অনুবদ্ধ প্রণয় পর্ব-০১

0
876

#অনুবদ্ধ প্রণয়
#ইবনাত_আয়াত
#প্রথম_প্রহর

বিয়ের রাতে বউ পালিয়ে গেছে এমন ঘটনা বহু শুনা যায়৷ কিন্তু বউকে পালাতে বর সাহায্য করেছে এমন ঘটনা বিরল৷ হ্যাঁ ঠিক এমনটি ঘটেছিল আমার খালাতো বোনের ক্ষেত্রে। কাল গায়ে হলুদ শেষে আজ তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সাধারণত শহরে বিয়ে রাতেই হয়। কিন্তু আপুর বিয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে করা হচ্ছিল। সব কিছু ভালোই যাচ্ছিল। বরযাত্রী চলে এসেছে৷ কিন্তু হঠাৎ ‘আপা নেই, আপা নেই’ করতে করতে ছুটে এলো কাজের মেয়ে। উপস্থিত সবাই হতভম্ব। খালামণি কান্নায় ভেঙে পড়েন। আঙ্কেল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। ইতোমধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়েছে। এখন সবার মুখে একটাই বাক্য, ‘কনে পালিয়ে গেছে’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এগিয়ে আসে আমার ভাইয়া। চিল্লিয়ে সবাইকে বলে, ‘শান্ত হোন আপনারা। শান্ত হোন। কনে পালায় নি। আপনারা শান্ত হোন এতেই সবার মঙ্গল।’

পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলেও কানাঘুষা চলছেই কিছু মানুষের।
__________

বর্তমানে রুমে উপস্থিত আব্বু, আম্মু, খালামণি, আঙ্কেল, ভাইয়া, আমি আর ইফা আপুর দাদু। দাদু গম্ভীর মুখে বসে আছেন সোফায়৷ আঙ্কেল এখনো মূর্তির ন্যায় বসে আছেন চেয়ারে। খালামণি এক কোণে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন। ভাইয়া দেওয়ালে হেলান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমি এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি। কী হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইফা আপু তো একটুক্ষণ আগে ঠিক’ই ছিল। হঠাৎ গায়েব কেন হয়ে গেল? তবে কী সত্যিই আপু পালিয়ে গেছে?

‘কী করে হলো এসব?’

দাদুর গম্ভীর গলায় সবাই নড়েচড়ে উঠল। খালামণি বললেন, ‘জানি না বাবা! মেয়েটা হঠাৎ করে কোথায় চলে গেছে।’

দাদু পূর্বের ন্যায় গম্ভীর গলায় বললেন, ‘পালিয়ে গেছে?’

‘আমার মেয়ে এমন কেন করবে বাবা? ও তো বিয়ের আগে না করেনি। তাহলে আজ কেন?’

দাদু চেঁচিয়ে বললেন, ‘তোমার মেয়ের এই অসময়েই কাজ টা করতে হলো? এবার কী হবে? সবাইকে মুখ দেখাতে পারব আমি? তোমার মেয়ে আমার মান সম্মান সব ধূলোয় মিশিয়ে দিল। সমাজের লোকের কাছে আমাকে ছোট করে দিল। এখন কী করব আমি?’

দাদুর হুংকারে সবাই কেঁপে উঠল। খালামণি কেঁদেই যাচ্ছেন। আর আঙ্কেল এখনো নিরব। দাদু আঙ্কেলকে চিল্লিয়ে বললেন, ‘এসব শিখিয়েছিস তোর মেয়েকে? যে বিয়ের রাতে বর রেখে পালিয়ে যেতে? বিয়ে করবে না তা আগে বলতে পারতো।’

ভাইয়া এতসবের মাঝে নির্ভয়ে বলে উঠল, ‘যাকে সবসময় হুমকির মাঝে রাখা হয় সে কীভাবে বলবে যে সে বিয়েতে রাজি না।’

ভাইয়ার কথায় সবাই তার দিকে ফিরে তাকালেন। দাদু বললেন, ‘কী বুঝাতে চাইছিস তুই?’

ভাইয়া ভাবলেশহীন ভাবে বলল, ‘ইফাকে চাঁপ দেওয়া হচ্ছিল বিয়েতে রাজি হতে। তোমরাই জোর করেছিলে তাই সে বলতে পারেনি। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছিলে। আর এখন সহ্য করতে না পেরে হয়তো পালিয়ে গেছে। একবার তার মতামত জানা উচিৎ ছিল।’

দাদু নিরব রইলেন। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছেন। শান্ত কন্ঠে আবার বললেন, ‘তাই বলে এভাবে পালিয়ে যাবে? আমাদের নাম এভাবে খারাপ না করলেও পারতো!’

‘কী করবে আর? হয়তো বুঝতে পারেনি।’

আঙ্কেল এবার নিরবতা ভেঙে বলে উঠলেন, ‘ওকে আমি খুব বিশ্বাস করতাম। আজ ও আমার সব বিশ্বাস ভেঙে দিল। আমি কী করে সবাইকে বলব যে আমার মেয়ে পালিয়ে গেছে। ওর বিয়ে ভেঙে গেছে। এই বিয়ে হবে না। বরযাত্রী অপমানিত হয়ে ফিরে যাবে। আর আমি? সমাজের কাছে আজ নিচু।’

আব্বু এবার বলে উঠেন, ‘এভাবে বলবেন না ভাই। আমি আছি না।’

আঙ্কেল বলেন, ‘কী করবেন আপনি ভাই? আমার সম্মান তো আর ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।’

‘আপনার মুখ তো যায় নি ভাই। আর কে বলেছে আপনার সম্মান চলে গেছে। আপনার সম্মান রক্ষা করতে আমি আছি আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সব ব্যাবস্থা করব।’

‘কী করবেন আপনি?’

আব্বু নিরব রইলেন কিয়ৎক্ষণ। একটু পর বলে উঠলেন, ‘আজ এই বিয়ে ভাঙবে না। বিয়ে হবে। আর হবে আমার মেয়ে ইয়ানাতের।’

মাথায় বাজ পড়ল। ঘুরে উঠল সব মুহুর্তেই। পায়ের তলায় যেন আমার মাটি নেই। দেহখান আমার অসর। কান যেন বলছে আমি ভুল শুনেছি। মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আম্মু বলল, ‘এসব কী বলছেন আপনি? ইয়ানাতের বিয়ে মানে?’

‘মানে যার সাথে ইফার বিয়ে হবার কথা ছিল তার সাথেই ইয়ানাতের বিয়ে হবে।’

দাদু বললেন, ‘ভেবে বলছ তো ইরহান?’

‘জ্বী চাচা আমি ভেবেই বলছি। কিছু করার নেই সম্মান বাঁচাতে হলে এটুকু করতেই হবে।’

আম্মু বলল, ‘তার মানে এই না যে সম্মান বাঁচাতে মেয়েকে আমরা বলি দেব।’

আব্বু ধমকে উঠেন, ‘ইরা! আমরা মেয়েকে আমরা বলি দিচ্ছি না। তাছাড়া ওর বিয়ের বয়স হয়েছে তাই বিয়ে দেওয়া টা বলির কিছু না।’

আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আব্বুর পানে। কী বললেন তিনি এখন’ই? আমার বিয়ে…

দাদু বললেন, ‘ঠিক আছে তাই হোক।’

কীহ্! দাদুও? তিনি এমনটি করতে পারলেন? আমার মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না। ভাষা হারিয়ে ফেলেছি মুখের। কী বলব আমি? তারা একে একে রুম ত্যাগ করল। অবশেষে রইল ভাইয়া। সে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে ‘বেস্ট অফ লাক’ বলেই চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই তিনজন মেয়ে এলো। হাতে দু’টো ব্যাগ। বুঝেছি পার্লার থেকে এসেছে। তা দেখে মাথা আরো গরম হয়ে গেল। তারা এগিয়ে এসে সাজাতে নিলেই তাদের থেকে দূরে সরে গেলাম। চিৎকার করে বললাম, ‘খবরদার ভুলেও এসব আমাকে দিবে না। যাও এখান থেকে। তোমরা সবাই আমার জীবন নরক বানাতে যাচ্ছ।’

চিৎকার করে সব জিনিস পত্র ছুড়তে লাগলাম। এই মুহুর্তে মাথা কাজ করছে না। বাবা কী করলো এটা আমার? আমি কী করব এখন? আমি বুড়া ব্যাটা টাকে বিয়ে করতে পারব না। নিশ্চয়ই বুড়া বলেই পালিয়েছে ইফা আপু। নাহ্ আমি এই বিয়ে কিছুতেই করব না। ইতোমধ্যে শব্দ শুনে সবাই রুমে চলে এলো। মেয়ে তিনটে গুটিশুটি মেরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ভয়ে। আব্বু ধমকে বললেন, ‘এসব কী ইয়ানাত? এসব কোন ধরনের বে-আদবী?’

চিৎকার করে বললাম, ‘তোমরা সবাই আমাকে শেষ করে দিচ্ছ। না চেয়েছ আমার অনুমতি, না চেয়েছ আমার সুখ৷ কেন এমন করলে? কী করেছি আমি? তোমাদের উপর খুব বড় বোঝা হয়ে গেছি তাই না? তাই তাড়িয়ে দিচ্ছ?’

আমাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ আব্বু এসে ‘ঠাস’ করে চড় বসিয়ে দিলেন আমার গালে। আমি সহ উপস্থিত সবাই হতভম্ব। আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা। আব্বু আমাকে মে’রে’ছেন? যিনি কখনো আমার গায়ে কারো ছায়া লাগতে দেন নি আজ তিনি আমাকে মে’রেছেন? অস্ফুট স্বরে বললাম, ‘আব্বু!’

আব্বু ধমক দিয়ে বললেন, ‘চুপ কর। আর একটা কথাও না। যা বলেছি তাই হবে। বুঝতে পেরেছিস?’

দাদু চিল্লিয়ে বললেন, ‘এসব কী ইরহান? তাই বলে তুমি আমার নাতনির গায়ে হাত তুলবে? যাও তোমরা বাহিরে যাও। আমি দেখছি ওকে।’

আব্বু হন হন করে বেরিয়ে গেলেন। সাথে উপস্থিত সবাই। আর মেয়ে তিনটেও। আমি দাদুর থেকে মুখ ঘুরিয়ে বিছানায় বসলাম। চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রুর ধারা বয়ে যাচ্ছে। দাদু এসে আমার পাশে বসলেন। বললেন, ‘কী ব্যাপার বুড়ি? আমার সাথে কথা বলবি না।’

ফুঁপিয়ে বললাম, ‘না! আমি কারো সাথে কথা বলব না। তোমরা খুব খারাপ। আমার অমতে আমার বিয়ে দিচ্ছ।’

‘ইয়ানাত! দেখ দাদুভাই আমি তোর ভালোর জন্যই করছি। এতে তোরও ভালো আমাদেরও ভালো।’

‘জানি তোমরা নিজ স্বার্থ হাসিল করতে এসব করছ।’

‘ইয়ানাত! আগে কথা শোন তারপর এসব বলিস। দেখ! মেয়ে হয়ে জন্ম যখন নিয়েছিস বিয়ে তো করতেই হবে। ইফা পালিয়ে গেছে। জানি না কেন এভাবে আমাদের বিশ্বাস ভেঙে পালিয়ে গেছে ও। দেখ দাদুভাই ছেলেটা খারাপ নয়। ইফা পাগল হয়ে গেছে যে এত ভালো ছেলে পেয়ে দূরে ঠেলে পালাচ্ছে। তুই অন্তত এমন করিস না। দাদু কিন্তু খুব রাগ করব। তুই কী চাস আমাকে এভাবে ডুবতে দেখতে?’

মাথা নাড়িয়ে না বললাম। দাদু আবার বললেন, ‘তুই কী চাস সবাই এটা বলুক যে আফজাল রহমানের নাতনি বিয়ে ভেঙে পালিয়েছে?’

আবারো মাথা নাড়িয়ে না বললাম। দাদু মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘বিয়ে টা করে নে। বিশ্বাস কর তুই ঠকবি না।’

করুন দৃষ্টিতে দাদুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। দাদু বললেন, ‘ইয়ানাত! ছেলেটা খুব ভালো। দেখিস তোকে খুব ভালো রাখবে। আর তুই হলি বিশ্ব সেরা সুন্দরীদের মধ্যে একজন। তোকে পছন্দ না করে পারবে না দেখে নিস।’

কিছু না বলে অন্যদিকে ফিরে রইলাম। দাদু মাথায় হাত বুলিয়ে রুম ত্যাগ করলেন। দাঁতে দাঁত চেঁপে অন্য দিকে চেয়ে রইলাম। চোখ বেয়ে পানির শিখা গড়িয়ে চলেছে। একটু পর রুমে কারো উপস্থিতি অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। আর আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে ভেংচি কেটে অন্য দিকে নজর দিলাম। ভাইয়া এবার এসে আমার মাথায় চাপড় মেরে পাশে বসে বলল, ‘কী রে? বিয়ে করতে যাচ্ছিস? আহারে! আমার বোন বিয়ে করে নিচ্ছে আর আমি এখনো সিঙ্গেল লাইফ লিড করছি। ধ্যাত জীবনটাই বেদনা ব্রো।’

পাশ ফিরে ইচ্ছামত তার পিঠে কিল মেরে বললাম, ‘চুপ চুপ বাঁদরের বংশধর কোথাকার। এমনিতে মাথা গরম হয়ে আছে তার উপর তোমার এসব ফালতু কথা। যাও এখান থেকে।’

‘আরে আরে রাগ করছিস কেন? আমি তো এমনি বললাম।’

আমি অন্য দিকে ফিরে বসলাম। ভাইয়া বলল, ‘মন খারাপ?’

‘মাথা খারাপ করো না ভাইয়া। দেখতে পাচ্ছ না মন খারাপ নাকি না?’

‘আরে আরে আবারো রাগ করছিস? মানে বললাম তুই কেন বিয়ে করতে চাইছিস না?’

‘তো তোমাকে যদি কেউ হঠাৎ বলে আজ তোমার বিয়ে তুমি কী করবে?’

‘অফ কোর্স! আমি হ্যাপিলি তাকে বিয়ে করে নেব। তোর মতো সং সেজে বসে থাকব না। হুহ্!’

‘ধুর।’

‘আচ্ছা আচ্ছা। তো বিয়ে কেন করতে চাইছিস না? দেখ এতে তোর আমার সবারই মঙ্গল।’

‘আমি কোন মঙ্গল টঙ্গল বুঝিনা আমি ওই বুইড়া টাকে কখনোই বিয়ে করব না। প্লীজ ভাইয়া কিছু করো।’

‘বুইড়া মানে? এই বুইড়াটা আবার কে?’

‘কে মানে কী? বুইড়া কে হবে আবার তোমাদের পরাণ প্রিয় জামাই।’

‘এই তোকে কে বলল ও বুড়া?’

‘কে বলল মানে? আমি বুঝতেই পারছি ও বুড়া। তা না হলে ইফা আপু পালিয়ে যেত না।’

‘ওই পাগলের মতো কথা বলিস না চুপ। ও বুইড়া না।’

‘সে যাই হোক। আমি এত কিছু বুঝিনা। আমি বিয়ে করব না মানে করব না। আমি পালাবো। আমাকে ব্যালকনি দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও ভাইয়া।’

‘এই এই পাগল নাকি? আমি পারব না।’

‘ঠিক আছে আমিই করে নিচ্ছি।’

‘এই না না বোন দাঁড়া। প্লীজ এমন কিছু করিস না।’

‘কেন? তাহলে কি মরব ওই বুইড়ার কাছে?’

‘এই বার বার বুইড়া বুইড়া করছিস কেন হা?’

‘তো কি করব? সবাই আমার লাইফটা হেল করে দিতে যাচ্ছে।’

বলতে বলতেই কেঁদে ফেললাম। ভাইয়া বলল, ‘এই আমার কিউট বোন টা। করে ফেল না। দেখিস তুই ভালো থাকবি।’

‘কী তুমিও?’

‘বোনু প্লীজ। রাজি হয়ে যা।’

‘মানে কী? ও আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। মানে আমাকে দূর করে দেওয়ার ধান্দা তাই না? থাক! আমি আর থাকবোই না এখানে। অনেক দূরে চলে যাব।’

‘আরে এই বোকা। এমন করে বলছিস কেন? আসলে..’

‘আসলে কী হা?’

‘তোকে সত্য টা বলব ইয়ানু?’

‘কী সত্য?’

‘আসলে ইয়ানু… ইফা পালায় নি।’

‘কীহ্?’

‘হ্যাঁ রে।’

‘তাহলে কোথায়?’

‘আসলে ও এখন চিলেকোঠায় লুকিয়ে আছে।’

মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘তাহলে চলো ইফা আপুকে বের করে আনি। তাহলে আমাকে এই বিয়ে করতে হবে না।’

‘এই এই চুপ চুপ। বেশি কথা বলিস না। এই বিয়ে তুই করবিই।’

‘মানে টা কী ভাইয়া?’

‘ইয়ানু.. আমার জন্য হলেও বিয়েটা করে নে প্লীজ।’

‘কেন ভাইয়া কী হয়েছে সেটা তো বলো।’

‘আচ্ছা তুই আমার সাথে চল।’

‘কোথায়?’

‘চিলেকোঠায়।’

‘কিন্তু কীভাবে? সবাই জেনে গেলে?’

‘চিন্তা করিস না মেয়ে তিনজনকে বাইরে দাঁড় করিয়ে এসেছি। ছাদ দিয়ে নিয়ে যাব তোকে। চল।’

ভাইয়ার কথা মত দু’জন বারান্দার সিড়ি দ্বারা ছাদে পৌছালাম। তারপর দু’জন বদ্ধ চিলেকোঠার সামনে গেলাম। ভাইয়া আস্তে করে টোকা দেয়। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলতেই বধুরূপী ইফা আপুকে দেখি। ভাইয়া আমাকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকে দেয়। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘এসব কী হচ্ছে ইফা আপু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

ইফা আপু বলল, ‘শান্ত হ ইয়ানাত শান্ত হ তুই। দেখ! আমি এই বিয়ে করতে চাই না। তাই আমি চাচ্ছি তুই করে নে।’

‘কীহ্! পাগল নাকি তুমি আপু? তোমার বিয়ে আমি কেন করব আজব?’

‘ইয়ানাত। আমি জানি তুই কনফিউজড। এই ইবনান ভাইয়া বুঝিয়ে বলুন না।’

ভাইয়া গোমড়া মুখে বলল, ‘ইয়ানাত। ইফা অন্য কাউকে ভালোবাসে।’

মাথায় বাজ পড়ল। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম, ‘কীহ্?’

দু’জন মাথা নাড়াল, ‘হ্যাঁ ইয়ানাত।’

কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে বললাম, ‘তুমি এসব আগে বলো নি কেন? তাহলে তো এসব হতো না।’

‘তুই তো জানিস। ওরা আমার মতকে কখনো গুরুত্ব দেয়নি। আর না আমার কথা শুনার চেষ্টা করেছে।’

‘তাহলে আমি কী করব এখন?’

দু’জন একসাথে বলল, ‘বিয়ে টা করে নে।’

‘কীহ্! তোমরা আমার সঙ্গে এমন কেন করছ বলো তো।’

‘প্লীজ ইয়ানাত বুঝার চেষ্টা কর।’

‘দেখ আপু তোমার বর যদি তোমার জায়গায় আমাকে দেখে তাহলে কী অবস্থা হবে ভাবতে পারছ?’

‘কিছুই হবে না ইয়ানাত। সব প্লান করা আছে। তা ছাড়া এই প্লান টা ওরও ছিল।’

‘মানে?’

‘মানে যার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা সে জানে আমি পালিয়ে যাব। দেখ ইয়ানাত! আমি ফাহাদ কে খুব ভালোবাসি। ওকে বিয়ে করতে চাই আমি। প্লীজ তুই আমায় বাঁচা!’

বসে পড়লাম চেয়ারে। ভাইয়া কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘তুই কী তোর ভাইয়ার কথা রাখবি না? তুই তো তোর ইফা আপুকে ভালোবাসিস না? তাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখবি? ও একজনকে খুব ভালোবাসে আর.. ওকে ছাড়া হয়তো ও ভালো থাকবে না। আর তুই রাজি হচ্ছিস না কেন? তোর কী কাউকে পছন্দ নাকি?’

চুপ করে রইলাম। ইশ! কেন যে আমার কোন ক্রাশ হলো না। ভাইয়া আবারো প্রশ্ন করল, ‘কী? আছে?’

‘না।’

‘তাহলে? রাজি হচ্ছিস না কেন?’

চুপ করে রইলাম। তারা খুব অনুরোধ করল। রাজি হলাম। কিন্তু মনকে মানাতে পারছি না। কী হবে এখন?
__________

শাড়ি পড়ানো হচ্ছে আমাকে। সাজতে বলা হয়েছিল কিন্তু সাজার অভ্যাস ছোট বেলা থেকেই নেই। দূরে সরিয়ে দিলাম ওদের। বললাম, ‘তোমরা যাও। আমি নিজেই তৈরি হবো।’

একজন বলল, ‘না ম্যাম উই আর স্যরি। ইরহান স্যার আমাদের আপনার সাথে থাকতে বলেছে।’

চিল্লিয়ে বললাম, ‘আই ডোন’ট কেয়ার হোয়াট দে’আর গোয়িং টু সে। জাস্ট গেট আউট।’

ধমকে তারা ভয় পেয়ে আস্তে করে বেরিয়ে গেল। আমি আয়নার সামনে বসে পড়লাম। লাল বেনারসি, চোখে কাজল আর খোঁপায় বাসন্তী ফুল জড়ানো। বধুরূপী নিজেকে দেখেই কেন যেন কান্না পাচ্ছে। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। যে আজ আমার বিয়ে? না জানি সেই লোকটা কেমন যার সঙ্গে ‘বিবাহ্’ নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছি।

বদ্ধ রুমে বসে আছি। বাহির থেকে ডেকেই চলেছে খালামণি আর আম্মু। কিন্তু আমি চুপ করে বসে আছি। এর মাঝে ভাইয়া ডেকে বলল, ‘তুই আমার কথা শুনবি না বোন?’

ভাইয়ার কথায় চোখে অশ্রুকণারা ভীড় জমাল। গিয়ে দরজা খুললাম। খালামণি, বাড়ির কিছু আন্টি সহ কাজী সাহেব প্রবেশ করেন। ও পক্ষের পড়ানো শেষ।

কবুল.. কবুল.. কবুল।

পাথর হয়ে বসে রইলাম। এই বুঝি আমি অন্য কারো সাথে এক চিরজীবনের সম্পর্কে জড়ালাম? এই বুঝি আমি হলাম কারো বউ, কারো পুত্রবধু, কারো ভাবী?
আব্বুকে একটা বারও কাছ থেকে দেখিনি। তাকে একটা কথাই বলতে মন চাইল, ‘খুশি? এখন খুশি আমায় মে’রে? এখন খুশি আমায় অন্যের হাতে এত জলদি তুলে দিয়ে?’

গাড়িতে ওঠার সময়ও বোধহয় আমার হুশ ছিল না। পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন আঙ্কেল মানে ইফা আপুর আব্বু এগিয়ে আসে। আমার ডান হস্ত পাশে থাকা অজ্ঞাত সেই ব্যক্তিটার হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘আজ আমার মেয়েকে আমি তোমার হাতে তুলে দিলাম। ওর সকল দায়িত্ব এখন তোমার। তুমিই ওর আশ্রয়। ওর ভরসা। আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো তাহমিদ বাবা।’

ওপাশের ব্যক্তিটা কেবল মাথা নাড়ে। তার দিকে তাকানোর মতো ইচ্ছা আমার নেই। আমি যেন কোন অনুভূতিহীন জড়বস্তু। যাওয়ার সময় আম্মু আর খালামণি আমায় জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদে। কিন্তু আমি সেই একি জড়বস্তু। নেই চোখে অশ্রু আর না তাদের ফিরতি জড়িয়ে ধরেছি। গাড়িতে উঠে বসার পূর্বে সেই ছোট্ট চিলেকোঠার ছোট্ট জানালার দিকে তাকালাম। সেখানে ইফা আপুর মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে। সে মাথা নাড়িয়ে জানাল ‘বেস্ট অফ লাক’।
ইফা আপুর কী হবে? সে কী চায়? তার আদও কী তার ভালোবাসার সঙ্গে সম্পর্কটা পূর্ণ হবে? তার বাবা মা আর দাদু কী মেনে নেবে?
আর না জানি আমারই বা কী হবে। না জানি কোথায় এর অন্ত!
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ্]