স্রোতধারা পর্ব-১৩

0
357

স্রোতধারা
ত্রয়োদশ_পর্ব
~মিহি

কফিশপে ধারার পাশের চেয়ারটাতে স্রোতের উপস্থিতি যেন ধারার মনে অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার করছে। সামনের চেয়ারে হায়া আর তার পাশে ধ্রুব বসে। অকস্মাৎ হায়া আর ধ্রুবকে একসাথে দেখে ধারা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল বটে কিন্তু পরবর্তীতে বই কেনার কথায় আশ্বস্ত হয়। হায়ার প্রয়োজনীয় বইগুলো কেনার পর স্রোত সবাইকে কফিশপে নিয়ে আসে।

ধারার অল্প হলেও অস্বস্তি লাগছে। এই প্রথম স্রোত তাকে হবু বউয়ের মতো ট্রিট করছে। কিছুটা অদ্ভুত আর অন্যরকম অনুভূতি! হায়া আর ধ্রুব কফি অর্ডার করলো। ধারার খুব চা খেতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু ধারা কিছু বলার আগেই স্রোত দু’কাপ চা অর্ডার দিল। ধারা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলো। স্রোত তবুও তাকে একবার জিজ্ঞাসা করতে পারতো। এসব ভাবতে ভাবতেই ধারার কানে এল মেসেজ টিউন। ফোন বের করলো ধারা। স্রোতের নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে,

“স্যরি তোমায় জিজ্ঞাসা না করে অর্ডার করে ফেললাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল তোমার চা খেতে ইচ্ছে করছে। অর্ডার চেঞ্জ করবো কী?”

মেসেজটা পড়ার পর ধারার মনে শীতল একটা প্রশান্তিময় হাওয়া ঢেউ খেলে গেল। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী নারী মনে হতে লাগলো। মেসেজের রিপ্লাই না করে ধারা স্রোতের দিকে তাকিয়ে অমায়িক একটা হাসি হাসলো। হায়া আর ধ্রুবর অলক্ষ্যে স্রোত নিজের হাতটা বুকের কাছে নিয়ে গিয়ে ‘খুন’ হয়ে যাওয়ার মতো ভান করলো। ধারার ঠোঁটের হাসি আরো কিছুটা প্রসারিত হলো। ধীরে ধীরে এই মানুষটা পুরোপুরি তাকে দখল করে ফেলছে।

__________________

“আচ্ছা আপু, স্রোত ভাইয়াকে তুমি সব বলে দিলে কেন?”

“সে এক বিরাট লম্বা কাহিনী। এসব বাদ দে। দাদী তোর সাথে কথা বলেছে?”

“উনি আবার কবে যেচে আমার সাথে কথা বলেন? যখন দেখবেন আমি কোন ভুল করেছি তখন দোষ ধরতে চলে আসবেন।”

“আহা,রাগ করিস না সোনা। বেশ কয়েকটা বই তো কিনলি, এখন একটু পড়াশোনা কর।”

“তোমরা কেন বোঝো না যে পড়াশোনা আমার দ্বারা হবে না? বিয়ে দিয়ে দাও তো!”

“তোর জন্য যে একটা রাজপুত্র লাগবে যে, তাকেই তো খুঁজছি।”

“রাজপুত্র তো আছেই, শুধু তোমাদেরই চোখে পড়ে না।” (বিড়বিড় করে)

“কী বিড়বিড় করছিস রে?”

“কিছুনা। আমি বরং ঘুমিয়ে পড়ি।”

“সে কী! খাবিনা রাতে?”

“তোমার মনে হয় ঐ দজ্জাল বুড়ির সামনে খেতে বসলে ও আমাকে শান্তিতে খেতে দেবে? অত কথা শোনার চেয়ে আমি এখন শান্তিতে ঘুমাবো।”

“চুপচাপ উঠে বস, আমি খাবার ঘরে নিয়ে আসছি।”

ধারা খাবার আনার জন্য রান্নাঘরে ঢুকতেই দাদী তাকে নিজের ঘরে ডাকলেন। ধারা না করতে পারলো না। দাদীর পেছন পেছন গেল। ঘরে ঢোকার পর দাদী তাকে বসতে বলে ব্যাগ থেকে একটা গয়নার বাক্স বের করলেন। এ বাক্সে তিনি কখনোই কাউকে হাত দিতে দেন না। এমনকি ছেলের বিয়েতেও বৌমাকে এ বাক্স থেকে একটাও গয়না দেননি। বাক্সের সব গয়না দাদীকে দাদা বেশ যত্ন করে বানিয়ে দিয়েছিলেন বলেই এর ভাগ তিনি কাউকে দিতে চাননা। ধারা কিছুটা অবাক হচ্ছে। যে বাক্স তিনি কারো সামনে বের করেন না, সেটা তিনি ধারাকে নিজে ডেকে দেখাচ্ছেন? ধারা আরো অবাক হলো যখন তিনি বেশ মোটা একটা হার বাক্স থেকে বের করে ধারার গলায় ধরলেন। ধারার অবাক চাহনিতে হেসে ফেললেন তার দাদী।

“কী রে? অমন করে দেখার কী হলো?”

“আপনি এ হার আমার গলায় ধরছেন কেন? আপনি তো এসব গয়না কাউকে দেখতেও দেন না।”

“দেখতে দেইনা বলে তোকেও দেব না নাকি? তুই তো আমার কলিজার টুকরো। ক’দিন পর পরের ঘরে যাবি, সোনায় মুড়িয়ে তবেই পাঠাবো। কেউ যেন বলতে না পারে তোকে খালি হাতে পাঠিয়েছে বাপের বাড়ি থেকে।”

“এমন করে কেউ বলবে না। আপনি এ গয়নাগুলো দাদার স্মৃতি হিসেবে আগলে রেখেছেন। এসব আমার চাই না।”

“বেশি বুঝবি না। বিয়ের দিন এ গয়না দিয়েই তোকে সাজানো হবে।”

“আপনার ভালোবাসা আর দোয়া ব্যতীত আমি কিচ্ছু চাইনা দাদী।”

“তোর জন্য আমার মন ভর্তি ভালোবাসা আর দোয়া রে নাতনী।”

“সেখান থেকে একটুখানি কি হায়াকে দেওয়া যায় না?”

“ওকে আমি কোনদিন মেনে নেব না। তোরা ওর উপর মায়া দেখিয়ে ওকে এনেছিস, আমার মতামতের গুরুত্ব দিসনি। এখন আমি ওকে কেন মানবো?”

“আপনার এই জেদের জন্য ছোট চাচ্চু কষ্ট পেয়ে সব ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি মারা যাওয়ার আগে নিজের মেয়ের মুখটুকুও দেখে যেতে পারেননি, জানতে পারেননি তার মেয়ের আগমন সংবাদ। হতে পারে তারা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু তার জন্য দুটো প্রাণের বিসর্জন গেছে। এখনো রাগ কমেনি আপনার?”

“এখন যা এখান থেকে। অযথা যতসব অলুক্ষুণে কথা বলে আমার মেজাজ খারাপ না করলে তোর হত না। যাই হোক, নাতজামাইয়ের ছবি আন তো।”

“আমার কাছে ছবি নেই।”

“বিয়ে শাদী করবি অথচ ছবি নেই। তোরা এ যুগের হয়ে তাহলে লাভটা কী? যা।”

দাদীর ঘর থেকে বেশ খিটখিটে মেজাজ নিয়েই বের হয় ধারা। না চাইতেও নিজের দাদীর কথায় অনেকটাই ব্যথিত হয়েছে সে। হায়ার জন্য খাবার সাজিয়ে ঘরে গিয়ে দেখলো হায়া ঘুমিয়ে পড়েছে। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো! হায়ার কথা ভেবে ধারারও আর কিছু খেতে ইচ্ছে করলো না। খাবারের প্লেটটা ঢেকে রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ধারা। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে ছিটেফোঁটা মেঘ, কখনো বা আড়াল করছে চাঁদের আভাকে। শীতল বাতাসের স্পর্শে ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠছে হায়া। হঠাৎ যেন অন্য গতিতে চলতে শুরু করেছে জীবন।আর ক’টা দিন পর সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে নতুন একটা সংসারে যেতে হবে। স্রোত স্বামী হিসেবে কেমন হবে? পাগলাটে ধরনের নাকি রাগী? প্রচুর ভালোবাসবে নাকি কথায় কথায় রাগ দেখাবে? হুটহাট ফুল এনে হাঁটু গেড়ে বসে বলবে ‘ভালোবাসি’ নাকি ক্লান্তিতে ধারার সাথে কথা বলার সময়টুকুও ফুরিয়ে ফেলবে? মাঝরাতে হঠাৎ আইসক্রিম খাওয়ার বায়না ধরলে স্রোত কি এনে দিবে নাকি ‘এসব ঢঙ বাদ দাও’ বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়বে? শত শত প্রশ্ন ঘুরছে ধারার মাথায়। প্রেমও তো রঙ বদলায়। স্রোতের ভালোবাসাও কি দিনশেষে রঙ বদলাবে নাকি প্রতিটি ভোর ধারাকে নিয়ে এক রঙিন সূচনার পথে অগ্রসর হবে স্রোত? স্রোতের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত দুটো বেজে গেছে খেয়াল করেনি ধারা। মাথায় একটা অদ্ভুত ভূত চাপলো। এই মাঝরাতে স্রোতকে কল দিয়ে বিরক্ত করার তীব্র ইচ্ছা মাথায় চেপে বসলো ধারার। ঝটপট ফোন হাতে নিয়ে স্রোতের নম্বরটা ডায়াল করলো ধারা। পরপর তিনবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ঘুমঘুম কণ্ঠে কেউ একজন ‘হ্যালো’ বলে উঠলো। ধারা কণ্ঠটা অস্পষ্ট লাগলো।

“ঘুমোচ্ছো?”

“মাঝরাতে ফোন দিয়ে ফাজলামি করেন? কে আপনি?”

“হবু বউয়ের গলা চিনো না, তুমি তো বিয়ের পরদিন আমারেও চিনবা না।”

“বউ! আমার বউ আসবে কোত্থেকে? উপসস শীট…স্যরি ভাবী, আপনার বর ঘুমায়। ওর ফোন আমি না দেখে রিসিভ করে ফেলছি।ওকে দিব?”

ধারা লজ্জায় খট করে কল কেটে দিল। কী লজ্জা কী লজ্জা! সে স্রোতের কণ্ঠ চিনতে পারেনি,উল্টো কণ্ঠ নিয়ে ভালোই ডায়লগ দিল। ধারার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। বারবার মনে মনে বলছে, “হে ধরণী দ্বিধা হও! আমি মাটির সাথে মিশে যাই। আমি এখন স্রোতের সামনে দাঁড়াতেই পারবো না লজ্জায়!” ধারা আর কিছু বলার আগে আবারো ফোনটা বেজে উঠে।

চলবে…