৩.২০ মিনিট পর্ব-০১

0
1301

#৩.২০ মিনিট
#রাবেয়া_সুলতানা
#১

___আজ আপনার বিয়ে হয়েছে আর আজকেই আপনার স্বামী খুন হয়েছে এতে আপনার কি কিছু বলার আছে?
কথাটা শুনে জেবা এস আই মাসুদের দিকে একবার তাকিয়ে নিচের দিকে তাকালো।হঠাৎ চমকে আবার উনার দিকে তাকিয়ে, কি বললেন আপনি? আমার স্বামী খুন হয়েছে মানে কি?(ভ্রু কুঁচকে কথাটা বললো জেবা)

-জ্বী আপনার স্বামী খুন হয়েছে।আসলে এইভাবে এই মূহুর্তে আপনাকে কথা গুলো বলা উচিৎ না কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই। তদন্ত করার জন্য আমরা আপনাকে জানাতে হয়েছে।জেবা মাসুদ সাহেবের কথা শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারছেনা।চিৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে, কি আবল তাবল কথা বলছেন আপনারা।আমার স্বামীর কিচ্ছু হতে পারেনা।ও কোথায় আছে আপনারা বলুন?

জেবার চেঁচামিচি শুনে সবাই জেবার রুমে আসলো।জেবা তার শাশুড়ীর কাছে গিয়ে তাকে ঝাঁকিয়ে বললেন, মা আপনার ছেলে কোথায়? মা এরা এইসব কি বলছে? আপনার ছেলে নাকি আর নেই।কথাটা বলতেই জেবা চিৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।
জেবাকে জিসানের মা জড়িয়ে ধরে, তুমি কেঁদোনা।আমিও যে কিছু বুজতে পারছিনা।এরা হঠাৎ এসেই কি যা তা বকে যাচ্ছে।মাসুদ সাহেব এইবার দাঁড়িয়ে বললেন,মিসেস জেবা আপনার স্বামীর সাধারণ কোনো মৃত্যু হয়নি। উনাকে কেউ খুন করেছেন।লাশটা দেখলে মনে হয় খুনি তার প্রতিশোধ নিতেই উনাকে খুন করেছেন।তাই আমরা আগে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছি, বিয়ের দিন একটা মানুষ খুন হয়েছে নিশ্চয়ই কেউ জেনে শুনেই করেছে।তাই আপনাকে বলছি আপনার কি কারো সাথে আগে রিলেশন ছিলো যার কারনে এই খুন।

-জাস্ট শেটাপ, আমার স্বামীর সাথে আমার ৩ বছরের রিলেশন। আর আপনি সন্দেহের তীরেটা আমার দিকেই ঘুরাতে চাইছেন? আমার স্বামী এখন কোথায় আছে সেটা বলুন আমি আমার স্বামীর কাছে যাবো। জিসান আমাকে এইভাবে একা রেখে চলে যেতে পারেনা।(কথা গুলো বলতেই জেবা কান্না করে দিলো)

-ঠিক আছে মিসেস জেবা চলুন।আমরাও চাই আপনি আপনার স্বামী লাশটা একবার দেখুন।মাসুদ তার দলের একজনকে ইশারা করে, উনাকে আমাদের সাথে নিয়ে আসো।

জেবা উনাদের সাথে যাবার জন্য পা বাড়াতেই,জিসানের চাচী এসে জেবার হাত ধরে,জেবা তুমি কি করছো? তুমি এই বাড়ির নতুন বউ।এই ভাবে পুলিশের সাথে বেরিয়ে যাওয়াটা লোকে ভালোভাবে নিবেনা মা।জিসানের বাবা কাকারা তো যাচ্ছেই।

জেবা জিসানের চাচীর হাত সরিয়ে,এই মূহুর্তে স্বামীর থেকে বড় কিছু আমার কাছে হতেই পারেনা।আমার স্বামী যেখানে চলে গেছে সেখানে আমার বউ সেজে বসে থাকা মানায় না চাচী।জিসান নাকি খুন হয়েছে। আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।জিসান তিন বছরে সম্পর্ক এক দিনেই শেষ করে দিয়ে আমাকে এই দয়া মায়াহীন পৃথিবীতে একা রেখে যেতে পারেনা।কথা গুলো বলে সামনে পা বাড়ালো জেবা।

মাসুদের সাথে চলে এলো জেবা যেখানে জিসান খুন হয়েছে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে জিসানের লাশের পাশে দাঁড়ালো।জেবা এখনো গাড়িতেই বসে আছে।মাসুদ জেবার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলো গাড়ি থেকে নামতে।

জেবা ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে জিসানের লাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে, দৌড়ে জিসানকে ধরতে যাবে এমন সময় মাসুদ মহিলা পুলিশ দুজনকে ইশারা দিলো জেবাকে আটকানোর।জেবাকে সরিয়ে এনে দাঁড় করিয়ে একজন বললো, উনাকে স্পর্শ করা যাবেনা।জেবা পাথরের মক্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে জিসানের লাশের দিকে তাকিয়ে ।চোখের পানি যেন নিমিষেই থমকে গেলো মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা।জেবা আস্তে করে মাটিতে লেপ্টে বসে গেলো।

মিস্টার মাসুদ জেবার সামনে এসে হাটু গেড়ে বসে,মিসেস জেবা আপনি কি কিছু খেয়াল করেছেন?
জেবা মাসুদের দিকে একবার তাকিয়ে আবার জিসানের লাশের দিকে তাকালো।হাত দুটো পিছন থেকে বাঁধা, পা গুলো বাঁধা কিন্তু যেটা দিয়ে বাঁধা হয়েছে সেটা একটা মেয়ের ওড়না।

-ওড়ানা টা কি আপনি চিনেন?
চুপ করে আছে জেবা। মাসুদ আবার জিজ্ঞেস করলো আপনি কি ওড়নাটা চিনেন।
জেবা কিছু বলছেনা।জেবার বুকের ভেতর সব দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাউকে বুজাতে পারছেনা।

জিসান কে নিয়ে গেলো পোস্টমর্টেম করার জন্য।আর জেবাকে নিয়ে এলো বাড়িতে।জেবার বার বার জিসানের ক্ষতবিক্ষত লাশটার চোখের উপর ভাসতেই চোখ গুলোকে বন্ধ করে ফেললো। জেবার বাবা মা চলে এসেছে জিসানদের বাড়িতে। সবাই আতংকিত হয়ে আছে।বাড়িটাতে অদ্ভুত ভয় বাসা বেঁধেছে। অনেকেই জেবার উপর আঙুল উঠিয়ে কথা বলতে ছাড় দিচ্ছেনা।কিন্তু জিসানের পরিবার জেবাকে কিছুই বলছে না।সবাই জায়গায় জায়গায় যে যার মতো কান্নাকাটি করছে।জেবা এখনো নিজের রুমে, সেই যে নিয়ে আসা হলো এখনো রুম থেকে বের হয়নি।জিসানের রুমে এলো মেলো হয়ে আছে।টেবিলের উপরে ছড়ানো ছিটানো বই, বাসর ঘর সাজাবে বলে ফুল এনেছিলো সেই ফুল গুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।কিন্ত বাসর আর সাজানো হলো না।জেবা খাটের মাঝখানটায় বসে আছে।চুল গুলো এলোমেলো, চোখের কাজল লেপ্টে আছে চোখ মুখ লালবাতির মতো হয় আছে। স্তব্ধ থাকা মুখটার দিকে তাকানোই যেনো যাচ্ছেনা। একের পর এক লোক গুলো আসা যাও করছে আর নানা রকম কথা বলে যাচ্ছে।
জিসানের কাকা এসে বলে গেলো জিসানের লাশ পোস্টমর্টেম করে সকাল বেলা নিয়ে আসা হবে।
জেবার মা মেয়েকে জড়িয়ে বসে আছে।জেবা দেওয়ালে থাকা জিসানের ছবি গুলোর দিকেই তাকিয়ে আছে।নানা রকম ভংগীতে জিসানের ছবি গুলো দেয়ালে ঝুলছে সাথে জেবারও। একটা ছবির দিকে তাকাতে জেবার মনে পড়লো জেবার সাথে জিসানের প্রথম দেখা।জেবা কলেজ থেকে আসার সময় বান্ধুবীদের সাথে দুষ্টুমি করতে করতে কখন যে ফুটপাতের রাস্তা ছেড়ে মেইন রাস্তায় চলে গেলো খেয়াল করেনি।তাসপিয়া জেবার মুখে কিছু লাগাতে গিয়ে জেবা সরে যেতেই জিসানের মোটরবাইকের সামনে এসে পড়লো।জিসান মোটর বাইক থামিয়ে নেমেই জেবার গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে,ফাজিল মেয়ে কোথাকার। এখন যদি কিছু একটা হয়ে যেতো তাহলে দোষটা তো আমারই হতো।
কলেজে যাও কি এই রাস্তাঘাটে এইসব করার জন্য? তোমাদের ফ্যামিলি লোকেরা তোমাদের মতো বেয়াদব ছেলেমেয়েদের শাসন করেনা তাই আজ তোমাদের এই অবস্থা। কথা গুলো জিসান রাগের মাথায় একদমে বলে যাচ্ছে আর কপালের দুপাশ দিয়ে ঘাম ঝরিয়ে পড়ছে।

জেবা চোখ মুখ কুঁচকে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সেই সময় জিসানের সাথে থাকা তার ফ্রেন্ড জেবার কয়েকটা ছবি তোলে ফেলে। সেটা দেখে জিসান তার বন্ধুর উপরেও ক্ষেপে যায়।

জেবার বান্ধুবীরা চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে একটা বললে উঠলো, স্যরি ভাইয়া”আমরা বুজতে পারিনি।আর কখনো এমন হবে না।

জেবা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে আর চোখ গুলো টলমল করছে।

জিসান জেবার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো, ইটস ওঁকে। এইভাবে আর কখনো করবেনা।তোমার যদি আজ কিছু হয়ে যেতো তাহলে তুমিই বলো তোমার বাবা মায়ের কি অবস্থা হতো।সেই সাথে আমার ও প্রবলেম হতো।আর কখনো বেখেয়ালি হয়ে চলবেনা।নিজের সাবধানতা নিজে অবলম্বন করবে।রোজ রোজ আমার মতো কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না।

কথা গুলো বলে জিসান আবার নিজের বাইকে উঠে চলে গেলো।

আর সেই ছবিটাও জিসান দেওয়ালে লাগিয়ে রেখেছে।
কথাটা ভাবতেই চোখ বন্ধ করে আবার বললো জিসান কেনো তুমি চলে গেলে আমায় রেখে? কেনো নিয়ে গেলেনা আমাকে সাথে? আজ রাতে তো আমার একা থাকার কথা ছিলোনা জিসান।তুমিই তো বলেছো ছাদে গিয়ে আমরা দুজন চন্দ্রবিলাশ করবো।রাতের আকাশ কে সাক্ষী রেখে তারাদের সাথে রাত জাগবো।যখন ভোর হবে পাখির দল বেঁধে এই পান্ত থেকে ওই পান্ত ছুটে বেড়াবে তখন আমি তোমার কাঁধে মাথা রেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবো।জেবা কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছে তার মায়ের কোলে।
সকাল ৬.০০ টা থমথমে বাড়িটা যে যেনো হঠাৎ করেই হৈচৈ শুরু হয়ে গেলো।জেবার কানে শব্দ আসতেই চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে তার পাশে কেউ নেই শুধু তার মা মাথার পাশে বসে মিন মিন করে কান্না করে যাচ্ছে।

মা আমার জিসানকে নিয়ে এসেছে? বাহিরে এতো হৈচৈ কিসের? জেবা দৌড়ে উঠে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখে প্রচুর লোকের আনাগোনা। সবাই জেনো জোড়ো হয়ে কিছু দেখছে।জেবার বুকের ভিতর যেনো সব তলিয়ে যাচ্ছে।চটপট করছে বাহিরে কি হয়েছে দেখারা জন্য।এমন সময় জিসানের বড় বোন এসে,আন্টি জেবাকে নিয়ে আসুন।জিসানের লাশটা ওকে একবার দেখানো উচিৎ।

জেবার মা উঠে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে, চল মা শেষ বারের মতো ছেলেটাকে এক নজর দেখে নে।

জিসানের বোন আর জেবার মা জেবাকে নিয়ে এসে লাশের খাটের সামনে জেবাকে দাঁড় করালো।

জেবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধপাস করে খাটের সামনে গিয়ে বসে,ধীরে ধীরে হাত এগিয়ে নিয়ে জিসানের গাল ছুয়ে চিৎকার দিয়ে,জিসান”

জিসান তুমি এইভাবে কেনো শুয়ে আছো? জিসান, তুমি না বলেছো যেখানে যাবে আমাকে সাথে নিয়ে যাবে? আজ তাহলে একা যাচ্ছো কেনো? জিসান তুমি একবার উঠো আমি তোমার সাথে আর ঝগড়া করবোনা।অভিমান করবোনা।তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো।কথা গুলো বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদছে জেবা।

-জেবা ভালো করেই জানে জিসান আর আসবেনা তবুও শুধু শুধু এইগুলো বলে কি লাভ? ছেলেটা তো চলেই গেছে আমাদের সবাইকে ছেড়ে। ছেলেটার এমন ভাবে মরবে কখনো কল্পনা করা যায় না।কারো সাথে তো শত্রুতাও নেই।কখনো কারো সাথে ঝামেলাও করতো না।
জিসানের চাচা কথা গুলো বলছে আর চোখের পানি মুছচ্ছে।
জেবাকে জোর করে ঘরে নিয়ে আসা হলো।জিসানের মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।জিসানের চাচাতো ভাই ডাক্তার, সেই জিসানের মায়ের পাশে বসে আছে।জিসানকে নেওয়ার পর জেবা আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।

চলবে,,,,,