অথৈ জলের পুষ্পমাল্য পর্ব-৯+১০

0
312

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু

৯)

রীমার ভীষণ মন খারাপ। এভাবে হুট করে শাশুড়ির কথায় রাজি হয়ে বাসা ছেড়ে চলে আসা ঠিক হয়নি। প্রয়োজনে ভাইজানের সাথে সীমাপাকে পাঠিয়ে দিয়ে রীমা পরে শাওনকে নিয়ে আসতে পারত। শাওন নিশ্চিত ভীষণ রাগ করেছে।

এতবার ফোন দেয়ার পরও শাওন পিক করেনি। এমন তো নয় শাওন ব্যস্ত। সে তো এখন বাসায় আছে। আর থাকবেও বাসায়, কারণ মা বাসায় একা।
বাসার সব কাজ এলোমেলো হয়ে আছে। ওয়াশরুমে রুপাইয়ের ন্যাপিসহ অনেক কাপড় ভিজানো আছে। ফ্রিজে পর্যাপ্ত পরিমান মাছ, মাংসও নেই। শাওন পারবে তো একাএকা সব সামলাতে। সীমা থাকায় এতদিন মাও খুব একটা রান্নাঘরে যাননি। তিনি কি জানবেন? কোন কৌটাতে লবন আছে? কোন কৌটাতে মরিচ আছে? শাওনের জন্য রীমার তার যতটা না খারাপ লাগছে, এর চেয়ে বেশি মন খারাপ লাগছে নিজের সংসারের জন্য।

রীমা অন্য মনষ্ক হয়ে জানালার পাশে বসে আছে। রুপাই একটা আসার পর থেকে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। অচেনা মানুষ, অপরিচিত পরিবেশ তার কাছে তো সবই নতুন। মায়ের মৃত্যুর পর রীমার কাছেই সব নতুন লাগছে। রুপাইটা কারো কোলেও যাচ্ছে না। রীমা আসার পর থেকে কারেন্টও নেই। কী পরিমান ভ্যাপসা গরম! সহ্য করা যায় না। জন্মের পর রুপাইকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছাড়া রীমা আর কোথাও যায়নি।

যে বাড়িতে হেসে-খেলে রীমা বড় হয়েছে, যে বাড়ির আলো -বাতাস গায়ে মেখে রীমা বেড়ে উঠেছে। মায়ের মুত্যুর পর আজ সে বাড়িরই সবকিছু কেমন যেন অচেনা লাগছে।
এদিকে রাহেলা বেগম রীমাকে দেখে খুশি হয়েছে কি-না সেটা বুঝা যায়নি। তবে সীমাকে দেখে যে একদমই খুশি হয়নি সেটা নিশ্চিত। আসার পর থেকে প্রায় একঘণ্টা হয়ে গেছে কেউ এখন পর্যন্ত এক গ্লাস পানিও দিয়ে যায়নি। ভাইয়ের মেয়েগুলোও কেমন জানি! দুইদিন পর তো এমন পরিনতি তাদের জীবনেও হবে। বিয়ের পর মেয়েরা বাবার বাড়ির অতিথি হয়ে যায়। মায়ের মৃত্যুর পর ভাইয়ের সংসারে পর।

রীমা মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিলো। ভাগ্যে ভালো শাওন সঙ্গে আসেনি। শাওনের সামনে সবাই এমন আচরণ করলে শাওন কী মনে করত! বাবার বাড়িতে মেয়েদের মূল্যায়ন না থাকলে শ্বশুর বাড়িতে ছোট হতে হয়।

রীমার তো একটা জায়গা আছে, কয়েকদিন পর স্বামীর কাছে ফিরে যাবে। কিন্তু সীমাটা কার কাছে যাবে? এই জলন্ত উনুনে তাকে পুড়তে হবে আজীবন।

এমন সময় শাওনের মোবাইল থেকে কল আসায় রীমা ভীষণ খুশি হলো।

” হ্যালো! কেমন আছো?”

” ও আচ্ছা মা, আপনে? আমি ভালা আছি। শাওন কোথায়?”

” হ্যাঁ আমি। শাওনও ভালা আছে। বুঝ না বেডা মানুষ। বউ বাপের বাড়ি গেলে একটু মুক্তির স্বাদ পায়। হাত, পা ছড়াই ঘুমাইতাছে।”

” ঠিক আছে তাইলে ঘুমাক। এহন বলার দরকার নাই। জাইগলে কইবেন, রুপাই বাপের জন্য খালি কাঁনতাছে।”

” মামির কোলে দিয়া যাও। নতুন মেহমান। একটু বুতুটুতু করি দেক। নানি তো নাই।”

একথা বলে শর্মিলি আহমেদ হাসলেন। মনে হচ্ছে খুব মজার কিছু বলেছেন। রীমাও শাশুড়ির সাথে কষ্ট করে হাসল। তার হাসতে ভালো লাগছিল না। কারণ রীমার ভাবি একবারের জন্যও তার ছেলেটাকে কোলে নেয়নি।

” মা, কিছু রানছেন?”

” ওইসব নিয়ে তুমি ভাইব না। আমি চল্লিশ বছর শুধু রান্দাবাড়ায় করছি। তুমি বাপের বাড়িতে মজা কইরা থাক কয় দিন। আমার দাদা ভাইয়ের দিকে শুধু একটু খেয়াল রাইখ। ”

” ঠিক আছে মা। শাওন জাগলে ফোন দিতে কইবেন।”

” ক্যান? শাওনরে আমি ফোন দিতে কমু ক্যান? তুমিই বা এতবার কল দিছ ক্যান? তুমি কি কিছু রাইখা গেছ? যে বারবার ফোন দিতে অইব। বরং লাইয়া গেছ আমগো বাড়ির সবচাইতে দামী জিনিস আমার দাদা ভাইকে। আমরা কল দিয়ে তোমার খুঁজ নিমু। তুমি ক্যান?

রীমা অপ্রস্তুত হয়ে গেল শাশুড়ির কথায়। কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ হয়ে গেল।

” শুন মা, মেয়েদেরকে নিজের গুরুত্ব নিজেরেই ধইরা রাখতে অয়। থাক কয়দিন বাপের বাড়ি। আইতে মন চাইলে ফোন দিও। আমি আননের ব্যবস্থা করুম। আর এদিক নিয়া চিন্তা করবা না। আমি সব সামলামু। ”

” ঠিক আছে মা।”

” টেকা, পয়সা আছে হাতে? লাগলে জানাইবা।”

” আছে মা। ”

“শুন, মাঝে মাঝে দূরে থাকা ভালা। দূরত্ব অনেক সময় গুরুত্ব বাড়ায়।”

” জি মা। ভালা থাকবেন।”

” তুমিও ভালা থাইক।”

ফোন রেখে শর্মিলি আহমেদ শাওনের দিকে তাকিয়ে আছেন।

” দেখলি মেয়েটা বাপের থাকলেও তার মন পইড়া আছে তোর কাছে। ”

” হ দেখলাম।”

” কী দেখলি? এসবরে কয় মায়া! দুই মাইলের মাতায় তোর নানার বাড়ি আছিল। অথচ তোগোরে রাইখা আমি এক রাইতের জন্যিও বাপের বাড়িত থাকি নয়।”

” মা, এবার রুপাইরে নিয়া বাড়ি গেলে, তারে আমার নানার বাড়ি দেখাই আনবা।”

” অবশ্য যাইব। আমার রীমা আর আমার দাদা ভাইরে আমি সব জায়গায় নিমু।”

” মা তুমি এক্কানা আলাদা। পোলাদের চাইতে বউদের বেশি ভালোবাসো।”

” হ, তোরে কইছে! তুমি অইলি আমার চাঁদের কণা। তোরে পাইয়া আমি অনেক কিছু হারাইছি। আবার অনেক কিছু পাইছি।”

” মা বাসন্তির কতা কইবা না?”

” কমু বাজান। একটা সইত্য গপ্প এবার তোর কাছে কমু। যেটা তুই জানোস না।”

” জানি মা। বাসন্তির কতা আমার মনে আছে।”

” বাসন্তির মেয়ে সুরাইয়া?”

” ছোটবেলায় দেখলাম তো মনে হয়।”

” সুরাইয়ার ঘাড়ে একটা তিল আছিল। যেটা তোর ঘাড়েও আছে।”

” মানে কি?

” মানে সুরাইয়া তোর বইন।”

চলবে…….

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু

১০)
বাবাকে ফেরেশতা তুল্যে জ্ঞান করে বড় হওয়ায় শাওনের মনে সারা জীবন মায়ের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা ছিল। মা সবসময় সবার সাথে হেসে, হেসে কথা বলতেন। সবার উপকার করতেন। সবার জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। শুধু বাবাকে দেখলেই মা অপরিচিতের ভান করতেন। সে জীবনেও দেখেনি বাবা,মা দুজনে একসাথে বসে কিছুক্ষণ গল্প করতে। কোথাও বেড়াতে যেতে। বাবা যেন মায়ের কাছে অচেনা কেউ একজন।

বাবাও কখনো এসব নিয়ে উচ্চ বাক্য করেনি। স্ত্রীর অবহেলা মুখ বুঝে সহ্য করা বাবাকে শাওনের কাছে আজীবন মহানুভব মানুষ হয়েছে।

মায়ের অবহেলার পিছনে যে এমন রূঢ় সত্য লুকিয়ে ছিল শাওন একবারও সেটা জানতে পারেনি। বিড়ালের মতো মিঁয়াও মিঁয়াও করার পিছনে বাবার দুর্বলতা ছিল। বাবা সন্তানদের কাছে আজীবন ক্লিন ইমেজ নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। মা সারা জীবন সে সত্য লুকিয়ে রেখে সন্তানের দৃষ্টিতে বাবাকে মহানুভব মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। এতবড় কঠিন সত্য মা কিভাবে বুকের ভেতর দাফন করেছেন? মায়ের জন্য শাওনের ভীষণ মায়া হলো।

শাওন ছুটে মায়ের রুমে গেল। মা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মাকে আজ বড় নির্ভার মনে হচ্ছে। বিশাল একটা দুশ্চিন্তার বোঝা মায়ের মাথা থেকে নেমে গেছে। শাওন মায়ের মুখের মাঝে তাকিয়ে রীমার ছায়া দেখতে পেল। নিজের অজান্তে শাওন রীমাকে মায়ের মতো দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছে না তো!

শাওন সিদ্ধান্ত নিলো আজ রাতে গিয়েই রীমাকে নিয়ে আসবে। না, নিষ্পাপ মেয়েটাকে ঠকানো ঠিক হচ্ছে না।

শাওন শার্ট, প্যান্ট পরে রেডি হয়ে গেল। হুট করে গিয়ে রীমাকে চমকে দেবে। এমন সময় শাওনের মোবাইলে একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসল। শাওন সাধারণত আননোন নাম্বারের কল রিসিভ করে না। আজ কি মনে করে রিসিভ করে বসল।
নাম্বারটা আননোন হলেও আজসহ প্রায় দশবার কল এসেছে এই নাম্বার থেকে।
শাওন কল রিসিভ করে ‘ হ্যালো’ বলল, একবার, দুইবার, তিনবার। অপরপ্রান্তে শুনশান নিরবতা। কেউ কিছু বলছে না। কিছুক্ষণ পর পর ভারি নিশ্বাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। শাওন খুব বিরক্ত হলো। এটা তো ইয়ার্কি করার বয়স নয়।

” আপনি কে? কিছু বলছেন না কেন?”

অপরপ্রান্ত থেকে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,

” আমি।”

এই কণ্ঠ চিনতে শাওন মোটেও ভুল করেনি। একটা সময় রাতের পর রাত শাওন দরজা বন্ধ করে রীমাকে ঠকিয়ে এই কণ্ঠস্বর শুনেছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো।

” জি, কিছু বলবেন?”

” শাওন!”

” রীমা কেমন আছে? আমার ছেলে?”

” আমার কথা জানতে চাইবে না?”

” কী জানতে চাইব? বাড়িতে থাকলে সবাই ভালো থাকে।”

” এটা কেমন ভালো থাকা হলো। আমি এমন ভালো থাকতে চাই না। আমি ফিরে আসতে চাই শাওন।”

” কোথায়?”

” তোমার কাছে। বিশ্বাস করো আমি তোমার সামনেও পড়ব না। দূর থেকে শুধু দেখব তোমায়।”

” সম্ভব নয়। আমাকে ক্ষমা কর। আমি আর আমার স্ত্রী সন্তানকে ঠকাতে চাই না।”

” আমি ঠকিনি। আমাকে ঠকাওনি তুমি?”

” ইচ্ছে করে তুমি আগুনে ঝাঁপ দিয়েছ তুমি।”

” আগুনের ঝাঁপি খুলে রেখেছিলে তুমি।”

” মোটেও না। ”

” ঠিক আছে সব অপরাধ আমার। আমি এখন সেই আগুনে পুড়তে চাই।”

” প্লিজ, নিজেকে সংযত কর।”

” নিজেকে সংযত করে আমি কার কাছে যাব? তুমি তো তোমার স্ত্রীর কাছে যাবে।”

” আমি তোমার একটা ব্যবস্থা করব। পাগলামী করো না।”

” ঠিক আছে। কাল তুমি আস।আমরা বাহিরে দেখা করব। আমার মোবাইলটা সঙ্গে নিয়ে এসো।”

” কাল নয়, আমি আজই যেতে চেয়েছিলাম।”

শর্মিলি আহমেদ পাশে এসে বললেন,

” কোথায় যাইবা বাপ।”

শাওন তাড়াতাড়ি মোবাইল রেখে দিয়ে বলল,

” তুমি উঠে পড়ছ মা?”

শর্মিলি আহমেদ ছেলের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল,

” কার লগে কতা কইছ বাবা?”

” মা, আমি কি তোমার খারাপ পোলা? তুমি কি আমারে ক্ষমা কইরবা না?”

” বাপ আমরা কেউই খারাপ না। হয়তো পরিস্থিতি আমগো অনুকূলে থাহে না।”

” কাইল ছুটির দিন। যদি মন চায়, রীমারে নিয়া আসার ব্যবস্থা কর। তুমি ঐ দিকে আর যাইও না বাবা। আমি রাজিবরে পাঠামু।”

” না, মা। রীমা আরও কিছুদিন থাকুক।”

” পোলাডার জন্য পরান পড়ে না বাবা?”

” জানি না মা।”

” ঠিক আছে আরও কয়ডাদিন নিজেরে সময় দাও।”

চলবে……