হঠাৎ অদ্ভুতুড়ে পর্ব-০৩ | বাংলা রোমান্টিক গল্প

0
2368

#হঠাৎ_অদ্ভুতুড়ে (পর্বঃ-০৩)
লিখাঃ- সুহাসিনী

ভয়ে চমকে উঠে চোখে মেলে তাকালাম। ঘরজুড়ে অন্ধকার। একটা মেয়ের গোঙানির শব্দে চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে আসছে। শরীরটা কাঁপছে আমার। মাথাটা অনেক কষ্টে চেপে ধরে আশেপাশে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলাম। শব্দটা আমার রুমের ভিতরেই কোথাও থেকে আসছে। কিন্তু আমার রুমে আমি ছাড়া তো অন্য কেউ নেই…

ওহ! এক মিনিট। ফাইজা আপু তো রাত্রে আমার সাথেই ঘুমিয়ে ছিলেন। তার মানে আপুর সাথে কোনো সমস্যা.! দ্রুত বালিশের নিচে থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে ফোনের আলো জ্বালিয়ে ত্রাত্রির বেডের দিকে ছুটে গেলাম। ফাইজা আপু নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত পা ছুঁড়ে কাউকে ধাক্কা দেবার চেষ্টা করছেন। মুখবর্ণ প্রায় তামাটে হয়ে গেছে। মুখের কী বিভৎস চাহনি!

আপুকে দুই হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার দিয়ে ডাকলাম,
“আপু, এই আপু, কী হলো আপনার।”

তবুও ফাইজা আপুর কোনো পরিবর্তন হলো না। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে আপুকে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে ঠেলে তুললাম। আপু একটা জোরে শ্বাস নিয়ে বেশ জোরালোভাবে একবার গা ঝাড়া দিয়ে চোখ মেলে তাকালেন। ভয়ার্ত তার চোখের দৃষ্টি। কোটরের ভিতর লাল টকটকে বর্ণ। বেশ কড়া গলায় আমাকে ধমকের সুরে আপু বলে উঠলেন,
– সুহাসিনী, তুই আমাকে মারতে এসেছিস? আজ তোর রুমে শোবার নাম করে আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলছিস.!

আপুর কথায় অবাক হয়ে গেলাম। আমাকে কোনোদিন উনি তুই সম্বোধন করে কথা বলেন না। আজ এতটাই রেগে গেছেন, তুই করে বলতেও তার মুখে বাধছে না। আমি ফাইজা আপুকে মারতে যাবো? এ কথা তো দুঃস্বপ্নেও গায়ে তোলা তো দূরের কথা খারাপ ব্যবহার করার কথাও ভাবতে পারি না। বললাম,
– কী বলছেন আপু এইসব? আমি আপনাকে মারবো কেনো?

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

– না তো কী? আমি এত জোরে হাত পা ছোড়ার চেষ্টা করছি,আর তুই আমাকে চেপে ধরেছিলি। চোখ মেলে দেখি তুই-ই তো আমার কাছে দাঁড়িয়ে
আছিস।

-কীসব আজেবাজে কথা বলছেন? আমি আপনাকে মারতে যাবোই বা কেনো? আপনার গোঙানির শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। তারপর আপনার এই অবস্থা দেখে ধাক্কা দিয়ে তুললাম।

ফাইজা আপু কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি গিয়ে ঘরের লাইটটা অন করে দিলাম। হৃদস্পন্দন দ্রুত উঠানামা করছে, সেটা বাইরে থেকেই বুঝা যাচ্ছে। বেশ কয়েক মুহুর্ত আপু নিরবে বসে শ্বাস নিয়ে শান্ত স্বরে বলতে লাগলেন,
– ঠিকই তো। তুমি কেনো আমাকে মারতে যাবে। কিন্তু এমনটা ঘটলো কেনো সুহাসিনী? আমার মনে হচ্ছিলো, কেউ যেন জোর শক্তি দিয়ে আমাকে চেপে ধরে চিৎকার করে বলছে, “তোমার সাহস কী করে হয় আমার ঘরে এসে ঘুমানোর? এখানে আসার আগে আমার অনুমতি নিয়েছো তুমি? নাও নি। আমার অনুমতি ছাড়া এভাবে আমার ঘরে ঘুমানোর শাস্তি তোমাকে তো পেতেই হবে।”

আপুর কথার জবাব আমার কাছে নেই। এমনটা কেন ঘটছে আমিও তো সেটা জানি না। আমার সাজগোজের জিনিসপত্র উধাও হয়ে গেছে। ত্রাত্রিও তার মেকাপ আইটেম হারিয়েছে। কাল রাতের ঘটনায় যাকে অনুভব করেছিলাম,সে আমাক আঘাত করে নি। শুধু ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেছে। আমার মাথা ভেজা ছিলো। ফ্রিজের দরজা খোলা। এর একটাই মানে- আমি যে আঘাত পেয়েছিলাম, ফ্রিজ থেকে বরফ এনে সে নিশ্চয় আমার মাথায় দিয়েছিলো ব্যথা উপশমের জন্যই। আমার ক্ষতি সে চায় না। তবে ফাইজা আপুর ক্ষতি কেনো করছে? শুধুমাত্র এই ঘরে আমার আর তার অধিকার আছে বলে? কিন্তু কে সে?

কিছুই মেলাতে পারছি না এখন। ফাইজা আপুকে উনার ঘরেই পাঠিয়ে দিলাম। কারণ এটুকু বুঝতে পারছি, আমার ক্ষতি কখনো করবে না। এতক্ষণ ভাবছিলাম, আপুর মধ্যে কোনো সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু এই মুহুর্তে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আপুকে এমন ভাবার প্রশ্নই আসে না। আবার আপু আমার সাথে অভিনয় করছে না তো? বলা মুশকিল। হাজারো প্রশ্ন, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণে আমি পাগলপ্রায় হয়ে গেলাম।

সারারাত ঘুম হয় নি। খুব সকালবেলা বিছানা ছেড়ে উঠে দূরের নদীর পাড়ের দিকে তাকালাম। এখনো সকাল হয়নি। শান্ত আর চুপচাপ নদীর পাড়টা। আজকাল ওই নদীর পাড়ের দিকে তাকালেই বুকটাতে ভার হয়ে যায়। কেমন যেন শূণ্যতা অনুভব করি। এশাকে আজকাল খুব করে মিস করি। প্রচন্ড রকম ভালোবেসে ফেলেছিলাম পাগলীটাকে। চঞ্চলতার মাঝেও নিজের বোনের মতোই আগলে রাখতো আমায়। আজ বড্ড একা হয়ে গেছি। ত্রাত্রি কবে ফিরবে কে জানে? ত্রাত্রির বাসা অনেকদূর, এতটুকুই জানি। ভারি চুপচাপ ও। এশার সাথে বিন্দু বিসর্গ মিল পাওয়া যাবে না।

এরপর সন্ধ্যার দিকে ফ্রেশ হয়ে ডাক্তার ইকবাল হাসনাতের চেম্বারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এ শহরে সাইকোলজিস্ট হিসেবে উনার বেশ সুনাম। আমার ফ্ল্যাট থেকে বড়জোর দশ পনেরো মিনিটের পথ। হেঁটে হেঁটেই চলে যেতে পারবো।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর মনে হচ্ছে, কেউ আমার পিছু নিয়েছে। এক পা, দুই পা, তিন পা। প্রতিটা পদক্ষেপে সে আমার সঙ্গে এগিয়ে আসছে। তার নিশ্বাসের শব্দটাও বেশ গাঢ়। ভয়ে আর পা উঠছে না আমার। আবার পিছেও ফিরে তাকাতে পারছি না। আমার সাথে রাস্তা অব্দি চলে এসেছে! সবকিছু কেমন যেন ভারি ভারি লাগছে এই মুহুর্তে। ভয় সমস্ত শরীর ঘেমে একাকার।মাথাটার ভিতরেই প্রতিটা নিউরণে হঠাৎ কেমন যেন ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম।

চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি। মাথার পাশে ত্রাত্রি আর ফাইজা আপু দাঁড়িয়ে আছে। ত্রাত্রির একটা হাত আমার মাথার উপরে। ফাইজা আপু আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে মুখটা নিচু করে মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,
– এখন কেমনবোধ করছো?

-ভালো। কিন্তু…

ত্রাত্রি মুচকি হেসে বললো- তুই রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলি। অনেক খুঁজে খুঁজে লোকগুলো তোর ফোন থেকে ফাইজা আপুকে কল দিয়েছিলেন। হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলাম। পরে ডাক্তার ডেকে এখানেই ট্রিটমেন্ট করানো হলো।

-তুই কখন ফিরেছিস?

-সে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। আমার কথা বাদ দে তো। তোর মতোন ভিতু আমি জীবনেও দেখি নি। কিসব আজগুবি কাজ শুরু করেছিস? মাথার ব্যথাটাও মনে হচ্ছে কমে নি তোর।
বাইরে রিদম দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ডাকবো?

মাথাটা দুলিয়ে ওকে ইশারা করে রিদমকে ভিতরে ডেকে নিয়ে আসতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিদম এসে দাড়ালো আমার পাশে। উদ্বাস্তুর মতোন চেহারা হয়ে গেছে ছেলেটার। কলেজের সবচেয়ে বেস্টফ্রেন্ড সে আমার। প্রতিটা কাজে রিদম ছাড়া একমুহূর্ত ভাবতেই পারি না। রিদমকে ভেতরে আসতে দেখে ফাইজা আপু দরজার দিকে সরে দাড়ালেন। ত্রাত্রিও রান্নাঘরে চলে গেছে রিদমের জন্য চা বানাতে।

রিদমকে দেখে মৃদু হাসির চেষ্টা করে বললাম,
-কেমন আছো?

রিদম বেশ অভিযোগের স্বরে জবাব দিলো,
-নিজে বিছানায় পড়ে থেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, কেমন আছো। তোমার এমন অবস্থায় আমার ভালো থাকার কথা?

– কী করবো বলো? তোমার সাথে এই কয়েকটা দিন যোগাযোগ করতে পারিনি। আমাদের ফ্ল্যাটে বিশেষ করে আমার এই ঘরটাতে আজকাল সব অদ্ভুতুড়ে ঘটনা ঘটছে, শুনলে তোমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাবে।

রিদমকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মনে হয়, সারাদিন খাওয়া,গোসল কোনোটাই এখনো করার সুযোগ পায়নি। রাতদিন পড়াশোনা আর টিউশনি নিয়েই ওর জীবন। শুষ্ক স্বরে বললো,
-তোমার উচিত ছিলো আমাকে সবটা জানানো। ব্যাপারটা কী বলো তো?

-বললে বিশ্বাস করবে?

-আহা, আগে বলে তো দেখো।

বেশ কয়েক মুহুর্ত রিদমের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার কথা অবিশ্বাস করার মতোন ছেলে সে নয়। বিগত দিনগুলোতে যা যা ঘটেছে, সবটা ওকে বললাম। ধীরে ধীরে রিদমের হাসিমাখা মুখটাতে চিন্তার ভাঁজ হয়ে উঠলো। এক পর্যায়ে সে আমার পাশেই ত্রাত্রির বেডে নিশ্চুপ বসে পড়লো। ওর মাথার উপরের দেওয়ালে ওয়াল ঘড়িটা টিকটিক আওয়াজ তুলছে। তাকিয়ে দেখলাম, ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে এগারোটা। রিদম বেশ গম্ভীর সুরে বলতে লাগলো,
-তোমার এতবড় সমস্যা,আর তুমি আমাকে আজ জানাচ্ছো? এভাবে তো চলতে দেওয়া যাবে না। আমি বিষয়টা…

ওর কথা শেষ হয়না। হঠাৎ ঘরের ইলেকট্রিসিটি চলে গেলো। ঘরজুড়ে অন্ধকার। শুনতে পেলাম “আহ!” বলে শব্দ করে কেউ যেন বিছানায় পড়ে গেলো। হ্যাঁ, ওটা তো রিদম। চিৎকার দিয়ে রিদমকে ডাকবো, ঠিক সেই মুহুর্তে কেউ একজন বাজখাঁই গলায় বলছে,
“তোর সাহস কী করে হয়, একটা ছেলে হয়ে আমার বিছানায় বসতে.?এতক্ষণ অব্দি আমি সহ্য করেছি। এবার তোকে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এই বিছানাটা আমার। শুধুই আমার।..

(চলবে…)