স্রোতধারা পর্ব-১৪

0
328

স্রোতধারা
চতুর্দশ_পর্ব
~মিহি

দিনগুলো যেন দ্রুত ঘনিয়ে এলো। বিয়ের পূর্বপ্রস্ততির ব্যস্ততায় ধারার স্রোতের সাথে একান্তে কথা বলার সময়টুকুও হচ্ছে না। বাড়িতে মেহমান ভর্তি। ছোট বড় সব ভাইবোনেরা এসেছে। কাল গায়ে হলুদ।ধারা যেই ফোন হাতে নেয়,সব কাজিন চেঁচিয়ে ‘ওওও’ করে উঠে। খুবই লজ্জাজনক লাগে ধারার কাছে। বাধ্য হয়ে ফোন করবো করবো করেও আর করে উঠতে পারে না সে। কাজিনরা হেসে কুটিকুটি হয়।

কাল গায়ে হলুদ। স্টেজ সাজানোর জন্য সন্ধ্যা থেকে কাজ শুরু হবে। সব কাজিনরা মিলেই স্টেজটা সাজাবে। এমনটাই প্ল্যান করা হয়েছে। সবাই এক জায়গায় বসে কথাবার্তা বলছে। ধারা উঠে একটু আলাদা বসতেই হায়া এসে ধারার কোল দখল করলো। বিড়ালছানার মতো আদুরে ভঙ্গিতে ধারার কোলে মাথা রেখে লেপ্টে রইল।

“এত আহ্লাদ কেন? নির্ঘাত কোন দুষ্টুমি চলছে মাথায়?”

“আহ আপু! আমি কি সবসময় দুষ্টুমি করি? আমাকে একটা কথা বলোতো, স্রোত ভাইয়া তোমায় কী করে প্রপোজ করলো?”

“সে অনেক কাহিনী। প্রপোজ করে আমি কিছু না বলার পর হাত কাঁটছিল। পাগল একটা লোক। ও শুরু থেকেই চাচ্ছিল আমাদের সম্পর্কটা বিয়ের পবিত্র বন্ধন দিয়ে শুরু হোক।”

“তুমি কিভাবে বুঝলে তুমি ভাইয়াকে ভালোবেসে ফেলেছ?”

“ওর হাত কাটার কথা শুনে ভেতরে ভেতরে আকুল হয়ে গিয়েছিলাম। এসব অনুভূতির আসলে কোনো ব্যাখ্যা নেই। একেকজনের ভালোবাসার ধরণ একেকরকম। যেমন ধর কেউ ভালোবেসে এতটা পাগল হয় যে তাকে ছাড়া কিছু বোঝে না। আবার কেউ এতটাই নীরবে ভালোবাসে যে প্রিয়জনের সুখের জন্য দূর থেকেই ভালোবেসে যায়। দুজনের ভালোবাসার কি তুলনা করা যাবে? যাবে না তবে দুজনের ভালোবাসাই নিঁখাদ।”

“দেখো, ভাইয়া তোমায় বিয়ের পর মাথায় তুলে রাখবে।”

“জানিস হায়া, আমার খুব শখ ছিল আমরা দুই বোন একসাথে এক বাড়িতে বিয়ে করবো। জানিনা আল্লাহ তোর ভাগ্যে কী লিখেছেন। আল্লাহ যা করেন নিশ্চিত মঙ্গলের জন্যই। তোর জন্যও তিনি রাজপুত্রই রেখেছেন।”

ধারার কথার প্রত্যুত্তরে কেবল একটুখানি হাসে হায়া। মনে মনে বলে,”আজ আমি একটা ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আপা। ধ্রুবকে আমি আজ মনের কথা জানিয়ে দেব। ও কী প্রত্যাখ্যান করবে আমায় যেমন করে তুমি ভাইয়াকে করেছিলে? আবার আমার অসুস্থতা শুনলে ছুটে আসবে কী?” নানাবিধ প্রশ্নে নিজেকে মুহূর্তেই জর্জরিত করে ফেলে হায়া।

রাতে প্রায় দুটো অবধি কাজ করে সবাই ঘুমোতে গেছে। ধ্রুব রয়ে গেছে। কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে সেও চলে যাবে। বিয়ে এটেন্ড করা তার ভাগ্যে নেই। মা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর ধ্রুবর কাছে আসার জন্য পাগলামি করছে। ধ্রুব জানে সবকিছুই তার বাবার সাজানো নাটক তবুও তাকে আবারো খাঁচায় বন্দি হতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ধ্রুবর খুব ইচ্ছে ছিল ধারা আর স্রোতের বিয়েটা দেখার কিন্তু সুযোগটা আর হবে না। আজ ভোর ছয়টায় সে চলে যাবে। ছবি তোলা শেষ করে ঘুরতেই হায়ার সাথে ধাক্কা লাগে ধ্রুবর। হায়ার দিকে তাকিয়েই খানিকটা ভিমড়ি খেয়ে পড়ে ধ্রুব। হায়ার গায়ে লাল শাড়ি জড়ানো। হায়ার গায়ে সে এই প্রথম মেয়েসুলভ কোনো পোশাক দেখছে। হায়ার শ্যামবর্ণের গালেও লজ্জার আভাস ফুটে উঠছে। ধ্রুব নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।

“মনে হচ্ছে বিয়েটা তোমার বোনের নয় বরং তোমার। যা সাজ সেজেছো। বাব্বাহ!”

“আপনার মনে হয় আমি এখানে ফাজলামি করার জন্য এসে দাঁড়িয়েছি?”

“না না। সুন্দর লাগছে তোমায়।”

“একটা কথা বলবো?”

“বলো।”

“কবিদের মতো অত সাহিত্যিক ভাষা আমার জানা নেই। মনের কথা মনের ভাষাতেই বলে ফেলি। আপনাকে প্রথম দেখার পর থেকেই ভালোবেসে ফেলি। বলবো বলবো করেও বারবার ভয়ে পিছপা হতে বাধ্য হয়েছি। কাল আপুর বিয়ে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ আমার আপু। সে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমার কষ্ট হচ্ছে প্রচুর। আপনাকে এসব বলছি কারণ আপনি হারিয়ে গেলেও আমি খুব কষ্ট পাবো। তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাবো নিজের মনের কথাটা আপনাকে না বলতে পারার কষ্টটা। আমি আপনাকে ভালোবাসি, ধ্রুব।”

হায়ার কাতর কণ্ঠের কাছে যেন স্তব্ধ ধ্রুব। তবুও দুর্বল হলে তার চলবে না। হায়ার মাথা থেকে এসব নামাতে হবে।

“দেখো হায়া, তুমি যা ফিল করছো তা ভালোবাসা নয়, একরকম এট্রাকশন। এসব কিশোর বয়সে হয়েই থাকে। আমি যে কতবার আমার ক্লাসের ম্যামকে প্রপোজ করেছি হিসেব নেই। এখন বড় হয়ে ওসব ভাবলে লজ্জা লাগে। তুমিও একটু ম্যাচিউর হও। দেখবা এসব কথা ভাবলেই নিজের উপর হাসি আসবে।”

“আপনি আমায় ভালোবাসেন না?”

“আমি কি বললাম সেটা বোঝো আগে।”

“আপনি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিন। আমার কিছু বোঝার নেই।”

“এই জেদটা করে পস্তাবে তুমি হায়া। আমি তোমার ভালোর জন্য বলছি।”

“উত্তরটা…”

“না…আমি তোমায় ভালোবাসি না।”

ধ্রুব আর কিছু না বলে হায়াকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। “আমার এ অনিশ্চিত জীবনের সাথে তোমার সুন্দর জীবনটাকে আমি জড়াতে চাই না হায়া। আমি যে নরকে থাকার অভ্যেস করে ফেলেছি সে নরকে নিঃশ্বাস ফেলার ক্ষমতাটুকুও তোমার নেই। তুমি যেখানে আছো, সেখানেই ভালো থাকতে পারবে। নিজের দুর্বলতার বশে তোমাকে হ্যাঁ বলে দিয়ে তোমার জীবনটা নষ্ট করতে চাই না। ভালো থেকো।” মনে মনে কথাটুকু বলেই চোখের কোণের জলটুকু মুছলো ধ্রুব। জীবনের সবচেয়ে বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো বোধহয় আজকের দিনের জন্যই তোলা ছিল।

___________________

স্রোতের পাগলামি নিয়ে আর পারে না সৌহার্দ্য। ধারার সাথে সকাল থেকে কথা হয়নি দেখে এখন তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন। সাথে বগলদাবা করে এনেছেন সৌহার্দ্যকেও। স্রোত ভেতরে গিয়ে ধারার সাথে কথা বলবে ততক্ষণ সৌহার্দ্য নাকি পাহারা দিবে। কী এক যন্ত্রণা! সৌহার্দ্য ঘুমে ঢুলছে। রাত তিনটায় এসব পাগলামির কোনো মানে হয়? বাড়িতে প্রবেশের পর স্রোত ধারার ঘর খুঁজতে গেল। সৌহার্দ্য ধীর পায়ে সামনে এগোচ্ছে। আচমকা গায়ে হলুদের স্টেজের কাছে আসতেই লাল শাড়ি পরিহিতা কাউকে দেখে বেশ চমকায়। হায়ার পড়নের লাল শাড়ি আর রক্তে হাত মাখামাখি দেখে সৌহার্দ্য দ্রুত ছুটে আসে।

সৌহার্দ্যকে ধ্রুব ভেবে জড়িয়ে ধরে হায়া। তার ধারণা ছিল ধ্রুব আসবে। অন্ধকারে সৌহার্দ্যকেই ধ্রুব ভেবে কান্না শুরু করলো সে। মুখে ভাষা নেই তবুও কান্নার মধ্যে দিয়েই যেন সব অনুভূতি প্রকাশ করতে চাইল সে। বেশ অনেকক্ষণ সৌহার্দ্যকে জড়িয়ে ধরে রাখার পর আচমকা পায়ের শব্দে সৌহার্দ্যের ঘোর কাটলো। হায়া তখনো কেঁদেই চলেছে। হাতের রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে, অল্প কেটেছে তাই খুব একটা ক্ষতির ঝুঁকি নেই। সৌহার্দ্য উঠে কিছু বলতে গেলে হায়া তাকে ছাড়তে চায় না। হায়ার ধারণা সে ছাড়লেই ধ্রুব চলে যাবে। অশ্রুসজল ঝাপসা দৃষ্টিতে সে ঠিকমতো চারিপাশ দেখে উঠতে পারার আগেই সর্বনাশ ঘটে গেল।

ভোরবেলা থেকেই ফ্ল্যাটের আশেপাশের প্রতিবেশীদের নিয়ে হলুদ বাঁটার কথা ছিল শায়লা আহমেদের। তাদের স্টেজ দেখাতে এনেই বিপাকে পড়লেন তিনি। সৌহার্দ্য আর হায়ার এমন অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে উপস্থিত সকলের মধ্যে ছিঃ ছিঃ পড়তে বেশি একটা সময় লাগলো না। হায়া ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। দুর্বল শরীর নিয়ে আর তাকাতে পারছিল না সে। সৌহার্দ্য বুঝে উঠতে পারছেনা এখন কী করবে। পরিস্থিতি সামলাতে না পারলে হয়তো তার দোষেই একটা নিষ্পাপ মেয়ের গায়ে কলঙ্কের ছোঁয়া লাগবে। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সৌহার্দ্য। একটা মিথ্যা দিয়ে যদি কারো ভালো হয়, তবে সে মিথ্যেই ভালো। চরম একটা মিথ্যে বলার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল সৌহার্দ্য যার তার এবং হায়াসহ গোটা পরিবারের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে চলেছিল।

চলবে…

[এখান থেকে ধ্রুব চরিত্রের উপস্থিতি শেষ।]