#হঠাৎ _অদ্ভুতুড়ে (পর্বঃ-০২)
লিখাঃ- সুহাসিনী
আমার যখন জ্ঞান ফিরলো, চেয়ে দেখি বেশ বেলা হয়ে গেছে। জানালার পর্দা দিয়ে মৃদু আলো ঢুকছে সঙ্গোপনে। সেই আলোর কিছুটা অংশ আমার চোখেমুখে। মাথাটায় কেমন যেন ব্যথা অনুভব করছি। কী আশ্চর্য! আমি ফ্লোরে শুয়ে আছি কেনো?
চারপাশের চেয়ে চেয়ে অবস্থা দেখে ধীরে ধীরে সব মনে পড়ছে। মেঝেতে কয়েকটা ভাঙা কাচের চুড়ি। আড়চোখে জানালার পর্দার দিকে তাকালাম। আংশিক পর্দা খোলা জানালা। মাথায় হাত চেপে ধরেই উঠে দাঁড়িয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালাম। সকালের মিষ্টি রোদ, শান্ত পরিবেশ। মনেই হচ্ছে না, কাল রাতে আমি কী রকম ভয়ংকর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। ফাইজা আপুটা থাকলে কী ভয় পেতো? কি জানি!
আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে হঠাৎ খেয়াল হলো, আমার মাথার চুল ভেজা। ভয়ে আঁৎকে উঠলাম। আমার মাথা ফেটে আবার রক্ত বের হয়নি তো? ছুটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরেফিরে নিজের মাথাটা চেক করে নিলাম। নাহ, সব ঠিকই তো আছে। তবে ভেজা চুল কেনো?
কোনো হিসাবই মিলছে না আজ। মেঝেতেও পানি গড়িয়ে পড়ার চিহ্ন আছে স্পষ্ট। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে খেয়াল হলো, ফ্রিজটা খোলা। অথচ আমি ফ্রিজে একবারও হাত দিই নি। এইসব ঘটনা মাথার মধ্যে জমে আসছে স্তূপের মতোন। প্রায় কয়েকঘন্টা রুমের মধ্যে উদাস হয়ে বসে থেকে অলস সময় কাটাচ্ছি আর কফি খাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর কলিংবেল বেজে উঠলো। কফির কাপটা হাতে নিয়েই দরজা খুলে দিলাম। ফাইজা আপু হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছেন। কেমন যেনো শুষ্ক মুখ তার। যেন কোথাও কোনো ধরণের ঝামেলা করে এসেছে। হাতের কব্জির কাছে ব্যান্ডেজ করা। অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম,
-আপু,আপনার হাতে কী হয়েছে?
আপু ক্লান্তস্বরে জবাব দিলো- আর বলিস না। সে এক বিশাল বড় প্যারায় পড়েছিলাম। হাসপাতালে আমার ফ্রেন্ডের বাবাকে যেই কেবিনে রাখা হয়েছে, ওটার জানালায় আমি হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। একটু আগেই যে কাচটা ভেঙে গেছে, সে তো আর জানি না। ব্যস, গেলো কেটে হাতখানা।
– একটু সাবধানে চলতে পারেন না কেনো?
-আরে পাগলী, চিন্তা করিস না তো। আমি ব্যান্ডেজ করে নিয়েছি। ঠিক হয়ে যাবে অল্পদিনের মধ্যেই।
-হুম, আচ্ছা।
ফাইজা আপুকে রুমে যেতে বলে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিলাম। আপুর হাত কেটে যাওয়ার ব্যাপারটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছে না। আমি তো রাতে কারো হাত চেপে ধরেছিলাম। ব্যথায় সে কুঁকড়ে উঠেছিলো। বারবার ওই ঘটনার সাথে কেন জানি ফাইজা আপুকে গুলিয়ে ফেলছি। কী বোকা আমি! ফাইজা আপুকে অদৃশ্য ভাবে দেখার সুযোগই বা কোথায়? তার কাছে তো আর রুপকথার গল্পের মতো সুপার শক্তি নেই।
মনের মধ্যে একরাশ প্রশ্ন। মাথায় গিয়েও ঘুরপাক খেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছে। রুমে ফিরে ত্রাত্রিকে কল দিলাম। তিনবার রিং হবার পরেও রিসিভ করে না। আরো প্রায় দুই মিনিট পর নিজেই কলব্যাক করে ওপাশ থেকে ত্রাত্রি বললো,
-মনে হচ্ছে তোর মাথায় গন্ডগোল হয়ে গেছে।
-মানে?
-মানে তুই তো একবারের বেশি জীবনেও কল দিস না। আজ হঠাৎ পর পর তিনবার কল দিয়ে ফেলেছিস।
-কিন্তু তোর তো কল রিসিভ করার নামগন্ধ নাই। এতবার কল দেওয়া দেখে মজ নিচ্ছিস, না?
-উহু, মোটেও না। আমি তো তোকে…
ত্রাত্রির কথা শেষ হয় না। এই মুহুর্তে ওর কথাতে আমার মনোযোগও নেই। ঘরজুড়ে কেমন যেনো অদ্ভুত বাতাসে ভারি হয়ে আসছে সমস্ত কিছু। খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারছি, কারো হেঁটে চলা পায়ের শব্দ। প্রতিটা ভারি ভারি পদক্ষেপ। আমার খুব আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে সে। ওপাশে ত্রাত্রি কথা বলছে কি না আর খোঁজ নিই নি। ফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘুরে দাড়ালাম। একবার ডানদিকে, আরেকবার বাম দিকে। কোথাও কেউ নেই। কিন্তু অস্তিত্বটা ঠিক টের পাওয়া যাচ্ছে। দিনের বেলাতেই এরকম! এই ফ্ল্যাটে নিশ্চয় কোনো সমস্যা হয়েছে। এর আগে আমি বিগত সাতমাস ধরে এই ঘরেই আছি, অথচ এমনটা তো ঘটে নি।
মাথাটা ঝিমঝিম করছে। অদ্ভুত সেই সুগন্ধটা যেন সারা মস্তিষ্কে বয়ে যাচ্ছে আমার। জোরে একবার শ্বাস নিয়ে ছুটে গেলাম ফাইজা আপুর রুমে। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ দিয়েও ফাইজা আপুর সাড়া পাচ্ছি না।
“ফাইজা আপু, আপু দরজা খুলুন। আপু…”
ওপাশে একেবারে নিঃশব্দ। আরো প্রায় দশ পনেরো সেকেন্ড পর মনে হলো, কেউ যেন সজোরে আমাকে ধাক্কা দিয়ে গেলো। কোথায় গেলো, কেনো গেলো, কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। এমন সময় ফাইজা আপু দরজার লক খুলে বাইরে এলেন। চোখে মুখে ব্যস্ততার ছাপ। যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। উনি জিজ্ঞাসা করলেন,
-কী রে, কোথাও লেগেছে নাকি?
আপুর প্রশ্নে অবাক হলাম। আমার কোথাও লেগেছে কি না উনি কীভাবে টের পেলেন! কাঁপা কাঁপা গলায় আপুকে বললাম,
– কোথাও লেগেছে বলতে?
-বাম হাতটা যেভাবে চেপে ধরে আছিস, মনে তো হচ্ছে কোথাও ধাক্কা খেয়ে এলি। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কী।
খেয়াল করে দেখি, আসলেই তো। আমি নিজেই ধাক্কা খেয়ে হাত চেপে ধরে আছি। অযথা ফাইজা আপুকে নিয়ে একটু হলেই উলটাপালটা ভাবতে বসছিলাম। এতদিনের পরিচিত মানুষটাকে নিয়ে এমন বোকা বোকা চিন্তা করে আসছি! আপু আবার বললেন,
– এমন অদ্ভুত আচরণ করছিস কেন বল তো?
-কী করছিলেন?
-কানে হেডফোন লাগিয়ে অংক করছিলাম। হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন ডাকছে আমায়। দরজা খুলে দেখি তুই।
-অহ আচ্ছা।
আরো একবার বেশ বড়সড় একটা শ্বাস নিয়ে বললাম,- আমাদের ফ্ল্যাটে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?
– হ্যাঁ, করেছি তো। সবাই যখন ছিলো, খুব হৈ চৈ হত। এখন পুরো ফ্ল্যাটটাই নিরব। ত্রাত্রিকেও খুব মিস করছি।
আপুকে থামিয়ে দিয়ে আবার বললাম -আমি ওই ব্যাপারে বলি নি। ফ্ল্যাটে আজকাল কীসব অদ্ভুতুড়ে ঘটনা ঘটছে। কাল রাতে তুমি যে মিষ্টি দিয়ে গেছো, ওটা কেউ খেয়ে ফেলেছে। আমার নতুন চুড়িগুলোও উধাও। একটু আগে যেন মনে হচ্ছিলো, কেউ আমার খুব কাছে মৃদু পা ফেলে হাটছে।
ফাইজা আপুর মুখের ভঙ্গি পরিবর্তন হলো। অনেকটা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। সেই তাকানোর দৃষ্টিতে চিন্তা নাকি ভয়, কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। শান্ত স্বরে আপু বললেন,
– এ যুগে এসে এসব হাবিজাবি চিন্তা করিস কীভাবে? আত্মা বলে জগতে কিছু নেই।
-কিন্তু আমি স্পষ্ট টের পেয়েছি। সত্যি আমাদের ফ্ল্যাটে কোনো আত্মা আনাগোনা করে আপু।।
আমার কথাটাকে একেবারে হেসে উড়িয়ে দিলেন ফাইজা আপু। যেনো আমি কোনো হাসির কথা বলে কৌতুক করলাম তার সাথে। আমার অবস্থাটা হয়তো সে টের পেয়েছিলো। মাথায় হাত রেখে বললো,- আচ্ছা, ঠিক আছে। আজ রাতে তাহলে আমি তোর রুমে ঘুমাচ্ছি। এখন ব্যাচে পড়তে যা।
ফাইজা আপুর কথায় আশ্বস্ত হয়ে নিজের রুমে ফিরে এলাম। বেলকনি দিয়ে দূরের নদীর পাড় দেখা যায়। প্রায়ই বিকালে আমি আর ত্রাত্রি নদীর পাড়ে হাঁটতে যাই। একসময় আমার পুরনো রুমমেট ছিল এশা। দারুণ প্রানবন্ত আর চঞ্চল। এশা আমাকে নদীর পাড়ে হাঁটার নেশাটা ধরিয়ে গেছে। মেয়েটাকে মিস করি খুব। ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো। পরে শুনেছি, বনিবনা হয়নি। আবার একদিন শুনলাম, সুইসাইড করার চেষ্টাও করেছিলো। অনেক বুঝিয়েছি। কী জানি, এখন কেমন আছে মেয়েটা। কথা হয় না অনেকদিন। ফোন নাম্বারটাও বন্ধ পাই।
রাতে খাওয়ার পর্ব শেষ করে ফাইজা আপু আমার ঘরে ঘুমোতে এলেন। দেখে মনে হচ্ছে, এই ঘরে ঘুমাতে পেরে সে বেশ খুশিই হয়েছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আপুর দিকে। আমাকে ভেংচি কেটে আপু বলল,
-কী রে, হা করে এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? সিনেমার নায়কদের মতোন রোমাঞ্চকর চাহনি। তোর তাকানো বড্ড খারাপ। নিষ্পাপ একটা মুখ হলেও তোর চোখের দৃষ্টিটা ভারি অশ্লীল।
আপুর কথায় লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম। তারপর অভিমানের সুরে বলতে লাগলাম-
আমি কী ইচ্ছে করে এভাবে তাকাই? আমাকে এভাবে বললে আমার খারাপ লাগে না?
-আমি কি তাই বলেছি,যে তুই ইচ্ছে করে তাকাস? বাদ দে এসব। চুপচাপ ঘুমা।
-হুম। কিন্তু তোমাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন আজকে?
-একা একা ঘুমোতে আমারও কেমন জানি লাগছে। তাই একসাথে ঘুমাতে পেরে এখন নিশ্চিন্ত।
আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ফাইজা আপু বেশ সময় নিয়ে চুলের বেনী করলেন। তারপর হাতে আর পায়ে লোশন মেখে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লেন। আপুকে সত্যিই আজ চিনতে ভারি কষ্ট হচ্ছে আমার। আপু কী ঠিক আছে? নাকি আমারই মাথার ঠিক নাই। হয়তো তাই হবে। সবকিছুই এত গোলমেলেভাবে জড়িয়ে ফেলেছি যে, কে কেমন ছিলো সেটাই ভুলে গেছি। ভালো একজন সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে আগামীকাল। এভাবে চললে আমি নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো।
রাত তখন কত হয়েছে, জানা নেই। নিজের কথা ভাবতে ভাবতেই আনমনেই ঘুমিয়ে গেছিলাম। হঠাৎ হালকা ঘুমের ঘোরেই কারো গোঙানির আওয়াজ এলো কানে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে সেই আওয়াজ। ভয়ে চমকে উঠে চোখে মেলে তাকালাম। ঘরজুড়ে অন্ধকার। একটা মেয়ের গোঙানির শব্দে চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে আসছে।
(to be continued …)