অথৈ জলের পুষ্পমাল্য পর্ব-০৬

0
315

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু

৬)
শাওন ফিরেছে দুই দিন পর। এই দুইদিনে শাওনের সাথে রীমার বিশেষ কোনো কথাই হয়নি। যতবারই রীমা কল দিয়েছে, শাওন ব্যস্ততার অজুহাতে ততবারই লাইন কেটে দিয়েছিল। সাধারণত অফিসের কাজে শাওন বাহিরে গেলে রীমা খুব একটা কল দেয় না। এবার কেন জানি মায়ের কথা শুনার পর থেকে রীমার আর কিছু ভালো লাগছিল না। সে মরিয়া হয়ে গেছে শাওন ফিরে আসার জন্য।
মায়ের সন্দেহ, তার ধারণা সব নিচক মিথ্যা এটা রীমা প্রামাণ করবেই। তার শাওন বদলে যায়নি। বদলাতে পারে না। সবটাই পরিস্থিতি। রীমা একটু তৎপর হলে, সবটা আগের মতো হয়ে যাবে।

শাওনের যতটা পরিবর্তন সবটাই রীমার উদাসিনতা এটা তো রীমা অস্বীকার করতে পারবে না। সন্তান হওয়ার অজুহাতে রীমা রাতের পর রাত শাওনকে বঞ্চিত করেছে। কাছে আসলে বিরক্ত প্রকাশ করেছে।

এবার আর রীমা এমন করবে না। সবটা ঠিক করে নেবে। নারীরা পারে না, এমন কোনো কাজ নেই। রীমাও পারবে।

শাওন ফিরে এলো ঠিকই কিন্তু দুইদিন স্ত্রী -সন্তান ছাড়া থাকায় একটা পুরুষের মাঝে যে শূণ্যতা থাকার কথা সেটা শাওনের মাঝে চোখে পড়ল না।

বরং এসেই সে উল্টো রীমার সাথে রাগারাগি শুরু করে দিল।

“জানোই তো অফিসের কাজে বাহিরে গেছি, প্রতি ঘণ্টায় ঘন্টায় ফোন দিয়ে বিরক্ত কেন করলে রীমা? দেখি কি এমন জরুরী আলাপ করার জন্য বারবার ফোন দিয়েছিলে বলো তো শুনি।”

রীমা যেন এই মানুষটাকে চিনে না। তার সামনে অগ্নিমূর্তি ধারন করে বসে থাকা লোকটা রুপাইর বাবা নয়, সে অন্য কেউ। অন্য গ্রহের অন্য মানুষ। রীমা হারিয়ে ফেলেছে শাওনকে।
কিন্তু কোথায় হারিয়েছে? কখন হারিয়েছে? কেন টের ফেল না?
রীমা বুঝতে পারল এই সময় মেজাজ খারাপ করলে লাভ হবে না। তাই সে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলে নেয়ার চেষ্টা করল।

সে উঠে গিয়ে শাওনের হাত ধরে,পাশে বসে আলতো করে কাঁধে মাথা রাখল।

” বুঝ না কখন একজন স্ত্রী তার স্বামীকে মরিয়া হয়ে খুঁজে!”

শাওন কিছু বলতে যাবে তখনই রীমা হাত দিয়ে শাওনের মুখ চেপে ধরে, চোখ দিয়ে ইশারা করল।

এবার উঠে গিয়ে দরজার সিটকিনি বন্ধ করে, জানালার পর্দা টেনে দিয়ে এসে শাওনের গা ঘেষে বসল। রীমার চোখে দুষ্ট-মিষ্টি হাসি। সে ব্লাউজের হুক খুলে দিয়ে শাওনকে আহবান করল। এই আহবানের ভাষা একজন স্বামীর অজানা থাকার কথা নয়। অথচ শাওন যেন বুঝতেই পারছে না।

” পাগলামী করছ কেন? রুপাই মায়ের কাছে না, কেঁদে উঠলে কি করব?”

” পাগলামীর কি দেখলে? এটা তো মাত্র শুরু।”

শাওন রীমাকে বুকে টেনে নিল, তারপর ঘামাক্ত ঠোঁটে গভীর চুম্বন বসিয়ে দিল রীমার ঠোঁটে, বুকে, ঘাড়ে।
শাওনের আলিঙ্গনে রীমা দীর্ঘদিনের ক্ষুদার্ত বাঘিনির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল শাওনের বুকে। নিজেই উন্মুক্ত করল নিজেকে, শাওনের জন্য অপেক্ষা করেনি।

হঠাৎ শাওনের মোবাইলে রিং বেজে উঠল। শাওন রীমাকে আলিঙ্গন মুক্ত করে মোবাইল পিক করল।

“দুঃখিত রীমা, প্লিজ রাগ করো না। আমাকে এক্ষুণি বের হতে হবে?”

এত বড় অসম্মান রীমা সহ্য করতে পারেনি। তার চোখে টলটল করল পানি। সে ধরা গলায় একবার বলল,

” ফোনটা এই মুহূর্তে পিক না করলে হতো না? আমি ছাড়াও তোমার জীবনে জরুরী কিছু থাকতে পারে? ”

” এসব কি ধরনের পাগলামি রীমা! আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি না-কি! তুমি ছাড়া জরুরী কিছু থাকবে না কেন? আমি অন্যের অধীনে চাকরি করি। সেখান থেকেও ফোন আসতে পারে।”

” শাওন তুমি এভাবে বলতে পারলে?”

” কিভাবে বলছি? তুমিও তো কখনো এত ন্যাকামি করোনি। যাও উঠে গিয়ে দরজা খোল। রুপাইয়ের কান্না শোনা যাচ্ছে।”

সমস্ত অপমান, অসম্মান, প্রত্যাক্ষান নিরবে হজম করে রীমা দরজা খুলে দেখল সীমা রুপাইকে কোলে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, রুপাই কাঁদছে।

সীমাকে সামনে দেখে রীমা রাগ সামলাতে পারল না। শাওনের উপর ঝমানো রাগ ঝাড়ল সীমার উপর।

” তুই এখানে কেন আপা? কালই তুই আমার বাসা থেকে চলে যাবি।”

শাওন এসে রীমাকে চিৎকার দিয়ে ধমক দিলো,

” মুখ খারাপ করছ কেন রীমা? তুমি ইদানিং পাগল হয়ে গেছ।”

সীমা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,

” কোথায় যাব? রুপাই কাঁদছে দেখতে পাচ্ছিস না?”

” একটা ছেলের কান্না বন্ধ করতে পার না তুমি? আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।”

” পারব না কেন? কিন্তু তুই আছিস তাই!”

” আমি মরে গেলে কি করবে?”

” সেটা ছেলের বাবার দায়িত্ব। তোর ছেলের কান্না বন্ধ করার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আমার না।”

রীমা আর সীমার কথার মাঝে এসে শর্মিলি আহমেদ উপস্থিত হলেন।

” সীমা রুপাই কাঁদছে কেন? ”

” জানি না, খুদা লাগছে হয়তো। ”

” ও তো আমার সাথে খেলছিল। তুমি ওকে আমার থেকে নিয়ে এলে কেন?”

শাওন বুঝতে পারছে এখানে পরিস্থিতি ঘোলাটে হচ্ছে, তাই সে মাঝখানে এসে বলল,

“ঠিক আছে সীমাপা আপনি রুপাইকে রীমার কাছে দিয়ে আমার নীল ব্লেজারটা একটু এনে আসুন। এটা পরে বের হওয়া যাবে না।”

সীমা রুপাইকে রীমার কোলে দিয়ে ছুটে গেল শাওনের রুমে।

” কোথায় যাচ্ছ আপা? তুমি শাওনের ব্লেজার কোথায় পাবে? তুমি সম্ভব হলে মাকে একটু চা বানিয়ে দাও। ব্লেজার আমি নিয়ে আসছি।”

সীমা কিছু না বলে চা বানানোর জন্য রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
সীমা যে ব্লেজার নিয়ে ফিরত ত্রিশ সেকেণ্ডে, সে ব্লেজার নিয়ে রীমা ফিরল চার মিনিটে।
কারণ রীমা জানেই না শাওনের কোন আলমারিতে কি আছে? আন্ডার ওয়্যার কোথায় আছে? সকস কোথায় আছে? ব্লেজার কোথায় আছে?
গত এক বছর এই কাজগুলো মূলত সীমাই করেছে। শাওনের জুতা থেকে মোজা, কোর্ট থেকে প্যান্ট সব ধোয়া, ইস্ত্রী করা, আলমারিতে সাজিয়ে রাখা আবার যথাসময়ে বের করে দেয়া এসব নিষ্ঠার সাথে সীমাই করেছে।

সেই সুযোগে রীমা ছেলেকে নিয়ে সুন্দর সময় কাটিয়েছে। শাওনও আর সময়, অসময় রীমাকে বিরক্ত করেনি।
আমার জুতা কোথায়? মোজা কোথায়?ঘড়ি কোথায়? ওয়ালেট কোথায়?
কারণ প্রয়োজনীয় কাজগুলোতো সীমা করেই দিচ্ছে।রীমাও মনে মনে এতদিন বোনের উপর কৃতজ্ঞ ছিল সীমাপা না থাকলে শাওনটা জালিয়ে মারত। সারাদিন ছেলেকে নিয়ে হুড়োহুড়ি করার পর স্বামীর আবদার রক্ষা করতে কার ভাল্লাগে।
এই মুহূর্তে রীমা বুঝতে পারছে নিজের পায়ের কুড়াল সে নিজেই মেরেছে।
একদিনে পরিস্থিতি এত ঘোলাটে হয়নি। এর পিছনে রীমারও দায় আছে।

চলবে…..