অনেক সাধনার পরে পর্ব-১৫+১৬+১৭

0
379

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[১৫]

সকালের নাস্তা তৈরী করছে আমেনা। নাস্তা তৈরির ফাঁকে শেফালীকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। মেয়েটা বড্ড ঘুমকাতুরে। জুলফিকার সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছে আর ফাঁকে ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছে। জুলেখা বেগম সেখানেই তার পাশে বসে চা খাচ্ছে।

শেফালী ঘুমুঘুমু চোখে এসে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসলো। আমেনা রান্না ঘর থেকে নাস্তার একটা প্লেট টেবিলে এনে রাখলো। শেফালীকে দেখেই প্রশ্ন করলো, ‘হাত মুখ ধুয়েছিস তো? নাকি ঘুমের কারনে সেটাও ভুলে গেছিস?’

শেফালী চেহারায় অসন্তুষ্টি এনে বললো, ‘আড়ামের ঘুম হারাম করে এখানে এসেছি যে এটাই বেশি।’

‘তার মানে ফজরের নামাজ পড়ো নি তুমি?’

জুলফিকারের গম্ভীর প্রশ্ন শুনে জড়সড় হলো শেফালী। চোখের ঘুম মুহূর্তেই ভয়ের জন্য গায়েব হয়ে গেলো বাবার কথায়। শুকনো ঢুক গিললো। জুলফিকার খালি চায়ের কাপ টেবিলে রেখে জানতে চাইলো, ‘মিতালী পড়েছে?’

শেফালী কন্ঠস্বর নিচু করে প্রতিত্তুর করলো, ‘জ্বি।’

‘তোমাকে ডাক দেয় নি?’

‘দিয়েছিলো। আমি উঠিনি।’ শেফালীর মিনমিনে উত্তর। গম্ভীর ভাব আসলো জুলফিকারের মাঝে। জুলেখা সোফায় বসে থেকেই বললেন, ‘মিতালী কই? টেবিলে দেখতাছি না যে।’

আমেনা উত্তর দেওয়ার আগেই শেফালী বলে উঠলো, ‘আপু তার ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে গেছে। একেবারে ভার্সিটি শেষে আসবে।’

ব্যাপার টা সবাই স্বাভাবিক ভাবেই নিলো। কিন্তু জুলেখা নিলো অন্যভাবে। মুখ বাঁকিয়ে কপাল কুঁচকে বলে উঠলো, ‘হায় হায়, কি যুগ আইছে। মাইয়া মানুষ সাত সকালে ফেরেন্ডের লগে দেখা করতো গেছে। কি আপায়া মেয়ে বাবাগো বাবা। আমেনা? বলি মাইয়া কে একটু ভালো শিক্ষা দাও। এমন মাইয়া থাকলে কলঙ্কের দাগ লাগবো গায়ে।’

‘লাগলে লাগুক। আপনার গায়ে তো আর লাগছে না। তাহলে এতো টেনশন কেন আপনার?’ শেফালীর কাটকাট কন্ঠে বলে উঠলো জুলেখাকে। রাগে ফুঁসছে সে। দাঁতে দাঁত পিষে তাকিয়ে রইলো দাদীর দিকে। জুলেখা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘মাগোমা! মেয়ে দেখো কি বেদ্দপ হইছে। বড়দের লগে কেমনে কথা কইতাছে। জুলফিকার তুই কিছু কো তোর ছোটু মাইয়া রে। আদর করতে করতে ভালাই বেদ্দপ বানাইছোস।’

জুলফিকার নিশ্চুপ। গম্ভীর তার চেহারার ধরন। প্রতিদিন এই একই কাহিনীতে সে মোটেও সন্তুষ্টি নয়। আমেনা মেয়েকে শাসনের কন্ঠে বললেন, ‘বেশি কথা শিখেছিস তুই? বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না?’

তেঁতে উঠলো শেফালী। চেয়ার ছেড়ে ধপ করে উঠে দাঁড়ালো। মায়ের দিকে তাকিয়ে কাটকাট গলায় বলে উঠলো, ‘আমাকে কেন সব সময় চুপ থাকতে বলো? প্রতিবার বুবুকে এই মহিলা এতো এতো কথা শুনায় তাও তোমরা দুইজনের একজনও তাকে কিছু বলো না। বুবু কি কোনো সার্কাস? নাকি সাজানো পুতুল? তোমরা যে যেই ভাবে পারো সে ভাবেই তাকে কথা শুনাও।’

আমেনা রাগি গলায় বললেন, ‘চুপ কর তুই। এই মহিলা কি? তোর দাদী লাগে।’

‘দাদী? সত্যি দাদী লাগে? আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোনো দাদী দেখেছো যে তার নাতনীকে উঠতে বসতে কটুকথা শুনায়? লাগবে না এমন দাদী। নিকুচি গেছে দাদীর। আর তোমরাও কি হ্যাঁ? নিজের মেয়ে কে এইভাবে মানুষ অপমান করবে আর চুপচাপ সয্য করে নিবে? লজ্জা নেই? কিছু বলতে পারো না তোমরা? ওহ হ্যাঁ বুঝেছি। তোমাদেরও ভালো লাগে বুবুকে এভাবে কথা শুনাতে দেখে। তোমরা সবাই এক।’

রাগের মাথায় কি থেকে কি বলছে শেফালীর জানা নেই। মুখের সব কথা ছুঁড়ে দিয়ে দাঁড়ালো না আর একটুও। দ্রুততার সাথে পা চালিয়ে রুম থেকে ব্যাগ নিয়ে গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো বাসা থেকে। থাকবে না এই বাসায়। যেখানে বুবুকে উঠতে বসতে অপমান করা হয় সেখানে যে কদম ফেলবে না। বাসার নিচে এসে রিকশা ডেকে উঠে বসলো তাতে। রাগে তার শরির মৃদু কাঁপছে।

জুলফিকার গম্ভীর চোখে জুলেখার দিকে তাকালো। চুপচাপ বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো। অর্থাৎ আজ নাস্তা করবে না বাসায়। হতাশ হলো আমেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো কেবল। মনে মনে বলতে লাগলো মেয়েটা মরে যাক। তাহলে আর কারোর সমস্যা হবে না। সবাই শান্তিতে থাকবে। নাহলে সে নিজেই মরে যাক। অন্তত্য নিজের মেয়ের এমন অপমান দেখতে হবে না।
.

ঘড়ির কাটা সাতটা দশের ঘরে। রাস্তার পাশে ইটের তৈরিকৃত ব্যাঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে অংকুর ও মিতালী। মাথার উপর বড় আকারের কৃষ্ণচূড়া গাছ। বাতাসের কারনে ফুল গুলো দুল খাচ্ছে। কিছু কিছু কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুল পিচ ঢাকা সরু রাস্তায় সজ্জিত হয়ে পরে আছে। সেদিকেই তাকিয়ে আছে মিতালী। অংকুর বসে বসে মোবাইল ঘাটাঘাটি করছে। মূলত সে ছবি সিলেক্ট করছে। মিতালীর হাতের কাপ ও তার হাতের কাপের সুন্দর ছবিটা এফবিতে দিবে তাই এই সিলেকশন।

‘এই তোমার আইডির নাম কি? তাড়াতাড়ি বলো।’

মিতালী চুপচাপ আইডির নাম জানিয়ে দিলো। অংকুর তাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করতে বললে তাই করলো সে। বেশ কিছুক্ষন পর নোটিফিকেশনের আওয়াজে এফবিতে গিয়ে দেখলো অংকুর তাকে ট্যাগ করেছে। তাও আবার অংকুরের প্রোফাইলে তাদের সদ্য তুলা চা কাপের ছবিতে। বিস্মিত হলো মিতালী। ক্যাপশন টা পরে যতোটা না অবাক হলো তার থেকেও বেশি লজ্জিত হলো অংকুরের ফ্রেন্ডদের কমেন্ট দেখে। ক্যাপশন টা ছিলো –

‘every morning is partial without a cup of tea as I’m partial without you.’

ঘড়ির কাটা যেন চলমান। থামতেই চাইনা। তারা স্রোতের মতোই প্রভাহমান। হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে নিরাশ হলো সে। সাতটা চল্লিশ বাজে। এতোটা সময় কিভাবে পার করে ফেললো অংকুরের জানা নেই। মিতালীর দিকে তাকালো। আফসোস সহিত বিড়বিড় করে বলে উঠলো, ‘আজকাল ঘড়িটাও আমার সাথে শত্রুতামী করে।’

কথাটা কর্ণপাত হলো মিতালোর। কপাল কুঁচকে আলতো ভাবে হেসে বললো, ‘ঘড়ি কিভাবে শত্রুতামী করে?’

‘করে তো। এইযে পাঁচ মিনিটা হয়েছে তোমার সাথে আছি। অথচ ঘড়িতে দেখো সাতটা চল্লিশ। কিভাবে সম্ভব? বেইমানি করলো না আমার সাথে? আর মাত্র পঞ্চাশ মিনিট সময় আছে। তারপর অফিসে যেতে হবে। আরেকটু আস্তে আস্তে ঘড়ির কাটা চললে কি ক্ষতি হতো? তোমার সাথে আরেকটু বেশি সময় পার করতে পারতাম।’

বিরক্তি নিয়ে বললো অংকুর। চেহারায় তার স্পষ্ট অসন্তুষ্টির ছাপ। মিতালী প্রশ্ন করলো, ‘আপনি এখান থেকে সরাসরি অফিসে যাবেন?’

‘হ্যাঁ দেখো একদম তৈরি হয়েই বের হয়েছি।’

‘নাস্তা করেছেন তো? না খেয়েই যাবেন নাকি?’

ভ্রুঁ কুঁচকালো অংকুর। চোখ ছোট ছোট করে মিতালীর দিকে তাকালো। ভ্রুঁ জোড়া নাচিয়ে দুষ্টু হেসে বললো, ‘বাহ্ বাহ্ প্রেমিকা হওয়ার চেষ্টা করছো নাকি? এতো কেয়ার। ওয়াও। ভালো ভালো। কেয়ারিং হওয়া ভালো। বিয়ের পর কাজে দিবে।’

ভ্যাবাচেকা খেলো মিতালী। লজ্জাভূতি হলো সে। অংকুরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললো, ‘কিসব আবুল তাবুল কথা আপনার মাথায় ঘুরে। আজিব পাবলিক আপনি।’

হাসলো অংকুর। বললো, ‘ব্যাপার না। বিয়ের পর তো তুমি নিজের হাতে নাস্তা তৈরি করবে তো না খেয়ে বের হওয়ার প্রশ্নই আসে না। অবশ্যই খেয়ে বের হবো। আর সাথে তো.!’

থেমে গেলো অংকুর। চোখ কুঁচকে ফেললো সে। মুখ ফঁশকে কি থেকে কি বলতে চলেছিল আল্লাহ মালুম। মিতালী চোখ দুটো ছানাবড়া করে অংকুরের দিকে তাকালো। অংকুর ভ্যাবাচেকা খেলো। থমথমে মুখে অপ্রস্তুত হয়ে বললো, ‘তোমার মাইন্ড খারাপ। আমি কিছু বলি নাই। এতোক্ষণ বসে থাকতে থাকতে কোমড় ধরে গেছে। একটু হাঁটি আসো।’

বসলো না অংকুর। দ্রুততার সাথে পা চালিয়ে সামনে এগুতে লাগলো। এক হাতে মাথা চুলকে নিজেকে আহাম্মক বলে গালি দিতে লাগলো। আনমনে মৃদু হেসে ফেললো মিতালী। তারপর সেও উঠে অংকুরের পিছু হাটতে লাগলো।
.

পার্কের পাশে একটা বিশাল বট গাছ আছে। যার চারপাশে ইট সিমেন্ট দিয়ে বাধায় করা। ইট গুলো বিভিন্ন কালার দিয়ে রাঙ্গানো। সেখানেই কোলে ব্যাগ নিয়ে গালে দুই হাত রেখে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে শেফালী। বিরক্ত সে। নিজের উপর মহা বিরক্ত। রাগ করে হুড়হুড় করে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলো। কিন্তু টাকা? সাথে এক টাকাও আনেনি। অন্য সময় ব্যাগে হাজার খানেক টাকা থাকতো কিন্তু আজ? ভাগ্যে লরাদশা লাগলো। একটাও নেই ব্যাগে। মোবাইলও আনতে ভুলে গেছে। নাহলে ফ্রেন্ড দের সাথে যোগাযোগ করতে পারতো। এখন নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। কে বলেছে তখন রাগ দেখিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসতে? এসে যখন মোবাইল ও টাকা খেয়াল করে নিবে না? সকাল থেকে না খাওয়া। খিদাও লেগেছে বেশ। এবার কি হবে?????

‘এই যে ফাঁকিবাজ। এতো সকালে এখানে কি করছেন?’

রাকিবের কথায় প্রতিত্তুর করলো না শেফালী। চুপচাপ গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। তার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে ভ্রুজোড়া কুঁচকে এলো রাকিবের। মেয়েটার মন খারাপ কেন? কিছু হয়েছে নাকি? কৌতুহল বাড়লো রাকিবের। শেফালীর পাশে বসে মোলায়েম কন্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘কি হয়েছে? মন খারাপ?’

শেফালী রাকিবের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। ঠোঁট উল্টে বললো, ‘শেষ! আমি ফকির। বাসায় যেতে পারবো না। এবার আমার কি হবেএএ?’

ন্যাকা কান্নার ভান ধরলো সে। শেফালীর মুখশ্রী দেখে রাকিবের প্রচুর হাসি পেল। আবার ভালো লাগাও কাজ করলো মনে। ঠোঁটে আলতো হাসি রেখে জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে নিল। বললো, ‘বাসায় যেতে পারবে না কেন? কি হয়েছে?’

‘আসলে সকালে রাগ করে বাসা থেকে বেড়িয়ে এসেছি। ভেবেছিলাম সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরবো। কিন্তু ব্যাগ এনেছি ঠিকই টাকা মোবাইল কিছুই আনি নি। কত বড় বেক্কল আমি।’

বিরক্ত সহিত বললো শেফালী। মৃদু আওয়াজে হেসে উঠলো রাকিব। তার হাসির শব্দ শেফালীর গায়ের আগুনে ঘি ঢেকে দেবার উপক্রম। দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘সমস্যা কি? ভ্যাটকাচ্ছেন কেন? এখানে ভ্যাটকানোর জায়গা?’

হাসির মাত্রা আরো দ্বিগুণ করলো রাকিব। বললো, ‘আমার ইচ্ছা তাতে তোমার কি? আজকে ক্লোজআপ দিয়ে ব্রাশ করেছি। তাই ভ্যাটকাইতাছি। সুন্দর সাদা দাঁত দেখাচ্ছি। এই দেখো ইইইইই!’

ইইই করে দাঁত বের করে দেখালো রাকিব। শেফালী নাক মুখ কুঁচকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো , ‘হারপিক ব্যবহার করা দরকার ছিল। যথেষ্ট সুন্দর আর এভাবে দেখাতে হবে না। সরেন।’

উচ্চস্বরে হাসলো রাকিব। শেফালী ত্যাঁছড়া চোখে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। গটগট পায়ে সামনে এগুতে লাগলো। ‘আরে দাঁড়াও আমিও আসছি।’ বলে রাকিবও পিছু নিলো তার। শেফালী দ্রুত হাটছে রাকিবের চোখের আড়াল হওয়ার জন্য। কিন্তু রাকিব তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে শেফালীকে ধরে ফেললো। পাশাপাশি হাটছে তাও শেফালী পায়ের গতি কমাচ্ছে না। ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে দ্রুত হাটছে। বিরক্ত হলো রাকিব। ধমকে উঠলো, ‘সমস্যা কি তোমার? এমন চোরের মতো পালাচ্ছো কেন?’

চলমান..

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[১৬]

রাকিবের কথা কর্ণপাত হতেই দাঁড়িয়ে পরলো শেফালী। কটমট চোখে রাকিবের দিকে ঘুরে তাকালো। শক্ত গলায় বললো, ‘আপনার সমস্যা কোথায়? আমার পিছু আসছেন কেন?’

ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো রাকিব। বলল, ‘কে তোমার পিছু নিয়েছে আশ্চর্য।’ বলেই হাত ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো। তারপর শেফালীকে বললো, ‘এতো সকালে নিশ্চয় খেয়ে বের হও নি? ক্ষিদে পেয়েছে? আসো কিছু খেয়ে নেই।’

‘আপনাকে বলবো কেন? আর আপনার সাথে কেন খেতে যাবো? আমার পিছে কি আপনার? যান এখান থেকে।

শেফালীর এরূপ ব্যবহারে প্রচুর রাগ হলো রাকিবের। মেয়েটা সব সময় ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলবে। ভালো কথা হোক কিংবা খারাপ; সবসময় ত্যাঁছড়া মার্কা উত্তর। তার এমন বেয়াদবি নিতে পারলো না রাকিব। তাই ধমকে উঠলো, ‘চুপ করো বেয়াদব মেয়ে। আর একটা ফালতু কথা বললে ডিরেক্ট জুলফিকার আঙ্কেল কে কল দিয়ে জানিয়ে দিবো সব। সবসময় ত্যাড়া ত্যাড়া উত্তর। চুপচাপ আমার সাথে আসো।’

ধমক শুনে মৃদু কেঁপে উঠলো শেফালী। ধাতস্থ হলো সে। কাচুমুচু ভাব আসলো তার মাঝে। এই জীবনে স্কুল টিচার বাদে এমন ধমক খায়নি সে। এখন একটা অপরিচিত ছেলের কাছ থেকে রাস্তায় ধমক খেতে হয়েছে তার। আশেপাশে তাকালো একবার। দেখলো একটু দূরে দাঁড়ানো একটা মহিলা ও দুইটা ছেলে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ কালো করে তাকালো শেফালী। নাক মুখ কুঁচকে রেখেছে সে। রাকিব চুপচাপ বিনা অনুমতিতে শেফালীর হাতের কব্জি ধরলো। হকচকিয়ে গেলো শেফালী। অবাক চোখে তাকালো রাকিবের দিকে। চেঁচিয়ে উঠলো,

‘সমস্যা কি? অনুমতি ছাড়া হাত ধরছেন কেন আমার? হাত ছাড়ুন বলছি। বেহায়া লোক কোথাকার।’

‘সিরিয়াসলি বলছি শেফালী। আর একটা কথা বললে মাথায় তুলে রাস্তার মাঝে আছাড় মা:রবো। চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো আমার সাথে আসো। নাহলে তোমার বাবার কাছে সব বলে দিবো।’

রাকিব দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো। ঠোঁট উল্টে তাকালো শেফালী। কাদুকাদু চেহারায় মিনমিনে গলায় বললো, ‘কথায় কথায় বাবাকে সব জানিয়ে দিবো বলে থ্রে:ট দেন কেন? আপনি অনেক বাজে একটা লোক।’

‘হ্যাঁ জানি!’ বলে শেফালীর হাত ধরে হাটতে লাগলো রাকিব। উদ্দেশ্য তার রেস্টুরেন্টের যাওয়া!
.

আজকের সকাল টা ছিলো স্নিগ্ধ। সূর্যকিরণের মুগ্ধকর আলোকরশ্মি। পাশাপাশি প্রিয় মানুষটার হাতে বানানো চা দিয়ে শুরু আজকের প্রভাত। যেহেতু দিনের শুরুটা ভালো কিছু হয়েছে তার মানেই সারাটা দিন আজ ভালো যাবে। মনটাও বেশ ফুরফুরে অংকুরের। হাস্যউজ্জল তার চেহারার বর্ণ। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। আটটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। নয় টার আগে অফিসে উপস্থিত হতে হবে। ভোরে রাস্তাঘাট নির্জন থাকলেও এখন একদম কোলাহলপূর্ণ। ফুটপাত জুড়ে চলছে মানুষের আনাগোনা। পিচ ঢালা রাস্তার উপর গাড়ি সব তুমুল বেগে চলছে। রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। মাথার উপর বিশালাকৃতি গাছ। ছায়ার কারনে পরিবেশটা শীতল। অংকুর তাকালো মিতালীর দিকে। হাস্যউজ্জল চেহারায় বললো, ‘ট্রাস্ট মি মিলি। এর আগে কখনো এতো ভালো মুহূর্ত উপভোগ করিনি আমি। আজকের সকালটা আমাকে দেওয়ার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মিস. পরিবেশ দূষণকারী কন্যা।’

অংকুরের প্রথম কথাগুলো শুনে স্মিতি হাসলেও শেষের সম্মোধনটা মোটেও ভালো লাগে নি। বিরক্তিকর চোখে তাকালো। বললো, ‘ফালতু কথার ফ্যাক্টরি খুলে বসে থাকেন নাকি সব সময়?’

দাঁত কেলালো অংকুর। হাত ঘড়িতে সময় দেখে বললো, ‘আরো অনেক কথা বাকি আছে। কিন্তু সময় নেই। অফিসে যেতে হবে। বাকিসব পরে বলবো। আর হ্যাঁ রাতে কল দিলে রিসিভ করবে।’

ভ্রুঁ কুঁচকালো মিতালী। ভোরের শুরু থেকে এখন অব্ধি পুরোটা সময় অংকুর একা একা কথা বলেছে। মিতালী কেবল চুপচাপ শুনেছে সব। এখন অংকুরের কথা শুনে বিস্মিত হলো। স্মিতি হেসে বললো, ‘এতোক্ষণ তো একা একা বকবক করে আমার কানের বারোটা বাজালেন। তাও বলছেন আরো কথা বাকি আছে?’

‘এখনো অনেক কিছু বলার আছে৷ ভালোবাসি বলা বাকি। তোমায় নিয়ে লিখা প্রতিটা কবিতা শুনানো বাকি। হাত ধরে পথচলা বাকি। তোমাকে নিয়ে পাহারের চূড়া, সমুদ্র বালুচরে হাঁটা বাকি ৷ রাতদুপুরে তোমার স্পর্শ পাওয়া বাকি।’

চোখে চোখ রেখে তাকালো মিতালী। অংকুরের দৃষ্টির গভীরত্ব ধরতে পারলো। অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করলো মনে। দৃষ্টি সরালো না। অংকুরের প্রগাঢ় চোখে চাহনীতে তাকিয়ে রইলো। মৃদু হাসলো অংকুর। বললো, ‘এমনিতেই ফিদা হয়ে আছি। এভাবে তাকালে তো একদম হার্টফেল করে ফেলবো। দৃষ্টি সরাও মেয়ে।’

হকচকিয়ে গেলো মিতালী। চোখের চাহনী তার তীক্ষ্ণ হলো। ফুঁশ করে বিরক্তির নিশ্বাস ছুঁড়লো। হেসে উঠলো অংকুর। বললো, ‘তোমাকে রাগিয়ে দেই আর তুমিও রেগে যাও। ব্যাপার টা প্রচুর কিউট। তার থেকেও বেশি কিউট তোমার রাগি চাহনী।’

মিতালী প্রতিত্তুর করলো না। বরঞ্চ হাত ঘড়ির দিকে তাকালো একবার। তারপর বিরক্ত নিয়ে বললো, ‘আপনার না অফিস আছে? যাচ্ছেন না কেন?’

‘যেতে ইচ্ছে করছে না।’

অংকুরের নিস্প্রভ কণ্ঠস্বর। হাসি পেলো মিতালীর। কিন্তু হাসলো না। উপরে গম্ভীর ভাব রেখে বললো, ‘তাহলে থাকেন। আমি যাচ্ছি।’

অংকুর কথা বললো না। তাকিয়ে রইলো মিতালীর দিকে। মিতালী একটা রিকশা থামালো। সেটাতে উঠে বসে অংকুরের দিকে তাকালো। অংকুর ঠোঁটে স্মিতি হাসি রেখে বললো, ‘আবারো দেখা হবে কৃষ্ণকন্যা। সাবধানে যাও।’

চলে গেলো মিতালী। অংকুর আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে। আনমনে প্রফুল্ল হেসে উঠলো সে। আহঃ আজকের এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখতে ইচ্ছে করছে তার। প্রথম ডেইট। তাও আবার প্রিয় মানুষটার হাতে বানানো চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে।ব্যাপারটা আসলেই জুউউউশ।
.

সিএনজির ভিতরে এক পাশে ব্যাগ বুকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে শেফালী। নাক ও কপাল কুঁচকে রেখেছে সে। আজ সে বাসায় যাবে না মানে না। যতোই জোড় করুক তাকে। সন্ধ্যা হলে খালার বাসায় চলে যাবে। রেগে আছে সে। তাই যাবে না। অপরদিকে রাকিবের চেহারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। শেফালীর এমন ব্যবহার তাকে রাগিয়ে তুলছে। আবারো ধমকে উঠলো, ‘সমস্যা কি? সিএনজি থেকে বের হচ্ছো না কেন?’

শেফালী ব্যাগ টা আরো শক্ত করে ধরে বললো, ‘বললাম তো আজ বাসায় যাবো না।’

রাকিব হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। বিকেল চারটা পঁচিশ। সকালে নাস্তা করার পর শেফালীকে সে কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়েছিলো। তারপর দুপুরে আবারো শেফালীকে নিয়ে লাঞ্চ করেছে। মেয়েটা বড্ড বিচ্ছু। বেয়াদপও বটে। কিছুতেই রাকিবের সাথে যেতে চাইছিলো না। জুরপূর্বক সাথে নিয়ে যেতে হয়েছে। প্রথমে ভালো করে বুঝিয়ে বলেছিল রাকিব। যখন দেখলো এই মেয়ে সোজা কথার মানুষ নয়। তখুনি আচ্ছা মতো ধমকে কথা শুনিয়েছে। ফুঁশ করে নিশ্বাস ছুঁড়লো রাকিব। জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে নিলো। কন্ঠস্বর মোলায়েম করে বললো, ‘বাসায় না গেলে টেনশন করবে সবাই। লক্ষি মেয়ের মতো বাসায় যাও এবার।’

‘বললাম তো যাবো না। আমি এখন খালামনির বাসায় চলে যাবো। তাও এই বাসায় যাবো না।’

শেফালী তার কথায় অটুট। এক চুলও নড়লো না জায়গা থেকে। বিরক্ত হলো অল্পবয়সী সিএনজি ওয়ালা ছেলেটি। প্রায় আধঘণ্টা ধরে এই মেয়ের জন্য গাড়ি আটকে আছে। আর সহ্য করতে পারলো না সে। তাই বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো, ‘আপা সমস্যা কি? নামেন না ক্যা গাড়ি থেইকা? নাইমা ঢং করেন তো। আমি যাইগা।’

শেফালীকে অন্য কেউ ধমক দেওয়ায় রাগান্বিত হলো রাকিব। ছেলেটা বয়সে ছোট। তাই বলে উঠলো, ‘থা:প্রাইয়া দাঁত ফালাই দিবো বেয়াদব ছেলে। চুপচাপ বসে থাক। তোর যতো টাকা লাগে আমি দিবো।’

চুপসে গেলো ছেলেটি। শুকনো ঢুক গিলে সামনে তাকিয়ে রইলো। রাকিব শেফালীর উদ্দেশ্যে বলল, ‘তুমি কি বের হবে? নাকি থাপ্পড় লাগাবো?’

অসন্তোষ-জনক চোখে তাকালো শেফালী। কপাল কুঁচকে বেড়িয়ে এলো সিএনজি থেকে।

‘চুপচাপ বাসায় যাও। যদি উল্টা পাল্টা কিছু করেছো তো খবর আছে।’

ঠান্ডা কন্ঠে কড়া থ্রে:ট। শেফালী অবাক হলো, রাগ হলো, সাথে বিরক্তও হলো। অন্য একজন ছেলে তাকে কন্ট্রোল করবে? এভাবে শাসন করবে? মানতে পারলো না শেফালী। বললো, ‘রীতিমতো অধিকার দেখানো শুরু করছেন আপনি? আমাকে এভাবে বলার আপনি কে? আমি যেখানে খুশি সেখানে যাবো। তাতে আপনার কি?’

রাকিব পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখিয়ে বললো, ‘জুলফিকার আঙ্কেল কে কল দিবো? বলবো তার মেয়ে কলেজ ফাঁকি দেয়? বলবো তার নেয়ে সারাদিন একটা ছেলের সাথে ছিলো? তাও অন্য কেউ না তারই বন্ধুর ছেলে। বলবো সব?’

চোখ বড়বড় করে তাকালো শেফালী। আতঙ্কিত হলো সে। অস্থির কন্ঠে অনুনয় করে বললো, ‘প্লিজ ভাইয়া। আব্বুকে কিছু জানাবেন না। কথায় কথায় আব্বুকে টানেন কেন? আব্বু জানলে রাগ করবে ভীষণ।’

‘তাহলে যা বলছি শুনো। চুপচাপ বাসায় যাও।’

প্রতিত্তুর করলো না শেফালী। কাদুকাদু চেহারায় রাকিবের দিকে তাকালো একবার। উদাস মনে বাসার ভিতরে ঢুকলো সে। রাকিব পকেটে দুই হাত গুঁজে তাকিয়ে রইলো শেফালীর দিকে। স্মিতি হাসি তার ঠোঁটে।

‘ভাই আমার টেকা।’

ড্রাইভার ছেলেটির কথায় ধ্যান ভাঙ্গে রাকিবের। বিরক্ত হলো সে। কিছু বললো না। নিশ্চুপ থেকে সিএনজি তে উঠে বসলো।

চলমান..

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[১৭]

ছোট একটি অর্থবহুল প্রবাদ আছে। “সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।” সময় চলে যায় মুহূর্তের মধ্যে, আর স্রোত যায় নদীর প্রবাহের আলোড়নের মধ্যে। সময় এবং স্রোত উভয় নিজের ইচ্ছামতো অতিবাহিত হয়। আপনি আমি কেউ চাইলেও তা আটকাতে পারবো না। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জীবনযাত্রার মান খাপ খাইয়ে নিতে হয়। বর্তমানে ঘটিত ভালো ভালো মুহূর্ত গুলো মনের দেয়ালে দাগ কাটে। তেমনি হলো মিতালী এবং অংকুরের মাঝে। দুজনের সম্পর্ক ইদানীং বেশ ভালো গভীর হয়েছে। বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ! একে অপরের সাথে দেখা করা, রাত জেগে ফোনালাপ করা, হুটহাট বিনা অনুমতিতে হাত ধরে পথচলা যেন তাদের নিত্যদিনের কাজ। যদিও এক্ষেত্রে অংকুর এক ধাপ এগিয়ে। সম্পর্কটাকে সে নিজেই একটু বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে মিতালীর দিক থেকে কোনো প্রকার পজিটিভ সাইন পাচ্ছে না। মিতালী নিশ্চুপ থাকে বরাবরই। তবে একসাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো তারা দুইজন বেশ ভালো উপভোগ করে।
.

আজকের অম্বর স্বচ্ছ। বাতাস শীতল। দিবাকরের উত্তাপ কোমল। বিকেলের হাওয়ায় মন মাতানোর উৎসব। এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে মিতালী। পরনে তার লাল কুর্তি। ঘড়ির দোকানে এসেছিলো সে।পছন্দ মতো নিজের জন্য একটা গোল্ডেন ও আরেকটা শেফালীর জন্য কালো রঙের ঘড়ি নিয়েছে। এখন ফুটপাতের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পড়েই রিকশা ডাকবে সে। মোবাইলে যখন পুরো দমে ব্যস্ত তখুনি কানে ভেসে এলো বহু পরিচিত কারোর কন্ঠ।

‘সারপ্রাইজ!’

অংকুর দুইটা হাওয়াই মিঠাই মুখের সামনে রেখে বললো কথাটি। তারপর হাওয়াই মিঠাই মুখের সামনে থেকে সরিয়ে এক গাল হাসলো। সঙ্গে মিতালীও। কোনো একসময় মিতালী তাকে বলেছিল হাওয়াই মিঠাই তার পছন্দের। সেই ছোট কথাটা অংকুর মনে রেখেছে? অবাক লাগলেও ভালো লাগা কাজ করলো মনে। পূর্ণদৃষ্টিতে অংকুরের দিকে তাকালো। দেখলো পরনে কালো শার্ট কনুই পর্যন্ত গুটানো। টাইট্যান ব্যান্ডের কালো ঘড়ি হাতে। সিল্কি কালো চুল গুলো বাতাসে উড়ছে। হাসির সাথে সাথে ছোট বাঁকা দাঁত টা স্পষ্ট ভাস্যমান হলো। হাসিটা মিতালীর ভালো লাগলো। স্মিতি হাসলো সে। অংকুর হাওয়াই মিঠাই গুলো মিতালীর হাতে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘তোমার খুব প্রিয় হাওয়াই মিঠাই?’

মিতালী হাস্যউজ্জল চেহারায় তাকালো। অংকুরের হাত থেকে হাওয়াই মিঠাই দুটো হাতে নিয়ে বললো, ‘ভীষণ প্রিয়। এর চেয়ে সুস্বাদু আর কিছুই হতে পারে না।’

অংকুর প্রতিত্তুরে মৃদু হাসলো। বললো, ‘কিন্তু এটা দীর্ঘস্থায়ী নয়। তাই এটা আমি আমার পছন্দের তালিকায় রাখলাম না।’

মিতালী একটা হাওয়াই মিঠাইয়ের পেকেট খুলে একটুকরো ছিঁড়ে মুখে দিলো। অংকুরের কথায় ভ্রুঁ কুঁচকালো সে। পছন্দ না করার কারণ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কেন?’

অংকুর ঠোঁটে প্রছন্ন হাসি রেখে উত্তরে বললো, ‘যদিও তোমার হাওয়াই মিঠাই প্রিয়। আমার প্রিয় তুমি। কারণ তোমার প্রিয় হাওয়াই মিঠাই ঠোঁটের স্পর্শে ফুরিয়ে গেলেও তোমার স্পর্শে আমার বিষাদ ফুরিয়ে যায়৷’

চমক চোখে অংকুরের দিকে তাকালো মিতালী। অংকুর প্রস্ফুটিত চোখেমুখে। মৃদু হাসি ঠোঁটে। মিতালীর হাত থেকে হাওয়াই মিঠাই একটু ছিঁড়ে মুখে দিল। দৃষ্টি সরালো না মিতালী। বরঞ্চ অংকুরের কথায় লজ্জাভূতি হলো সে। চোখ ফিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। এই প্রগাঢ় নেত্রপল্লবের দিকে তাকিয়ে থাকার সাধ্য তার নেই।

হাওয়াই মিঠাই দীর্ঘস্থায়ী নয়। একটুকু বাতাসে গলে পরে যায়। এখুনি আছে তো আবার এখুনি নেই। অন্যত্র প্রিয় মানুষটার সংস্পর্শে আসলে মনের যতোসব গ্লানিবোধ, বিষন্নতা এক নিমিষেই কেটে যায়। তাই পছন্দের তালিকায় সর্বদা প্রিয় মানুষটাই উর্ধ্বে।
.
বিকেলের শেষভাগ। হাওয়াই মিঠাই খাওয়া শেষ! দুইজন এতোক্ষণ ফুটপাতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলো। মিতালী হাত ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখলো। সাঁঝবেলায় শীতল হাওয়া। সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবি ডুবি অবস্থা।

‘সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আমি যাই। নাহলে আম্মু টেনশন করবে।’

‘এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে?’ অংকুরের নিস্প্রভ কন্ঠস্বর। যেন মিতালীর চলে যাওয়ার কথা শুনে বিষন্ন হলো তার উল্লাসিত মন। মলিনতা আসলো মুখশ্রীতে। সময় গুলো এতো নগণ্য কেন? ঘড়ির কাটা গুলো এতো দ্রুত অতিবাহিত হয় কেন? পুরো বিকেলটা একইসঙ্গে কাটানোর পরেও মনে হচ্ছে খুব কম সময় পাশাপাশি কাটিয়েছি। প্রসন্ন হয়নি মন। বরঞ্চ আরো, আরো বেশি সময় একসাথে থাকতে ইচ্ছে করছে। অংকুরের প্রতিত্তুর শুনে মৃদু হাসলো মিতালী। ঠোঁটে স্মিতি হাসি রেখে বললো, ‘এইটুকু সময় যথেষ্ট নয় কি?

‘তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তটা খুব দ্রুত চলে যায়। এইটুকু সময় আমার পুষাই না।’

অসাড় হলো মিতালী। নিবিড় চোখে তাকিয়ে রইলো অংকুরের চোখে। একটা ঘোরের মাঝে চলে গেলো সে। অংকুরের চোখ দুটো সাংঘাতিক। একটা মানুষকে ঘায়েল করে দেওয়ার মতো দুর্গম ক্ষমতা রাখে। মিতালীর ক্ষেত্রেও তাই হলো। মায়াবী আঁখি যুগল থেকে চোখ ফিরানোর সাধ্য হলো না তার। অংকুরের দৃষ্টির গভীরত্বে ডুবে গেলো। মনে পরলো গানের একটা লাইন। ‘ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়।’ লাইনটা যথার্থতা আজ ধরতে পারলো সে।

মিতালীর দিকে দু-পা এগিয়ে আসলো অংকুর। চোখে চোখ রেখে বললো,

‘আজ সকালটা কেটেছে নিরবতায়। দুপুরটা ছিলো ক্লান্তিজনক। আর দিনের শেষ সময়টা ছিলো মনোরম। প্রিয় মানুষটার সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও দামি। মুহূর্তগুলো ক্ষণস্থায়ী হলেও স্মৃতিগুলো সর্বদা চিরস্থায়ী।’

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে স্মিতি হাসলো মিতালী। প্রতিত্তুর করলো না। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। কিয়ৎক্ষণ পর আজানের ধ্বনিতে মুখরিত হবে পরিবেশ। রাস্তাঘাটে যানবাহন ও মানবজাতিতে পরিপূর্ণ। কোলাহলে ভরপুর একদম। মিতালী এক হাতের ইশারায় একটা রিকশা কাছে ডাকলো। তারপর সেটাতে উঠে বসলো। অংকুর বললো, ‘বাসায় গিয়ে ম্যাসেজ দিও।’

‘কেন কল দিতে পারবো না?’

মজার ছলে মিতালী কথার পিঠে কথা ছুঁড়লো। নিঃশব্দে হেসে উঠলো অংকুর। প্রাণবন্তর এই হাসি। নেই কোনো বিষাদ, নেই কোনো প্রকার জড়তা। ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো, ‘ তোমার মোবাইলে তো ব্যালেন্স ট্যালেন্স থাকে না। আজ অব্ধি কোনো কল আমার মোবাইলে আসে নি। তাই ম্যাসেজ দিতে বললাম।’

ভ্রুঁ কুঁচকালো মিতালী। বললো, ‘ব্যালেন্স থাকে না মানে?’

‘ব্যালেন্স থাকলে তো কল দিতে। কিন্তু তুমি কখনো কল দাও নি। তারমানে ব্যালেন্স নেই। অবশ্য সব মেয়েদের মোবাইলেই ব্যালেন্স থাকে না।’ গা ছাড়া ভাবে বললো অংকুর। দাঁত কেলিয়ে হাসলো।

‘আরেহ্ বাহ্। মেয়েদের খবরাখবর নিয়ে পিএইসডি করে রেখেছেন মনে হচ্ছে।’

এবার একটু জুড়েই হেসে ফেললো অংকুর। বাঁকা উজ্জ্বল দাঁতটা ভেসে উঠলো। হাসির মাঝেই চোখ গেলো রাস্তার অপর পাশে ফুলের দোকানে। মিতালীকে চোখের ইশারায় থাকতে বলে বিলম্ব করলো না। দ্রুত পা চালিয়ে রাস্তার অপর পাশের ফুলের দোকানে গিয়ে লাল গোলাপ ফুল হাতে নিলো। ফুলটার দিকে তাকিয়ে প্রাপ্তির হাসি দিলো একটা।
.

‘মামা আপনার রিকশার চাকা কোন কোম্পানির?’

একটা অল্পবয়সী যুবক রিকশা চালকের উদ্দেশ্যে বললো কথাটি। মিতালী এক দৃষ্টিতে রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অংকুরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ছেলেটির কথা শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। মূলত মিতালী যেই রিকশায় বসে ছিলো সেই রিকশা চালক-কেই বলেছে কথাটি। তিনি বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো, ‘ক্যান? কোম্পানির নাম জাইনা কি করবা?’

দাঁত কেলিয়ে বিদ্রোপ হাসি দিলো ছেলেটি। বলে উঠলো, ‘যাত্রী তো উঠাইছেন একজন মাশাআল্লাহ। টায়ার তো পাঞ্চার হয়ে যাবে।’

বলেই হাসতে লাগলো সে। যথেষ্ট অপমানিত বোধ করলো মিতালী। রাস্তায় অপরিচিত একটা পুরুষ মানুষের কাছ থেকে নিজের নামে এমন কূটক্তি শুনে বেশ লজ্জা পেলো সে। এই মুহূর্তে দুনিয়া থেকে সরে যেতে ইচ্ছে করল তার।

রিকশাচালক ছিলো অর্ধ-বৃদ্ধ। মন তার স্বচ্ছ। ক্ষেপে গেলেন ছেলেটার কথায়। কপাট রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘এমনে কইতাছো ক্যান? শরম করে না? অন্য মাইয়াদের নিজের বোইনের মতো দেখবা। বাপ মা শিক্ষা দেয় নাই বেদ্দপ পোলাপাইন।’

বাপ-মা উচ্চারণ করায় ছেলেটা রেগে গেলো প্রচন্ড। ঘাড় ত্যাড়ার মতো বুক ফুলিয়ে রিকশাচালকের দিকে তেড়ে আসতে নিলো। তখুনি পিছন থেকে ঘাড়ে কারোর হেচকা টান খেলো ছেলেটি। আজ্ঞত মানুষটাকে দেখার আগেই মুখ বরাবর একটা ঘু:ষি পরলো। মুহূর্তেই নাক দিয়ে তরতর করে তরতাজা রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগলো। আকর্স্মিক ঘটনায় মিতালী প্রচন্ড বিস্মিত হলো। চোখ বড়বড় করে মুখে এক হাত রেখে অংকুরের দিকে তাকালো।

রাগে শরির মৃদু কাঁপছে অংকুরের। সম্পূর্ণ কথায় তার কর্ণপাত হয়েছে। গোলাপ ফুল কিনে মাত্রই এসেছিলো সে। ছেলেটির বলা শেষের কথাটা শুনেছে। শুনেছে রিকশাচালকের প্রতিত্তুর। তাৎক্ষনাৎ দাঁতে দাঁত লেগে এলো তার। যখন ছেলেটির চেহারা দেখে চিনতে পেলো তখুনি আর রাগ সামলাতে পারলো না। এগিয়ে এসে ছেলেটির কলারে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়েই নাক বরাবর ঘু:ষি মারলো একটা। এখন আবারো এগিয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পরে থাকা ছেলেটির কলারটি ধরে উঠালো। তারপর গালে থাপ্পড় দিতে দিতে বললো, ‘শা:লা তোর সাহস বেশি বেড়ে গেছে? কাকে কি বলছিস তুই? বলেছিলাম না তোকে যেন আর না দেখি? এখানে কি তোর?’

আশিক এখানে অংকুরকে দেখতে পাবে কল্পনাতেও ভাবে নি। তাকে দেখেই চোখ চড়কগাছের ন্যায়। কিছুদিন পূর্বে খেলার মাঠে অংকুরের সাথে বেয়াদবি করেছিলো সে। যার ধরন তাকে মাঠেই কয়েকটা চড় খেতে হয়ে ছিলো। আর আজ! কিন্তু এখন মার খাওয়ার সঠিক কারণ ধরতে পারলো না। শুকনো ঢুক গিললো আশিক। অংকুরের এলোপাথাড়ি থাপ্পড় খেতে খেতে গাল দুটো ভোতা হয়ে এসেছে প্রায়। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।

সূর্য পশ্চিম আকাশে ডুবে পরিবেশ অন্ধকার হলেও রাস্তা একদম আলোকিত। এমন ঘটনায় আশেপাশে মানুষের ভীড় জমে এলো। দুইজন লোক এসে অংকুর কে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মিতালী এখনো হতভম্ব হয়ে বসে আছে। অংকুরের এমন ভয়াবহ রূপ এই প্রথম নজরে আসলো তার।

আশিক নামের ছেলেটা আর সহ্য করতে পারলো না। আর্তনাদ করে উঠলো, ‘অংকুর ভাই। মা:রতেছেন কেন? আমি তো আপনারে কিছু করি নাই। হুদাই কেন মা:রতাছেন আমারে?’

চলমান..