অতিরিক্ত চেয়েছি পূর্ণতায় পর্ব-১০

0
286

#অতিরিক্ত_চেয়েছি_পূর্ণতায়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১০

ইফতিয়াস স্বাভাবিক আচরণ করছে ঠিক তবে তার ফোনে চলছে বিরাট ষড়যন্ত্র। ইশিতার অগোচরে স্ত্রীর ফোনের মধ্যে রাফিয়ার ফেসবুক আইডি খুঁজে চলেছে। রাফিয়া নাম লিখে বারংবার সার্চ করেও সুফলতা পেল না। কোনোভাবে তার আইডি হাতে পেলেই হবে! বাকি অপদস্থতা সে নিজ হাতে শিকার করবে। ইশিতা আপনমনে খুশির উল্লাসে শাওয়ার নিচ্ছে। প্রতিটা রাত্রি তাদের জন্য সুখকর মুহুর্তের মত। আকস্মিক বেল বাজার শব্দে শাওয়ারের মাঝে ধ্যান ফিরে ইশিতার। ইফতিয়াস ভড়কে গেল। স্ত্রী শাওয়ার থামিয়ে বের হবে এই ভয়ে সে তৎক্ষণাৎ ফোনের মধ্যে থেকে সব তথ্য মুছে নেয়।

দরজা খুলে দেখে এক ওয়েটার হাতের মধ্যে ট্রে করে ডিনারের আইটেম এনেছে। ইফতিয়াস দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। কারণ স্ত্রীর নজর থেকে এ যাত্রায় রক্ষা পেল। ট্রে হাতে নিয়ে দরজা আটকে দেয়। ইতিমধ্যে নাইটিসুট পরিহিত অবস্থায় বিছানায় আয়েশে আবেদনীয় ভঙ্গিতে বসে রইল ইশিতা। হাতে তার নিজের ফোন। ঘাঁটাঘাটি করছে ও অপেক্ষা করছে স্বামীর আগমনের। টেবিলে ট্রে রেখে স্ত্রীর সাজ রঞ্জন দেখে আনমনে তাচ্ছিল্যেতা প্রকাশ করে ইফতিয়াস।
ইশিতা ট্রের মধ্যে ডিনারের আইটেম দেখে ইফতিয়াসকে নিয়ে খেতে বসে।
খাবারের মাঝে মন বসাতে চেয়েও পারছে না ইফতিয়াস। বারে বারে ইশিতার আকর্ষণীয় সদ্য স্নান নেওয়া শরীরের দিকে যাচ্ছে। কোনোমতে রাতের খাবার শেষ করে বিনা বাক্য ব্যয় করে চলে যায় ইফতিয়াস। তার কর্মে যেন হতভম্ব হলো ইশিতা। নিজের দিকে একবার চেয়ে, স্বামীর প্রস্থান করার অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। তবে খোঁজে পেল না এর কারণ!
নাইটিসুট পরিহিত অবস্থায় শুয়ে পড়ে সে। ভাবতে লাগল পরিশেষে এক ফাইভ স্টার হোটেলে তাদের অবস্থান হলো। এতদিন নির্জন গুহায় থেকে থেকে দুজনের শরীরে গরমের লাল রেশ,দাগ চলে এসেছিল। ফাইভস্টার হোটেলে নিজেদের টাকা দ্বারা খাচ্ছে ও কাজ করছে। কাজ যে ইফতিয়াস করছে তা নয়। বরং ইশিতা আউটসোর্সিং করে অনলাইনে ইনকাম করছে।
____

রাফিয়ার সঙ্গে কথা বলার দায়ে বেশ চ’ড়,লা’থ খেতে হয়েছে ইশরাকের। ভার্সিটির সকলের মুখে নানান গুঞ্জন শুনে বাকরুদ্ধ হলো সে। মুখের মধ্যে যে দমটা ছিল নিমিশেষে ফুড়ৎ করে উড়াল দিল তার। ইশরাকের বন্ধুবান্ধবীরা অসহায়,ভীতি দৃষ্টিতে রাফিয়াকে দেখছে। তাদের কাছে এই ভীতিগ্রস্থতার কারণ হলো রাফিয়ার সঙ্গে নিশ্চয় কোনো মন্ত্রী টন্ত্রী টাইপ ব্যক্তির সম্পর্ক আছে। না হলে কেউ কাউকে খালি কথা বলার দায়ে এত আঘাত করতে পারে! রাফিয়া বিষয়টি এড়িয়ে ইশরাকের ফ্রেন্ডসার্কেলের কাছাকাছি যেতেই তারা ভূত দেখার মত চমকে উঠে। রাফিয়া আনমনে দ্বিধা রেখে বলে,

‘তোরা আমার থেকে নজর লুকিয়ে চলছিস কেন!’

সকলের মাঝে আমতা ভাব পরিস্ফুটিত হলো। মুখ লুকানোর স্থান না থাকায় একজন বলে উঠে।

‘চল তো ভার্সিটির বাহিরে বিকাশ আছে টাকা ভরব।’

তার কথার মাঝে ফ্রেন্ডসার্কেল সায় দিয়ে দেয়। এতে বিষন্নতার সৃষ্টি হয় রাফিয়ার মনে। সে বিষন্নতা লুকিয়ে দৃঢ় গলায় বলে,

‘বিকাশ একজন করবে বাকিরা কেন যাচ্ছিস!’

চুপছে যায় তারা। তাদের মধ্যে গম্ভীর নিরব থাকা মেয়েটি সূচাঁলো দৃষ্টিতে চেয়ে এগিয়ে এলো। রাফিয়ার চোখে চোখ রেখে তীক্ষ্ণতার স্বরে বলে,

‘দেখ বোইন তোর মত উচ্চবিত্তের সম্পর্কওয়ালীর সঙ্গে আমাদের ফ্রেন্ডসার্কেলের কোনো সামঞ্জ্যতা নেই। প্লিজ আমাদেরকে আমাদের হালে ছেড়ে দেয়। তোর কারণে মেডিক্যালে ভর্তি ইশরাক। যদি সে স্বেচ্ছায় তোকে আমাদের কাছে না আনতো তবে তোর মত উচ্চবিত্তের সঙ্গে আমাদের পরিচয়ই হতো না। না হলেই ভালো হতো। চল সবাই।’

মেয়েটির রুক্ষ কণ্ঠে তীব্র রাগের সঙ্গে প্রণয়ঘটিত ব্যক্তির আহত শরীরের বিস্ফোরিত মনের স্বর শুনতে পেল রাফিয়া। চোখজোড়া নামিয়ে পা পিছিয়ে ধীরস্থিরভাবে প্রস্থান করে সে। হৃদয়ের ব্যক্তির একটুখানি আহত অবস্থাও দম বন্ধ করার জন্য যথেষ্ঠ। ইশরাকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিংকু বলে,

‘ফারিজা এভাবে না বললেও পারতি! মেয়েটারই বা কি দোষ ছিল! সে তো জানতই না এমন কিছু তার কারণে ঘটে যাবে।’

বিনিময়ে ফারিজা নিশ্চুপ রইল। শান্ত নিবিড় নেত্রপল্লবে ইশরাকের আহত শরীরের ঘুমন্ত চেহারা ভেসে উঠে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল ঐ মেয়েটাকে দেখতেই। পূর্বে যাও বান্ধবীপূর্ণ ভাব ছিল নিমিত্তে মিটে গেল। একটুর জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলতে সে! তিবিৎতম শ্বাস নিয়ে প্রস্থান করে ফ্রেন্ডসার্কেল মাঝ থেকে। ইশরাকের সঙ্গে দেখা করা উচিৎ।

অন্যত্রে রাফিয়া নিজেকে রুমবন্ধি করে নেয়। রুজহানের কারণে সে পুনরায় সঙ্গহীন হয়ে গেল। অথচ কোনোভাবেও তার ও ইশরাকের মাঝে সে দিন পরিচয় হবার পর থেকে কথা হয়নি। বরং সামনে মুখোমুখি হলে সালাম,হাই,হ্যালো কেমন আছিস ব্যস এটুকুতে সামীবদ্ধ ছিল। আজ তাও ব্যারিষ্টার গন্ডা’লের জন্য হারিয়ে ফেলল। নিরবে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে সে। পুরু ভার্সিটির সামনে নির্দোষ হয়েও দোষী সাব্যস্ত হলো। সে চাইলেই প্রতিবাদ করে উঠতো তবে করেনি কারণ তাদের অধিকার আছে বন্ধুর আহত হওয়ার কারণবশত অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার। ফলে ইশরাকের অন্য বন্ধুবান্ধব দোষ না দিলেও তার আপনসত্ত্বা তো দিয়েছে। হ্যাঁ সে জানে ফারিজাই ঐ মেয়ে যাকে ইশরাক মনমতো পছন্দ করে চুপ থাকে। মুখ ফুটে না বলার ব্যথতা কাটিয়ে উঠতেই সোমবারে ক্যাফটেরিয়ার মধ্যে হাত ধরে সহায়তা চেয়ে ছিল। যার উপকৃতের চেয়েও বেশি অপকৃত হলো আজ।

_____

কোর্টের মোকাদ্দমা শেষে হাঁপানোর ন্যায় রেলিং ধরে দাঁড়ায় রুজহান। বিপক্ষকে হার মানাতে তার জান কলিজা বেরিয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো জান কলিজার মাঝে থাকা হৃদয়টা বের হয়নি। তাহলে সকলের সামনে তার রাফুরাণীর ছবি বেরিয়ে পড়ত। তখন গুন্ডা দল এসে তার হৃদয়ে ভাগাভাগি চাইতো। হা! এত সহজ হৃদয়ের ভাগাভাগি করবে আসছে কোথাকার কোন গুন্ডা। আচ্ছা আমি নিজেই তো গুন্ডা অন্য মানবরে আর কি বকবো!
আনমনে ভেবে রুজহান নিজেই খিলখিলে হেসে দেয়। তখনি একজন সুরেলী গলায় ‘এক্সকিউজ মি’ বলে। তার পাশ থেকে মেয়েলী কণ্ঠ পেয়ে ভ্রু কুঁচকায়। মেয়ের পরণে লাল শাড়ি আশ্চর্য হলো রুজহান! সে তো বিয়ে করেনি বরং রাফিয়াকে বুকিং দিয়ে অন্য মেয়ের দ্বারপ্রান্তেও ঘেঁষেনি। তবে কোন মেয়ে বধূর সাজে দাঁড়িয়ে আছে এই!
কেন তার সঙ্গে এক্সকিউজ মিওয়ালা রিলেশন করবে! আবুল তাবুল ভাবনা তার মাথায় অগণিত আসতে থাকায়। একজটে মাথা ঝেড়ে নেয়। চুল সেট করে ‘ইয়েস’ বলে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায় রুজহান। মেয়েটি ভেবাচ্যাকা খেল ব্যারিষ্টারের ওমন চাহনীতে। কাশি দিয়ে বলে,

‘আপনিই সে যার কথা আমার পক্ষত্বের লোকেরা বলে ছিল। হুম স্মার্ট,ডেশিং বয়। আপনাকেই চয়েজ করা হলো সামনের দুসপ্তাহ পর আমার বিপক্ষ দলকে হারানোর জন্য। সো মিস্টার হোয়াট’স ইউর নেইম!’

বেশ ভাবপূর্ণ শৌখিনতা বিরাজ করছে মেয়েটির আচরণে। যা কখনো সে রাফিয়ার মাঝে দেখেনি। মেয়েটি এতটা সহজ সরল যে প্রতিবারই ভালোবাসার সাগরে ডুব দিতে মন চাই তার! রাফিয়ার কথা ভেবে ঠোঁট কামড়ে ‘নো’ বলে। মেয়েটি তার প্রশ্নের জবাবে ‘নো’ শুনে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,

‘নো ফর হোয়াট!’

‘নো মিনস আইম নট ইন্টারেস্টেড ফর ইউর কেস। এন্ড হোয়াটএভার ইউ আর! যে আমার নামই জানে না, তার কেস কেমন হবে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ওকে মিস বাই।’

সিড়ির মধ্যে পা ফেলে চার সিড়ি পার হওয়ার পূর্বেই পেছন থেকে ‘ব্যারিষ্টার তাওসীফ রাইট!’
উপাধির সঙ্গে নামে ডেকে উঠে। কদম থেমে যায় রুজহানের। সে শেষ এক সিড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি মুচকি হেসে রুজহানের সন্নিকটে এসে দাঁড়ায়। তার পা পথের উপর ফেলে রুজহানের পথ আটকে দেয়। শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রুজহান। একটুও বিরক্তির সূচকে ‘হু টু উফ শব্দ’ বের করছে না। মেয়েটি মিটমিটিয়ে হেসে বলে,

‘আপনার নাম আইডিকার্ডের উপর দেওয়া আছে। অফকোস আই নো ইউর নেইম এন্ড হাইডেন্টি। নাউ আই হোপ ইউ উইল হ্যান্ডেল মাই কেস।’

কথার প্রত্যত্তুর করার ইচ্ছে পোষণ করেনি রুজহান। মেয়েটিকে এড়িয়ে পাশ কেটে চলে যায় বাইকের কাছে। দূর থেকে বাইকে বসা ব্যারিষ্টারের ফর্মে তাওসীফকে যে মানানসই লাগছে তা মেয়েটার চোখে রুপ ধাঁধানোর মত লাগছে। মৃদু হেসে বলে,

‘আপনাকে তো আমার কেস নিয়ে লড়তেই হবে মিস্টার ব্যারিষ্টার! যাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ। এই এরিশা মেহজাবিনের পক্ষ নিয়ে লড়বেন আপনি।’

বাসায় শুনশান নিরবতা দেখে রুজহান হা করে তাকিয়ে রইল। সোফায় বসা অবস্থায় মিসেস আরজিয়া ছেলেকে ভেতরে আসতে দেখে। উঠে দাঁড়ায় অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে ছেলের দিকে এগিয়ে যায় । তার স্বামী দিবায়েত সাহেব নিশ্চুপ। রুজহান তার মায়ের এগিয়ে আসা দেখে কিছু বলার পূর্বেই মিসেস আরজিয়া উত্তেজিত মনে ছেলের কান মলে দেয়। রুজহান ‘আহ মা কি হলো ছাড়ো!’ বলে উঠল।
মিসেস আরজিয়া কান আর শক্তভাবে মলে দিতে থেকে বলে,

‘কেন করলি তুই রাফিয়ার সঙ্গে এমন কুকর্ম। মেয়েটা সবেই ভার্সিটির মধ্যে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশে স্বাভাবিক হচ্ছিল। তুই গিয়ে মাতলামি করে কাজ বিগড়ে দিলি। বলি তোর কি আক্কেল জ্ঞান নেই!’

‘আমি কবে কার সাথে মাতলামি করলাম।’

কান ছেড়ে হতাশ দৃষ্টিতে চাইল মিসেস আরজিয়া। ছেলে তার বাহানা দিতে কেন চাইছে! তিনি করুণ গলায় আওড়ায়।

‘রাফুমামুনি নিজেকে রুমবন্ধী করে রেখেছে। তুই নাকি তার ভার্সিটির কাকে মে’রে হাসপাতাল ভর্তি করিয়েছিস। রাফুমামুনি ও ছেলেটার কোনো প্রকার দোষই ছিল না।’

হতভম্ব হলো রুজহান। তার মা কি বলছে সব যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আসল ঘটনা কি তা জানার পূর্বেই চিৎকার শুনা গেল রাফিয়ার রুম থেকে।

চলবে…..