অথৈ জলের পুষ্পমাল্য পর্ব-০৮

0
290

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য

কামরুন নাহার মিশু

৮)

রীমার বড়ভাইজান আফসার উদ্দিন এসেছেন গ্রাম থেকে। আফসার উদ্দিনের একটা বদ অভ্যাস হচ্ছে, তিনি কারো বাসায় যাওয়ার সময় খালি হাতে যান। তিনি না-কি বুঝে উঠতে পারেন না, কি নিয়ে যাবেন!কোনো ভাবে অদরকারি বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে টাকা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

তাই আফসার উদ্দিন যার বাসায় যান, যতদিন থাকেন ফেরার সময় প্রতিবেলা খাওয়ার খরচ হিসাব করে বাড়ির কর্তার হাতে একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা তুলে দিয়ে, খুব আঁকুতি করে বলেন,

” কিছু মনে কইরবেন না, আহনের সময় তাড়াহুড়ো করে খালি হাতে চইলা আইছি। এই টেকাটা রাখুন। ছোট বাচ্চাদের কিছু উপহার কিন্ন্যা দিয়েন।”

টাকার পরিমানটা এত কম থাকে যে, সেটা দিয়ে ছোট বাচ্চাদের উপহার কিনে দেয়া ছাড়া আর কোনো কাজে আসে না।

আফসার উদ্দিনের এই বদ অভ্যাসের খবর রীমা তো জানেই। পাঁচ বছর বিয়ে করার কারণে পুরো বিষয়টা শাওনেরও অজানা নয়।

তাই শাওন খালি হাতে সম্মন্ধীকে দেখলে কিছু মনে করে না। উল্টো ভালোভাবে আদর আপ্যায়ন করে দেখতে চায়, তিনি যাওয়ার সময় কি অজুহাতে কত টাকা দিয়ে যান।
কিন্তু এবার বিপত্তি বাধাল রীমার শাশুড়ি, তিনি তো জানেন না বউমার ভাই যে খালি হাতে কুটিমবাড়ি চলে আসে।

আফসার উদ্দিন যখন সায়েদাবাদ টিটি পাড়ায় এসে রীমাকে ফোন দিয়ে বলল,

” আসার পথে আমার মোবাইলসহ ওয়ালেট ছিনতাই অই গেছে। আমি এহনি আইতাছি। সিএনজি ভাড়া নিয়া রাখিস।”

ভাইজানের ব্যস্ততার কারণে রীমা আর বলার সুযোগ পায়নি বাসায় সে একা নয় তার শাশুড়িও আছে।

রীমা তাড়াহুড়ো করে শাশুড়ির কাছে ভাইয়ের ইজ্জত রক্ষা করার জন্য দারোয়ানকে দিয়ে আগে থেকে কিছু ফল, মিষ্টি আনিয়ে রেখেছে ।

এদিকে আফসার উদ্দিন বাসায় পা দিয়েই হাঁক ডাক শুরু করে দিয়েছেন।

” আরে তোর বাসায় আহনের নাম নিবার লগে আমার কুফা লাগছে। টিটি পাড়া থেকে আমার ওয়ালেটসহ মোবাইলটা ছিনতাই অই গেছে। দেখি ২০০ ট্যাকা দেয় সিএনজির ড্রাইভার খাড়াই আছে।”

ভাইজানের আক্কেল জ্ঞান দেখে রীমা যারপরনাই বিরক্ত হলো। ভাই, বোন কেউই তার সম্মানের কথা চিন্তা করল না।
তার বড় বোন তার সংসার ভাঙার পায়তারা করছে। ভাই এসে ওয়ালেট ছিনতাই হওয়ার ভান করে সিএনজি ভাড়া যাচ্ছে।

রীমা নিশ্চিত তার ভাই আফসার উদ্দিনের কোনো ওয়ালেট ছিনতাই হয়নি। বোনের বাসায় কিছু আনার ভয়ে সে এই পরিকল্পনা করেছে।

আফসার উদ্দিন এসেছেন দুইদিন। এই দুইদিনেই সীমা কেঁদে কেটে বাড়িতে থাকতে তার অসুবিধার কথা ভাইয়াজানকে বলে আর কিছুদিন রীমার বাসায় থাকার আবদার করল।

এদিকে সীমার, রীমার বাসায় থাকার ইচ্ছে শুনে আফসার উদ্দিন মনে মনে বেশ খুশি হলেন। কারণ তিনিও চাচ্ছেন না সীমা বাড়ি ফিরে যাক। কারণ প্রথম থেকেই আফসার উদ্দিনের স্ত্রী রাহেলা বেগম সীমাকে পছন্দ করে না। তার পিছনে একটাকা খরচ করা তো বেশি, একবেলা ভাত খাওয়ানোকেও অপচয় মনে করে।

এদিকে রাহেলা বেগমও সীমাকে নিজের বাড়িতে রাখতে অপরাগতা প্রকাশ করে রীমাকে ফোন করছে বারবার। সীমাকে যেন কোনোভাবেই তার বাড়িতে না পাঠায়। বোনকে ভাই খাইয়েছে পনেরো বছর। বোন অন্তত দশ বছর খাওয়াক। কেউ খাওয়াতে না পারলে সবাই মিলে সীমার বিয়ের ব্যবস্থা করুক। তার ছেলে- মেয়ে বড় হয়েছে। তাদের আলাদা থাকার ঘর, পড়ার ঘর দরকার। মেয়ের বিয়ের জন্য আসে। যে বাড়িতে সমত্ত ফুফু আছে, রঙ,ঢঙ করে বেড়ায় সেই বাড়িতে ভাইজির বিয়ে হয় না। তাই সংসারে অশান্তির ভয়ে আফসার উদ্দিনও সীমাকে আর নিজের বাড়িতে নিতে চাচ্ছে না।

আফসার উদ্দিন যখন রীমার কাছে এসে অনুনয় করে বলল,

” বইন সীমারে এই মুহূর্তে বাড়িত নেওন সম্ভব নয়। তোর এইহানে রাখতে সমিস্যা অইলে কয়দিন লায়লা খালার কাছে রাইখা আসুম। খালা তো ঢাকাই থাকে। তারপর একটা বিয়ার ব্যবস্থা করি….. ”

ভাইয়ের সমস্যা আর বোনের অসহায়ত্বের কথা ভেবে রীমা প্রায় রাজি হয়েই যাচ্ছিল। সীমা না হয় থাক আরও কিছুদিন তার বাসায়। এখন তো সন্দেহ করার মতো কিছু চোখে পড়ছে না।

চার দিন থেকে আফসার উদ্দিন যাওয়ার সময় শর্মিলি আহমেদ এসে পথরোধ করে সামনে দাঁড়ালেন।

” কোথায় যাচ্ছেন আপনে?”

” কেন খালাম্মা? বাড়িত যাই।”

” বাড়িতই যাইবেন। কিন্তু আপনে একা ক্যান?”

” খালাম্মা একটা ব্যক্তিগত সমিস্যা আছে।”

” বাজি, সমিস্যা কারো কম নাই। সব সমিস্যারে বড় করি দেইখলে অয় না। আপনি তো যাইবেনই, সাথে সীমা , রীমা আর আমার দাদা ভাইরেও নিয়ে যাবেন। রুপাইর বয়স ছয়মাস। তার নানা বাড়ি যাওনের সময় অইছে।”

” খালাম্মা শাওন!”

” না, শাওন যাইবার পরব না। তার অফিস আছে। ”

” যাও সীমা তোমার ব্যাগ গোছাই নাও। তোমার বই, পাখি সব নিবা।”

” খালাম্মা আর কয়টা দিন পর, আমি আইসা শাওনসহ…. ”

” না, শাওন যাইবার পারব না। তুমি এহনই ওদের নিয়া যাইবা। কয়দিন পর রীমা আর রুপাইরে দিয়া যাইও। ”

শাশুড়ির আচরণে রীমা হতভম্ব হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে না, শাওনকে না জানিয়ে এভাবে যাওয়া ঠিক হবে কি-না! শাওনের জন্য রান্নাবান্না কে করবে? এদিকে মাও আছেন। আগামী সপ্তাহে না-কি রাজিবও আসবে।

তাই রীমা সাহস করে শাশুড়িকে বলল,

” মা, তাহলে ভাইজান আজ যাক। শুক্রবারে না অয় শাওন আমাকে আর সীমাপাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ থাইকব। রাজিব আইসা আপনার কাছে থাকতে পাইরব।”

” রীমা! তোমার সমিস্যা তো আমি বুঝতাছি না। বাবার বাড়িত যাইতে এত কিছু ভাইবতে অয় না। এদিকে আমি আছি তো!”

শাশুড়ির কথায় বাধ্য হয়ে রীমা ব্যাগ গোছাতে চলে গেল। এদিকে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। রীমার ব্যাগ গোছানো হলেও সীমার ব্যাগ গোছানো শেষ হয়নি। সে সময় নষ্ট করেই চলছে। যতই যাওয়ার জন্য আফসার উদ্দিন বোনদের তাড়া দিচ্ছিল, কোনো কাজ হচ্ছে না।

হঠাৎ সীমা একটা নতুন সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে তার মোবাইল খুঁজে পাচ্ছে না। মোবাইল শাওন সার্ভিসিং করতে দিছে। মোবাইল ঠিক না হলে সে যেতে পারবে না।
হয় আফসার উদ্দিন আরেকদিন থেকে আগামীকাল যাবেন, না হয় সীমা পরে মোবাইল নিয়ে যাবে।

শর্মিলি আহমেদ বললেন,

” তোমার মোবাইলের কী কাম? কে কিন্ন্যা দিছে তোমারে মোবাইল?”

রীমা তড়িঘড়ি করে উত্তর দিলো।

” মোবাইলটা ঘরেই পড়ে ছিল মা। শাওনের পুরানো মোবাইল।”

” ভালা অইছে। শাওনের মোবাইল শাওনের কাছেই রইল। দরকার অইল, তোমার ভাইজান তোমারে একটা কিন্ন্যা দিব।”

সীমা গড়িমসি করতে করতে বিকাল হয়ে গেল। এদিকে শাওনও অফিস থেকে এসে হাজির হয়েছে। আজ মনে হচ্ছে শাওন প্রতিদিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই বাসায় এসে পৌঁছেছে।

বাসায় এসে এত ব্যাগ একসাথে দেখে সে বলল,

” বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ কোথায় যাও তোমরা?”

সীমা বলল,

” ভাইজানের সাথে বাড়ি যাই।”

” তাই না-কি! কিন্তু রুপাই তার খালারে ছাড়া থাকতে পারবে?”

শর্মিলি আহমেদ পান চিবুতে চিবুতে বললেন,

” পারব না তো। তাই রুপাই দাদা ভাইও খালার লগে যাইতাছে।”

” তাহলে তো বেশ ভালো। এককাজ করো আমাকেও নিয়ে চলো। আমি তোমাদেরকে পৌঁছে দিয়ে কাল ব্যাক করব। রাজিবকে ফোন দেই সে আজ রাতে এসে মায়ের সাথে থাকবে।”

” কোনো দরকার নাই। তুমি কোনোহানে যাইবানা বাপ। ”

” আমি রুপাইকে ছাড়া থাকব কিভাবে মা?”

” যেভাবে পাশের রুমে ছিলা। যেভাবে চট্রগাম থাকছ।”

মায়ের যুক্তির কাছে শাওন পরাজিত হলো। রীমা বুঝতে পারল, সীমাকে বাসা থেকে তাড়ানোর জন্যই মা কাজটা করছেন। রীমা আড়চোখে একবার সীমার দিকে তাকাল। বোনটার জন্য তার হঠাৎ মায়া লাগল। কত অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। আসলেই কি শাওনকে সে যাচ্ছে? না-কি সবটাই মায়ের বাড়াবাড়ি।

যাওয়ার আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় সীমা একটা কথাও বলল না। তবে সে ইচ্ছে করে তার বেশির ভাগ জিনিসপত্র রেখে গেল। যেন আবার ফিরে আসতে পারে। রীমা বুঝতে পেরেও কিছু বলল না। কিন্তু শর্মিলি আহমেদ একটা সুতাও সীমার রাখতে দিলেন না, নিজেই সব ব্যাগে করে সীমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

” যাও মা। বইনের বাসায় এতদিন থাওন ভালা না। মায়া জন্মায়। মায়া খুব খারাপ জিনিস। ভালা থাইক।”

রীমা, সীমা চলে যাওয়ার পর শাওন মায়ের সাথে একটা কথাও বলল না। সোজা নিজের রুমে গিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। শর্মিলি আহমেদ বুঝতে পারলেন, পোঁড়া গন্ধটা কোথা থেকে আসছে।
ছেলেকে কিছুক্ষণ নিজের মতো থাকতে দিয়ে শর্মিলি আহমেদ গিয়ে শাওনের পাশে বসে কপালে হাত রাখল।

” চলো বাবা। ছোডবেলার মতোন তোমারে মা ডিম দিয়া খিঁচুড়ি রাইন্ধা দিমু।”

মায়ের কথার অবাধ্যতা না করে শাওন উঠে বসল,

” মা, ভাল্লাগতাছে না কিছু। বাড়ি, ঘর সব কেমন খালি খালি লাগতাছে।”

” কোনো ব্যাপার না বাবা। সব ঠিক অই যাইব। চলো আমরা কিছুক্ষণ গপ্প করি।”

শাওন মাকে নিয়ে বারান্দায় এসে বসল। বারান্দায় ফুটে থাকা হাসনাহেনা ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ এসে তাদের নাকে লাগল। শাওন মুখ ফসকে বলে ফেলল,

” মা, হাসনাহেনা গাছটা সীমাপা লাগাইছিল।”

” ভালা করছে। তোমগে বাড়ির সব গাছও তোমার করিম চাচা লাগাইছিল। আমরা কিন্তু তোমার করিম চাচার কতা কই না। কই তোমার দাদার কতা। তোমার দাদা করিম চাচারে দিয়া গাছ লাগাইছিল।”

” মা আমি তোমার কোলে একটু শুই?”

শর্মিলি আহমেদ বুঝতে পারলেন ছেলের মনে কি চলছে।

” শুইবা মানে! এহনি শোও। আমি তোমার চুল টাইন্না দিতাছি।”

শর্মিলি আহমেদ আলতো করে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

” রীমাকে ফোন দিছ বাবা?”

” না, মা।”

” যাও মোবাইল নিয়ে আস। রীমাকে একটা ফোন দাও।”

” ইচ্ছে করছে না মা।”

” ইচ্ছে না করলেও দিতে অইবে। রীমার সাথে তোমার ছেলে আছে।”

শাওন মায়ের কথায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোবাইল নিয়ে ফিরে এলো। রীমা কল দিয়েছে পনেরোবার। মিসড কল হয়ে আছে।

” মা নাও কল দিয়ে, তুমি কথা বল।”

শর্মিলি আহমেদ রীমার নাম্বারে কল দিতে দিতে বললেন,

“আমাদের বাড়িতে কাজ করা বাসন্তির কতা তোমার মনে আছে বাপ?

চলবে…….