঝতে পারলেন আহনাফ কেন কলেজ থেকে এসে ভাঙচুর করেছে। আতিয়া চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগলেন, অদিতি আর আহনাফের সম্পর্ক বেশ ভালো চলছিলো। বিষয়টা দুই পরিবারে জানাজানি হলে আমরা সবাই মেনে নেই। দীর্ঘদিন ওদের সম্পর্ক চলার পরে অদিতি একদিন ফোন করে বলে, মামনি তোমার ছেলের সাথে আমি সম্পর্কটা রাখতে পারবোনা আর। সরাসরি ওকে বলতে ভয় করছে তাই তোমাকে আগে বললাম। তুমি ওকে একটু আভাস দিয়ে রেখো। অদিতির
কথা শুনে মনে হয়েছিলো আমি নিজের দুনিয়াতে নেই আর। আহনাফ ভীষণ রাগি ছেলে। কেউ যদি ওকে একমাত্র সামলাতে পারে সে হলো অদিতি। অদিতি ওকে শিখিয়েছে কীভাবে রাগ সামলে হাসিমুখে চলতে হয়। সেই অদিতি ওকে ছাড়তে চায় কথাটা আমি কীভাবে বলবো আহনাফকে? আর আহনাফই বা কীভাবে নেবে? কিছু ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পরে অদিতিকে বলেছিলাম,” মা মজা করছিস তাইনা? তুই আমার আহনাফকে ছাড়বি এটা হতেই পারে না।” কিন্তু অদিতি দৃঢ় গলায় বলেছিলো সে আহনাফকে ছাড়তে চায়। তার গলার দৃঢ়তা দেখে সেদিন আর কিছু বলার সাহস হয়নি আমার। আহনাফকেও আগ বাড়িয়ে কিছু জানাইনি আমি । ভেবেছিলাম বাচ্চাদের ঝামেলা ঠিক হয়ে যাবে দুদিন পরে।। এরপর বেশকয়েকদিন স্বাভাবিক গেলো! মাঝে বেশ কয়েকবার অদিতির সাথে কথা হলেও অদিতি আর বিষয়টা তোলেনি। আমিও ভেবেছিলাম সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু একদিন দুপুর বেলা খাবার টেবিলে বসে ফোন ঘাটার সময় একটা টেক্সট পেয়ে পুরো ডায়নিং লন্ডভন্ড করে আহনাফ। বিষয়টা কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিলাম হয়তো। রাগের মাথায় একা গাড়ি চালাতে গিয়ে ছোটখাটো এক্সিডেন্ট করে আহনাফ। এটুকু বলেই কাঁদতে শুরু করেন আতিয়া চৌধুরী। এদিকে মুর্তিপাথরের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সঞ্জয়। দিনদুনিয়া তার কাছে অন্ধকার লাগছে। অদিতি আহনাফের সাথে সম্পর্ক ভেঙেছে এটা যেন বিশ্বাসই হতে চাচ্ছেনা তার। কাঁদতে কাঁদতে আতিয়া চৌধুরীর অবস্থা খারাপ। সেন্সলেস হয়ে গিয়েছেন তিনি। স্থানীয় লোকদের সহায়তা নিয়ে ডক্টরের চেম্বারে নিয়ে গেলো সঞ্জয়৷
আর সারাপথ ভাবতে লাগলো জীবন কতো বৈচিত্র্যময়। সবসময় সবকিছু মানুষের ইচ্ছে ভাবনা অনুযায়ী হয়না। সৃষ্টিকর্তার অনুমতি ব্যাতীত গাছের একটা পাতাও ঝড়ে না। হুট করে পুরনো কিছু কথা ভেবে সঞ্জয়ের মনের আকাশে টুকরো টুকরো কালো মেঘ জমতে লাগলো৷ এক্ষুনি যেন সেই মেঘ ভেঙে নোনাজল গড়িয়ে পড়বে কপোল বেয়ে। বিধাতার কি অদ্ভুত ইচ্ছে! আচ্ছা সব গল্পের শেষটা কেন সুন্দর হয়না? সবকিছুতে সুখ থাকে না কেন? কিছু গল্পের শেষটা কেন বিষাদভারাক্রান্ত হয়? দুঃখ না থাকলে হয়তো সুখের উপলব্ধিটা অদ্ভুত সুন্দর হতো না। সঞ্জয়ের দুঃখে প্রকৃতিও কেঁদে উঠেছে। এই শীতকালে প্রবল বর্ষণ। শীতকালের বৃষ্টি অসম্ভব ভালো লাগে সঞ্জয়ের তবে রাতে হলে বিষয়টা আরো উপভোগ্য তার জন্য। গাড়ির কাঁচে বৃষ্টির ঝাঁট তৈরি করেছে একধরণের ধোঁয়াসা৷ ডক্টের চেম্বার থেকে চেকাপ করিয়ে আতিয়ার জ্ঞান ফেরার পরে তাকে বাসায় ঢ্রপ করে দিলো সঞ্জয়। বেশ কয়েকবার বলার পরও সঞ্জয় বাসায় ঢুকলো না। অন্য আরেকদিনের জন্য আস্বস্ত করে বেড়িয়ে এলো।

আবির চৌধুরীর ডাক পেয়ে আহনাফ তাড়াতাড়ি তার কাছে গেলেন। গিয়ে যা শুনতে পেলো তাতে প্রথমে রাগে দাঁত কিড়মিড় করলেও পরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে৷ আর মনে মনে বললো পুচকি একটা মেয়ে আবার লাগতে এসেছে আমার সাথে হাহাহা।

চলবে,,,,,