অথৈ জলের পুষ্পমাল্য পর্ব-০৭

0
279

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য

কামরুন নাহার মিশু

৭)

সীমা বুঝতে পারল এই পরিবারে তার সময় পুরিয়ে আসছে। যেভাবে হোক, সেটাকে দীর্ঘায়িত করতে হবে। আর দীর্ঘায়িত করার জন্য একমাত্র মাধ্যেম শর্মিলি আহমেদ। তাকে বশ মানাতে হবে। আর মধ্যবয়স্ক মহিলারা কাজেকর্মে গোছানো আর সিরিয়াস মেয়েদেরকেই বেশি পছন্দ করেন। সীমা তাই ইচ্ছে করে সে পথেই হাঁটল।

ইদানিং সে ইচ্ছে করেই আর শাওনের সামনে পড়ে না।গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। কাজে কর্মে যেমন সংযত হয়েছে, তেমনি কথা বার্তায় হয়েছে নিয়ন্ত্রিত। সারাক্ষণ পড়ে থাকে শর্মিলি আহমেদের রুমে। এটা সেটা কাজ করে, গল্প করে। মোট কথা নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে শর্মিলি আহমেদের কাছে উপস্থাপন করছে।

স্ত্রী আর মায়ের মনোভাব বুঝতে পেরে শাওনও দূরত্ব কমিয়ে নিয়েছে সীমার থেকে। শাওন এখন স্ত্রী সন্তানের সাথে একই রুমে ঘুমায়। একসাথে খেতে বসে, একসাথে টিভি দেখে, একসাথে গল্প করে।

স্বামীকে হারিয়ে ফেলার যে ভয় ছিল রীমার মনে সেটা এখন আর নেই। তাই রীমাও আর অকারণে সীমাকে ঘাটায়নি।

তবে রাতারাতি ঘরের পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় চিন্তায় পড়ে গেলেন শর্মিলি আহমেদ।
জীবন কখনো এমন ছবির মতো সুন্দর হয় না। তাঁর জীবন হয়নি। তাঁর বউমার জীবনও নিশ্চয়ই হবে না।

শর্মিলি আহমেদের জীবনে বাসন্তি নামক কাল নাগিনীর ছায়া যখন পড়েছিল। তখন তিনি রীমার মতোই অবুঝ ছিলেন। বিশ্বাস করেছিলেন স্বামীকে। আত্মবিশ্বাস ছিল নিজের ভালোবাসার উপর। যাকে উজাড় করে দিয়েছেন নিজের সর্বস্ব, সে মাত্র কয়েক দিনের জন্য শর্মিলি আহমেদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।

মাতৃত্বকালিন সময় আর কয়দিন! মাত্র দেড় মাস। অথচ সেই দেড়মাসের অল্প সময়ে এসে ছোবল বসিয়েছে কাল নাগিনি। সুযোগ করে দিয়েছিল বিশ্বাসঘাতক জানোয়ার।

শর্মিলি আহমেদ নিশ্চিত হওয়ার পর তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাসন্তিকে। অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন স্বামীকে। যতবারই স্বামী নামক বিশ্বাসঘাতক জানোয়ার দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। শর্মিলি আহমেদ ক্ষমা করতে পারেননি। সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে তারা স্বামী, স্ত্রী হয়ে থেকে ছিলেন সারাজীবন। জীবনের প্রয়োজনে এই স্বামীর সন্তানের মাও হয়েছিলেন। অথচ কোনোদিন ভালোবাসতে পারেনি।

যেদিন বাসন্তি পেট নিয়ে এসে হাজির হয়ে, সন্তানের দাবী পিতৃত্ব দাবী করেছিল। সেই বিভিষিকাময় দিনের কথা শর্মিলি আহমেদ ভুলেননি।

এই সব মেয়েরা সংসারে ‘সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের’ হয়। তাই নোরাং ছায়া জীবনে একবার পড়লে সে ছায়ার অভিশাপ থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয় না। উপড়ে ফেলতে হয় শিকড় থেকে।

তবে শর্মিলি আহমেদ বুঝতে পারছেন যতটুকু ফাঁক ছেলে আর বউমার মধ্যে হয়েছে সেখানে বউমার অপরাধও কম নয়। একটা সমত্ত মেয়ে, সে যে পরিচয়ের হোক কোনো স্ত্রীর উচিত নয় তাকে ঘরে রাখার।

হোক বোন, হোক ভাবি, হোক কাজের লোক। শর্মিলি আহমেদ বাসায় সমত্ত কাজের মেয়ে রাখাও পছন্দ করেন না। সেখানে স্বামী পরিত্যক্তা একটা নারী। যাকে ঘরে রেখে ছেড়ে দিয়েছে নিজের স্বামীকে সম্পূর্ন তার হাতে। কী ভরসায়!

এসব উদাসীন মেয়ে ছেলে দিয়ে আর যাই হোক সংসার সুখের হয় না। চোখে আঙ্গুল দিয়ে রীমাকেও নিজের ত্রুটি ধরিয়ে দিতে হবে। না হয় আজ সীমার হাত থেকে শাওনকে বাঁচাতে পারলেও কাল অন্য মেয়ের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না।

শর্মিলি আহমেদের যতটা রাগ লাগছে সীমার উপর ঠিক ততটাই রাগ লাগছে রীমার উপরও।

তবে সীমার নিস্পৃহ আচরণে শর্মিলি আহমেদের কাছে মনে হচ্ছে এখানে বড়সড় একটা ঝামেলা আছে। সেটা তিনি প্রমাণ করবেন। তাই তিনি মাস পুরে গেলেও আর গ্রামে ফিরে যাননি। থেকে গেলেন ছেলের বাসায়। তিনি জানেন এসব আগাছা কিভাবে উপড়াতে হয়। কিন্তু এখানে সীমা, শাওন আর রীমার সম্পর্কটা এতটাই জটিল যে পরিপূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না।

তাই শর্মিলি আহমেদ বসে আছেন নিশ্চিত হওয়ার অপেক্ষায়।

শর্মিলি আহমেদ রীমার কাছে একটু আদা চা খেতে চেয়েছেন তিনদিন আগে। বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে রীমা সেটা ভুলে গেছে। তিনদিন পর সে এক কাপ লেবু চা আর দুটো মিষ্টি নিয়ে এসেছে শাশুড়ির রুমে। মিষ্টি পাঠিয়েছে শাওনের অফিসের কলিগ আফসার সাহেব। বিয়ের তেরো বছর পর তিনি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন। সেই আনন্দে তিনি প্রায় একমন মিস্টি বিলিয়েছেন পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন সবার বাসায়। রীমার বাসায়ও পাঠিয়েছেন এককেজি। শাশুড়ির জন্য মিষ্টি নিয়ে এসে দেখে সীমা শর্মিলি আহমেদের চুলে বিলি কেটে খাঁটি নারিকেল তেল লাগিয়ে দিচ্ছেন। আর দুজনে হেসে হেসে গল্প করছেন।

” আপা তুমি এখানে? আমি তোমার রুমে চা রেখে এলাম।”

” ঠিক আছে আমি খালাম্মার চুলে তেল লাগিয়ে যাচ্ছি। তুই চা খাবি না? নিয়ে আয় আমরা তিনজন একসাথে খাই!”

” আমি এখন চা খাব না। রুপাইয়ের জন্য চুলায় খিচুড়ি বসিয়েছি। শাওন ফিরলে তখন খাব।

” কী চা আনছ রীমা?”

” লেমু চা মা।”

” আমি তোমার থেইকা তিনদিন আগে আদা চা খাইতে চাইছিলাম রীমা।”

” দুঃখিত মা। ভুলে গেছি। আমি এহনি আনতাছি।”

” কোনো দরকার নাই। আমারে সীমা চা বানাই খাওয়াইছে।”

” এত উদাসীন অইলে অয় না রীমা।”

শাশুড়ির কথায় রীমার মুখ ভার হয়ে গেল। সে কোনো মতে হেসে বলল,

” আপনার নাতি আমার সব এলোমেলো কইরা ফেলছে মা।”

“এহন তো মাত্র একটা নাতি, আরও নাতি অইবে, নাতনি অইব। কিন্তু কোনোকিছু এলোমেলো অইলে চলব না। সব গুছায়ে রাইখতে অহব।”

” জি মা। রুপাইটা আর একটু বড় অহলে সব ঠিক অই যাইব।”

” কেমনে গোছাইতে অইব দেইখা যাও। ”

বলে শর্মিলি আহমেদ রীমার হাত ধরে নিয়ে এলেন তার আলমারির কাছে।

” দেখো, সীমা গতদুইদিনে আমার কাপড়-চোপড় সব
কেমনে গোছাইয়া দিছে। পানের বাটা হইতে টুথপিক পইরযন্ত। এলোমেলো অওনের ডরে আমি আইজ আলমারি থেইকা একটা কাপড়ও বের করিন।”

” জি মা, সীমাপা রুপাইর সব কাপড়ও এমনে গোছিয়ে রাখে।”

” সীমা গোছালে তো অইবে না। এসব তুমার কাজ। তোমারেই করতে অইব।”

এদের বউ, শাশুড়ির কথার ফাঁকে সীমা বেরিয়ে গেল রুম থেকে। চুলায় রুপাইর খিচুড়ি আছে, এটা সে শুনতে পেয়েছে। তাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে।

” জি মা। সব ঠিক করে নিব।”

সীমার অনুপস্থিতে শর্মিলি আহমেদ হঠাৎ নিচু গলায় বললেন,

” তোমার ভাইজানরে ফোন করনাই? কবে আইব সে? হুনো তোমার বইনডারে এবার বাড়ি থাইকা বাইর করতে অইব। তবে এডা এত সহজে সম্ভব অইত না। ”

” মা!”

” কি? এত অবাক হইছ ক্যান তুমি। অবাক অইবার তো কিছু নাই। তুমি কি মনে কর যাইতে কইলেই হে যাইব?”

” মা ভাইজান এই হপ্তায় যে কোনোদিন আইব।”

” যদি আমার ধারণা সইত্য অয়। তয় তোমার ভাইজান আইলেও তোমার বইন যাইত না। আর যদি যায়ও আবার কোনো একটা অজুহাতে আইয়া পড়ব। হে রাণী অইবার স্বপ্ন দেখতাছে।”

” মা সীমাপা চলি যাইব।”

” যাইলে তো ভালা। তবে তার একটা বিয়ার ব্যবস্থা কইরলে ভালা অইত। সব মাইয়্যাগো একটা সংসার দরকার। নিজের সংসার। হেয় সেবা করব নিজের শাশুড়ির। বইনের শাশুড়ির সেবা কইরবার দরকার নাই।”

রীমা কিছু বলার আগেই শর্মিলি আহমেদ উচ্চস্বরে আবার বলতে শুরু করলেন,

” এত গোছানো মাইয়া তোমার বোইনটা। অথচ কী দুঃখ! তার সংসার অইল না। বিয়া একটা দাও দেখিনি তারে! সংসার করুক মাইয়াটা।”

” জি মা, এবার চেষ্টা করুম। ভাইজানরেরে কইয়া দেখুম। তার চেনা, পরিচিত কেউ আছে কি না!”

” তোমার ভাইজানরে আমি কমু। তুমি গোছাই কইতে জানবা না। আহারে বেচারি, বিরস মুখে অন্যের সংসার সাজাইতাছে। অন্যের সংসার সাজাই লাভ আছে? সাজাইতে অয় নিজের সংসার।”

” জি মা ঠিক বলছেন।”

রীমা কিছু বুঝতে পারছে না, দুই মিনিট আগে যে মা আকারে ইঙ্গিতে সীমার নিন্দা-মন্দ করছিলেন, সেই মা এখন সীমার গুনগান গাইছেন।

সীমাপার একটা বড় গুন আছে। খুব সহজে মানুষের মন জয় করে নিতে পারে। দেখা যায় তাকে অপছন্দ করা মানুষটা দুদিনের মধ্যে কিভাবে কিভাবে যেন তার বড় ভক্ত হয়ে যায়।

হঠাৎ দরজার দিকে চোখ যাওয়ায় রীমা দেখতে পেল, সীমা দাঁড়িয়ে আছে।

রীমা শাশুড়ির বুদ্ধিমত্তা দেখে মনে মনে মুচকি হাসল।

তবে এটা ঠিক প্রথম প্রথম শাওনও সীমাপাকে পছন্দ করত না। তার কাছে নাকি বাড়তি ঝামেলা মনে হতো। মনে হতো নিজের ঘরে নিজের প্রাইভেসি নেই। নিজের মতো থাকা যায় না, কথা বলা যায় না। নিজের মতো করে স্ত্রী সন্তানকে আদর করা যায় না। সারাক্ষণ মেপে,মেপে চলতে হয়। সীমা আপাকে রেখে আসার জন্য শাওন রাগারাগি করত।

হঠাৎ একদিন সেই শাওনই সীমাপাকে পরিবারের একজন করে নিয়েছিল। তখন মনে হচ্ছিল শাওন দিব্যি রীমাকে ছাড়া থাকতে পারবে, কিন্তু সীমাকে ছাড়া নয়। এখন অবশ্য তেমন মনে হচ্ছে না।

সীমাপা কর্ম দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সবার কাছে শুধু গুরুত্বপূর্ণ হতে পারেনি নিজের সংসারে। সামান্য একটা অজুহাতে বিয়ের তিনমাসের মধ্যে তার সংসার ভাঙল। রীমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, সীমাপার সংসারে জোড়াই লাগেনি ভাঙবে কি। একদিন সংসার করা স্ত্রীর প্রতিও তো মানুষের একটা মায়া জন্ম নেয়। সেই মায়া কি এত সহজে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

তিনমাস সংসার করে লোকটা কিভাবে সে মায়া এড়িয়ে গেছে। তিনমাসের সংসার হলেও সীমাপা তার বরের সাথে ত্রিশ রাতও একসাথে থাকেনি। সীমাপার বর চাকরি করত সিলেট ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায়। এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসে বিয়ে করেছে। বিয়ের ধকল কাটতে কাটতে কেটে গেল চারদিন। বাকি তিনদিন স্ত্রীর সাথে কাটিয়ে ফিরে গেল কর্মস্থলে, তিনমাস পর ফিরে এসে তো সীমাপাকে ডিভোর্সই দিয়ে দিল। অবশ্যই এর মধ্য একমাস নাকি সীমাপা তার বরের সাথে গিয়ে থেকেছে।

তিনমাসের বিবাহিত জীবনে সীমাপা সংসার করল সর্বসাকুল্য ত্রিশদিন।
ত্রিশ দিন, ত্রিশমাস কি ত্রিশ যুগেও তো একজন মানুষকে বুঝা যায় না।

পাঁচ বছর হলো রীমা আর শাওনের বিয়ে হলো। তাদের সম্পর্কের মাঝে কোনো ফাঁক ছিল না। যেমন স্বচ্ছ ছিল সম্পর্ক, তেমন ভালোবাসাও ছিল। অথচ রীমা শাওনকে চিনতে পারছে না।
চিনতে পারছে না নিজের মায়ের পেটের বোন সীমাকে, যার সাথে হেসে খেলে বড় হয়েছে।

চলবে……