সে অবেলায় এসেছে পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
301

#সে অবেলায় এসেছে
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৫ (শেষ)

হু হু করে কেঁদে উঠলো অর্থী। এতগুলো মাস পরে আবারো বাড়ছে বুকের যন্ত্রণা। হারানোর যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে ভেতরটা। আলোকের চোখ বেয়েও গড়িয়ে পরলো এক ফোঁটা জল।

“আব্বু আম্মু কেনো ফিরে এলো? ওনারা না আসলে তো আমি নিঃস্ব হতাম না। হয়তো নীলয়ের হাতে ম’রে যেতাম নাহয় ওকে শেষ করতাম। দুজনের সংসারে সেদিন ওনাদের আসা কি খুব প্রয়োজন ছিল? আমি আজও মানতে পারিনা আমার কেউ নেই। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে আব্বুর রক্তাক্ত চেহারা। ভাইয়ের কাতরানোর দৃশ্য। আম্মুর অসহায় চেহারা। আমি ঘুমাতে পারিনা। একটা রাতও ঘুমাতে পারিনা।”

অর্থীকে শান্তনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুজে পাচ্ছেনা আলোক। এতো বছরের জীবনে এমন সাংঘাতিক ঘটনার সম্মুখীন কখনও হয়নি সে। এতটা দুর্বলও হয়নি কোনো কেস নিয়ে। এবার ঘটনা ভিন্ন। সামনের মানুষটার প্রতি দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে আলোকের। মস্তিষ্কের উপর হানা দিচ্ছে হৃদয়ের সিদ্ধান্ত। মনের অভিব্যক্তি কখনও ভুল হয়না। আবার মনের কথা শুনে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামি বৈ কিছু নয়।

“আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি একটা সুন্দর সকাল আপনার হবে। কারাগারের বেড়াজাল থেকে বের করে আপনাদের দুজনকে একটা সুন্দর সকাল উপহার দেওয়ার সম্ভাব্য সকল চেষ্টা আমি করবো।”

দ্রুতকদমে বেরিয়ে যায় আলোক। পিছনে ফেলে রেখে যায় ছলছল করা দুটো চোখ। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায় এক মানবীকে।

নির্দিষ্ট জায়গার সামনে এসে জীপ থামায় আলোক। একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে আশেপাশে চোখ বোলায়। বাড়ীটা বিগত মাসগুলো পুলিশের আওতায়। নৃশংস এই ঘটনার পর আশেপাশের কিছু মানুষজনও বাড়ি ছেড়েছে। ফাঁপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাউকে ইশারায় তালা খুলতে বলে আলোক। রুমের প্রতিটা জায়গায় তন্ন তন্ন করে খোঁজ চালাচ্ছে চারজন পুলিশ। অর্থীর কথামতো নীলয়ের আলমারির সবজায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে আলোক। অর্থীর ফোন কিংবা সেই চিঠির কোনো নাগাল পেলোনা। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে আলোক জোরে লাথি মারে আলমারিতে। কেস সম্পর্কিত কোনরূপ প্রমাণ জোগাড় করতে পারছেনা সে। এদিকে হাতে মাত্র হয়তো দশ কিংবা পনেরো দিন। অর্থীর সন্তান ভূমিষ্ট হলেই নির্দেশমতো ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে অর্থীকে। বিচলিত চোখ হঠাৎ আলমারীতে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে ফেলে আলোক। কয়েকপা এগিয়ে ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা লক্ষ্য করে। লোহার আলমারিতে নিচের দিকে তিনটে তাক। উপরের অংশে ডানদিকে একটা লকার। বামদিকে হ্যাঙারে করে ঝোলানো কাপড়। তাক থেকে কাপড়গুলো মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। তিনটির মধ্যে মাঝের তাকের লোহার পাতটা অতিরিক্ত মোটা। সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে সামান্য টোকা দিয়ে দিতেই সন্দেহ গাঢ় হয়। ভেতরটা ফাঁপা।

“নিখিল। এদিকে এসো। এর মধ্যে নিশ্চই আলাদা করে কোনো বক্স আছে। ভেতরটা ফাঁপা। প্রমাণ এই বাড়ি থেকে অন্য কোথাও লোকানোর সুযোগ নীলয় পায়নি। তাই চিঠি আর মেমোরি দুটোই এই বাড়িতেই আছে। আমার মন বলছে আমাদের সন্ধান করা জিনিস এখানেই লুকানো আছে। বেশ বুদ্ধি খাটিয়ে এই সিক্রেট যায়গাটা করা হয়েছে। এমনি এমনি নিশ্চয়ই নয়।”

চাবি না থাকায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদি দিয়ে ভেঙে ফেলা হয় লক। আলোকের ধারণা সঠিক প্রমাণ হয়। বেশ কিছু জিনিসের মধ্যে সেই চিঠির খামও আছে।

শীতের শেষভাগ। ফাল্গুনের সকালে বাতাসে বসন্ত বসন্ত আমেজ। প্রকৃতি মেতেছে নানা রঙে। পাখিদের কলরবে মুখরিত স্নিগ্ধ সকাল। মিষ্টি রোদের ঝলসালো আলো তেচরা ভাবে মুখে পড়ায় ঘুম হালকা হয়ে আসে আলোকের। তবুও ক্লান্তিতে চোখের পাতা মেলে ধরা দায়। ধকলগুলো একের পর এক শরীরের উপর যেভাবে যাচ্ছে রাতে বিছানায় গা এলাতেই ঘুমে চোখ টেনে আসে। আর মাত্র দুটো দিন। উপযুক্ত সমস্ত প্রমাণ কোর্টে পেশ করা হয়েছে। কাজের কোনো রকম ফাঁকফোঁকর রাখেনি। ভিডিও ক্লিপটা নিজের হাতে এডিট করেছে। পাছে অন্যকেউ না সেই নারী চেহারা দেখে ভৎসনা দেয়। অর্থীকে দেওয়া কথা সে রেখেছে। মেয়েটার মুখ ঝাপসা করে ঢেকে দিয়েছে আলোক। সেই সাথে কোর্টে লিখিত আর্জি জারি করেছে ভিডিও ক্লিপ যেনো জনসম্মুখে না আসে। ইনভেস্টিগেশনের সময় পেয়েছে আরও কিছু অজানা তথ্য। বেডরুম ছাড়া প্রতিটা রুমে ছিলো হিডেন ক্যামেরা। ঠিক কি কারণে বেডরুমে ক্যামেরা লাগানো হয়নি তা জানা নেই আলোকের। তবে সৃষ্টিকর্তা একটা রাস্তা বন্ধ করলে আরো দশটা রাস্তা খুলে দেন। এই বিশ্বাস নিয়েই দিন রাত এক করে দিয়েছে এই কেসটা নিয়ে। অর্থীর কেসটা এখন শুধু তার কাছে একটা কেস নয়, বরং অন্তরের গভীরে প্রবাহমান এক আবেগ। সেদিনের প্রতিটা ঘটনা ক্যামেরাতে রেকর্ড হয়েছে। যা প্রমাণ স্বরূপ পেশ করা হয়েছে কোর্টে। অর্থীর রেহাই পাওয়ার সম্ভবনা আরো খানিকটা বেড়ে গেছে। পরশু শেষবারের মতো কোর্টে আনা হবে অর্থীকে। শুনানির শেষ দিনে বিচারকের রায় কোনদিকে হবে জানা নেই আলোকের। তবে সৃষ্টিকর্তার কাছে সবসময় চেয়েছে অর্থী ভালো থাকুক। মুছে যাক তার সব কষ্ট।

আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে ওঠে আলোক। পিটপিট চাহনিতে ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে যায়। আটটা দশ। শরীরেরই বা কি দোষ। দীর্ঘদিনের এই ধকলের পর ক্লান্তি স্বাভাবিক। ডিউটি শুরু নয়টা থেকে। আজ আর অর্থীর জন্য নিজের হাতে রান্না করা হবেনা। ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় আলোকের। চাকরিসূত্রে এই বাড়িতে একাই থাকে আলোক। রোজ নিজেই যত্ন করে রান্না করে সে অর্থীর জন্য। অথচ অর্থীর সামনে সুন্দরভাবে আড়াল করে ফেলে নিজেকে। কৃতিত্ব দেয় মায়ের।

বাইরে থেকে হেলদি কিছু খাবার প্যাক করে ঢোকে কারাগারের মধ্যে। রুম নম্বর 207 এর সামনে আসলেই ধুকপুক করে ওঠে বুক। হৃদস্পন্দন বাড়ে ক্রমাগত। হৃদস্পন্দন যেনো আগাম জানান দেয়, সে এসেছে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই চমকে ওঠে আলোক। হাতের খাবার পড়ে যায় মাটিতে। পেটের কাছে খামচে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে অর্থী। যন্ত্রণায় দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আছে ঠোঁট। যন্ত্রণার তোপে কাটা মাছের মতো কাতরাচ্ছে অর্থী। ডান হাত পেটে চেপে ক্ষীণ আওয়াজে আর্তনাদ করছে। বাম হাত অনবরত দাপিয়ে খুঁজে চলার চেষ্টা করছে একটা ঠাঁই। মোচড়ামুচড়ির ফলে বেডের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে।

“অর্থী কি হয়েছে আপনার? অ্যাম্বুলেন্স ডাকবো? কষ্ট হচ্ছে? প্লীজ চোখ খুলে রাখুন। জোরে করে নিঃশ্বাস নিন। একটু ভরসা রাখুন।”

অর্থীর একহাত নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে বিচলিত কণ্ঠে বলে ওঠে আলোক। নিভু নিভু হয়ে আসছে অর্থীর চোখ। যন্ত্রণার তাড়নায় এই বুঝি জ্ঞ্যান হারাবে।

“সে অবেলায় এসেছে। বড্ডো অবেলায় তার আগমন। কথা দিন তাকে দেখে রাখবেন। আমি আপনার চোখ পড়েছি। অনেককিছু দেখেছি সেই দৃষ্টিতে। আমার শেষ সম্ববলটাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নেবেন একটু? প্লীজ অন্তত অনাথআশ্রমে কিংবা রাস্তায় যেনো বড়ো না হয়ে ওঠা হয় ওর।”

অনেক কষ্টে ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে কথাগুলো বলে অর্থী। এরপর নিশ্চুপ। জ্ঞ্যান হারিয়ে ঢলে পড়ে আলোকের কোলে। বিস্মিত দৃষ্টিতে অর্থীকে আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আলোক। নারী জাতি কি অসম্ভব রকম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। শত ব্যাথা সহ্য করেও নিজের পরিবার, সন্তানের জন্য চিন্তা করতে ভোলেনা।

হসপিটালে ওটির বাইরে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে আলোক। আশেপাশের কয়েকজন তার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। অর্থীকে কোলে করে নিয়ে আসার সময়ও ডিপার্টমেন্টের কয়েকজনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অবলোকন করেছে সে।

“আপনাকে ফিরে আসতে হবে অর্থী। আমার আপনাকে প্রয়োজন। ভীষণ রকমের প্রয়োজন। নিজের করে না হলেও, দূর থেকে আপনার সুখ দেখার জন্য আপনাকে চাই। আপনাকে নিজের করে পাওয়ার মতো নিষিদ্ধ সুখ আমি চাইনা। ভালোবাসি যে। দূর থেকেই আপনার ভালো থাকা দেখতে চাই। মাঝে মাঝে আপনার অগোচরে আপনার সুখের সামান্যতম কারণ হতে পারলেই আমি সুখী। আমি সুখি আপনার সুখ দুচোখ ভরে দেখে।”

••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

বসন্তের প্রারম্ভকাল। রঙে রঙে সেজেছে প্রকৃতি। বাসন্তী রঙের পোশাকে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল কপোত কপোতী। জীপের চাবি ঘুরিয়ে হন্তদন্ত করে স্ট্রার্ট দেয় আলোক। ব্যাস্ত ভঙ্গিমায় বাম হাতের ঘড়ির দিকে চোখ ফেলতেই গলা শুকিয়ে যায়। আজ নির্ঘাত কপালে দুঃখ আছে।

মেইন ডোর লাগিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় রুমের দিকে। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলোনা। ড্রয়িং রুমে রাগী মুখ করে বসে আছে অথৈ।

“আমাকে কেউ ভালোবাসেনা। আজকে যে একটা বিশেষ দিন সবাই ভুলে গেছে। থাকবোনা আমি এখানে। ব্যাগ প্যাক করে দাও চলে যাবো।”

মেয়ের রাগী চেহারা দেখে মনে মনে ভীষণ হাঁসি পায় আলোকের। কিন্তু এই মুহূর্তে হাঁসি বারণ। হাসলে তার আর রক্ষে নেই।

“আমার মা টা কি রাগ করেছে আমার উপর? আব্বু তো একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। এই দেখো কান ধরছে। এবার কি মাফ করা যায়না?”

কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলা আলোকের কথায় খিল খিল করে হেঁসে উঠলো অথৈ। অথৈর হাঁসি দেখে নিজেও হেঁসে ফেললো আলোক। ছোট্টো দেহটাকে টেনে নিলো বুকের মাঝে। প্রশান্তিতে চোখ বুঁজতেই দুই চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পরলো কয়েকফোঁটা অশ্রু। চারটে বছর কেটে গেছে অর্থীর বিদায়ের। সেদিন ওটি থেকে আর ফিরে আসেনি অর্থী। দীর্ঘদিনের মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নিয়েছে। আলোকের এত এত পরিশ্রম বৃথা করে পাড়ি জমিয়েছে দূর দেশে। রেখে গেছে এই ছোট্ট প্রাণ। যা এখন আলোকের প্রাণভোমরা। বেঁচে থাকার অবলম্বন। অর্থীর চলে যাওয়ার পর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে আলোক নিজের ভালোবাসা। তার জীবনের সবটুকু অংশ দখল করে নিয়েছে মেয়েটা। অর্থীর শেষ সম্পদ অথৈ। ভীষণ আদর যত্নে নিজের মেয়ের পরিচয়ে মানুষ করলেও মায়ের অভাব তো আর পূরণ করতে পারেনি। আজ অর্থীর মৃত্যুদিবস। সাথে অথৈর জন্মদিন। প্রতিবছর এইদিনে আলোক নিজের হাতে ভোজের আয়োজন করে। অনাথআশ্রম আর গরীব মানুষদের মাঝে নিজেই সেই খাবার বিতরণ করে দেয়। সব শেষে বাড়ি ফিরতে লেট হয়ে যায়। অথৈর জন্মদিন পালন করে রাত বারোটার পর। এইদিনটা সে শুধু অর্থীর জন্য বরাদ্দ রাখে।

“আম্মু থাকলে কতো ভালো হতো তাইনা আব্বু?”

“আম্মু তো আছে মা। এইতো তোমার মনের মধ্যে আম্মু সবসময় আছেন। ওইযে দেখো সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা কেমন জ্বলজ্বল করছে। আম্মু ওখান থেকেই তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।”

“জানেন, এই পৃথিবী বড্ডো নিষ্ঠুর। তাই আমি আমার সন্তানকে এখন থেকেই পরিচয় করাচ্ছি এই নিষ্ঠুরতার সাথে। দুনিয়ার হিসেব নিকেষ কষা শিখিয়ে দিচ্ছি। যেনো তারও ভুল না হয় আমার মতো। মানুষ চিনতে যেনো ভুল না হয় তার।”

আজও আমার মনে পড়ে তোমার শেষ কথাগুলো অর্থী। সত্যিই সে বড্ডো অবেলায় এসেছে। ঠিক যেমন অবেলায় তুমি এসেছিলে আমার জীবনে। এক জনম দুঃখ কি উপহার দিয়ে গেলে আমাদের বাবা মেয়েকে? তোমায় ভালোবাসার অপরাধে।

সমাপ্ত।